বৌ-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

বৌ-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

০৫/০৩/২০২২

আজকের কাহিনীর পটভূমিকা ঊনিশ শতকের পাঁচের দশকের কোন একটা বছর। কালের হিসেবে বোঝাই যায় যে সেটা ছিল এমন একটা সময় যে সময়টার কোনকিছুই আমাদের এখনকার সময়ের সঙ্গে মেলে না। যেমন সে যুগে গেরস্ত বাড়ির রান্নাঘরে হেঁসেল থাকত, কিচেন স্ল্যাব নয়; ডাক্তারের সঙ্গে কম্পাউণ্ডার থাকত, রিসেপসনিষ্ট নয়; ভূগোলের দিদিমনির জিওগ্রাফির ম‍্যাম্ হতে তখনও বহু দেরি; খেতে বসে প্রথম পাতে আমরা চচ্চড়ি খেতাম, মিক্সড্ ভেজিটেবল নয়। বহু দিদিমা ঠাকুমারা শীতকালে আর্থারাইটিসে নয়, বাতের ব‍্যাথায় ভুগতন। তেমনই আবার অনেকের দাদু ঠাকুর্দা বিকেলের দিকে ইনডাইজেশনে নয়, অম্বল বা গ‍্যাসের অস্বস্তিতে কাবু থাকতেন; ইত্যাদি ইত্যাদি এবং আরও অনেককিছু। কিন্তু এসবের বাইরে গিয়েও দৈনন্দিন এবং পারিবারিক জীবনযাপনের আঙ্গিক হাজারটা সামাজিক প্রথার মধ‍্যে বহুকিছু সময়ের নিয়ম মেনে আজ হারিয়ে গেছে অথবা ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে। এইরকম হারিয়ে যাওয়া সব প্রথাগুলোর মধ‍্যে একটি মোটামুটি অধুনালুপ্ত প্রথা খুব বেশী করে আমার নজর কাড়ে। সেটা হচ্ছে সেইসময়ের বেশিরভাগ মায়েরা সন্তান প্রসবের প্রাক্কালে বাপের বাড়ি চলে আসত। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের এবং তারও আগের, সবার না হলেও, বেশিরভাগেরই জন্মস্থান কিন্তু মামাবাড়ি।

 

এরকম এক গেরস্ত বাড়ি ছিল আমার মামারবাড়ি। আক্ষরিক অর্থে তিনজন পারিবারিক সদস‍্য। সঙ্গে ঝি, চাকর, গোয়ালা, জলের ভারি ইত‍্যাদি সব মিলিয়ে আরও জনা চার পাঁচ। দাদুর মক্কেল টক্কেল মিলিয়ে আরও কয়েকজন। এবং জনা তিন-চার পার্মাণেণ্ট অথবা সেমিপার্মাণেণ্ট দূরদূরান্তের আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল আত্মীয় পরিজন। এককথায় বলতে গেলে ভরাট গেরস্ত বাড়ি। সাধারণ দিনগুলোর দুপুরে নিয়ম করে পাত পড়ত অন্তত জনা পনেরো কুড়ির।

 

তা আমাদের আজকের গল্পের সেই ঊনিশ শতকের পাঁচের দশকের কোন একটা বছরের ভরা গ্রীষ্মে আমার মা তার বাপের বাড়িতে ছিল, প্রথম সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায়। বাড়িতে কুড়ি-পঁচিশ বছরের পুরনো ঝি আমোদিনি। দোর্দণ্ড প্রতাপশালিনী, একাই-একশ টাইপের  দশভূজা এক জাঁদরেল মহিলা। মা বাপেরবাড়ি পৌঁছনোর পরে বাড়ির সবাইকে মায়ের পরিচর্যার দিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সংসারের পুরো দায়িত্ব আমোদিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

 

এইরকম একটা সময় যখন নতুন আগমনের অপেক্ষায় সবকিছুর ব‍্যবস্থা মোটামুটি সম্পূর্ণ, তখন বলা নেই কওয়া নেই একদিন দুপুরবেলা ভাতটাত খেয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে আমোদিনি মারা গেল। সেই আকূলপাথার দিশেহারা সময়ে খড়কুটোর মতো কোথা থেকে যেন ভেসে এসেছিল বৌ। আমাদের আজকের গল্প এখানেই শুরু।

 

