তিনি সহজ গলায় বললেন, পড়তে যা। টিভির সামনে বসে আছিস কেন ? বলেই তিনি মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। মন্টু আবারাে টিভি ছাড়ল। এক্স ফাইলে আজকের গল্পটা খুবই জটিল।
এক লােকের অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব সময় পারে না । ইচ্ছা শক্তি খাটাতে হলে তার আশেপাশে গাছ লাগে। টবে বসানাে গাছ হলেও হয়। ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগানাের পর গাছটা মরে যায়। মন্টু টিভির পর্দার সঙ্গে প্রায় চোখ লাগিয়ে আছে। সাউন্ডটা আরেকটু বাড়াতে পারলে ভাল হত। সেটা ঠিক হবে না।
সুলতানা মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন । শামা বলল, বাবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে ? সুলতানা বললেন, হ্যা ঘুমুচ্ছে। তুমি ভাত খেয়ে নাও। আমি খাব না। ক্ষিধে নেই।
এশা বলল, মা শােন, খেতে যাও। বাবার শরীর খারাপ করেছে বলে বাবা খাচ্ছে না। তাই বলে তুমিও খাবে না এটা কেমন কথা ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ
বললাম না ক্ষিধে নেই।
খেতে বসলেই ক্ষিধে হবে। আমি এত আগ্রহ করে রান্না করেছি তুমি খাবে না এটা কেমন কথা!
তাের বাবা শখ করে মাছটা এনেছে। সরিষা বাটা রান্না হবে বলে সরিষা কিনে এনেছে। সে খেতে পারল না, আর আমি খাব এটাই বা কেমন কথা!
এশা ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলল, না খেয়ে তুমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছ মা ? তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ যে বাবার সঙ্গে তােমার গভীর প্রণয় ?
আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। ক্ষিধে মরে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে বলে খাব না। তােরা ঘুমুতে যা।
সুলতানা চলে গেলেন। শামা এশার দিকে তাকিয়ে বলল, মা এই কাজগুলাে
যে করে, মন থেকে করে, না দায়িত্ব থেকে করে ?
এশা বলল, তােমার বিয়ে হােক, তখন তুমি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। শামা বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেল। এশা বলল, আমরা আজ এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম, ঘুমতাে আসবে না।
আয় শুয়ে শুয়ে গল্প করি । এশা তুই কি একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, বাতি নিভিয়ে গল্প করতে এক রকম লাগে আবার বাতি জ্বালিয়ে গল্প করতে অন্য রকম লাগে ? একই গল্প শুধুমাত্র বাতি জ্বালানাে নিভানাের কারণে দুরকম হয়ে যায় ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ
এশা বলল, মুত্তালিব চাচার কি ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ হয়েছিল ?
শামা বলল, খুব পছন্দ হয়েছে। চেটেপুটে খেয়েছেন। তুই রান্না করেছিস শুনে বলল তােকে একটা মেডেল দেবে। রুপার মেডেল। মেডেলে লেখা থাকবে— দ্রৌপদী পদক।
দ্রৌপদী কি খুব ভাল রাঁধতেন ?
উনার পাঁচটা স্বামী ছিল না ?
এশা হাসছে। শামা বলল, হাসছিস কেন? এশা বলল, বেচারি দ্রৌপদীর কথা ভেবে হাসছি। সে কী বিপদেই না ছিল! পাঁচটা স্বামীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখাতাে সহজ কথা না। একটা স্বামীকেই ভুলানাে যায় না, আর পাঁচ পাঁচটা স্বামী। কোনাে স্বামী হয়ত লাজুক, সে স্ত্রীকে একভাবে চাইবে। আবার কোনাে স্বামী নির্লজ্জ, সে চাইবে অন্যভাবে।
শামা বলল, এশা চুপ করতাে, তাের মুখে এই ধরনের কথা একেবারেই মানাচ্ছে না।
কেন ? তােমার কাছে কি মনে হয় আমি এখনাে ছােট ? ছােটইতাে।
আমি অনেক বড় হয়ে গেছি আপা। যতটা বড় তুমি আমাকে ভাব, আমি তার চেয়েও বড়। তুমি তাে এখনাে বিয়ে কর নি। আমি কিন্তু বিয়ে করে ফেলেছি।
শামা উঠে বসতে বসতে বলল, তার মানে ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ
এশা কিছু বলল না, হাসল। অন্ধকারে তার হাসি শােনা গেল। শামা বলল, এই তুই কি ঠাট্টা করছিস ?
এ রকম ঠাট্টা করবি না। তুই যেভাবে বললি আমার মনে হলাে সত্যি বুঝি কিছু করে ফেলেছিস।
এশা বলল, আমি যা করি খুব চিন্তা ভাবনা করে করি। ইচ্ছা হলাে আর হুট করে ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম আমার বেলায় এ রকম কখনাে হবে না। যদি আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে গােপনে বিয়ে করি তাহলে বুঝতে হবে এটা ছাড়া আমার হাতে অন্য কোনাে পথ খােলা ছিল না।
তুই কি গােপনে বিয়ে করেছিস ?
এখনাে করি নি, তবে... তবে আবার কী ? বিয়ে করব। ছেলেটা কে? এশা হাসল। শামা কঠিন গলায় বলল, হাসি বন্ধ করে বলতাে ছেলেটা কে ? তুমি চিনবে না। খুবই আজেবাজে টাইপের ছেলে। আজেবাজে টাইপ ছেলের সঙ্গে তাের পরিচয় হলাে কীভাবে ? যেভাবেই হােক, হয়েছে। ছেলে করে কী ?
কিছু করলেতাে বলতাম না আজেবাজে টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তােলে।
তার মানে ?
রবীন্দ্র জয়ন্তী করবে তার জন্য চাঁদা তুলবে, নজরুল দিবস করবে তার জন্য চাদা তুলবে, পাড়ায় ক্রিকেট খেলার চাদা, দুঃস্থজনগণের জন্য চাদা। এপাড়ার মানুষদের মাসের মধ্যে দু‘তিনবার তাকে চাঁদা দিতে হয়। যে চাদা দেয় সে হাসি মুখে দেয়, সেও হাসি মুখেই চাঁদা নেয়। চাঁদা তােলা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সে একজন ডিরেক্টর। তার ব্যবহারও অত্যন্ত ভাল। অফিস বসদের ব্যবহার সাধারণত ভাল হয় না। তারা খিটখিটে স্বভাবের হয়। ইনি সে রকম।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ
তুই আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছিস নাতাে?
শামা বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যাচ্ছিল, এশা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যাচ্ছ কোথায়?
শামা বলল, বাবাকে ডেকে তুলি। তাের কথাগুলি তাঁকে বলি।
এশা বলল, বাবার শরীর ভাল না। ঘুমুচ্ছেন। তাছাড়া বাবাকে তােমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। তুমি চুপ করে বিছানায় বস।
সুলতানার শােবার ঘর থেকে কথাবার্তা শােনা যাচ্ছে। দরজা খােলা হলাে । স্বামী স্ত্রী দুজন এক সঙ্গে বেরুচ্ছেন। সাড়াশব্দ পেয়ে এশা এবং শামা ঘর থেকে বের হয়েছে।
এশা বলল, কী হয়েছে?
সুলতানা লজ্জা লজ্জা গলায় বললেন, কাণ্ড দেখ না। তাের বাবা এখন বলছে ভাত খাবে। তার না–কি শরীর ভাল লাগছে। ক্ষুধা হচ্ছে।
এশা বলল, তােমরা খাবার টেবিলে বসাে। আমি খাবার গরম করে আনছি। আবদুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত গলায় বললেন, আমার মনে হয় ফুড পয়জনিং হয়েছিল। বমির সঙ্গে পয়জন সবটা বের হয়ে গেছে। এখন শরীর ফ্রেশ লাগছে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)– হুমায়ূন আহমেদ
এশা খাবার গরম করছে। শামা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। শামা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বােনের দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখ থমথম করছে। শামা বলল, ছেলের নাম কী ?
এশা হালকা গলায় বলল, নামেতাে আপা কিছু যায় আসে না। ওর নাম সলিম হলেও যা, দবির হলেও তা, আবার খলিলুল্লাহ হলেও ঠিক আছে।
আমি মনে হয় ছেলেটাকে চিনতে পারছি। একদিন কলেজে যাবার জন্যে রিকশা পাচ্ছিলাম না, তখন ফর্সামতাে লম্বা একটা ছেলে রিকশা ঠিক করে দিয়ে
আমাকে বলল, আপা উঠুন।
রিকশাওয়ালা কি তােমার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে ? ভাড়া নেবে না কেন ?
এশা হালকা গলায় বলল, রিকশাওয়ালা তােমার কাছ থেকে ভাড়া নিলে বুঝতে হবে মাহফুজ না। মাহফুজ রিকশা ঠিক করে দেবে আর রিকশাওয়ালা ভাড়া নেবে এ রকম হতেই পারে না।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ
ছেলের নাম মাহফুজ ? হ্যা । তুই কি সত্যি সত্যি তাকে বিয়ে করেছিস ? আমার গা ছুঁয়ে বলতাে। প্লিজ।
এশা বিরক্ত গলায় বলল, টেনশনে তােমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। তুমি টেনশন করছ কেন ? টেনশন করব আমি। তােমার এখানে টেনশন করার কিছু নেই।
আমি টেনশন করব না ?
না। আমরা যখন এক সঙ্গে ছিলাম তখন একজন আরেকজনের সমস্যা দেখেছি। এক সঙ্গে থাকার সময় শেষ হয়েছে। তােমার একটা জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। তুমি তােমারটা দেখবে। আমি দেখব আমারটা।
(চলবে)