০১. গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না
গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।
চাবি ঘুরালে ভররর জাতীয় ক্ষীণ শব্দ হচ্ছে। শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। হাসান লীনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল, কী করা যায় বল তো?
লীনা ঢোঁক গিলল। হাসানকে সে অসম্ভব ভয় পায়। অফিস বসকে ভয় পাওয়া দোষের কিছু না। ভয় লাগামছাড়া হওয়াটা দোষের। হাসান জিজ্ঞেস করেছে— কী করা যায় বল তো। নির্দোষ প্রশ্ন। স্মার্ট মেয়ে হিসেবে লীনার বলা উচিত ছিল— স্যার চলুন আমরা একটা ক্যাব নিয়ে চলে যাই। তা না বলে সে ঢোঁক গিলছে। ঢোঁক গেলার মত প্রশ্ন তো না। পি এ-র প্রধান দায়িত্ব বসের মেজাজের দিকে লক্ষ্য রাখা। তার সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা করা। তা না করে সে খাতাপত্র নিয়ে জড়ভরতের মতো বসে আছে।
হাসান বলল, লীনা কটা বাজে দেখ তো।
লীনা আবারো ঢোঁক গিলল। তার হাতে ঘড়ি নেই। সবদিন ঘড়ি থাকে, শুধু আজই নেই। ঘড়ি পরতে ভুলে গেছে। সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠেছে তখন তার মা দোতলার বারান্দায় এসে বলেছেন, লীনা তুই ঘড়ি ফেলে গেছিস। লীনা বলেছে, থাক লাগবে না। এটা না করে সে যদি রিকশা থেকে নেমে ঘড়িটা নিয়ে আসত। তাহলে সময় বলতে পারত।
হাসান বলল, তোমার ঘড়ি নেই?
না স্যার।
ঘড়ি কিনে নাও না কেন? ঘড়ি ছাড়া কি চলে। এই সময়ে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘড়ি দেখতে হয়। ঘড়ি তো এখন সস্তা। তিনশ চারশ টাকায় সুন্দর সুন্দর ঘড়ি পাওয়া যায়।
লীনা চুপ করে রইল। তার বলা উচিত ছিল, স্যার আমার ঘড়ি আছে। আজ তাড়াহুড়া করে অফিসে এসেছি বলে ঘড়ি আনতে ভুলে গেছি। এইসব কিছু না বলে সে মনে মনে ইয়া মুকাদ্দেমু, ইয়া মুকাদ্দেমু পড়ছে। বিপদে পড়লে আল্লাহর এই নাম জপলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।
তারা তো এখন বিপদেই পড়েছে। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি আটকে আছে। অন্য কোনো সময় হলে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তেমন বিপদজনক হত না। কয়েকজন টোকাই এনে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গ্যারাজে নিয়ে যাওয়া যেত। আজকের ঘটনা অন্য, ইয়াকুব সাহেবের অফিস থেকে বলা হয়েছে— পাঁচটা থেকে দুটার মধ্যে আসতে হবে। এই সময়ের মধ্যে এলেই স্যারের সঙ্গে দেখা হবে। ইয়াকুব সাহেবের কাছ থেকে বড় একটা কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা। কাজটা পাওয়া খুব দরকার। লীনাদের আফিসে গতমাসে হাফ-বেতন হয়েছে। এই মাসে হয়তো বেতনই হবে না। হাসান স্যারের দিকে তাকালে লীনার খুবই মায়া লাগে। মানুষটা চারদিক থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। গত তিনমাস অফিসের ভাড়া দেয়া হয়নি। ইলেকট্রিসিটি বিল দেয়া হয়নি। টেলিফোন বিল দেয়া হয়নি। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে লীনা প্রথম যে-কাজটা করে তা হল টেলিফোন রিসিভারটা তুলে কানে দেয়। ডায়েল-টোন আছে কি-না তার পরীক্ষা। ডায়াল-টোন থাকা মানে– অফিস এখনো বেঁচে আছে।
লীনা!
জ্বি স্যার।
কী করা যায় বল।
লীনা কী বলবে? তার মাথায় কিছুই আসছে না। তার এই ভেবে খারাপ লাগছে যে মানুষটাকে সে সাহায্য করতে পারছে না।
চল গাড়ি ফেলে রেখে বেবীটেক্সি নিয়ে চলে যাই।
এর উত্তরেও লীনা কিছু বলতে পারল না। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি ফেলে গেলে কী হয় কে জানে। গাড়ির মালিকদেরই এটা ভালো জানার কথা। লীনাদের গাড়ি নেই। তার কোনো আত্মীয়স্বজনদেরও গাড়ি নেই। লীনার ছোটমামী একবার একটা পুরনো ট্রাক কিনেছিলেন। কথা ছিল তিনি সবাইকে ট্রাকে নিয়ে সাভার যাবেন। সেষ্টা হয়নি। কারণ ট্রাক কেনার সাতদিনের মাথায় এক্সিডেন্ট করে সেই ট্রাক একটা মানুষ মেরে ফেলল। ছোটমামা ট্রাক বিক্রি করে দিলেন।
লীনা?
জি স্যার।
শেষ চেষ্টা করে দেখি। গাড়ি ঠেলতে হবে। পারবে না?
পারব স্যার।
তুমি একী পারবে না। আরো কয়েকজন জোগাড় কর।
লীনা লোক জোগাড় করার জন্যে ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়ে রিকশার ধাক্কা খেয়ে হাত কেটে ফেলল। টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু লীনা খুবই আনন্দিত যে এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা স্যার দেখেননি। তিনি গাড়ির বনেট খুলে কী যেন করছেন। স্যার ব্যাপারটা দেখলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। লীনা কাকে বলবে গাড়ি ঠেলতে? আর বলবেই বা কীভাবে? ভাই আমাদের গাড়িটা একটু ঠেলে দেবেন? কোন ধরনের লোকদের এই কথা বলা যায়? লীনা আবারো ইয়া মুকাদ্দেমু পড়তে লাগলো।
তারা মতিঝিলে পৌঁছল ছটা সতেরো মিনিটে।
সেক্রেটারি টাইপ এক লোক শুকনো মুখে বলল, আপনাদের তো পাঁচটার মধ্যে আসার কথা।
হাসান বলল, দেখতেই পাচ্ছেন, কথামতো আসতে পারিনি। স্যার কি আছেন না চলে গেছেন?
স্যার আছেন। তবে সময়ের পর স্যার কথা বলেন না।
কথা বলেন না কেন–গলায় কোনো প্রবলেম? কথা বলতে কষ্ট হয়? ফেরেনজাইটিস?
সেক্রেটারি রাগীচোখে তাকিয়ে আছে। লীনা অনেক কষ্টে হাসি চেপে আছে। বেশিক্ষণ হাসি চাপতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। অথচ এখন তার হাসির সময় না। কাজটা তারা পাচ্ছে না। সেক্রেটারি লীনার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন যদি তিনি লীনার হাসি দেখে ফেলে তাহলে খুব সমস্যা হবে। লীনা অফিসঘর দেখতে লাগল। কী সুন্দর সাজানো অফিস। সবকিছু ঝকঝক করছে। একেক জনের বসার জায়গা কাচ দিয়ে ঘেরা। প্রত্যেকের সামনে একটা করে কম্পিউটার এরকম একটা কাচের ঘর যদি লীনার থাকত।
হাসান তার পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, আপনাদের এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
সেক্রেটারি বলল, না। সিগারেট খেতে হলে বারান্দায় গিয়ে খেতে হবে।
আপনাদের বস ইয়াকুব সাহেব তো সিগারেট খান। তিনিও কি বারান্দায় গিয়ে খান?
আপনি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছেন কেন?
হাসান বলল, আমি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছি কারণ আমরা একই গোত্রের। উনি একটা কোম্পানির মালিক, আমিও একটা কোম্পানির মালিক। যত ছোট কোম্পানি, হোক না কেন আমি মালিক তো বটেই। দ্বিতীয় যুক্তি আরো কঠিন—— আমরা দুজনই হমোসেপিয়ান। মানবসম্প্রদায়ের সদস্য। এমন না যে উনি মানুষ আর আমি মানুষ।
লীনা হাসি চেপে রাখতে পারল না। তার এত আনন্দ লাগছে। স্যার মানুষটাকে যুক্তিতে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলেছেন। সেক্রেটারির চেহারাই এখন কেমন ছাগলের মতো হয়ে গেছে। লীনা মনে মনে বলল, তুই যদি আরো কিছুক্ষণ স্যারের সঙ্গে কথা বলিস তাহলে তোর চেহারা পুরোপরি ছাগলের মতো হয়ে যাবে। থুতনি দিয়ে ছাগলের মতো ফিনফিনে দাড়ি বের হয়ে যাবে রে হাঁদারাম।
হাসান সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে এসেছি এই খবরটা স্যারকে দিন। উনি যদি দেখা করতে না চান কোনো সমস্যা নেই, চলে যাব।
দেখা হবে না। টাইমের পর স্যার কারো সঙ্গে দেখা করেন না।
ভাই আপনার নাম কী?
নাজমুল করিম।
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, নাজমুল করিম সাহেব— আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি আমি যে দেরি করে হলেও এসেছি এই খবরটা স্যারের কাছে পৌছানো দরকার। আপনার হয়তো জানা নেই, উনি আমাকে জরুরী তলব দিয়েছেন। প্রয়োজনটা আমার চেয়ে উনার বেশি। কোনো একদিন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হল–আমি তাঁকে বললাম যে আমি এসেছিলাম, কিন্তু সামান্য দেরি হয়েছে বলে আপনি দেখা করতে দেন নি। সেটা কি ভালো হবে?
নাজমুল করিম তাকিয়ে আছে। সে সামান্য ধাঁধায় পড়েছে, কিন্তু আগের সিদ্ধান্ত বদলাবে এরকম মনে হচ্ছে না। হাসান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে বিদায়।
নাজমুল করিম বলল, বসুন কিছুক্ষণ। স্যার এখন চা খাচ্ছেন। চা খাওয়া শেষ হলে খবর দিয়ে দেখব। তবে লাভ হবে না। আমি এখানে পাঁচ বছর চাকরি করছি, কোনোদিন স্যারকে দেখিনি ছটার পর কারো সঙ্গে অফিসে কথা বলতে।
হাসান বলল, আমি বরং এই ফাঁকে সিগারেট টেনে আসি। আপনাদের বারান্দাটা কোন্ দিকে বলুন তো?
লীনা সবুজ রঙের সোফায় বসে আছে। তার খুবই টেনশান লাগছে। এখন যদি ইয়াকুব সাহেব বলেন— দেখা হবে না, তাহলে কী হবে? হাসান স্যার লজ্জা পাবেন। এই মানুষটা লজ্জা পাচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগছে। লীনার সামনে সুন্দর একটা চায়ের কাপ ভর্তি হালকা লিকারের রঙ-চা। নাজমুল করিম সাহেব এই চায়ের কাপ তার সামনে রেখেছেন। মানুষটাকে শুরুতে যত খারাপ মনে হচ্ছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। বরং ভালোমানুষ বলেই মনে হচ্ছে। লীনা চায়ের কাপে চুমুক দিল। সুন্দর গন্ধ। চিনিও দেয়া হয়েছে পরিমাণ মতো। লীনা নাজমুল করিমের দিকে তাকিয়ে বলল, চা-টা খুব ভালো।
নাজমুল করিম বলল, আমাদের বাগানের চা। আমরা মৌলভীবাজারে একটা চায়ের বাগান কিনেছি। ছোট বাগান। চারশ পঞ্চাশ একর।
এখন লীনার নাজমুল করিম মানুষটাকে অনেক বেশি ভালো লাগছে। সে বলেনি–স্যার একটা চা-বাগান কিনেছেন, কিংবা আমাদের কোম্পানি একটা চা-বাগাল কিনেছে। সে বলছে আমরা একটা চা-বাগান কিনেছি। আমরা বলাটাই খুব কঠিন। মালিকের সম্পদ নিয়ে কেউ অহংকার করছে। শুনতে ভালো লাগে।
নাজমুল করিমের টেবিলের উপর রাখা ইন্টারকম বেজে উঠল। লীনার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়েছে এক্ষুনি জানা যাবে যে ইয়াকুব সাহেব তাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। কারণ তারা একঘণ্টারও বেশি দেরি করে এসেছে। ইয়াকুব সাহেবের মতো মানুষদের কাছে প্রতি সেকেন্ডেরও অনেক দাম। সেখানে এক ঘণ্টা দশ মিনিট–ইমপসিবল। লীনা চায়ের কাপ রেখে দিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার ডান পায়ে টনটনে ব্যথা। যে কোনো টেনশানে ইদানীং তার এই সমস্যা হচ্ছে। পা ব্যথা করছে। কোনো একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে ভাল হত। টেনশানে মানুষের বুক ব্যথা করে। কিন্তু পা ব্যথা তো করে না। তার বেলায় সবকিছু এমন উল্টা কেন?
নাজমুল করিম ইন্টারকমের রিসিভার রেখে লীনার কাছে এগিয়ে এসে বললেন— স্যার আপনাদের ডাকছেন।
ইয়াকুব সাহেবের কামরাটা পুরোটাই কাঠের। মেঝে, দেয়াল, মাথার উপরের ফলস সিলিং সবই কাঠ। ঘরে ঢোকেই প্রথম কথা যা মনে আসে তা হল—বাহ্ সুন্দর তো। তারপর আসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিক দেখার প্রশ্ন। লীনা কোনো কিছুই খুঁটিয়ে দেখছে না। সে তাকিয়ে আছে ইয়াকুব নামের মানুষটার দিকে। সে মনে মনে ভাবছে ইয়াকুব নামের এই মানুষটার সঙ্গে তার যদি হঠাৎ কোথাও দেখা হত তাহলে কি সে বুঝতে পারত— ইনি অসম্ভব বিত্তবান একজন মানুষ।
কাঠের বড় গোলটেবিলের পেছনে ছোট্ট চেয়ারে বৃদ্ধ একজন মানুষ জবুথবু হয়ে পা গুটিয়ে বসে আছে। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। মাথা কামানোর পর চুল গজালে যেমন দেখায় তেমন দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের মনে হয় শাদা রঙের প্রতি দুর্বলতা আছে। তার পরনের পায়জামা পাঞ্জাবি শাদা, গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছেন, চাদরটাও শাদা। ভদ্রলোকের গায়ের রঙও অতিরিক্ত শাদা। গোল মুখ। তীক্ষ্ণ চোখ–জ্বলজ্বল করছে। লীনার যে ব্যাপারটা ভালো লাগল–তা হচ্ছে দ্রলোক খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইয়াকুব সাহেবের মতো মানুষরা যে অবস্থানে আছেন সেই অবস্থান থেকে কেউ অন্যদের দিকে এত আগ্রহ করে তাকায় না। আগ্রহ করে তাকানোকে বিত্তবানরা দূর্বলতা মনে করে।
তোমার নাম হাসান? কেমন আছ?
হাসান বলল, ভালো।
ইয়াকুব সাহেব লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে! তোমার নাম কী?
লীনা বলল, স্যার আমার নাম লীনা।
তুমি কেমন আছ?
ভালো আছি।
ইয়াকুব সাহেব হঠাৎ খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রয়ার খুললেন। মনে হচ্ছে জরুরি কোনো কিছু তার হঠাৎ মনে পড়েছে। জরুরী ব্যাপারটা শেষ করে কথা শুরু করবেন। ইয়াকুব সাহেব ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ বের করতে করতে বললেন, তোমাদের সঙ্গে মোবাইল টেলিফোন নেই তো। যদি থাকে অফ করে রাখো। আমার জটিল কোনো সমস্যা হয়েছে, মোবাইল টেলিফোনের রিঙের শব্দে চট করে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। নরম্যাল টেলিফোনে হয় না। আমার ধারণা সমস্যাটা মানসিক।
লীনা বলল, স্যার আমাদের সঙ্গে মোবাইল টেলিফোন নেই।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, নেই কেন? তোমাদের এতবড় ফার্ম।
হাসান বলল, স্যার আমাদের ফার্ম বড় না, খুব ছোট।
ইয়াকুব সাহেব হাসানের দিকে ঘুরে বসে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন— কত ছোট? তোমাদের অফিসে লোক কত জন?
হাসান বলল, সব মিলিয়ে চারজন ছিল। একজনের চাকরি চলে গেছে— এখন তিনজন। আমি লীনা এবং একজন অফিস পিওন।
কার চাকরি চলে গেল?
হাদিউজ্জামান বলে একজন ছিল—ম্যানেজার।
চাকরি কেন গেল? টাকাপয়সার হিসেবে গণ্ডগোল করেছে?
অনেকটা সেরকমই।
তিনজনে অফিস চালাতে পারছ?
জি পারছি। আমরা যখন কাজ পাই, তখন লোক ভাড়া করি।
তোমরা কি আমার বাগানের চা খেয়েছ?
লীনা বলল, জ্বি স্যার।
চায়ে গন্ধ কেমন?
সুন্দর গন্ধ।
ইয়াকুব সাহেব আবারো টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। লীনার কাছে মনে হল তিনি একটা ঘড়ি বের করেছেন। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। কিংবা একটু পর পর ড্রয়ার খোলা হয়ত তাঁর অভ্যাস। বড় মানুষদের অনেক বিচিত্র অভ্যাস থাকে।
ইয়াকুব সাহেব লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমার হাতে যে জিনিসটা দেখছ এর নাম স্টপওয়াচ। আমি তোমাকে এক মিনিট সময় দিলাম। এই এক মিনিটের ভেতর তুমি আমার বাগানের চায়ের একটা নাম দেবে। আমি বাগানের চা মার্কেটিং করব। চায়ের নাম খুঁজছি। তুমি মনে করো না যে তোমাকেই শুধু নাম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। যারা আমার বাগানের চা খেয়েছে তাদের প্রায় সবাইকেই এই প্রশ্ন করেছি। এক মিনিট সময় দিয়েছি। তাদের সবার নামই
লেখা আছে। যার নাম শেষপর্যন্ত ঠিক করা হবে তার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।
লীনা ভীত গলায় বলল, আমার মাথায় কোনো নাম আসছে না স্যার।
ইয়াকুব সাহেব প্যাডের একটা কাগজ ছিড়ে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন— এই কাগজে তোমার নাম ঠিকানা লেখ। এখন আমি স্টপওয়াচ চালু করছি। তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? তুমি তো পরীক্ষা দিতে বস নি। টপটপ করে ঘাম পড়ছে। আশ্চর্য তো!
লীনার হাত পা কাঁপছে। কী কাণ্ড! হঠাৎ সে এমন ঝামেলায় পড়বে কে জানত। চায়ের নাম কিছু-একটা তো লিখতে হবে। সে কী লিখবে। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটা নামই ঘুরছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইএর নাম সঞ্চয়িতা। সে নিশ্চয়ই চায়ের নাম সঞ্চয়িতা রাখতে পারে না। টিভিতে এড় যাবে সঞ্চয়িতা চা খান। এ ধরনের কোনো নাম কাগজে লিখলে ইয়াকুব নামের মানুষটা বিরক্ত হবেন। তিনি হয়তো ভাববেন লীনা তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। অথচ সে ঠাট্টা করছে না। সে কারো সঙ্গেই ঠাট্টা করতে পারে না। আশ্চর্য আল্লাহ তাকে এমন গাধার মতো মগজ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কেন? সঞ্চয়িতা ছাড়া আর কোনো নাম কেন তার মাথায় আসছে না?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, সময় শেষ। নামটা কাগজে লিখে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দাও। এসো এখন কাজের কথা শুরু করা যাক।
ইয়াকুব সাহেব আবারো ড্রয়ারে হাত দিলেন। ড্রয়ার থেকে খুব সুন্দর কাজ করা কাঠের বাক্স বের করলেন। বাক্স খুলে সিগারেট বের করে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাক্স হাসানের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, সিগারেটের নিকোটিনে শরীর অভ্যস্ত থাকলে সিগারেট ধরাও। জটিল আলোচনার সময় নিকোটিনের সাপ্লাইয়ের তোমার প্রয়োজন হতেও পারে। বয়সজনিত কারণে আমাকে সমীহ করার কোনো কারণ নেই।
হাসান সিগারেট ধরাল। ইয়াকুব সাহেব চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, আমি তোমার একটা কাজ দেখেছি।
হাসান বলল, কোন কাজটা দেখেছেন?
জুমলা সাহেবের বাগানবাড়ির সামনে তুমি একটা ওয়াটার-বড়ি তৈরি করেছ। সেখানে একটা পরীর মূর্তি আছে। মূর্তিটা পানিতে ডুবে আছে, শুধু তার চোখ দেখা যাচ্ছে। আমি এই কাজটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
হাসান বলল, থ্যাংক য়্যু স্যার।
তুমি ঐ কাজটা শেষ করনি কেন?
জুমলা সাহবের সঙ্গে আমার মতের মিল হল না। উনি বললেন, মূর্তি যদি পানিতে ডুবেই থাকে তাহলে এতটাকা খরচ করে মূর্তি বানানো হল কেন?
আমি ওয়াটার-বড়িতে জলপদ্মের ব্যবস্থা করেছিলাম, উনি চাইলেন বিদেশী বড় বড় পাতার কী যেন গাছ। আমি বললাম, কাজ করব না। উনি আমার সব পেমেন্ট আটকে দিলেন।
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনাদের মতো বড়মানুষদের সঙ্গে কাজ করার একটা প্রধান সমস্যা হল–আপনাদের অর্থ আছে, কিন্তু রুচি নেই। আপনারা নিজের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, কিন্তু যাকে কাজ দিচ্ছেন তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ধারণা তোমার রুচি খুব উন্নত?
হাসান বলল, আমার কল্পনার ক্ষমতা ভালো। বিত্তবান মানুষরা কল্পনা করতে পারেন না। তারা বাস্তব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে কল্পনা করার সময় পান না। কল্পনা না করতে করতে কল্পনা করার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। তারা যখন কোন পরী কল্পনা করেন তখন আকাশে পরী উড়ছে এই কল্পনাই করেন। একটা পরীযে পানিতে ডুব দিয়েও থাকতে পারে এই কল্পনা করতে পারেন না।
তোমার কথা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে যে আমার কল্পনা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
হাসান কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, পরে কোনো এক সময় এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব। আজ কাজের কথা বলি।
জ্বি বলুন।
আমার একটি মাত্র মেয়ে। সে তার কন্যা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকে— ভার্জিনিয়াতে। আমার মেয়ের নাম শামা। শামার কন্যাটির নাম এলেন। এলেনের বয়স পাঁচ আগামী জুন মাসের ৯ তারিখে এলেনের বয়স হবে ছয় বছর।
হাসানের মনে হল— ইয়াকুব সাহেব বৃদ্ধবয়সজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বৃদ্ধ বয়সে লোকজন কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের অবচেতন মনের কোনো অংশ হয়তো সিগন্যাল পাঠায় সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে— যা কথা বলার তাড়াতাড়ি বলে নাও। বৃদ্ধ তার মেয়ে এবং নাতনীর যে ইতিহাস শুরু করেছে তার সঙ্গে হাসানের কাজের সম্পর্ক কী?
হাসান।
জ্বি স্যার।
জয়দেবপুরের শালবনে আমার দুশ বিঘার মতো জমি আছে। একটা কেমিকেল ইনডাস্ট্রি করার জন্যে জায়গাটা নিয়েছিলাম পরে আর ইন্ডাস্ট্রি করা হয়নি। জায়গাটা পতিত পরে আছে। আমি সেখানে একটা পার্কের মতো করতে চাই— শিশু পার্ক।
পার্কে কী থাকবে?
কী থাকবে সেটা তুমি ঠিক করবে। তোমার রুচি আছে, কল্পনাশক্তি আছে। আমার যেহেতু টাকাপয়সা আছে, তোমার লজিক অনুসারেই রুচি এবং কল্পনাশক্তি থাকার কথা না। আমি তোমার রুচি এবং তোমার কল্পনার উপর ভরসা করছি।
হাসান ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার কথায় রাগ করবেন না। আপনি পার্ক নিয়ে কী ভাবছেন আমার জানা দরকার।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি কিছুই ভাবছি না। আমি শুধু ভাবছি ছনম্বর জন্মদিন এলেন ঐ পার্কে করবে এবং সে মুগ্ধ হয়ে ভাববে— এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে আছে! সে যেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে মা আমি এখানেই থাকব। আমি স্টেটস-এ ফিরে যাব না। আমি আমার নিম্নমানের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি— সে নিজের মনে ছোটাছুটি করতে করছে— যাই দেখছে সে বিস্মিত হচ্ছে। সে ছুটে গেল জঙ্গলে সেখানে বিশাল সাইজের ডায়নোসর। এমনভাবে বানানো হয়েছে। যেন ডায়নোসরগুলি কংক্রিটের না, জীবন্তু। বুঝতে পারছ?
জ্বি পারছি।
এলেন মুগ্ধ হয়ে ছুটছে, হঠাৎ দেখল– রূপকথার জগৎ। রূপকথার রাজারানীদের প্রাসাদের মতো প্রাসাদ। এক জায়গায় দেখল— ডাইনীদের আস্তানা। ডাইনীরা বড় ডেগচিতে কী যেন রান্না বসিয়েছে। খুব সম্ভব নরমাংস।
একটা লেক থাকবে। লেকের পানি তুবে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। লেক ভর্তি রঙিন মাছের ঝাঁক। লেকের উপর নৌকা থাকবে। ও আচ্ছা, নকল জলপ্রপাত থাকবে। একটা সুড়ং থাকতে পারে। সুড়ংঙের ভেতর দিয়ে এলেন যখন হাঁটবে, যে নানান বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে দেখতে এগুবে। সুড়ং যেখানে শেষ হবে সেখানে তার জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিস্ময়টা কী আমি জানি না। জানতেও চাই না। হাসান, এতবড় দায়িত্ব এককভাবে নেবার মতো সাহস কি তোমার আছে?
হাসান বলল, আছে। আপনার বাজেট কত?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার কত দরকার?
হাসান বলল, কত দরকার আমি বুঝতে আপ্রছি না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি তোমার বানানো পানিতে ডুবে থাকা পরী দেখেছি। তুমি যদি সাহস করে বলো আমি পারব। তাহলে তুমি পারবে। বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
হাসান বলল, কাজ শুরুর সময় সবাই এরকম বলে— বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কাজ কিছুদূর আগাবার পরই বাজেট সমস্যা শুরু হয়।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, শখের কাজে কখনো বাজেট সমস্যা হয় না। শখের বাজেট সব সময় থাকে।
হাসান বলল, শখের একটা সমস্যাও আছে স্যার। শখ বেশিদিন থাকে। আপনি কিছু বোঝার আগেই দেখবেন শখ চলে গেছে।
ইয়াকুব সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, হাসান শোনো। প্রতিটি মানুষই আলাদা। সেই হিসেবে একেক জন মানুষের শখের স্থায়িত্ব একেক রকম।
স্যার আপনি পুরো কাজটা করতে চাচ্ছেন— এলেন নামের পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে মুগ্ধ করার জন্যে। ধরুন কোনো কারণে মেয়েটি বলল—— সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারছে না, পরে কোনো এক সময় আসবে তখনো কি আপনার শখ থাকবে?
এলেন আসবে। কারণ আমি তাকে দেখতে চেয়েছি। আমি অসুস্থ আমি একজন ডাইং পেসেন্ট। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন খুব বেশি হলে আমি দুবছর বাঁচব। এই অবস্থায় এলেন আসবে না তা হয় না। তারপরেও যদি না আসে কোনো ক্ষতি নেই। আমার মুখের কথার দাম অনেক বেশি। আমার সঙ্গে তোমার সেরকম পরিচয় নেই বলেই তুমি দ্বিধায় ভুগছু। ঠিকমত বলো তুমি কি কাজটা করতে পারবে?
পারব— যদি মানি সাম্পাই ঠিক থাকে আমি পারব। কিছুদূর কাজ করার পর টাকার জন্যে হাতগুটিয়ে বসে থাকতে হলে আমি পারব না।
জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে— পারবে?
পারব।
প্রশ্নটা আবার করছি : জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে। পারবে?
পারব।
ভালো। হাত বাড়াও আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক কর।
হাসান বলল, আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার আগে আমার কিছু কথা আছে স্যার।
বলো।
আমি কাজটা আমার মতো করব। সেখানে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। আপনি বলতে পারবেন না–এই ডায়নোসরটা এরকম কেন? সাইজে ছোট কেন? কিংবা এই ডায়নোসরটার মুখ বাকা কেন?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি এলেনের সঙ্গে জুন মাসের নয় তারিখেই প্রথম পার্কে যাব।
আমি কোথায় কী করছি এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করব না।
আলাপের প্রয়োজন দেখছি না।
আপনি আমার কোম্পানির নামে প্রথম চেক আগামীকাল ব্যাংকে জমা দেবেন। চেকে কত টাকার অংক বসানো আছে সেটা দেখে আমি বুঝতে পারব আপনি আমার কাছে কি চাচ্ছেন। কাজ শুরু হবে আগামীকাল থেকে। এই টাকা যখন শেষ হবে তখন আপনাকে বলব— আপনি আরেকটা চেক দেবেন।
তোমার রেমুনারেশন কী হবে?
জুন মাসের নয় তারিখে পার্ক যেদিন খোলা হবে সেদিন আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমাকে রেমুনারেশন দেবেন। ইচ্ছা না করলে দিতে হবে না।
তোমার কোম্পানির নাম, যে ব্যাংকে তোমার একাউন্ট আছে তার নাম এবং একাউন্ট নাম্বারটা পরিষ্কার করে এই কাগজে লিখে দাও।
হাসান লিখল। লিখতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল তার হাত কাঁপছে— বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। মনে হচ্ছে অতিরিক্ত উত্তেজনায় জ্বর এসে যাচ্ছে। ইয়াকুব সাহেব বললেন, এখন কি আমরা হেন্ডশেক করতে পারি?
হাসান হাত বাড়িয়ে দিল।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমরা ওয়েটিংরুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি আমার ক্যাশিয়ারকে বলছি চেক রেড়ি করতে চেক সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমি এক কোটি টাকায় একটা চেক লিখছি।
লীনার কাছে মনে হল— ভূমিকম্প হচ্ছে, ঘরবাড়ি দুলছে। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি সামলাতে চোখের পানি সামলানো মনে হয় কঠিন হবে। কোনো একটা বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলে কেমন হয়? এদের এত সুন্দর অফিস। বাথরুমগুলিও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে।
টেবিলের উপর পেপার ওয়েটে চাপা দেয়া কাগজে লীনা চায়ের যে নামটা লিখে রেখেছে তার জন্যেও ভয় ভয় লাগছে। বিশ্রী একটা নাম দেয়ার কারণে ইয়াকুব সাহেব তাদেরকে হয়ত রাগ করে কাজই দেবেন না। কায়দা করে কাগজটা সরিয়ে ফেললে হয় না?
লীনা চায়ের নাম লিখেছে ইয়া-চা। মাথায় শেষ মুহূর্তে ইয়াকুব সাহেবের নামটা এসেছে। ইয়াকুব সাহেবের নামের সঙ্গে মিলিয়ে–ইয়া চা। ছি! কি ছেলেমানুষী!
০২. লীনার মা সুলতানা
লীনার মা সুলতানা সন্ধ্যা সাতটা থেকে বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছেন। মেয়ে অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করছে কেন? এত দেরি তো কখনো হয় না। ঢাকা শহরের অবস্থা ভালো না! ছেলেরাই সন্ধ্যার পর বের হয় না, সেখানে লীনা একটা মেয়ে। বাইশ বছর বয়েসী বাচ্চামেয়ে।
টেনশানে সুলতানার মাথা ধরে গেছে। এখন সামান্য ধরেছে। লীনা আসতে যত দেরি করকে মাথাধরা ততই বাড়তে থাকবে। একসময় ব্যাথাটা মাইগ্রেনে চলে যাবে। তখন দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় ছটফট করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তার মাইগ্রেন জগৎবিখ্যাত। একবার ব্যথা উঠলে তিন-চারদিন থাকে।
সুলতানার ছোটমেয়ে বীনা বারান্দায় এসে মার পাশে দাঁড়ায়। হাসিমুখে বলল, মা তুমি একবার ঘরে যাচ্ছ একবার বারান্দায় আসছ— এই করে মোট একুশ বার ঘর-বারান্দা করে ফেলেছে। আমি বসে বসে শুনলাম।
সুলতানা বললেন, তাতে তোর কী সমস্যা?
বীনা বলল, বিরক্তি লাগছে মা। একই জিনিস কেউ দুবার করলেই আমার বিরক্তি লাগে, তুমি একুশ বার করছ,— বিরক্তি লাগবে না? তারচে একটা কাজ কর— আমি মোড়া এনে দিচ্ছি, তুমি বারান্দায় বসে থাকো।
সুলতানা বললেন, চুলায় গরম পানি দিয়ে রাখ। লীনা এসেই গরম পানিতে গোসল করে। পানিটা রেডি থাকুক।
আপাকে আসতে দাও মা। আগেই গরম পানি কীজন্যে? এমনওতো হতে পারে আপা আসবেই না।
সুলতানা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আসবে না মানে?
বীনা বলল, ঠাট্টা করলাম মা।
আর কখনো এরকম ঠাট্টা করবি না।
আচ্ছা যাও করব না। একটা বেবিটেক্সি এসে থেমেছে মা। আপার মতো দেখতে একটা মেয়ে নামছে। এই দেখ তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু হাতটা নাড়োতো মা।
সুলতানার মাথাধরা দূর হয়েছে। তাঁর এই আনন্দ লাগছে যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অথচ এত অনিন্দিত হবার কিছু নেই। মেয়ে তো ঘরে ফিরবেই। চাকরি করে যে মেয়ে সে দু-একদিন দেরি করে ফিরবে এটাও তো স্বাভাবিক।
লীনা ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। সুলতানা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। মুখে হাসি এসে যাচ্ছে। ধুপধাপ শব্দটা তাঁর আনন্দ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা সব কাজে এত শান্ত, শুধু সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় দৌড়ে উঠবে। কোনো একদিন পা পিছলে একটা ঘটনা না ঘটায়। মেয়েটাকে ধমক দিতে হবে। আজ না অন্য কোনোদিন।
লীনা ঘরে ঢুকেই বলল, রান্না কী মা?
সুলতানা বললেন, সিমের বিচি দিয়ে শিং মাছ, করলা ভাজি, ডাল। ঘরে বেগুন আছে তুই চাইলে বেগুন ভেজে দেব।
লীনা বলল, সব রান্না নর্দমায় ফেলে দাও তো মা। সব ফেলে দিয়ে হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে ফেল।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আজ বাইরে থেকে খাবার আসবে। স্যার খাবার পাঠাবেন।
সুলতানা বললেন, খাবার পাঠাবেন কেন?
লীনা বলল, আজ আমরা বিরাট এক কাজ পেয়েছি মা। এই উপলক্ষে খাবার আসবে। খুবই রোমাঞ্চকর ঘটনা। গোসল করে এসে তোমাকে বলব। গোসলের পানি কি গরম আছে মা?
সুলতানা লজ্জিত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। তাঁর মেয়েটা অফিস থেকে এসেই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে চায়। এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তার পরেও পানিটা গরম থাকে না। এই দোষটা তার। সুলতানা মনে মনে ঠিক করে ফেললেন— এই ভুল আর হবে না।
লীনা বাথরুমে গোসল করছে।
বাথরুমের দরজা অর্ধেক খোলা। দরজার ওপাশে মোড়া পেতে বীনা বসে আছে। গোসল করতে করতে বীনার সঙ্গে গল্প করা লীনার অনেকদিনের পুরানো অভ্যাস। গল্পগুজবের এই অংশে সুলতানা থাকেন না। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন তাকে দেখলেই দুই মেয়ে গল্প থামিয়ে দেয়। এতে তিনি খুবই মনে কষ্ট পান। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের ব্যক্তিগত গল্প থাকতেই পারে। যে গল্প মাকে শোনানো যায় না। সুলতানার মন তীতে শান্ত হয় না। দুই বোনের গল্পের এই অংশে তিনি মন খারাপ করে রান্নাঘরে বসে থাকেন।
বীনা বলল, তোমাদের কোম্পানি বড় একটা কাজ পেয়েছে তাতে তুমি এত খুশি কেন? তুমি তো মাসের শেষে বেতনটাই শুধু পাবে। বাড়তি কিছু তো পাবে না।
লীনা বলল, আমাদের কোম্পানি কাজ পেয়েছে এইজন্যেই আমি খুশি। আমাদের অবস্থা যে কী খারাপ যাচ্ছিল। স্যার শুকনোমুখে অফিসে বসে থাকতেন। কী যে মায়া লাগত।
তোমার তো আপা মায়া বেশি। মায়ার বস্তা নিয়ে ঘুরবে না। একসময় বিপদে পড়ে যাবে। তোমার জন্যে একটা আনন্দ-সংবাদ আছে আপা।
কী আনন্দ সংবাদ।
ফিরোজ ভাই রাতে খেতে আসবে। কাজেই গোসলের পর ভালো একটা শাড়ি পরো আপা। যে শাড়ি তুমি পরবে বলে এনেছ, এই শাড়ি পরলে তোমাকে কাজের বুয়ার বোন বলে মনে হবে।
লীনা লজ্জিত গলায় বলল, মনে হলে মনে হবে। ও আসবে বলে ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে বসে থাকতে হবে না-কি?
বীনা বলল, ফিরোজ ভাই তোমাকে যে শাড়িটা দিয়েছে ঐটা পরো। ফিরোজ ভাই খুশি হবে।
লীনা বলল, তোর কি ধারণা ও কী শাড়ি দিয়েছে মনে করে বসে আছে? এইসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শাড়ি দিয়েছে কি-না এটাও তার মনে নেই।
বীনা বলল, মনে না থাকলে তুমি মনে করিয়ে দেবে। কায়দা করে একসময় বলবে –তুমি যে শাড়িটা দিয়েছিলে ঐটা পরেছি। আপা শাড়িটা নিয়ে আসি?
নিয়ে আয়।
তোমার স্যার আজ কী খাবার পাঠাবে?
জানি না কী পাঠাবেন। ভালো কিছু অবশ্যই পাঠাবেন। উনার নজর খুব উঁচু।
বীনা গম্ভীরগলায় বলল, আপা তুমি তোমার স্যারের যে-কোনো প্রসঙ্গ উঠলেই বেশ গদগদ ভাব কর। এটা আমাদের সামনে কর খুব ভালো কথা। ফিরোজ ভাই-এর সামনে কখনো করবে না। ছেলেরা এইসব জিনিস নিতে পারে না।
লীনা বলল, তোকে জ্ঞান দিতে হবে না।
বীনা বলল, এখন তোমাকে একটা দামী উপদেশ দেব। উপদেশটা শুনলে তোমার ভালো হবে।
কী উপদেশ?
দেরি না করে ফিরোজ ভাইকে বিয়ে করে ফেল। ব্যাপারটা অনেক দিন থেকে ঝুলছে। আর ঝােলা ঠিক হবে না।
লীনা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। এই নিশ্বাস তৃপ্তি এবং আনন্দের। তার ছোটবোনটা উপদেশ দিতে ভালোবাসে। উপদেশ দেবার এই স্বভাব সে পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবা উপদেশ দিতে খুব পছন্দ করতেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে উপদেশ দিতে চাইলেন আমার দুই মেয়ে কোথায়? তোমরা আমার কয়েকটা কথা শোনো। উপদেশ ভাবলে উপদেশ, আদেশ ভাবলে আদেশ। এই বলেই তিনি মাথা চুলকাতে লাগলেন। লীনার ধারণা কোনো উপদেশ তার মনে আসছিল না।
যত দিন যাচ্ছে, বীনা বাবার ফটোকপি হয়ে যাচ্ছে।
হাসান বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। মিস্তিরীকে গাড়ি দেখিয়ে ফিরতে দেরি হল। তার ইচ্ছা ছিল গোলাপ কিনবে। পান্থপথের সিগন্যালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। ফুল বিক্রি করা মেয়েরা ছুটে আসে। শস্তায় খুব ফুল পাওয়া যায়। দুশ টাকার ফুলে গাড়ির পেছনের সিট ভর্তি হয়ে যাবার কথা। বেছে বেছে আজই কোনো সিগন্যাল পড়ল না। হাসান একটানে চলে এল। গ্যারাজে গাড়ি রেখে কলিংবেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। হাসানের স্ত্রী নাজমা মনে হয় দরজা ধরেই দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হাসান ভেবে পেল না নাজমা এত রেগে আছে কেন? রাগের কোনো কারণ কি সে ঘটিয়েছে? নাজমার কোনো আত্মীয়ার বিয়েতে তাদের দুজনের যাবার কথা ছিল–সে ভুলে গেছে। নাজমার বাবা বেলায়েত হোসেন চিটাগাং খাকেন, তিনি খুবই অসুস্থ। তার কি কোনো খারাপ খবর এসেছে?
নাজমা বলল, কটা বাজে জানো?
হাসান হাসিমুখে বলল, জানি না। সঙ্গে ঘড়ি নেই। ঘড়ি ফেলে গেছি।
অনুমান করতে পার কটা বাজে? সাড়ে নয়, কিংবা দশ।
হাসান শার্ট খোলার জন্যে বোতামে হাত দিয়েছে। নাজমা বলল, শার্ট খুলবে না।
হাসান বলল, ব্যাপার কী?
ব্যাপার কি তুমি জানো না?
হাসান তার মুখের হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সে তার স্ত্রীকে ভালো একটা খবর দেবে। তার জন্যে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নাজমা রাগে গনগন করছে এই অবস্থায় তাকে বিশাল কাজ পাবার আনন্দময় খবর দেয়া যায় না।
হাসান বলল, ঘটনাটা কী বল তো?
অফিসে যাবার সময় তুমি দেখে যাওনি অন্তুর একশ দুই জ্বর।
জ্বর বেড়েছে না-কি?
তুমি বলে গিয়েছিলে– বিকেলে এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। বলেছ কি বলনি?
ভুলে গেছি। জরুরি একটা কাজ ছিল।
দেখে গেলে ছেলে জ্বরে ছটফট করছে তারপরেও ভুলে গেলে?
এখন জ্বর কত?
একশ চার পর্যন্ত জ্বর উঠেছিল, এখন একশ দুই।
তাহলে তো মনে হয় কমা শুরু করেছে।
কমা শুরু করেছে কি করেনি এই ডাক্তারি কথা আমি তোমার কাছে শুনতে চাচ্ছি না। এক্ষুনি অন্তুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও।
এত রাতে ডাক্তার পাব? নটার দিকে তো ডাক্তাররা ক্লিনিক বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়।
বাড়ি চলে গেলে তুমি ডাক্তারের বাড়িতে যাবে।
আচ্ছা যাচ্ছি।
আমি তোমার অফিসে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম পাওনি?
আমি বিকেলে অফিসে ছিলাম না।
তুমি যে অফিসে ছিলে না। সেই খবর আমাকে অফিস থেকে দেয়া হয়েছে। তুমি তোমার পি. এ-কে নিয়ে বের হয়েছ তিনটার সময়। এতক্ষণ কি তার সঙ্গেই ছিলে? সারাক্ষণ গায়ে মেয়েমানুষের বাতাস না লাগালে ভালো লাগে না?
হাসান কিছু বলল না। অন্তু ঘুমুচ্ছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই চাদর পেঁচিয়ে তাকে গাড়িতে নিয়ে তুলতেই সে চোখ মেলে হাসানকে দেখে হেসে ফেলে বলল বাবা। তার গা-ভর্তি জ্বর, চোখ লাল, ঠোঁট ফুলে গেছে–ঠোঁটের কোনায় হাসি চিকমিক করছে। অন্তুর বয়স আট, বয়সের তুলনায় সে খুবই গম্ভীর। শুধু বাবা আশেপাশে থাকলে তার গাম্ভীর্য থাকে না।
জ্বর বাধিয়েছিস নাকি রে ব্যাটা?
হুঁ।
খুব ভালো করেছিস।
অন্তু আগ্রহ নিয়ে বলল, খুব ভালো করেছি কেন বাবা?
অন্তু জানে তার বাবা উল্টাপাল্টা কথা বলে, কথা শুনলে মনে হয় ভুল কথা। আসলে ভুল না। বাবা যখন বলেছে জ্বর হয়ে ভালো হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। ভালোটা কী তা সে বুঝতে পারছে না।
হাসান গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, জ্বর বাঁধিয়ে ভালো করেছিস, কারণ জ্বর হবার কারণে সবাই তোকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ পানি ঢালছে, কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, স্কুলে যেতে হচ্ছে না।
আমার স্কুল ভালো লাগে না বাবা।
আমারো লাগে না। আমার ক্ষমতা থাকলে সব স্কুল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম।
অন্তু আনন্দে হেসে ফেলল। সে আগেও লক্ষ্য করেছে একমাত্র বাবাই তার মনের কথাগুলি জানে। আর কেউ জানে না। অন্তু বলল, বাবা তুমি সুপারম্যান হলে ভালো হত।
কীরকম ভালো?
সুপারম্যানদের পাওয়ার থাকে। পাওয়ার দিয়ে তারা সব জ্বালিয়ে দিতে পারে। টিভিতে দেখেছি।
কোন্ চ্যানেলে?
কার্টুন চ্যানেলে।
আমি সুপারম্যান হলে তুই কী হতি? সুপারম্যানের ছানা?
ধ্যাৎ সুপারম্যানদের কোনো ছানা থাকে না। বাবা আমার নাক দিয়ে সর্দি পড়ছে। গাড়িতে টিসু আছে?
টিসু ফিসু নেই। শার্টের কোনায় সর্দি মুছে ফেল।
মা বকবে।
মা জানলে তবেই না বকবে। নাকে সর্দি হয় কেন বাবা?
নাকটা হল নদীর মতো। বর্ষার সময় নদীতে যেমন পানি আসে, নাকে সেইভাবে সর্দি আসে। নাকে সর্দি আসিলে বুঝতে হবে শরীরে বর্ষা নেমেছে।
ধ্যাৎ, বাবা তুমি মিথুক হয়ে যাচ্ছ।
তা একটু একটু হচ্ছি। অন্তু, ডাক্তারের কাছে না গেলে কেমন হয়?
অন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলল, খুব ভালো হয় বাবা।
হাসান বলল, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেয়ে চল দুজন খানিকক্ষণ রাস্তায় ঘুরি। আইসক্রিমের দোকান থেকে দুটা কোন-আইসক্রিম কিনে খাই।
বাবা আমি চকলেট ফ্লেভার খাব। তুমি কোন্টা খাবে?
হাসান বলল, আমি খাব ভ্যানিলা। তবে তোর চকলেট-কোনে একটা কামড় দেব।
ছোট করে কামড় দিও বাবা।
আমার মুখের যে সাইজ আমি সেই সাইজেই কামড় দেব। এরচে ছোট করে কামড় দেব কীভাবে? আমার মুখ কি তোর মতো ছোট?
অন্তু বলল, বাবা আমি কি তোমার ভ্যানিলা আইসক্রিম কোনে একটা কামড় দিতে পারি?
হাসান বলল, না। আমি সবকিছু শেয়ার করতে রাজি আছি। আইসক্রিম শেয়ার করতে রাজি না।
অন্তু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বাবা যা বলছে তা হল অন্তুর একেবারে মনের কথা। অন্তুও বাবার মত আইসক্রিম শেয়ার করতে পারে না। অন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না— পৃথিবীতে শুধুমাত্র বাবা কী করে তার মনের কথাগুলি বুঝে ফেলে, আর কেউ তো বুঝতে পারে না।
বাবা।
কি রে ব্যাটা?
শরীর খারাপ লাগছে বাবা।
মাথা যন্ত্রণা করছে?
হুঁ।
দেখি মাথাটা আমার কাছে নিয়ে আয়ত। জ্বর দেখি।
অন্তু মাথা এগিয়ে দিল। হাসান জ্বর দেখল। অনেক জ্বর। একজন ডাক্তার আসলেই দেখানো দরকার। হাসপাতালগুলি সারারাত খোলা থাকার কথা। শিশু-হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেমন হয়। শিশু হাসপাতাল কোনদিকে তাও তো মনে পড়ছে না।
অন্তু বলল, বাসায় যাব বাবা।
হাসান বলল, তোর জ্বর বেড়েছে রে ব্যাটা। একজন ডাক্তার দেখিয়ে তারপর চল বাড়ি যাই। কোনটা আগে করব? ডাক্তার না আইসক্রিম?
আইসক্রিম খাব মা বাবা। আমাকে কোলে নাও।
গাড়ি চালাতে চালাতে কোলে নেব কীভাবে? তুই বরং এক কাজ কর। আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাক্।
ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে হাসানের পৌনে বারোটা বেজে গেল। ডাক্তার কোনো ওষুধ দেয়নি। প্রথমদিনের জ্বরে কিছু বোঝা যায় না। জ্বর কমানোর জন্যে সাপোজিটরি দিয়েছে। প্রচুর তরল খাবার খেতে বলেছে।
হাসান ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। সিগারেট খাবে, দেয়াশলাই নেই। রান্নাঘর থেকে দেয়াশলাই নিতে হবে।
নাজমা বলল, খবরদার এখন সিগারেট খাবে না। হাতমুখ ধুয়ে আসো, ভাত খাবে। রাত বারোটা পর্যন্ত আমি খাবার নিয়ে বসে থাকতে পারব না।
খাবারের কথায় হাসানের মনে পড়ল— লীনার বাসায় তার খাবার পাঠানোর কথা। ওরা সবাই নিশ্চয়ই না-খেয়ে অপেক্ষা করছে। খুবই ভুল হয়েছে। এত রাতে খাবারের কোনো দোকান কি খোলা আছে? পুরনো ঢাকার কিছু রেস্টুরেন্ট সারারাত খোলা থাকে। ওদের মোঘলাই খাবার খেতে ভালো।
নাজমা বলল, কী হল দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চিন্তা করছ?
হাসান বলল, আমাকে এখন একটু বের হতে হবে।
কোথায়?
হাসান চুপ করে আছে। সে অন্য এক বাসার জন্যে খাবার কিনতে যাবে, এটা বলা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। কী বলা যায় হাসানের মাথায় আসছে না।
কী হল, কোথায় যাবে?
জরুরি কাজ আছে—একজনকে খবর দিতে হবে।
পরিষ্কার করে বল তো। ঝেড়ে কাশো।
ঝেড়ে কাশার কিছু নেই। আমার খুবই জরুরি কাজ।
নাজমা শান্ত গলায় বলল, রাতে ফিরবে?
হাসান বলল, রাতে ফিরব মানে? রাতে কোথায় থাকব?
রাত বারোটার সময় জরুরি কাজে যাচ্ছ। দুটার সময় ফেরার চেয়ে না ফেরা ভাল না?
তুমি শুধু শুধু রাগ করছ নাজমা।
আমি মোটেই রাগ করছি না। আমি একটা সুন্দর সাজেশান দিলাম। আচ্ছা শোননা তোমার জন্যে একটা ভালো খবর আছে। ভালো খবরটা। এখন শুনবে নাকি রাত দুটার সময় যখন বাসায় ফিরবে তখন শুনবে?
ভালো খবরটা কী?
নীতুরও জ্বর এসেছে। একশ দুই।
এটা ভালো খবর ইল কীভাবে?
আমাদের অসুখবিসুখ হলে তুমি তো মনে হয় আনন্দিতই হও, এইজন্যে বলছি ভালো খবর।
হাসান সিগারেট ধরাল। খুব ক্লান্তি লাগছে। তারপরেও সে গাড়ি নিয়ে বের হল। গাড়ির তেল একেবারে শূন্যের কোঠায়। কোনো পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিতে হবে।
ফিরোজ ঘড়ি দেখে বলল, লীনা বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমার তো মনে হয় না খাবার আসবে। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে দাও। খিদে লেগেছে।
লীনা রান্নাঘরে গেল। সুলতানা বুদ্ধি করে ভাত চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বেগুন ভাজতে বসলেন। বেসনে বেগুন ডুবিয়ে ভাজা। বেগুন বিসকিটের মতো শক্ত থাকে। ফিরোজ খুব পছন্দ করে।
সুলতানা লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই এমন মুখ কালো করে আছিস কেন? খাবার আসেনি এই অপরাধ তো তোর না। উনি ভুলে গেছেন।
লীনা বলল, স্যার ভুলে যাবার মানুষ না। খাবার ঠিকই আসবে। সবাই যখন খেতে বসবে তখন আসবে।
সুলতানা বললেন, খেতে খেতে খাবার যদি চলে আসে তাহলে তো ভালোই। তুই রান্নাঘরে বসে আছিস কেন— যা ফিরোজের সঙ্গে গল্প কর।
আমার গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ধরেছে।
বেশি মাথা ধরেছে?
হুঁ।
তুই অতিরিক্ত টেনশান করিস। তোর হয়েছে আমার মতো স্বভাব টেনশান করা।
লীনা বলল, মা আমার একটা ব্যাপার নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। আমার ধারণা স্যার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন–গাড়ি আবার নষ্ট হয়েছে। স্যারকে
আমি বলব— এবার যেন অবশ্যি উনি একটা নতুন গাড়ি কেনেন।
বলিস।
ভাঙ্গা একটা গাড়ির মধ্যে উনি কী যে পেয়েছেন কে জানে।
ফিরোজ বীনার সঙ্গে ভূতের গল্প শুরু করেছে। বীনার খুবই বিরক্তি লাগছে। তারপরেও ভাব করছে যেন আগ্রহ নিয়ে শুনছে। সিক্স-সেভেনে পড়া মেয়েদের কাছে এই গল্প ভালো লাগতে পারে। বীনা এবছর অনার্স ফাইন্যাল দেবে। তার সাবজেক্ট ফিজিক্স। ফিজিক্সের একজন ছাত্রীর কাছে ভূতের গল্প করাটাও তো ক্রাইম।
বুঝলে বীনা, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম প্ল্যানচেট করব। তবে নরম্যাল যে প্ল্যানচেট করা হয়–সেরকম না। একটু অন্যরকম। হিন্দুয়ানি মতে মৃত আত্মাকে আহ্বান করা। এটাকে প্ল্যানচেট বলে না বলে চক্র। গোল করে হাতের উপর হাত রেখে বসতে হয়। মানুষ লাগে বেজোড় সংখ্যক। একজনের বাঁ হাতের উপর অন্যজনের ডান হাত থাকে। সবাইকে পাক পবিত্র হয়ে বসতে হয়। শুদ্ধ মনে আত্মাকে আহ্বান করতে হয়।
বীনা বলল, ফিরোজ ভাই, খাবার দেয়া হয়েছে। খেয়ে তারপর গল্পটা শেষ করুন।
ফিরোজ বলল, খেয়ে গল্প করা যাবে না। বারোটা বাজে। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।
তাহলে গল্পটা অন্য আরেকদিনের জন্যে ভালো থাকুক।
তুমি কি গল্পটায় ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না?
খুবই ইন্টারেস্ট পাচ্ছি। আসুন খেতে আসুন। খেতে খেতে গল্প করুন। আপাও শুনবে। আপা আবার ভূতের গল্প খুবই পছন্দ করে।
সে কোথায়?
আপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপার এখনো ধারণা— তার স্যার খাবার পাঠাবে।
ফিরোজ বিরক্ত গলায় বলল, পাঠালে পাঠাবে। তার জন্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি! লীনার চরিত্রের মধ্যে বাড়াবাড়ির ব্যাপার আছে। বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।
বীনা বলল, খেতে আসুন ফিরোজ ভাই। আরেকটা কথা আপার কোনো বদনাম আমার সামনে করবেন না। এটা আমি খুবই অপছন্দ করি। আপার মতো ভালো মেয়ে এই পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না। আপার বদনাম শুনলে এইজন্যই ভালো লাগে না।
ফিরোজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বাড়াবাড়ির প্রবণতা তোমার মধ্যেও আছে।
বীনা বলল, থাকুক। সব মানুষ তো একরকম হয় না। আমরা দু বোন একটু আলাদা।
ফিরোজ বলল, আমার কেন জানি খিদে মরে গেছে। খাবার সময় পার হয়ে গেলে আমি খেতে পারি না। তোমরা খেয়ে নাও আমি বরং চলি। সাড়ে বারোটায় মেসের গেট বন্ধ করে। ডাকাডাকি করে দারোয়ান ডাকতে হয়। মেসের ম্যানেজার বিরক্ত হয়।
আপনি খাবেন না?
খেতে চাচ্ছি না।
ফিরোজ ভাই আপনি অকারণে রাগ দেখাচ্ছেন। রাগ দেখাবার মতো কিছু হয়নি। আপনি না-খেলে আপা খুব কষ্ট পাবে। মা কষ্ট পাবে। আমার কিছু যাবে আসবে না। আমি সহজে কষ্ট পাই না।
ফিরোজ খেতে বসল। ফিরোজের সঙ্গে খেতে বসল বীনা। লীনা খাবে। তার হঠাৎ মাথাধরা এমন বেড়েছে যে সে মাথা তুলতে পারছে না। সে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে।
রাত একটার মতো বাজে।
সুলতানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন এবং নিচুগলায় গল্প করছেন। লীনা যখন ছোট ছিল তখন সে কী করত— সেই গল্প। লীনা চুপ করে আছে। সে মার কথা শুনে যাচ্ছে। নিজ থেকে একটা কথাও বলছে না। সুলতানা একসময় বললেন, কাজটা তুই ভুল করেছিস মা।
লীনা বলল, কী ভুল করলাম?
ফিরোজ তোকে এতবার খেতে ডাকল, তুই খেতে এলি না। বেচারা একা একা খেয়েছে।
একা তো খায় নি। বীনা সঙ্গে ছিল।
বীনার থাকা আর তোর থাকা কি এক হল?
আমার মাথা ধরেছিল মা। আমি মাথাই তুলতে পারছিলাম না।
ফিরোজ হয়তো ভেবেছে— তোর স্যার খাবার পাঠায়নি এই দুঃখে তুই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস।
ভাবলে ভেবেছে। আমার দুঃখ হওয়াই তো স্বাভাবিক।
কলিংবেল বাজছে। লীনা চমকে উঠল। কেউ কি এসেছে? স্যার আসেননি তো! লীনা ধড়মড় করে উঠে বসল। বীনা এসে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল।
সুলতানা বললেন, কে এসেছে রে?
বীনা বলল, আপার স্যার এসেছেন। একগাদা খাবার নিয়ে এসেছেন।
সুলতানা তীক্ষ্ণচোখে বড়মেয়ের দিকে তাকালেন। লীনা কাঁদছে। তার গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সুলতানার বুক ধ্বক করে উঠল। চোখে পানি আসার মতো কোনো ঘটনাতো ঘটে নি। মেয়ের চোখে পানি কেন?
০৩. হাসানের মাথায় ক্রিকেটারদের টুপি
হাসানের মাথায় ক্রিকেটারদের টুপির মতো শাদা টুপি। গায়ে হালকা নীল রঙের শার্ট। পরনে জিনসের তিনচার পকেটওয়ালা প্যান্ট। কিন্তু পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। গতকালই গর্তে পড়ে পায়ের গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। জুতা পরার কোনো উপায় নেই। সাইটে কাজ করার সময় তার পায়ে থাকে কাপড়ের জুতা। আগামী কয়েকদিন এই জুতা সে পরতে পারবে তেমন সম্ভাবনা নেই। তার ডান পা ফুলে উঠেছে। এখন পা ফেললেই তার জন্যে সমস্যা।
সকাল দশটা।
হাসান আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চারপাশের অবস্থা দেখে সে মোটামুটি তৃপ্ত। তবে আরো অনেক কিছু করার বাকি। এক সপ্তাহে কাজ যতটুকু আগানোর কথা ততটুকু অবশ্যি আগায়নি। তিনটা টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ডীপ টিউবওয়েলের কাজ চলছে— এখনো শেষ হয়নি। দুটা বড় জেনারেটর চলে এসছে। ইলেকট্রিক লাইন টানার কাজ মোটামুটি শেষ।
ওয়ার্কারদের থাকার জন্যে চারটা লম্বা টিনের শেড করা হয়েছে। এই মুহূর্তে একশ আঠারোজন ওয়ার্কার কাজ করছে। এই সংখ্যা আরো বাড়বে। আরো দুটা টিনশেড বানাতে হবে। একেক ধরনের ওয়ার্কার একেকটা টিনশেডে থাকবে। মাটি কাটার মানুষরা একটিতে, রাজমিস্ত্রিরা আরেকটিতে, লোহার কারিগররা আরেকটিতে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি। অনেকগুলি দল।
সংখ্যায় বেশি হলেই কাজ ভালো হয় না— সংখ্যাটাকে কাজে লাগানোর জন্যেও একদল হুকুম দেবার লোক লাগে। হাসান এই শ্রেণীর লোকেরই অভাব অনুভব করছে। তবে সে অত্যন্ত আনন্দিত যে মজুকে পাওয়া গেছে। মজুর বয়স চল্লিশের মতো–কাকলাসের মতো চেহারা। চামড়া রোদে পুড়ে প্রায় ঝলসে গেছে। গলার স্বরে সমস্যা আছে। কথা বলে চি চি করে। তার খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তার সব কথা কেউ বুঝতে পারে না।
মজু যে-কোনো কাজ জানে। যে-কোনো সমস্যা বুদ্ধি খাটিয়ে করতে পারে। মজুকে যদি বলা হয়–মজু এই কাজটা করতে হবে। সম্পূর্ণ মাটির ঘর বাড়ি হবে— ঘরের ছাদও মাটির। বৃষ্টি পড়লে মাটির ছাদ গলে বাড়ি ধসে যাবে। একটা বুদ্ধি বের কর যেন ছাদ ধসে না যায়। মজু দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কাটতে কাটতে বলবে— আচ্ছা।
পারা যাবে না?
মজু অবশ্যই হা-সূচক মাথা নাড়বে। হাসানের ধারণা মজুর ঘাড়ে কোনো সমস্যা আছে বলে সে না-সূচক মাথা নাড়তে পারে না। শারীরিক সমস্যার কারণে হা-সূচক মাথা নাড়ে। যেহেতু হা-সূচক মাথা নেড়ে ফেলেছে সেহেতু কোনো-না-কোনো বুদ্ধি বের করে কাজটা করে ফেলে।
হাসানের মতে এরকম একটা লোক পাশে থাকা আর দশটা হাতি পাশে থাকা সমান। মঞ্জুর মতো আরেকজন আছে মোবারক। হাসান তাকে। ডাকে ফাঁকিবাজ মোবারক। তার প্রধান লক্ষ্য কীভাবে ফাঁকি দেবে। শুধু একা ফাঁকি দেবে না, তার পুরা দল নিয়ে ফাকি দেবে। ফাকি ধরা পড়লে মিষ্টি করে হাসবে, মাথা চুলকাবে। মোবারক মূলত রঙমিস্ত্রি, কিন্তু সেও মজুর মতো। সব জানে এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি। মোবারকের বুদ্ধি কানে লাগাতে হলে তার পেছনে সবসময় একজনকে লেগে থাকতে হয়, যার প্রধান কাজ মোবারক কোন্ দিক দিয়ে ফাঁকি দিচ্ছে সেটা বের করা।
ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাস-করা তিনজনকে হাসান তার প্রজেক্টে কাজ দিয়েছে। এদের বয়স অল্প নতুন চিন্তাভাবনায় এরা ভালো করবে। কার্যক্ষেত্রে সেরকম দেখা যাচ্ছে না। প্রজেক্টের ব্যাপার দেখে এরা মোটামুটি হকচকিয়ে গিয়েছে। তারা তিনজনই একসঙ্গে ঘোরে। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নিচুগলায় কথা বলে। খুবই আনাড়ি ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে খুকখুক করে ক্যশে। হাসানের ধারণা, চাকরি পাবার পর তারা সিগারেট ধরেছে। হাসানকে তারা তিনজনই কোনো কারণ ছাড়াই অসম্ভব ভয় পায়। হাসান তাদেরকে এখনো কোনো কাজ দেয়নি। বিরাট কর্মযজ্ঞে পড়ে তিন তরুণ ইনজিনিয়ারের শুকনা মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। তিনজন এখন গিটু পাকিয়ে আছে। গিঁট ফাড়িয়ে তিনজনকে তিনদিকে লাগিয়ে দিতে হবে। এমন কাজের চাপে ফেলতে হবে যেন তাদের দেখা হয় রাত দশটার পরে।
হাসান পা লেংচাতে লেংচাতে এগুচ্ছে। তাকে এগুতে দেখে দূর থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে লীনা উপস্থিত হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
হাসান বলল, কোথাও না। একটু হাঁটি।
আপনার পা ফুলে কী হয়েছে। এই অবস্থায় আপনি হাঁটছেন। পা তো আরো ফুলবে।
ফোলা পা-কে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আপনি যাচ্ছেন কোন দিকে? বিশেষ কোনো দিকে না, আমি পুরো জায়গাটায় একটা চক্কর দেব।
লীনা আতঙ্কিত গলায় বলল, পুরো জায়গাটা চক্কর দিতেতো স্যার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। স্যার, আপনি একটা ভ্যানগাড়িতে বসুন। ভ্যানগাড়ি আপনাকে টেনে নিয়ে যাক।
হাসান বলল, তুমি আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমি যত বেশিবার জায়গাটা ঘুরব ততবেশি জায়গাটা আমার মাথায় ঢুকবে। পরিকল্পনা করতে আমার তত সুবিধা হবে।
স্যার আমি আপনার সঙ্গে আসছি।
তোমাকে সঙ্গে আসতে হবে না। তোমার গেস্ট এসেছে। গেস্ট এন্টারটেইন কর। গেস্টদের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হল তোমার বোন। একই রকম চেহারা। আরেকজন কে?
লীনা লজ্জিত গলায় বলল, ফিরোজ ভাই।
হাসান বলল, ও আচ্ছা–ইনার সঙ্গেই তোমার এনগেজমেন্ট হয়েছে। বিয়ে কবে?
এখনো ঠিক হয়নি স্যার।
ফিরোজ সাহেব কী করেন?
একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেন।
তোমার গেস্টরা কি আজ থাকবেন, না চলে যাবেন?
চলে যাবেন।
তাদের রেখে দাও। থাকার তো অসুবিধা নেই। তোমার বোন তোমার সঙ্গে তাঁবুতে থাকতে পারে। ফিরোজ সাহেব থাকবেন গেস্টদের তাঁবুতে।
স্যার আমি বলে দেখব।
লীনা তুমি আরেকটা কাজ কর। তিনজন ইয়াং ইনজিনিয়ার আছে না? একসঙ্গে গিটু পাকিয়ে ঘুরছে। ঠিক একঘণ্টা পর এদের একজনকে আমার কাছে পাঠাবে। তার প্রথম এসাইনমেন্ট হচ্ছে আমাকে খুঁজে বের করা।
কোন্ জনকে পাঠাব স্যার?
যে-কোনো একজনকে পাঠালেই হবে। এক ঘণ্টা পরে পাঠাবে। এখন at
জ্বি আচ্ছা স্যার।
যাকে পাঠাবে তার বায়োডাটার কাগজটা একটা ইনভেলপে ভরে সিল করে তার হাতে দিয়ে দেবে। ইনভেলপে কী আছে তাকে বলবে না। শুধু বলবে ইনভেলপটা যেন আমার হাতে দেয়।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তুমি তোমার গেস্টদের কাছে যাও— আজ তোমার ছুটি।
লীনা ফিরোজ এবং বীনাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছে। লীনা যাচ্ছে আগে আগে। লীনার পেছনেই বীনা। তার পেছনে ফিরোজ। লীনা এমন ভঙ্গিতে হাঁটছে যেন পুরো অঞ্চলটা তার চেনা। যেন এটা তারই রাজত্ব। সে রাজত্ব দেখতে বের হয়েছে। অথচ জায়গাটা সে মোটেই চেনে না। পরশুদিনই সে একবার শালবনে হারিয়ে গিয়েছিল। শালবন থেকে কোন দিকে বের হবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। আজও সে শালবনের ভেতরই ঢুকেছে।
ফিরোজ বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
লীনা বলল, বালির পাহাড় দেখতে যাচ্ছি।
ফিরোজ বলল, বালির পাহাড় মানে?
লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, দু-শো ট্রাক বালি এনে ফেলা হয়েছে। মায়মেনসিং সেভ। মোটাদানার বালি। আরো দু-শো ট্রাক বালি আসবে। চারশো ট্রাক বালির দাম চার লাখ টাকা। এক হাজার টাকা করে ট্রাক।
বীনা বলল, বালির দাম কত তাও তোমার জানতে হয়?
লীনা বলল, বালির দাম কত জানতে হয় না। জানার ইচ্ছা হয়েছিল— ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।
ফিরোজ বলল, চারশো ট্রাক বালি দিয়ে কী হবে? মরুভূমি বানানো হবে নাকি?
লীনা বলল, ঠিক ধরেছ। নকল মরুভূমি বানানো হচ্ছে। আমাদের দশ একর প্লেন ল্যান্ড আছে। পুরোটা বালি দিয়ে ঢাকা হবে। ঠিক মাঝখানে মাটির কিছু উঁচু উঁচু ঘর তৈরি হবে। ঘরগুলি একটার গায়ে একটা লেগে আছে। অদ্ভুত ড্রিজইন। দেখলেই গা শিরশির করে। স্যারের ড্রয়িংবোর্ডে ডিজাইন আছে। তুমি দেখতে চাইলে ডিজাইন এনে দেখাব। আইডিয়াটা অদ্ভুত না? মরুভূমির মাঝখানে কিছু স্ট্রেঞ্জ লুকিং উচু উঁচু মাটির ঘর।
ফিরোজ বলল, লীনা তুমি কিছু মনে করো না–আমার কাছে নকল মরুভূমির ব্যাপারটা খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে।
লীনা বলল, হাস্যকর কেন?
ফিরোজ বলল, মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি যদি চারদিকে সবুজ গাছপালা দেখ, শালবন দেখ— তাহলে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যায় না? এমন এক মরুভূমি তৈরি হচ্ছে যার চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ি।
লীনা আহত গলায় বলল, স্যার হাস্যকর কাজ কখনো করবেন না। চারপাশের গাছপালা যেন দেখা না যায় সেরকম কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।
ফিরোজ বলল, ব্যবস্থা নেয়া হলে তো ভালোই। তুমি এমন রাগ করছ কেন?
স্যার সম্পর্কে কেউ হেলাফেলাভাবে কথা বললে আমার খুব রাগ লাগে।
কেন, রাগ লাগবে কেন? উনি কি মহাপুরুষ নাকি।
লীনা কঠিন গলায় বলল, উনি মহাপুরুষ না। উনি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ হয়েও উনি স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন।
ফিরোজ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তিনি কিন্তু নিজের স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন না। অন্যের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করেন। অন্যের ফরমায়েসি স্বপ্ন অন্যের অর্থে তৈরি করা।
লীনা দাঁড়িয়ে পড়ল। চাপা গলায় বলল, প্লিজ স্টপ ইট। বালির পাহাড় দেখতে হবে না। চলো ফিরে যাই।
ফিরোজ বলল, তুমি অকারণে রাগ করছ। রেগে আগুন হবার মতো কোনো কথা আমি বলিনি। কিছু সত্যিকথা বলেছি। চলল তোমার বালির পাহাড় দেখে আসি।
না দেখতে হবে না।
লীনা উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। বীনা এসে পাশে দাঁড়াল। বীনা চাপা গলায় বলল, তুমি এরকম ছেলেমানুষি করছ কেন আপা?
লীনা বলল, কী ছেলেমানুষি করলাম।
তুমি কাঁদছ। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। তুমি অবশ্যই চোখ মুছে আমাদের বালির পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে। আপা চোখ মোছো।
লীনা চোখ মুছল।
আপা, তুমি কি জানো যে তুমি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছ?
জানি না। মন খারাপ হয়েছে এইটুকু জানি।
মন খারাপটা এত ঘন ঘন না করে একটু কম করলে হয় না আপা।
আমার মধ্যে তোর মতো কোনো সুইচ নেই যে, মন খারাপের সুইচ অফ করে মন ভালো করার সুইচ অন করে দেব।
চোখ মোছে আপা। আবার তোমার চোখে পানি।
লীনা চোখ মুছল।
হাসান ঝিলের পাড়ে একা বসে আছে। জায়গাটা ঝিল না— নিচু জায়গা। প্রজেক্টে এই জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ঝিল। মাটি কেটে কৃত্রিম ঝিল বানানো হবে। মাটি কাটার লোকজন আছে– এখনো মাটিকাটা শুরু হয়নি। ঝিলের জন্যে জায়গাটা হাসানের পছন্দ হচ্ছে না। জায়গাটা নিচু বর্ষায় এমনিতেই পানি জমে থাকে। সুবিধা বলতে এইটুক। হাসানের মতে ঝিলটা শালবনের ভেতর দিয়ে যাবে। ঝিলের পানি হবে কাকচক্ষুর মতো টলটলে। পানি খুব গভীর হবে না, সূর্যের আলো যতটুকু যেতে পারে তটুকুই গভীর হবে।
স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হাসান পাশ ফিরল। তার পা ভালোই যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। সে পা নাড়িয়ে শুধু পাশ ফিরেছে। এতেই পা টনটন করছে।
লীনা আপা এই খামটা আপনাকে দিতে বললেন।
হাসান খাম হাতে নিল।
আপনার একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটাও আপা আপনাকে দিতে বলেছেন।
থ্যাংক য়্যু।
হাসান ব্যক্তিগত
লেখা খামটা চোখের সামনে ধৰ্বল। নাজমার চিঠি। ডাকে আসেনি–হাতে হাতে এসেছে। প্রতিদিনই একটা গাড়ি ঢাকা থেকে আসছে,
ঢাকায় যাচ্ছে। চিঠি আনা-নেয়া কোনো সমস্যা না। হাসানের মনে হল— অতি দ্রুত এমন কোনো ব্যবস্থা করা উচিত যেন সরাসরি চিঠি চলে আসে।
সেইসঙ্গে একজন পাস-করা ডাক্তারও দরকার। জরুরি কিছু ওষুধপত্র।
হাসান নাজমার চিঠি রেখে অন্য খামটা খুলল। নাজমুল আলম কোরেশির বায়োডাটা। হাসান লীনাকে বলেছিল যে-ছেলেটিকে পাঠাবে তার বায়োডাটা সঙ্গে দিয়ে দিতে। কীজন্যে বলেছিল, এখন মনে পড়ছে না। সে কি অতিরিক্ত চাপের মধ্যে আছে? আছে হয়তো।
নাজমুল আলম কোরেশি, তোমার ডাক নাম কী?
বাবুল।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, ঘাসের উপর বস। প্যান্ট অবশ্যি নোংরা হবে। তাতে কী?
নাজমুল বসল। হাসান তার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, সিগারেটে টান দিতে ইচ্ছা করলে টান দাও। আমাকে লজ্জা করার কিছু নেই। চাকরি কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে।
ভালো লাগার কী আছে? কোনো কাজ নেই। তিনবন্ধু একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ। চাকরি করতে এসেছ। ঘুরে বেড়াতে তো আসেনি।
কী করব বুঝতে পারছি না স্যার। কোনো দায়িত্ব যদি পাই চেষ্টা করতে পারি।
বিশেষ কোনো দায়িত্ব কি তুমি নিতে চাও?
আমি সেইভাবে চিন্তা করিনি স্যার।
নকল মরুভূমির মাঝখানে কিছু অদ্ভুত ধরনের ঘর তৈরি হচ্ছে–শুনেছ নিশ্চয়।
জ্বি।
তার ডিজাইন দেখেছ?
জ্বি না।
ডিজাইনটা আমার ড্রাফট-টেবিলে আছে। ডিজাইনটা খুব ভালোমতো দেখবে। ঘরে বিশেষ ধরনের লাইটিং হবে। দরজা জানালা দিয়ে গাঢ় হলুদ আলো আসবে। বালির উপর হলুদ আলো পড়ে বালি চিকচিক করবে। বিল্ডিঙের বাইরেও হলুদ আলো ফেলা হবে। লাইটের সোর্স এমন হবে যে সোর্স দেখা যাবে না। কেউ বুঝতেও পারবে না— আলো কোথেকে আসছে।
ডিজাইনে নিশ্চয়ই এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অবশ্যই রাখা হয়েছে। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে লাইটিঙের ব্যাপারটা দেখা। তোমার সঙ্গে একজন ডিপ্লোমা ইনজিনিয়ার থাকবে। রহিম নাম। খুবই এক্সপার্ট। তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারবে। সমস্যায় পড়লে মিজুর সাহায্য নেবে। মিজুকে চেনো?
জ্বি না।
খুঁজে বের করবে। তার সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্টা করবে। এই খাতিরটা কাজে লাগবে।
জ্বি আচ্ছা।
লাইটিং প্ল্যানে বড় একটা ভুল আছে। ভুলটা বের করে আমাকে বলবে। আমি দেখতে চাই তোমার বুদ্ধি কেমন! আচ্ছা এখন যাও।
নাজমুল চলে যাচ্ছে। খুব উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ! মনে হয় ছেলেটা টিকে যাবে। হাসান সিগারেট ধরাল। ছোট্ট ভুল হয়েছে। ফ্লাস্কে করে চা আনা উচিত ছিল। চা খেতে ইচ্ছা করছে। হাসান নাজমার চিঠি খুলল। কী সুন্দর পরিষ্কার ঝকঝকে লেখা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
হাসান,
চিঠিতে কঠিন কঠিন কথা
লেখা আমার খুব অপছন্দ। কঠিন কথা সামনা সামনি হওয়া উচিত। যে মানুষটা দূরে আছে, চিঠি লিখে তাকে হার্ট করার কোনো অর্থ হয় না। তারপরেও বাধ্য হয়ে তোমাকে কঠিন চিঠি লিখছি।
অন্তু এবং নীতুর জ্বর তুমি দেখে এসেছ। সাধারণ জ্বর না, বাড়াবাড়ি ধরনের জ্বর। তারপরেও তুমি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে। কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করলে। একবার খোঁজ নিলে না, ওদের জুর কেমন। পনেরো দিনে একবারও তোমার
ঢাকায় আসার কথা মনে পড়ল না। জয়দেবপুর ঢাকা থেকে এমন কোনো দূরত্বে অবস্থান করছে না।
আমার ব্যাপারে তোমার আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে এটা আমি যেমন জানি তুমি তারচে অনেক ভালো করে জানো। তারপরেও বাচ্চাদের প্রতিও তুমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
Workaholic কথাটার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কাজ নিয়ে নেশাগ্রস্ত মানুষ অবশ্যই আছে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনও কিন্তু কাজেরই অংশ। বারে তারিখে আমার জন্মদিন গিয়েছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এই দিনটা তোমার মনে থাকবে এবং
ঢাকায় এসে হৈ চৈ করে (মেকি হৈ চৈ) কাটাবে।
অঙ্কু এবং নীতুকেও বললাম– আজ তোমাদের বাবা আসবে। অন্তু এটা শুনেই বলল, সে আজ স্কুলে যাবে না। বাচ্চাদের স্কুল কামাই আমি খুবই অপছন্দ করি। তারপরেও বললাম আচ্ছা ঠিক আছে যেতে হবে না। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। তার একবারও টিভির কার্টুন চ্যানেল ছাড়ার কথা মনে হয় নি।
আমি বুঝতে পারছি অন্তুর অপেক্ষার কথা শুনে তোমার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। আবার এও বুঝতে পারছি চিঠি পড়ে পুত্রপ্রেমে পাগল হয়ে তুমি হা পুত্র হা পুত্র করতে করতে ছুটে আসবে না। তুমি তোমার মতো কাজ করবে।
বারো অরিখে আমি অন্তুর মতো বারান্দায় বসে না-থাকলেও অপেক্ষা করেছি। বুঝতে পারছি সূতায় প্রকল টান পড়েছে। একটা সুতাকে দুজন দুদিকে টানছি। যে-কোনো মুহূর্তে সূতা ছিড়বে। সূতা ছিড়লে ক্ষতি নেই, কিন্তু সূতা ধরে অন্তু এবং নীতু ঝুলছে। ওদের কী হবে কে জানে।
একটা সময় ছিল যখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি। তোমার সঙ্গে আমার সামানাই পরিচয়। আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। হুট করে এক দুপুরে তুমি উপস্থিত। আমার প্রাচীনপন্থী বাবা খুবই রেগে গেলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না অতি সামান্য পরিচয়ে কী করে একটা ছেলে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে একটি মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়। তোমাকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করা হল। তুমি নান্দাইল রোড স্টেশনে গিয়ে বসে রইলে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায়। দুপুরবেলা আমি এসে তোমাকে স্টেশন থেকে বাসায় নিয়ে গেলাম।
যাই হোক, তুমি তোমার স্বপ্নরাজ্য সাজাতে থাকে। অন্তু এবং নীতুর জ্বর সেরেছে। তারা ভালো আছে। তাদের নিয়ে টেনশান করার কিছু নেই। মানসিক দিক দিয়ে আমি ক্লান্তিবোধ করছি। ক্লান্তি কাটানোর জন্যে চিটাগাঙে মেজভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। সেখান থেকে টেকনাফে যাবার কথা। তোমার বাচ্চারা আসন্ন ভ্রমণের আনন্দে উল্লসিত। তুমি ভাল থেকো।…
হাসান উঠে দাঁড়াল। সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। রোদে মাথা চিড়বিড় করছে। পায়ের যন্ত্রণাও বাড়ছে। পা টেনে টেনে এতদূর আসাটা বোকামি হয়েছে। ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে চিল উড়ছে।
সব পাখি জোড়ায় জোড়ায় ওড়ে পক্ষীকুলে শুধুমাত্র চিলকেই নিঃসঙ্গ উড়তে দেখা যায়। নিঃসঙ্গতার আনন্দের সঙ্গে এই পাখিটির কি পরিচয় আছে?
উড়ন্ত চিল দেখার পরপরই হাসানের মাথায় পাখি বিষয়ক একটা চিন্তা এসেছে— মরুভূমির ঘরগুলিতে কবুতর থাকার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়। পোষ মানিয়ে শত শত কবুতর যদি রাখা যায়! যত অদ্ভুত, যত সুন্দরই ঘরগুলো হোক না কেন, ঘরের কোনো প্রাণ থাকে না–শত শত কবুতর যদি সেই ঘরগুলি ঘিরে ওড়াওড়ি করতে থাকে, তবেই ঘরগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।
বিকেল পাঁচটার সময় সাইট থেকে
ঢাকায় একটা গাড়ি যায়। তার পরের গাড়িটা ছাড়ে রাতের ডিনারের পর পর। দশটা-সাড়েদশটা বাজে। ফিরোজ বিকালের গাড়িতে যাবে বলে ঠিক করেছে। তার রাতে থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বীনাকে যেতেই হবে। পরীক্ষা সামনে, একটা মিনিট নষ্ট করার সময়ও তার নেই। তাছাড়া
ঢাকায় মা একা। একটা কাজের মেয়ে ছিল, সেও পাঁচ কেজি চালের একটা ব্যাগ এবং লীনার দুটা ব্যবহারী শাড়ি নিয়ে সরে পড়েছে। এখন বাড়িতে মা একা।
বীনা বলল, মা বাড়িতে একা–এটা কোনো সমস্যা না। একৗ থাকা তাকে অভ্যাস করতে হবে। আমরা দু-বোন বিয়ে করে চলে যাব, মাকে তখন তো একা থাকতেই হবে। মা নিশ্চয়ই প্ল্যান করছেন পুঁটলি-পাঁটলা নিয়ে জামাইএর বাড়িতে উঠবেন।
লীনা বলল, তুই এমন কঠিন কথা কীভাবে বলিস।
বীনা বলল, খুব সহজভাবে বলি। কথাগুলি মোটেই কঠিন না। কথাগুলি বাস্তব। বাস্তব আমাদের ভালো না লাগলেও স্বীকার করতে হবে।
ফিরোজ হাসতে হাসতে বলল, বাস্তবতা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি বিকেল পাঁচটায় চলে যাচ্ছ।
বীনা বলল, আপনার কি থাকার ইচ্ছা নাকি?
ফিরোজ বলল, জঙ্গলে কোনোদিন রাত কাটাইনি। জঙ্গলে রাত কাটাতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু তুমি
ঢাকায় গেলে আমি অবশই যাব। আমি তোমাকে একা ছেড়ে দেব না।
আমি কি কচি খুকি।
কচি খুকি হও বা বুড়ি নানী হও, আমি তোমাকে একা ছাড়ব না। আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি, সঙ্গে নিয়ে যাব।
তাহলে চলুন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি।
আমার ব্যাগ সব সময় গোছানোই থাকে। তুমি তোমার ব্যাগ গুছাও।
লীনা তাঁবুর ভেতরের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। ফিরোজ তার পাশে বসতে বসতে বলল, শরীর খারাপ নাকি?
লীনা বলল, না।
ফিরোজ বলল, আমরা চলে যাব। আমাদের হাসিমুখে বিদায় দাও। উঠে বোস। যাবার আগে তোমার হাতে এক কাপ চা খেয়ে যাই।
লীলা উঠে বসল। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, তোমরা থেকে যাও। স্যার থেকে যেতে বলেছেন।
ফিরোজ বলল, তোমার স্যার কী বলছেন বা না বলছেন তা তোমার কাছে যত গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার বলাটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বলছি থেকে যাও।
একটা বিশেষ কারণে আমার নিজ থেকেই থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল— তুমি না বললেও এটা আমার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। বীনা যেহেতু যাচ্ছে কাজেই আমাকে যেতেই হবে।
লীনা বলল, বিশেষ কারণটা কী?
ফিরোজ বলল, শালবনের দিকে চলো। হাঁটতে হাঁটতে বিশেষ কারণটা বলি। এখানে বলা যাবে না। বীনা যে-কোনো সময় এসে পড়বে।
লীমা বলল, আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। এখানেই বলো।
তুমি মনে হয় এখনো আমার উপর রেগে আছ। রাগটা একপাশে সরিয়ে আমার সঙ্গে চলো তো। প্লিজ। তোমার স্যার সম্পর্কে কঠিন কোন কথা বলে যদি তোমাকে হার্ট করে থাকি আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ক্ষমা প্রার্থনার কী হল?
কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নয়তো এত রাগ তুমি করবে না। লীনা শোনো, আমি সর্ব অর্থে একজন প্রতিভাশূন্য মানুষ। প্রতিভাধরদের এইজন্যে প্রচণ্ড হিংসা হয়। যা বলি হিংসা থেকে বলি। এটা আমার চরিত্রের প্রধান ত্রুটিগুলির একটি। এই ক্রটি তোমাকে ক্ষমা করতে হবে। চলো একটু হাঁটতে যাই। পাঁচটা বাজতে এখনো পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরি আছে। আমরা তার আগেই চলে আসব।
লীনা স্যান্ডেল পরল। তাঁবুর পেছনেই শালবন। তাদের বেশি হাঁটতে হল না। ফিরোজ বলল, বইপত্রে পড়েছি জঙ্গলের পুর্ণিমা অসাধারণ হয়। নেক্সট পূর্ণিমায় আমি চলে আসব।
লীনা বলল, চলে এসো।
ভরা পুর্ণিমায় হাত ধরাধরি করে তোমাকে নিয়ে বনে হাঁটব। আশাকরি তোমার স্যার রাগ করবেন না।
স্যারের কথা এখানে আসছে কেন? স্যার কেন রাগ করবেন?
তাঁর লয়েল কর্মচারী কোম্পানির স্বার্থ চিন্তা না করে অন্য একজন পুরুষমানুষের হাত ধরে হাঁটছে। রাগ করার কথা তো।
উনার সঙ্গে এইভাবে কথা বলবে না।
ঠাট্টা করছিলাম।
লীনা বলল, আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করবে না। আমি ঠাট্টা বুঝি না।
ফিরোজ বলল, আচ্ছা যাও ঠাট্টাও করব না। সবসময় সিরিয়াস কথা বলব।
ফিরোজ তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, তোমার জন্যে সামান্য একটা উপহার এনেছি।
কী উপহার?
একটা আংটি।
হঠাৎ আংটি দেবার দরকার পড়ল কেন?
কী আশ্চর্য, তোমাকে আমি একটা আংটি দিতে পারব না। তোমার আঙুলে হয় কি-না দেখ।
লীনা বলল, তুমি পরিয়ে দাও।
ফিরোজ হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। লীনা বলল, হাসছ কেন?
একটা বিশেষ ঠাট্টা করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ঠাট্টাটার কথা মনে করেই হাসি আসছে। ঠাট্টাটা করতে ইচ্ছা করছে— আমি আবার প্রমিজ করেছি ঠাট্টা করব না। শোনো লীনা— একটা শেষ ঠাট্টা করি। আর কোনোদিন করব না। প্রমিজ বাই ইওর নেম।
লীলা বলল, কর। ঠাট্টা কর। ঠাট্ট করা যার স্বভাব সে ঠাট্টা না করে থাকতে পারবে না।
ফিরোজ বলল, তুমি যখন আংটিটা আমার কাছে দিয়ে বললে তুমি পরিয়ে দাও তখন আমার বলতে ইচ্ছা করল–আমার পরিয়ে দেয়াটা শোভন হবে না। তুমি বরং আংটিটা তোমার স্যারের কাছে নিয়ে যাও। উনি মুরুব্বিমানুষ। উনি পরিয়ে দেবেন। হা হা হা।
লীনাও হেসে ফেলল। তার আঙুলে পরানো আংটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল— হীরের আংটি নাকি?
ফিরোজ বলল, হ্যাঁ হীরের আংটি। আমি খুবই দরিদ্র মানুষ। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। তারপরেও আমি ঠিক করে রেখেছিলাম এমন একটা আংটি তোমাকে আমি দেব যার গল্প তুমি কোনো-একদিন তোমার পুত্র-কন্যাদের করবে। তুমি তাদের বলবে–যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন তোমার বাবার খুবই খারাপ অবস্থা। একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সে চাকরি করত, সেই চাকরিও চলে গেছে। তারপরেও তোমার বাবা পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা হীরের আংটি কিনে দিয়েছিল।
লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আংটিটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা?
ফিরোজ বলল, না— ষোলো হাজার টাকা। গল্প করার সময় তুমি নিশ্চয়ই একটু বাড়িয়ে বলবে। বলবে না?
লীনা বলল, তোমার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিটা নিশ্চয়ই এখনো আছে।
হ্যাঁ আছে। তবে যাই যাই করছে।
যাই যাই করছে কেন?
বুঝতে পারছি না। আমি লক্ষ্য করেছি বা আমাকে পছন্দ করে না। নিশ্চয়ই আমার চরিত্রে এমন কিছু আছে যা মানুষকে বিরক্ত করে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, কিছুক্ষণ কথা বললেই একজন মানুষ অন্যজনকে পছন্দ করা শুরু করে। আমার বেলায় উল্টোটা ঘটে। কেউ আমার সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বললে সে আমাকে অপছন্দ করবে এটা নিশ্চিত। লীনা আংটিটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। খুব সুন্দর আংটি। এত দাম দিয়ে আংটি কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তোমার জন্যে হয়তো প্রয়োজন নেই। আমার জন্যে প্রয়োজন। তুমি ধরেই নিতে পার— এটাই হবে তোমাকে দেয়া আমার একমাত্র দামি উপহার। আমার পরের উপহারগুলি দু-শো আড়াইশো টাকা দামের শাড়িতে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ঢাকায় যাবার গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। বীনাকে দেখা যাচ্ছে ব্যাগ হাতে গাড়ির পাশে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফিরোজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল : দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি-বেলা দ্বিপ্রহর…।
রাত দশটা।
হাসান তার বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পায়ের ব্যথা তীব্র হয়েছে। ক্লোফেনাক ট্যাবলেট সে কিছুক্ষণ আগে খেয়েছে। ব্যথা তেমন কমেনি, তবে শরীর ঝিম ধরে আসছে। মনে হচ্ছে ব্যথা না কমলেও ঘুম চলে আসবে। তাঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে। রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল, হাসান ফেরত পাঠিয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে, কোনো খাবার মুখে দিতে ইচ্ছা করছে না।
লীনা তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল, স্যার আসি?
হাসান বলল, এসো।
লীনা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। সে রাত আটটা থেকেই ভাবছে স্যারকে দেখে আসবে। কেন জানি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। হাসান যখন রাতের খাবার ফেরত পাঠান তখন তার মনে হল— যাওয়া উচিত। একটা মানুষ ব্যথায় ছটফট করবে আর সে আরাম করে ঘুমাবে, এটা কেমন কথা।
স্যার ব্যথা কি খুব বেশি?
ব্যথা ভালোই আছে।
আদার রস মেশানো গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে ব্যথা কমবে।
হাসান উঠে বসতে বসতে বলল, এই চিকিৎসা কোথায় পেয়েছ?
আমার বাবাকে করতে দেখেছি। পা মচকে গেলে তিনি গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতেন।
এইসব লাগবে না। সকালে ডাক্তার আসবে। রাতটা পার করতে পারলেই হবে।
লীনা বলল, স্যার আমি আদা মিশিয়ে গরম পানি আনতে বলেছি।
পানি নিয়ে এলে তো পা ডুবাতেই হবে। তোমার অতিথিরা শুনলাম চলে গেছে।
জ্বি স্যার। পূর্ণিমার সময় আবার আসবে।
আমাদের প্রজেক্ট তাদের কেমন লাগল?
ভালো লেগেছে।
খুব ভালো, না মোটামুটি ভালো?
খুব ভালো। আচ্ছা স্যার, মরুভূমির যে-ঘরটা আমরা বানাচ্ছি ঐটা…
লীনা কথার মাঝখানে চুপ করে গেল। হাসান কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে তার অতিথিরা মরুভূমির ঘর নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে। লীনার মনে প্রশ্নটা আছে, তবে স্যারকে বলতে পারছে না। স্যার আবার কিছু মনে করেন। লীনার একটা ব্যাপার হাসানের ভালো লেগেছে–স্যার আমরা যে ঘরটা বানাচ্ছি। সে বলতে পারত যে ঘরটা বানানো হচ্ছে। তা সে বলেনি।
লীনা প্রশ্নটা শেষ কর। তেমন কিছু না স্যার।
তবু শুনি।
মরুভূমিতে কেউ যখন দাঁড়াবে তখন সে দেখবে চারপাশে সবুজ ঘাস, গাছপালা। তার খটকা লাগবে না?
হাসান বলল, চারপাশের গাছপালা তো কেউ দেখতে পারবে না। মরুভূমির চারদিকে পাহাড়ের মতো করা হচ্ছে। দৃষ্টি পাহাড়ে আটকে যাবে। ঝিল কেটে যে মাটি উঠবে, সেই মাটি দিয়ে পাহাড় হবে। পাহাড়ের গায়েও বালি দিয়ে দেয়া হবে। মূল ডিজাইনে আছে। শেলফ থেকে ডিজাইনটা আননা, আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।
দেখাতে হবে না স্যার আমি বুঝতে পারছি।
আরো ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ যদি মনে করে। যে-কোনো দিক দিয়ে মরুভূমিতে ঢুকতে পারবে তাহলে সে ভুল করবে। সরাসরি সেখানে যাবার পথ নেই। খাল কেটে জায়গাটা আলাদা করা।
সেখানে যাবার ব্যবস্থা কী?
টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। অনেকক্ষণ অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হবে। টালেনের মুখ দিয়ে বের হওয়া মাত্র সে ঝলমলে আলোর জগতে এসে পড়বে। এটা দেখ, এটা হচ্ছে টানেল সাড়ে ছয় ফুট ডায়ামিটার। কাগজ আর কলম নাও–একটা মজার জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছি।
লীলার কেমন যেন লাগছে। স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে বিরাট বনভূমিতে সে এবং তার স্যার। আর কেউ নেই। গভীর রাত— জোছনায় বনভূমি ভেসে যাচ্ছে। স্যার হাঁটছেন সেও হাঁটছে। খুব বাতাস হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় তার লম্বা চুল মাঝে মাঝে স্যারের চোখেমুখে পড়ছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। আবার কেন জানি খুব ভালো লাগছে।
০৪. ইয়াকুব সাহেব তাঁর শোবার ঘরে
ইয়াকুব সাহেব তাঁর শোবার ঘরে, খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এই সময় তার অফিসে থাকার কথা। আজ অফিসে যাননি। অফিসের পুরনো কর্মচারী মনসুরকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এক বছর হল মনসুরের কোনো চাকরি নেই। অফিসের দুই লাখ টাকার হিসেবে গণ্ডগোল হবার পর তার চাকরি চলে গেছে। তারপরেও সে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করে। সে পুরনো কর্মচারীদের একজন। এই হিসেবে তাকে প্রতিমাসেই আগের বেতনের কাছাকাছি পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। অফিসে তার বসার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। সবার টেবিলে সে বসে। পুরনো দিনের গল্প করে। চা-টা খায়। চাকরি চলে গেলেও অফিসে তার অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ ইয়াকুব সাহেব মাঝে মাঝে তাকে ডেকে নিয়ে গল্প করেন।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, কেমন আছ মনসুর?
মনসুর বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ভালো আছি স্যার।
বোস।
মনসুর বসল। ইয়াকুব সাহেবের সামনে একটা নিচু চেয়ার রাখা। মনসুর এসে বসবে এইজন্যেই রাখা। ইয়াকুব সাহেবের শোবার ঘরে খাট ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই।
ইয়াকুব সাহেব পা দোলাতে দোলাতে বললেন, জয়দেবপুরে আমাদের যে প্রজেক্ট চলছে–শুনলাম তুমি দেখতে গিয়েছিলে।
মনসুর বলল, এই নিয়ে তিনবার গিয়েছি স্যার। মাঝখানে একবার গিয়ে দুই দিন দুই রাত ছিলাম।
কেমন দেখলে?
বললে আপনি রাগ করবেন, টাকাপয়সার হরির লুট চলছে। হাসান নামে যাকে কাজ দিয়েছেন সে বাতাসে টাকা ওড়াচ্ছে। নিজের টাকাতো না, পরের টাকা নষ্ট করতে মায়া লাগে না। দেখে কষ্ট লাগল।
খুব টাকা ওড়াওড়ি হচ্ছে?
দুইটা জেনারেটর আছে— তারপরেও আরেকটা নতুন জেনারেটর কেনা হয়েছে। রাজশাহী থেকে মাটির ঘরের কারিগর এসেছে দশ জন। এদের কোন কাজকর্ম নাই। খাওয়া দাওয়া করছে। ঘুরাফিরা করছে। পরের টাকা হলেই এমনভাবে ওড়াতে হবে?
তাতো ঠিকই। পরের টাকায় মায়া স্বাভাবিকভাবেই কম থাকবে–তাই বলে এত কম থাকাও তো ঠিক না। কাজকর্ম হচ্ছে কেমন?
কাজকর্মেরও কোনো আগামাথা দেখলাম না। প্রথম একটা জায়গায় খাল কাটা শুরু হয়েছে–একশো কুলি সারাদিন কাজ করল। সন্ধ্যাবেলা হাসান সাহেব বললেন, না, খালটা এখানে হবে না। অন্য দিক দিয়ে হবে।
খুব খাল কাটাকাটি হচ্ছে?
কী যে হচ্ছে না বোঝা স্যার মুসকিল। লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। প্রতিদিনই কিছু না-কিছু যন্ত্রপাতি আসছে। একটা বুলড়জার ভাড়া করেছে— বুলডজারটা খামাখা পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবহার দেখলাম না।
কথা বলেছ হাসানের সঙ্গে?
জ্বি না। ইচ্ছা করে নাই।
রাতে ঘুমিয়েছ কোথায়?
থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা। অন্যের টাকা-তা, সমানে খরচ করতেছে। বিরাট ঘর আছে, ভালো বাথরুম, খাওয়াও ভালো।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, টাকা খরচ করতে পারা কিন্তু সহজ ব্যাপার। অনেকেই টাকা খরচ করতে পারে না। ধর কাউকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বললে ইচ্ছামতো খরচ কর। দশ দিন পরে খোঁজ নিতে গেলে কত খরচ হয়েছে। দেখা গেল খরচ করতে পেরেছে তিন হাজার টাকা।
মনসুর বলল, এই লোক খরচ পারে। এক কোটি টাকা এই লোক দশ দিনে খরচ করবে।
ইয়াকুব বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এক কোটি টাকার প্রাথমিক বাজেট সে শেষ করে ফেলেছে। তাকে আরো টাকা দিতে হবে।
মনসুর চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারলনা। বয়স হলে মানুষের মাথা আউলা হয়ে যায়। আউলা মানুষ কী করবে না করবে বুঝতে পারে না। এই বুড়োর দেখি সেই ঘটনাই ঘটেছে। মাথী ফোর্টি নাইন হয়ে গেছে।
ইয়াকুক সাহেব বললেন, ঠিক আছে মনসুর তুমি যাও।
মনসুর কিছু না বলে বের হয়ে গেল। তার মন খুব খারাপ হয়েছে। সামান্য দুই লাখ টাকার কারণে তার চাকরি চলে গেছে অথচ কোটি টাকার কোনো হিসাব নাই। বেকুবি ছাড়া এর আর কী মানে হতে পারে। আল্লাহপাক এরকম কেন? বড় বড় বেকুবের কোলে টাকার বস্তা ঢেলে দিয়েছে। ঘটনা কি তাহলে এরকম যে, যত বড় বেকুব, তার তত টাকা।
মনসুর ঘর থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াকুব সাহেবের ব্যক্তিগত ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। বয়স্ক মানুষ। প্রাকটিস অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন, তবে ইয়াকুব সাহেবের চিকিৎসা করেন। ভদ্রলোকের নাম আবদুল মোহিত। স্বল্পভাষী মানুষ। নানাবিধ ব্যাধিতে সারাবছর ভুগছেন। তিনি রোগের ব্যারোমিটার। ঢাকা শহরে যে কোন রোগ তাকে দিয়ে প্রথম শুরু হবে।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, শরীর কেমন ডাক্তার?
ডাক্তার সাহেব বললেন, মোটামুটি।
পা ফুলে গিয়েছিল বলেছিলে। পায়ের ফোলা কমেছে?
কিছু কমেছে।
বাইরে কোথাও গিয়ে শরীর দেখিয়ে আসো।
দেখি।
মোহিত সাহেব ব্লাডপ্রেশারের যন্ত্রপাতি বের করে ইয়াকুব সাহেবের ব্লডিপ্রেশার মাপলেন। রক্ত নিলেন। ইউরিনের স্যাম্পল তৈরি ছিল সেটিও নিলেন। মোহিত সাহেব কিছুদিন হল একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাব দিয়েছেন। ইয়াকুব সাহেবের রক্ত ইউরিন কিছুদিন পরপরই সেখানে পরীক্ষা করা হয়।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি যাই।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, কিছুক্ষণ বোস গল্প করি।
ডাক্তার সাহেব বসলেন। তাঁর মুখ বিষণ্ণ। গল্প করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, চুপ করে আছ কেন? কথা বলো।
মোহিত সাহেব বললেন, কী কথা বল?
যা তোমার বলতে ইচ্ছা করে। কিছু বলতে ইচ্ছা না করলে চুপচাপ সামনে বসে থাকো।
মোহিত সাহেব চুপচাপ সামনে বসে রইলেন। ইয়াকুব সাহেব বললেন, সিগারেট খাবে?
না। ছেড়ে দিয়েছি।
একটা খেয়ে দেখ। মৃত্যুর সময় তো এসেই গেছে। মনের সব সাধ আহ্লাদ মিটিয়ে ফেলা ভালো।
মোহিত সাহেব কিছু বললেন না।
ইয়াকুব সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, জয়দেবপুরে আমি যে বিরাট একটা কাজে হাত দিয়েছি শুনেছ নাকি?
শুনেছি।
আমার নাতনী আসবে। নাতনীকে এবং আমার মেয়েকে চমকে দেবার ব্যবস্থা।
চমকে দেবার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন?
হুঁ করছি।
মোহিত সাহেব লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, টাকা আছে খরচ করতে অসুবিধা কী? পাঁচ কোটি টাকা খরচ করলে— এক মাসের ভেতর অন্য কোনো ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি টাকা চলে আসবে।
তা হয়তো আসবে। না আসলেও অসুবিধা নেই।
মোহিত সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছেন। একেবারেই কোনো কথা না-বলা অভদ্রতা হয় ভেবেই হয়তো বললেন, আপনার নাতনী কবে আসবে?
ইয়াকুব সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, জুন মাসে আসবে। সে তার জন্মদিন এখানে করবে।
তার আগেই কি শিশুপার্ক না কী যেন বানাচ্ছেন সেটা শেষ হবে?
অবশ্যই হবে। এক্সপার্টের হাতে পড়েছে। কাজ হচ্ছে মেশিনের মতো।
দেখেছেন?
না দেখিনি। নাতনীর সঙ্গে দেখব। তবে কাজ কেমন আগাচ্ছে সে রিপোর্ট প্রতিদিন পাচ্ছি।
উঠি। শরীরটা ভালো লাগছে না। বিশ্রাম করব।
বোস ভাক্তার বোস। আরেকটু বোস। শরীর ভালো লাগছে না এইজনেই তো বেশি বসা দরকার। বোস গল্প কর।
মোহিত সাহেব অনিচ্ছার সঙ্গে বসে আছেন। ইয়াকুব সাহেব অতি বুদ্ধিমান মানুষ। কেউ একজন তার সামনে অনাগ্রহ নিয়ে বসে থাকবে এটা বুঝতে না-পারার কোনো কারণ তার নেই। কিন্তু মোহিত সাহেবের মনে হচ্ছে ইয়াকুব সাহেব এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না।
ডাক্তার!
জ্বি।
তুমি যেটাকে শিশুপার্ক বললে, সেটা আসলে পার্ক না। তার নাম দেয়া হয়েছে, মায়ানগর। নামটা কেমন?
খারাপ না।
মায়ানগর নামটা ভালো, না-কি মায়াপুরী?
একই।
মায়ানগরে যাবার পর তোমার চোখে মায়া লেগে থাকবে। যাই দেখবে মনে হবে মায়া-বিভ্ৰম-জাদু।
ভালো তো।
একটা ডায়নোসর পার্ক হচ্ছে। দশটা নানান ধরনের ডায়ানোসর বানানো হচ্ছে। ডায়নোসরগুলি কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে না। এক হাঁটু পানিতে থাকবে।
ও।
ডায়নোসর তো স্থবির। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে তাদের স্থবিরতা খানিকটা দূর হয়।
ও।
কী করা হয়েছে শোনো। যে পানির উপর ডায়নোসরগুলি দাঁড়িয়ে আছে–সেই পানির রঙ পরিবর্তনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভোরবেলায় পানির রঙ থাকবে গাঢ় নীল। যতই সময় যাবে পানির রঙ বদলাতে থাকবে। ঠিক সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার সময় পানির রঙ হবে গাঢ় লাল। পানির নিচে থাকবে লাইটিঙের ব্যবস্থা। তোমার কাছে ব্যবস্থাটা কেমন লাগছে?
খারাপ না।
আমি শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এই বয়সে আমি যদি মুগ্ধ হই তাহলে বাচ্চাদের অবস্থা কী হবে চিন্তা কর।
আজ উঠি। সামান্য কাজও আছে। বড়মেয়ের শাশুড়ি আজমির শরিফ যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
কাল পরশু আবার এসো, মায়ানগরের অন্য প্রজেক্টগুলির কথা বলব। কুবরিকের একটা ছবি আছে, তুমি হয়তো দেখনি 2001 Space odessg, আর্থার সি ক্লার্কের উপন্যাস নিয়ে বানানো ছবি। সেখানে একটা অদ্ভুত স্লেভ আছে। মসৃণ স্লেভ–অনেকদূর পর্যন্ত উঠেছে। সেখান থেকে বিচিত্র সুরের সংগীত শোনা যায় সেই ব্যবস্থাও হচ্ছে। আমার কাছে ডিজাইনের কপি আছে। তোমাকে দেখাব।
আচ্ছা।
ইয়াকুব সাহেব ছেলেমানুষের মতো কিছুক্ষণ পা নাচালেন। হাতের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরালেন। এতক্ষণ আনন্দে ছটফট করছিলেন হঠাৎ সব আনন্দ দূর হয়ে গেল। তার মনে হল এলেনা শেষপর্যন্ত আসবে না। যাবার তারিখ ঠিকঠাক হবে, প্লেনের টিকিট কাটা হবে। তখন বড় ধরনের কোনো ঝামেলা হবে। এলেনার মাম্পস হবে। কিংবা তার স্কুল থেকে ঠিক করা হবে ছাত্রছাত্রীদের সামার-ক্যাম্পে যেতে হবে। এলেনা নিজেই ডিজাইন করে একটা কার্ড পাঠাবে। সেই কার্ডে
লেখা থাকবে : Grandpa Sorry.
এর আগেও দুবার এই ঘটনা ঘটেছে। এবারেরটা নিয়ে হবে তিনবার। কথায় বলে দানে দানে তিনবার। তবে এবার যদি এলেনা আসতে না পারে তাহলে আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। এই সত্য ইয়াকুব সাহেব খুব ভালো করে জানেন। তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তাঁর কাজকর্ম বহুদূর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কখনো মনে হয়নি একটা সময় আসবে যখন কাজ গুটানোর প্রয়োজন পড়বে। কাজ ছড়ানো যেমন কঠিন, গুটানোও কঠিন। ছড়ানোর ব্যাপারটা আনন্দময়, গুটানোর কাজটা বিষাদমাখা।
ইয়াকুব সাহেব ভুরু কুঁচকালেন। হিসেবে কিছু ভুল হচ্ছে–তিনি আসলে কাজ গুটাচ্ছেন না। আরো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এলিনের জন্মদিনে বাজারে নতুন একটা চা আসছে। তার নিজের বাগানের চা। চায়ের নাম ঠিক হয়েছে। এদেশের সবচে বড় বিজ্ঞাপনসংস্থাকে দেয়া হয়েছে নতুন চায়ের কেমপেইন ঠিকমতো করতে। পোস্টার দিয়ে সারাদেশ মুড়ে দিতে হবে। টিভির যে-কোনো চ্যানেল খুললে প্রতিদিন অন্তত দুবার যেন চায়ের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তিনি যতদূর জানেন টিভি স্পট তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কিছু কাজ হচ্ছে বোম্বেতে। একটা বিজ্ঞাপনচিত্রের আইডিয়া তার খুব পছন্দ হয়েছে। গম্ভীর ধরনের বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছেন। তার ফুটফুটে ছ-সাত বছরের বাচ্চামেয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা পিরিচ। বাবা পিরিচে খানিকটা চা ঢেলে দিলেন। মেয়ের মুখে হাসি। সে পিরিচের চায়ে চুমুক দিচ্ছে।
লেখা ফুটে উঠল : ইয়া-চা।
ইয়াকুব সাহেব নিজেকে সব কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে রাখবেন, এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে ঘটনা সে রকম ঘটবে না। তার শরীর খুবই অসুস্থ্য। ডাক্তাররা মোটামুটি ইংগিত দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর উচিত বড় যাত্রার প্রস্তুতি নেয়া। ব্যাগ গোছানো। তা না করে তিনি শেষ মুহূর্তে আরও বড় কাজে ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছেন। চা কোম্পানির চা বাজারজাত করার নানান পরিকল্পনা তার মাথায় আসছে। চায়ের নাম তার পছন্দ হচ্ছে না। নামের ব্যাপারে তিনি এখন একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন।
অসংখ্য নামের মধ্যে ইয়াকুব সাহেবের ইয়া-চা নামটা পছন্দ হয়েছে। ইয়াকুব নামের প্রথম দুটি অক্ষর ইয়া-চার মধ্যে আছে সেজন্যে না। ইয়া শব্দটাই আনন্দময়। ইয়াকুব সাহেবের ধারণা, ঠিকমতো বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে পারলে মানুষদের মধ্যে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া যাবে— চা কয় রকম? দুরকম। সাধারণ চা এবং ইয়া-চা।
অচ্ছাি বিজ্ঞাপনের ভাষা হিসেবে এটাও তো খারাপ না।
কী চা খাবেন? সাধারণ চা, নাকি ইয়া-চা?
ইয়া-চা নামটা দিয়েছে হাসানের সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছিল সে। নামকরণের জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক সে পাবে। এটা করা হবে সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
অনুষ্ঠানটা করা হবে সোনারগাঁ হোটেলে। অতিথিদের সবাইকে সুন্দর কাপড়ের ব্যাগে একব্যাগ চা দেয়া হবে। চায়ের সঙ্গে ইয়া-চা লগো বসানো একটা টিপট এবং দুটা কাপ। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া মাত্র কেমপেইন শুরু হবে।
বিজ্ঞাপনের ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করে এদেশের প্রতিটি মানুষের মাথায় ইয়া-চা ঢুকিয়ে দেবেন। তার এক জীবনে তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। এখানেও তাই হবে।
ইয়াকুব সাহেব আবারো পা দোলাতে শুরু করেছেন। তাঁর চোখেমুখে বিষাদের ছাপ এখন আর নেই। তাঁকে শিশুর মতোই আনন্দিত মনে হচ্ছে।
০৫. বিকেল পাঁচটায়
ঢাকায় গাড়ি যাবে
বিকেল পাঁচটায়
ঢাকায় গাড়ি যাবে। লীনা চিঠি লিখতে বসেছে। দুটা চিঠি লিখবে। একটা মাকে আরেকটা বোনকে। চিঠি গতরাতেই লিখে রাখা উচিত ছিল। এখন তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে। কত কিছু লেখার আছে তাড়াহুড়া করে কি লেখা যায়? শেষে দেখা যাবে আসল কথাগুলিই
লেখা হয়নি। মার কাছে লেখা চিঠি হবে একরকম, বোনের কাছে লেখা চিঠি হবে অন্যরকম। মার চিঠিতে থাকতে হবে—শরীরের খবর, খাওয়াদাওয়া কেমন হচ্ছে তার কিছু কথা। এই চিঠিটা লিখতে হবে খুব গুছিয়ে। বীনার চিঠিতে বানান ভুল থাকলে হবে না। বানান ভুল থাকলে বীনা খুব রাগ করে। চিঠির উত্তর দেবার সময় লেখে : সাধারণ বানান ভুল কর কেন আপা? ধুলা বানান কবে থেকে দীর্ঘউকার হল?
লীনা মার চিঠি লিখতে বসল। মাকে চিঠি লিখতে তার খুব ভালো লাগে। যা ইচ্ছা লেখা যায়।
মা,
তুমি কেমন আছ গো?
রোজ রাতে ঘুমুবার সময় তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার সঙ্গে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন অভ্যাস খারাপ হয়েছে, তোমার গায়ের গন্ধ নাকে না এলে ঘুম হয় না। তুমি অবশ্যই একটা বোতলে তোমার গায়ের গন্ধ ভর্তি করে পাঠাবে।
আমাদের এখানে খাওয়াদাওয়া খুব ভালো। সকালে তিন ধরনের নাশতা থাকে। একটা হল কমন আইটেম–খিচুড়ি। মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়। সবাই খুব আগ্রহ করে খিচুড়ি খায়। আরেকটা আইটেম হল— রুটি, ভাজি এবং ডিম। আমি বেশিরভাগ দিন এইটা খাই।
আমাদের স্যার সকালে নাশতা খেতে পারেন না। তিনি এক কাপ চা আর একটা টোস্ট বিসকিট খান। দুপুরে লাঞ্চ খান। মাঝখানে চা ছাড়া আর কিছু না। আমার খুব ইচ্ছা করে তাকে জোর করে নাশতা খাওয়াতে। অন্য সবার খাবারদাবারের দিকে তার এত নজর, কিন্তু নিজের খাবারদাবারের দিকে কোনো নজর নেই।
মা, তুমি যে চালতার আচার বানিয়ে পাঠিয়েছিলে— স্যারকে খেতে দিয়েছিলাম। উনি খুবই পছন্দ করেছেন। আমি আচারের কৌটাটা স্যারের তাঁবুতে রেখে দিয়েছি। বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি যেন রোজ খাবারের সঙ্গে আচার দেয়।
এখন একটা মজার কথা বলি মা। গতরাতে স্যারের তাঁবুতে বিরাট হৈচৈ। ঘুম ভেঙে আমি ছুটে গেলাম। সবাই বলাবলি করছে তাঁবুতে সাপ ঢুকেছে। আমি তাঁবুতে ঢুকে দেখি স্যার বিছানায় পা তুলে বসে ঠকঠক করে কাঁপছেন। তাঁবুভর্তি লোকজন। ঘটনা হচ্ছে–স্যারের তাঁবুতে বড় একটা মাকড়সা দেখা গেছে। স্যারের মাকড়সা-ভীতি যে কী ভয়ংকর, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। সাধারণ একটা মাকড়সাকে কেউ এত ভয় পায়। অনেকেই এটা নিয়ে হাসাহাসি করছিল— আমার এত মায়া লাগল!
মা তুমি আমাকে নিয়মিত দুধ খেতে বলেছ। তোমার মনের আনন্দের জন্যে বলছি, আমি রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাপ করে দুধ খাচ্ছি। গ্রাম থেকে খাঁটি গরুর দুধ নিয়ে আসছে। আমি বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি সে যেন স্যারকেও শোবার সময় এক কাপ করে দুধ দেয়। সে তাই দিচ্ছে। আমার ধারণা ছিল স্যার সেই দুধ খান না। গতকাল বাবুর্চির কাছে শুনেছি স্যার দুধ খাচ্ছেন।
আমাদের বেশ কয়েকজন বাবুর্চি। স্যারের জন্যে যে বাবুর্চি রান্না করে তার নাম হোসেন মিয়া। সে অনেক রকমের ভর্তা বানাতে জানে। এর মধ্যে একটা ভর্তা হল— চিনাবাদামের ভর্তা। চিনে বাদাম পিষে সরিষার তেল পিয়াজ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ভর্তা বানায়। এই ভর্তাটা খেতে খুব ভালো। স্যার এই ভর্তা পছন্দ করে খান।
মা তুমি তো অনেক রকমের ভর্তা বানাতে জানো একটা কোনো বিশেষ ধরনের ভর্তা বানানোর পদ্ধতি আমাকে সুন্দর করে চিঠিতে লিখে জানিও। আমি স্যারকে বেঁধে খাওয়াব।
তুমি শুনে খুবই অবাক হবে যে, সারেরও রান্নার শখ আছে। আমি লক্ষ্য করেছি বাবুর্চি যখন রান্না করে, স্যার প্রায়ই আগ্রহ করে রান্না দেখেন। একদিন দেখি তিনি নিজেই খুঁড়িতে চামচ দিয়ে নাড়ছেন। আমি তাড়াতাড়ি কাছে গেলাম। স্যার বললেন, লীনা জাপানিজ খাবার কখনো খেয়েছে? আমি বললাম, না। স্যার বললেন, একদিন তোমাকে জাপানিজ খাবার রান্না করে খাওয়াব। আমি খুব ভালো জাপানীজ রান্না জানি। দুমাস জাপানে ছিলাম তেমন কিছু শিখতে পারিনি। ওদের রান্নাটা শিখেছি। জাপানিজদের মতো চিংড়িমাছ পৃথিবীর আর কেউ রাঁধতে পারে না।
মা, আমি ভাবিওনি যে স্যার সত্যিসত্যি জাপানিজ খাবার রান্না করবেন। উনি এত ব্যস্ত রান্না করার তাঁর সময় কোথায়? তাছাড়া বড়মানুষরা অনেক কথা বলেন যেসব কথা তাঁরা মনেও রাখেন না। মনে রাখলে চলে না। আমার এই ধারণাটা যে কত ভুল তার প্রমাণ পেলাম গত বুধবারে। স্যার আমাকে কিচেনে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি তিনি রান্নার সমস্ত আয়োজন শেষ করে বসে আছেন। আমার সামনে রাধবেন, যেন আমি শিখতে পারি।
রান্নার জাপানিজ নাম— আলিও ওলিও।
আমি খুব গুছিয়ে লিখে দিচ্ছি যাতে তুমি বঁধতে পার। প্রথমে কিছু স্পেগেটি নিয়ে সাত-আট মিনিট সিদ্ধ করতে দেবে। এই ফঁাকে কড়াইয়ে ওলিভওয়েল নেবে। সেই ওলিভ ওয়েলে একগাদা রসুন কুঁচিকুঁচি করে ছেড়ে দেবে। রসুনের সঙ্গে থাকবে কুঁচিকুঁচি করা শুকনা মরিচ। একটু লালচে হতেই সিদ্ধ স্পেগেটি কড়াইয়ে ছেড়ে এক মিনিট নেড়ে নামিয়ে ফেলবে। খেতে হবে গরম গরম। মা, খেতে কী যে অসাধারণ! আর দেখলে কত সহজ রান্না!…
লীনা ভেবেছিল মাকে ছোট্ট চিঠি লিখবে। এই পর্যন্ত লিখেই সে চমকে উঠল— পাঁচটা বাজতে দুতিন মিনিট বাকি আছে। বীনাকে চিঠি লিখতে হলে গাড়ি মিস হবে। লীনা তার মার চিঠিটা খামে বন্ধ করে ঠিকানা লিখে ছুটে গেল।
ঢাকাগামী গাড়ির কাছে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। লীনাকে দেখে সে হাসিমুখে বলল, চিঠি কার কাছে যাচ্ছে?
লীনা বলল, মার কাছে।
হাসান বলল, তুমি তো অনেকদিন হল এখানে পড়ে আছ। ছুটি নাওনি। এক কাজ কর— গাড়িতে করে চলে যাও, একদিন মার সঙ্গে কাটিয়ে আসো।
লীনা বলল, আজ যা না স্যার।
হাসান বলল, আজ না গেলে অবশ্যি একদিক দিয়ে তোমার লাভ হবে–পূর্ণিমা দেখতে পারবে। আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা দেখার জন্যে আজ বিশাল আয়োজন করেছি। রাতের শিফটের কাজ বন্ধ। কোনো বাতি জ্বলবে না। কোনো ঘটঘট শব্দ হবে না। যার ইচ্ছা সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরবে। মনের শখ মিটিয়ে পূর্ণিমা দেখবে। বড় সৌন্দর্য দেখার জন্যে বড় আয়োজন লাগে। লীনা, তোমার কি শাদা শিফন শাড়ি আছে? শাদা শিফন শাড়ি থাকলে ঐটা পরো। পূর্ণিমার আলোয় শাদা শিফনের শাড়ি পরা মেয়েদের দেখলে কী মনে হয় জানো? মনে হয়, যে শাড়িটা সে পরেছে সেটাও চাঁদের আলোয় তৈরি।
কী আশ্চর্য কাণ্ড! শাদা শিফনের শাড়ি লীনার আছে। ফিরোজ কিনে দিয়েছিল। লীনা শাড়ি দেখে বলেছিল— শাদা কিনলে কেন বল তো? শাদা হল বিধবাদের রঙ। ফিরোজ বলেছিল, শাদা রঙটা তোমাকে মানাবে এই ভেবে কিনেছি। বিধবা-সধবা ভেবে কিনিনি। হাত দিয়ে দেখ কী সফট। এই শাড়ি লীনা পরে নি। এখানে আনার ইচ্ছাও ছিল না। ভাগ্যিস এনেছে। আজ কী সুন্দর কাজে লেগে গেল।
হাসান বলল, মুসলমানরা চাঁদের হিসেবে চলে। সেইদিকে বিচার করলে ভরা-পূর্ণিমায় মুসলমানদের কোনো চন্দ্র-উৎসব থাকা উচিত ছিল, তা নেই। বৌদ্ধদের আছে। তাদের সমস্ত বড় ধর্মীয় উৎসব পূর্ণিমাকেন্দ্রিক। এক ভর-পূর্ণিমায় বুদ্ধদেব গৃহত্যাগ করেন, আরেক ভরা-পূর্ণিমায় তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন, আরেক ভরা-পূর্ণিমায় তিনি দেহত্যাগ করেন।
লীনা বলল, ইংরেজরা কি পূর্ণিমায় কোনো উৎসব করে?
হাসান বলল, পাগল হয়েছ? ওরা পূর্ণিমায় উৎসব করবে? চাঁদের কোনো গুরুত্ব ওদের কাছে নেই। আমাদের যেমন চাঁদের আলোর আলাদা প্রতিশব্দ আছে–জোছনা। ওদের তাও নেই। চাঁদের আলো হল— Moon light.
লীনা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলে কি করে?
হাসান বলল, ভালোমতো চাঁদটা উঠুক, তখন আমাকে মনে করিয়ে দিও। আমি তোমাকে বলব আফ্রিকার একদল আদিবাসী কী বিচিত্র উপায়ে চন্দ্র উৎসব করে সেই গল্প।
জি আচ্ছা।
আমি উত্সবের বর্ণনা বইএ পড়েছি। নিজে কখনো দেখিনি। খুব ইচ্ছা আছে একবার গিয়ে ওদের উৎসবে অংশ নেব। ওদের এই উৎসবটার নাম রাংসানি। আমার জীবনে কয়েকটা শখ আছে। একটা হচ্ছে রাংসানি উৎসবে যোগদেয়া — আরেকটা হল আন্টার্কটিকায় গিয়ে পূর্ণিমা দেখা। চারদিক বরফে ঢাকা, সেখানে চাঁদ যখন উঠবে— অপূর্ব ব্যাপার হবে না? বরফের গায়ে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। চারদিক ঝলমল, ঝলমল করছে।
লীনা চুপ করে আছে। তার বলতে ইচ্ছা করছে, স্যার ঐসব জায়গায় আপনি যখন যাবেন অবশ্যি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আমি একা একা তো যেতে পারব না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আমি এমন কাউকে সঙ্গে নিতে চাই যে সৌন্দর্য কী তা জানে। সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে পারে।
লীনা!
জি স্যার।
আমরা বাঙালিরা শুধু কাজলা দিদির কারণে বাঁশবাগানের মাথার উপরের চাঁদের কথা জানি। এ ছাড়াও যে চাঁদ কত সুন্দর হতে পারে তা জানি না। কল্পনাতেও দেখতে পারি না। মরুভূমির চাঁদও অপূর্ব। জয়সলমীরের মরুভূমিতে এক পূর্ণিমায় আমি ছিলাম— চাঁদ মাথার উপর উঠার পর ভৌতিক অনুভূতি হতে লাগল। ইংরেজিতে এই অনুভূতির নাম Uncarning feeling. জয়সলমীর তো কাছেই, একবার সেখানে গিয়ে জোছনা দেখে এসো।
লীনা বলল, জ্বি আচ্ছা।
হাসান তার ভঁৰুর দিকে রওনা হল। লীনা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে সে হাঁটতে পারছে না। তার ভয়ংকর কোন অসুখ হয়ে হাতপা শক্ত হয়ে গেছে। আকাশে রুপার থালার মতো চাঁদ উঠলেই অসুখটা সারবে। চাঁদ না-ওঠা পর্যন্ত অসুখ সারবে না।
লীনা অনেক সময় নিয়ে গোসল করল। চোখে কাজল দিল। সঙ্গে কাজল বা কাজলদানি কিছুই ছিল না। কাঁঠালপাতার উল্টোদিকে মোমবাতির শিখা দিয়ে কাজল তৈরি করে সেই কাজল চোখে মাখল। শাদা শিফনের শাড়ি পরে যখন বের হল— তখন আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। তবে চাঁদে রঙ ধরেনি–লাল রাগী চাঁদ। লীনার কেমন যেন লজ্জা-লজ্জা লাগছে। যেন সে ভয়ংকর কোনো কাজ করতে যাচ্ছে। ভয়ংকর কিন্তু আনন্দময়।
লীনা হাসানের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ জেনারেটর ছাড়া হয়নি বলে তাঁবুর ভেতরে অন্ধকার। তারপরেও তাঁবুর পর্দা সরিয়ে সে উঁকি দিতে পারে। কিন্তু তার লজ্জা-লজ্জা লাগছে। স্যার যদি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন— ঘটনা কি? এত সেজেছ কেন?
তাঁবুর ভেতর থেকে বাবুর্চি হোসেন মিয়া ট্রেতে করে খালি চায়ের কাপ পিরিচ নিয়ে বের হল। লীনাকে বলল, আপা, স্যারের খুঁজে আসছেন? স্যার তো নাই।
নাই কেন? উনি কোথায়?
স্যার
ঢাকায় গেছেন। বেগম সাহেব আর বাচ্চাদের আনবেন। জোছনা দেখবেন।
কখন গেলেন?
পাঁচটার গাড়িতে গেছেন।
লীনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছা করছে ছুটে গভীর কোনো জঙ্গলে চলে যায়। জঙ্গলে লুকিয়ে বসে থাকে। যেন কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়।
আপা আপনাকে চা দিব?
দাও। আচ্ছা একটা কাজ কর– ছোট ফ্লাস্কে করে চা দাও। আমি জঙ্গলে হাটব, জোছনা দেখব, আর চা খাব।
ঢাকায় আসতে জাম-টাম মিলিয়ে দুঘণ্টার মতো লাগে।
আজ রাস্তা অস্বাভাবিক ফাঁকা। কোনো জাম নেই, রেড সিগন্যালে গাড়ি আটকা পড়ল না। এক ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে হাসান তার বাসায় ঢুকল। বাসায় ঢোকার ব্যাপারটাও সহজে ঘটল। দরজা খোলা, কলিংবেল টিপতে হল না। বাসায় নতুন বুয়া রাখা হয়েছে। হাসান তাকে আগে দেখেনি। সে এসে কঠিনচোখে হাসানের দিকে তাকাতেই হাসান বলল, আমি এই বাড়ির মানুষ। অন্তুর বাবা। তুমি চট করে চা বানাও।
অন্তু টিভি দেখছিল। বাবা এসেছে এটা সে দেখেছে। আনন্দে তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু সে ভাব করছে যেন বাবাকে দেখেনি। আর দেখলেও তার কিছু যায় আসে না। বাবার সঙ্গে এরকম অভিনয় করতে তার খুব ভালো লাগে।
হাসান বলল, অন্তু ব্যাটা কাছে আয় আদর করে দেই।
অন্তু বলল, আসতে পারব না। টিভি দেখছি।
অন্তুর অবশ্যি ইচ্ছা করছে ঝাপ দিয়ে বাবার কোলে পড়তে। ইচ্ছা করলেই কাজটা করতে হবে তা না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে টিভির দিকে মনোযোগ দিতে।
হাসান বলল, কী দেখছিসরে ব্যাটা? কার্টুন?
না, জিওগ্রাফি চ্যানেল।
বাবা তুই তো জ্ঞানী হয়ে যাবি। অতীশ দীপংকর টাইপ।
অন্তুর ইচ্ছা করছে জিজ্ঞেস করে— অতীশ দীপংকর টাইপটা কী। সে জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে টিভির দিকে তার মন নেই। তার মন পড়ে আছে বাবার দিকে।
মা কইরে ব্যাটা?
শপিঙে গেছে।
নীতুও গেছে?
হুঁ।
তুই যাসনি কেন?
শপিঙে যেতে আমার ভালো লাগে না।
গুড। আমারো ভালো লাগে না। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরা। দরদাম করা। টিভিতে কী দেখাচ্ছে?
মেরিন লাইফ।
টিভিটা বন্ধ কর তো বাবা। তোর সঙ্গে কিছু সিরিয়াস কথা আছে।
অন্তু আনন্দের সঙ্গে টিভি বন্ধ করল। কিন্তু ভাব করল যেন সে খুব বিরক্ত হয়েছে। হাসান বলল, বেড়াতে যাবি?
অন্তু বলল, যাব।
হাসান বলল, কোথায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চাচ্ছি সেট; না-জেনেই বলে বসলি— যাব। হয়তো এমন কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে চাচ্ছি যেখানে যেতে তোর ভালো লাগবে না। তখন কী হবে। স্লাগে জিজ্ঞেস কর— কোথায়?
অন্তু বলল, কোথায়?
জঙ্গলে।
অন্তু বলল, হুঁ বাবা আমি যাব। জঙ্গলে কী আছে?
বাঘ ভাল্লুক কিছুই নেই। থাকলে ভালো হত। তবে এখন যা আছে তাও খারাপ না। দুর্দান্ত একটা চাঁদ উঠেছে– জঙ্গলে সেই চাঁদের আলো আছে।
দুর্দান্ত মানে কী বাবা?
দুর্দান্ত মানে—মারাত্মক।
মারাত্মক মানে কী?
মারাত্মক মানে ভয়ংকর।
ইংরেজি কী বল।
ইংরেজি হল ডেনজারাস।
ডেনজারাস কেন?
ডেনজারাস, কারণ হল–এমন এক চাঁদ উঠেছে যার আলো গায়ে পড়লেই মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়। ওয়ার উলফ টাইপ। তখন চিঙ্কার করতে ইচ্ছা করে।
কখন যাব বাবা?
তোর মা এলেই রওনা দিয়ে দেব। ব্যাগ গুছিয়ে নে।
ব্যাগে কী কী নেব?
অনেক কিছু নিতে হবে। সবার প্রথম লাগবে একটা কম্পাস। পথ হারিয়ে গেলে কম্পাস দেখে পথ খুঁজে পেতে হবে। কম্পাস কি আছে?
অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কম্পাসটা তার বাবাই তাকে গত জন্মদিনে কিনে দিয়েছে। এখনো সে ব্যবহার করতে পারেনি। আজ ব্যবহার হবে।
তারপর লাগবে মোমবাতি দেয়াশলাই।
মোমবাতি-দেয়াশলাই কেন লাগবে?
মনে কর কোনো বিচিত্র কারণে চাঁদ ডুবে গেল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তখন মোমবাতি জ্বালাতে হবে না?
টর্চ লাগাবে না বাবা? আমার একটা পেন্সিলটর্চ আছে।
টর্চ তো লাগবেই। বিশেষ করে পেন্সিলটর্চই লাগবে। পেন্সিলটর্চ ছাড়া জঙ্গলভ্রমণ মোটেই নিরাপদ হবে না?
বাবা চাকু লাগবে? আমার সুইস নাইফ আছে।
সুইস নাইফ ছাড়া ম্যাকগাইভার কি কখনো জঙ্গলে যেত?
না।
তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন সুইস নাইফ তো লাগবেই। তোর আছে না?
আছে। বাবা দড়ি লাগবে না?
আসল জিনিসই ভুলে গেছি। দড়ি is must. লাইলনের নীল রঙের দড়ি হলে খুব ভাল হয়।
মহা-উৎসাহে অন্তু ব্যাগ গুছাচ্ছে।
হাসানের চা এসে গেছে চায়ের কাপে দ্রুত কয়েকটা চুমুক দিয়ে সে বাথরুমে ঢুকল। অনেকদিন পর নিজের বাথরুমে গোসল। পরিচিত জায়গা। পরিচিত সাবানের গন্ধ। পরিচিত টাওয়েল। ওয়াটার হিটারটা নষ্ট ছিল। ঠিক করা হয়েছে। আগুনগরম পানি আসছে। হাসানের মনে হল, সামান্য ভুল হয়েছে। মগভর্তি গরম চা নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। হট শাওয়ার নিতে নিতে গরম চা বা কফি খাবার আলাদা আনন্দ। এই আনন্দ তার আবিষ্কার।
বাথরুম থেকে বের হয়ে হাসান দেখল নাজমা চলে এসেছে। তার হাতে প্লেট। নলা বানিয়ে নীতুর মুখে দিচ্ছে। নীতু চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে ভাত খাচ্ছে। নাজমার মুখ শান্ত। সে একবার শুধু চোখ তুলে হাসানকে দেখল।
হাসান বলল, নীতুকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে রেডি হয়ে নাও। রাত এগারোটার মধ্যে আমাদের পৌঁছতে হবে।
নাজমা বলল, কোথায়?
হাসান বলল, অন্তু তোমাকে বলেনি? আমরা জঙ্গলে জোছনা দেখতে যাচ্ছি। বলেছে, নাকি বলেনি।
নাজমা শান্ত গলায় বলল, বলেছে।
হাসান বলল, দুর্দান্ত একটা চাঁদ উঠেছে। আমরা রাত দুটা পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জোছনা দেখব। দুটার পর ঘুমুতে যাব। তোমার জন্যে গাড়ি স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ঘুম ভাঙলেই গাড়ি করে চলে আসতে পারবে। আর যদি মনে কর— একটা দিন বাচ্চারা স্কুল মিস করা এমন কিছু না— তাহলে থাকবে। আমি আমাদের কাজের অগ্রগতি তোমাকে দেখাব। তোমার টাসকি লেগে যাবে।
নাজমা চুপ করে রইল।
হাসান নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে বুড়ি জঙ্গলে যাবি?
নীতু বলল, না।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে সে না বলে। তার এই না মানে বেশির ভাগ সময়ই হ্যাঁ।
হাসান বলল, আমাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা পথ থেকে একটা বিগ সাইজ পিজা কিনে নেব।
নাজমা বলল, তুমি টাওয়েল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। গা মুছে কাপড় পরে টেবিলে এসে বস। আগে কথা বলি।
হাসান বলল, তোমার কথা বলার টোনটা ভালো লাগছে না। এতদিন পরে এসেছি, এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না।
নাজমা বলল, ঝগড়া করব না। শান্তভাবেই কয়েকটা কথা বলব। তুমি চাইলে হাসিমুখেই বলব।
হাসান বলল, তুমি ঝগড়া করতে চাইলে ঝগড়া করতে পার। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পার— আমার দিকে চায়ের কাপ বা গ্লাসও ছুড়ে মারতে পার— শুধু জঙ্গলে জোছনা দেখার ব্যাপারে না বোলো না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি একা জোছনা দেখতে পারি না।
নাজমা বলল, তুমি কাপড় বদলে বারান্দায় বসো–আমি নীতুকে খাইয়ে আসছি। তখন কথা হবে।
হাসান বারান্দায় বসে আছে। হাসানের পাশে ব্যাগ হাতে অন্তু। নাইলনের নীল রঙের দড়ি ছাড়া অন্তুর ব্যাগে সবই নেয়া হয়েছে, শুধু তার পেন্সিলটর্চের ব্যাটারি নেই। হাসান তাকে কয়েকবার আশ্বস্ত করেছে ব্যাটারি কেনা হবে, অন্তু কেন জানি ভরসা পাচ্ছে না। রাস্তার ওপাশের দোকানটা খোলা আছে। অন্তুর ইচ্ছা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এক্ষুনি সে ব্যাটারি কিনবে।
নাজমা নিজের জন্যে মগভর্তি চা নিয়ে হাসানের পাশে বসল। অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, অন্তু তুমি ঘরে যাও। তোমার বাবার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলব।
অন্তু বলল, আমাদের তো দেরি হয়ে যাচ্ছে মা।
দেরি হলেও কিছু করার নেই। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা আগে শেষ হতে হবে। ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে যাও।
অন্তু ঘরে চলে গেল। নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি
ঢাকায় এসেছ এক মাস আঠারো দিন পর।
হাসান বলল, কী যে কাজের চাপ যাচ্ছে তুমি এখানে বসে কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি তোমাকে তিনটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম, তুমি তার একটার জবাব দিয়েছ। তিন লাইনের জবাব।
একবার তো বলেছি প্রচণ্ড কাজের চাপ।
এতই যখন কাজের চাপ, তাহলে জোছনা দেখানোর জন্যে চলে এলে কেন? কাজের মধ্যে জোছনা কী?
নাজমা তুমি ঝগড়া করার চেষ্টা করছ।
ঝগড়া করছি না। তোমার সঙ্গে আলাপ করছি। আলাপ করার জন্যে তোমাকে পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেছে। ভাগ্যিস তোমাদের জঙ্গলে একটা চাঁদ উঠেছিল।
এই-যে কথাগুলি বলছ, চলো এক কাজ করি–জঙ্গলে জোছনায় বসে আলাপ-আলোচনা যা হবার হোক।
নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ পাশে রাখতে রাখতে বলল, শুরুতেই বিষয়টা পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।
যাচ্ছ না মানে?
যাচ্ছি না মানে যাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে জোছনা দেখার আমার শখ নেই। কারো সঙ্গেই নেই।
অন্তু ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে।
এটাও তোমার চমৎকার ট্রিকস-এর একটি। অন্তুকে আগেভাগে বলেছ। সে ব্যাগ গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি জানো এটা আমার উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। যেতে ইচ্ছা না করলেও ছেলের শুকনোমুখ দেখে আমি যাব। তোমার ট্রিকস আজ কাজ করবে না। আমি যাব না।
যাবে না?
অবশ্যই না। আমাকে বা অন্তু নীতুকে তোমার প্রয়োজনও নেই। দুএকজন মুগ্ধ মানুষ তোমার আশেপাশে থাকলেই হল। সেরকম মানুষ তোমার সঙ্গে আছে। তোমার পি.এ, আছে না! মেয়েটার নাম কী যেন?
লীনা।
হ্যাঁ লীনা। মেয়েটার নাম আমি জানি, তারপরেও তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি দেখাতে চাচ্ছিলাম তুমি তার নামটা কত মিষ্টি করে উচ্চারণ কর।
খুব মিষ্টি করে কি উচ্চারণ করেছি?
হ্যাঁ করেছ। মুগ্ধ মানবী একজন তো তোমার সঙ্গেই আছে। শুধুশুধু আমাদের নিতে এসেছ কেন?
নাজমা তুমি ভুল লজিক ধরে এগুচ্ছ। তুমি আমার সঙ্গে যাবে না ভালো কথা। মেয়েটাকে শুধু শুধু টানছ কেন?
মেয়েটাকে টানছি কারণ আমি তোমার স্বভাবচরিত্র জানি। তুমি যখন কিছু বলার জন্যে মাথার ভেতর কথা গুছাও–তখন তোমার মুখের দিকে
তাকিয়ে আমি বলে দিতে পারি তুমি কী বলতে যাচ্ছ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই প্রমাণ দেব?
প্রমাণ দিতে হবে না। প্রমাণ ছাড়াই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি।
তারপরেও প্রমাণ দেই। জোছনা উপলক্ষে তুমি তোমার মায়ানগরে মোটামুটি একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছ। জোছনা-উৎসবের আয়োজন করেছ। করনি?
উৎসবের আয়োজন করিনি। তবে কাজকর্ম বন্ধ রেখেছি। জেনারেটর চালু হয়নি।
লীনা মেয়েটিকে বলনি শাদা শিফন পরে জোছনায় হাঁটতে? চাঁদের আলোয় শাদা শিফন পরলে মনে হবে জোছনার কাপড় পরা হয়েছে। এই কথা একসময় আমাকে বলেছ— আরো অনেককে বলেছ। তাকেও নিশ্চয় বলেছ। বলনি?
হ্যাঁ বলেছি।
জাপানি খাবার রান্না করে খাওয়াও নি? আলিও ওলিও, কিংবা টমেটো বেসড স্পেগেটি পমরো। নিশ্চয়ই খাইয়েছ।
হ্যাঁ খাইয়েছি, তাতে কী প্রমাণিত হয়?
আগে যা অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে তাই প্রমাণিত হয় আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই। তোমার প্রয়োজন একজন মুগ্ধ মানবী—যার চোখ সারাক্ষণ বিস্ময়ে চকমক করবে। আমার মধ্যে বিস্ময় নেই, মুগ্ধতাও নেই– আমাকে দরকার হবে কেন?
কথা শেষ হয়েছে, না আরো বলবে?
মূল কথা বলা হয়ে গেছে। মূলের বাইরের একটা কথা বলে নিই। অন্তুর জন্যে যে তীব্র আকর্ষণ তুমি বোধ কর তার কারণটা কি তুমি জানো?
পুত্রের প্রতি আকর্ষণের পেছনে কারণ লাগে?
অবশ্যি কারণ লাগে। অন্তু মুগ্ধ বিস্ময়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে বলেই তুমি তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ কর। মুগ্ধ হবার মতো বয়স নীতুর হয়নি বলে তুমি নীতুর প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ কর না। ওরা যখন বড় হবে, ওদের মুগ্ধতা কেটে যাবে, তখন ওদের প্রতি তুমি কোনোই আকর্ষণ বোধ করবে না। আমার কথা শেষ— এসো খেতে এসো।
হাসান বলল, অন্তু যেতে না পারলে খুবই মনখারাপ করবে। একটা কাজ করি, আমি নতজানু হয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করি। এবারের মতো চলো।
এইসব নাটক অনেকবার করেছ। আর না প্লিজ।
তাহলে যাচ্ছ না?
না।
নাজমা ঘরে ঢুকে গেল। হাসান বসে রইল একা। অন্তু এসে ঢুকল। অন্তু বলল, বাবা তুমি এত বোকা কেন? আসল জিনিসটার কথা তুমি ভুলে গেছ।
হাসান বলল, আসল জিনিস কী?
আমরা যে জঙ্গলে যাচ্ছি সেই জঙ্গলটার একটা মাপ লাগবে না? পথ হারিয়ে ফেললে তো আমাদের ম্যাপ দেখতে হবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি পথ হারিয়ে ফেললে এরা ম্যাপ দেখে।
হাসান দ্রুত চিন্তা করছে। আজ যাওয়া হবে না, এই দুঃসংবাদটা ছেলেকে কীভাবে দেয়া যায়। এমনভাবে বলতে হবে যেন ছেলে মনে কষ্ট না পায়। কোনো কিছুই মাথায় আসছে না।
অন্তু বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দ এবং উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করছে।
লীনা বনের ভেতর বসে আছে। তার হাতে ঘড়ি নেই। সময় কতটা পার হয়েছে বুঝতে পারছে না। তবে রাত অনেক হয়েছে। একটু আগে চাঁদটা ছিল মাথার উপর, এখন নামতে শুরু করেছে। ক্যাম্প থেকে সাড়াশব্দ আসছিল, এখন তাও নেই। লীনা উঠে দাঁড়াল। সে এগুচ্ছে গভীর বনের দিকে। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। দিনের বেলাতেই সে একবার পথ হারিয়েছিল আর এখন মধ্যরাত। চাঁদের আলো অবশ্যি আছে। চাঁদের আলো পথ খুঁজতে সাহায্য করে না, বরং পথ ভুলিয়ে দেয়। লীনা এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটছে। মনে হচ্ছে ঠিক হাঁটছেও না। বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগুচ্ছে।
ম্যাডাম স্লামালিকুম।
লীনা থমকে দাঁড়াল। শামসুল আলম কোরেশি নামের অল্পবয়েসী ইনজিনিয়ার ছেলেটা। ওরা তিনজন সবসময় একদলে থাকে। আজ সে একা হাঁটছে। কিংবা তিনজন মিলেই হয়তো হাঁটছে, বাকি দুজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে পাঠানো হয়েছে কথা বলার জন্যে।
কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?
কোথাও যাচ্ছিনা তো। হাঁটছি, জোছনা দেখছি।
আমি অনেক দূর থেকে আপনাকে দেখে খুবই চমকে গিয়েছিলাম।
কেন?
শামসুল আলম কোরেশি নিচুগলায় বলল, আপনি শাদা রঙের শাড়ি পরেছেন। শাদা রঙের শাড়ি, চাঁদের আলো সব মিলে হঠাৎ মনে হয়েছিল— আপনি বোধহয় মানুষ না। অন্যকিছু।
ভূত-প্রেত?
না, তাও না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল পরী। ম্যাডাম, আমার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি কিছু ভেবে কথাটা বলিনি।
আমি কিছু মনে করিনি।
ম্যাডাম আসুন, আপনাকে তাঁবুতে পৌঁছে দেই। এত রাতে একা একা জঙ্গলে হাঁটা ঠিক হবে না।
আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না, আমি একা একা হাঁটব। ঝিলটা কোন্ দিকে একটু দেখিয়ে দিন।
আমি কি সঙ্গে আসব?
না। থ্যাংক য়্যু। লীনা ঝিলের দিকে এগুচ্ছে। চাঁদের আলোয় ঝিলের পানিতে নিজের ছায়া দেখতে ইচ্ছা করছে।
০৬. মার কাছে
লেখা দীর্ঘ চিঠি
আপা,
মার কাছে
লেখা তোমার দীর্ঘ চিঠি খুব মন দিয়ে পড়লাম। তুমি আমার স্বভাব জানো, আমি কখনো অন্যের চিঠি পড়ি না। মা আমাকে পড়তে দিল। আমি বললাম, আপাকে লেখা চিঠি আমি পড়ব না। তখন মা বলল, চিঠিটা পড়ে দেখ। আমার মনে হয় লীনার মাথার ঠিক নেই।
আপা, আমারও তাই ধারণা। তোমার মাথা ঠিক নেই। মাকে তুমি কী লিখেছ তা কি তোমার মনে আছে? পুরো চিঠিতে তোমার স্যারের কথা। তোমার ভুবন স্যারময় হয়ে গেছে। যেন তিনি আছেন বলেই তুমি আছ। তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েদের মতো তুমি যে তোমার স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ তা কি তুমি জানো? কিশোরী মেয়েদের একটা সুবিধা আছে তারা হাবুডুবু খায়, আবার একসময় ভেসে ওঠে। হাঁসের মতো শরীর থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে প্যাকপ্যাক করতে করতে বাড়ি চলে যায়। এই সুবিধাটা তোমার নেই।
তোমার স্যার খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ। তিনি তোমার মানসিক অবস্থা অবশ্যই ধরতে পেরেছেন। তার উচিত ছিল ব্যাপারটা শক্তহাতে সামলানো। তিনি তা করেননি। কেন করেননি তাও অনুমান করতে পারি। ইট-পাথরও পূজা পেতে পছন্দ করে। আর উনি ইট-পাথর না, বুদ্ধিমান একজন মানুষ। কেউ হৃদয়-মন দিয়ে তাকে পূজা করছে তা তিনি পছন্দ করবেন না এটা হতেই পারে না। আপা শোনো, তুমি তো গান টান পছন্দ কর না। রবীন্দ্রসংগীত নজরুল গীতির মধ্যে তফাৎটা কোথায় তাও বোধহয় জানো না। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে—
আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
এই গানটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার জন্যে লিখেছেন। তুমি সকল নিয়ে সর্বনাশের আশায় বসে আছ।
এখন তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। তুমি আমার বয়সে বড়, নয়তো তোমাকে আদেশ দিতাম। উপদেশটা হচ্ছে চাকরি ছেড়ে তুমি
ঢাকায় চলে এসো। যেদিন চিঠি পাবে সেদিনই। এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
তোমার স্যারকে তুমি প্রাণভোমরা ভাবছ। আসলে তিনি তোমার মরণপাখি। এই পাখি যেই তুমি হাত দিয়ে ছুঁবে অমনি তোমার সব শেষ।
আপা, বুঝতে পারছ কী বলছি? তোমার রেসিপি সরি তোমার না, তোমার গুরুদেবের রেসিপি মো জাপানি খাবার আলিও ওলিও রান্না করলাম। যে কটি অখাদ্য আমি এ জীবনে খেয়েছি তোমার আলিও ওলিও তার মধ্যে একটি। আর এই খাবারের স্বাদের যে বর্ণনা তুমি দিয়েছ, পড়লে মনে হয়–বেহেশতে এই রান্না হয়েছে।
আপা, তুমি এখন যে-অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছ তাতে আমি নিশ্চিত তোমার স্যার যদি গরুর ভূষি অলিভ ওয়েল রসুন এবং শুকনোমরিচ দিয়ে মেখে এনে বলে— এই জাপানি খাবারের নাম ভূষিও আলিও–তুমি গবগ করে খাবে এবং বলবে তুমি তোমার মনুষ্যজীবনে এরচে ভালো খাবার খাওনি।
আমার খুব ভয় লাগছে আপা। তুমি চলে এস, চলে এসো, চলে এসো।
ফিরোজভাই প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি আগের মতোই হাসিখুশি আছেন, তবে তোমার ব্যাপারে খানিকটা চিন্তিত। সেদিন কথায় কথায় বললেন–তুমি তাকে কোনো চিঠি দাওনি। তুমি তার চিঠির জবাব দিচ্ছ না— এটা কেমন কথা বল তো?
আপা মনে রেখো, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পুরো পরিবার জলে ভেসে যেতে বসেছিল; ফিরোজ ভাই একা সেই ভেসে যাওয়া পরিবার টেনে তুলেছেন।
ভাইয়ার কথা তোমার মনে পড়ে না আপা? আমাদের সবাইকে কী ভালোই না বসিত! ভাইয়া মারা গেছেন— আমরা ভাইয়াকে ভুলেও গেছি। কিন্তু ভাইয়ার এই বন্ধুটি তাকে ভুলেনি। ফিরোজ ভাই মনে কষ্ট পায় এমন কিছু তুমি কখনো করবে না। কখনো না। কখনো না। কখনো না। চিঠি শেষ করার আগে আরো একবার লিখছি— তুমি চাকরি ছেড়ে চলে এসো।
মা তোমার জন্যে শুকনোমরিচের আচার দিয়ে দিয়েছেন। তোমার খাবার জন্যে, তোমার স্যারের খাবার জন্যে না।
আমার কী ইচ্ছা করছে জানো? আমার ইচ্ছা ঐ ভণ্ডটাকে একটা চিঠি লিখে তার ভণ্ডামি দূর করে দি।
তোমার গুরুদেবকে আমি ভণ্ড বলছি, তুমি নিশ্চয়ই রাগে লাফাচ্ছ। রাগে লাফালেও আমার কিছু করার নেই। আমি তাকে ভওই ডাকব। ভণ্ড ভণ্ড ভণ্ড।
ইতি
বীনা।
লীনা সব চিঠিই তিনবার করে পড়ে। প্রথমবার অতি দ্রুত পড়ে। কী পড়ছে বেশিরভাগই মাথায় ঢুকে না। দ্বিতীয়বার ভাবে ধীরেসুস্থে পড়বে। দ্বিতীয়বার প্রথমবারের চেয়েও দ্রুত পড়ে। তৃতীয়বারের পড়াটা ভালো হয়। লীনা তার বোনের চিঠি একবারই পড়ল। পড়ার পর চিঠিটা একপাশে সরিয়ে রেখে কাগজ কলম হাতে নিল। এক্ষুনি বীনাকে চিঠির জবাব দিতে হবে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। বীনাকে চিঠি না-লেখা পর্যন্ত রাগটা কমবে না। সমস্যা একটাই—কী লিখবে কিছু মাথায় নেই। মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।
লীনা লিখল–
বীনা,
তোর চিঠি পড়েছি। খুব ন্যায় কথা লিখেছিস। তারপরেও তোর কথা মানলাম। আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসছি। স্যারকে তুই ভণ্ড বলেছিস। আমি তাতে মনঃকষ্ট পেয়েছি। ভুল বা অন্যায় যা করার আমি করেছি। আমাকে ভণ্ড বলতে চাইলে বলু। উনাকে কেন বলবি?
এই পর্যন্ত লিখে লীনার মনে হল চিঠি লেখার প্রয়োজন নেই। সে তো চলেই যাচ্ছে। আগামীকাল বীনার সঙ্গে দেখা হবে। যা বলার সামনাসামনি বললেই হবে। লীনা চিঠি ছিড়ে ফেলে চাকরি ছেড়ে দেবার বিষয়টা নিয়ে তার স্যারকে লিখতে বসল। রেজিগনেশন লেটার লেখার কিছু নিয়মকানুন আছে। সে ঐসব নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে সে যাবে না। সহজ সরল একটা চিঠি লিখবে। আজই স্যারের হাতে দেবে। স্যার এমন মানুষ যে চিঠি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না।
লীনা লিখল–
শ্রদ্ধেয় স্যার, আমার সালাম নিন। নিতান্তই পারিবারিক কারণে আমি এই চাকরি করতে পারছি না। আমাকে বাড়িতে থাকতে হবে। আপনার সঙ্গে কাজ করা আমার জীবনের আনন্দময় কিছু ঘটনার একটি। আপনি যে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন আমি নিশ্চিত তা আপনি খুব সুন্দরভাবেই শেষ করবেন। এর সঙ্গে আমি শেষপর্যন্ত যুক্ত থাকতে পারব না এটা ভেবেই আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন এই কামনা।
বিনীতা
লীনা।
কোনো বানান ভুল আছে কিনা বের করার জন্যে চিঠিটী লীনা কয়েকবার পড়ল। যদিও বানান ভুল নিয়ে স্যারের তেমন মাথাব্যাথা নেই। বানানভুল নিয়ে হৈচৈ করবে বীনা। স্যার কখনো করবেন না। চিঠি পড়ে স্যার কী করবেন তাও লীনা জানে। তিনি কোনো প্রশ্ন করবেন না। কোনো সমস্যার জন্যে লীনা কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও জানতে চাইবেন না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন— কখন সে যাবে, গাড়ি আছে কি-না এসব জানার জন্যে। চলে যাবার সময় স্যার বলবেন, ভালো থেকো। দুই শব্দের এই বাক্যটি ছাড়া স্যার আর কিছু বলবেন বলে লীনা মনে করে না। না-বলাই ভালো। এরচে বেশি কথা বললে লীনার চোখে অবশ্যই পানি এসে যাবে। সে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে অথচ ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— এটা হবে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ঘটনা। চিঠিটা যে এখনই দিতে হবে এমন কোনো কথা না।
লেখা থাকল। কাল ভোরে স্যার যখন নাশতা খেতে বসবেন তখন সে চিঠি দেবে।
লীনা চিঠিহাতে উঠে দাঁড়াতেই বাবুর্চি হোসেন এসে বলল, আপা স্যার আপনাকে ডাকে।
লীনা বলল, স্যার কোথায়?
হোসেন বলল, ডায়নোসর পার্কে। স্যার আমাকে বলেছেন, আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে।
কী জন্যে জান?
একটা ঘটনা আছে আপা।
চলো যাই।
রাত নটার মতো বাজে। অন্য সময় রাত নটায় ক্যাম্পে প্রচুর আলো থাকে। সারি সারি ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে। আজ কোনো বাতি নেই। শুধু ভঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে– এর বাইরে কোনো আলো নেই। লোকজনও নেই। সব কেমন ফাঁকা।
লীনা বলল, লোকজন সব কোথায়?
ডায়নোসর পার্কে গেছে আপা। ঐখানেই ঘটনা।
কী ঘটনা?
হোসেন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। কী ঘটনা সে বলতে চায় না। লীনা ভাবছে— স্যারের সঙ্গে যেই থাকে সেই স্যারের মতো হয়ে যায়। হোসেন প্রথম যখন কাজ করতে আসে তখন প্রচুর কথা বলত। এখন কথাবলা কমিয়ে দিয়েছে। এখন কোনো প্রশ্ন করলেই অবিকল সারের মতো করে রহস্যময় হাসি হাসার চেষ্টা করে।
ডায়নোসর পার্কের ঝিলের পাশে প্রচুর লোকজন। অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। বিশাল ডায়নোসরগুলিকে কালো পাহাড়ের মতো লাগছে। একজন কে মাঝে মাঝে ডায়নোসরের গায়ে টর্চ ফেলছে, তখন আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে।
হাসান বলল, এখন কেউ টর্চ ফেলবে না।
টর্চের আলো নিভে গেল।
লীনাকে দেখেই হাসান বলল, ম্যাডাম আপনার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছি।
হাসানের কণ্ঠস্বর তরল, আনন্দময়। লীনা চমকে উঠল। কী আশ্চর্য! স্যার তো এমন ভঙ্গিতে কখনো কথা বলেন না। তার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালোও লাগছে। লীনা বলল, স্যার কী হচ্ছে?
হাসান বলল, ম্যাজিক হচ্ছে। এখন আমরা ম্যাজিক দেখব। আমাদের ম্যাজিক দেখাবেন, দি গ্রেট জাদুকর মিজু।
মিজু হাসানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার স্বভাবমতো বিড়বিড় করে কিছু বলল। কেউ তার একটা কথাও বুঝতে পারল না।
হাসান বলল, ডায়নোসরগুলি এখনো কমপ্লিট হয়নি। স্টিল ফ্রেমে কংক্রিট দেয়া হয়েছে। শেপ দাঁড়িয়ে গেছে তবে ফাইন্যাল ফিনিসিং হয়নি। ফিনিশিং হবে, রঙ হবে। মোটামুটিভাবে যে-কাজটা শেষ হয়েছে, তা হল যে জলভূমিতে ডায়নোসর দাঁড়িয়ে আছে সেটা। আলোর ব্যবস্থা করা শেষ। আজকে সবাইকে ডেকেছি ব্যবস্থাটা কেমন পরী করার জন্যে। মিজু আমরা কি শুরু করব?
মিজু আবারো বিড়বিড় করল।
হাসান বলল, ওকে লাইট।
বড় জেনারেটরটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল। হাসানের কথার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু হল। ঘড়ঘড় সঙ্গে বনভূমি কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লীনা তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বকধ্বক করছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ঝিলের অন্ধকার পানিতে হঠাৎ যেন কিছু হল। পানি দেখা যেতে শুরু করল। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল তখন। পানিতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হল। পানি হয়ে গেল গাঢ় নীল। যেন এই ঝিল পার্থিব জগতের না। সত্যি সত্যি মায়ানগরের মাঝিল। গাঢ় নীল পানি পানি থেকে নীলাভ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে ডায়নোসরগুলির গায়ে আলো পড়েছে। ডায়নোসরের ছায়া পড়েছে নীল পানিতে। কী অলৌকিক অবিশ্বাস্য ছবি!
লীনা তাকাল হাসানের দিকে। হাসানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঝিলের গাঢ় নীল রঙের পানি যেমন সুন্দর–হাসানের চোখের পানিও সেরকমই সুন্দর।
হাসান বলল, লীনা কেমন দেখলে?
লীনা বলল, স্যার আমি আমার জীবনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি।
হাসান বলল, শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াবে আমি নিজেও কল্পনা করিনি। পানির রঙ গাঢ় নীল থেকে গাঢ় লাল হবে— এই ব্যবস্থা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখব। এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নীল রঙটাই পারফেক্ট।
আমারো সেরকম মনে হচ্ছে স্যার।
হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পানির রঙ নীল হবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে আমাদের জায়গাটার নাম মায়ানগর। মায়ানগরের পানির রঙ সবুজ হতে পারে, লাল হতে পারে, বেগুনি হতে পারে। পারে না?
জ্বি স্যার পারে।
আবার সোনালি হতে পারে। কি বলো, পারে না?
জ্বি পারে।
সমস্যা কী জানো চোখে অভ্যস্ত না এমন কোনো রঙ ব্যবহার করলে কিন্তু যে এফেক্ট আমরা আশা করছি তা পাব না। পানির নীল রঙ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কাজেই পানির রঙ নীলের কাছাকাছি থাকতে হবে। বলো তোমার এই বিষয়ে কী মত?
লীনা বলল, স্যার আপনি যা বলেন তাই আমার কাছে সত্যি মনে হয়। এখন আপনি যদি বলেন–পানির রঙ কুচকুচে কালো হলে খুব সুন্দর লাগবে। আমার কাছে সেটাই সত্যি মনে হবে।
হাসান বলল, কুচকুচে কালো রঙের পানি দেখে যদি তোমার ভালো না লাগে, তারপরেও কি বলবে আমার কথাই ঠিক?
জ্বি বলব।
কেন বলবে, কোন্ যুক্তিতে বলবে?
তখন আমার মনে হবে, আমার কাছে সুন্দর লাগছে না, কারণ আমার দেখার চোখ নেই।
চলো ফিরে যাই।
চলুন।
ঝিলের পানির রঙ নিয়ে আরেকটা চিন্তা মাথায় এসেছে। চিন্তাটা উদ্ভট, তারপরেও পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
উদ্ভব চিন্তাটা কি আমাকে বলবেন?
না বলব না। লীনা শোননা, আমি
ঢাকায় যাচ্ছি। ইয়াকুব সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। আজ রাতেই দেখা করতে হবে। যত রাতই হোক আমি যেন দেখা করি। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন। আমার টেনশান লাগছে।
কিসের টেনশান স্যার?
ইয়াকুব সাহেব খেয়ালি ধরনের মানুষ। আমাকে যদি বলেন— এই কাজের এখানেই সমাপ্তি। টাকা অনেক বেশি খরচ হয়ে গেছে। আর খরচ করা যাবে না এই নিয়েই টেনশান।
তিনি মাঝপথে কাজ থামিয়ে দেবেন।
তা দিতে পারেন। খেয়ালি মানুষের খেয়াল হল পানির বুদ্বুদের মতো। দেখতে সুন্দর, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। কে জানে তার নাতনী হয়তো খবর পাঠিয়েছে–সে আসবে না।
লীনা বলল, স্যার আপনি শুধুশুধু টেনশান করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইয়াকুব সাহেবকে একবার যদি এনে আপনি ডায়নোসর পার্ক দেখান তাহলেই হবে।
বিয়ের কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে দেখাতে হয়। প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে কিছুই দেখাব না।
শালবনের ভেতর দিয়ে পথ। হাসান আগৈ আগে যাচ্ছে, তার কয়েক পা পেছনে লীনা। হাসানের অভ্যাস অতি দ্রুত হাঁটা। লীনাকে তার সঙ্গে সঙ্গে আসতে কষ্ট করতে হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। হাসানের হাতে টর্চলাইট। টর্চলাইটের খুব আলো। মনে হচ্ছে জাহাজ থেকে জঙ্গলে সার্চলাইট ফেলা হচ্ছে।
লীনা।
জ্বি স্যার।
শালবনের একটা বিশেষ ব্যাপার কি তোমার চোখে পড়েছে?
আমার চোখ খুব সাধারণ। বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়ে না।
জোনাকি চোখে পড়ছে না?
জ্বি স্যার।
অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। জোনাকি বলে যে একটা অপূর্ব ব্যাপার আছে–ভুলেই গিয়েছিলাম। জোনাকি পোকার চাষ করা গেলে ভালো হত। মায়ানগরে কৃষ্ণপক্ষের রাতে হাজার হাজর জোনাকিপোকা জ্বলছে— অপূর্ব দেখাবে না?
জ্বি দেখাবে।
জোনাকিপোকা কোন্ আবহাওয়ায় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে তা জানার চেষ্টা করছি। আমেরিকায় আমার এক বন্ধুকে ই-মেইল করেছি ফায়ার ফ্লাই সম্পর্কে প্রকাশিত সব বই যেন পাঠায়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ। রেস্ট নেবে?
লীনা কিছু বলল না। হাসান দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের টর্চ নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। শালগাছের মাথার উপরে তারাভর্তি আকাশ ঝলমল করছে।
হাসান বলল, লীনা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— তুমি কিছু মনে কোরো না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এই চাকরি ছেড়ে
ঢাকায় চলে যাবার কথা চিন্তা করছ?
লীনা চমকে উঠে বলল, এই কথা কেন বললেন স্যার?
হাসান বলল, আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে এই কথাটা বলছে। অবশ্যি সিক্সথ সেন্স আসলে তো কিছু না–অবচেতন মনের চিন্তা। অবচেতন মন নানান তথ্য সংগ্রহ করে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসে। এই সিদ্ধান্ত চেতন-মনকে জানায়। চেতন-মন হঠাৎ সিদ্ধান্তের খবর জানতে পারে সে ভাবে সিক্সথ সেন্স তাকে খবরটা দিয়েছে।
লীনা কিছু বলল না।
হাসান বলল, লীনা আমি তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি–প্রজেক্টটা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমার পাশে থাকো। চলো রওনা দেয়া যাক।
হাসান আবারো আগের ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে। লীনা এখন আর হাসানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত হাঁটছে না। সে পিছিয়ে পড়ছে। তার জন্যে তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। তার ইচ্ছা করছে অন্তত কিছু সময়ের জন্যে একা হয়ে যেতে। শালবনের ভেতর সে একা একা ঘুরবে। কেউ তাকে দেখবে না।
তাঁবুতে পৌঁছেই হাসানের কাছে
লেখা চিঠিটা লীনা ছিড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলল। এবং তার স্বভাবমতো বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল।
০৭. শোবার ঘরের বারান্দায়
শোবার ঘরের বারান্দায় ইয়াকুব সাহেব বসে আছেন। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসা না। শরীর টানটান করে বসা। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি নেই। হাসাল চিন্তিত বোধ করছে। এমন কিছু কী ঘটেছে যে ইয়াকুব সাহেব তার উপর বিরক্ত? এই মানুষটির সঙ্গে তার তেমন পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে হাসান তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারত-মানুষটা বিরক্ত না-কি বিরক্ত না। বিরক্তি প্রকাশের একটা সাধারণ ভঙ্গি আছে! এই মানুষটাকে ঠিক সাধারণের পর্যায়ে ফেলা যাচ্ছে না।
হাসান, ভালো আছ?
জি ভালো আছি।
লণ্ডভণ্ড শব্দটার ইংরেজি জানো?
কোন্ ধরনের লণ্ডভণ্ড মানসিক লণ্ডভণ্ডের এক ইংরেজি, আবার ঘরবাড়ির লণ্ডভণ্ডের আরেক ইংরেজি।
শুনলাম তুমি আমার জায়গাটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছ?
হাসান চুপ করে রইল। আলোচনা কোনদিকে যাবে সে এখনো বুঝতে পারছে না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, লণ্ডভণ্ড কর বা অন্য কিছু কর কিছুই যায় আসে না–যে সময় তোমাকে বেঁধে দিয়েছি, ঐ সময়ে কাজটা শেষ করতে হবে। পারবে?
পারব।
এটা বলার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি। তুমি আরো কিছু টাকা চেয়েছিলে। পাঠানো হয়নি। চেকটা রেডি করে রেখেছি তোমাকে হাতে হাতে দেবার জন্যে বসে আছি।
থ্যাংক য়্যু স্যার, আপনি কি এর মধ্যে গিয়ে কাজের প্রগ্রেস দেখবেন?
তুমি কি চাও আমি দেখি?
না, চাই না।
চাও না কেন?
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি মায়ানগর বানাচ্ছেন আপনার নাতনীকে চমকে দেবার জন্যে। আমি এটা বানাচ্ছি আপনাকে চমকে দেবার জন্যে। আগেভাগে যদি দেখে ফেলেন, পুরো চমকটা পাবেন না।
শুনেছি তোমার মায়ানগরে অনেক নতুন নতুন ব্যাপার রেখেছ। এর যে-কোনো একটার কথা আমাকে বলো তো। না-যে-কোনো একটা না, তোমার সবচে পছন্দের প্রজেক্টের কথা বলো।
হাসান চুপ করে রইল। কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, হাসান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? ডাক্তাররা আমার জন্যে সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বাড়িতে কোনো সিগারেট নেই। একটা খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি একটা সিগারেট ধরাও। আমি একটা ধরাই।
হাসান সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। ইয়াকুব সাহেব খুবই আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট ধরালেন।
হাসান!
জ্বি স্যার।
তোমার সবচে প্রিয় প্রজেক্টের ব্যাপারটা আমাকে বলো। শুনতে ইচ্ছা করছে।
প্রজেক্টের ব্যাপারটা বলার আগে, একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা শোনার ধৈর্য কি আপনার আছে?
অনেকদিন আমি গল্প শুনি না। শোনাও একটা গল্প। হাসান শোনো, এই সিগারেট শেষ করে আমি কিন্তু আরেকটা সিগারেট খাব।
ইয়াকুব সাহেব ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। হাসান গল্প শুরু করল।
স্যার, আমার একটা ছেলে আছে তার নাম অন্তু। ছেলেটা অন্যরকম। কথাবার্তা খুব কম বলে। কোনো ব্যাপারে মনে কষ্ট পেলে লুকিয়ে একা একা কাঁদে। একদিন কী একটা ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। সে ঠিক করেছে আমার ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়েই তার বাবার বাড়িতে চলে যাবে। আমি বললাম, আচ্ছা চলে যাও। তারা চলে গেল। আমার খুবই মেজাজ খারাপ। কিছুক্ষণ বই পড়লাম, গান শুনলাম। নিজেই কফি বানিয়ে কফি খেলাম। মন ঠিক হল না। আমি বসলাম টিভির সামনে। কুৎসিত একটা প্রেমের নাটক হচ্ছে। মেজাজ খারাপ নিয়ে তাই দেখছি, হঠাৎ কানে আসল অন্তু কাঁদছে। আমি হতভম্ব। টিভি বন্ধ করলাম। অন্তুর কান্নার শব্দ আরো স্পষ্ট হল। আমার শরীর ঘেমে গেল। আমি বুঝলাম আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে। বোঝার পরেও এ-ঘরে সে-ঘরে খুঁজলাম। কান্নার শব্দ হয়, শব্দ শুনে এগিয়ে গেলে আর শব্দ পাওয়া যায় না। তখন অন্য ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে। আমার হাতপা কাপতে শুরু করল। শেষে টেলিফোন করলাম শ্বশুরবাড়িতে। অন্তুর মা নাজমা টেলিফোন ধরল। আমি বললাম, অন্তুকে একটু দাও তো কথা বলি। নাজমা বলল, অন্তুকে দাও তো মানে? অন্তুকে তো আমি আনিনি। সে তো তোমার এখানেই আছে। সে এমন কাঁদতে শুরু করল, বাবার সঙ্গে থাকবে, যে আমি তাকে রেখে চলে এসেছি। ও ঘরেই কোথায় লুকিয়ে আছে। খুঁজে বের করে আমাকে টেলিফোন কর।
আমি অন্তুকে খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করলাম। আমার গল্পটা স্যার এখানেই শেষ। এখন প্রজেক্টের কথাটা বলি।
ইয়কুব সাহেব বললেন, তোমার গল্পটা ইন্টারেষ্টিং। প্রজেক্টের সঙ্গে এই গল্পের সম্পর্ক বুঝতে পারছি না।
স্যার, আমি একটা গোলকধাঁধা বানাচ্ছি। গোলকধাঁধায় যখন কেউ ঢুকবে তখনই সে বাচ্চা একটা ছেলের ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শুনবে। ছেলেটাকে খুঁজে বের করার ইচ্ছা হবে। খুঁজতে শুরু করবে, কিন্তু খুঁজে পাবে না। এক ঘর থেকে আরেক ঘর। একটা বাচ্চাছেলে কাঁদছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দেয়ালে তার হাতের
লেখা আমি হারিয়ে গেছি। কখনো দেখা যাবে একটা ফুটবল পড়ে আছে। ছেলেটাই ফেলে গেছে। এক জায়গায় দেখা যাবে চুইংগামের খোসা। এই হল আমার প্রজেক্ট।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ছেলে অ্যুকে আমি নিমন্ত্রণ করছি। আমার নাতনীকে নিয়ে আমি যখন মায়ানগরে পা দেব তখন অন্তুও থাকবে আমার সঙ্গে থাকে। দুজন থাকবে আমার দুপাশে। হাসান, তুমি আজই তোমার ছেলেকে আমার নিমন্ত্রণ পৌঁছে দেবে।
জ্বি স্যার, আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। রাতটা বাসায় থাকব। অন্তুকে বলব। স্যার উঠি?
আচ্ছা যাও।
একটা সিগারেট রেখে যাচ্ছি স্যার।
থ্যাংক য়্যু।
নাজমা দরজা খুলে দিল। নাজমার মুখ শান্ত। হাসান স্বস্তিবোধ করল। ঘরে ঢুকেই কঠিন মুখ দেখতে ভালো লাগে না। ঘর মানেই আশ্রয়। যিনি আশ্রয় দেবেন তার মধ্যে মায়া থাকতে হবে। প্রতিটি ঘর হবে ছোট্ট একটা মায়ানগর। আশ্রয় যিনি দেবেন তিনি হবেন মায়াবতী।
নাজমা, কেমন আছ?
ভালো। এত রাতে?
ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
না ঘুমাইনি। খাওয়াদাওয়া করে এসেছ, না খাবে?
ভাত খাব। কিছু থাকলে একটা ডিম ভেজে দাও। অন্তু নীতু কেমন আছে?
ভালো আছে।
দুজনই ঘুমুচ্ছে?
হুঁ। তুমি কি গোসল করবে?
হ্যাঁ করব।
ধীরেসুস্থে গোসল কর—এর মধ্যে আমি চারটা চাল ফুটিয়ে ফেলি। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত ছাড়া ডিম ভাজা দিয়ে খেয়ে আরাম পাবে না। তোমার প্রজেক্ট কেমন এগুচ্ছে?
খুব ভালো এগুচ্ছে। একদিন বাচ্চাদের নিয়ে চলো— তাঁবুতে থাকবে, জঙ্গলে ঘুরবে। বিদেশীদের মতো ক্যাম্পিং।
দেখি।
কোনো এক ছুটির দিনে চলো।
আচ্ছা যাব।
হাসান বাথরুমে ঢুকল। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। রাতের খাবারটা আরাম করে খেল। আগুনগরম ভাতের উপর ঘি ছিটিয়ে দেয়া, ডিম ভাজা, শুকনামরিচ ভাজা। হাসানের মনে হল— ঢাকা শহরে এরকম একটা রেস্টুরেন্ট খুব চলবে। রেষ্টুরেন্টের ফিক্সড মেনু–
বিরুই চালের গরম ভাত
গাওয়া ঘি
দেশী মুরগির ডিম ভাজা
শুকনামরিচ ভাজা
ডিম আগেই ভাজা হবে না। ঘি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করলে ডিম ভাজা হবে। কড়াই থেকে চামচে করে এনে সরাসরি পাতে দিয়ে দেয়া হবে।
হাসান খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল। নাজমা তাকে পান এনে দিল। সে নিজে পান খায় না। হাসান দুপুরে এবং রাতে পান খায় বলে তার জন্যে ঘরে পান রাখা হয়।
নাজমা বলল, অন্তুর জ্বর।
হাসান বলল, তবে যে বললে ওরা ভালো।
মাত্র ঘরে এসে ঢুকেছ এই সময় অসুখ-বিসুখের খবর দিলাম না। ওর পায়ে পানিও এসেছে। ডাক্তার সন্দেহ করছেন কিডনি বিষয়ক জটিলতা।
আমাকে খবর দাওনি কেন?
খবর দিলে কী করতে? সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে? না, আসতে। ছেলের জন্যে দুশ্চিন্তা নিশ্চয়ই করতে, কিন্তু আসতে না। ধরো ছেলেকে যদি চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরেও নিয়ে যেতে হয়, আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। তুমি কিন্তু নিয়ে যাবে না।
হাসান চমকে উঠে বলল, দেশের বাইরে নিয়ে যেতে হবে নাকি?
নাজমা বলল, ডাক্তার এমন কিছু বলেননি। তবে তাকে খুব গম্ভীর মনে হল। তিনি বললেন কিডনির অসুখটা ছোটবাচ্চাদের এখন খুব হচ্ছে। অসুখটা ভালো না।
হাসান সিগারেট ফেলে অদ্ভুর কাছে গেল। কেমন অসহায় ভঙ্গিতে সে খাটে শুয়ে আছে। গায়ে বেগুনি রঙের কম্বল। হাসান পাশে বসতেই অন্ত চোখ বড় বড় করে বাবাকে দেখেই ফিক করে হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাসান বলল, জেগে আছিস নাকি রে ব্যাটা?
অন্তু চোখ বন্ধ করেই হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল।
হাসান বলল, কখন ঘুম ভাঙল?
অন্তু বলল, তুমি যখন ঘরে ঢুকেছু তখনই ঘুম ভেঙেছে।
ডাকিসনি কেন?
ইচ্ছা করেনি।
অসুখ বাধিয়েছিস কেন?
জানি না।
ঘরে কোনো ভালো মুভি আছে? ভিসিআরে ভালো কোনো মুভি দেখতে ইচ্ছা করছে। কার্টুন ফান্টুন না, সিরিয়াস ভূতের ছবি। কফিন থেকে ভূত উঠে আসছে–এই টাইপ। আছে?
ঘোস্ট স্টরি আছে। কিন্তু বাবা তুমি ভয় পাবে।
বেশি ভয়ের নাকি?
খুবই ভয়ের।
তাহলে এক কাজ করি, চাদরের নিচে শরীরটা ঢেকে শুধু মাথা বের করে দেখি। ভয় লাগলে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলব। বুদ্ধিটা কেমন?
বুদ্ধিটা খুবই ভালো।
তাহলে উঠে আয়–ছবি দেখব।
মা বকবে না তো বাবা?
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। তারপরেও রিস্ক নিতে হবে। ভালো কথা অন্তু, তোর একটা দাওয়াত আছে।
কিসের দাওয়াত।
মায়ানগরে ঢোকার নিমন্ত্রণ। তুই ঢুকবি আর এক বিদেশী মেয়ে ঢুকবে। মেয়েটার নাম এলেন। তোর বয়েসী। দেখিস আবার যেন মেয়েটার সঙ্গে প্রেম না হয়ে যায়।
ধ্যাৎ বাবা! তুমি সবসময় এত অসভ্য কথা কেন বলো। আমি প্রেমও করব না, বিয়েও করব না।
তুই না করলে কী হবে। মেয়েরা তো করতে চাইবে।
বাবা অসভ্য কথা বলবে না। আমি কিন্তু রাগ করছি।
হাসন চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে। চাদরের ভেতর হাসানের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসেছে অন্তু। ভিসিআরে ভূতের ছবি চলছে।
নাজমা দৃশ্যটা দেখেও কিছু বলল না। তার মন অসম্ভব খারাপ। হাসানকে সে এখনো জানায়নি যে অন্তুকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়েছে। নাজমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারও ইচ্ছা করছে চাদরের নিচে ছেলের পাশে বসে ছবি দেখতে ইচ্ছাটাকে সে আমল দিল না। নাজমা জানে অন্তর একটি ভুবন আছে শুধুই তার বাবাকে নিয়ে। সেই ভূবনে নাজমার প্রবেশাধিকার নেই।
০৮. সুলতানার দাঁতে ব্যথা
সুলতানার দাঁতে ব্যথা।
দাঁতে কোনো ক্যারিজ নেই, কোনো দাত নড়ছেও না, তারপরেও তীব্র ব্যথা। গাল ফুলে গেছে। ব্যথায় তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না।
বীনা বলল, মা তুমি রিকশা করে কোনো একজন ডেনটিস্টের কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার বের হওয়া মানে তিনঘণ্টা সময় নষ্ট। তিন ঘণ্টায় আমি অপটিক্সের একটা চ্যাপ্টার শেষ করতে পারি।
সুলতানা বললেন, তোকে যেতে হবে না। তুই পড়া শেষ কর।
বীনা বলল, মা তুমি রাগ করলে নাকি?
না।
তোমার গলার স্বর কেমন রাগী-রাগী মনে হয়েছে।
সুলতানা বললেন, এত কথা বলিসনা তো বীনা।
বীনা বলল, তুমি শুধু-যে রাগ করেছ তা না— তোমার মনটাও খারাপ হয়েছে। তুমি মনে মনে ভাবছ লীনা কাছে থাকলে আমাকে কখনো বলত না একা একা ডাক্তারের কাছে যেতে। সে অবশ্যই আমার সঙ্গে যেত। মা তুমি এ রকম ভাবছ না?
না আমি এরকম ভাবছি না।
অবশ্যই তুমি এরকম ভাবচ্ছ। কারণ মানুষের স্বভাবই হল তুলনা করা। মানুষ তুলনা করবেই। আচ্ছা মা শোনো, এসো সন্ধা ছটা পর্যন্ত দেখি। আমার ধারণা ফিরোজভাই এর মধ্যে চলে আসবে। যদি না আসে আমি নিয়ে যাব।
আমাকে তোদের কারোরই ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। দরকার মনে করলে আমি নিজেই যাব।
খুবই ভালো কথা মা। তাহলে একটা কাজ কর। রান্নাঘরে যাও। গরম পানি কর, যাতে গরম পানিতে লবণ দিয়ে তুমি গার্গল করতে পার। এইসঙ্গে গরমপানিতে খানিকটা চা-পাতা দিয়ে আমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এসো।
সুলতানা মেয়ের পাশ থেকে উঠে এসে রান্নাঘরে ঢুকলেন। দাঁতে ব্যথা ছাড়াও তাঁর মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। গত সপ্তাহে বড়মেয়ের কোনো চিঠি পাননি। প্রতি সপ্তাহেই তিনি দুটা করে চিঠি পান। গত সপ্তাহে একটা চিঠিও আসল না–এটা কেমন কথা। আজ দুপুরে বিছানায় শুয়েছিলেন, তন্দ্রামতো এসেছে— এর মধ্যে লীনাকে স্বপ্নে দেখেছেন। লীনার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। একটা চোখ বসন্তরোগে নষ্ট হয়ে গেছে। ঠোঁট, জিভ সব কুচকুচে কালো।
স্বপ্নে তিনি আঁৎকে উঠে বলেছেন— কে কে? কুৎসিত মেয়েটা বলেছে— মা আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার বড়মেয়ে। আমার নাম লীনা। বসন্তরোগে আমার চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে মা। তবে এতে আমার খুব ক্ষতি হয়নি। আমি ভিক্ষা করি তো। চেহারা কুৎসিত হয়ে যাওয়ায় ভিক্ষা বেশি পাই। দেখ আমার সারাদিনের রোজগার।
এই বলেই লীনা তার থালা উল্টে দিল। ঝনঝন শব্দে থালা থেকে নানান ধরনের মুদ্রা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
এরকম কুৎসিত স্বপ্নের কোনো মানে আছে? সুলতানা বীনার কাছে গিয়েছিলেন স্বপ্নের কথা বলতে। শেষপর্যন্ত বলেননি। বললে বীনা নানান ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করে দিত— তিনি খুব স্বাভাবিক স্বপ্ন দেখেছেন। এই স্বপ্ন দেখে অস্থির হবার কিছু নেই। মুরগি সদকা দেবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সবসময় যুক্তিতর্ক শুনতে ভালো লাগে না।
সুলতানা রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে আছেন। বড়মেয়ের জন্যে তাঁর খুব মন কাঁদছে। লীনা পাশে থাকলে কোনো অবস্থাতেই তিনি রান্নাঘরে আগুনের পাশে বসতে পারতেন না। তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হত। মেয়ে তারচেয়েও অনেক অস্থির বোধ করত।
সুলতানার ইচ্ছা করছে মেয়ে যেখানে কাজ করছে সেখানে চলে যেতে। মেয়েকে দেখে এলেন। সম্ভব হলে মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন। তাকে নিয়ে যাবে কে? ফিরোজকে বললে সে অবশ্যই নিয়ে যাবে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ যদি ফিরোজ আসে তাহলে তো ভালই–আজ যদি সে না আসে তিনি বাড়িওয়ালার মেয়েকে দিয়ে ফিরোজের অফিসে টেলিফোন করিয়ে তাকে আনাবেন।
বীনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ফিরোজ আজ সন্ধ্যা ছটার মধ্যে আসবে। বীনা যা বলে প্রায় সময়ই সে-কথা ফলে যায়। একধরনের মেয়ে আছে তারা যা বলে তাই ফলে যায়। এইসব মেয়েদেরকে বলে ফলানি। ফলানিরা নিজের জীবনে খুব দুঃখ-কষ্ট করে। সুলতানার প্রায়ই মনে হয়— বীনা বোধ হয় একজন ফলানি।
কাঁটায় কাঁটায় দুটার সময় ফিরোজ এসে উপস্থিত। সে এই বাড়িতে কখনো খালিহাতে আসে না। আজও আসেনি। দশটা বড় সাইজের কৈমাছ এনেছে। এক কেজি বগুড়ার দৈ এনেছে। দুই কেজি শুকনো বড়ই এনেছে।
বীনা পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কোমরে হাত দিয়ে রাগী-রাগী গলায় বলল, ফিরোজ ভাই-আপনি তো জানেন আপা জয়দেবপুরে। তারপরেও এই বাজার আনলেন কেন?
ফিরোজ বলল, তোমাদের জন্যে এনেছি—তোমরা খাবে।
বীনা বলল, আমাদের জন্যে আপনি কিছু আনেননি। আমি কৈ মাছ খাই না। একবার কৈ মাছের ভাজা খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা ফুটেছিল— সেই থেকে কৈ মাছ খাওয়া বন্ধ। আপা আবার কৈ মাছের জন্যে পাগল। আপনি এনেছেন কৈ মাছ। আপার পছন্দের খাবার। বগুড়ার দৈ এনেছেনএটাও আপার পছন্দের খাবার। শুকনো বড়ই এনেছেন যাতে মা আচার বানিয়ে আপাকে পাঠাতে পারে। আপা আচার খায় আমি খাই না।
ফিরোজ উত্তরে কিছু বলতে পারল না। বীনী যা বলছে সত্যি বলছে।
বীনা বলল, যাই হোক আপনার অপরাধ ক্ষমা করা গেল। এখন আপনি দয়া করে মাকে একজন ডেনটিস্ট দেখিয়ে আনুন। আমি পড়া ছেড়ে উঠতে পারছি না। মার দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা।
ফিরোজ বলল, আমি এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি।
বীনা বলল, আপনাকে এক্ষুনি নিতে হবে না। এসেছেন যখন, পাঁচ-দশ মিনিট বসুন। চা খান। শুধু চা ভো মা আপনাকে দেবে না। চায়ের সঙ্গে কোনো-না-কোনো নাশতা মা বানাবে। আমি সেই নাশতায় ভাগ বসাব। আমার প্রচণ্ড খিদে লেগেছে।
সুলতানা ফিরোজের জন্যে বোম্বাই টোস্ট বানাচ্ছেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, তার দাঁতের ব্যথাটা চলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও মনে হচ্ছিল মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে, সেখানে কোনো ব্যথাই নেই–এটা খুবই আশ্চর্যের কথা।
ফিরোজ বীনার সঙ্গে গল্প করছে। বীনার সঙ্গে গল্প করতে ফিরোজ পছন্দ করে। বীনা তার বোনের মতো না। বীনার সঙ্গে অনেক কঠিন কথা খুব সহজেই বলা যায়। অথচ লীনার কাছে বলা যায় না। লীনা কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়। একই পরিবারের দুই মেয়ে, অথচ তাদের মধ্যে কোনো মিলই নেই।
তোমার পরীক্ষা কবে বীনা?
সামনের মাসের ছাব্বিশ তারিখ।
টেনশান লাগছে?
যতটা টেনশান লাগা উচিত ছিল— ততটা লাগছে না।
প্রিপারেশন কেমন?
খুবই খারাপ। মন লাগিয়ে পড়তে পারছি না।
পীর সাহেবের দোয়া বা তাবিজ লাগলে আমাকে বলবে। আমি জোগাড় করে দেব। আমাদের পাড়ায় একজন পীরসাহেব থাকেন, তিনি পরীক্ষাপাসের তাবিজ দেন। পঞ্চাশ টাকা করে হাদিয়া নেন। আমি একশো টাকা দিয়ে ডাবল একশানের একটা তাবিজ নিয়ে আসতে পারি।
আপনাকে তাবিজ আনতে হবে না। আপনি নিজে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে আসবেন। টুকটাক কিছু কাজ করে দেবেন। এতেই আমার উপকার হবে। ফিরোজ ভাই, কাল কী হয়েছে শুনুন— রাত নটার সময় মা বলে কী ঘরে লবণ নেই, মুদির দোকান থেকে লবণ এনে দিবি? চিন্তা করেন অবস্থা।
আমার গ্রামের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে আনিয়ে দেব।
থ্যাংক য়্যু ফিরোজ ভাই।
ফিরোজ বলল, তোমার জন্যে বিরাট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা দেব?
বীনা চিন্তিতমুখে বলল, কী দুঃসংবাদ?
তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবার মতো দুঃসংবাদ।
কী সর্বনাশ!
দুঃসংবাদটা হল— আমি সামনের মাসের ২১ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বিয়ে করছি। ধানমণ্ডিতে উল্লাস নামের একটা কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়েটা হবে। তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবে। বিয়ের দিনের পড়া আর বিয়ের আগে তোমার আপার গায়ে হলুদ যেদিন হবে, সেদিনের পড়া। নিজের বোনের বিয়ে— এই ক্ষতিটা তো তোমাকে সহ্য করতেই হবে।
তাই না?
বীনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই আনন্দের খবরটা কি আপা জানে?
ফিরোজ বলল, জানে না। আমি আগামীকাল জয়দেবপুর যাব। তাকে খবরটা দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।
বীনা বলল, ফিরোজ ভাই আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি, বিয়ের পর আপা হবে এই পৃথিবীর সুখী মেয়েদের একজন।
ফিরোজ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কথা ঠিক না বীনা। আমি প্রতিভাশূন্য সাধারণ একজন মানুষ। আমার জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে কোনো ড্রামা নেই। কোনো একসাইটমেন্ট নেই। আমি আদর্শ স্বামীর মতো দশটা-পাঁচটা অফিস করব। বাজার করব। ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদেরকে রোজ সন্ধ্যায় পড়াতে বসব। খুবই সরল জীবনযাপন। কোনো মেয়ের জন্যেই এই জীবন আদর্শ জীবন না।
সাধারণ মানুষ হতেও প্রতিভা লাগে। সাধারণ হওয়াও কিন্তু খুব কঠিন কাজ।
তোমার কথা শুনে ভালো লাগল বীনা। তোমার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। যাই হোক তুমি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করবে?
কি কাজ?।
বলতে খুব সংকোচবোধ করছি কিন্তু না বলে পারছি না। তুমি কি লীনার স্যার হাসান সাহেবকে একটা চিঠি লিখে দেবে। আমি চিঠিটা তাঁকে দিতাম।
চিঠিতে কি লিখতে হবে?
চিঠিতে কি লিখতে হবে তুমি জান। জান না?
হ্যাঁ জানি।
ফিরোজ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিঠিটা লিখবে খুব গুছিয়ে, যেন চিঠি পড়েই উনি লীনাকে
ঢাকায় পাঠিয়ে দেন।
০৯. টানেলের স্ল্যাভ বসানো হচ্ছে
টানেলের স্ল্যাভ বসানো হচ্ছে।
বিশাল ক্রেন এসেছে। লোহার শিকলে বাঁধা দৈত্যাকৃতি স্ল্যাভ নামানো হচ্ছে। চারদিকে সীমাহীন ব্যস্ততা। লোকজনের হৈ চৈ, ডাকাডাকি। ক্রেনের শব্দের সঙ্গে মিশেছে জেনারেটরের শব্দ। দুটা বড় জেনারেটরই একসঙ্গে চলছে। একটির শব্দেই কানে তালা ধরে যায়, সেখানে দুটা পাওয়ারফুল ইনজিন। লীনা মুগ্ধচোখে দেখছে। এখানে তার কোনো কাজ নেই। তার দায়িত্ব বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করা। সেসব ফেলে সকাল থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচে আনন্দময় কাজটা ক্রেনের চালক করছে। কত উঁচুতে আকাশের কাছাকাছি মানুষটা বসে আছে। সুইচ টিপছে, অমনি সে উপরে উঠছে, নিচে নামছে। বিশাল সব স্লাভ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
কে যেন লীনার কাধে হাত রাখল। লীনা চমকে উঠে পেছনে তাকাল। হাসিমুখে ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। সে কী যেন বলল, কিছুই বোঝা গেল না। মনে হচ্ছে ফিরোজ শুধু ঠোঁট নাড়ছে।
লীনা বলল, তুমি কখন এসেছ?
ফিরোজ হাতের ইশারায় বুঝল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
লীনার মনে হল— বাহ্, বেশ মজা তো! কথা হচ্ছে, কেউ কথা বুঝতে পারছে না। এরকম অবস্থায় যা ইচ্ছা বলা যায়।
লীনা বলল, কাজের সময় তুমি এসেছ কেন? তোমাকে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। আমার খুব বিরক্তি লাগছে।
ফিরোজ আবারও ইশারা করল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ফিরোজ বলল, চলে দূরে যাই। বলেই ইশারায় তবু দেখাল।
লীনার এক পা যেতে ইচ্ছা করছে না। এখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সব ফেলে দিয়ে সে তাঁবুতে চলে যাবে? গুটুর গুটুর করে গল্প করবে? গল্প করার সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। সারাজীবনে অনেক গল্প করা যাবে। এখন কাজ দেখা যাক। এই কাজ সারাজীবন থাকবে না। কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপরেও লীনা রওনা হল।
তাঁবুর কাছ থেকেও জেনারেটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে এখানে কথা বললে শোনা যায়। লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, জান আমাদের সূর্যঘর কমপ্লিট হয়েছে। আমরা অবিকল মরুভূমির মতো তৈরি করে ফেলেছি। ঘরগুলি যে কী সুন্দর হয়েছে। দেখলে ধড়াম করে শব্দ হবে।
ধড়াম করে শব্দ হবে কেন?
ঘরগুলি এতই অদ্ভুত যে দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে, তখন ধড়াম করে শব্দ।
ফিরোজ হেসে ফেলল।
লীনা বলল, হাসবে না। আমি সিরিয়াস। দেখে তুমি যদি অজ্ঞান না হও, আমি ভ্যানগগের মতো কান কেটে তোমাকে দিয়ে দেব।
তোমাদের প্রজেক্ট কি কমপ্লিট নাকি?
আরে না। অনেক বাকি। আমরা টার্গেট থেকে সামান্য পিছিয়েও পড়েছি। রাতদিন কাজ হচ্ছে। আমাদের কারোরই নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
আমি এসে মনে হয় তোমাদের কাজের ক্ষতি করলাম।
তা তো করেছই।
সরি বেশিক্ষণ থাকব না, বিকেল পাঁচটার গাড়িতে চলে যাব।
তুমি বলেছিলে পূর্ণিমা দেখতে আসবে। আসনি কেন?
ফিরোজ বলল, ঢাকা শহরে থেকে কবে পূর্ণিমা, কবে অমাবস্যা এইসব বোঝা যায়। কোন ফাঁকে পূর্ণিমা এসেছে, কোন ফাঁকে চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। লীনা তোমাকে একটা বিশেষ খবর দেবার জন্যে এসেছি।
দাও।
এখানে না। চলো কোনো নিরিবিলি জায়গাতে যাই। সেখানে বলি। চলো তোমাদের সূর্যঘরে যাই।
সূর্যঘরে তো এখন যাওয়া যাবে না। কোনো এপ্রোচ রোড নেই। যেতে হবে টানেলের ভিতর দিয়ে। টানেল এখানো তৈরি হয়নি।
তাহলে চলো তাঁবুর ভেতর যাই। তাঁবুর ভেতরটা নিশ্চয়ই নিরিবিলি।
চলো যাই।
নাশতা জাতীয় কিছু কি পাওয়া যাবে? খুব ভোরে রওনা হয়েছি নাশতা খাওয়া হয় নি। খিদেয় পেটের নাড়িভুড়ি তো হজম হয়েছেই, এখন পেটের চামড়া হজম হওয়া শুরু হয়েছে।
তুমি তাঁবুর ভেতর গিয়ে বোস, আমি নাশতা নিয়ে আসছি।
তোমার স্যার কোথায়? তাঁকে তো দেখছি না।
স্যার ডায়নোসর-পার্কে আছেন। ডায়নোসরের গায়ে বনটাইল করা হচ্ছে। স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন।
বনটাইল কী জিনিস?
রঙ করার একধরনের পদ্ধতি। উঁচু উঁচু দানার মতো হয়ে গায়ে রঙ লাগে। দেখতে চাইলে তোমাকে দেখাব।
অবশ্যই দেখতে চাই, তবে নাশতাটা খেয়ে নেই। খিদে-পেটে ডায়নোসর দেখলে কী হবে জানো? ডায়নোসরগুলিকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হবে। তোমার স্যার নিশ্চয়ই সেটা পছন্দ করবেন না।
তোমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। কারণটা কী বল তো?
কারণ আমার বিয়ে। সামনের মাসের ২১ তারিখ। শুক্রবার বাদ জুম্মা।
লীনা তাকিয়ে আছে। ফিরোজ বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছ। তুমি কি চাও না আমার বিয়ে হোক?
লীনা জবাব দিল না।
হাসান বলল, তুমি না চাইলে বিয়ে করব না। এইভাবে তাকিয়ে থেকো না, খাবার নিয়ে এসো। ভালো কথা, তোমার মা তোমার জন্যে কৈ মাছ বেঁধে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। দুপুরে এই কৈ মাছ খেতে হবে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে দুপুরে এই কৈ মাছ তাঁর কন্যার সামনে বসিয়ে খাওয়াতে হবে। কন্যা মাছ খেয়ে কেমন তৃপ্তি পেয়েছে সেটা আমাকে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। হোসেন আলি ভালো নাশতার আয়োজন করেছে। পরোটা, মাংস, বুটের ডাল, ডিমের ওমলেট। এর সঙ্গে আছে টোস্ট, মাখন, এক কাপ দুধ, একটা কলা।
ফিরোজ বলল, কী সর্বনাশ! তোমার স্যারের ব্রেকফাস্ট ভুল করে আমাকে দিয়ে দিয়েছে।
লীনা বলল, স্যার সকালে এক কাপ চা আর একটা টোস্ট খান। ভালো ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আমাদের এখানে গেস্টদের জন্যে থাকে।
ফিরোজ বলল, মুখটা এমন কঠিন করে ফেলেছ কেন লীনা? আমি তো তোমার স্যারের প্রসঙ্গে এখনো খারাপ কিছু বলিনি।
বলতে ইচ্ছা করলে বলো। কোনো সমস্যা নেই।
তুমি একটু সহজ হও তো। তোমার সঙ্গে দেখি হালকা ঠাট্টা-তামাশাও করা যায় না। এখন বলো সামনের মাসের একুশ তারিখে তোমার কি কোনো প্রগ্রাম আছে? বিয়েতে কনে উপস্থিত না থাকলে তো সমস্যা। অবশ্যি মোবাইল টেলিফোন আছে। কবুল কবুল মোবাইল টেলিফোনেও বলতে পারবে।
লীনা বলল, এই প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যেতে পারব না।
প্রজেক্ট শেষ হবে কবে?
জুন মাসের আট তারিখে। জুন মাসের নয় তারিখে ওপেনিং।
জুন মাসের আট তারিখ পর্যন্ত তোমাকে এখানে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে?
হ্যাঁ। আট না, নয় তারিখ পর্যন্ত। ওপেনিঙে আমি থাকব।
তোমার স্যার একদিনের জন্যেও ছুটি দেবেন না?
চাইলে দেবেন। কিন্তু আমি ছুটি নেব না।
কেন?
প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে আমি বিয়ের ঝামেলায় যাব না।
বিয়েটাকে তোমার এখন ঝামেলার মতো মনে হচ্ছে?
তোমার সঙ্গে আমি কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না। এখানে সবাই রাতদিন পরিশ্রম করছে আর আমি বিয়ে করে শাড়ি গয়না পরে বউ সেজে বসে থাকব, তা কেমন করে হয়?
হয় না তাই না?
না, হয় না।
ফিরোজ নাশতা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। তুমি যেমন কঠিনচোখে তাকিয়ে আছ, বলার সাহস পাচ্ছি না। চোখের দৃষ্টি একটু নরম কর— আমি নতুন একটা প্ল্যানের কথা বলি।
লীনা চুপ করে রইল। কেন জানি হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। সামনে বসে-থাকা মানুষটাকে অসহ্য বোধ হচ্ছে। নিজের উপর রাগ লাগছে। সে সব কাজকর্ম ফেলে তাঁবুতে বসে মজা করে গল্প করছে। তার উচিত সাইটে চলে যাওয়া।
ফিরোজ বলল, আমার বুদ্ধিটা হচ্ছে–চলো আমরা দুজন একসঙ্গে তোমার স্যারের কাছে যাই। তাঁকে বলি— হে মহামান্য গুরুদেব। আপনি আমাদের দুজনের প্রতি সামান্য দয়া করুন। একটা কাজি খবর দিয়ে এখানে নিয়ে আসুন। আমরা বিয়ে করে ফেলি। এটা একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। প্রজেক্টের লোকজন এতই ব্যস্ত যে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তাদের সাইটে করতে হচ্ছে।
তোমার শস্তা ধরনের রসিকতার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে। আমি এখন কাজে যাব।
আমি কী করব?
তুমি বিশ্রাম করতে চাইলে বিশ্রাম কর। ঘুরে দেখতে চাইলে ঘুরে দেখ।
তুমি কি সত্যি আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
একুশ তারিখে আমি তাহলে বিয়েটা করতে পারছি না?
না।
তোমাকে একটা আংটি দিয়েছিলাম। আংটিটা দেখছি না। ফেলে দিয়েছ নাকি?
হীরার আংটি ফেলে দেব কেন? কী বলছ তুমি! আংটি পরে কাজ করতে অসুবিধা হয়। এইজন্যে খুলে রেখেছি।
তোমাদের এখানে কি দুপুরের দিকে কোনো গাড়ি যায়?
না।
দুপুরে গাড়ি গেলে দুপুরে চলে যেতাম।
দুপুরে কোনো গাড়ি যায় না।
শেষ গাড়িটা
ঢাকায় কখন যায়?
রাত দশটায়।
তাহলে একটা কাজ করি, রাত দশটার গাড়িতেই যাই। এই সময়ে তোমার যদি মন বদলায় সেটাও দেখে যাই! এমনও তো হতে পারে রাত দশটার সময় তুমি ঠিক করলে আমার সঙ্গে চলে যাবে। তখন তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম।
লীনা বলল, আমি যাচ্ছি। কোনো কিছুর দরকার হলে হোসেনকে বলবে। ও ব্যবস্থা করবে।
ফিরোজ বলল, তোমাদের এখানে নাপিত আছে? সময়ের অভাবে সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে পারছি না। এখন যখন কিছু ফ্রি টাইম পাওয়া গেছে-~~ ফ্রি টাইমটা কাজে লাগাই। হেয়ার কাট পাস মাখা ম্যাসাজ। নাপিত আছে?
লীনা বলল, নাপিত নেই। তবে হোসেনকে বললে সে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে।
ফিরোজ বলল, তুমি হোসেনকে বলে যাও আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।
নাপিত খবর দিয়ে আনার জন্যে ফিরোজের হোসেনকে দরকার নেই। হোসেনকে দিয়ে সে স্যারের কাছে বীনার চিঠিটা পাঠাবে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল বীনার চিঠির প্রয়োজন পড়বে না।
কী
লেখা বীনার চিঠিতে? জানতে ইচ্ছা করছে, আবার জানতে ইচ্ছাও করছে না। হোসেনের হাতে চিঠিটা পাঠানো কি ঠিক হবে? সবচে ভালো হত সে নিজে যদি চিঠিটা নিয়ে যেত। সেটাও সম্ভব না।
ফিরোজ পুরোদিন একা কাটাল। লীনা দুপুরে খেতে এল না। সে নাকি সাইটে খাবে। হোসেন আলি তাঁবুর ভেতর ফিরোজের খাবার দিয়ে গেল। ফিরোজ বলল, হোসেন–চিঠি দিয়েছিলে?
হোসেন বলল, জ্বি।
ফিরোজ বলল, স্যার কি চিঠিটা পড়েছেন?
জানিনা। আমি উনার হাতে চিঠি দিয়া চইল্যা আসছি।
লীনার জন্যে তার মা একবাটি তরকারি পাঠিয়েছিলেন। তরকারিটা গরম করে লীনাকে দিতে হবে।
জ্বি আচ্ছা।
দুপুরের খাওয়ার শেষে ফিরোজ ঘুমুতে গেল। চারদিকের হৈহল্লার মধ্যে ঘুমানো মুশকিল। তবে দীর্ঘ সময় শব্দের ভেতরে বাস করছে বলে শব্দ এখন আর কানে লাগছে না। সে কোথায় যেন পড়েছিল— পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতায় ঘুম ভালো হয় না।
ফিরোজ ঘুমাল মরার মতো। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা। তাঁবুর ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। হোসেন আলি টি-পটে করে চা নিয়ে এসেছে।
হোসেন বিনীত গলায় বলল, এর আগেও দুইবার আসছি। ঘুমে ছিলেন, ডাক দেই নাই।
ফিরোজ বলল, ভালো করেছ। লীনা সাইট থেকে এখনো ফিরে নি?
হোসেন বলল, জি ফিরছেন। স্যারের তাঁবুতে আছেন। চা খাইতেছেন।
আমার এখানে কি এসেছিল?
বলতে পারি না।
বিকেল পাঁচটার গাড়ি কি চলে গিয়েছে?
অনেক আগে গেছে। অখন বাজে ছয়টা।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা দেখি তো হোসেন মিয়া—তোমার কেমন বুদ্ধি—এই ধাঁধার উত্তর কি হবে বল।
সংসারে এমন জিনিস কিবা আছে বল
লইতে না চাহে তারে মানব সকল।
কিন্তু তাহা সবে পাবে অতি আশ্চর্য,
বল দেখি বুঝি তব বুদ্ধির তাৎপর্য!
হোসেন তাকিয়ে আছে। মনে হল তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফিরোজ বলল, সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সংসারে একটা জিনিস আছে যা কেউ চায় না। পিতা চায় না, মাতা চায় না, পুত্র-কন্যা চায় না। না চাইলেও সবাইকে সেই জিনিস গ্রহণ করতে হয়। কেউ বাদ যায় না।
বলতে পারব না।
ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা যাও। বলতে না পারলে কী আর করা।
ফিরোজ অন্ধকারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার মাথায় আরো ধাঁধা আসছে। লীনা যখন ছোট ছিল-সেভেন এইটে পড়ত, তখন ফিরোজ তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। লীনা প্রাণপণ চেষ্টা করত ধাঁধার জবাব দিতে। যখন দিতে পারত না তখন কেঁদে ফেলত। নিঃশব্দ কান্না না, ভেউ ভেউ করে বাড়িঘর ঝাঁপিয়ে কান্না। লীনার বড়ভাই সাব্বির ফিরোজের উপর রাগ করত। বিরক্তগলায় বলত, তুই সবসময় ওকে কাঁদাস কেন? জানিস ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে সে কাঁদে। জেনেশুনে কঠিন কঠিন ধাঁধা।
ফিরোজ বলত, ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে কাঁদবে কেন?
লীনা অন্য সবার মতো না। নরম স্বভাবের মেয়ে। এটা মাথায় রাখবি। যেসব ধাঁধার জবাব সে জানে সেসব জিজ্ঞেস করবি। দেখবি জবাব দিয়ে সে কত খুশি হয়। মানুষকে খুশি করার মধ্যে কি কোনো দোষ আছে?
না, দোষ নেই।
কথা দে, তুই কখনো লীনাকে কঠিন কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি না।
আচ্ছা যা কথা দিলাম।
মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
ফিরোজের মনে আছে। লীনাকে সে কখনোই কোনো কঠিন ধাঁধা জিজ্ঞেস করেনি। সমস্যা হচ্ছে যে মেয়ে কঠিন ধাঁধা পছন্দ করে না, সে নিজে ঝাপ দিয়ে কঠিন এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এই ধাঁধার জবাব ফিরোজ ইচ্ছা করলে দিয়ে দিতে পারে। দেয়া ঠিক হবে না। কিছু কিছু ধাঁধার জবাব নিজেকে খুঁজে বের করতে হয়। এমনও হয় যে, খুব সহজ ধাঁধা কিন্তু জবাব খুঁজতে এক জীবন চলে যায়।
লীনা হাসানের সামনে বসে আছে।
হাসান কাপে কফি ঢালছে। এই কাজটা করা উচিত লীনার, কিন্তু সে করতে পারছে না। স্যার কফির পট হাতে নিয়ে নিয়ে কফি ঢালা শুরু করেছেন। সে তো এখন কেড়ে স্যারের হাত থেকে কফিপট নিয়ে নিতে পারে না। লীনা খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
লীনা কেমন আছ বলো।
লীনা নড়েচড়ে বসল। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আজ সারাদিন তো সে স্যারের সঙ্গেই ছিল। ডায়নোসরে কীভাবে রঙ করা হয় দেখছিল। তাঁবুতে সে স্যারের সঙ্গেই এসেছে। স্যার বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো লীনা। কিছুক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি।
তখন থেকেই লীনার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। স্যার তার সাথে কি কথা বলবেন? সে ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। এখন বললেন, লীনা কেমন আছ বলো। লীনা কি বলবে সে ভালো আছে? নাকি চুপ করে থাকবে।
কফি খেতে কেমন হয়েছে লীনা?
ভালো হয়েছে স্যার।
ফিরোজ সাহেব যে এসেছিলেন, উনি কি চলে গেছেন?
পাঁচটার সময় চলে যাবার কথা, হয়তো চলে গেছেন। আমি খোঁজ নিইনি।
হাসান বলল, উনি যাননি। আমি খোঁজ নিয়েছি।
লীনা বলল, তাহলে স্যার উনি রাত দশটায় যাবেন।
হাসান বলল, একটা কাজ কর। তুমি তার সঙ্গে চলে যাও।
লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আমি কোথায় যাব?
তোমার মার কাছে যাবে। সামনের মাসে তোমার বিয়ে। জঙ্গলে পড়ে থাকলে তো হবে না। বিয়ের আগে আগে কত কাজকর্ম আছে।
এখানে এতকিছু হচ্ছে, সব ফেলে আমি বাসায় চলে যাব?
হ্যাঁ যাবে। যে কাজকর্ম এখানে হচ্ছে তাতে তুমি তেমন কোনো সাহায্য করতে পারছ না। তোমাকে বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করতে বলেছিলাম, সেটা কি করেছ? আমি লক্ষ্য করছি এখানে তোমার প্রধান কাজ হচ্ছে সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো। গত পরশু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি সূর্যঘরে বসেছিলে। তাই না?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
লীনা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমরা এত সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাচ্ছি, এসব দেখতে আমার ভালো লাগে।
হাসান কঠিন গলায় বলল, হোসেনের কাছে শুনেছি সপ্তাহখানিক আগে রাত একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তুমি আমার তাঁবুর সামনে রাখা বেঞ্চটায় বসেছিলে। এটা কি সত্যি?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ শেষরাতে উঠে। চাঁদ দেখার জন্যে বসেছিলাম।
তোমার ভাবুর সামনে বসে চাঁদ দেখা যায় না?
যায় স্যার।
তাহলে আমার ভাবুর সামনে বসে ছিলে কেন?
লীনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার আমি আর কোনোদিন বসব না।
হাসান বলল, লীনা কাঁদবে না। তরুণী এক মেয়ে বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— দেখতে ভালো লাগে না। কান্না বন্ধ কর।
কান্না বন্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা লীনা করছে। পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। স্যার তার উপর রাগ করেছেন— এরচে মরে যাওয়া ভালো ছিল। ক্রেন দিয়ে বড় বড় স্ল্যাভ যখন নামাচ্ছিল তখন সে কেন দৌড়ে কোনো একটা স্লাভের নিচে দাঁড়াল না!
লীনা শশানো, তুমি এখানে তেমন কোনো কাজ করতে পারছ না। দীর্ঘদিন তুমি এখানে আছ, এটা খুবই সত্যি। একদিনের জন্যেও ছুটি নিয়ে
ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আমার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না
ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আবার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না তাও সত্যি। তুমি কি বুঝতে পারছ?
পারছি স্যার।
কাজেই তুমি ঢাকায় চলে যাও। মার সঙ্গে থাকো। বিশ্রাম কর। বিয়ের সময় কনের উপর দিয়ে অনেক মানসিক চাপ যায়। কাজেই বিয়ের কনের বিশ্রাম দরকার।
বিয়ের পর আমি কি আবার এসে কাজ শুরু করব?
না। বিয়ের পর জঙ্গলে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। স্বামীর সঙ্গে থাকবে। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি–তুমি কি ইয়াকুব সাহেবের চা-এর কোনো নাম দিয়েছিলে?
জ্বি।
কী নাম?
এখন মনে পড়ছে না স্যার।
ইয়াকুব সাহেব তোমার নামটাই পছন্দ করেছেন। তার জন্যে তুমি নিশ্চয়ই বেশ ভালো এমাউন্টের একটা চেক পাবে। নতুন সংসার শুরু করার সময় টাকাটা কাজে লাগবে। কনগ্রাজুলেশনস।
আমি কি এখন চলে যাব স্যার?
হ্যাঁ।
কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে না?
না।
কয়েক দিন পরে যাই স্যার? নতুন কেউ আসুক, তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যাই। এই কদিন আমি তাঁবুর ভেতর থাকব। তবু থেকে বের হব না।
দায়িত্ব বুঝানোর কিছু নেই। তোমাকে এমন কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে আরেকজনকে বুঝাতে হবে। তুমি আজই যাবে।
জি আচ্ছা যাব। আজই যাব।
যাবার আগে ফিরোজ সাহেবকে আমার কাছে পাঠাবে। তার হাতে আমি একটা চিঠি দিয়ে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
লীনা উঠে দাঁড়াল। তাঁবুর দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
জিজ্ঞেস কর।
জিজ্ঞেস করতে ভয়-ভয় লাগছে স্যার। আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পাই।
ভয় পাবার কিছু নেই। জিজ্ঞেস কর।
অনেক দিন থেকে দেখছি আপনার খুবই মন খারাপ। কেন মন খারাপ স্যার?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, আমার ছেলেটা অসুস্থ। বেশ অসুস্থ। তার মা একা তাকে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি করছে। তার প্রচণ্ড দুঃসময়ে আমি পাশে থাকছি না। এইজন্যেই সারাক্ষণ মনটা খারাপ হয়ে থাকে। লীনা এখন তুমি যাও। আমি কাজ করব। কয়েকটা জরুরি চিঠি লিখতে হবে।
স্যার আপনি একটু সহজভাবে আমার দিকে তাকান। আমি আপাকে খুবই ভয় পাই। আপনি যেভাবে তাকিয়ে আছেন আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে?
লীনা, তুমি যাও তো। এখন তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
হাসানের প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথার ভেতর দপদপ শব্দ হচ্ছে। তার উচিত ব্যথা কমাবার কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। তবে তারও আগে চিঠিটা লিখে ফেলা দরকার। হাসান কাগজ কলম নিয়ে বসল—
কল্যাণীয়াসু বীনা,
তোমার চিঠিটা পড়লাম। এত সুন্দর করে এত গুছিয়ে এর আগে আমাকে কেউ চিঠি লিখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। তোমার কথামতো তোমার অতিপ্রিয় বোনকে
ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম। কাজটি করার জন্যে আমাকে রূঢ় আচরণ করতে হয়েছে। আমি বিষণ্ণ বোধ করছি। মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে আমি অভ্যস্ত না। এই আচরণ লীনার প্রাপ্য ছিল না।
আমি তোমার বোন এবং ফিরোজ সাহেবকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে চাই। আমি চাই না এরা কেউ জানুক গিফটটা কে দিয়েছে। তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। এই ব্যবস্থাটা তুমি অবশ্যই করতে পারবে।
গিফটটা কী তা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলে নেই। আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তারপরেও সাহস করে দুজনের জন্যে ঢাকা–কাঠমুণ্ডুর দুটা রিটার্ন টিকেট কিনে ফেলি। যেন আমাদের দুজনের জীবনের শুরুটা হয় বিশাল হিমালয়ের পাশে। শেষপর্যন্ত আমাদের নেপাল যাওয়া হয়নি। টাকাপয়সার এমন ঝামেলায় পড়লাম যে বলার না। বাড়িওয়ালা তিন মাসের ভাড়া পায়। ভাড়া না দিলে উচ্ছেদ করে দেবে এই অবস্থা। টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে এলাম। এরপর জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি। কিন্তু রাগ করে হাতের কাছেই কাঠমুণ্ডু সেখানে যাই নি। আমি লীনা এবং তার বরকে কাঠমুণ্ডুর দুটা টিকিট, সেখানের সবচে ভালো হোটেলে সাতদিন থাকার ব্যবস্থা করে দিতে চাই। তোমার চিঠি পড়ে মনে হল আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা ভালো না। হয়তো তোমার ধারণা ঠিক। আমি নিজে যে নিজেকে সবসময় বুঝি তা না। তারপরেও বলব মায়ানগর সম্পূর্ণ হলে একবার এসে দেখে যেও। আমার মন বলছে মায়াগর দেখার পরে তুমি বলবে—লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম এত খারাপ তো সে না।
বীনা শোনো, যার ভেতর অন্ধকার থাকে সে আলো নিয়ে খেলতে পারে না। আমি সারাজীবন আলো নিয়েই খেলেছি। তারপরেও আমার ভুল হতে পারে। হয়তো তারাই আলো নিয়ে খেলে যাদের হৃদয়ে গভীর অন্ধকার।
তুমি ভালো থেকো। তোমার চিঠি খুব ভালো হয়েছে। এটা আবারো না বলে পারছি না।
হাসানুল করিম
১০. ডাকে মাদ্রাজ থেকে নাজমার চিঠি
ডাকে মাদ্রাজ থেকে নাজমার চিঠি এসেছে। সংক্ষিপ্ত চিঠি। নাজমা লিখেছে—
প্রিয় অন্তুর বাবা,
সুসংবাদ দিয়ে শুরু করছি। এখানকার ডাক্তাররা অন্তুর অসুখ প্রায় সারিয়ে ফেলেছেন এটা বলা যায়। তার পায়ের ফোলা, মুখের ফোলা কমেছে। একটা কিডনি ফিফটি পারসেন্ট কাজ করতে শুরু করেছে। গতকাল তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরতে বের হয়েছিলাম–সে ভূতের ভিডিও ক্যাসেট কিনবে এবং তোমাকে নিয়ে দেখবে। দোকানদারকে সে বেশ গুছানো ইংরেজিতে বলেছে— ভূতের ছবি দিন। তবে সেই ছবিতে মাকড়সা থাকলে চলবে না। আমার বাবা আবার মাকড়সা খুব বেশি ভয় পায়।
শুধু-যে ভূতের সিডি কেনা হয়েছে তা না, সে যাই দেখছে বলছে–বাবার জন্যে কিনব। তার যন্ত্রণায় এ পর্যন্ত তোমার জন্যে যেসব জিনিস কেনা হয়েছে তা হল–
একজোড়া স্পঞ্জের গাবদা স্যান্ডেল।
একটা লিটল মারমেইডের ছবি আঁকা তোয়ালে।
নীল রঙের নাইলনের ফিতা। এই ফিতাটা নাকি তোমার খুব কাজে লাগবে।
আচ্ছা শোন, কিছু কিছু মানুষকে তুমি কী জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ কর বল তো। তোমার কাছ থেকে আমাকে কৌশলটা শিখতে হবে। আমি পুত্র-কন্যা-স্বামী কাউকেই মুগ্ধ করতে পারিনি।
তোমার মায়ানগরের কাজ আশা করি খুব ভালো হচ্ছে। ঠিক সময়ে শেষ হবে? দিন তো ঘনিয়ে এল।
অন্তু তোমার একটা ছবি এঁকেছে। ছবিটা পাঠালাম–ওর এখন প্রধান কাজ হচ্ছে বাবার ছবি আঁকা।
১১. ফিরোজের জন্যে লীনার খুব মায়া
ফিরোজের জন্যে লীনার খুব মায়া লাগছে।
বেচারা কী বিপদেই না পড়েছে। তার বাড়ির সবাই ঘোষণা করেছে ফিরোজের বিয়েতে থাকবে না। বড় ছেলের বিয়ে অথচ কেউ থাকবে না। কী অদ্ভুত কথা। ফিরোজ পরামর্শের জন্যে বার বার লীনার কাছে ছুটে আসছে। লীনা কী পরামর্শ দেবে? তার কি এত বুদ্ধি আছে। একেকবার ফিরোজ পরামর্শের জন্যে আসছে আর মায়ায় লীনার মনটা ভরে যাচ্ছে।
কম্যুনিটি সেন্টারের উৎসবটা বাতিল করে দেই। কি বল লীনা। সবাই আসবে বাবা-মা ভাই-বোন কেউ আসবে না।
দাওয়াতের চিঠি যাদের দিয়েছ তারা কি করবে?
বাড়ি বাড়ি গিয়ে না করে আসব। একটাই সমস্যা ওদের এডভ্যান্স টাকা যা দিয়েছিলাম সেই টাকাটা মার যাবে।
কত টাকা দিয়েছিলে?
সাত হাজার টাকা।
উৎসব না করলে বেশ কিছু টাকাতো তোমার বেঁচেও যাবে।
তা বাঁচবে।
তোমার যে অবস্থা এখনতো তোমার টাকা দরকার।
ফিরোজ চুপ করে আছে। তার চিন্তিত মুখ দেখে লীনার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে গায়ে হাত দিয়ে বলে এত দুঃশ্চিন্তা করো না। একটা ভালো ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত হবেই।
লীনা?
বল।
আসল সমস্যাতো তোমাকে বলাই হয় নি।
আরও সমস্যা আছে নাকি?
আছে। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে উঠব কোথায়? আগে ঠিক করাছিল–বাবা মার সঙ্গে থাকব। বড় একটা ঘর গুছিয়ে রেখেছি। এখনতো আর সেখানে তোমাকে নিয়ে তোলা যায় না।
তারা কি বলেছেন যে আমি সেখানে যেতে পারব না।
সরাসরি না বললেও আকারে ইংগিতে বলেছে।
হঠাৎ সমস্যাটা হল কেন?
আছে অনেক ব্যাপার। তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।
এত দুঃশ্চিন্তা করোনা তো সব ঠিক হয়ে যাবে।
আপাতত ছোট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করি। কি বল? বেতন যা পাই তা দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা সম্ভব না। কয়েকটা মাস যাক তারপর অন্য ব্যবস্থা হবে। কি বল?
বীনার সঙ্গে পরামর্শ করলে কেমন হয়?
ভালো হয় না। সমস্যাটা আমাদের। সমাধান আমাদের বের করতে হবে।
ঠিক আছে। চল ফ্ল্যাট ভাড়া করি।
ফ্ল্যাট একটা পাওয়া গেছে। সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া। দুটা ঘর-বারান্দা, রান্নাঘর। ফ্ল্যাট লীনার খুবই পছন্দ হয়েছে। এতো ভালো লাগছে ফ্ল্যাট সাজাতে। খাট কেনা, দরজা-জানালার পর্দা কেনা, চেয়ারটেবিল কেনা, রান্নার জন্যে হাড়ি-পাতিল কেনা। একেকবার লীনা দোকানে একেকটা জিনিস কিনতে যায় আর আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসে। ছোট বাচ্চাদের একটা মশারি দেখে তার এত ভালো লাগল। ইচ্ছা করছিল এখুনি কিনে ফেলতে। সেটা কি আর সম্ভব? এখনো বিয়েই হয় নি আর সে কিনবে বাচ্চার মশারি।
ইয়াকুব সাহেবের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা পাওয়া গেছে। টাকাটা লীনার খুব কাজে লেগেছে। তার শখের কিছু জিনিস সে কিনে ফেলেছে। একটা রঙিন টিভি কিনেছে, মিউজিক সেন্টার কিনেছে। ফিরোজের জন্যে সুন্দর সুন্দর কিছু সার্ট-পেন্ট কিনেছে। তারপরেও তার হাতে সতেরো হাজার টাকা আছে। কিছু টাকা হাতে থাকা দরকার। তাছাড়া ফ্রীজ এখনো কেনা হয় নি। স্টেডিয়ামে ফ্রীজের সব দোকান লীনা একা একা ঘুরে এসেছে। নানান রকমের ফ্রীজ আছে, লীনার পছন্দের রঙটা নেই। লীনার পছন্দ লাল রঙ। ঘরের কোণায় টুকটুকে লাল রঙের ফ্রীজ দেখতেই ভালো লাগবে।
বিয়ের ব্যবস্থা সব মোটামুটি ঠিক হয়ে আছে। ফিরোজ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আসবে। কাজীও সঙ্গে করে আনবে। বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর লীনা চলে যাবে তার ফ্ল্যাটে। সে কোনো কাজের লোক রাখবে না। রান্না-বান্না, ঘর গোছানো সব নিজেই করবে। ফিরোজকে বলবে সপ্তাহের বাজার এনে ফ্রীজে রেখে দিতে। নিজের সংসার শুরু করার এত আনন্দ লীনা আগে বুঝতে পারে নি।
বিয়ের উত্তেজনার কিছুই বীনাকে স্পর্শ করছে না। সে ব্যস্ত নিজের পড়াশোনা নিয়ে। লীনা যখন বোনের সঙ্গে গল্প করতে যায় বীনা -কুঁচকে বলে তোমাকে দশ মিনিট সময় দেয়া হল। এই দশ মিনিট আমাকে বিরক্ত করে শপিং-এ চলে যাও। অনেক কিছুই নিশ্চয় কেনার বাকি। চার্জার কিনেছ? কারেন্ট চলে গেলে চার্জার লাগবে।
লীনার ইচ্ছা করে বোনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় গল্প করে। বীনার সময় হয় না। বিয়ের আগের রাতে লীনা বোনের সঙ্গে ঘুমুতে গেল। বীনা বলল, গায়ে হাত না রেখে যদি ঘুমাতে পার তাহলে এসো। একটাই শর্ত গায়ে হাত দেবে না। লীনা বলল, তুই কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে
আছিস?
বীনা বলল, না।
নতুন সংসার নিয়ে আমি বোধ হয় একটু বেশি আহ্লাদী করছি। তাই না?
বেশি আহ্লাদী করছ না। যতটুকু আহ্লাদী করবে বলে আমি ভেবেছিলাম ততটুকুই করছ।
আমার ব্যাপারে তোর হিসাব মিলে যাচ্ছে?
সামান্য গণ্ডগোল হচ্ছে। আমি বলেছিলাম বিয়ের পর তুমি এই পৃথিবীর সুখি মহিলাদের একজন হবে। এখন দেখা যাচ্ছে বিয়ের আগেই হয়ে গেছ?
লীনা তৃপ্তির হাসি হাসল। বীনা বলল, বিয়েতে তুমি তোমার স্যারকে দাওয়াত কর নি?
কোনো উৎসবতো হচ্ছে না। দাওয়াত করবো কি ভাবে।
বিয়ের খবর জানিয়ে একটা চিঠিতে
লেখা যেত।
লীনা কিছু বলল না। বীনা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার স্যারের ছেলেটার খুব অসুখ শুনেছিলাম। অসুখ কী সেরেছে? উনার স্ত্রী কী বিদেশ থেকে ফিরেছেন?
লীনা বলল, জানি না।
বীনা বলল, তোমার স্যারের জন্যে কদিন থেকেই আমার খুব মায়া লাগছে আপা। মায়া লাগা উচিত না। কিন্তু লাগছে। যে মানুষটা একা একা মায়ানগর তৈরি করে তার জন্যতো মায়া লাগবেই। তাই না আপা?
১২. আকাশে বৃষ্টি ও মেঘমালা
জুন মাস। নয় তারিখ।
আকাশ মেঘশূন্য। গতকাল সন্ধ্যায় বেশ কিছুক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে বৃষ্টির আর্দ্রতা আছে। জুন মাসের উত্তাপ নেই।
মায়ানগরের প্রধান ফটক কিছুক্ষণের মধ্যেই খোলা হবে। ফটকের বাইরে ইয়াকুব সাহেব অপেক্ষা করছেন। ইয়াকুব সাহেবের সঙ্গে তাঁর নাতনী এলেন। এলেনের কাঁধে হাভারসেক। হাতে মিকিমাউস বটল। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে স্ট্র লাগিয়ে মাঝে মাঝে বোতলে চুমুক দিচ্ছে। ইয়াকুব সাহেবের দিকে তাকিয়ে সে ইংরেজিতে বলল, আমরা কি কারোর জন্যে অপেক্ষা করছি?
ইয়াকুব সাহেব না সূচক মাথা নাড়লেন। গেটের ডান দিকে তাকালেন। সেখানে অনেক মানুষের জটলা। এলেনের মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু গাড়ি থেমে আছে–আরো গাড়ি আসছে। ইয়াকুব সাহেব বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা বোধ করছেন। তার হার্টে পেসমেকার লাগানো আছে উত্তেজনা তার জন্যে ভালো না। তবু উত্তেজনা কমাতে পারছেন না। এলেন বলল, আমি কি জানতে পারি কেন আমরা ভেতরে যাচ্ছি মা? ইয়াকুব সাহেব নাতনীর প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাসানের দিকে তাকিয়ে তাকে কাছে আসতে ইশারা করলেন। হাসান এগিয়ে এল। ইয়াকুব সাহেব বললেন, থ্যাংক য়্যু, তুমি যথাসময়ে শেষ করেছ।
হাসান কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ছেলেকে আসতে বলেছিলাম। সে কোথায়? আমি বলেছিলাম আমার একপাশে থাকবে এলেন। আরেক পাশে তোমার পুত্র। যতদূর মনে পড়ে তার নাম–অন্তু।
হাসান চুপ করে আছে। ইয়াকুব সাহেবের আনন্দযাত্রায় মৃত্যুর খবর সে দিতে চাচ্ছে না। অন্তু মারা গেছে মাদ্রাজে। কফিনে করে তার মৃতদেহ দেশে এসেছে। হাসান পুত্রের মৃতদেহ দেখতে যায় নি। ইচ্ছা করেনি। সেই সময় সে কাজ করেছে গোলক ধাঁধার। একটা বাচ্চা কাঁদবে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। সুন্দর একটা খেলা। অন্তুও কাঁদছে কেউ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, হাসান আমরা কি ঢুকব?
অবশ্যই স্যার।
তুমি যাচ্ছ না সঙ্গে?
জি না। ভেতরে গাইড আছে সে সব দেখাবে। সবচে ভালো হয়। গাইড ছাড়া যদি নিজে নিজে ঘুরে বেড়ান।
তুমি সঙ্গে যাবে না কেন?
কোনো প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে যাবার পর তার প্রতি আমার আর কোনো উৎসাহ থাকে না।
ইয়াকুব সাহেব কয়েক সেকেন্ড অপলকে হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলেটা ভালো আছে তো হাসান?
হাসান জবাব দিল না।
ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মায়ানগরের বিশাল তোরণ খুলে যাচ্ছে। মাইক্রফোন সিস্টেমে নানান জায়গা থেকে একসঙ্গে ট্রাম্পেটের বাজনা বেজে উঠল। এলেন গেটের ভেতর প্রথম পা দিয়ে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করল–
Oh my God. What is it।
ইয়াকুব সাহেব ঢুকেছেন। তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তিনি গাঢ় স্বরে ডাকলেন–হাসান, হাসান। হাসান কোথায়?
হাসান ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে। সে এখন বাসায় যাবে। বাসায় কেউ নেই। নাজমা মেয়েকে নিয়ে চিটাগাং-এ তার ভাইয়ের বাসায় চলে গেছে। হাসানকে সে খুবই নরম ভাষায় একটি চিঠি লিখেছে। চিঠিতে জানিয়েছে হাসানের সঙ্গে জীবন যাপন করা তার সম্ভব হচ্ছে না। হাসান যেন ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেয় এবং তাকে ক্ষমা করে দেয়। নাজমা লিখেছে–তোমাকে দেখলেই আমার অন্তর কথা মনে পড়বে। অদ্ভু তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও হাত বাড়িয়ে বাবাকে খুঁজেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। বাবা কোথায়? Where is my dad? তুমি তখন ব্যস্ত ছিলে তোমার স্বপ্ন নিয়ে। এই কথা আমি তোমার পুত্রকে বলতে পারি নি। আমি শুধু বলেছি চলে আসবে। যে কোনো সময় চলে আসবে। আমি এইসব স্মৃতির। ভেতর দিয়ে যেতে চাই না। কাজেই তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছি। তুমি কিছু মনে করো না।
হাঁটতে হাঁটতে হাসান আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কে জানে আজও হয়তো বৃষ্টি হবে।
হাসানের ইচ্ছা করছে কোনো জনমানব শূন্য দ্বীপে নতুন কোনো প্রজেক্ট শুরু করতে। দ্বীপটার নাম দেয়া যাক মায়া দ্বীপ। সেই দ্বীপে শুধুই কদম গাছ থাকবে। বর্ষায় ফুটবে কদম ফুল।
কোনো এক আষাঢ় সন্ধ্যায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। হাসান বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কদম বনে ঘুরে বেড়াবে। সে খুঁজে বেড়াবে তার প্রিয় মুখদের। যেহেতু দ্বীপের নাম মায়াদ্বীপ কাজেই খুঁজলেই সব প্রিয়জনদের সেখানে পাওয়া যাবে। তাদের খুব কাছে যাওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের পায়ের শব্দ পাওয়া যাবে। প্রিয় পদরেখা দেখা যাবে। শোনা যাবে তাদের চাপা হাসি। হাসান যখন ডাকবে— বাবা অন্তু তুমি কোথায় গো? তখন কোনো কদম গাছের আড়াল থেকে অন্তু বলবে, আমি এখানে।
হাসান আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে বৃষ্টি ও মেঘমালা।
(সমাপ্ত)