সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১

কাটিহারের গঙ্গারাম। 

চাটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে বাইরে কোথাও গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড

ভৌতিক গল্পসমগ্র

বেধে যায়। তাই ছােটমামা সাধাসাধি করলেও সন্ধ্যার পর তাঁর সঙ্গে কোথাও যেতুম না। সে কলকাতায় যাত্রা দেখতেই হােক, কী মেলা দেখতেই হােক। অবশ্য সব সময় দোষটা যে ছােটমামারই, এমন কিন্তু নয়। কোথাও দিনদুপুরে গিয়ে কোনও কারণে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত্রি তাে হতেই পারে। তখন কী আর করা যাবে? 

তেমনই একটা রাতের বিদঘুটে কাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। সেটা গােড়া থেকেই বলা যাক। 

ঠাকুরদা সপ্তাহে তিনদিন দাড়ি কামাতেন। আর তাঁর দাড়ি কামাতে আসত ভােলারাম নরসুন্দর। ভােলারামকে নাপিত বললেই জিভ কেটে সে বলত, ছি-ছি! নাপিত বলতে নেই। নাপিত বললে কী হবে জানাে খােকাবাবু? এই বয়সেই বড়বাবুর। মতাে ভােমার গোঁফদাড়ি গজিয়ে যাবে। আমাকে বলবে নরসুন্দর। কেমন ? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১

এই ভােলারামের অভ্যাস ছিল দাড়ি কামাতে কামাতে গাঁয়ের সবরকম খবর বলা। গাঁয়ের খবর ফুরিয়ে গেলে তখন সে অন্য গাঁয়ের নানারকম খবর বলা শুরু করত। ঠাকুরদা আরামে চোখ বুজে থাকতেন আর হুঁ দিয়ে যেতেন। 

সেবার শরৎকালে এক রােববারের সকালে ভােলারাম ঠাকুরদার দাড়ি কামাতে এসেছে। উঠোনে পেয়ারাতলায় চেয়ারে বসে ঠাকুরদা পা ছড়িয়ে চোখ বুজে আছেন। ভােলারাম অভ্যাসমতাে ঠাকুরদার গালে সাবান মাখাতে-মাখাতে বকবক করে চলেছে।

দাড়ি কামানাে হয়ে গেলে সে ঠাকুরদার গোঁফ ছাঁটতে কঁচি বের করল। তার খবরের এইখানটায় ছিল সিঙ্গিমশাইয়ের ঠাকরুনদিঘির মাছ। জেলেরা জালে একটা দশ কেজি মাছ তুলেছিল। মাছটার লেজের কাছে নাকি সিঙ্গিমশায়ের নাম লেখা। গাঁসুষ্ঠু লােক ভিড় করে দেখতে গিয়েছিল। 

এবার মাছের কথায় আরও কত খবর এসে গেল। গোঁফ ছাঁটা হয়ে গেলে আয়নায় গোঁফ দেখতে-দেখতে ঠাকুরদা বললেন, হে ভােলারাম! এরকম মাছের খবর তাে দিচ্ছ। কিন্তু আজকাল আগের মতাে বড়-বড় খয়রা মাছ দেখি না কেন? বড় খয়রা কেন, ছােট খয়রারও পাত্তা নেই। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১

ভােলারাম বলল,কী যে বলেন বড়বাবু? খয়রার পাত্ত থাকবে না কেন? আর ছােট খয়রা কী বলছেন, এই হাতের মতাে বড়-বড় জ্যান্ত খয়রা বিক্রি হচ্ছে। দোমােহানির হাটে। বিলভাসানাে জল টেনে নিচ্ছে মৌরি নদী। আর নদীর মুখে জাল কাটিহারের গঙ্গারাম পেতে বসে আছে জেলেরা। পেল্লায় সাইজের খয়রা জালে উঠছে।

দেখলে চোখ জ্বলে যাবে বড়বাবু! | ঠাকুরদা চেয়ারে সােজা হয়ে বসে বললেন,বলাে কী হে! শুনেছি দোমােহানিতে হাট বসে বিকেলবেলায়। তিন মাইল মেঠো রাস্তায় পায়ে হেঁটে তােমার পেল্লায় সাইজের খয়রা আনতে যাবে কে? 

ছােটমামা সবে তখন বাড়ি ঢুকছিলেন। তাকে দেখিয়ে ভােলারাম বলল, ওই তাে! নান্টুবাবুকে পাঠিয়ে দিলেই হল। দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবেন। পড়ন্ত বেলায় বিল থেকে মাছ আসতে শুরু করবে। সস্তার তিন অবস্থা বলে কথা আছে। না? দশ টাকা কেজি দর হাঁকতে-হাঁকতে মেছুনিমাসিরা শেষ অবধি পাঁচ টাকায় দর নামাবে। অত খদ্দের কোথা?

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১

  ছােটমামার ডাকনাম নান্টু আর আমার ডাকনাম পুঁটু। ঠাকুরদার হুকুম না মেনে উপায় নেই। ছােটমামা মুখ ব্যাজার করে ঘরে ঢুকলেন। বিকেলে স্কুলের মাঠে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট! আমিও মনমরা হয়ে গেলুম। একা-একা কি খেলা দেখতে ভালাে লাগে? 

 ভােলারাম নরসুন্দর ছুরিকঁচিরুন গুটিয়ে ছােট্ট বাকসােতে ভরে আমার দিকে তাকাল। চোখ নাচিয়ে সে বললে,—পুঁটুবাবু! তুমিও মামার সঙ্গে যেও। দোমােহানির হাটতলায় ম্যাজিকবাজির তঁাবু বসেছে। কাটা মুণ্ডুর খেলা দেখলে তুমি একেবারে অবাক হয়ে যাবে। হ্যা গাে পুঁটুবাবু! দু-চোখের দিব্যি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, কাটামুণ্ডু কথা বলছে। 

ঠাকুরদা সায় দিয়ে বললেন,“বাঃ! এখন তাে পুজোর ছুটি। পুঁটু! নান্টুর সঙ্গে দোমােহানি গিয়ে ম্যাজিক দেখে এসাে। আমি বাড়তি টাকা দেব।… 

পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের পায়ে হাঁটার অভ্যাস তখনও ছিল। এদিকের ললাকে দূরত্ব মাপতে কিলােমিটার বলত না। কিলােগ্রাম বা কেজি অবশ্য চালু হয়েছিল। কিন্তু মাইল বা ক্রোশ কথাটা চালু ছিল।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *