ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ।

হেমকূট ও জয়স্থল নামে দুই প্রসিদ্ধ প্রাচীন রাজ্য ছিল। দুই রাজ্যের পরস্পর ঘোরতর বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে, জয়স্থলে এই নৃশংস নিয়ম বিধিবদ্ধ হয়, হেমকূটের কোনও প্রজা, বাণিজ্য বা অন্যবিধ কার্য্যের অনুরোধে, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিলে তাহার গুরুতর অর্থদণ্ড, অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হইলে প্রাণদণ্ড, হইবেক। হেমকূটরাজ্যেও, জয়স্থলবাসী লোকদিগের পক্ষে, অবিকল তদ্রূপ নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় রাজ্যই বাণিজ্যের প্রধান স্থান। উভয় রাজ্যের প্রজারাই উভয়ত্র বিস্তারিত রূপে বাণিজ্য করিত। এক্ষণে, উভয় রাজ্যেই উল্লিখিত নৃশংস নিয়ম ব্যবস্থাপিত হওয়াতে, সেই বহুবিস্তৃত বাণিজ্য এক কালে রহিত হইয়া গেল।

এই নিয়ম প্রচারিত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরে, সোমদত্ত নামে এক বৃদ্ধ বণিক, ঘটনাক্রমে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়া, হেমকূটবাসী বলিয়া পরিজ্ঞাত ও বিচারালয়ে নীত হইলেন। জয়স্থলে অধিরাজ বিজয়বল্লভ স্বয়ং রাজকার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। তিনি, সবিশেষ অবগত হইয়া, সোমদত্তের দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ পূর্ব্বক কহিলেন, অহে হেমকূটবাসী বণিক! তুমি, প্রতিষ্ঠিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছ, এই অপরাধে আমি তোমার পাঁচ সহস্র মুদ্রা দণ্ড করিলাম; যদি অবিলম্বে এই দণ্ড দিতে না পার, সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড হইবেক।

অধিরাজের আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া, সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে আমার প্রাণদণ্ড করুন, তজ্জন্য আমি কিছুমাত্র কাতর নহি। আমি অহর্নিশ দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করিতেছি; মৃত্যু হইলে পরিত্রাণ বোধ করিব। কিন্তু, মহারাজ! যথার্থ বিচার করিলে, আমার দণ্ড হইতে পারে না। সাত বৎসর অতীত হইল, আমি জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়া দেশপর্য্যটন করিতেছি। যৎকালে হেমকূট হইতে প্রস্থান করি, উভয় রাজ্যের পরস্পর বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল। এক্ষণে পরস্পর যে বিরোধ ঘটিয়াছে, এবং ঐ উপলক্ষে উভয় রাজ্যে যে এরূপ কঠিন নিয়ম বিধিবদ্ধ হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। যদি, প্রচারিত নিয়মের বিশেষজ্ঞ হইয়া, আপনকার অধিকারে প্রবেশ করিতাম, তাহা হইলে আমি অবশ্য অপরাধী হইতাম।

এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া, বিজয়বল্লভ কহিলেন, শুন, সোমদত্ত! জয়স্থলের প্রচলিত বিধি সর্ব্বতোভাবে প্রতিপালন করিয়া চলিব, কদাচ তাহার অন্যথাচরণ করিব না, ধর্ম্মপ্রমাণ এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, আমি অধিরাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছি। সুতরাং জয়স্থলে, হেমকূটবাসী লোকদিগের পক্ষে যে সমস্ত বিধি প্রচলিত আছে, আমি প্রাণান্তেও তাঁহার বিপরীত আচরণ করিতে পারিব না। জয়স্থলের কতিপয় পোতবণিক দুই রাজ্যের বিরোধ ও অভিনব বিধি প্রচলনের বিষয় কিছুমাত্র অবগত ছিল না। তাহারাও, তোমার মত, না জানিয়া হেমকূটের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিল। তোমাদের অধিরাজ, নবপ্রবর্ত্তিত বিধির অনুবর্ত্তী হইয়া, প্রথমতঃ, তাহাদের অর্থদণ্ড বিধান করেন। অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হওয়াতে, অবশেষে তাহাদের প্রাণদণ্ড হইয়াছে। এই নৃশংস ঘটনা জয়স্থলবাসীদিগের অন্তঃকরণে সম্পূর্ণ জাগরূক রহিয়াছে। এ অবস্থায়, আমি, প্রচলিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করিতে পাবি না। অবিলম্বে পাঁচ সহস্র মুদ্র দিতে পারিলে, তুমি অক্ষত শরীরে স্বদেশে প্রতিগমন করিতে পার; কিন্তু আমি তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না; কারণ, তোমার সমভিব্যাহারে যাহা কিছু আছে, সমুদয়ের মূল্য ঊর্দ্ধসংখ্যায় দুই শত মুদ্রার অধিক হইবেক না; সুতরাং সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড একপ্রকার অবধারিত বলিতে হইবেক।

এই সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, সোমদত্ত অক্ষুব্ধচিত্তে কহিলেন, মহারাজ! আমি যে দুঃসহ দুঃখপরম্পরা ভোগ করিয়া আসিতেছি, তাহাতে আমার অণুমাত্রও প্রাণের মায়া নাই। আপনকার নিকট অকপট হৃদয়ে কহিতেছি, এক ক্ষণের জন্যেও আমি বাঁচিতে ইচ্ছা করি না। আপনি সায়ংকালের কথা কি বলিতেছেন, এই মুহূর্ত্তে প্রাণবিয়োগ হইলে, আমার নিস্তার হয়।

ঈদৃশ আক্ষেপ বাক্য শ্রবণে, অধিরাজের অন্তঃকরণে বিলক্ষণ অনুকম্পা ও কৌতূহল উদ্ভূত হইল। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সোমদত্ত! কি কারণে তুমি মরণ কামনা করিতেছ, কি হেতুতেই বা তুমি, জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়া, ক্রমাগত সাত বৎসর কাল দেশপর্য্যটন করিতেছ; কি উপলক্ষেই বা তুমি অবশেষে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়াছ, বল। সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! আমার অন্তর নিরন্তর দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইতেছে; জন্মভূমি পরিত্যাগের ও দেশপর্য্যটনের কারণ নির্দ্দেশ করিতে গেলে, আমার শোকানল শতগুণ প্রবল হইয়া উঠিবেক। সুতরাং, আপনকার আদেশ প্রতিপালন অপেক্ষা আমার পক্ষে অধিকতর আন্তরিক ক্লেশকর ব্যাপার আর কিছুই ঘটিতে পারে না। তথাপি, আপনকার সন্তোষার্থে, সংক্ষেপে আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি। তাহাতে আমার এক মহৎ লাভ হইবেক। সকল লোকে জানিতে পারিবেক, আমি, কেবল পরিবারের মায়ায় বদ্ধ হইয়া, এই অবান্ধব দেশে রাজদণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতেছি; আমার এই প্রাণদণ্ড কোনও গুরুতর অপরাধ নিবন্ধন নহে।

মহারাজ! শ্রবণ করুন, আমি হেমকূটনগরে জন্মগ্রহণ করি। যৌবনকাল উপস্থিত হইলে, লাবণ্যময়ী নাম্নী এক সুরূপা রমণীর পাণিগ্রহণ করিলাম। লাবণ্যময়ী যেমন সৎকুলোৎপন্না, তেমনই সদ্‌গুণ সম্পন্ন ছিলেন। উভয়ের সহবাসে উভয়েই পরম সুখে কালহরণ করিতে লাগিলাম। মলয়পুরে আমার বহুবিস্তৃত বাণিজ্য ব্যবসায় ছিল, তদ্দ্বারা প্রভূত অর্থাগম হইতে লাগিল। যদি অদৃষ্ট মন্দ না হইত, অবিচ্ছিন্ন সুখসম্ভোগে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারিতাম। মলয়পুরে আমার যিনি কর্ম্মাধ্যক্ষ ছিলেন, হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়াতে, তত্রত্য কার্য্য সকল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল। শুনিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইলাম এবং, সহধর্ম্মিণীকে গৃহে রাখিয়া, মলয়পুর প্রস্থান করিলাম। ছয় মাস অতীত না হইতেই, লাবণ্যময়ী, বিরহবেদনা সহ্য করিতে না পারিয়া, তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং অনধিক কাল মধ্যেই অন্তর্বত্নী হইয়া, যথাকালে দুই সুকুমার যমজ কুমার প্রসব করিলেন। কুমারযুগলের অবয়বগত অণুমাত্র বৈলক্ষণ্য ছিল না। উভয়েই সর্ব্বাংশে এরূপ একাকৃতি সে উভয়ের ভেদগ্রহ কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। আমরা যে পান্থনিবাসে অবস্থিতি করিতাম, তথায় সেই দিনে সেই সময়ে এক দুঃখিনী নারীও সর্ব্বাংশে একাকৃতি দুই যমজ তনয় প্রসব করে। উহাদের প্রতিপালন করা অসাধ্য ভাবিয়া, সে আমার নিকট ঐ দুই যমজ সন্তান বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল। উত্তরকালে উহারা দুই সহোদরে আমার পুত্ত্রদ্বয়ের পরিচর্য্যা করিবেক, এই অভিপ্রায়ে উহাদিগকে ক্রয় করিয়া, পুত্ত্রনির্বিশেষে প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। যমজেরা সর্ব্বাংশে একাকৃতি বলিয়া, এক নামে এক এক যমলের নামকরণ করিলাম; পুত্ত্রযুগলের নাম চিরঞ্জীব, ক্রীত শিশুযুগলের নাম কিঙ্কর রাখিলাম।

কিছু কাল গত হইলে, আমার সহধর্ম্মিণী, হেমকূট প্রতিগমনের নিমিত্ত নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া, সর্ব্বদা উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন। আমি অবশেষে, নিতান্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, সম্মত হইলাম। অল্প দিনের মধ্যেই, চারি শিশু সমভিব্যাহারে, আমরা অর্ণবপোতে আরোহণ করিলাম। মলয়পুর পরিত্যাগ করিয়া যোজনমাত্র গমন করিয়াছি, এমন সময়ে অকস্মাৎ গগনমণ্ডল নিবিড় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইল; প্রবল বেগে প্রচণ্ড বাত্যা বহিতে লাগিল; সমুদ্র উত্তাল তরঙ্গমালায় আন্দোলিত হইয়া উঠিল। আমরা জীবনের আশায় বিসর্জ্জন দিয়া, প্রতি ক্ষণেই মৃত্যু প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমার সহধর্ম্মিণী সাতিশয় আর্ত্ত স্বরে হাহাকার ও শিরে করাঘাত করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন দেখিয়া, দুই তনয় ও দুই ক্রীত বালক চীৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিল। গৃহিণী, বাষ্পাকুল লোচনে, অতি কাতর বচনে, মুহুর্মুহুঃ কহিতে লাগিলেন, নাথ! আমরা মরি তাহাতে কিছুমাত্র খেদ নাই; যাহাতে দুটি সন্তানের প্রাণ রক্ষা হয়, তাহার কোনও উপায় কর।

কিয়ৎ ক্ষণ পরে অর্ণবপোত মগ্নপ্রায় হইল। নাবিকেরা, পোত রক্ষা বিষয়ে সম্পূর্ণ হতাশ্বাস হইয়া, আত্মরক্ষার চেষ্টা দেখিতে লাগিল, এবং অর্ণবপোতে যে কয়খানি ক্ষুদ্র তরী ছিল, তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক প্রস্থান করিল। তখন আমি, নিতান্ত নিরুপায় দেখিয়া, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, এক উপায় স্থির করিলাম। অর্ণবপোতে দুটি অতিরিক্ত গুণবৃক্ষ ছিল; একের প্রান্তভাগে জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র ও জ্যেষ্ঠ ক্রীত শিশুকে, অপরটির প্রান্তভাগে কনিষ্ঠ পুত্ত্র ও কনিষ্ঠ ক্রীত শিশুকে বন্ধন পূর্ব্বক, আমরা স্ত্রী পুরুষে একৈকের অপর প্রান্তভাগে এক এক জন করিয়া আপনাদিগকে বদ্ধ করিলাম। দুই গুণবৃক্ষ, স্রোতের অনুবর্ত্তী হইয়া, ভাসিতে ভাসিতে চলিল। বোধ হইল, আমরা কর্ণপুর অভিমুখে নীত হইতেছি। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সূর্য্যদেবের আবির্ভাব ও বাত্যার তিরোভাব হইল। তখন দেখিতে পাইলাম, দুই অর্ণবপোত অতি বেগে আমাদের দিকে আসিতেছে। বোধ হইল, আমাদের উদ্ধরণের জন্যই উহারা ঐ রূপে আসিতেছিল। তন্মধ্যে একখানি কর্ণপুরের, অপর খানি উদয়নগরের। এ পর্য্যন্ত দুই গুণবৃক্ষ পরস্পর অতি সন্নিহিত ছিল; কিন্তু, উল্লিখিত পোতদ্বয় আমাদের নিকটে আসিবার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে, আকস্মিক বায়ুবেগবশে পরস্পর অতিশয় দূরবর্ত্তী হইয়া পড়িল। আমি এক দৃষ্টিতে অপর গুণবৃক্ষ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। দেখিতে পাইলাম, কর্ণপুরের পোতস্থিত লোকেরা, বন্ধন মোচন পূর্ব্বক, আমার গৃহিণী, পুত্ত্র ও ক্রীত শিশুকে অর্ণবগর্ভ হইতে উদ্ধৃত করিল। কিঞ্চিৎ পরেই, অপর পোত আসিয়া আমাদের তিন জনের উদ্ধরণ করিল। এই পোতের লোকেরা যেরূপ সুহৃদ্ভাবে সাহায্য করিতে আসিয়াছিলেন, অপর পোতের লোকেরা সেরূপ নহেন; ইহা বুঝিতে পারিয়া, আমাদের উদ্ধারকেরা, আমার গৃহিণী ও শিশুদ্বয়ের উদ্ধারার্থ উদ্যুক্ত হইলেন; কিন্তু অপর পোত অধিকতর বেগে যাইতেছিল, সুতরাং ধরিতে পারিলেন না। তদবধি আমি পুত্ত্র ও প্রেয়সী উভয়ে বিয়োজিত হইয়াছি। মহারাজ! আমার মত হতভাগ্য আর কেহ নাই—

এই কথা বলিতে বলিতে, সোমদত্তের নয়নযুগল হইতে প্রবল বেগে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, আর কিছুই বলিতে পারিলেন না। তখন বিজয়বল্লভ কহিলেন, সোমদত্ত! দৈববিড়ম্বনায় তোমার যে শোচনীয় অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা শুনিয়া আমার হৃদয় অতিশয় শোকাকুল হইতেছে; ক্ষমতা থাকিলে, এই দণ্ডে, তোমার প্রাণদণ্ড রহিত করিতাম। সে যাহা হউক, তৎপরে কি কি ঘটনা হইল, সমুদয় শুনিবার নিমিত্তে, আমার চিত্তে, অত্যন্ত ঔৎসুক্য জন্মিতেছে; সবিস্তর বর্ণন করিলে, আমি অনুগৃহীত বোধ করিব।

সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! তৎপরে কিছু দিনের মধ্যেই, কনিষ্ঠ তনয় ও কনিষ্ঠ ক্রীত শিশু সমভিব্যাহারে, নিজ আগারে প্রতিগমন পূর্ব্বক, কিঞ্চিৎ অংশে শোক সংবরণ করিয়া, শিশুযুগলের লালন পালন করিতে লাগিলাম। বহু কাল অতীত হইয়া গেল, কিন্তু, গৃহিণী ও অপর শিশুযুগলের কোনও সংবাদ পাইলাম না। কনিষ্ঠ পুত্ত্রটির যত জ্ঞান হইতে লাগিল, ততই সে জননী ও সহোদরের বিষয়ে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। আমার নিকট স্বকৃত জিজ্ঞাসার যে উত্তর পাইত, তাহাতে তাহার সন্তোষ জন্মিত না। অবশেষে, অষ্টাদশবর্ষ বয়সে, নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া, আমার অনুমতি গ্রহণ পূর্ব্বক, স্বীয় পরিচারক সমভিব্যাহারে, সে তাহাদের উদ্দেশার্থে প্রস্থান করিল। পুত্ত্রটি, অন্ধের যষ্টিস্বরূপ, আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল; এজন্য তাহাকে ছাড়িয়া দিতে কোনও মতে ইচ্ছা ছিল না। তৎকালে এই আশঙ্কা হইতে লাগিল, এ জন্মে যে গৃহিণী ও জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের সহিত সমাগম হইবেক, তাহার আর প্রত্যাশা নাই; আমার যেরূপ অদৃষ্ট, হয় ত এই অবধি ইহাকেও হারাইলাম। মহারাজ! ভাগ্যক্রমে আমার তাহাই ঘটিয়া উঠিল। দুই বৎসর অতীত হইল, তথাপি কনিষ্ঠ পুত্ত্র প্রত্যাগমন করিল না। আমি তাহার অন্বেষণে নির্গত হইলাম; পাঁচ বৎসর কাল অবিশ্রান্ত পর্য্যটন করিলাম, কিন্তু, কোনও স্থানেই কিছুমাত্র সন্ধান পাইলাম না। পরিশেষে, নিতান্ত নিরাশ্বাস হইয়া, হেমকূট অভিমুখে গমন করিতেছিলাম; জয়স্থলের উপকল দর্শন করিয়া মনে ভাবিলাম, এত দেশ পর্য্যটন করিলাম, এই স্থানটি অবশিষ্ট থাকে কেন। এখানে যে তাহাকে দেখিতে পাইব, তাহার কিছুমাত্র আশ্বাস ছিল না; কিন্তু না দেখিয়া চলিয়া যাইতেও, কোনও মতে, ইচ্ছা হইল না। এইরূপে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ পরেই ধৃত ও মহারাজের সম্মুখে আনীত হইয়াছি। মহারাজ! তাজ সায়ংকালে আমার সকল ক্লেশের অবসান হইবেক। যদি, প্রেয়লী ও তনয়েরা জীবিত আছে, ইহা শুনিয়া মরিতে পারি, তাহা হইলে আর আমার কোনও ক্ষোভ থাকে না।

এই হৃদয়বিদারণ আখ্যান শ্রবণে নিবতিশয় দুঃখিত হইয়া বিজয়বল্লভ কহিলেন, সোমদত্ত! আমার বোধ হয়, তোমার মত হতভাগ্য ভূমণ্ডলে আর নাই। অবিচ্ছিন্ন ক্লেশভোগে কালহরণ করিবার নিমিত্তই, তুমি জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলে। তোমার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া, আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। যদি ব্যবস্থাপিত বিধির উল্লঙ্ঘন না হইত, তাহা হইলে, আমি তোমার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিতাম। জয়স্থলের প্রচলিত বিধি অনুসারে তোমার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা হইয়াছে; যদি, অনুকম্পাব বশবর্ত্তী হইয়া, ঐ ব্যবস্থা রহিত করি, তাহা হইলে, আমি, চিরকালের জন্য, জয়স্থলসমাজে যাব পর নাই হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইব। তবে, আমার যে পর্য্যন্ত ক্ষমতা আছে, তাহা করিতেছি। তোমাকে সায়ংকাল পর্য্যন্ত সময় দিতেছি, এই সময়ের মধ্যে যদি কোনও রূপে, পাঁচ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করিতে পার, তোমার প্রাণ রক্ষণ হইবেক, নতুবা তোমার প্রাণদণ্ড অপরিহার্য্য। অনন্তর, তিনি কারাধ্যক্ষকে কহিলেন, তুমি সোমদত্তকে যথাস্থানে সাবধানে রাখ। কারাধ্যক্ষ, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, সোমদত্ত সমভিব্যাহারে প্রস্থান করিল।

কর্ণপুরের লোকেরা কুবলয়পুরের অধিপতি মহাবল পরাক্রান্ত বিখ্যাত বীর বিজয়বর্ম্মাব নিকট চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে বিক্রয় করে। তৎপরে কিয়ৎকাল অতীত হইলে, বিজয়বর্ম্মা নিজ ভ্রাতৃপুত্ত্র বিজয়বল্লভের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। তিনি চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে এত ভাল বাসিতেন, যে ক্ষণকালের জন্যেও তাহাদিগকে নয়নের অন্তরাল করিতেন না। সুতরাং, জয়স্থল প্রস্থানকালে তিনি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া যান। ঐ দুই বালককে দেখিয়া ও তাহাদের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত শুনিয়া, বিজয়বল্লভের অন্তঃকরণে অত্যন্ত দয়া উপস্থিত হয়, এবং দিন দিন তাহাদের প্রতি সাতিশয় স্নেহসঞ্চার হইতে থাকে। পিতৃব্যের প্রস্থানসময় সমাগত হইলে, ভ্রাতৃব্য আগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক তাঁহার নিকট বালকদ্বয়ের প্রাপ্তিবাসনা জানাইয়াছিলেন। তদনুসারে বিজয়বর্ম্মা তদীয় প্রার্থনা পরিপূর্ণ কবিয়া স্বস্থানে প্রতিগমন করেন। অভিপ্রেতলাভে আহ্লাদিত হইয়া, বিজয়বল্লভ পরম যত্নে চিরঞ্জীবের লালন পালন করিতে লাগিলেন, এবং, সে বিষয়কার্য্যের উপযোগী বয়স প্রাপ্ত হইলে, তাহাকে এককালে সেনাসংক্রান্ত উন্নত পদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। চিরঞ্জীব প্রত্যেক যুদ্ধেই বুদ্ধিমত্তা, কার্য্যদক্ষতা, অকুতোভয়তা প্রভৃতির প্রভূত পরিচয় দিতে লাগিলেন। একবার বিজয়বল্লভ একাকী বিপক্ষমণ্ডলে এরূপে বেষ্টিত হইয়াছিলেন, যে তাঁহার প্রাণবিনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ঘটিয়াছিল, সে দিবস কেবল চিরঞ্জীবের বুদ্ধিকৌশলে ও সহসগুণে তাহার প্রাণরক্ষা হয়। বিজয়বল্লভ, যার পর নাই, প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া, তদবধি তাঁহার প্রতি পুত্ত্রবাৎসল্য প্রদর্শন করিতে লাগিলেন।

এই ঘটনার কিছু দিন পূর্ব্বে, জয়স্থলবাসী এক শ্রেষ্ঠী, অতুল ঐশ্বর্য্য এবং চন্দ্রপ্রভা ও বিলাসিনী নাম্নী দুই পরম সুন্দরী কন্যা রাখিয়া, পরলোক যাত্রা করেন। মৃত্যুকালে তিনি অধিরাজ বিজয়বল্লভের হস্তে স্বীয় বিষয়ের ও কন্যাদ্বিতয়ের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সমস্ত ভার প্রদান করিয়া যান। বিজয়বল্লভ শ্রেষ্ঠীর জ্যেষ্ঠা কন্যা চন্দ্রপ্রভার সহিত চিরঞ্জীবের বিবাহ দিলেন। চিরঞ্জীব, এই অসম্ভাবিত পরিণয় সংঘটন দ্বারা, এককালে এক সুরূপা কামিনীর পতি ও অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইলেন। এই রূপে তিনি, বিজয়বল্লভের স্নেহগুণে ও অনুগ্রহ বলে, জয়স্থলে গণনীয় ব্যক্তি হইয়া উঠিলেন, এবং স্বভাবসিদ্ধ দয়া, সৌজন্য, ন্যায়পরতা ও অমায়িক ব্যবহার দ্বারা সর্ব্বসাধারণের স্নেহপাত্র ও সম্মানভাজন হইয়া, পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন।

চিরঞ্জীব অতি শৈশবকালে পিতা, মাতা ও ভ্রাতার সহিত বিয়োজিত হইয়াছিলেন, তৎপরে আর কখনও তাঁহাদের কোনও সংবাদ পান নাই। সুতরাং, জগতে তাঁহার আপনার কেহ আছে বলিয়া কিছুমাত্র বোধ ছিল না। তিনি শৈশবকালের সকল কথাই ভুলিয়া গিয়াছিলেন; সমুদ্রে মগ্ন হইয়াছিলেন, কোনও রূপে প্রাণরক্ষা হইয়াছে; কেবল এই বিষয়টির অনতিপরিস্ফুট স্মরণ ছিল। জয়স্থলে তাঁহার আধিপত্যের সীমা ছিল না। যদি তিনি জানিতে পারিতেন, সোমদত্ত তাঁহার জন্মদাতা তাহা হইলে সোমদত্তকে, এক ক্ষণের জন্যেও, রাজদণ্ডে নিগ্রহভোগ করিতে হইত না।

যে দিবস সোমদত্ত জয়স্থলে উপস্থিত হন, কনিষ্ঠ চিরঞ্জীবও সেই দিবস, স্বকীয় পরিচারক কনিষ্ঠ কিঙ্কর সমভিব্যাহারে, তথায় উপনীত হইয়াছিলেন। তিনি, স্বীয় পিতার ন্যায়, ধৃত, বিচারালয়ে নীত ও রাজদণ্ডে নিগৃহীত হইতেন, তাহার সন্দেহ নাই। দৈবযোগে, এক বিদেশীয় বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে, তিনি কহিলেন, বয়স্য! তুমি এ দেশে আসিয়াছ কেন। কিছু দিন হইল, জয়স্থলে হেমকূটবাসীদিগের পক্ষে ভয়ানক নিয়ম প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। তুমি হেমকূটবাসী বলিয়া কোনও ক্রমে কাহারও নিকট পরিচয় দিও না। মলয়পুর তোমার জন্মস্থান, এবং সে স্থানে তোমাদের বহুবিস্তৃত বাণিজ্য আছে; কেহ তোমায় জিজ্ঞাসা করিলে, মলয়পুরবাসী বলিয়া পরিচয় দিবে। অত্রত্য লোকে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইলে, নিঃসন্দেহ তোমার প্রাণদণ্ড হইবেক। হেমকূটবাসী এক বৃদ্ধ বণিক আজ জয়স্থলে আসিয়াছিলেন। অধিরাজের আদেশক্রমে, সূর্য্যদেবের অস্তাচলচূড়ায় অধিরোহণ করিবার পূর্ব্বেই, তাঁহার প্রাণদণ্ড হইবেক। অতএব, যত ক্ষণ এখানে থাকিবে, সাবধানে চলিবে। আর আমার নিকট যাহা রাখিতে দিয়াছিলে, লও।

এই বলিয়া, তিনি স্বর্ণমুদ্রার একটি থলী চিরঞ্জীবের হস্তে প্রত্যর্পণ করিলেন। তিনি তাহা স্বকীয় পরিচারকের হস্তে দিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! তুমি এই স্বর্ণমুদ্রা লইয়া পান্থনিবাসে প্রতিগমন কর; অতি সাবধানে রাখিবে, কোনও ক্রমে কাহারও হস্তে দিবে না। এখনও আমাদের আহারের সময় হয় নাই, প্রায় এক ঘণ্টা বিলম্ব আছে; এই সময় মধ্যে নগর দর্শন করিয়া, আমিও পান্থনিবাসে প্রতিগমন করিতেছি। তুমি যাও, আর দেরী করিও না। কিঙ্কর যে আজ্ঞা বলিয়া প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব সেই বৈদেশিক বন্ধুকে কহিলেন, বয়স্য! কিঙ্কর আমার চিরসহচর ও যার পর নাই বিশ্বাসভাজন। উহার বিশেষ এক গুণ আছে; আমি যখন দুর্ভাবনায় অভিভূত হই, তখন ও পরিহাস করিয়া আমার চিত্তের অপেক্ষাকৃত সাচ্ছন্দ্য, সম্পাদন করে। এক্ষণে চল, দুই বন্ধুতে নগর দর্শন করিতে যাই; তৎপরে উভয়ে পান্থনিবাসে এক সঙ্গে আহার আদি করিব। তিনি কহিলেন, আজ এক বণিক আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অবিলম্বে তদীয় আলয়ে যাইতে হইবেক। তাঁহার নিকট আমার উপকারের প্রত্যাশা আছে। অতএব আমায় মাপ কর, এখন আমি তোমার সঙ্গে যাইতে পারিব না; অপরাহ্নে নিঃসন্দেহ সাক্ষাৎ করিব, এবং শয়নের সময় পর্য্যন্ত তোমার নিকটে থাকিব। এই বলিয়া, সে ব্যক্তি বিদায় লইয়া প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব একাকী নগর দর্শনে নির্গত হইলেন।

জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব অতি প্রত্যুষে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন; আহারের সময় উপস্থিত হইল, তথাপি প্রতিগমন করিলেন না। তাঁহার গৃহিণী চন্দ্রপ্রভা, অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়া, কিঙ্করকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, দেখ, কিঙ্কর! এত বেলা হইল, তথাপি তিনি গৃহে আসিতেছেন না। বোধ করি, কোনও গুরুতর কার্য্যে আবদ্ধ হইয়াছেন, তাহাতেই আহারের সময় পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। তুমি যাও, সত্বর তাঁহাকে ডাকিয়া আন; দেখিও, যেন কোনও মতে বিলম্ব না হয়; তাঁহার জন্যে সকলকার আহার বন্ধ। কিঙ্কর, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল, এবং কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, নগরদর্শনে ব্যাপৃত হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, স্বপ্রভুজ্ঞানে সত্বর গমনে তাঁহার সন্নিহিত হইতে লাগিল।

চিরঞ্জীবযুগল ও কিঙ্করযুগল জন্মকালে যেরূপ সর্ব্বাংশে একারুতি হইয়াছিলেন, এখনও তাঁহারা অবিকল সেইরূপ ছিলেন, বয়োবৃদ্ধি বা অবস্থাভেদ নিবন্ধন কোনও অংশে আকৃতির কিছুমাত্র বিভিন্নতা ঘটে নাই। এক ব্যক্তিকে দেখিলে অপর ব্যক্তিজ্ঞান একান্ত অপরিহার্য্য। সুতরাং, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্করের যেমন স্বীয় প্রভু বলিয়া বোধ জন্মিয়াছিল, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর সন্নিহিত হইবামাত্র, তাহাকে দেখিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবেরও তেমনই স্বীয় পরিচারক বলিয়া বোধ জন্মিল, সে যে তাহার সহচর কিঙ্কর নয়, তিনি তাহার কিছুমাত্র উপলব্ধি করিতে পারলেন না। তদনুসারে, তিনি কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কি হে, তুমি এত সত্বর আসিলে কেন। সে কহিল, এত সত্বর আসিলে, কেমন; বরং এত বিলম্বে আসিলে কেন, বলুন। বেলা প্রায় দুই প্রহর হইল, আপনি এ পর্য্যন্ত গৃহে না যাওয়াতে, কত্রী ঠাকুরাণী অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন। অনেক ক্ষণ আহারসামগ্রী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে এবং ক্রমে শীতল হইয়া যাইতেছে। আহারসামগ্রী যত শীতল হইতেছে, কর্ত্রী ঠাকুরাণী তত উষ্ণ হইতেছেন। আহারসামগ্রী শীতল হইতেছে, কারণ আপনি গৃহে যান নাই; আপনি গৃহে যান নাই, কারণ আপন: কার ক্ষুধা নাই; আপনকার ক্ষুধা নাই, কারণ আপনি বিলক্ষণ জলযোগ করিয়াছেন; কিন্তু আপনকার অনুপস্থিতি জন্ত আমরা অনাহারে মারা পড়িতেছি।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব ভাবিলেন, পরিহাসরসিক কিঙ্কর কৌতুক করিতেছে। তখন তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! আমি এখন তোমার পরিহাসরসের অভিলাষী নহি; তোমার হস্তে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছি, কাহার নিকট রাখিয়া আসিলে, বল। সে চকিত হইয়া কহিল, সে কি, আপনি স্বর্ণমুদ্রা আমার হস্তে কবে দিলেন; কেবল বুধবার দিন, চর্ম্মকারকে দিবার জন্য, চারি আনা দিয়াছিলেন, সেই দিনেই তাহাকে দিয়াছি, আমার নিকটে রাখি নাই; চর্ম্মকার কর্ত্রী ঠাকুরাণীর ঘোড়ার সাজ মেরামত করিয়াছিল। শুনিয়া সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জাব কহিলেন, কিঙ্কর! এ পরিহাসের সময় নয়; যদি ভাল চাও, স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিলে, বল। আমরা ঘটনাক্রমে এই নিতান্ত অপরিচিত অবান্ধব দেশে আসিয়াছি; কি সাহসে, কোন বিবেচনায়, তত স্বর্ণমুদ্রা অপরের হস্তে দিলে। কিঙ্কর কহিল, মহাশয়। আপনি আহারে বসিয়া পরিহাস করিবেন, আমরা আছাদিত চিত্তে শুনিব। এখন আপনি গৃহে চলুন; কর্ত্রী ঠাকুরাণী সত্বর আপনারে লইয়া যাইতে বলিয়া দিয়াছেন; বিলম্ব হইলে, কিংবা আপনারে না লইয়া গেলে, আমার লাঞ্ছনার সীমা থাকিবেক না; হয় ত, প্রহার পর্য্যন্ত হইয়া যাইবেক।  চিরঞ্জীব নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া কহিলেন, কিঙ্কর! তুমি বড় নিবোধ, যত আমায় ভাল লাগিতেছে না, ততই তুমি পরিহাস করিতেছ; বারংবার বুারণ করিতেছি, তথাপি ক্ষান্ত হইতেছ না; দেখ, সময়ে সকলই ভাল লাগে; অসময়ে অমৃতও বিস্বাদ ও বিষতুল্য বোধ হয়। যাহা হউক, আমি তোমার হস্তুে যে সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছি, তাহা কোথায় রাখিলে, বল। কিঙ্কর কহিল, না মহাশয়! আপনি আমার হস্তে কখনই স্বর্ণমুদ্রা দেন নাই। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর। আজ তোমার কি হইয়াছে, বলিতে পারি না। পাগলামির চুড়ান্ত হইয়াছে, আর নয়, ক্ষান্ত হও। বল, স্বর্ণমুদ্রা কোথায় কাহার নিকটে রাখিয়া আসিলে। সে কহিল, মহাশয়! এখন স্বর্ণমুদ্রার কথা রাখুন। আমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দিয়া থাকেন, পরে বুঝিয়া লইবেন; সে জন্যে আমার তত ভাবনা নাই। কিন্তু, কর্ত্রী ঠাকুরাণী আজ কাল অতিশয় উগ্রচণ্ডা হইয়াছেন, তাহার ভয়েই আমি অস্থির হইতেছি। তিনি সত্বর আপনাকে বাটতে লইয়া যাইতে বলিয়া দিয়াছেন। আপনারে লইয়া না গেলে, আমার লাঞ্ছনার একশেষ হইবেক। অতএব, বিনয় করিয়া বলিতেছি, সত্বর গৃহে চলুন। তিনি ও তাঁহার ভগিনী নিতান্ত আকুল চিত্তে আপনকার প্রতীক্ষা করিতেছেন।  এই সকল কথা শুনিয়া, কোপে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, আরে দুরাত্মন! তুমি পুনঃ পুনঃ কর্ত্রী ঠাকুরাশীর নাম করিতেছ; তোমার কর্ত্রী ঠাকুরাণী কে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কিঙ্কর কহিল, কেন মহাশয়। আপনি কি জানেন না, আপনকার সহধর্ম্মিণীকে আমরা সকলেই কর্ত্রী ঠাকুরাণী বলিয়া থাকি; তিনি ভিন্ন আর কাহাকে কর্ত্রী ঠাকুরাণী বলিব। তিনিই আমায় আপনাকে গৃহে লইয়া যাইবার নিমিত্ত পাঠাইয়াছেন। চলুন, আর বিলম্ব করিবেন না; আহারের সময় বহিয়া যাইতেছে। চিরঞ্জীব কহিলেন, নিঃসন্দেহ তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, নতুবা উন্মাদগ্রস্তের ন্যায় কথা কহিতে না। আমি কবে কোন কামিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছি যে, তুমি বারংবার আমার সহধর্ম্মিণীর উল্লেখ করিতেছ। এখানে আমার বাটী কোথায় যে, আমায় বাটীতে লইয়া যাইবার জন্য এত ব্যস্ত হইতেছ। কিঙ্কর শুনিয়া হাস্যমুখে কহিল, মহাশয়। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আপনারই বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; আপনিই উন্মাদগ্রস্তের দ্যায় কথা কহিতেছেন। এ সকল কথা কর্ত্রী ঠাকুরাণীর কর্ণগোচর হইলে, তিনি আপনাকে বিলক্ষণ শিক্ষা দিবেন; তখন, এখানে আপনকার বাটী আছে কি না এবং কখনও কোনও কামিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন কি না, অক্লেশে বুঝিতে পারিবেন। যাহা হউক, আপনি হঠাৎ কেমন করিয়া এমন রসিক হইয়া উঠিলেন, বলুন। চিরঞ্জীব, আর সহ্য করিতে না পারিয়া, এই তোমার পাগলামির ফল ভোগ কর; এই বলিয়া, তাহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কিঙ্কর হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, মহাশয়! অকারণে প্রহার করেন কেন; আমি কি অপরাধ করিয়াছি। আপনকার ইচ্ছা হয়, বাটীতে যাইবেন, ইচ্ছা না হয়, না যাইবেন; যাঁহার কথায় লইয়া যাইতে আসিয়াছিলাম, তাঁহার নিকটেই চলিলাম।

ইহা কহিয়া কিঙ্কর প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন, বোধ হয়, কোনও ধূর্ত্ত, কৌশল করিয়া, কিঙ্করের নিকট হইতে স্বর্ণমুদ্রাগুলি অপহরণ করিয়াছে, তাহাতেই ভয়ে উহার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; নতুবা পূর্ব্বাপর এত প্রলাপবাক্য উচ্চাচরণ করিবেক কেন; প্রকতিস্থ ব্যক্তি কখনও এরূপ অসম্বদ্ধ কথা কহে না, হয় ত, হতভাগ্য উন্মাদগ্রস্ত হইল। সকলে বলে, জয়স্থলে ঐন্দ্রজালিকবিদ্যা বিলক্ষণ প্রচলিত; এখানকার লোকে এরূপ প্রচ্ছন্ন বেশে চলে যে,উহাদিগকে কোনও মতে চিনিতে পারা যায় না; উহারা, দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তার করিয়া, বৈদেশিক লোকের ধনে প্রাণে উচ্ছেদ সাধন করে। শুনিতে পাই, এখানকার কামিনীরা নিতান্ত মায়াবিনী; বৈদেশিক পুরুষদিগকে অনায়াসে মুগ্ধ করিয়া ফেলে; একবার মোহজালে বদ্ধ হইলে, আর নিস্তার নাই। আমি এখানে আসিয়া ভাল করি নাই, শীঘ্র পলায়ন করাই বিধেয়। আর আমার নগরদর্শনের আমোদে কাজ নাই; পান্থনিবাসে যাই এবং যাহাতে অবিলম্বে এ স্থান হইতে প্রস্থান করিতে পারি, তাহার উদ্যোগ করি। এখানে আর এক মুহূর্ত্তও থাকা উচিত নহে।

চিরঞ্জীব, এই বলিয়া, নগরদর্শনকৌতুকে বিসর্জন দিয়া, আকুল মনে, সত্বর গমনে, পান্থনিবাস অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস – ২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কিঙ্করকে পতি অন্বেষণে প্রেরণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা স্বীয় সহোদরাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, বিলাসিনি! দেখ, প্রায় চারি দণ্ড হইল, কিঙ্করকে তাঁহার অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছি; না এ পর্যন্ত তিনিই আসিলেন, না কিঙ্করই ফিরিয়া আসিল; ইহার কারণ কি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বিলাসিনি কহিলেন, আমার বোধ হইতেছে, কোনও স্থানে নিমন্ত্রণ হইয়াছিল, অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, তথায় আহার করিয়াছেন। অতএব, আর তাঁহার প্রতীক্ষায় থাকিবার প্রয়োজন নাই; চল, আমরা আহার করি। বেলা অতিরিক্ত হইয়াছে, আর বিলম্ব করা উচিত নয়। আর, তোমায় একটি কথা বলি, তাঁহার আসিতে বিলম্ব হইলে, তুমি এত বিষন্ন হও কেন এবং কি জন্যেই বা এত আক্ষেপ কর। পুরুষেরা সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ, স্ত্রীজাতিকে তাহাদের অনুবর্ত্তিনী হইয়া চলিতে হয়। পুরুষজাতির রোষ বা অসন্তোষ ভয়ে স্ত্রীজাতিকে যত সঙ্কুচিত ও সাবধান হইয়া সংসারধর্ম্ম করিতে হয়; পুরুষজাতিকে যদি সেরূপে চলিতে হইত, তাহা হইলে স্ত্রীজাতির সৌভাগ্যের সীমা থাকিত না। স্ত্রীজাতি নিতান্ত পরাধীন, সুতরাং তাহাদিগকে অনেক সহ্য করিয়া কালহরণ করিতে হয়। তাহাদের অভিমান করা বৃথা।  শুনিয়া, সাতিশয় রোষবশী হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, স্ত্রীজাতি অপেক্ষা পুরুষজাতির স্বাতন্ত্র্য অধিক হইবেক কেন, আমি তাহা বুঝিতে পারি না, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, স্ত্রী পুরুষ উভয় জাতিরই সমান স্বাতন্ত্র্য আছে; সে বিষয়ে ইতরবিশেষ হইবার কোনও কারণ নাই। তিনি আপন ইচ্ছামতে চলিবেন, আমি আপন ইচ্ছামতে চলিতে পারিব না, কেন। বিলাসিনী কহিলেন, কারণ, তাহার ইচ্ছা তোমার ইচ্ছার বন্ধনশৃঙ্খলাস্বরূপ। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, গো গর্দভ ব্যতিরিক্ত কে ওরূপ শৃঙ্খলাবন্ধন সহ করিবেক। বিলাসিনী কহিলেন, দিদি! তুমি না বুঝিয়। এরূপ উদ্ধত ভাবে কথা কহিতেছ। স্ত্রীজাতির অসদৃশ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন পরিণামে নিরতিশয় ক্লেশের কারণ হইয়া উঠে। জলে, স্থলে, নভোমণ্ডলে, যেখানে দৃষ্টিপাত কর, স্ত্রী জাতির স্বাতন্ত্র্য দেখিতে পাইবে না; কি জলচর, কি স্থলচর, কি নভশ্চর, জীবমাত্রেই এই নিয়ম অনুসরণ করিয়া চলিয়া থাকে।

এই সকল কথা শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়। রহিলেন; অনন্তর, সম্মিত বদনে পরিহাসবচনে কহিলেন, এই পরাধীনতার ভয়েই বুঝি তুমি বিবাহ করিতে চাও ন॥ বিলাসিনীও হাস্যমুখে উত্তর দিলেন, হা, ও এক কারণ বটে; তদ্ভিন্ন, বিবাহিত অবস্থায় অন্যবিধ নানা অসুবিধা আছে। চন্দ্র প্রভ কহিলেন, আমার বোধ হয়, তুমি, বিবাহিত হইলে, পুরুষের আধিপত্য ও অত্যাচার অনায়াসে সহ করিতে পারিবে। বিলাসিনী কহিলেন, পুরুষের অভিপ্রায় বুঝিয়া চলা  বিলক্ষণ রূপে অভ্যাস না করিয়া, আমি বিবাহ করিব না। চন্দ্রপ্রভা শুনিয়া হাস্যমুখে কহিলেন, ভগিনি। যত অভ্যাস কর না কেন, কখনই অবিরক্ত চিত্তে সংসারধর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে পারবে না। পুরুষের পদে পদে অত্যাচার; কত সহ্য করিবে, বল। তুমি পুরুষের আচরণের বিষয় সবিশেষ জান না, এজন্য ওরূপ কহিতেছ; যখন ঠেকিবে, তখন শিখিবে; এখন মুখে ওরূপ বলিলে কি হইবে। বিশেষতঃ, পরের বেলায় আমরা উপদেশ দিতে বিলক্ষণ পটু, আপনার বেলায় বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে; তখন বিবেচনাও থাকে না, সহিষ্ণুতাও থাকে না। তুমি এখন আমায় ধৈর্য্য অবলম্বন করিতে বলিতেছ; কিন্তু যদি কখনও বিবাহ কর, আমার মত অবস্থায় কত ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া চল, দেখিব।

উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে কিঙ্কর, বিষন্ন বদনে তাঁহাদের সম্মুখবর্তী হইল। চন্দ্রপ্রভা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিঙ্কর! তুমি যে একাকী আসিলে; তোমার প্রভু কোথায়; তাহার দেখা পাইয়াছ কি না; কত ক্ষণে গৃহে আসিবেন, বলিলেন। কিঙ্কর কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমার বলিতে শঙ্কা হইতেছে; কিন্তু না বলিলে নয়, এজন্য বলিতেছি। আমি তাহাকে যেরূপ দেখিলাম, তাহাতে আমার স্পষ্ট বোধ হইল, তাঁহার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাঁহাতে উন্মাদের সম্পূর্ণ লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে। আমি কহিলাম, কর্ত্রী ঠাকুরাণীর আদেশে, আমি আপনাকে ডাকিতে আসিয়াছি, ত্বরায় গৃহে চলুন, আহারের সময় বহিয়া যাইতেছে। তিনি আমার দেখিয়া, বিরক্তি প্রকাশ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিয়া আসিলে। পরে, আমি যত গৃহে আসিতে বলি, তিনি ততই বিরক্ত হইতে লাগিলেন এবং আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায়, বারংবার কেবল এই কথা বলিতে লাগিলেন। আমি কহিলাম, আপনি এ পর্য্যন্ত গৃহে না যাওয়াতে, কর্ত্রী ঠাকুরাণী অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন। তিনি সাতিশয় কুপিত হইয়। কহিলেন, তুই কর্ত্রী ঠাকুরাণী কোথায় পাইলি; আমি তোর কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে চিনি না; আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিলি, বল।

এই কথা শুনিয়া, চকিত হইয়া, বিলাসিনী জিজ্ঞাসিলেন, কিঙ্কর। এ কথা কে বলিল। কিঙ্কর কহিল, কেন, আমার প্রভু বলিলেন; তিনি কহিলেন, আমার বাটী কোথায়, আমার স্ত্রী কোথায়, আমি কবে কাহাকে বিবাহ করিয়াছি যে কথায় কথায় আমার স্ত্রীর উল্লেখ করিতেছিস্। অবশেষে, কি কারণে বলিতে পারি না, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, আমায় প্রহার করিলেন। এই বলিয়া, সে স্বীয় কর্ণমূলে মুষ্টিপ্রহারের চিহ্ন দেখাইতে লাগিল। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, তুমি পুনরায় যাও, এবং যেরূপে পার, তাঁহারে অবিলম্বে গৃহে লইয়া আইস। সে কহিল, আমি পুনরায় যাইব এবং পুনরায় মার খাইয়া গৃহে আসিব। বলিতে কি, আমি আর মার খাইতে পারিব না; আপনি আর কাহাকেও পাঠাইয় দেন। শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চন্দ্র প্রভা কহিলেন, যদি তুমি না যাও, আমি তোমায় বিলক্ষণ শিক্ষা দিব; যদি ভাল চাও, এখনই চলিয়া যাও। কিঙ্কর কহিল, আপনি প্রহার করিয়া এখান হইতে তাড়াইবেন, তিনি প্রহার করিয়া সেখান হইতে তাড়াইবেন; আমার উভয় সঙ্কট, কোনও দিকেই নিস্তার নাই।

এই বলিয়া সে চলিয়া গেলে পর, চন্দ্রপ্রভা ঈর্য্যাকষায়িত লোচনে সরোষ বচনে কহিতে লাগিলেন, বিলাসিনি! তোমার ভগিনীপতির কথা শুনিলে। এত ক্ষণ আমায় কত বুঝাইতেছিলে, এখন কি বল। শুনিলে ত, তাঁহার বাটী নাই, তাঁহার স্ত্রী নাই, তিনি বিবাহ করেন নাই। আমি কিঙ্করকে পাঠাইয়াছিলাম, অকারণে তাহাকে প্রহার করা আমার উপর অবজ্ঞা প্রদর্শন মাত্র। আমি ইদানীং তাহার চক্ষের শূল হইয়াছি। আমরা তাঁহার প্রতীক্ষায় এত বেলা পর্য্যন্ত অনাহারে রহিয়াছি, তিনি অন্যত্র আমোদ আহ্বাদে কাল কাটাইতেছেন। তুমি যা বল, এখন তাঁর উপর আমার বিলক্ষণ সন্দেহ হয়। আমি তার নিকট কি অপরাধে অপরাধিনী হইয়াছি, বলিতে পারি না। আমি কিছু তত রূপহীন বা গুণহীন নই যে, তিনি আমায় এত ঘৃণা করিতে পারেন। অথবা কার দোষ দিব, সকলই আমার অদৃষ্ট্রের দোষ।

ভগিনীর ভাব দর্শন করিয়া, বিলাসিনী কহিলেন, দিদি! ঈর্ষ্যা স্ত্রীলোকের অতি বিষম শত্রু; ঈর্ষ্যার বশবর্ত্তিনী হইলে, স্ত্রীজাতিকে যাবজ্জীবন দুঃখভাগিনী হইতে হয়; অতএব এরূপ শক্রকে অন্তঃকরণ হইতে একবারে অপসারিত কর। এই কথা শুনিয়া, যার পর নাই বিরক্ত হইয়া, চন্দ্র প্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! ক্ষমা কর, আর তোমার আমায় বুঝাইতে হইবেক না; এত অত্যাচার সহ করা আমার কর্ম্ম নয়। আমি তত নিরভিমান হইতে পারিব না যে, তাহার এরূপ আচরণ দেখিয়াও, আমার মনে অসুখ জন্মিবেক ন। ভাল, বল দেখি; যদি আমার প্রতি পূর্ব্বের মত অনুরাগ থাকিত, তিনি কি এত ক্ষণ গৃহে আসিতেন না; না, অকারণে কিঙ্করকে প্রহার করিয়া বিদায় করিতেন। তুমি ত জান, আজ কত দিন হইল, আমায় এক ছড়া হার গড়াইয়া দিবেন, বলিয়াছিলেন; সেই অবধি আর কখনও তাঁহার মুখে হারের কথা শুনিয়াছ। বলিতে কি, এত হতাদর হইয়া বাঁচা অপেক্ষা মরা ভাল। যেরূপ হইয়াছে, এবং উত্তরোত্তর যেরূপ হইবেক, তাহাতে আমার অদৃষ্টে কত কষ্টভোগ আছে, বলিতে পারি না।

