তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছে প্রতিদিন খুব কম করে হলেও এক থেকে দেড় ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
তিনি হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না কারণ মাস তিনেক হলাে ডান পায়ের হাঁটু বাঁকাতে পারছেন না।হাঁটু বাকাতে মালিশ এবং চিকিৎসা চলছে, কোনাে লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে, হাঁটু শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার আগে সামান্য বাঁকত, এখন তাও বাকছে না। একটা লােহার মতাে শক্ত পা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তিনি নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক বা ইভিনিং ওয়াক করতে পারেন ?
তিনি একটা হুইল চেয়ার কিনেছেন। বেশির ভাগ সময় হুইল চেয়ারে বসে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যান। আবার ফিরে আসেন। সময় কাটানাের জন্যে একটা বাইনােকুলার কিনেছেন। বাইনােকুলার চোখে দিয়ে রাস্তার লােক চলাচল দেখেন। বাইনােকুলার চোখে লাগালেই রাস্তার লােকজন চোখের সামনে চলে আসে। তখন তাদের সঙ্গে গম্ভীর গলায় কথাবার্তা বলেন এই যে চশমাওয়ালা, মাথাটা বাঁকা করে আছেন কেন? ঘাড়ে ব্যথা ? রাতে বেকায়দায় ঘুমিয়েছিলেন?
ভদ্রলােক বাড়িতে একা থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হয় নি বলে পনেরাে বছর আগে ডিভোের্স হয়ে গেছে। তিনি নিজে ডিভাের্সের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের সাত বছর বয়সের একটা মেয়ে আছে। ডির্ভোস হলে মেয়েটা যাবে কোথায় ? কিন্তু মুত্তালিব সাহেবের স্ত্রী হেলেনা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
উকিল এনে ডিভাের্সের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তিনি অন্ন স্পর্শ করবেন না। হেলেনা ডিভাের্সের দু‘বছরের মাথায় আবারাে বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে তাঁর জীবন সুখেই কাটছে বলে মনে হয়। এই ঘরে ছেলে মেয়ে হয়েছে। দুই ছেলে এক মেয়ে। বিস্ময়কর মনে হলেও সত্যি তিনি প্রায়ই তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।
মুত্তালিব সাহেবের একটাই মেয়ে মীনাক্ষি। হেলেনার দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি মীনাক্ষীকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেন। মীনাক্ষীর বয়স তখন আট। সে এমনই কান্নাকাটি শুরু করে যে তিনি নিজেই মেয়েকে তার মা‘র কাছে রেখে আসেন এবং হুঙ্কার দিয়ে বলেন, তােকে যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি তাহলে কিন্তু কাঁচা খেয়ে ফেলব।
আর খবরদার আমাকে বাবা ডাকবি না। গোঁফওয়ালা যে ছাগলটার সঙ্গে তাের মা‘র বিয়ে হয়েছে তাকে বাবা ডাকবি। আমাকে নাম ধরে ডাকবি। মিস্টার মুত্তালিব ডাকবি। ফাজিল মেয়ে। সেই মীনাক্ষী এখন থাকে স্বামীর সঙ্গে নিউ অর্লিন্সে। টেলিফোনে বাবার খোজ খবর প্রায়ই করে। মুত্তালিব সাহেব কখনাে টেলিফোন করেন না।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
কারণ তিনি মেয়ের টেলিফোন নাম্বার বা ঠিকানা জানেন না। কখনাে জানার আগ্রহ বােধ করেন নি। ভদ্রলােক যৌবনে নানান ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। কোনােটিই তেমন জমে নি। জীবনে শেষ বেলায় তার সঞ্চয় অতীশ দীপংকর রােডে দুতলা একটি বাড়ি। তেরশ সিসির লাল রঙের একটা টয়ােটা এবং ব্যাংকে কিছু ফিক্সড ডিপােজিট। এক সময় ভেবেছিলেন ফিক্সড ডিপােজিটের সুদের টাকায় জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন। এখন তা ভাবছেন না। প্রায়ই তাকে মূল সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে।
মুত্তালিব সাহেব শামা মেয়েটিকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। কোনাে এক বিচিত্র কারণে তিনি চান না তার পছন্দের কথাটা শামা জানুক। শামার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি তটস্থ হয়ে থাকেন। তার একটাই চিন্তা অস্বাভাবিক মমতার ব্যাপারটা তিনি কীভাবে গােপন রাখবেন। তার ধারণা এই কাজটা তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবেই করছেন। বাস্তব সে রকম না। শামা ব্যাপারটা খুব ভাল মতাে জানে।
বিকেলে শামাকে দোতলায় উঠতে দেখে তিনি ধমকের গলায় বললেন, টেলিফোন করতে এসেছিস? তােকে একশবার বলেছি এটা পাবলিক টেলিফোন না।
শামা বলল, টেলিফোন করতে আসি নি। আপনার পায়ের অবস্থা জানতে এসেছি। পায়ের অবস্থা কী ? হাঁটু কি বাঁকা হচ্ছে না আগের মতােই আছে ?
মুত্তালিব সাহেব জবাব দিলেন না। শামা বলল, এরকম রাগী রাগী মুখ করে বসে আছেন কেন ?
মুত্তালিব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মাথা ধরেছে। তুই কথা বলিস নাতাে। তাের ক্যানক্যানে গলা শুনে মাথা ধরা আরাে বেড়ে যাচ্ছে। তুই যে জন্যে এসেছিস সেটা শেষ করে বিদেয় হ।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আমি কী জন্যে এসেছি ?
টেলিফোন করতে এসেছিস। তৃণা না কতগুলি মেয়ে বান্ধবী ভাল জুটিয়েছিস। বেয়াদবের এক শেষ।
আপনার সঙ্গে কী বেয়াদবি করল ? রাত সাড়ে এগারােটার সময় টেলিফোন করে বলে, আপনাদের একতলায় যে থাকে, শামা নাম, তাকে একটু ডেকে দিনতাে। কোনাে স্লামালাইকুম নেই। কিছু নেই।
আপনি কী করলেন? খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন? আমি বললাম, রাত সাড়ে এগারােটা বাজে— এটা আড়ার সময় না ঘুমাতে
যাবার সময়। বিছানায় যাও— ঘুমাবার চেষ্টা কর।
এটা বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন ?
খট করে রাখলাম না, যেভাবে রাখতে হয় সেভাবেই রাখলাম। তুই দুনিয়ার মানুষকে আমার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছিস এটা ঠিক না।
আর দেব না। যাদেরকে দিয়েছিস তাদের বলে দিবি কখনাে যেন এই নাম্বারে তােকে খোজ করে।
আচ্ছা বলে দেব। আপনি দয়া করে রাগে দাঁত কিড়মিড় করবেন না। আপনার ফলস দাত খুলে পড়ে যাবে।
শামা হাসছে। মুত্তালিব সাহেব ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটা খুবই সুন্দর করে হাসছে। দেখলেই মায়া লাগে। মুত্তালিব সাহেবের এখন বলতে ইচ্ছে করছে— শামা শোন, তার বন্ধুদের বলিস টেলিফোন করতে। আমি তােকে ডেকে দেব।
শামা বলল, চাচা, ডাক্তার যে আপনাকে বলেছে দেয়াল ধরে হাঁটতে, আপনি কি হাঁটছেন?
আসুন আমার হাত ধরে ধরে হাঁটুন। প্রতিদিন আমি আধঘণ্টা করে আপনাকে হাঁটা প্র্যাকটিস করব।
তার বদলে আমাকে কী করতে হবে ?
তার বদলে আপনি আমাকে আধঘণ্টা করে টেলিফোন করতে দেবেন। ঠিক আছে চাচা?
, ঠিক নেই। আজ বিকেলে তােদের এখানে কে এসেছিল ? খাতাউর সাহেব এসেছিলেন। খাতাউরটা কে ?
এখনাে কেউ না তবে ভবিষ্যতে আমার হাসবেন্ড হয়ে আসরে নামতে পারেন। সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
মুত্তালিব সাহেব হুইল চেয়ারে সােজা হয়ে বসলেন। কনে দেখার মতাে বড় একটা ব্যাপার ঘটেছে অথচ কেউ তাকে খবর দেয় নি! খবর পাঠালে তিনি কি উপস্থিত হতেন না? হাঁটুতে সমস্যা তাই বলে হাঁটাহাঁটিতে পুরােপুরি বন্ধ না।
ছেলে কী করে? বাবার অফিসে চাকরি করে।
দেশ কোথায় ? দেশ হলাে বাংলাদেশ। কোন জেলা, গ্রামের বাড়ি কোথায় ? জানি না। ছেলের নাম কি সত্যি খাতাউর ? জ্বি না। ভাল নাম আতাউর তবে সব মহলে খাতাউর নামে পরিচিত।
শামা আবারাে হাসছে। মুত্তালিব সাহেব শামার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে আছেন। হাসি খুশি এই মেয়েটা বিয়ের পর নিশ্চয়ই তার কাছে আসবে।
সহজ ভঙ্গিতে গল্প করবে না।
চাচা!
আমি কি আজ শেষবারের মতাে আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি? আমার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই খবরটা বন্ধুদের দেব। | মুত্তালিব সাহেব শার্টের পকেট থেকে টেলিফোনের চাবি বের করে দিলেন। তিনি তাঁর টেলিফোন সব সময় তালাবন্ধ করে রাখেন।
শামা সবসময় খুব আয়ােজন করে টেলিফোন করে। টেলিফোন সেটের পাশেই ইজি চেয়ার। সে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। টেলিফোন সেটটা রাখে নিজের কোলে। কথা বলার সময় তার চোখ থাকে বন্ধ। চোখ বন্ধ থাকলে যার সঙ্গে কথা বলা হয় তার চেহারা চোখে ভাসে। তখন কথা বলতে ভাল লাগে।
হ্যালাে তৃণা?
কী করছিলি ? কিছু করছিলাম না। আচার খাচ্ছিলাম। কীসের আচার ? তেঁতুলের আচার। খাবি ? হুঁ খাব।
শামা হাসছে। তৃণাও হাসছে। শামা তার বিয়ের খবরটা কীভাবে দেবে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। তৃণা বলল, ১৭ তারিখের কথা মনে আছে ? মীরার
বিয়ে।
হু মনে আছে।
বাসা থেকে পারমিশন করিয়ে রাখবি। আমরা সারা রাত থাকব। খুব হুল্লোড় করব। জিনিয়া বলেছে সে তার বাবার কালেকশন থেকে এক বােতল শ্যাম্পেন নিয়ে আসবে। দরজা বন্ধ করে শ্যাম্পেন খাওয়া হবে।
(চলবে)