আমার মামারবাড়ীর শেষ স্থায়ী ঝি ছিল বৌ। আমাদের সবার কাছে বৌ, আর বাইরের লোকের কাছে ছলোর মা। একটানা বছর তিরিশ কাটিয়েছিল, আক্ষরিক অর্থেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত‍্য।

 

রং ময়লা, ছোটখাটো গাট্টাগোট্টl চেহারার মানুষ। পরনে সবসময় মোটা কাপড়ের সরু পাড় সাদা শাড়ি, ঋতু নির্বিশেষে কনুই পযর্ন্ত হাতঅলা ঢিলেঢালা গলাবন্ধ ব্লাউজ, ডান হাতে পেতল বা ঐ জাতিও কিছুর তৈরী সরু একটা ক্ষয়াটে চুড়ি এবং মাথায় কখনো না নেমে যাওয়া আধ-ঘোমটা। খুব ভোরবেলা রকের সিঁড়িতে ঝাঁট পড়ার আওয়াজে আমরা বুঝতে পারতাম বৌ কাজে এসেছে। বাড়ী যেত সন্ধ্যের শাঁখ বাজার পরে। ওইটুকু চেহারার একটা মানুষ ওই প্রকাণ্ড  তিনতলা বাড়ীটা (যেটার গল্প আগে বলেছি) কীভাবে  দিনের পর দিন ঝাঁট দিয়ে ধুয়েমুছে পরিষ্কার রাখত সেটা আজও আমাকে অবাক করে। তার সঙ্গে ছিলো বাসনমাজা, কাপড়কাচা, অগুন্তি ফাইফরমাস খাটা এবং গেরস্ত বাড়ির আনুষঙ্গিক আরও হাজারো কাজ।

 

সকালের চা দুটো বাসি রুটি দিয়ে খেত। পাঁউরুটি ছিল একেবারেই অপছন্দের। দিনের শুরুতে মুড়ি খেতে চাইতো না খেতে অনেকটা সময় নষ্ট হয় বলে। অগত‍্যা বাসি রুটি। তারপর সকালের সব কাজকর্ম সেরে বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ সাদা রঙের নীল বর্ডার দেওয়া কানাউঁচু এনামেলের থালায় সরষের তেল দিয়ে মাখা মুড়ি, কাঁচালঙ্কা আর আধ গেলাস চা দিয়ে জলখাবার সারত।  গেলাসভর্তি চা খেত না, কারণ তাতে নাকি ওর ‘গেস’ হত। লুচি পরোটার জলখাবারে বৌএর ঠিক সন্তুষ্টি ছিল না। যেদিন লুচি বা পরোটা থাকত সেইসব সকালগুলোতে খাওয়ার শেষে মুখসুদ্ধির জন‍্য দু’এক মুঠো মুড়ি নিত।

 

বেড়ে ওঠার বয়েসগুলোতে অল্পস্বল্প বদমায়েশিগুলোর জন্যে বৌ আমাদের বকাবকি করত। কিন্তু বিন্দুমাত্র অসভ্যতার গন্ধ পেলে মা’কে বলে দেওয়ার ভয় দেখাত। তাতে কাজও হতো। এত বছর ধরে দেখেছি, বৌকে কখনও সেরকম রেগে যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একমাত্র যখন আমাদের ভাইবোনদের ওপর চড়থাপ্পড় পড়ত তখন অনেক্ষণধরে নিচু স্বরে গজগজ করত নিজের মনে। ওটাই ছিল ওর প্রতিবাদের ভাষা এবং ধরণ।

 

আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ সামাজিক রীতিনীতি, আদবকায়দাগুলো রপ্ত করি প্রধানত চারপাশের মানুষজনকে দেখে বা অনুসরণ করে। সেইভাবেই বৌকে দেখে শিখেছিলাম মানুষের খেতে বসা, খাওয়ার পদ্ধতি, খাবারের প্রতি ব্যবহার এগুলোসব কী ভীষণ মূল্যবান জিনিস। কত অনায়াসে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেত বৌ ঐগুলোকে। জানি না ও নিজে এসব  অনুভব করত কি না। কিন্তু সেটা বোধহয় আলোচ‍্য বা বিবেচ্য নয় এখানে।

 

রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, ভাঁড়ার ঘর, পুজোর ঘর, আঁতুর ঘর, দাদুর অফিসঘর আর পাথুমামার (তার কথা আরেক দিন হবে) ঘর, সবগুলো ছিল একতলায়। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা সবাই দোতলায় চলে যেতাম। নেমে আসতাম শেষ বিকেলে, সন্ধ‍্যের শুরুতে। দাদু থাকত কোর্টে। সারা সকালের বেহিসেবি কোলাহলের পরে নিঃঝুম দুপুরগুলোয় একতলাটা ভরে যেত এক শরীর ভারি করা নিস্তব্ধতায়। সাক্ষী হিসেবে থাকত শুধু বৌ আর মাঝেমধ‍্যে কিছু কাক, শালিক আর চড়াইএর আওয়াজ। ওরা আসত উঠোনে রাখা এঁটো বাসন খুঁটতে। ঐ দুপুরগুলোতে কী অদ্ভুত হয়ে উঠত ওর চালচলন – শান্ত, ধীর, স্থির, ওজন-ভারি পদক্ষেপ। ও তখন এক অন্য বৌ। অনেকটাই আমার চেনা, কিন্তু ঠিক পরিচিত নয়। পরিবেশ যেন অপেক্ষা করত ওর ইচ্ছের, ওর আদেশের। আবহওয়া যেন থমকে থাকতো ওর সান্নিধ্যে, ওর প্রতি সম্ভ্রমে। ওই সময়টুকুর জন্যে আমাদের বৌ হয়ে উঠত স্থান, কাল আর পরিস্থিতির একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী।

 

শীতের দুপুরগুলোতে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর বৌ প্রথমেই একটা আলু আর একটা টমেটো নিভে যাওয়া উনুনের ছাইয়ের মধ‍্যে গুঁজে দিত। তারপর পুকুরঘাটে গিয়ে বাসন মাজতে বসতো। দেখতাম বাসন মাজতে মাজতে বৌ কখনো নিজের সঙ্গে অনর্গল কথা বলছে, আবার কখনো বা গল্প করছে এঁটোকাঁটা খেতে আসা চুনোপুঁটি মাছগুলোর সাথে। আপনমনে বকবক করাটা যদিও বা বুঝতাম, মাছদের সঙ্গে গল্প করাটা মাথায় ঢুকত না আমাদের। আসলে পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারি বাসনমাজার সময়টা ছিল ওর নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার সময়, গল্প করার সময়।

 

বাসনটাসন মাজা শেষ করে, কুঁয়োতলায় চানটান করে, বৌ উনুনের ভেতর থেকে সেই আলু আর টমেটো পোড়া বার করত। সেগুলো লঙ্কা, নুন আর সরষের তেল দিয়ে মেখে, ভাতের থালা নিয়ে, উঠোনের ধারের বারান্দায় এসে বসত; শীতের রোদটা পিঠে নিয়ে, আর তাতে চুলটা এলিয়ে দিয়ে। খাবার থালাটা দিদা সাজিয়ে দিয়ে যেত সেই কানা উঁচু নীল র্বডার দেওয়া সাদা রঙের এনামেলের থালাতে। চূড়ো করে ভাত, আর চার ধারে ভাতের মধ্যেই চেপে চেপে বাটির মত করে গর্ত করে তাতে শাক, তরকারি এইসব।  শুধু ডাল বা ঝোল থাকত বাটিতে, যদিও বাটি জিনিসটা বৌ একেবারে পছন্দ করত না। এরপরে, প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে যেভাবে বৌ দুপুরের খাওয়াটা সারত, জানি না সেটাকেই কবিতা লেখা অথবা ছবি আঁকা বলে কিনা! সেই খাওয়াতে কোন তাড়া থাকত না, কোন হুড়ো থাকত না, খিদের কোন আবেগ থাকত না, পেট ভরানোর কোন তাগিদ থাকত না, অতৃপ্তির কোন জায়গা থাকত না। নিজেকে বড় ভাগ‍্যবান মনে হয় যখন ভাবি এ জিনিস আমি প্রায় সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি, একবার নয়, বহুবার। ‘প্রায়’ কথাটা লিখলাম কারণ বৌয়ের প্রবল অস্বস্তি ছিল খাওয়ার সময় কেউ কাছেপিঠে থাকলে। যখনই দেখতে ইচ্ছে হয়েছে দোতলার সিঁড়ির আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছি।

 

শুনেছি (তবে নিজে পড়িনি, তাই ঠিক বা ভুল জানি না) কোনো একটা উপনিষদে নাকি আছে যে খাওয়াটা হচ্ছে নিজের আত্মাকে ভোগ দেওয়া। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতেই হয় আমি এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি যে তার নিজের আত্মাকে ভোগ দিত, প্রতিদিন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *