সারারাত থাকতে দেবে না। অবশ্যই দেবে। না দেবার কী আছে ? তুই তাে কচি খুকি না। আমাদের বাসা অন্যসব বাসার মতাে না ।। কোনাে কথা শুনতে চাচ্ছি না। যেভাবেই হােক পারমিশন আদায় করবি। আচ্ছা দেখি।
তুই একটু ধরতাে শামা, আমার হাতের তেঁতুল শেষ হয়ে গেছে। তেঁতুল নিয়ে আসি। এক মিনিট।
শামা টেলিফোন ধরে বসে রইল, তৃণা ফিরে এল না। তৃণার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলে এ ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। তৃণা কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ বলে, ‘এক মিনিট, ধর। আমি আসছি। আর আসে না। তুণা কি এটা ইচ্ছা করে করে ? যাদের সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না তাদের সঙ্গে এ ধরনের ট্রিকস করে।
আবদুর রহমান সাহেব দশটা বাজতেই ঘুমুতে যান। আজ ঘুমুতে গেলেন সাড়ে এগারােটায় । হিসেবের বাইরের দেড় ঘণ্টা কাটালেন টিভি দেখে। কোনাে একটা চ্যানেলে বাংলা ছবি হচ্ছিল। মাঝামাঝি থেকে দেখতে শুরু করেছেন। দেখতে তেমন ভাল লাগছে না, আবার খারাপও লাগছে না। তার ইচ্ছা করছিল স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিয়ে ছবি দেখেন। সেটা সম্ভব হলাে না। মন্টু বলল, তার পরীক্ষা সে টিভি দেখবে না । এশা বলল, সে বাংলা ছবি দেখে না। শামা বলল, তার মাথা ধরেছে। তিনি একা একাই টিভির সামনে বসে রইলেন। সিনেমার গল্পে মন দেবার চেষ্টা করলেন। বড়লােক নায়ক গাড়ি একসিডেন্ট করে অন্ধ হয়ে গেছে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
তার সেবা শুশ্রুষা করার জন্যে অসম্ভব রূপবতী এক নার্স বাড়িতে এসেছে। নার্স ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেছে। অথচ ছেলেটির অন্য এক প্রেমিকা আছে। গল্পে নানান ধরনের জটিলতা। এর মধ্যে নায়কের এক বন্ধু আছে, যার প্রধান দায়িত্ব হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করে লােক হাসানাে। যেমন সে ফ্রিজের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ফ্রিজ থেকে পানির বােতল আনতে গেলে সে নিজেই হাত বের করে বােতল তুলে দেয়। আবদুর রহমান নায়কের বন্ধুর অভিনয়ে খুবই মজা পেলেন। যে ক‘বার তাকে পর্দায় দেখা গেল সে ক‘বারই তিনি প্রাণ খুলে হাসলেন।
শামা মাকে বলল, বাবার বােধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী রকম বিশ্রী করে হাসছে! মা তুমি বাবার মাথায় পানি ঢেলে বিছানায় শুইয়ে দাও।
সুলতানা হাসলেন। শামা বলল, হাসির কথা না মা। আমার সত্যি ভাল লাগছে না।
সুলতানা বললেন, তাের বিয়ে ঠিক হওয়ায় বেচারা খুবই খুশি হয়েছে। খুশি চাপতে পারছে না বলে এ রকম করছে।
আমারতাে মা কোনাে রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। কেরানি টাইপ একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে।
তাের বাবার খুবই পছন্দের ছেলে। মাঝে মাঝে এরকম হয়— কারণ ছাড়াই কোনাে একজনকে মনে ধরে যায়।
কারণ ছাড়া কিছু হয় না মা। সব কিছুর পেছনে কারণ থাকে। মাঝে মাঝে কারণটা বােঝা যায়। মাঝে মাঝে বােঝা যায় না।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
তাের কি ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে ?
তাের বাবাতাে এক্কেবারে বিয়ের তারিখ টারিখ করে ফেলল।
করলেও কোনাে লাভ হবে না। আচ্ছা মা শােন, ওরা যে এক হাজার এক টাকা দিয়ে গেছে এই টাকাটা আমি খরচ করে ফেলি ?
সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শামা বলল, আমার এক বান্ধবীর বিয়ে। তার বিয়েতে উপহার কিনতে হবে।
সুলতানা শামার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের প্রশ্নটা আবার করলেন, ছেলে কি তাের মােটেও পছন্দ হয় নি ?
না হয় নি।
তাহলেতাে তাের বাবাকে বলা দরকার । অপছন্দের একজনকে কেন বিয়ে করবি ?
বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই। যেহেতু আমার পছন্দের কেউ নেই, আমি শেষটায় খাতাউরের গলা ধরে ঝুলে বসতেও পারি। মা শােন, আমি কি ঐ এক হাজার এক টাকাটা খরচ করতে পারি ?
তাের টাকা তুই খরচ করবি এতবার জিজ্ঞেস করার কী আছে ?
আমার ঐ বান্ধবীর বিয়ে হবে উত্তরায়। আমরা সারারাত থেকে খুব হুল্লোড় করব। বাবার কাছে বলে আমার ভিসা করিয়ে রাখবে।
আমি কিছু বলতে পারব না। তুই নিজে বলবি। তাের বাবা রাজি হবে
বলে আমার মনে হয় না। আর শােন তুই তাের বাবার সঙ্গে কথা বলে তারপর ঘুমুতে যা।
কেন ?
তুই বাড়িওয়ালার বাসায় ছিলি, তাের বাবা কয়েকবার তােকে খোজ করেছে। মনে হয় কিছু বলবে।
বাবা খেজুরে আলাপ করবে। খেজুরে আলাপ আমার একদম পছন্দ না। এইভাবে কথা বলছিস কেন— ছিঃ! খালি হাতে বাবার সামনে যেতে পারব না। পান টান কিছু দাও নিয়ে যাই।
সুলতানা বললেন, এক কাজ কর। তাের বাবা যে শাড়িটা এনেছে এটা পরে যা । তাের বাবা খুব খুশি হবে।
শামা হাই তুলতে তুলতে বলল, বাবা এম্নিতেই খুশি আছে। আরাে খুশি করার দরকার নেই। বেলুনে বেশি বাতাস ভরলে বেলুন ব্রাস্ট করে। বাবা এখন ব্রাস্ট করার পর্যায়ে চলে গেছেন।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
শামা খিলখিল করে হাসছে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের হাসি দেখছেন।
আবদুর রহমান মশারির ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন। বড় মেয়েকে দেখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। শামা বলল, বাবা তােমার জন্যে পান এনেছি।
আবদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, পানতাে আমি একবেলা খাই। শুধু দুপুরে ভাত খাবার পর। যাই হােক, এনেছিস যখন খেয়ে ফেলি। সমস্যা একটাই— আবার দাঁত মাজতে হবে। চলে যাচ্ছিস না–কি? বােস, পান খেতে খেতে গল্প করি।
শামা বসল না। দাঁড়িয়ে রইল। বসলেই বাবা দীর্ঘ কথাবার্তা শুরু করতে পারেন। বাবাকে এই সুযােগ কিছুতেই দেয়া যাবে না। শামার মনে হলাে বাবার মেজাজ আজ শুধু যে ভাল না, অস্বাভাবিক ভাল। বান্ধবীর বিয়েতে সারা রাত কাটাবার অনুমতি নিতে হলে আজই নিতে হবে। এ রকম সুযােগ আর পাওয়া যাবে না।
আবদুর রহমান পান মুখে দিয়ে বললেন, এশার কাছে একটা টেলিফোন নাম্বার আছে। আতাউরের নাম্বার। যদিও বিয়ের আগে মেলামেশা মােটেও বাঞ্ছনীয় না, তারপরেও বিশেষ কিছু যদি জানতে চাস
শামা বলল, কিছু জানতে চাই না।
আবদুর রহমান বললেন, বিয়ে শাদি পুরােপুরি ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক খোজ খবর করে বিয়ে দেবার পর দেখা যায় বিরাট ঝামেলা। স্বামী তেল আর
স্ত্রী জল। ঝাকাঝাকি করলে মিশে আবার ঝাকাঝাকি বন্ধ করলেই তেল জল আলাদা হয়ে যায়।
শামা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আবদুর রহমান হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার মুখ থেকে পানের রস গড়িয়ে শাদা গেঞ্জিতে পড়ছে। থুতনিতে রস লেগে আছে। তিনি তেল জল বিষয়ক কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। কী বলছেন নিজেও বােধহয় জানেন না। শামা ভেবে পাচ্ছে না তার বাবা এত খুশি কেন। রহস্যটা কী! সে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাবা তােমাকে একটা জরুরি কথা চট করে বলে নেই, পরে ভুলে যাব।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আবদুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী কথা?
আমার এক বান্ধবীর বিয়ে। মীরা নাম। উত্তরায় ওদের বাড়ি। আমরা সব বন্ধুরা দল বেঁধে বিয়েতে যাচ্ছি। মীরা বলে দিয়েছে আমাদের সারা রাত থাকতে হবে।
(চলবে)