হেমকুটের চিরঞ্জীব, আকুল হৃদয়ে পান্থনিবাসে উপস্থিত হইয়া, তথাকার অধ্যক্ষকে কিঙ্করের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কহিলেন, প্রায় চরি দণ্ড হইল, সে এখানে আসিয়াছে। এবং আপনি তাহার হস্তে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছিলেন, তাহা সিন্ধুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। পরে, অনেক ক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া, বিলম্ব দেখিয়া, সে এইমাত্র আপনকার অন্বেষণে গেল। এই কথা শুনিয়া, সংশয়ারূঢ় হইয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, অধ্যক্ষ যেরূপ বলিলেন, তাহাতে আমি স্বর্ণমুদ্রা সহিত কিঙ্করকে আপণ হইতে বিদায় করিলে পর, তাহার সহিত আমার আর সাক্ষাৎ বা কথোপকথন হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু আমি তাহার সহিত কথোপকথন করিয়াছি, এবং অবশেষে প্রহার পর্য্যন্ত করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। অধ্যক্ষ বলিতেছেন, সে এইমাত্র পান্থনিবাস হইতে নির্গত হইয়াছে; এ কিরূপ হইল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি ন। মনোমধ্যে এই আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে হেমকুটের কিঙ্কর তাঁহার সন্নিহিত হইল।

তাহাকে দেখিতে পাইবামাত্র, চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন কিঙ্কর! তোমার পরিহাসপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি পাইয়াছে, অথবা সেইরূপই রহিয়াছে। তুমি মার খাইতে বড় ভাল বাস, অতএব আমার ইচ্ছা, তুমি আর খানিক আমার সঙ্গে পরিহাস কর। কেমন, আজ আমি তোমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দি নাই, তোমার কর্ত্রী ঠাকুরাণী আমায় লইয়া যাইবার জন্য পাঠাইয়াছেন, জয়স্থলে আমার বাস। তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; নতুবা, পাগলের মত আমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে না। কিঙ্কর শুনিয়া চকিত হইয়া কহিল, সে কি মহাশয়! আমি কখন আপনকার নিকট ও সকল কথা বলিলাম। চিরঞ্জীব কহিলেন, কিছু পূর্ব্বে, বোধ হয় এখনও আধ ঘণ্টা হয় নাই। কিঙ্কর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিল, আপনি স্বর্ণমুদ্রার থলী আমার হস্তে দিয়া এখানে পাঠাইলে পর, কই আপনকার সঙ্গে ত আর আমার দেখা হয় নাই। চিরঞ্জীব অত্যন্ত কুপিত হইয়া কহিলেন,দুরাত্মন‌! আর আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই, বটে; তুমি বারংবার বলিতে লাগিলে, আপনি আমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দেন নাই, কর্ত্রী ঠাকুরাণী আপনাকে লইয়া যাইতে পাঠাইয়াছেন, তিনি ও তাহার ভগিনী আপনকার অপেক্ষায় আহার করিতে পারিতেছেন না। পরিশেষে, সাতিশয় রোষাক্রান্ত হইয়া আমি তোমায় প্রহার করিলাম।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, কিঙ্কর কিয়ং ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; অবশেষে, চিরঞ্জীব কৌতুক করিতেছেন বিবেচনা করিয়া কহিল, মহাশয়! এত দিনের পর, আপনকার যে পরিহাসে প্রবৃত্তি হইয়াছে, ইহাতে আমি অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম; কিন্তু, এ সময়ে এরূপ পরিহাস করিতেছেন কেন, তাহার মর্ম্ম বুঝিতে পারিতেছি না; অনুগ্রহ করিয়া তাহার কারণ বলিলে, আমার সন্দেহ দূর হয়। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি পরিহাস করিতেছি, না তুমি পরিহাস করিতেছ; আজ তোমার দুর্ম্মতি ঘটিয়াছে; তখন যৎপরোনাস্তি বিরক্ত করিয়াছ, এখন আবার বলিতেছ, আমি পরিহাস করিতেছি। এই তোমার দুর্ম্মতির ফল ভোগ কর। এই বলিয়া, তিনি তাহাকে ক্রোধভরে বিলক্ষণ প্রহার করিলেন।

এইরূপে প্রহার প্রাপ্ত হইয়া, কিঙ্কর কহিল, আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে আপনি আমায় এত প্রহার করিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার কোনও অপরাধ নাই; সকল অপরাধ আমার। ভূত্যের সহিত প্রভুর যেরূপ ব্যবহার করা উচিত, তাহা না করিয়া, আমি যে তোমার সঙ্গে সৌহৃদ্যভাবে কথা কই, এবং সময়ে সময়ে তোমার পরিহাস শুনিতে ভাল বাসি, তাহাতেই তোমার এত আস্পর্দ্ধা বাড়িয়াছে। তোমার সময় অসময় বিবেচনা নাই। যদি আমার নিকট পরিহাস করিবার ইচ্ছা থাকে, আমি কখন কি ভাবে থাকি, তাহা জান ও তদনুসারে চলিতে আরম্ভ কর, নতুবা প্রহার দ্বারা তোমার পরিহাসরোগের শান্তি করিব। কিঙ্কর কহিল, আপনি প্রভু, প্রহার করিলেন, করুন; আমি দাস, অনায়াসে সহ করিলাম; কিন্তু কি কারণে প্রহার করিলেন, তাহা না বলিলে, কিছুতেই ছাড়িব নাই। চিরঞ্জীব, এই সময়ে, দুটি ভদ্র স্ত্রীলোককে তাঁহার দিকে আসিতে দেখিয়া, কহিলেন, আরে নির্ব্বোধ! স্থির হও, এখন আর ও সকল কথা কহিও না; দুটি ভদ্রবংশের স্ত্রীলোক, বোধ হয়, আমার নিকটেই আসিতেছেন।

জয়স্থলের কিঙ্কর সত্বর প্রতিগমন না করাতে, চন্দ্রপ্রভা, নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া, ভগিনীকে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় পতি চিরঞ্জীবের অন্বেষণে নির্গত হইয়াছিলেন। ইতস্ততঃ অনেক অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে পান্থনিবাসে উপস্থিত হইয়া, তিনি হেমকুটের চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে দেখিতে পাইলেন, এবং তাহাদিগকে জয়স্থলের চিরঞ্জীব ও কিঙ্কর স্থির করিয়া, নিকটবর্ত্তিনী হইলেন। হেমকুটের চিরঞ্জীব, ইতিপূর্ব্বেই, স্বীয় ভূত্য কিঙ্করের উপর অত্যন্ত কোপান্বিত হইয়াছিলেন; এক্ষণে বিলক্ষণ যত্ন পাইলেন, তথাপি তদীয় উগ্রভাবের একবারে তিরোভাব হইল না। চন্দ্রপ্রভা, তাঁহার মুখের দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ করিয়া, অভিমানভরে কহিতে লাগিলেন, নাথ! আমায় দেখিলেই তোমার ভাবান্তর উপস্থিত হয়; তোমার বদনে রোষ ও অসন্তোষ বিলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। যাহারে দেখিলে সুখোদয় হয়, তাহার নিকটে কিছু এ ভাব অবলম্বন কর না। আমি এখন আর সে চন্দ্রপ্রভা নই; তোমার পরিণীতা বনিতাও নই। পূর্ব্বে, আমি কথা কহিলে, তোমার কর্ণে অমৃতবর্ষণ হইত; আমি দৃষ্টিপাত করিলে, তোমার নয়নযুগল প্রীতিরসে পরিপূর্ণ হইত; আমি স্পর্শ করিলে, তোমার সর্ব্ব শরীর পুলকিত হইত; আমি হস্তে করিয়া না দিলে, উপাদেয় আহারসামগ্রীও তোমার সুস্বাদ বোধ হইত না। তখন আমা বই আর জানিতে না। আমি ক্ষণ কাল নয়নের অন্তরাল হইলে, দশ দিক শূন্য দেখিতে। এখন সে সব দিন গত হইয়াছে। কি কারণে এই বিসদৃশ ভাবান্তর উপস্থিত হইল, বল। আমার নিতান্ত তোমাগত প্রাণ; তুমি বই এ সংসারে আমার আর কে আছে। তুমি এত নিদয় হইলে, আমি কেমন করিয়া প্রাণ ধারণ করিব। বিলাসিনীকে জিজ্ঞাসা কর, ইদানীং আমি কেমন মনের সুখে আছি। দুর্ভাবনায় শরীর শীর্ণ হইয়া যাইতেছে। আমি স্পষ্ট দেখিতেছি, আমার উপর তোমার আর সে অনুরাগ নাই। যাহার ভাগ্য ভাল, এখন সে তোমার অনুরাগভাজন হইয়াছে। আমি দেখিয়া শুনিয়া জীবন্মৃত হইয়া আছি। দেখ, আর নিদয় হইও না, আমায় মর্ম্মান্তিক যাতনা দিও না। বিবেচনা কর, কেবল আমিই যে যন্ত্রণা ভোগ করিব, এরূপ নহে; এ সকল কথা ব্যক্ত হইলে, তুমিও ভদ্রসমাজে হেয় হইবে।  চন্দ্রপ্রভার আক্ষেপ ও অনুযোগ শ্রবণ করিয়া, হেমকুট বাসী চিরঞ্জীব হতবুদ্ধি হইলেন, এবং কি কারণে অপরিচিত ব্যক্তিকে পতি সম্ভাষণ, ও পতিকৃত অনুচিত আচরণের আরোপণ পূর্ব্বক ভৎসন, করিতেছে, কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, কিছু বলা আবশ্বক, নিতান্ত মৌনাবলম্বন করিয়া থাকা বিধেয় নহে, এই বিবেচনা করিয়া, তিনি বিস্ময়াকুল লোচনে মৃদু বচনে কহিলেন, অয়ি বরবর্ণিনি! আমি বৈদেশিক ব্যক্তি, জয়স্থলে আমার বাস নয়; এই সর্ব্বপ্রথম এ স্থানে আসিয়াছি, তাহাও চারি পাঁচ দণ্ডের অধিক নহে। ইহার পূর্ব্বে, আমি আর কখনও তোমায় দেখি নাই। তুমি আমায় লক্ষ্য করিয়া যে সকল কথা বলিলে, তাহার এক বর্ণও বুঝিতে পারিলাম না। বিলাসিনী শুনিয়া, আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া, কহিলেন, ও কি হে, তুমি যে আমায় একবারে অবাক করিয়া দিলে; হঠাৎ তোমার মনের ভাব এত, বিপরীত হইল কেন। যা হউক ভাই! ইতিপূর্ব্বে, আর কখনও দিদির উপর তোমার এ ভাব দেখি নাই। দিদির অপরাধ কি, আহারের সময় বহিয়া যায়, এজন্য কিঙ্করকে তোমায় ডাকিতে পাঠাইয়াছিলেন।

এই কথা বলিবামাত্র, চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্করকে! কিঙ্করও চকিত হইয়া কহিল, কি আমাকে! তখন চন্দ্রপ্রভা কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, হাঁ তোমাকে। তুমি উহার নিকট হইতে ফিরিয়া গিয়া বলিলে, তিনি প্রহার করিলেন; বলিলেন, আমার বাটী নাই, আমার স্ত্রী নাই। এখন আবার, যেন কিছুই জান না, এইরূপ ভান করিতেছ। চিরঞ্জীব শুনিয়া, ঈষৎ কুপিত হইয়া, কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কি এই স্ত্রীলোকের সহিত কথোপকথন করিয়াছিলে। সে কহিল, না মহাশয়! আমি উহার সঙ্গে কখন কথা কহিলাম; কথা কহা দূরে থাকুক, ইহার পূর্ব্বে আমি উহারে কখনও দেখি নাই। চিরঞ্জীব কহিলেন, দুরাত্মন্‌! তুমি মিথ্যা বলিতেছ; উনি যে সকল কথা বলিতেছেন, তুমি আপণে গিয়া আমার নিকট অবিকল ঐ কথাগুলি বলিয়াছিলে। সে কহিল, না মহাশয়। আমি কখনও বলি নাই; জন্মাবচ্ছিন্নে আমি উঁহার সহিত কথা কই নাই। চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার সঙ্গে যদি দেখা ও কথা না হইবে, উনি কেমন করিয়া আমাদের নাম জানিলেন।

হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবের ও কিঙ্করের কথোপকথন শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হইলেন, এবং চিরঞ্জীবকে, স্বীয় পতি জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব জ্ঞানে সম্ভাষণ করিয়া, আক্ষেপ বচনে কহিতে লাগিলেন, নাথ! যদিই আমার উপর বিরাগ জন্মিয়া থাকে, চাকরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া, এরূপে অপমান করা উচিত নহে। আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে এরূপ ছল করিয়া আমার এত লাঞ্ছনা করিতেছ। তুমি কখনই আমায় পরিত্যাগ করিতে পারিবে না। তুমি যা ভাব না কেন, আমি তোম। বই আর জানি না; যাবৎ এ দেহে প্রাণ থাকিবেক, তাবৎ আমি তোমার বই আর কারও নই। আমি জীবিত থাকিতে, তুমি কখনও অন্যের হইতে পারিবে না। তুমি দিবাকর, আমি কমলিনী; তুমি শশধর, আমি কুমুদিনী; তুমি জলধর, আমি সৌদামিনী। তুমি পরিত্যাগ করিতে চাহিলেও, আমি তোমায় ছাড়িব না। অতএব, আর কেন, গৃহে চল; কেন অনর্থক লোক হাসাইবে, বল।

এই সকল কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ কি দায় উপস্থিত! কেহ কখনও এমন বিপদে পড়ে না। এ ত পতিজ্ঞানে আমায় সম্ভাষণ করিতেছে। যেরূপ ভাবভঙ্গী দেখিতেছি, তাহাতে বৈদেশিক লোক পাইয়। পরিহাস করিতেছে, সেরূপও প্রতীতি হইতেছে না। আকার প্রকার দেখিয়া স্পষ্ট বোধ হইতেছে, এ সম্ভ্রান্ত লোকের কন্যা, সামান্যা কামিনী নহে। আমি নিতান্ত অপরিচিত বৈদেশিক ব্যক্তি, আমাকে পতিজ্ঞানে সম্ভাষণ করে কেন। আমি কি নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছি; অথবা, ভূতাবেশ বশতঃ আমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহাতেই এরূপ দেখিতেছি ও শুনিতেছি। যাহা হউক, কোনও অনির্ণীত হেতু বশতঃ, আমার দর্শনশক্তির ও শ্রবণশক্তির সম্পূর্ণ বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সংশয় নাই। এখন কি উপায়ে এ দায় হইতে নিষ্কৃতি পাই।

এই সময়ে বিলাসিনী কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি সত্বর বাটীতে গিয়া ভূত্যদিগকে সমস্ত প্রস্তুত করিতে বল, আমরা যাইবামাত্র আহার করিতে বসিব। তখন কিঙ্কর, চিরঞ্জীবের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, অস্থির লোচনে আকুল বচনে কহিতে লাগিল, মহাশয়। আপনি সবিশেষ না জানিয়া কোথায় আসিয়াছেন। এ বড় সহজ স্থান নহে। এখানকার সকলই মায়া, সকলই ইন্দ্রজাল। আমরা সহজে নিষ্কৃতি পাইব, বোধ হয় না। যে রঙ্গ দেখিতেছি, প্রাণ বাচাইয়া দেশে যাইব, আমার আর সে আশা নাই। এই মানবরূপিণী ঠাকুরাণীরা যেরূপ মায়াবিনী, তাহাতে ইহাদের হস্ত হইতে সহজে নিস্তার পাইব, মনে করিবেন না। কি অশুভ ক্ষণেই এ দেশে পদাপর্ণ করিয়াছিলেন। যেরূপ দেখিতেছি, ইঁহাদের মতের অনুবর্ত্তী হইয়া না চলিলে, নিঃসংশয় প্রাণসংশয় ঘটিবেক। অতএব যাহা কর্ত্তব্য হয়, বিবেচনা করুন। কিঙ্করের এই সকল কথা শুনিয়া, অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া, বিলাসিনী কহিলেন, অহে কিঙ্কর! তোমায় পরিহাসের অনেক কৌশল আইসে, তা আমরা বহু দিন অবধি জানি; আর তোমার সে বিষয়ে নৈপুণ্য দেখাইতে হইবেক না; আমরা বড় আপ্যাষিত হইয়াছি। এক্ষণে ক্ষান্ত হও; যা বলি, তা শুন। শুনিয়া সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, কিঙ্কর চিরঞ্জীবকে কহিল, মহাশয়। আমার বুদ্ধিলোপ হইরাছে, এখন কি করিবেন, করুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, কেবল তোমার নয়, আমিও দেখিয়া শুনিয়া, তোমার মত, হতবুদ্ধি হইয়াছি। তখন চন্দ্রপ্রভা, চিরঞ্জীবের হস্তে ধরিয়া, আর কেন, গৃহে চল; চাকর মনিবে মন্ত্রণা করিয়া, আজ আমার যথেষ্ট লাঞ্ছনা করিলে। সময় অতীত হইয়া গিয়াছে, আর বিলম্বে কাজ নাই। তিনি তাঁহাকে এই বলিয়া বলপূর্ব্বক গৃহে লইয়া চলিলেন। চিরঞ্জীব, অয়স্কান্তে আকৃষ্ট লৌহের ন্যায়, নিতান্ত অনায়ত্ত হইয়া, আপত্তি বা অনিচ্ছাপ্রদর্শন করিতে পারিলেন না। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বাটীতে উপস্থিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কিরুকে কহিলেন, দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখ, যদি কেহ তোমার প্রভুর অনুসন্ধান করে, বলিবে, আজ তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে না; এবং যে কেন হউক না, কাহাকেও কোনও কারণে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিবে না। অনন্তর, চিরঞ্জীবকে কহিলেন, নাথ! আজ আমি তোমায় আর বাড়ীর বাহির হইতে দিব না; তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। চিরঞ্জীব, দেখিয়া শুনিয়া হতবুদ্ধি হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, আজ আমার অদৃষ্টে এ কি ঘটিল। আমি পৃথিবীতে আছি, কি স্বর্গে রহিয়াছি; নিদ্রিত আছি, কি জাগরিত রহিয়াছি; প্রকৃতিস্থ আছি, কি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছি; কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এক্ষণে কি করি; অথবা ইহাদের অভিপ্রায়ের অনুবর্ত্তী হইয়া চলি, ভাগ্য যাহা আছে, তাহাই ঘটিবেক। তাহাকে বাটীর অভ্যন্তরে যাইতে দেখিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! আমি কি দ্বারদেশে বসিয়া থাকিব। চিরঞ্জীব কোনও উত্তর দিলেন না। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, দেখিও যেন কেহ বাটীতে প্রবেশ করিতে না পায়। ইহার অন্যথা হইলে, আমি তোমার যৎপরোনাস্তি শাস্তি করিব। এই বলিয়া, চিরঞ্জীবকে লইয়া তিনি অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন।

ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

জয়স্থলবাসী কিঙ্কর, চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে, দ্বিতীয় বার স্বীয় প্রভুর অন্বেষণে নির্গত হইয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের বিপণিতে তাঁহার দর্শন পাইল; এবং কহিল, মহাশয়! এখনও কি আপনকার ক্ষুধা বোধ হয় নাই। সত্বর বাটীতে চলুন; কর্ত্রী ঠাকুরাণী আপনকার জন্য অস্থির হইয়াছেন। আপনি, ইতিপূর্বে সাক্ষাৎকালে, যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, এবং অকারণে আমায় যে প্রহার করিয়াছিলেন, আমি সে সমস্ত তাঁহার নিকটে বলিয়াছি। শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আজ কখন তোমর সঙ্গে দেখা হইল, কখন বা তোমায় কি কথা বলিলাম, এবং কখনই বা তোমায় প্রহার করিলাম। সে যাহা হউক, গৃহিণীর নিকট কি কথা বলিয়াছ, বল। সে কহিল, কেন আপনি বলিয়াছিলেন, আমি কোথায় যাইব, আমার বাটী নাই, আমি বিবাহ করি নাই, আমার স্ত্রী নাই। এই সকল কথা আমি তাঁহার নিকটে বলিয়াছি। তৎপরে, তিনি পুনরায় আমায় আপনার নিকটে পাঠাইলেন; বলিয়া দিলেন, যেরূপে পার, তাঁহাকে সত্বর বাটীতে লইয়া আইস।

শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে পাপিষ্ঠ! তুমি কোথায় এমন মাতলামি শিখিয়াছ; কতকগুলি কল্পিত কথা শুনাইয়া অকারণে তাঁহার মনে কষ্ট দিয়াছ। তোমার এরূপ করিবার তাৎপর্য্য কি, বুঝিতে পারিতেছি না। আমার সঙ্গে দেখা নাই, অথচ আমার নাম করিয়া তুমি তাঁহার নিকট এই সকল কথা বলিয়াছ। কিঙ্কর কহিল, আমি তাহাকে একটিও অলীক কথা শুনাই নাই; আপণে সাক্ষাৎকালে যাহা বলিয়াছেন, ও যাহা করিয়াছেন, আমি তাহার অতিরিক্ত কিছুই বলি নাই। আপনি যখন যাহাতে সুবিধা দেখেন, তাহাই বলেন, তাহাই করেন। আপনি আমায় যে প্রহার করিয়াছেন, কর্ণমূলে তাহার চিহ্ন রহিয়াছে। এখন কি প্রহার পর্য্যন্ত অপলাপ করিতে চাহেন। চিরঞ্জীব ক্রোধে অধীর হইয়া কহিলেন, তোমায় আর কি বলিব, তুমি গর্দ্দভ। কিঙ্কর কহিল, তাহার সন্দেহ কি, গর্দ্দভ না হইলে, এত প্রহার সহ্য করিতে পারিব কেন। গর্দ্দভ, প্রহৃত হইলে, নিরুপায় হইয়া, পদপ্রহার করে; অতঃপর আমিও সেই পথ অবলম্বন করিব; তাহা হইলে, আপনি সতর্ক হইবেন, আর কথায় কথায় আমায় প্রহার করিতে চাহিবেন না।

চিরঞ্জীব, যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, তাহার কথার আর উত্তর না দিয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারকে বলিলেন, দেখ, আমার গৃহ প্রতিগমনে বিলম্ব হইলে, গৃহিণী অত্যন্ত আক্ষেপ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন, এবং নানা সন্দেহ করিয়া, আমার সহিত বিবাদ ও বাদানুবাদ করিয়া থাকেন। অতএব, তুমি সঙ্গে চল; তাঁহার নিকটে বলিবে তাহার জন্যে যে হার গড়িতেছ, তাহ এই সময়ে প্রস্তুত হইবার কথা ছিল; প্রস্তত হইলেই লইয়া যাইব, এই আশায় আমি তোমার বিপণিতে বসিয়াছিলাম; কিন্তু এ বেলা প্রস্তুত হইয়া উঠিল না; সায়ংকালে নিঃসন্দেহ প্রস্তুত হইবেক এবং কল্য প্রাতে তুমি তাঁহার নিকটে লইয়া যাইবে। তাঁহাকে এই কথা বলিয়া, সন্নিহিত রত্নদত্ত শ্রেষ্ঠীকে কহিলেন, আপনিও চলুন, আজ সকলে এক সঙ্গে আহার করিব; অনেক দিন আপনি আমার বাটীতে আহার করেন নাই। রত্নদত্ত ও বসুপ্রিয় সম্মত হইলেন; চিরঞ্জীব, উভয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় ভবনের অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বাটীর সন্নিকৃষ্ট হইয়া, চিরঞ্জীব দেখিলেন, দ্বার রুদ্ধ রহিয়াছে; তখন কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি অগ্রসর হইয়া, আমাদের পঁহুছিবার পূর্ব্বে, দ্বার খুলাইয়া রাখ। কিঙ্কর, সত্বর গমনে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া, অপরাপর ভূত্যদিগের নাম গ্রহণ পূর্ব্বক দ্বার খুলিয়া দিতে বলিল। চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে হেমকূটবালী কিঙ্কর ঐ সময়ে দ্বারবানের কার্য্য সম্পাদন করিতেছিল, সে কহিল, তুমি কে, কি জন্যে দ্বার খুলিতে বলিতেছ; গৃহস্বামিনী যেরূপ অনুমতি দিয়াছেন, তাহাতে আমি কদাচ দ্বার খুলিব না এবং কাহাকেও বাটীতে প্রবেশ করিতে দিব না। অতএব তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও, আর ইচ্ছা হয়, রাস্তায় বসিয়া রোদন কর। এইরূপ উদ্ধত ও অবজ্ঞাপূর্ণ বাক্য শুনিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, তুই কে, কোথাকার লোক, তোর কেমন আচরণ; প্রভু পথে দাঁড়াইয়। রহিলেন, তুই দ্বার খুলিয়া দিবি না। হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, তোমার প্রভুকে বল, তিনি যেখান হইতে আসিয়াছেন, সেই খানে ফিরিয়া যান। আমি কোনও ক্রমে তাঁহাকে এ বাটীতে প্রবেশ করিতে দিব না।

কিঙ্করের কথায় দ্বার খুলিল না দেখিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, কে ও, বাটীর ভিতরে কথা কও হে, শীঘ্র দ্বার খুলিয়া দাও। পরিহাসপ্রিয় হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, আমি কখন দ্বার খুলিয়া দিব, তাহা আমি আপনাকে পরে বলিব; আপনি কি জন্যে দ্বার খুলিতে বলিতেছেন, তাহা আমায় আগে বলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আহারের জন্যে; আজ এ পর্য্যন্ত আমার আহার হয় নাই। কিঙ্কর কহিল, এখন এখানে আপনকার আহারের কোনও সুবিধা নাই; ইচ্ছা হয়, পরে কোনও সময়ে আসিবেন। তখন চিরঞ্জীব কোপান্বিত হইয়া কহিলেন, তুমি কে হে, যে আমায় আমার বাটীতে প্রবেশ করিতে দিতেছ না। কিঙ্কর কহিল, আমি এই সময়ের জন্য দ্বাররক্ষার ভার পাইয়াছি, আমার নাম কিঙ্কর। এই কথা শুনিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, অরে দুরাত্মন! তুই আমার নাম ও পদ উভয়ই, অপহরণ করিয়াছিস্; যদি ভাল চাহিস্, শীঘ্র দ্বার খুলিয়া দে, প্রভু কত ক্ষণ পথে দাঁড়াইয়া থাকিবেন। হেমকূটবাসী কিঙ্কর তথাপি দ্বার খুলিয়া দিল না। তখন জয়স্থলবাসী কিঙ্কর স্বীয় প্রভুকে কহিল, মহাশয়। আজ ভাল লক্ষণ দেখিতেছি না; সহজে দ্বার খুলিয়া দেয়, এরূপ বোধ হয় না। ধাক্কা মারিয়া দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলুন, আর কত ক্ষণ এমন করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবেন; বিশেষতঃ, আপনকার নিমন্ত্রিত এই দুই মহাশয়ের অতিশয় কষ্ট হইতেছে।

এই সময়ে চন্দ্রপ্রভা অভ্যন্তর হইতে কহিলেন, কিঙ্কর। ওরা সব কে, কি জন্যে দরজায় জমা হইয়া গোলযোগ করিতেছে। হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, ঠাকুরাণি! গোলযোগের কথা কেন জিজ্ঞাসা করেন, আপনাদের এই নগরটি উচ্ছৃঙ্খল লোকে পরিপূর্ণ; এখানে গোলযোগের অপ্রতুল কি। চন্দ্রপ্রভার স্বর শুনিতে পাইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, বলি, গিন্নি। আজকার এ কি কাণ্ড। এই কথা শুনিবামাত্র, চন্দ্রপ্রভা কোপে জ্বলিত হইয়া কহিলেন, তুই কোথাকার হতভাগা, দূর হয়ে যা, দরজার কাছে গোল করিস না। লক্ষ্মীছাড়ার আস্পর্দ্ধা দেখ না, রাস্তায় দাঁড়াইয়া আমায় গিন্নি বলিয়া সম্ভাষণ করিতেছে। জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! বড় লজ্জার কথা, এঁরা দুজন দাঁড়াইয়া রহিলেন, আমরা দরজা খুলাইতে পারিলাম না। যাহাতে শীঘ্র খুলিয়া দেয়, তাহার কোনও উপায় করুন। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর! আমি দেখিয়া শুনিয়া এক বারে হতবুদ্ধি হইয়াছি, আজকার কাণ্ড কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তখন কিঙ্কর কহিল, তবে আর বিলম্বে কাজ নাই, দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, অতঃপর সেই পরামর্শই ভাল, দরজা ভাঙ্গা বই আর উপায় দেখিতেছি না। যেখানে পাও, সত্বর দুই তিন খান কুঠার লইয়া আইস। কিঙ্কর যে আজ্ঞা বলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল।  এই সময়ে রত্নদত্ত কহিলেন, মহাশয়! ধৈর্য্য অবলম্বন করুন। কোনও ক্রমে দরজা ভাঙ্গা হইবেক না। যাহা দেখিলাম, যাহা শুনিলাম, তাহাতে ক্রোধ সংবরণ করা সহজ নয়। রক্ত মাংসের শরীরে এত সহ্য হয় না। কিন্তু, সংসারী ব্যক্তিকে অনেক বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে হয়। এখন আপনি ক্রোধাভরে এক কর্ম্ম করিবেন, কিন্তু ক্রোধশান্তি হইলে, যার পর नाই অনুতাপগ্রস্ত হইবেন। অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া কোনও কর্ম্ম করা পরামর্শসিদ্ধ নয়। যদি, এই দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, আপনি দ্বারভঙ্গে প্রবৃত্ত হন, রাজপথবাহী সমস্ত লোক, সমবেত হইয়া, কত কুতর্ক উপস্থিত করিবেক। আপনকার কলঙ্ক রাখিবার স্থান থাকিবেক না। মানবজাতি নিরতিশয় কুৎসাপ্রিয়; লোকের কুৎসা করিবার নিমিত্ত, কত অমূলক গল্প কল্পনা করে, এবং কপিত গল্পের আকর্ষণী শক্তি সম্পাদনের নিমিত্ত, উহাতে কত অলঙ্কার যোজনা করিয়া দেয়। যদি কোনও ব্যক্তির প্রশংসা করিবার সহস্ৰ হেতু থাকে, অধিকাংশ লোকে ভুলিয়াও সে দিকে দৃষ্টিপাত করে না; কিন্তু কুৎসা করিবার অণুমাত্র সোপান পাইলে, মনের আমোদে সেই দিকে ধাবমান হয়। আপনি নিতান্ত অমায়িক; মনে ভাবেন, কখনও কাহারও অপকার করেন নাই, সাধ্য অনুসারে সকলের হিতচেষ্টা করিয়া থাকেন; সুতরাং কেহ আপনকার বিপক্ষ ও বিদ্বেষী নাই; সকলেই আপনকার আত্মীয় ও হিতৈষী। কিন্তু আপনকার সে সংস্কার সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক। আপনি প্রাণপণে যাঁহাদের উপকার করিয়াছেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে আত্মীয়া বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই আপনকার বিষম বিদ্বেষী। ঐ সকল ব্যক্তি আপনকার যার পর নাই কুৎসা করিয়া বেড়ান। কতকগুলি নিরপেক্ষ লোক আপনকার যথার্থ গুণগ্রাহী আছেন; তাঁহারা, আপনকার দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি সদ্‌গুণপরম্পরা দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করিয়া থাকেন। আপনি অতি সামান্য ব্যক্তি ছিলেন, এক্ষণে জয়স্থলে বিলক্ষণ মাননীয় ও প্রশংসনীয় হইয়াছেন। এজন্য, যে সকল লোক সচরাচর ভদ্র বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিরই অন্তঃকরণ ঈর্ষ্যারসে সাতিশয় কলুষিত হইয়া আছে। তাঁহারা আপনকার অনুষ্ঠিত কর্ম্মমাত্রেরই এক এক অভিসন্ধি বহিষ্কৃত করেন; আপনি কোনও কর্ম্ম ধর্ম্মবুদ্ধিতে করিয়া থাকেন, তাহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতে দেন না। আমি অনেক বার অনেক স্থলে দেখিয়াছি, আপনকার অনুষ্ঠিত কর্ম্ম সমুদয়ের উল্লেখ করিয়া কেহ প্রশংসা করিলে, তাঁহাদের নিতান্ত অসহ্য হয়; তাহারা তৎক্ষণাৎ তত্তৎ কর্ম্মকে অসদভিসন্ধিপ্রয়োজিত বা স্বার্থানুসন্ধানমূলক বলিইয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা পান; অবশেষে, যাহা কখনও সম্ভব নয় এরূপ গল্প তুলিয়া, আপনকার নির্ম্মল চরিতে কুৎসিত কলঙ্ক যোজনা করিয়া থাকেন। এমন স্থলে, কুৎসা করিবার এরূপ সোপান পাইলে, ঐ সকল মহাত্মাদের আমোদের সীমা থাকিবেক না; তাঁহারা আপনারে একবারে নরকে নিক্ষিপ্ত করিবেন। আর, আমরা আপনকার গৃহিণীকে বিলক্ষণ জানি। তিনি নির্ব্বোধ নহেন। তিনি যে, এ সময়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আপনাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিতেছেন না, অবশ্যই ইহার বিশিষ্ট হেতু আছে; আপনি এখন তাহা জানেন না; পরে সাক্ষাৎ হইলে, তিনি অবশ্যই আপনাকে বুঝাইয়া দিবেন। অতএব, আমার কথা শুনুন, আর এখানে দাঁড়াইয়া গোল করিবার প্রয়োজন নাই; চলুন, এ বেলা আমরা স্থানান্তরে গিয়া আহার করি। অপরাহ্লে একাকী আসিয়া, এই বিসদৃশ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করিবেন।

রত্নদত্তের কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর কহিলেন, আপনি সৎপরামশের কথাই বলিয়াছেন, ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া, এখান হইতে চলিয়া যাওয়াই সর্ব্বাংশে শ্রেয়ঃকল্প বোধ হইতেছে। যাহা বলিলেন, আমার স্ত্রী কোনও ক্রমে নির্ব্বোধ নহেন। কিন্তু তাহার একটি বিষম দোষ আছে। আমার বাটীতে আসিতে বিলম্ব হইলে, তিনি নিতান্ত অস্থির ও উন্মত্তপ্রায় হন, এবং মনে নানা কুতর্ক উপস্থিত করিয়া, অকারণে আমার সঙ্গে কলহ করেন। আজ বিশেষতঃ কিঙ্কর তাঁহাকে অতিশয় রাগাইয়া দিয়াছে; তাহাতেই এই অনর্থ উপস্থিত হইয়াছে, বুঝিতে পারিতেছি। অনন্তর, বসুপ্রিয়কে কহিলেন, বোধ করি, এত ক্ষণে হার প্রস্তুত হইয়াছে; তুমি অবিলম্বে বাটী প্রতিগমন কর; আমি অপরাজিতার আবাসে থাকিব, হার লইয়া তথায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে; দেখিও, যেন কোনও মতে বিলম্ব না হয়। ঐ হার আমি তাঁহাকে দিব; তাহা হইলেই, গৃহিণী বিলক্ষণ শিক্ষা পাইবেন, এবং আর কখনও আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিবেন না। বসুপ্রিয় কহিলেন, যত সত্বর পারি, হার লইয়া সাক্ষাৎ করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি দ্রুত পদে প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব ও রত্নদত্ত অভিপ্রেত স্থানে গমন করিলেন।

এ দিকে, আহারের সময়, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব প্রায়ই মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, চন্দ্রপ্রভা বা বিলাসিনীর কোনও কথার উত্তর দিলেন না; এবং, কোথায় আসিয়াছি, কি করিতেছি, অবশেষেই বা কি বিপদে পড়িব,, এই দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া, ভাল রূপে আহারও করিতে পারিলেন মা। তাহার এই ভাব দেখিয়া, চন্দ্রপ্রভা স্থির করিলেন, তিনি তাঁহার প্রতি একবারেই নির্ম্মম ও অনুরাগশূন্য হইয়াছেন। তদনুসারে, তিনি শিরে করাঘাত ও রোদন করিতে করিতে, গৃহান্তরে প্রবেশ পূর্বক, ভূতলশায়িনী হইলেন। চিরঞ্জাব ব্যতিরিক্ত আর কেহ সেখানে নাই দেখিয়া, বিলাসিনী তাঁহাকে বুঝাইতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কহিলেন, দেখ, ভাই! তুমি তাঁহার স্বামী নও, তিনি তোমার স্ত্রী নন, বারংবার যে এই সকল কথা বলিতেছ, ইহার কারণ কি! তুমি এত বিরক্ত হইতে পার, আমি ত দিদির তেমন কোনও অপরাধ দেখিতেছি না। এই তোমাদের প্রণয়ের সময়, যাহাতে উত্তরোত্তর প্রণয়ের বৃদ্ধি হয়, উভয়েরই প্রাণপণে সেই চেষ্টা করা উচিত। প্রণয়বৰ্দ্ধনের কথা দূরে থাকুক, তুমি একবারে পরিণয়পর্য্যন্ত অপলাপ করিতেছ। যদি কেবল ঐশ্বর্য্যের অনুরোধে দিদির পাণিগ্রহণ করিয়া থাক, তাহা হইলে, সেই ঐশ্বর্য্যের অনুরোধেই দিদির প্রতি দয়া ও সৌজন্য প্রদর্শন করা উচিত। আজ তোমার যেরূপ ভাব দেখিতেছি, তাহাতে দিদির প্রতি তোমার যে কিছুমাত্র দয়া বা মমতা আছে, এরূপ বোধ হয় না। তুমি আমার স্ত্রী নও, আমি তোমার পতি নই, আমি তোমার পাণিগ্রহণ করি নাই; বাটীর সকল লোকের সমক্ষে, দিদির মুখের উপর, এ সকল কথা বলা অত্যন্ত অন্যায়। স্বামীর মুখে এরূপ কথা শুনা অপেক্ষা স্ত্রীলোকের পক্ষে অধিকতর ক্লেশকর আর কিছুই নাই। বলিতে কি, আজ তুমি দিদির সঙ্গে নিতান্ত ইতরের ব্যবহার করিতেছ। যদি মনেও অনুরাগ না থাকে, মৌখিক প্রণয় ও সৌজন্য দেখাইবার হানি কি; তাহা হইলেও দিদির মন অনেক তুষ্ট থাকে। যা হউক, ভাই। আজ তুমি বড় ঢলাঢলি করিলে। স্ত্রীপুরুষে এরূপ ঢলাঢলি করা কেবল লোক হাসান মাত্র। তোমার আজকার আচরণ দেখিলে, তুমি যেন সে লোক নও, বোধ হয়। কি কারণে আজ এত বিরস বদনে রহিয়াছ, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। মুখ দেখিলে বোধ হয়, তোমার অন্তঃকরণ দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া আছে। এখন আমার কথা শুন, ঘরের ভিতরে গিয়া দিদিকে সান্ত্বনা কর। বলিবে, ইতিপূর্ব্বে যাহা কিছু বলিয়াছি, সে সব পরিহাস মাত্র, তোমার মনের ভাব পরীক্ষা ভিন্ন তাহার আর কোনও অভিসন্ধি নাই। যদি দুটা মিষ্ট কথা বলিলে তাঁহার অভিমান দূর হয় ও খেদ নিবারণ হয়, তাহাতে তোমার আপত্তি কি।

বিলাসিনীর বচনবিন্যাস শ্রবণ করিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, অয়ি চারুশীলে! আমি দেখিয়া শুনিয়া এককালে হতজ্ঞান হইয়াছি; আমার বুদ্ধিকস্ফূর্তি বা বাঙনিষ্পত্তি হইতেছে না। তোমার কথার কি উত্তর দিব, ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমি, যে পথে প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত, এত ক্ষণ আমায় উপদেশ দিলে, আমি সে পথের পথিক নই; প্রাণান্তেও তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে পারিব না। তোমরা দেবী কি মানবী, আমি এ পর্য্যন্ত তাহ স্থির করিতে পারি নাই। যদি দেবযোনিসম্ভবা হও, আমায় স্বতন্ত্র বুদ্ধি ও স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি দাও; তাহা হইলে, তোমাদের অভিপ্রায়ের অনুবর্ত্তী হইয়া চলিতে পারি; নতুবা, এখন আমার যেরূপ বুদ্ধি ও যেরূপ প্রবৃত্তি আছে, তদনুসারে আমি কোনও ক্রমে পরকীয় মহিলার সংস্রবে যাইতে পারিব না। স্পষ্ট কথায় বলিতেছি, তোমার ভগিনী আমার পত্নী নহেন, আমি কখনও উঁহার পাণিগ্রহণ করি নাই। তিনি অধীর হইয়া অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন, সত্য বটে; কিন্তু তাঁহার খেদাপনয়নের নিমিত্তে তুমি এত ক্ষণ আমায় যে উপদেশ দিলে, আমি প্রাণান্তেও তদনুযায়ী কার্য্য করিতে পারিব না। আমি বিনয় করিয়া বলিতেছি, তুমি আর আমায় ওরূপ উপদেশ দিও না। যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে তিনি বিবা হিত কামিনী। জানিয়া শুনিয়া কি রূপে অপকর্ম্মে প্রবৃত্ত হই বল। আমি অবিবাহিত পুরুষ। তুমিও অদ্যাপি অবিবাহিতা আছ, বোধ হইতেছে। যদি তোমার অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত কর। আমি তোমায় সহধর্ম্মিণীভাবে পরিগ্রহ করিতে প্রস্তুত আছি। প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরস্পর যথাবিধি পরিণয়শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইলে, প্রাণপণে তোমার সন্তোষ সম্পাদনে যত্ন করিব, এবং যাবজ্জীবন তোমার মতের অনুব্ররত্তী হইয়া চলিব। প্রেয়সি! বলিতে কি, তোমার রূপ লাবণ্য দর্শনে ও বচনমাধুরী শ্রবণে আমার মন এত মোহিত হইয়াছে, যে তোমার সম্মতি হইলে আমি এই দণ্ডে তোমায় বিবাহ করি। বিলাসিনী শুনিয়া, চকিত হইয়া, কছিলেন, আমি তোমার প্রেয়সী নই, দিদি তোমার প্রেয়সী, তাঁহারেই এই প্রিয়সম্ভাষণ করা উচিত। চিরঞ্জীব কহিলেন, যাহার প্রতি মনের অনুরাগ জন্মে, সেই প্রেয়সী; তোমার প্রতি আমার মন অনুরক্ত হইয়াছে, অতএব তুমিই আমার প্রেয়সী; তোমার দিদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি; তিনি আমার প্রেয়সী নহেন। এই কথা শুনিয়া বিলাসিনী কহিলেন, বলিতে কি, ভাই! তুমি যথার্থই পাগল হয়েছ; নতুবা এমন কথা কেমন করিয়া মুখে আনিলে। ছি ছি! কি লজ্জার কথা, আর যেন কেহ ও কথা শুনে না। দিদি শুনিলে আত্মঘাতিনী হইবেন। আমি দিদিকে ডাকিয়া দিতেছি; অতঃপর তিনি আপনার মামলা আপনি করুন। তোমার যে ভাব দেখিতেছি, আমি আর একাকিনী তোমার নিকটে থাকিব না। এই বলিয়া, বিলাসিনী সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। হেমকুটের চিরঞ্জীব, হতবুদ্ধি হইয়া, একাকী সেই স্থানে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

এই সময়ে, হেমকূটবাসী কিঙ্কর, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া, চিরজীবের নিকটে উপস্থিত হইল, এবং আকুল বচনে কহিতে লাগিল, মহাশয়! আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি; রক্ষা করুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, ব্যাপার কি বল। সে কহিল, এ বাটীর কর্ত্রী ঠাকুরাণী যেরূপ, পরিচারিণীগুলিও অবিকল সেই রূপ চরিত্রের লোক; কর্ত্রী ঠাকুরাণী যেমন আপনাকে পতি বলিয়া অধিকার করিতে চাহেন, পাকশালায় যে পরিচারিণী আছে, সে আমাকে সেইরূপ অধিকার করিতে চাহে। সে আমার নাম জানে, আমার শরীরের কোন স্থানে কি চিহ্ন আছে, সমুদয় জানে। সে কিরূপে এ সমস্ত জানিতে পারিল, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। সে সহসা আমার নিকটে উপস্থিত হইল, এবং প্রণয়সম্ভাষণ পূর্ব্বক কহিল, এখানে একাকী বসিয়া কি করিতেছ; পাকশালায় আইস, আমোদ আহ্লাদ করিব। সে এই বলিয়া, আমার হস্তে ধরিয়া, টানাটানি করিতে লাগিল। তাহার আকার প্রকার দেখিয়া, আমার মনে এমন ভয় জন্মিল যে আমি কোনও ক্রমে তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম না। সে যেমন বিশ্রী, তেমনই স্থূলকায় ও দীর্ঘাকার। আমি আপনকার সঙ্গে অনেক দেশ বেড়াইয়াছি, কিন্তু কখনও এমন ভয়ানক মূর্ত্তি দেখি নাই; আমার বোধ হয়, সে রাক্ষসী, মানুষী নয়। আমি যমালয়ে যাইতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু প্রাণান্তেও পাকশালায় প্রবিষ্ট হইতে পারিব না। অধিক কি বলিব, তাহার আকার প্রকার দেখিয়া, আমার শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। আমি পাকশালায় যাইতে যত অসম্মত হইতে লাগিলাম, সে উত্তরোত্তর ততই উৎপীড়ন করিতে লাগিল। অবশেষে, পলাইয়া আপনকার নিকটে আসিয়াছি, যাহাতে আমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাই, তাহা করুন।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর। আমি কি রূপে তোমার নিস্তার করিব, বল;আমার নিস্তার কে করে, তাহার ঠিকানা নাই। এ দেশের সকলই অদ্ভুত কাণ্ড। পাকশালার পরিচারিণী কিরূপে তোমার নাম ও শরীরগত চিহ্ন সকল জানিতে পারিল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, সত্বর পলায়ন ব্যতিরেকে নিস্তারের পথ নাই। তুমি এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করিও না, এখনই চলিয়া যাও এবং অনুসন্ধান – করিয়া জান, আজ কোনও জাহাজ এখান হইতে স্থানান্তরে যাইতেছে কি না। তুমি এই সংবাদ লইয়া আপণে যাইবে, আমিও ইতিমধ্যে তথায় উপস্থিত হইতেছি। অথবা বিলম্বের প্রয়োজন কি, এখন এখানে কেহ নাই; এক সঙ্গেই পলায়ন করা ভাল। এই বলিয়া চিরঞ্জীব, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে সেই ভবন হইতে বহির্গত হইলেন, এবং তাহাকে অর্ণৰপোতের অনুসন্ধানে প্রেরণ করিয়া, দ্রুত পদে আপণ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

বসুপ্রিয় স্বর্ণকার, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবের আদেশ অনুসারে, হার আনিতে গিয়াছিলেন। তিনি এই সময়ে হার লইয়া তাঁহার নিকটে যাইতেছিলেন; পথিমধ্যে হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব বোধ করিয়া কহিলেন, এই যে চিরঞ্জীব বাবুর সহিত পথেই সাক্ষাৎ হইল। তিনি কহিলেন, হাঁ আমার নাম চিরঞ্জীব বটে। বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনকার নাম আমি বিলক্ষণ জানি, আপনারে আর সে পরিচয় দিতে হইবেক না; এ নগরে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আপনকার নাম জানে। আমি হার অনিয়াছি, লউন। এই বলিয়া, সেই হার তিনি চিরঞ্জীবের হস্তে সমর্পণ করিলেন। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি আমায় এ হার দিতেছেন কেন; তামি হার লইয়া কি করিব। বসুপ্রিয় কহিলেন, সে কথা আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন; আপনকার যাহা ইচ্ছা হয়, করিবেন; হার আপনকার আদেশে তাপনকার জন্যে প্রস্তুত হইয়াছে। তিনি কহিলেন, কই, আমি ত আপনাকে হার গড়িতে বলি নাই। বসুপ্রিয় কহিলেন, সে কি মহাশয়! এক বার নয়, দুই বার নয়, অন্ততঃ বিশ বার, আপনি আমায় এই হার গড়িতে বলিয়াছেন। কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে এই হারের জন্য আমার বাটীতে অন্ততঃ দুই ঘণ্টাকাল বসিয়া ছিলেন এবং আধ ঘণ্টা পূর্ব্বে আমায় এই হার লইয়া আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বলিয়াছেন। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, পরিহাস শুনিবার সময় নাই। আপনি হার লইয়া যান, আমি পরে সাক্ষাৎ করিব এবং হারের মূল্য লইয়া আসিব। তিনি কহিলেন, যদি নিতান্তই আমায় হার লইতে হয়, আপনি উহার মূল্য লউন; হয় ত, অতঃপর আর আপনি আমার দেখা পাইবেন না; সুতরাং এখন না লইলে, পরে আর হারের মূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। বসুপ্রিয় কহিলেন, আমার সঙ্গে এত পরিহাস কেন।

এই বলিয়া, তিনি দ্রুত পদে প্রস্থান করিলেন। চিরঞ্জীব হার লইয়া ভাবিতে লাগিলেন, এ আবার এক অদ্ভুত কাণ্ড উপস্থিত হইল। এখানকার লোকের ভাব বুঝাই ভার। এ ব্যক্তির সহিত কস্মিন্‌ কালে আমার দেখা শুনা নাই, অথচ বহু মূল্যের হার আমার হস্তে দিয়া, চলিয়া গেল; মূল্য লইতে বলিলাম, তাহাও লইল না। এ কি ব্যাপার, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। অথবা, এখানকার সকলই অদ্ভুত ব্যাপার। যাহা হউক, এখানে আর এক মুহূর্ত্তও থাকা বিধেয় নহে। জাহাজ স্থির হইলেই প্রস্থান করিব। সত্বর আপণে যাই; বোধ করি, কিঙ্কর এত ক্ষণে সেখানে আসিয়াছে। এই বলিতে বলিতে, তিনি আপণ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস – ৪

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

 

বসুপ্রিয় স্বর্ণকার, এক বিদেশীয় বণিকের নিকট, পাঁচ শত টাকা ধার লইয়াছিলেন। যে সময়ে পরিশোধ করিবার অঙ্গীকার ছিল, তাহা অতীত হইয়া যায়, তথাপি বণিক বসুপ্রিয়কে উৎপীড়ন করেন নাই। পরে, দূর দেশান্তরে যাইবার প্রয়োজন হওয়াতে, তিনি টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করেন। অবশেষে, অনায়াসে টাকা পাওয়া দুর্ঘট বিবেচনা করিয়া, এক জন রাজপুরুষ সঙ্গে লইয়া, তিনি বসুপ্রিয়ের আলয়ে উপস্থিত হইলেন; এবং তাঁহাকে কহিলেন, আজ আমি এখান হইতে প্রস্থান করিব, সমুদায় আয়োজন হইয়াছে, জাহাজে আরোহণ করিলেই হয়; যে জাহাজে যাইব, উহা সন্ধ্যার প্রাক্কালে জয়স্থল হইতে চলিয়া যাইবে। আমি যে প্রয়োজনে যাইতেছি, তাহাতে সঙ্গে কিছু অধিক টাকা থাকা আবশ্যক। অতএব, আমার প্রাপ্য টাকা গুলি এখনই দিতে হইবেক; না দেন, আপনাকে এই রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করিব। বসুপ্রিয় কহিলেন, টাকা দিতে আমার, এক মুহুর্ত্তের জন্যেও, অনিচ্ছা বা আপত্তি নাই। আপনি আমার নিকট যে টাকা পাইবেন, চিরঞ্জীব বাবুর নিকট আমার তদপেক্ষা অধিক টাকা পাওয়া আছে। তাঁহাকে এক ছড়া হার গড়িয়া দিয়াছি, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেই ঐ হারের মূল্য পাইব। অতএব, আপনি অনুগ্রহ করিয়া, তাহার বাটী পর্যন্ত, আমার সঙ্গে চলুন, সেখানে যাইবা মাত্র আপনি টাকা পাইবেন। তিনি অগত্যা সম্মত হইলে, বসুপ্রিয় তাঁহাকে ও তাঁহার আনীত রাজপুরুষকে সমভিব্যাহারে করিয়। চিরঞ্জীবের আলয়ে চলিলেন।

জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব অপরাজিতার আবাসে আহার করিয়াছিলেন। তাঁহার হস্তে একটি অতি সুন্দর অঙ্গুরীয় ছিল; তিনি তদীয় অঙ্গুলি হইতে ঐ অঙ্গুরীয়টি খুলিয়া লয়েন, বলেন, আমি এটি আর ফিরিয়া দিব না; ইহার পরিবর্তে আপনারে এক ছড়া নূতন হার দিব। হারের বর্ণনা শুনিয়া, অপরাজি্তা দেখিলেন, অঙ্গুরীয় অপেক্ষ হারের মূল্য অন্ততঃ দশগুণ অধিক। এজন্য, তিনি এই বিনিময়ে সম্মত হইয়া, জিজ্ঞাসা করেন, আমি হার কখন পাইব। চিরঞ্জীব কহিয়াছিলেন, স্বর্ণকারের সহিত অবধারিত কথা আছে, হার লইয়া তিনি অবিলম্বে এখানেই আসিবেন। আপনি চারি পাঁচ দণ্ডের মধ্যে হার পাইবেন। নির্দিষ্ট সময় অতীত হইয়া গেল, তথাপি স্বর্ণকার উপস্থিত হইলেন না। চিরঞ্জীব অতিশয় অপ্রতিভ হইলেন, এবং আমি স্বয়ং স্বর্ণকারের বাটীতে গিয়া হার আনিয়া দিতেছি, এই বলিয়া কিঙ্করকে সমভিব্যাহারে লইয়া প্রস্থান করিলেন।

কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, চিরঞ্জীব কিঙ্করকে কহিলেন, দেখ! আজ গৃহিণী যে আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই, তাহার পুরস্কারস্বরূপ, হারের পরিবর্তে, তাঁহাকে একগাছা মোট দড়ী দিব; তিনি ও তাঁহার মন্ত্রিণীরা ঐরূপ হার পাইবারই উপযুক্ত পাত্র। তুমি ঐ রূপ দড়ী সংগ্রহ করিয়া রাখিবে, এবং আমি বাটতে যাইবা মাত্র আমার হস্তে দিবে; দেখিও, যেন বিলম্ব হয় না। এই বলিয়া,. রজ্জুক্রয়ের নিমিত্ত একটি টাকা দিয়া, তিনি তাহাকে বিদায় করিতেছেন, এমন সময়ে স্বর্ণকার, বণিক ও রাজপুরুষ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। যথাকালে হার না পাওয়াতে, চিরঞ্জীব স্বর্ণকারের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া ছিলেন; এক্ষণে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া, ভৎর্সনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, তোমার বাক্যনিষ্ঠা দর্শনে আজ আমি বড় সন্তুষ্ট হইয়াছি; তোমায় বারংবার বলিয়া দিলাম, এই সময় মধ্যে আমার নিকটে হার লইয়া যাইবে; না তুমি গেলে, না হার পাঠাইলে, কিছুই করিলে না; এজন্য আজ আমি বড় অপ্রস্তুত হইয়াছি; তোমার কথায় যে বিশ্বাস করে, তাহার ভদ্রস্থতা নাই। তুমি অতি অন্যায় করিয়াছ। এ পর্যন্ত তুমি না যাওয়াতে, আমি হারের জন্য তোমার ব্তী যাইতেছিলাম।

বসুপ্রিয়, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব জ্ঞান করিয়া, কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে তাঁহার হস্তে হার দিয়াছিলেন। সুতরাং, প্রকৃত ব্যক্তিকে হার দিয়াছেন বলিয়া, তাঁহার সংস্কার ছিল। এজন্য, তিনি কহিলেন, মহাশয়! এখন পরিহাস রাখুন; আপনকার হারের হিসাব প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি, দৃষ্টি করুন। এই বলিয়া, সেই হিসাবের ফর্দ্দ তাহার হস্তে দিয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনকার নিকট আমার পাওয়ানা পাঁচ শত পঞ্চাশ টাকা। আমি এই বণিকের পাঁচ শত টাকা ধারি। ইনি অদ্যই এখান হইতে প্রস্থান করিতেছেন। এত ক্ষণ কোন কালে জাহাজে চড়িতেন, কেবল এই টাকার জন্যে যাইতে পারিতেছেন না। অতএব, আপনি হারের হিসাবে আমায় আপাততঃ পাচ শত টাকা দিউন।

তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, আমার সঙ্গে কি টাকা আছে যে এখনই দিব। বিশেষতঃ, আমার কতকগুলি বরাত আছে, তাহা শেষ না করিয়াও বাটী যাইতে পারিব না। অতএব, তুমি এই মহাশয়কে সঙ্গে করিয়া আমার বাটীতে যাও; আমার স্ত্রীর হস্তে হার দিয়া, আমার নাম করিয়া বলিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ টাকা দিবেন; আর, বোধ করি, আমিও, ঐ সময়ে বাটীতে উপস্থিত হইতেছি। বসুপ্রিয় কহিলেন, হার আপনকার নিকটে থাকুক, আপনিই তাঁহাকে দিবেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, না, সে কথা ভাল নয়; হয় ত, আমি যথাসময়ে পহুছিতে পারিব না; অতএব, আপনিই হার লইয়া যান। তখন বসুপ্রিয় কহিলেন, হার কি আপনকার সঙ্গে আছে। চিরঞ্জীব চকিত হইয়া কহিলেন, ও কেমন কথা! তুমি কি আমায় হার দিয়াছ, যে হার আমার সঙ্গে আছে কি না, জিজ্ঞাসা করিতেছ। বসুপ্রিয় কহিলেন, মহাশয়! এ পরিহাসের সময় নয়, ইঁহার প্রস্থানের সময় বহিয়া যাইতেছে; আর বিলম্ব করা চলে না। অতএব, আমার হস্তে হার দেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, তুমি যে হারের বিষয়ে আমার নিকট অঙ্গীকার রক্ষা করিতে পার নাই, সেই দোষ ঢাকিবার জ্ন্য বুঝি এই ছল করিতেছ। আমি কোথায় সে জন্যে তোমায় ভৎর্সনা করিব, মনে করিয়াছি; না হইয়া তুমি, কলহপ্রিয়া কামিনতর ন্যায়, অগ্রেই তর্জ্জন গর্জ্জন আরম্ভ করিলে। .

এই সময়ে, বণিক বসুপ্রিয়কে কহিলেন, সময় অতীত হইয়া যাইতেছে, আর আমি কোনও মতে বিলম্ব করিতে পারি না। তুখন বসুপ্রিয় চিরজীবকে কহিলেন, মহাশয়! শুনিলেন ত, উনি আর বিলম্ব করিতে পারেন না। চিরঞ্জীব কহিলেন, হার লইয়া আমার স্ত্রীর নিকটে গেলেই টাকা পাইবে। শুনিয়া, সাতিশয় বিরক্ত হইয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, মহাশয়। আপনি কেমন কথা বলিতেছেন; কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমি আপনকার হস্তে হার দিয়াছি; আমার নিকটে আর কেমন করিয়া হার থাকিবেক। হয়, হার পাঠাইয়া দেন, নয় পত্র লিখিয়া দেন। এই কথা শুনিয়া, কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার কৌতুক আর ভাল লাগিতেছে না; হার কেমন হইয়াছে, দেখাও।

উভয়ের এইরূপ বিবাদ দর্শনে ও বাদানুবাদ শ্রবণে, যার পর নাই বিরক্ত হইয়া, বণিক চিরঞ্জীবকে বলিলেন, আপনাদের বাকচাতুরী আর আমার সহ্য হইতেছে না; আপনি টাকা দিবেন কি না, স্পষ্ট বলুন; যদি না দেন, আমি ইঁহাকে রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করি। চিরঞ্জীব কহিলেন, আপনকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি, যে আপনি এত রূঢ় ভাবে আমার সহিত আলাপ করিতেছেন। তখন বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনি হারের হিসাবে আমার টাকা ধারেন, সেই সম্পর্কে উনি এরূপ আলাপ করিতেছেন। সে যাহা হউক, টাকা এই দণ্ডে দিবেন কি না, বলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি যত ক্ষণ হার ন। পাইতেছি, তোমায় এক কপর্দ্দকও দিব না। বসুপ্রিয় কহিলেন, কেন, আমি আধ ঘণ্টা পূর্ব্বে আপনকার হস্তে হার দিয়াছি। চিরঞ্জীব কহিলেন, তুমি কখনই আমায় হার দাও নাই। এরূপ মিথ্যা অভিযোগ করা বড় অন্যায়। উহাতে আমার যথেষ্ট অনিষ্ট করা হইতেছে। বসুপ্রিয় কহিলেন, হার পাওয়া অপলাপ করিয়া, আপনি আমার অধিকতর অনিষ্ট করিতেছেন; চির কালের জন্য আমার সন্ত্রম যাইতেছে।

সত্বর টাকা পাইবার কোনও সম্ভাবনা নাই, দেখিয়া, বণিক রাজপুরুষকে কহিলেন, আপনি ইহাকে অবরুদ্ধ করুন। রাজপুরুষ বসুপ্রিয়কে অবরুদ্ধ করিলে, তিনি চিরঞ্জীবকে কহিলেন, দেখুন, আপনকার দোষে চির কালের জন্যে আমার মান সন্ত্রম যাইতেছে; আপনি টাকা দিয়া আমায় মুক্ত করুন; নতুবা আমিও আপনাকে এই দণ্ডে অবরুদ্ধ করাইব। শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! আমি হার না পাইয়া টাকা দিব, কেন। তোমার সাহস হয়, আমায় অবরুদ্ধ করাও। তখন বসুপ্রিয় রাজপুরুষের হস্তে অবরোধনের খরচা দিয়া কহিলেন, দেখুন, ইনি আমার নিকট হইতে এক ছড়া বহুমূল্য হার লইয়া মূল্য দিতেছেন না, অতএব, আপনি ইঁহাকে অবরুদ্ধ করুন। সহোদরও যদি আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করে, আমি তাহাকেও ক্ষমা করিতে পারি না। স্বর্ণকারের অভিপ্রায় বুঝিয়া, রাজপুরুষ চিরঞ্জীবকে অবরুদ্ধ করিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি যে পর্যন্ত টাকা জমা করিতে, বা জামীন দিতে, না পারিতেছি, তাবৎ আপনকার অবরোধে থাকিব। এই বলিয়া, তিনি বসুপ্রিয়কে কহিলেন, আরে দুরাত্মন্‌! তুমি যে অকারণে আমার অবমাননা করিলে, তোমায় তাহার সম্পূর্ণ ফল ভোগ করিতে হইবেক; বোধ করি, এই দুর্বৃত্ততা অপরাধে তোমার সর্ব্বস্বান্ত হইবেক। বসুপ্রিয় কহিলেন, ভাল দেখা যাইবেক। জয়স্থল নিতান্ত অরাজক স্থান নহে। যখন উভয়ে বিচারালয়ে উপস্থিত হইব, আপনকার সমস্ত গুণ এরূপে প্রকাশ করিব, যে আপনি আর লোকালয়ে মুখ দেখাইতে পারিবেন না। আপনি অধিরাজ বাহাদুরের প্রিয় পাত্র বলিয়া, এরূপ গর্ব্বিত কথা কহিতেছেন। কিন্তু, তিনি যেরূপ ন্যায়পরায়ন, তাহাতে কখনই অন্যায় বিচার করিবেন না।

হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব স্বীয় সহচর কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছিলেন। সমুদয় স্থির করিয়া, যার পর নাই আহ্লাদিত চিত্তে, সে স্বীয় প্রভুকে এই সংবাদ দিতে যাইতেছিল, পথিমধ্যে জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, স্বপ্রভু জ্ঞানে তাঁহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া কহিতে লাগিল, মহাশয়? আর আমাদের ভাবনা নাই, মলয়পুরের এক জাহাজ পাওয়া গিয়াছে; তাহাতে আমাদের যাওয়ার সমুদয় বন্দোবস্তু করিয়া আসিয়াছি। ঐ জাহাজ অবিলম্বে প্রস্থান করিবেক; অতএব, পান্থনিবাসে চলুন, দ্রব্য সামগ্রী সমুদয় লইয়া, এ পাপিষ্ঠ স্থান হইতে চলিয়া যাই। শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! আরে পাগল! মলয়পুরের জাহাজের কথা কি বলিতেছ। সে কহিল, কেন মহাশয়। আপনি কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমায় জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি তোমায় জাহাজের কথা বলি নাই, দড়ি কিনিতে পাঠাইয়াছিলাম। সে কহিল, না মহাশয়! আপনি দড়ি কিনিবার কথা কখন বলিলেন, জাহাজ দেখিতে পাঠাইয়াছিলেন। তখন চিরঞ্জীব যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে পাপিষ্ঠ! এখন আমি তোমার সঙ্গে এ বিষয়ের বিচার ও মীমাংসা করিতে পারি না; যখন সচ্ছন্দ চিত্তে থাকিব, তখন করিব, এবং যাহাতে উত্তরকালে আমার কথা মন দিয়া শুন, তাহাও ভাল করিয়া শিখাইয়া দিব। এখন সত্বর তুমি বাটী যাও, এই চাবিটি চন্দ্রপ্রভার হস্তে দিয়া বল, পাঁচ শত টাকার জন্য আমি পথে অবরুদ্ধ হইয়াছি; আমার বাক্সের ভিতরে যে স্বর্ণমুদ্রার থলী আছে, তাহা তোমা দ্বারা অবিলম্বে পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে আমি অবরোধ হইতে মুক্ত হইব। আর দাঁড়াইও না, শীঘ্র চলিয়া যাও। এই বলিয়া, কিঙ্করকে বিদায় করিয়া, তিনি রাজপুরুষকে কহিলেন, অহে রাজপুরুষ! যত ক্ষন টাকা না আসিতেছে, আমায় কারাগারে লইয়া চল। অনস্তর, তাঁহারা তিন জনে কারাগার অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কিঙ্কর মনে মনে কহিতে লাগিল, আমায় চন্দ্রপ্রভার নিকটে যাইতে বলিলেন; সুতরাং, আজ আমরা যে বাটতে আহার করিয়াছিলাম, আমায় তথায় যাইতে হইবেক। পাকশালার পরিচারিণীর ভয়ে, সে বাটীতে প্রবেশ করিতে আমার সাহস হইতেছে না। কিন্তু প্রভু যে অবস্থায় যে জন্যে আমায় পাঠাই্ছেতেন, না গেলে কোনও মতে চলিতেছে না। এই বলিতে বলিতে, সে সেই বাটীর উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

এ দিকে, বিলাসিনী, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবের সমক্ষ হইতে পলাইয়া, চন্দ্র প্রভার নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং চিরঞ্জীবের সহিত যেরূপ কথোপকথন হইয়াছিল, সবিশেষ সমস্ত শুনাই লেন। চন্দ্রপ্রভা শুনিয়া কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর জিজ্ঞাসিলেন, বিলাসিনি। তিনি যে তোমার উপর অনুরাগ প্রকাশ, এবং পরিশেষে পরিণয় প্রস্তাব ও প্রলোভন বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমার বাস্তবিক বলিয়া বোধ হইল; আমার অনুভব হয়, তিনি পরিহাস করিয়াছেন। বিলাসিনী কহিলেন, না দিদি! পরিহাস নয়; আমার উপর তাঁহার যে বিলক্ষণ অনুরাগ জন্মিয়াছে, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই; অন্তঃকরণে প্রগাঢ় অনুরাগ সঞ্চার না হইলে, পুরুষদিগের সেরূপ ভাবভঙ্গী ও সেরূপ কথাপ্রণালী হয় না। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস না হইলে, কখনই তোমার নিকট এই কথার উল্লেখ করিতাম না। শুনিয়া, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল, তিনি কি কি কথা বলিলেন। বিলাসিনী কহিলেন, তিনি বলিলেন, তোমার সহিত তাঁহার কোনও সম্পর্ক নাই, তিনি তোমার পাণিগ্রহণ করেন নাই, তোমার উপর তাহার কিছুমাত্র অনুরাগ নাই, তিনি বৈদেশিক ব্যক্তি, জয়স্থলে তাঁহার বাস নয়; পরে আমার উপর স্পষ্ট বাক্যে অনুরাগ প্রকাশ ও স্পষ্টতর বাক্যে পরিণয় প্রস্তাব করিলেন; অবশেষে, তাহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া, ভয় পাইয়া, আমি পলাইয়া আসিলাম।

সমুদয় শ্রবণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! তোমার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে এ জন্মে আর র্তাহার সঙ্গে আলাপ করিতে হয় না। তিনি যে এমন নীচ প্রকৃতির লোক, তাহা আমি এক বারও মনে করি নাই। কিন্তু আমার মন কেমন, বলিতে পারি না। দেখ, তিনি কেমন মমতাশূন্য হইয়াছেন, এবং কেমন নৃশংস ব্যবহার করিতেছেন; আমি কিন্তু তাহার প্রতি সেরূপ মমতাশূন্য হইতে বা সেরূপ নৃশংস ব্যবহার করিতে পারিতেছি না; এখনও আমার অনুরাগ অণুমাত্র বিচলিত হইতেছে না। এই বলিয়া, চন্দ্রপ্রভা খেদ করিতে আরম্ভ করিলেন, বিলাসিনী প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।

এই সময়ে হেমকুটের কিঙ্কর তাঁহাদের নিকটবর্তী হইল। তাহাকে দেখিয়া, জয়স্থলের কিঙ্কর বোধ করিয়া, বিলাসিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, কিঙ্কর। তুমি হাঁপাইতেছ কেন। সে কহিল, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া আসিয়াছি, তাহাতেই হাঁপাইতেছি। বিলাসিনী কহিলেন, তোমার প্রভু কোথায়, তিনি ভাল আছেন ত। তোমার ভাব দেখিয়া ভয় হইতেছে; কেমন, কোনও অনিষ্টঘটনা হয় নাই ত। সে কহিল, তিনি রাজপুরুষের হস্তে সমর্পিত হইয়াছেন; সে তাহারে অবরুদ্ধ করিয়া কারাগারে লইয়া যাইতেছে। শুনিয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, কিঙ্কর। কাহার অভিযোগে তিনি অবরুদ্ধ হইলেন। সে কহিল, আমি তাহার কিছুই জানি না; আমায় এক কর্ম্মে পাঠাইয়াছিলেন; কর্ম্ম শেষ করিয়া তাহার সন্নিহিত হইবামাত্র, তিনি আমার হস্তে এই চাবিটি দিয়া আপনকার নিকটে আসিতে কহিলেন; বলিয়া দিলেন, তাঁহার বাক্সের মধ্যে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলী আছে, আপনি চাবি খুলিয়া তাহা বাহির করিয়া আমার হস্তে দেন; ঐ টাকা দিলে, তিনি অবরোধ হইতে নিষ্কৃতি পাইবেন। শুনিবামাত্র, বিলাসিনী, চিরঞ্জীবের বাক্স হইতে স্বর্ণমুদ্রার থলী আনিয়া, কিঙ্করের হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং কহিলেন, অবিলম্বে তোমার প্রভুকে বাটীতে লইয়া আসিবে। সে স্বর্ণমুদ্রা লইয়া দ্রুত পদে প্রস্থান করিল; তাঁহারা দুই ভগিনীতে, দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া, বিষম অসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

হেমকুটের চিরঞ্জীব, কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে প্রেরণ করিয়া বহু ক্ষণ পর্য্যন্ত, উৎসুক চিত্তে, তাহার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিলেন; এবং সমধিক বিলম্ব দর্শনে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, কিঙ্করকে সত্বর সংবাদ আনিতে বলিয়াছিলাম, সে এখনও আসিল না, কেন। যে জন্যে পাঠাইয়াছি হয় ত তাহারই কোনও স্থিরতা করিতে পারে নাই, নয় ত পথিমধ্যে কোনও উৎপাতে পড়িয়াছে; নতুবা, যে বিষয়ের জন্য গিয়াছে তাহাতে উপেক্ষা করিয়া, বিষয়ান্তরে আসক্ত হইবেক, এরূপ বোধ হয় না; কারণ, জয়স্থল হইতে পলাইবার নিমিত্ত সে আমা অপেক্ষাও ব্যস্ত হইয়াছে। অতএব, পুনরায় কোনও উপদ্রব ঘটিয়াছে, সন্দেহ নাই। এ নগরের যে রঙ্গ দেখিতেছি, তাহাতে উপদ্রবঘটনার অপ্রতুল নাই। রাজপথে নির্গত হইলে, সকল লোকেই আমার নাম গ্রহণ পূর্ব্বক সম্বোধন ও সংবৰ্দ্ধনা করে; অনেকেই চিরপরিচিত সুহৃদের ন্যায় প্রিয় সম্ভাষণ করে; কেহ কেহ এরূপ ভাব প্রকাশ করে, যেন আমি নিজ অর্থ দ্বারা তাহাদের অনেক আনুকুল্য করিয়াছি, অথবা আমার সহায়তায় তাহারা বিপদ হইতে উদ্ধার লাভ করিয়াছে; কেহ কেহ আমায় টাকা দিতে উদ্যত হয়; কেহ কেহ আহারের নিমন্ত্রণ করে; কেহ কেহ পরিবারের কুশল জিজ্ঞাসা করে; কেহ কেহ কহে, আপনি যে দ্রব্যের জন্য আদেশ করিয়াছিলেন তাহা সংগৃহীত হইয়াছে, আমার দোকানে গিয়া দেখিবে, না বাটীতে পাঠাইয়া দিব; পান্থনিবাসে আসিবার সময়, এক দরজী, পীড়াপীড়ি করিয়া, দোকানে লইয়া গেল এবং আপনকার চাপকানের জন্ত এই গরদের থান আনিয়াছি বলিয়া, আমার গায়ের মাপ লইয়া ছাড়িয়া দিল; আবার, এক স্বর্ণকার, আমার হস্তে বহু মূল্যের হার দিয়া, মূল্য না লইয়া চলিয়া গেল। কেহই আমায় বৈদেশিক বিবেচনা করে না। আমি যেন জয়স্থলের এক জন গণনীয় ব্যক্তি। আর মধ্যাহ্ন কালে দুই স্ত্রীলোক যে কাণ্ড করিল, তাহ অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব্ব। এ স্থানে মাদৃশ বৈদেশিক ব্যক্তির কোনও ক্রমে ভদ্রস্থতা নাই। এখানকার ব্যাপার বুঝিয়া উঠা ভার। যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে প্রস্থান করিতে পারি, তাহা হইলেই মঙ্গল। কিন্তু, কিঙ্কর কি জন্য এত বিলম্ব করিতেছে। যাহা হউক, আর তাহার প্রতীক্ষায় থাকিলে চলে না; অন্বেষণ করিতে হইল।

এই বলিয়া, পান্থনিবাস হইতে নির্গত হইয়া, চিরঞ্জাব রাজপথে অবতীর্ণ হইয়াছেন, এমন সময়ে, কিঙ্কর সত্বর গমনে তাঁহার সন্নিহিত হইল, এবং কহিল, যে স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য আমায় পাঠাইয়াছিলেন, তাহা এই। ইহা কহিয়া, সে স্বর্ণমুদ্রার থলী তাঁহার হস্তে দিল; এবং জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি রূপে সেই ভীষণমূর্ত্তি রাজপুরুষের হস্ত হইতে নিস্তার পাইলেন; সে যে বড় টাকা না পাইয়া ছাড়িয়া দিল। তিনি স্বর্ণমুদ্রা দর্শনে ও কিঙ্করের কথা শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, কিঙ্কর এ স্বর্ণমুদ্রা কোথায় পাইলে এবং কি জন্যেই বা আমার হস্তে দিলে, বল; আমি ত তোমায় স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য পাঠাই নাই। কিঙ্কর কহিল, সে কি মহাশয়। রাজপুরুষ আপনারে কারাগারে লইয়া যাইতেছিল, এমন সময়ে আপনি, আমায় দেখিতে পাইয়া, আমার হস্তে একটি চাবি দিয়া কহিলেন, বাক্সের মধ্যে পাঁচ শত টাকার স্বর্ণমুদ্রা আছে; চন্দ্রপ্রভার হস্তে এই চাবি দিলে, তিনি তাহা বহিষ্কৃত করিয়া তোমার হস্তে দিবেন; তুমি ক্ষণ মাত্র বিলুম্ব না করিয়া আমার নিকটে আনিবে। তদনুসারে, আমি এই স্বর্ণমুদ্রা আনিয়াছি। বোধ হয়, আপনকার স্মরণ আছে, আমরা মধ্যাহ্ন কালে যে স্ত্রীলোকের বাটতে আহার করিয়াছিলাম, তাঁহার নাম চন্দ্রপ্রভা। তিনি ও তাঁহার ভগিনী, অবরোধের কথা শুনিয়া, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়াছেন, এবং সত্বর আপনারে লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। এক্ষণে আপনকার যেরূপ অভিরুচি। আমি কিন্তু প্রাণন্তেও আর সে বাটীতে প্রবেশ করিব না। আপনি বিপদে পড়িয়াছিলেন, কেবল এই অনুরোধে স্বর্ণমুদ্রা আনিতে গিয়াছিলাম। সে যাহা হউক, আপনি যে এই অবান্ধব দেশে সহজে রাজপুরুষের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছেন, ইহাতে আমি বড় আহ্লাদিত হইয়াছি। তদপেক্ষা অধিক আহ্লাদের বিষয় এই যে, এই এক উপলক্ষে পাঁচ শত টাকার স্বর্ণমুদ্রা অনায়াসে হস্তগত হইল।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া, পরিহাসরনিক কিঙ্কর কৌতুক করিতেছে ইহা ভাবিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, আরে নরাধম! আমি তোমায় যে জন্যে পাঠাইয়াছিলাম, তাহার কোনও কথা না বলিয়া, কেবল পাগলামি করিতেছ এখান হইতে অবিলম্বে পলায়ন করাই শ্রেয়ঃ, এই পরামর্শ স্থির করিয়া, তোমায় জাহাজের অন্বেষণে পাঠাইয়াছিলাম। অতএব বল, আজ কোনও জাহাজ জয়স্থল হইতে প্রস্থান করিবেক কি না, এবং তাহাতে আমাদের যাওয়া ঘটিবেক কি না। কিঙ্কর কহিল, সে কি মহাশয়। আমি যে এক ঘণ্টা পূর্ব্বে আপনাকে সে বিষয়ের সংবাদ দিয়াছি। তখন অবরোধের হঙ্গামে পড়িয়াছিলেন; সে জন্যেই হউক, অ্ন্য কোনও কারণেই হউক, আপনি সে কথায় মনোযোগ করিলেন না, বরং আমার উপর বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। নতুবা, এত ক্ষণ আমরা দ্রব্যসামগ্রী লইয়া জাহাজে উঠিতে পারিতাম। কিঙ্করের কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, হতভাগ্য বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়াছে, তাহাতেই পাগলের মত এত অসম্বদ্ধ কথা বলিতেছে; অথবা উহারই বা অপরাধ কি, আমিও ত স্থানমাহাত্ম্যে অবিকল ঐরূপ হইয়াছি। উভয়েরই তুল্যরূপ বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহার আর কোনও সন্দেহ নাই। তিনি মনে মনে এই সমস্ত আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে কিঙ্কর, একটি স্ত্রীলোককে আসিতে দেখিয়া, চকিত হইয়া, আকুল বচনে কহিল, মহাশয়। সাবধান হউন, ঐ দেখুন, আবার কে এক ঠাকুরাণী আদিতেছেন। উনি যাহাতে আহারের লোভ দেখাইয়া, অথবা অন্য কোনও ছলে বা কৌশলে ভুলাইয়া আমাদিগকে লইয়া যাইতে না পারেন, তাহা করিবেন। পূর্ব্ব বারে যেমন, পতিসম্ভাষণ করিয়া, হাত ধরিয়া, এক ঠাকুরাণী আপন বাটীতে লইয়া গেলেন, আপনি, একটিও কথা না কহিয়া, চোরের মত চলিয়া গেলেন, এ বার যেন সেরূপ না হয়। জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব, স্বীয় ভবনে প্রবেশ করিতে না পাইয়া, মধ্যাহ্নকালে অপরাজিত নাম্নী যে কামিনীর বাটীতে আহার করিয়াছিলেন, তাঁহার অঙ্গুলি হইতে একটি মনোহর অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া লয়েন, এবং সেই অঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে, তাহাকে বসুপ্রিয়নির্ম্মিত মহামূল্য হার দিবার অঙ্গীকার করেন। হার যথাকালে উপস্থিত না হওয়াতে লজ্জিত হইয়া, তিনি স্বয়ং স্বর্ণকারের বিপণি হইতে হার আনয়ন করিতে যান। অপরাজিতা, তাঁহার সমধিক বিলম্ব দর্শনে, তদীয় অন্বেষণে নিৰ্গত হইয়া, কিয়ং ক্ষণ পরে হেমকূটবাদী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইলেন, এবং জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীববোধে তাঁহার সন্নিহিত হইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমায় যে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, আপনকার গলায় এ কি সেই হার। এ বেলা আমার বাটীতে আহার করিতে হইবেক; আমি আপনাকে লইয়া যাইতে আসিয়াছি। এ আবার কোথাকার আপদ উপস্থিত হইল এই ভাবিয়া, চিরঞ্জীব রোষকষায়িত লোচনে সাতিশয় পরুষ বচনে কহিলেন, অরে মায়াবিনি! তুমি দূর হও; তোমায় সতর্ক করিয়া দিতেছি, আমায় কোনও প্রকার প্রলোভন প্রদর্শন করিও না। কিঙ্কর, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, স্বীয় প্রভুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, মহাশয়! সাবধান হইবেন, যেন এ রাক্ষসীর মায়ায় ভুলিয়া, উহার বাটীতে আহার করিতে না যান।

উভয়ের ভাব দর্শনে ও বাক্য শ্রবণে, অপরাজিতা, বিস্মিত না হইয়া, সম্মিত বদনে কহিলেন, মহাশয়। আপনি যেমন পরিহাসপ্রিয়, আপনকার ভূতাটি আবার তদপেক্ষা অধিক। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমার বাটীতে যাইবেন কি না বলুন, আমি আহারের সমুদয় আয়োজন করিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! আমি পুনরায় সাবধান করিতেছি, আপনি কদাচ এই পিশাচীর মায়ায় ভুলিবেন না। তখন চিরঞ্জীব ক্রোধে অন্ধ হইয়া কহিলেন, অরে পাপীয়সি! তুমি এই দণ্ডে এখান হইতে চলিয়া যাও। তোমার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক যে তুমি আমায় আহার করিতে ডাকিতেছ। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এখানকার স্ত্রীলোক মাত্রেই ডাকিনী। স্পষ্ট

কথায় বলিতেছি, যদি ভাল চাও, অবিলম্বে আমার সম্মুখ হইতে চলিয়া যাও। জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবের সহিত এই স্ত্রীলোকের বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল, তিনি যে তাঁহার প্রতি এবংবিধ অযুক্ত আচরণ করিবেন, ইহা স্বপ্নের অগোচর। চিরঞ্জীববাবুর নিকট এরূপে অপমানিত হইলাম, এই ভাবিয়া, তিনি সাতিশয় রোষ ও অসন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক কহিলেন, এত কাল আপনাকে ভদ্র বলিয়া বোধ ছিল; কিন্তু আপনি যেমন ভদ্র, আজ তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইলাম। সে যাহা হউক, মধ্যাহ্নে, আহারের সময়, আমার অঙ্গুলি হইতে যে অঙ্গুরীয় খুলিয়া লইয়াছেন, হয় তাহা ফিরিয়া দেন, নয় উহার বিনিময়ে যে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, তাহা দেন; দুয়ের এক পাইলেই আমি চলিয়া যাই; তৎপরে আর এ জন্মে আপনকার সহিত আলাপ করিব না, এবং প্রাণান্ত ও সর্ব্বস্বান্ত হইলেও কোনও সংস্রব রাখিব না। এই সকল কথা শুনিয়া কিঙ্কর কহিল, অন্য অন্য ডাইন, ছাড়িবার সময়, বাটা, কুলে, শিল, নোড়া বা ছেড়া জুতা পাইলেই সন্তুষ্ট হইয়া যায়, এ দিব্যাঙ্গনা ডাইনটির অধিক লোভ দেখিতেছি; ইনি হয় হার, নয় আঙ্গটি, দুয়ের একটি না পাইলে যাইবেন না। মহাশয়। সাবধান, কিছুই দিবেন না, দিলেই অনর্থপাত হইবেক। অপরাজিতা, কিঙ্করের কথার উত্তর না দিয়া, চিরঞ্জীবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাশয়! হয় হার, নয় আঙ্গটি দেন। বোধ করি, আমায় ঠকান আপনকার অভিপ্রেত নহে। চিরঞ্জীব উত্তরোত্তর অধিকতর কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, অরে ডাকিনি! দূর হও। এই বলিয়া, কিঙ্করকে সঙ্গে লইয়া, তিনি চলিয়া গেলেন।

এইরূপে তিরস্কৃত ও অপমানিত হইয়া, অপরাজিতা কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন; অনন্তর মনে মনে কহিতে লাগিলেন, চিরঞ্জীববাবু নিঃসন্দেহ উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন, নতুবা উঁহার আচরণ এরূপ বিসদৃশ হইবেক, কেন। চিরকাল আমরা উহাকে সুশীল, সুবোধ, দয়ালু ও অমায়িক লোক বলিয়া জানি; কেহ কখনও কোনও কারণে উহারে ক্রোধের বশীভূত হইতে দেখি নাই; আজ তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিতেছি। উন্মাদ ব্যতিরেকে এরূপ লোকের এরূপ ভাবান্তর কোনও ক্রমে সম্ভবে না ইনি, বিনিময়ে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়া, অঙ্গুরীয় লইয়াছেন; এখন, আমায় কিছুই দিতে চাহিতেছেন না। ইনি, সহজ অবস্থায়, এরূপ করিবার লোক নহেন। মধ্যাহ্নকালে, আমার আলয়ে আহার করিবার সময় বলিয়াছিলেন, চন্দ্রপ্রভা আজ উঁহাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই। তখন এ কথার ভাব বুঝিতে পারি নাই। এখন স্পষ্ট বোধ হইতেছে, উনি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়াই, তিনি দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। এখন আমি কি করি; অথবা উঁহার স্ত্রীর নিকটে গিয়া বলি, আপনকার স্বামী, উন্মাদগ্রস্ত হইয়া, মধ্যাহ্নকালে আমার বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এবং বল পূর্ব্বক আমার অঙ্গুরীয় লইয়া পলায়ন করিয়াছেন। ইহা শুনিলে, তিনি অবশ্যই আমার অঙ্গুরীয় প্রতিপ্রাপ্তির কোনও উপায় করিবেন। আমি অকারণে এক শত টাকা মূল্যের বস্তু হারাইতে পারি না। এই স্থির করিয়া, তিনি চিরঞ্জীবের আলয় অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব মনে করিয়াছিলেন, কিঙ্কর সত্বর স্বর্ণমুদ্রা আনয়ন করিবেক। কিন্তু বহু ক্ষণ পর্য্যন্ত সে না আসাতে, তিনি অবরোধকারী রাজপুরুষকে কহিলেন, তুমি অকারণে আমায় কষ্ট দিতেছ; যে টাকার জন্য আমি অবরুদ্ধ হইয়াছি, বাটী যাইবামাত্র তাহা দিতে পারি। অতএব, তুমি আমার সঙ্গে চল। আর, আমি যে কারাগার হইতে বহির্গত হইলে, পথে তোমার হাত ছাড়াইয়া পলাইব, সে আশঙ্কা করিও না। আমি নিতান্ত সামান্য লোকও নই, এবং তোমার অথবা অন্য কোনও রাজপুরুষের নিতান্ত অপরিচিতও নই। কিঙ্কর টাকা না লইয়া আসিবার দুই কারণ বোধ হইতেছে; প্রথম এই যে, আমি জয়স্থলে কোনও কারণে অবরুদ্ধ হইব, আমার স্ত্রী সহজে তাহা বিশ্বাস করিবেন না; সুতরাং কিঙ্করের কথা শুনিয়া উপহাস করিয়াছেন। দ্বিতীয় এই যে, কি কারণে বলিতে পারি না, তিনি আজ সম্পূর্ণ বিকলচিত্ত হইয়া আছেন; হয় ত, তজ্জন্য কিঙ্করের কথিত বিষয়ে মনোযোগ দেন নাই। রাজপুরুষ সম্মত হইলেন। চিরঞ্জীব, তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় ভবন অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, কিঞ্চিৎ অন্তরে কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া, চিরঞ্জীব রাজপুরুষকে কহিলেন, ঐ আমার লোক আসিতেছে। ও টাকা সংগ্রহ করিয়। আসিয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই। অতএব, আর তোমায় আমার বাটী পর্যন্ত যাইতে হইবেক না। অল্প ক্ষণের মধ্যেই কিঙ্কর সম্মুখবর্ত্তী হইলে, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, কিঙ্কর! যে জন্যে পাঠাইয়াছিলাম, তাহা সংগ্রহ হইয়াছে কি না। সে কহিল, হাঁ মহাশয়। তাহা সংগ্রহ না করিয়া, আমি আপনকার নিকটে আসি নাই। এই বলিয়া, সে ক্রীত রজ্জু তাঁহাকে দেখাইল। চিরঞ্জীব কহিলেন, বলি, টাকা কোথায়। সে কহিল, আর টাকা আমি কোথায় পাইব; আমার নিকটে যাহা ছিল, তাহা দিয়া এই দড়ী কিনিয়া আনিয়াছি। তিনি কহিলেন, এক গাছ দড়ী কিনিতে কি পাঁচ শত টাকা লাগিল। এখন পাগলামি ছাড়; বল, আমি যে জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পাঠাইলাম, তাহার কি হইল। সে কহিল, আপনি আমায় দড়ী কিনিয়া বাড়ি যাইতে বলিয়াছিলেন; দড়ী কিনিয়াছি, এবং তাড়াতাড়ি বাড়ি যাইতেছি। চিরঞ্জীব, সাতিশয় কুপিত হইয়া, কিঙ্করকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া সমভিব্যাহারী রাজপুরুষ চিরঞ্জীবকে কহিলেন, মহাশয়! এত অধৈর্য্য হইবেন না; সহিষ্ণতা যে কত বড় গুণ, তাহা কি আপনি জানেন না। এই কথা শুনিয়া কিঙ্কর কহিল, উঁহারে সহিষ্ণু হইবার উপদেশ দিবার প্রয়োজন কি। যে কষ্ট ভোগ করে, তাহারই সহিষ্ণুতা গুণ থাকা আবশ্যক; আমি প্রহারের কষ্ট ভোগ করিতেছি; আমায় বরং আপনি ঐ উপদেশ দেন। তখন রাজপুরুষ রোষ প্রদর্শন করিয়া কছিলেন, অরে পাপিষ্ঠ! যদি ভাল চাও, মুখ বন্ধ কর। কিঙ্কর কহিল, আমায় মুখ বন্ধ করিতে বলা অপেক্ষা, উঁহাকে হাত বন্ধ করিতে বলিলে ভাল হয়।

এই সকল কথা শুনিয়া, যার পর নাই ক্রোধান্বিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে অচেতন নরাধম। আর আমায় বিরক্ত করিও না। সে কহিল, আমি অচেতন হইলে, আমার পক্ষে ভাল হইত। যদি অচেতন হইতাম, আপনি প্রহার করিলে, কষ্ট অনুভব করিতাম না। তিনি কহিলেন, তুমি অন্য সকল বিষয়ে অচেতন, কেবল প্রহার সহন বিষয়ে নহ; সে বিষয়ে তোমায় ও গর্দ্দভে বিভেদ নাই। সে কহিল, আমি যে গর্দ্দভ, তার সন্দেহ কি; গর্দ্দভ না হইলে, আমার কান লম্বা হইবেক কেন। এই বলিয়া, রাজপুরুষকে সম্ভাষণ করিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়। জন্মাবধি প্রাণপণে ইঁহার পরিচর্য্যা করিতেছি, কিন্তু কখনও প্রহার ভিন্ন অন্য পুরস্কার পাই নাই। শীত বোধ হইলে, প্রহার করিয়া গরম করিয়া দেন; গরম বোধ হইলে, প্রহার করিয়া শীতল করিয়া দেন, নিদ্রাবেশ হইলে, প্রহার করিয়া সজাগর করিয়া দেন; বসিয়া থাকিলে, প্রহার করিয়া উঠাইয়া দেন; কোনও কাজে পাঠাইতে হইলে, প্রহার করিয়া বাটী হইতে বাহির করিয়া দেন; কার্য্য সমাধা করিয়া বাটীতে আসিলে, প্রহার করিয়া আমার সংবৰ্দ্ধনা করেন; কথায় কথায় কান ধরিয়া টানেন, তাহাতেই আমার কান এত লম্বা হইয়াছে। বলিতে কি, মহাশয়। কেহ কখনও এমন গুণের মনিব ও এমন সুখের চাকরি পায় নাই; আমি ইহার আশ্রয়ে পরম সুখে কাল কাটাইতেছি।

এই সময়ে চিরঞ্জীব দেখিতে পাইলেন, তাঁহার সহধর্ম্মিণী কতকগুলি লোক সঙ্গে লইয়া আসিতেছেন। তখন তিনি কিঙ্করকে কহিলেন, আরে বানর। আর তোমার পাগলামি করিতে হইবেক না। এখন এখান হইতে চলিয়া যাও; আমার গৃহিণী আসিতেছেন। কিঙ্কর, তাহাকে দেখিতে পাইয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, মা ঠাকুরাণি। শীঘ্র আসুন; বাবু আজ আপনাকে বিলক্ষণ পুরস্কার দিবেন; হারের পরিবর্ত্তে এক রমণীয় উপহার পাইবেন। এই বলিয়া, হস্তস্থিত রজ্জু উত্তোলিত করিয়া, সে তাঁহাকে দেখাইতে লাগিল। চিরঞ্জীব, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, তাহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন।

অপরাজিতার মুখে চিরঞ্জীবের উন্মাদের সংবাদ পাইয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাধর নামক এক ব্যক্তিকে ডাকাইয়া আনেন। বিদ্যাধর ঐ পাড়ার গুরুমহাশয় ছিল; কিন্তু অবসরকালে পাড়ায় পাড়ায় চিকিৎসা করিয়া বেড়াইত। অনেকে বিশ্বাস করিত, ভূতে পাইলে, কিংবা ডাইনে খাইলে, সে অনায়াসে প্রতিকার করিতে পারে; এজন্য, সে সেই পল্লীর স্ত্রীলোকের ও ইতর লোকের নিকট বড় মান্য ও আদরণীয় ছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞ বৈদ্য চিকিৎসা করিলেও, বিদ্যাধর না দেখিলে, তাহাদের মনের সন্তোষ হইত না। ফলতঃ, ঐ সকল লোকের নিকট বিদ্যাধরের প্রতিপত্তির সীমা ছিল না। সে উপস্থিত হইলে, চন্দ্রপ্রভা, স্বামীর পীড়ার বৃত্তান্ত কহিয়া, তাহার হস্তে ধরিয়া বলেন, তুমি সত্বর তাহাকে সুস্থ ও প্রকৃতিস্ত করিয়া দাও, তোমায় বিলক্ষণ পুরস্কার দিব। সে কহে, আপনি কোনও ভাবনা করিবেন না। আমি অনেক বিদ্যা জানি; আমার পিতা মাতা, না বুঝিয়া, আমায় বিদ্যাধর নাম দেন নাই। সে যাহা হউক, অবিলম্বে তাঁহাকে বাটতে আনা আবশ্যক। চলুন, আমি সঙ্গে যাইতেছি। কিন্তু, উন্মত্ত ব্যক্তিকে আনা সহজ ব্যাপার নহে; অতএব লোক সঙ্গে লইতে হইবেক। চন্দ্রপ্রভা, পাচ সাত জন লোক সংগ্রহ করিয়া, বিদ্যাধর, বিলাসিনী ও অপরাজিতাকে সঙ্গে লইয়া, চিরঞ্জীবের অন্বেষণে নির্গত হইয়াছিলেন।

যে সময়ে চিরঞ্জীব, ক্রোধে অধীর হইয়া, কিঙ্করকে প্রহার ও তিরস্কার করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে চন্দ্রপ্রভা তাঁহার সমীপবর্ত্তিনী হইলেন। অপরাজিতা তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেখ, তোমার স্বামী উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন কি না। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, উঁহার ব্যবহার ও আকার প্রকার দেখিয়া, আমার আর সন্দেহ বোধ হইতেছে না। এই বলিয়া, তিনি বিদ্যাধরকে কহিলেন, দেখ, তুমি অনেক মন্ত্র, অনেক ঔষধ, এবং চিকিৎসার অনেক কৌশল জান, এক্ষণে সত্বর উহারে প্রকৃতিস্থ কর; তুমি যে পুরস্কার চাহিবে, আমি তাহাই দিয়া তোমায় সন্তুষ্ট করিব। বিলাসিনী সাতিশয় দুঃখিত ও বিষন্ন হইয়। কহিলেন, হায়! কোথা হইতে এমন সর্ব্বনাশিয়া রোগ আসিয়া জুটিল; উঁহার সে আকার নাই, সে মুখশ্রী নাই; কখনও উহার এমন বিকট মূর্ত্তি দেখি নাই, উঁহার দিকে তাকাইতেও ভয় হইতেছে। বিদ্যাধর চিরঞ্জীবকে কহিল, বাবু! তোমার হাতটা দাও, নাড়ীর গতি কিরূপ, দেখিব। চিরঞ্জীব যৎপরোনাস্তি কুপিত হইয়া কহিলেন, এই আমার হাত, তুমি কানটি বাড়াইয়া দাও। তখন বিদ্যাধর স্থির করিল, চিরঞ্জীবের শরীরে ভুতাবেশ বশতঃ প্রকৃতির বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে। তদনুসারে সে, কতিপয় মন্ত্র পাঠ করিয়া, তাঁহার দেহগত ভুতকে সম্বোধিয়া কহিতে লাগিল, অরে দুরাত্মনৃ পিশাচ। আমি তোরে আদেশ করিতেছি, অবিলম্বে উঁহার কলেবর হইতে নিৰ্গত হইয়। স্বস্থানে প্রস্থান কর। চিরঞ্জীব শুনিয়া নিরতিশয় ক্রোধভরে কহিলেন, অরে নিবোধ! অরে পাপিষ্ঠ! অরে অর্থপিশাচ! চুপ কর, আমি পাগল হই নাই। শুনিয়া, যার পর নাই দুঃখিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা বাষ্পাকুল লোচনে অতি দীন বচনে কহিলেন, পূর্ব্বে ত তুমি এরূপ ছিলে না; আমার নিতান্ত পোড়া কপাল বলিয়া, আজ অকস্মাৎ এই বিষম রোগ কোথা হইতে তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়াছে। চন্দ্রপ্রভার বাক্য শ্রবণে, চিরঞ্জীবের কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি তাঁহাকে যথোচিত ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, অরে পাপীয়সি। এই নরাধম, বুঝি, আজ কাল তোর অন্তরঙ্গ হইয়াছে। এই দুরাত্মার সঙ্গে আহার বিহারের আমোদে মত্ত হইয়াই, বুঝি, দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলি, এবং আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দিল নাই। শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা চকিত হইয়া কহিলেন, ও কেমন কথা বলিতেছ; তোমার আসিতে কিছু বিলম্ব হইয়াছিল বটে; তার পরে ত সকলে এক সঙ্গে আহার করিয়াছি। তুমি আহারের পর বরাবর বাটীতে ছিলে; কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে, কাহাকেও কিছু না বলিয়া, চলিয়া আসিয়াছ। এখন কি কারণে আমায় ভর্ৎসনা করিতেছ ও এরূপ কুৎসিত কথা বলিতেছ, বুঝিতে পারিতেছি না।

এই কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব স্বীয় অনুচরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হে, কিঙ্কর। আজ আমি কি মধ্যাহ্নকালে বাটীতে আহার করিয়াছি। সে কহিল, না মহাশয়। আজ আপনি বাটীতে আহার করেন নাই। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, আমি আজ যখন আহার করিতে যাই, বাটীর দ্বার রুদ্ধ ছিল কি না, এবং আমাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিয়াছিল কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, বাটীর দ্বার রুদ্ধ করা ছিল, এবং আপনাকে প্রবেশ করিতে দেয় নাই। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, আচ্ছা, উনি নিজে অভ্যন্তর হইতে আমাকে গালাগালি দিয়াছেন কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, উনি অত্যন্ত কটুবাক্য বলিয়াছিলেন। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, তৎপরে আমি, অবমানিত বোধ করিয়া, ক্রোধভরে সেখান হইতে চলিয়া যাই কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, তার পর আপনি ক্রোধভরে সেখান হইতে চলিয়া যান।

এই প্রশ্নোত্তরপরম্পরা শ্রবণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা আক্ষেপবচনে কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি বিলক্ষণ প্রভুভক্ত; প্রভুর যথার্থ হিতচেষ্টা করিতেছ। যাহাতে উহার মনের শান্তি হয়, সে চেষ্টা না করিয়া, কেবল রাগবৃদ্ধি করিয়া দিতেছ। বিদ্যাধর কহিল, আপনি উহারে অন্যায় তিরস্কার করিতেছেন; ও অবিবেচনার কর্ম্ম করিতেছে না। ও ব্যক্তি উহার রীতি ও প্রকৃতি বিলক্ষণ জানে। এরূপ অবস্থায় চিত্তের অনুবর্ত্তন করিলে, যেরূপ উপকার দর্শে, অন্য কোনও উপায়ে সেরূপ হয় না। চিরঞ্জীব চন্দ্রপ্রভার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তুই স্বর্ণকারের সহিত যোগ দিয়া আমায় কয়েদ করাইয়াছিস; নতুবা স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইলি না কেন। শুনিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, সে কি নাথ! এমন কথা বলিও না; কিঙ্কর আসিয়া, অবরোধের উল্লেখ করিবামাত্র, আমি উহা দ্বারা স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইয়া দিয়াছি। কিঙ্কর চকিত হইয়া কহিল, আমা দ্বারা পাঠাইয়াছেন? আপনকার যাহা ইচ্ছা হইতেছে, তাহাই বলিতেছেন। এই বলিয়া সে চিরঞ্জীবকে কহিল, না মহাশয়! আমার হস্তে এক পয়সাও দেন নাই; আপনি উহার কথায় বিশ্বাস করিবেন না। তখন চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য উঁহার নিকটে যাও নাই? চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, ও আমার নিকটে গিয়াছিল, বিলাসিনী তদণ্ডে উহার হস্তে স্বর্ণমুদ্রার থলী দিয়াছে। বিলাসিনীও কহিলেন, আমি স্বয়ং উহার হস্তে স্বর্ণমুদ্রার থলী দিয়াছি। তখন কিঙ্কর কহিল, পরমেশ্বর জানেন ও যে দড়ী বিক্রয় করে, সে জানে, আপনি দড়ী কেনা বই আজ আমায় আর কোনও কর্ম্মে পাঠান নাই।

এই সমস্ত কথোপকথন শ্রবণ করিয়া, বিদ্যাধর চন্দ্রপ্রভাকে কহিল, দেখুন, প্রভু ও ভৃত্য উভয়েই ভূতাবিষ্ট হইয়াছেন, আমি উভয়ের চেহারা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি। বন্ধন করিয়া অন্ধকারগৃহে রুদ্ধ করিয়া না রাখিলে, প্রতিকার হইবেক না। চন্দ্রপ্রভা সম্মতি প্রদান করিলেন। শুনিয়া কোপে কম্পমান হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে মায়াবিনি! অরে দুশ্চারিণি! তুই এত দিন আমায় এমন মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলি, যে তোরে নিতান্ত পতিপ্রাণা কামিনী স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম; এখন দেখিতেছি, তুই ভয়ঙ্কর কালভুজঙ্গী; অসৎ অভিপ্রায় সাধনের নিমিত্ত, এই সকল দুরাচারদিগের সহিত মন্ত্রণা করিয়া, আমার প্রাণবধের চেষ্টা দেখিতেছিস, এবং উন্মাদ প্রচার করিয়া, বন্ধন পূর্ব্বক অন্ধকারময় গৃহে রাখিবি, এই মনস্থ করিয়া আসিয়াছিস। আমি তোর দুরভিসন্ধির সমুচিত প্রতিফল দিতেছি। এই বলিয়া তিনি, কোপজ্বলিত লোচনে, উদ্ধত গমনে চন্দ্রপ্রভার দিকে ধাবমান হইলেন। চন্দ্রাওপ্রভা নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া সন্নিহিত লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা দাড়াইয়া তামাসা দেখিতেছ, তোমাদের কি আচরণ, বুঝিতে পারিতেছি না; শীঘ্র উহারে বন্ধন কর, আমার নিকটে আসিতে দিও না। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, যেরূপ দেখিতেছি, তুই নিতান্তই আমার প্রাণবধের সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছিস।

অনন্তর, চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে, সমভিব্যাহারী লোকেরা বন্ধন করিতে উদ্যত হইলে, চিরঞ্জীব নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, রাজপুরুষকে কহিলেন, দেখ, আমি এক্ষণে তোমার অবরোধে আছি; এ অবস্থায় আমায় কিরূপে ছাড়িয়া দিবে; ছাড়িয়া দিলে তুমি সম্পূর্ণ অপরাধী হইবে। তখন রাজপুরুষ চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, আপনি উঁহারে আমার নিকট হইতে লইয়া যাইতে পারিবেন না, উনি অবরোধে আছেন। এই কথা শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, অহে রাজপুরুষ! তুমি সমস্তই স্বচক্ষে দেখিতেছ ও স্বকর্ণে শুনিতেছ, তথাপি কোন বিবেচনায় উঁহারে ছাড়িয়া দিতে চাহিতেছ না। উঁহার এই অবস্থা দেখিয়া, বোধ করি, তোমার আমোদ হইতেছে। রাজপুরুষ কহিলেন, আপনি অন্যায় অনুযোগ করিতেছেন; উঁহাকে ছাড়িয়া দিলে, আমি পাঁচ শত টাকার দায়ে পড়িব। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তুমি আমায় উঁহারে লইয়া যাইতে দাও; আমি ধর্ম্মপ্রমাণ অঙ্গীকার করিতেছি, উঁহার ঋণ পরিশোধ না করিয়া, তোমার নিকট হইতে যাইব না। তুমি আমায় উঁহার উত্তমর্ণের নিকটে লইয়া চল। .কি জন্যে ঋণ হইল, তাহার মুখে শুনিয়া, টাকা দিব। তদনন্তর, তিনি বিদ্যাধরকে কহিলেন, তুমি উহারে সাবধানে বাটীতে লইয়া যাও, আমি এই রাজপুরুষের সঙ্গে চলিলাম। বিলাসিনি! তুমি আমার সঙ্গে এস। বিদ্যাধর! তোমরা বিলম্ব করিও না, চলিয়া যাও; সাবধান, যেন কোনও রূপে বন্ধন খুলিয়া পলাইতে না পারেন। অনন্তর, বিদ্যাধর দৃঢ়বদ্ধ চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে লইয়া প্রস্থান করিল।

বিদ্যাধর প্রভৃতি দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, চড়া রাজপুরুষকে জিজ্ঞাসা করিলেন, উনি কোন ব্যক্তির অভিযোগে অবরুদ্ধ হইয়াছেন, বল। তিনি কহিলেন, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের; আপনি কি তাহাকে জানেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, হাঁ, আমি তাহাকে জানি; তিনি কি জন্যে কত টাকা পাইবেন, জান। রাজপুরুষ কহিলেন, স্বর্ণকার এক ছড়া হার গড়িয়া দিয়াছেন, তাহার মূল্য পান নাই। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আমার জন্যে হার গড়িতে দিয়াছেন, শুনিয়াছিলাম; কিন্তু এ পর্য্য়ন্ত হার দেখি নাই। অপরাজিতা কহিলেন, আজ আমার বাটীতে আহার করিতে গিয়া, উনি আমার অঙ্গুলি হইতে অঙ্গুরীয় লইয়া পলায়ন করিলে পর, কিঞ্চিৎ কাল বিলম্বে পথে আমার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল; তখন উহার গলায় এক ছড়া নূতনগড়া হার দেখিয়াছি। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, যাহা বলিতেছ, অসম্ভব নয়, কিন্তু আমি কখনও সে হার দেখি নাই। যাহা হউক, অহে রাজপুরুষ! সত্বর আমায় স্বর্ণকারের নিকটে লইয়া চল; তাহার নিকট সবিশেষ না শুনিলে, প্রকৃত কথা জানিতে পারিতেছি না।

হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব, ভর্ৎসনা ও ভয় প্রদর্শন দ্বারা অপরাজিতাকে দূর করিয়া দিয়া, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে যে রাজপথে গমন করিতেছিলেন, চন্দ্রপ্রভা প্রভৃতিও সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। বিলাসিনী, দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, দিদি! কি সর্বনাশ! কি সর্বনাশ! ঐ দেখ, তিনি ও কিঙ্কর উভয়েই বন্ধন খুলিয়া পলাইয়া আসিয়াছেন। এখন কি উপায় হয়। চন্দ্রপ্রভা দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, রাজপথবাহী লোকদিগকে ও সমভিব্যাহারী রাজপুরুষকে কহিতে লাগিলেন, যেরূপে পার, তোমরা উঁহারে বন্ধন করিয়া আমার নিকটে দাও। এই উপলক্ষে বিলক্ষণ গোলযোগ উপস্থিত হইল। চিরঞ্জীব দেখিলেন, যে মায়াবিনী মধ্যাহ্নকালে ধরিয়া বাটীতে লইয়া গিয়াছিল, সে এক্ষণে এক রাজপুরুষ সঙ্গে করিয়া আসিতেছে। ইহাতেই তিনি ও তাঁহার সহচর কিঙ্কর বিলক্ষণ ভয় পাইয়াছিলেন; পরে, তাঁহারা, বন্ধন করিয়া লইয়া যাইবার পরামর্শ করিতেছেন জানিতে পারিয়া, তরবারি নিষ্কাশন পূর্ব্বক, প্রহার অভিপ্রায়ে তাহাদের দিকে ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা ও তাহার ভগিনীকে সম্ভাষণ করিয়া, রাজপুরুষ কহিলেন, একে উঁহাদের উন্মাদ অবস্থা, তাহাতে আবার হস্তে তরবারি; এ সময়ে বন্ধনের চেষ্টা পাইলে, অনেকের প্রাণহানি সম্ভাবনা। আমি এ পরামর্শে নাই, তোমাদের যেরূপ অভিরুচি হয় কর; আমি চলিলাম, আর এখানে থাকিব না; আমার বোধে, তোমাদেরও পলায়ন করা ভাল। এই বলিয়া রাজপুরুষ চলিয়া গেলে, চন্দ্রপ্রভা ও বিলাসিনী অধিক লোক সংগ্রহের নিমিত্ত, প্রয়াণ করিলেন।

সকলকে আকুল ভাবে পলায়ন করিতে দেখিয়া, চিরঞ্জীব স্বীয় সহচরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! এখানকার ডাকিনীরা তরবারি দেখিলে ভয় পায়। ভাগ্যে আমাদের সঙ্গে তরবারি ছিল; নতুবা পুনরায় আমাদিগকে ধরিয়া লইয়া যাইত, এবং অবশেষে কি করিত, বলিতে পারি না। কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! যিনি মধ্যাহ্নকালে আপনার স্ত্রী হইবার নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়াছিলেন, দেখিলাম, তিনিই সর্ব্বাপেক্ষায় অধিক ভয় পাইয়াছেন, এবং সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিয়াছেন। তরবারি ডাইন ছাড়াইবার এমন মন্ত্র, তাহা আমি এত দিন জানিতাম না। চিরঞ্জীব কহিলেন, দেখ, কিঙ্কর! যত শীঘ্র জাহাজে উঠিতে পারি, ততই মঙ্গল; এখানকার যেরূপ কাণ্ড, তাহাতে কখন কি উপস্থিত হয়, বলা যায় না। অতএব চল, পান্থনিবাসে গিয়া, দ্রব্যসামগ্রী লইয়া, সন্ধ্যার মধ্যেই জাহাজে উঠিব। কিঙ্কর কহিল, আপনি এত ব্যস্ত হইতেছেন কেন; আজকার রাত্রি এখানে থাকুন। উহারা কখনই আমাদের অনিষ্ট করিবেক না। আমরা প্রথমে উহাদিগকে যত ভয়ঙ্কর ভাবিয়াছিলাম, উহারা সেরূপ নহে। দেখুন, কেমন মিষ্ট কথা কয়; বাটীতে লইয়া গিয়া, কেমন উত্তম আহার দেয়; কখনও দেখা শুনা নাই, তথাপি পতিসম্ভাষণ করিয়া প্রণয় করিতে চায়; আবার, প্রয়োজন জানাইলে, অকাতরে স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে। ইহাতেও বদি আমরা উহাদিগকে অভদ্র বলি, লোকে আমাদিগকে কৃতঘ্ন বলিবে। আমি ত আপনকার সঙ্গে অনেক দেশ বেড়াইয়াছি, কোথাও এরূপ সৌজন্য ও এরূপ বদান্যতা দেখি নাই। বলিতে কি, মহাশয়! আমি, উহাদের ব্যবহার দেখিয়া, এত মোহিত হইয়াছি যে, যদি পাকশালার হস্তিনী আমার স্ত্রী হইতে না চাহিত, তাহা হইলে আমি, নিঃসন্দেহ, আহ্লাদিত চিত্তে এই রাজ্যে বাস করিতাম। চিরঞ্জীব শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! অধিক আর কি বলিব, যদি এই বাজ্যের অধিরাজপদ পাই, তথাপি আমি কোনও ক্রমে এখানে রাত্রিবাস করিব না। চল, আর বিলম্বে কাজ নাই; সন্ধ্যার মধ্যেই অর্ণবপোতে আরোহণ করিতে হইবেক। এই বলিয়া,উভয়ে পান্থনিবাস অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

ভ্রান্তিবিলাস – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভ্রান্তিবিলাস – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

রাজপুরুষ, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবকে লইয়া, তদীয় আলয় অভিমুখে প্রয়াণ করিলে পর, উত্তমর্ণ বণিক অধমর্ণ স্বর্ণকারকে বলিলেন, তোমায় টাকা দিয়া পাইতে এত কষ্ট হইবেক, তাহা আমি এক বারও মনে করি নাই। হয় ত, এই টাকার গোলে আজ আমার যাওয়া হইল না; যাওয়া না হইলে, বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হইব। এখন বোধ হইতেছে, সে সময়ে তোমার উপকার করিয়া ভাল করি নাই। স্বর্ণকার সাতিশয় কুণ্ঠিত হইয়া, কহিলেন, মহাশয়! আর আমার লজ্জা দিবেন না, আমি আপনকার আবশ্যক সময়ে টাকা দিতে না পারিয়া মরিয়া রহিয়াছি। চিরঞ্জীববাবু যে আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিবেন, ইহা স্বপ্নের অগোচর। উনি যে হার লইয়া পাই নাই বলিবেন, অথবা টাকা দিতে আপত্তি করিবেন, এক মুহূর্ত্তের জন্যেও মনে হয় নাই। আপনি এ সন্দেহ করিবেন না যে আমি উহাকে হার দি নাই, কেবল আপনকার সঙ্গে ছল করিতেছি। আমি ধর্ম্মপ্রমাণ বলিতেছি, চারি দণ্ড পূর্ব্বে আমি নিজে উহার হস্তে হার দিয়াছি। উনি সে সময়ে মূল্য দিতে চাহিয়াছিলেন; আমার কুবুদ্ধি, আমি বলিলাম, এখন কার্য্যান্তরে যাইতেছি, পরে সাক্ষাৎ করিব ও মূল্য লইব। উনি কিন্তু সে সময়ে বলিয়াছিলেন, এখন না লও, পরে আর পাইবার সম্ভবনা থাকিবে না। তৎকালে কি অভিপ্রায়ে উনি এ কথা বলিয়াছিলেন, জানি না; কিন্তু কার্য্যগতিকে উহার কথাই ঠিক হইতেছে।

স্বর্ণকারের এই সকল কথা শুনিয়া বণিক জিজ্ঞাসা করিলেন, বলি, চিরঞ্জীববাবু লোক কেমন। বসুপ্রিয় কহিলেন, উনি জয়স্থলে সর্ব্ব বিষয়ে অদ্বিতীয় ব্যক্তি। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই উঁহাকে জানে এবং সকলেই উঁহাকে ভাল বাসে। উনি সকল সমাজে সমান আদরণীয় ও সর্ব্বপ্রকারে প্রশংসনীয় ব্যক্তি। ঐশ্বর্য্য ও আধিপত্য বিষয়ে এ রাজ্যে উঁহার তুল্য লোক নাই। কখনও কোনও বিষয়ে উঁহার কথা অন্যথা হয় না। পরোপকারার্থে অকাতরে অর্থব্যয় করিয়া থাকেন। উনি যে আজ আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিলেন, শুনিলে কেহ বিশ্বাস করিবেক না। এই সকল কথা শুনিয়া বণিক কহিলেন, আমরা আর এখানে অনর্থক বসিয়া থাকি কেন; চল, তাঁহার বাটীতে যাই; তাহা হইলে শীঘ্র টাকা পাইব এবং হয় ত আজই যাইতে পারিব। অনন্তর বসুপ্রিয় ও বণিক উভয়ে চিরঞ্জীবের ভবন অভিমুখে গমন করিলেন।

এই সময়ে, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে, পান্থনিবাসে প্রতিগমন করিতেছিলেন। বণিক দূর হইতে দেখিতে পাইয়া বসুপ্রিয়কে কহিলেন, আমার বোধ হয়, চিরঞ্জীববাবু আসিতেছেন। বসুপ্রিয় কহিলেন, হাঁ তিনিই বটে; আর, আমার নির্ম্মিত হারও উঁহার গলায় রহিয়াছে, দেখিতেছি; অথচ, দেখুন, আপনকার সমক্ষে উনি স্পষ্ট বাক্যে বারংবার হার পাই নাই বলিলেন, এবং আমার সঙ্গে কত বিবাদ ও বাদানুবাদ করিলেন। এই বলিয়া, তাহার নিকটে গিয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, চিরঞ্জীববাবু! আমি আজ আপনকার আচরণ দেখিয়া হতবুদ্ধি হইরাছি। আপনি কেবল আমায় কষ্ট দিতেছেন ও অপদস্থ করিতেছেন এরূপ নহে, আপনকারও বিলক্ষণ অপযশ হইতেছে। এখন, হার পরিয়া রাজপথে স্পষ্ট বেড়াইতেছেন; কিন্তু, তখন, অনায়াসে শপথ পূর্ব্বক হারপ্রাপ্তি অপলাপ করিলেন। আপনকার এরূপ ব্যবহারে এই এক ভদ্র লোকের কত কার্য্য়ক্ষতি হইল, বলিবার নয়। উনি স্থানান্তরে যাইবার সমুদয় স্থির করিয়াছিলেন; এত ক্ষণ কোন কালে চলিয়া যাইতেন; কেবল আমাদের বিবাদের জন্যে যাইতে পারিলেন না। তখন অনায়াসে অপলাপ করিয়াছেন, এখনও কি অপলাপ করিবেন।

বসুপ্রিয়ের এই কথা শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি তোমার নিকট হইতে এই হার পাইয়াছি বটে, কিন্তু এক বারও তাহা অস্বীকার করি নাই, তুমি সহসা আমার উপর এরূপ দোষারোপ করিতেছ কেন। তখন বণিক কহিলেন, হাঁ, আপনি অস্বীকার করিয়াছেন, এবং, হার পাই নাই বলিয়া, বারংবার শপথ পর্য্য়ন্ত করিয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি শপথ ও অস্বীকার করিয়াছি, তাহা কে শুনিয়াছে। বণিক কহিলেন, আমি নিজে স্বকর্ণে শুনিয়াছি। ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়, যে তোমার মত নরাধমেরা ভদ্রসমাজে প্রবেশ করিতে পায়। শুনিয়া, কোপে কম্পিতকলেবর হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, তুই বেটা বড় পাজি ও বড় ছোট লোক, অকারণে আমায় কটু বলিতেছিস। আমি ভদ্র কি অভদ্র, তাহা এখনই তোরে শিখাইতেছি। মর বেটা পাজি, যত বড় মুখ, তত বড় কথা। এই বলিয়া, তিনি তরবারি নিকাশিত করিলেন, এবং বণিকও তরবারি নিষ্কাশিত করিয়া, দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্যত হইলেন।

এই সময়ে চন্দ্রপ্রভা, কতকগুলি লোক সঙ্গে করিয়া, সহসা সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন এবং বণিকের সহিত হেমকূটবাসী চিরজীবের দ্বন্দ্বযুদ্ধের উপক্রম দেখিয়া, স্বীয় পতি জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব তাদৃশ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেছেন, এই বোধে, সাতিশয় কাতরতা প্রদর্শন পূর্ব্বক, বণিককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দোহাই ধর্ম্মের, উঁহারে প্রহার করিবেন না, উনি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন। এ অবস্থায়, কোনও কারণে উঁহার উপর রাগ করা উচিত নয়। কৃতাঞ্জলিপুটে বলিতেছি, দয়া করিয়া ক্ষান্ত হউন। এই বলিয়া, তিনি সঙ্গের লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা, কৌশল করিয়া, উঁহার হাত হইতে তরবারি ছাড়াইয়া লও, এবং প্রভু ও ভৃত্য উভয়কে বন্ধন করিয়া আমার আলয়ে লইয়া চল। চন্দ্রপ্রভাকে সহসা সমাগত দেখিয়া ও তদীয় আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া, কিঙ্কর চিরঞ্জীবকে কহিল, মহাশয়! আবার সেই মায়াবিনী ঠাকুরাণী আসিয়াছেন; আর এখানে দাঁড়াইবেন না, পলায়ন করুন; নতুবা নিস্তার নাই। এই বলিয়া, সে চারি দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ করিয়া কহিল, মহাশয়! আসুন, এই দেবালয়ে প্রবেশ করি; তাহা হইলে, আমাদের উপর কেহ আর অত্যাচার করিতে পারিবেক না। তৎক্ষণাৎ উভয়ে দৌডিয়া পার্শ্ববর্ত্তী দেবালয়ে প্রবিষ্ট হইলেন। চন্দ্রপ্রভা, বিলাসিনী ও তাঁহাদের সমভিব্যাহারের লোক সকল দেবালয়ের দ্বারদেশে উপনীত হইল। এই গোলযোগ উপস্থিত দেখিয়া, রাজপথবাহী লোক সকলও তথায় সমবেত হইতে লাগিল।

ঐ দেবালয়ের কার্য্য পর্য্য়বেক্ষণের সমস্ত ভার এক বর্ষীয়সী তপস্বিনীর হস্তে ন্যস্ত ছিল। ইনি যার পর নাই সুশীলা ও নিরতিশয় দয়াশীলা ছিলেন এবং সুচারুরূপে দেবালয়ের কার্য্য সম্পাদন করিতেন; এজন্য, জয়স্থলবাসী যাবতীয় লোকের বিলক্ষণ ভক্তিভাজন ও সাতিশয় শ্রদ্ধাস্পদ ছিলেন। অভ্যন্তর হইতে অকস্মাৎ বিষম গোলযোগ শ্রবণ করিয়া, কারণ জানিবার নিমিত্ত, তিনি দেবালয় হইতে বহির্গত হইলেন এবং সমবেত লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি জন্য তোমরা এখানে গোলযোগ করিতেছ। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আমার উন্মাদগ্রস্ত স্বামী পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে ও আমার লোকদিগকে ভিতরে যাইতে দেন, আমরা তাঁহারে বন্ধন করিয়া বাটী লইয়া যাইব। তপস্বিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, কত দিন তিনি এই দুর্দ্দান্ত রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, পাঁচ সাত দিন হইতে তাঁহাকে সর্ব্বদাই বিরক্ত, অন্যমনস্ক ও দুর্ভাবনায় অভিভূত দেখিতাম, কিন্তু, আজ আড়াই প্রহরের সময় অবধি, এক বারে বাহ্য়জ্ঞানশূণ্যপ্রায় হইয়াছেন। এই বলিয়া, তিনি সঙ্গের লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা ভিতরে গিয়া, তাঁহাকে ও কিঙ্করকে বন্ধন করিয়া, সাবধানে লইয়া আইস। তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! তোমার একটি লোকও দেবালয়ে প্রবেশ করিতে পারিবেক না। তখন চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তবে আপনকার লোকদিগকে আদেশ করুন, তাহারাই বন্ধন করিয়া তাঁহাকে আমার নিকটে আনিয়া দিউক। তপস্বিনী কহিলেন, তাহাও হইবেক না; তিনি যখন এই দেবালয়ে আশ্রয় লইয়াছেন, তখন, যত ক্ষণ বা যত দিন ইচ্ছা হয়, তিনি সচ্ছন্দে এখানে থাকিবেন; সে সময়ে তোমার বা অন্য কোনও ব্যক্তির তাঁহার উপর কোনও অধিকার থাকিবেক না। আমি উঁহার চিকিৎসার ও শুশ্রুষার সমস্ত ভার লইতেছি। উনি সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ হইলে আপন আলয়ে যাইবেন। এ অবস্থায়, আমি কোনও ক্রমে উঁহাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিতে পারিব না।

এই সকল কথা শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন; আমি যেমন প্রাণপণে উঁহার চিকিৎসা করাইব ও পরিচর্য্য়া করিব, অন্যের সেরূপ করা সম্ভব নহে। আপনি উঁহাকে আমার হস্তে সমর্পণ করুন। তখন তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! এত উতলা হইতেছ কেন, ধৈর্য্য অবলম্বন কর। আমি অনেক প্রকার মন্ত্র, ঔষধ ও চিকিৎসা জানি, এবং এ পর্যন্ত শত শত লোকের শারীরিক ও মানসিক রোগের শান্তি করিয়াছি। যেরূপ শুনিতেছি, আমি, অল্প কালের মধ্যেই, তোমার স্বামীকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিব; তখন তিনি স্বেচ্ছাক্রমে আপন ভবনে প্রতিগমন করিবেন। আমাদের তপস্যা ও ধর্ম্মচর্য্য়ার যেরূপ নিয়ম এবং দেবালয়ের কার্য্য়নির্ব্বাহ সম্বন্ধে যেরূপ নিয়মাবলী প্রচলিত আছে, তদনুসারে, যখন তোমার স্বামী এখানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার অনিচ্ছায় বল পূর্ব্বক উঁহাকে দেবালয় হইতে বহিষ্কৃত করিতে পারি না। অতএব, বৎসে! প্রস্থান কর; যাবৎ উনি আরোগ্য লাভ না করিতেছেন, আমার নিকটেই থাকুন; উঁহার চিকিৎসা বা শুশ্রুষা বিষয়ে কোনও অংশে ত্রুটি হইবেক না, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকিবে। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, উঁহাকে ছাড়িয়া, আমি কখনও এখান হইতে যাইব না। আমার অনিচ্ছায় ও অসম্মতিতে, আমার স্বামীকে এখানে রুদ্ধ করিয়া রাখা কোনও মতে আপনার উচিত হইতেছে না। আপনি, সকল বিষয়ের বিশেষ অনুধাবন না করিয়াই, আমায় এখান হইতে চলিয়া যাইতে বলিতেছেন। শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া, তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! তুমি এ বিষয়ে অনর্থক আগ্রহ প্রকাশ করিতেছ; তোমার সঙ্গে বৃথা বাদানুবাদ করিব না। আমি এক কথায় বলিতেছি, তোমার স্বামী সুস্থ না হইলে, তুমি কখনও তাঁহাকে এখান হইতে লইয়া যাইতে পারিবে না; এখন আপন আলয়ে প্রতিগমন কর।

এই বলিয়া, তপস্বিনী দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, দেবালয়ের দ্বার রুদ্ধ হইল; সুতরাং, আর কাহারও তথায় প্রবেশ করিবার পথ রহিল না। চন্দ্রপ্রভার এইরূপ অবমাননা দর্শনে, বিলাসিনী অতিশয় রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, দিদি! আর এখানে দাঁড়াইয়া ভাবিলে ও বৃথা কালহরণ করিলে, কি ফল হইবে বল; চল, আমরা অধিরাজ বাহাদুরের নিকটে গিয়া, এই অহঙ্কারিণী তপস্বিনীর অন্যায় আচরণ বিষয়ে অভিযোেগ করি, তিনি অবশ্যই বিচার করিবেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! তুমি বিলক্ষণ বুদ্ধির কথা বলিয়াছ; চল, তাঁহার নিকটেই যাই। তিনি যত ক্ষণ না, স্বয়ং এখানে আসিয়া, আমার স্বামীকে বল পূর্ব্বক দেবালয় হইতে বহিস্কৃত করিয়া, আমার হস্তে দিতে সম্মত হন, তাবৎ আমি কোনও ক্রমে তাহাকে ছাড়িব না; তাঁহার চরণে পড়িয়া থাকিব এবং অবিশ্রামে অশ্রু বিসর্জ্জন করিব। এই কথা শুনিয়া বণিক কহিলেন, আপনারা কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করিলে, এই খানেই অধিরাজের সহিত সাক্ষাৎ হইবেক। আমি অবধারিত জানি, সন্ধ্যার অব্যবহিত পূর্ব্বে, তিনি এই পথ দিয়া বধ্যভূমিতে যাইবেন। বেলা অবসান হইয়াছে; সায়ংকাল আগতপ্রায়; তাঁহার আসিবার আর বড় বিলম্ব নাই। বসুপ্রিয় জিজ্ঞাসিলেন, তিনি কি জন্যে এ সময়ে বধ্যভূমিতে যাইবেন। বণিক কহিলেন, আপনি কি শুনেন নাই, হেমকূটের এক বৃদ্ধ বণিক জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এই অপরাধে তাহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে; ভাহার শিরচ্ছেদনকালে অধিরাজ বাহাদুব স্বয়ং বধ্যভূমিতে উপস্থিত থাকবেন। বিলাসিণী চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, অধিরাজ বাহাদুর দেবালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলেই, তুমি তাঁহার চরণে ধরিয়া বিচার প্রার্থনা করিবে, কোনও মতে ভীত বা সঙ্কুচিত হইবে না।

কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, অধিরাজ বিজয়বল্লভ, রাজপুরুষগণ ও বধ্যবেশধারী সোমদত্ত প্রভৃতি সমভিব্যাহারে, দেবালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দেখিবামাত্র, চন্দ্রপ্রভা, তার সম্মুখবর্ত্তিনী হইয়া, অঞ্জলি বন্ধ পূর্ব্বক, বিনীত বচনে কহিলেন, মহারাজ! এই দেবালয়ের কর্ত্রী তপস্বিনী আমার উপর যার পর নাই অত্যাচাব করিয়াছেন, আপনারে অনুগ্রহ করিয়া বিচার করিতে হইবেক। শুনিয়া বিজয়বল্লভ কহিলেন, তিনি অতি সুশীলা ধর্ম্মশীলা প্রবীণা নারী, কোনও ক্রমে অন্যায় আচরণ করিবার লোক নহেন; তুমি কি কারণে তাঁহাব নামে অত্যাচারের অভিযোগ করিতেছ, বুঝিতে পারিলাম না। চন্দ্র প্রভ কহিলেন, মহাবাজ! আমি মিথ্যা অভিযোগ করিতেছি না; কিঞ্চিৎ মনোেযোগ দিয়া আমার নিবেদন শুনিতে হইবেক। আপনি যে ব্যক্তির সহিত আমার বিবাহ দিয়াছেন, তিনি ও তাঁহার পরিচারক কিঙ্কর উভয়ে উন্মাদরোগে আক্রান্ত হইয়াছেন, এবং রাজপথে ও লোকের বাটীতে অনেক প্রকার অত্যাচার করিতেছেন, এই সংবাদ পাইয়া, এক বার অনেক যত্নে বন্ধন পূর্ব্বক তাঁহাকে ও কিঙ্করকে বাটীতে পাঠাইয়া দিয়া, কোনও কার্য্য়বশতঃ বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের আময়ে যাইতেছিলাম; ইতিমধ্যে দেখিতে পাইলাম, তিনি ও কিঙ্কর বাটী হইতে পলাইয়া আসিয়াছেন! আমি, পুনরায় তাঁহাদিগকে বাটীতে লইয়া যাইবার চেষ্টা পাইলাম। উভয়েই এক বারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য; আমাদিগকে দেখবামাত্র, উভয়েই তরবারি হস্তে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলেন। তৎকালে আমার সঙ্গে অধিক লোক ছিল না; এজন্য, আমি তৎক্ষণাৎ বাটী গিয়া, লোক সংগ্রহ পূর্ব্বক, তাঁহাকে ও কিঙ্করকে লইয়া যাইতে আসিয়াছিলাম। এ বার আমাদিগকে দেখিয়া, ভয় পাইয়া, উভয়ে এই দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। আমরাও তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবিষ্ট হইতেছিলাম; এমন সময়ে, এখানকার কর্ত্রী তপস্বিনী, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমাদিগকে প্রবেশ করিতে দিলেন না। অনেক বিনয় করিয়া বলিলাম; কিন্তু তিনি কোনও ক্রমে আমায় উঁহাকে লইয়া যাইতে দিবেন না। আমি, উঁহাকে এ অবস্থায় এখানে রাখিয়া, কেমন করিয়া বাটীতে নিশ্চিন্ত থাকিব। মহারাজ! যাহাতে আমি অবিলম্বে উঁহাকে বাটীতে লইয়া যাইতে পারি, অনুগ্রহ পূর্ব্বক তাহার উপায় করিয়া দেন, নতুবা আমি আপকে যাইতে দিব না।

এই বলিয়া চন্দ্রপ্রভা অধিরাজের চরণে নিপতিত হইয়া রহিলেন, এবং অবিশ্রান্ত অশ্রু বিমোচন করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে অধিরাজের অন্তঃকরণে দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি পার্শ্ববর্ত্তী রাজপুরুষকে কহিলেন, তুমি দেবালয়ের কর্ত্রীকে আমার নমস্কার জানাইয়া, একবার ক্ষণকালের জন্য, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বল; অনন্তর, চন্দ্রপ্রভার হস্তে ধরিয়া, ভূতল হইতে উঠাইলেন কহিলেন, বৎসে! শোক সংবরণ কর, এ বিষয়ের মীমাংসা না করিয়া আমি এখান হইতে যাইতেছি না।

এই সময়ে, এক ভৃত্য আসিয়া, অতি আকুল বচনে চন্দ্রপ্রভাকে কহিতে লাগিল, মা ঠাকুরাণি! যদি প্রাণ বাঁচাইতে চান, অবিলম্বে কোনও স্থানে লুকাইয়া থাকুন। কর্তা মহাশয় ও কিঙ্কর উভয়ে বন্ধন ছেদন করিয়াছেন এবং দাস দাসীদিগকে প্রহার করিয়া, বিদ্যাধর মাহাশয়কে দৃঢ় রূপে বন্ধন পূর্ব্বক তাহার দাড়ীতে আগুন লাগাইয়া দিয়াছেন; পরে, আগুন নিবাইবার জন্য, ময়লা জল আনিয়া তাঁহার মুখে ঢালিয়া দিতেছেন। বিদ্যাধর মহাশয়ের উপর প্রভুর যেরূপ রাগ দেখিলাম, তাহতে, হয় ত, তাঁহার প্রাণবধ করিবেন। এক্ষণে, যাহা কর্ত্তব্য হয় করুন, এবং আপনি সাবধান হউন। শুনিয়া চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, অরে নির্বোধ! তুই মিথ্যা বলিতেছিস; তোর প্রভু ও কিঙ্কর উভয়ে কিছু পূর্ব্বে এই দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। ভৃত্য কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমি মিথ্যা বলিতেছি না। তিনি বন্ধন ছেদন পূর্ব্বক দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিলে, আমি, ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া, আপনার নিকটে আসিয়াছি। এই কথা বলিতে বলিতে, চিরঞ্জীবের তর্জন গর্জন শুনিতে পাইয়া, সে কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমি তাঁহার চীৎকার শুনিতে পাইতেছি; বোধ হয় এখানেই আসিতেছেন; আপনি সাবধান হউন। তিনি বারংবার বলিয়াছেন, আপনাকে পাইলে, নাক কান কাটিয়া হতশ্রী করিয়া দিবেন। সত্বর পলায়ন করুন, কদাচ এখানে থাকিবেন না। চন্দ্রপ্রভা, ভয়ে অভিভূত হইয়া, ইতস্ততঃ দৃষ্টি সঞ্চারণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে অধিরাজ বাহাদুর কহিলেন, বৎসে! ভয় নাই, আমার নিকটে আসিয়া দাঁড়াও। এই বলিয়া তিনি রক্ষকদিগকে বলিলেন, কাহাকেও নিকটে আসিতে দিও না।

চিরঞ্জীবকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, চন্দ্রপ্রভা অধিরাজ বাহাদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! কি আশ্চর্য্য দেখুন। প্রথমতঃ, আমি উঁহারে, দৃঢ় বন্ধন করাইয়া, বাটীতে পাঠাই; কিঞ্চিৎ পরেই, উঁহারে রাজপথে দেখিতে পাই, তত অল্প সময়ের মধ্যে, বন্ধন ছেদন পূর্ব্বক রাজপথে উপস্থিত হওয়া কোনও মতে সম্ভব নহে। তৎপরে, পলাইয়া এইমাত্র দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। দেবালয়ে প্রবেশনির্গমের এক বই পথ নাই; বিশেষতঃ, আমরা সকলে দ্বারদেশে সমবেত আছি; ইতিমধ্যে, কেমন করিয়া, দেবালয় হইতে বহির্গত হইলেন, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বলিতে কি, মহারাজ! উহার আজকার কাজ সকল মনুষ্যের বুদ্ধি ও বিবেচনার অতীত। এই সময়ে, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব, উন্মত্তের ন্যায়, বিশৃঙ্খল বেশে অধিরাজের সম্মুখদেশে উপস্থিত হইলেন, এবং কহিতে লাগিলেন, দোহাই মহারাজের! দোহাই মহারাজের। আজ আমার উপর ঘোরতর অত্যাচার হইয়াছে; আমি জন্মাবচ্ছেদে কখনও এরূপ অপদস্থ ও অপমানিত হই নাই, এবং কখনও এরূপ লাঞ্ছনা ও এরূপ যাতনা ভোগ করি নাই। আমার স্ত্রী চন্দ্রপ্রভা, নিতান্ত সাধুশীলার ন্যায়, আপনার নিকটে দাড়াইয়া আছেন; কিন্তু আমি ইঁহার তুল্য দুশ্চারিণী নারী আর দেখি নাই। কতকগুলি ইতরের সংসর্গে কালযাপন আরম্ভ করিয়াছেন; এবং তাহাদের কুমন্ত্রণায় আজ যে যন্ত্রণা দিয়াছেন এবং যে দুরবস্থা করিয়াছেন, তাহা বর্ণন করিবার নয়। আপনারে নিরপেক্ষ হইয়া বিচার করিতে হইবেক; নতুরা আমি আত্মঘাতী হইব।

চিরঞ্জীবের অভিযোগ শুনিয়া, অধিরাজ কহিলেন, তোমার উপর কি অত্যাচার হইয়াছে বল; যদি বাস্তবিক হয়, অবশ্য প্রতিকার করিব। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আজ মধ্যাহ্নকালে, আহারের সময়, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই, এবং সেই সময়ে কতকগুলি ইতর লোক লইয়া আমোদ আলাদ করিয়াছেন। শুনিয়া অধিরাজ কহিলেন, এ কথা যদি যথার্থ হয়, তাহা হইলে স্ত্রীলোকের পক্ষে ইহা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ আর কিছুই হইতে পারে না। চন্দ্রপ্রভা! এ বিষয়ে তোমার কিছু বলিবার আছে। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, মহারাজ! উনি অমূলক কথা বলিতেছেন; আজ মধ্যাহ্নকালে উনি, আমি ও বিলাসিনী তিন জনে একত্র আহার করিয়াছি; এ কথা যদি অন্যথা হয়, আমার যেন নরকেও স্থান না হয়। বিলাসিনী কহিলেন, হাঁ মহারাজ! দিদি আপনকার নিকট একটিও অলীক কথা বলেন নাই। উভয়ের কথা শুনিয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকার বলিলেন, মহারাজ! আমি ইহাদের তুল্য মিথ্যাবাদিনী কামিনী ভূমণ্ডলে দেখি নাই; উভয়েই সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিতেছেন। চিরঞ্জীববাবু আজ উন্মাদগ্রস্তই হউন, আর যাই হউন, উনি যে অভিযোগ করিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। আপনি এই দুই দুরাচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।

অনন্তর, চিরঞ্জীব নিজ দুরবস্থার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারাজ! আমি মত্ত বা উন্মত্ত কিছুই হই নাই। কিন্তু আজ আমার উপর যেরূপ অত্যাচার হইয়াছে, যাহার উপর সেরূপ হইবেক, সেই উন্মত্ত হইবেক। প্রথমতঃ, আহারের সময়, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই; তৎকালে বসুপ্রিয় স্বর্ণকার ও রত্নদত্ত বণিক আমার সঙ্গে ছিলেন। আমি ক্রোধভরে দ্বারভঙ্গে উদ্যত হইয়াছিলাম; রত্নদত্ত অনেক বুঝাইয়া আমায় নিবারণ করিলেন। পরে আমি, বসুপ্রিয়কে সত্বর আমার নিকট হার লইয়া যাইতে বলিয়া, রত্নদত্ত সমভিব্যাহারে অপরাজিতার বাটীতে আহার করিলাম। বসুপ্রিয়ের আসিতে অনেক বিলম্ব হওয়াতে, আমি উঁহার অন্বেষণে নির্গত হইলাম। পথিমধ্যে উঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তৎকালে ঐ বণিকটি উঁহার সঙ্গে ছিলেন। বসুপ্রিয় কহিলেন, কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমি তোমায় হার দিয়াছি, টাকা দাও! কিন্তু, জগদীশ্বর সাক্ষী, আমি এ পর্য্য়ন্ত হার দেখি নাই। উনি তৎক্ষণাৎ রাজপুরুষ দ্বারা আমায় অবরুদ্ধ করাইলেন। পরে নিরুপায় হইয়া, আমার পরিচারক কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া, টাকা আনিবার জন্য বাটীতে পাঠাইলাম। সে যে গেল, সেই গেল, আর ফিরিয়া আসিল না। আমি অনেক বিনয়ে সম্মত করিয়া, রাজপুরুষকে সঙ্গে লইয়া বাটী যাইতেছিলাম; এমন সময়ে, আমার স্ত্রী ও তাহার ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। দেখিলাম, উঁহাদের সঙ্গে কতকগুলি ইতর লোক রহিয়াছে; আর, আমাদের পল্লীতে বিদ্যাধর নামে একটা হতভাগা গুরুমহাশয় আছে, তাহাকেও সঙ্গে আনিয়াছেন। সে লোকের নিকট চিকিৎসক বলিয়াও পরিচয় দিয়া থাকে। তাহার মত দুশ্চরিত্র নরাধম ভূমণ্ডলে নাই। সেই দুরাত্মা আজ কাল আমার স্ত্রীর প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়াছে। সে আমায় দেখিয়া বলিল, আমি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছি। অনন্তর, তাহার উপদেশ অনুসারে, আমাকে ও কিঙ্করকে বন্ধন করিয়া বাটীতে লইয়া গেল, এবং এক দুর্গন্ধপূর্ণ অন্ধকারময় গৃহে বন্ধন অবস্থায় রাখিয়া দিল। আমরা, অনেক কষ্টে দন্ত দ্বারা রজ্জু ছেদন পূর্ব্বক, পলাইয়া আপনকার সমীপে সমুদয় নিবেদন করিতে যাইতেছিলাম; ভাগ্যক্রমে এই স্থানে আপনার সাক্ষাৎ পাইলাম। আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম্মের অবতার, এ রাজ্যে ন্যায় অন্যায় বিচারের একমাত্র কর্তা। আমার প্রার্থনা এই, যথার্থ বিচার করিয়া, অপরাধীর সমুচিত দণ্ড বিধান করেন। আমি আপনকার সমক্ষে যে সকল কথা বলিলাম, যদি ইহার একটিও মিথ্যা হয়, আপনি আমার প্রাণদণ্ড করিবেন।

এই বলিয়া, চিরঞ্জীব বিরত হইবামাত্র, বসুপ্রিয় কহিলেন, মহারাজ! উনি আহারের সময় বাটীতে প্রবেশ করিতে পান নাই, এবং বাটীতে আহার করেন নাই, আমি এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছি; তৎকালে আমি উঁহার সঙ্গে ছিলাম। অধিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি উঁহারে হার দিয়াছ কি না, বল। বসুপ্রিয় কহিলেন, হাঁ মহারাজ! আমি স্বয়ং উঁহার হস্তে হার দিয়াছি। উনি কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে যখন পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করেন, উঁহার গলায় ঐ হার ছিল, ইঁহারা সকলে স্বচক্ষে দেখিয়াছেন। বণিক কহিলেন, মহারাজ! যখন উঁহার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, তখন একবারে হারপ্রাপ্তি অস্বীকার করিয়াছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় বার সাক্ষাৎকারকালে, হার পাইয়াছি বলিয়া স্পষ্ট বাক্যে স্বীকার করিয়াছেন। আমি উঁহার স্বীকার ও অস্বীকার উভয়ই স্বকর্ণে শুনিয়াছি। তৎপরে কথায় কথায় বিবাদ উপস্থিত হওয়াতে, উভয়েই তরবারি লইয়া দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্যত হইয়াছিলাম; এমন সময়ে, উনি পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করেন, এক্ষণে দেবালয় হইতে বহির্গত হইয়া, আপনকার সমক্ষে উপস্থিত হইয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! এ জন্মে আমি এ দেবালয়ে প্রবেশ করি নাই; বণিকের সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হই নাই; বসুপ্রিয় কখনই আমার হস্তে হার দেন নাই। উহারা আমার নামে এ তিনটি মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিতেছেন।

এই সমস্ত অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগ শ্রবণ করিয়া, অধিরাজ কহিলেন, এরূপ দুরূহ বিষয় কখনও আমার সম্মুখে উপস্থিত হয় নাই। আমার বোধ হয়, তোমাদের সকলেরই দৃষ্টিক্ষয় ও বুদ্ধি বিপর্য্য়য় ঘটিয়াছে। তোমরা সকলেই বলিতেছ, চিরঞ্জীব এইমাত্র দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছে; যদি দেবালয়ে প্রবেশ করিত, এখনও দেবালয়েই থাকিত। তোমরা কহিতেছ, চিরঞ্জীব উন্মত্ত হইয়াছে; যদি উন্মত্ত হইত, তাহা হইলে এরূপ বুদ্ধি ও বিবেচনা সহকারে এত ক্ষণ আমার সমক্ষে অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগ করিতে পারিত না। তোমরা দুই ভগিনীতে বলিতেছ, চিরঞ্জীব বাটীতে আহার করিয়াছে; কিন্তু বসুপ্রিয় তৎকালে তাহার সঙ্গে ছিল, সে বলিতেছে, চিরঞ্জীব বাটীতে আহার করে নাই। এই বলিয়া, তিনি কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কি রে, তুই কি জানিস, বল্‌। সে কহিল, মহারাজ! কর্ত্তা আজ মধ্যাহ্নকালে অপরাজিতার বাটীতে আহার করিয়াছেন। অপরাজিতা কহিলেন, হা মহারাজ! আজ চিরঞ্জীববাবু আমার বাটীতে আহার করিয়াছিলেন; ঐ সময়ে আমার অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরীয় খুলিয়া লইয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, হাঁ মহারাজ! আমি এই অঙ্গুরীয়টি উঁহার অঙ্গুলি হইতে খুলিয়া লইয়াছি, যথার্থ বটে। অধিরাজ অপরাজিতাকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন, তুমি কি চিরঞ্জীবকে দেবালয়ে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছ। অপরাজিতা কহিলেন, আজ্ঞা হাঁ, মহারাজ! আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, সে বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

এইরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ উক্তি প্রত্যুক্তি শ্রবণ করিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, অধিরাজ কহিলেন, আমি এমন অদ্ভুত কাণ্ড কখনও দেখি নাই ও শুনি নাই। আমার স্পষ্ট বোধ হইতেছে, তোমরা সকলেই উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছ। অনন্তর, তিনি এক রাজপুরুষকে কহিলেন, আমার নাম করিয়া, তুমি দেবালয়ের কর্ত্রীকে অবিলম্বে এখানে আনিতে বল; দেখা যাউক, তিনিই বা কিরূপ বলেন। রাজপুরুষ, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন।

চিরঞ্জীব অধিরাজের সম্মুখবর্ত্তী হইবামাত্র, সোমদত্ত তাঁহাকে নয়নগোচর করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যদি শোকে ও দুরবস্থায় পড়িয়া, আমার নিতান্তই বুদ্ধির ভ্রংশ ও দর্শনশক্তির ব্যতিক্রম না ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে, এ ব্যক্তি আমার পুত্র চিরঞ্জীব ও অপর ব্যক্তি তাহার পরিচারক কিঙ্কর, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। তিনি, চিরঞ্জীবকে পুত্র বলিয়া সম্ভাষণ করিবার নিমিত্ত, নিতান্ত অস্থিরচিত্ত হইয়াছিলেন, কেবল অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগের গোলযোগে অবকাশ পান নাই, এক্ষণে অধিরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! যদি অনুমতি হয়, কিছু নিবেদন করিতে ইচ্ছা করি। অধিরাজ কহিলেন, যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে বল, কোনও বিষয়ে কিছুমাত্র সঙ্কোচ করিও না। সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! এত ক্ষণের পর, এই জনতার মধ্যে, আমি একটি আত্মীয় দেখিতে পাইয়াছি; বোধ করি, তিনি টাকা দিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিতে পারেন। অধিরাজ কহিলেন, সোমদত্ত! যদি কোনও রূপে তোমার প্রাণরক্ষা হয়, আমি কি পর্য্যন্ত আহ্লাদিত হই, বলিতে পারি না। তুমি তোমার আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা কর, তিনি তোমায় প্রাণরক্ষার্থে, এই মুহূর্ভে পাঁচ সহস্র টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন কি না। তখন সোমদত্ত চিরঞ্জীবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন গো, বাবা! তোমার নাম চিরঞ্জীব ও তোমার পরিচারকের নাম কিঙ্কর বটে। বধ্যবেশধারী অপরিচিত বৈদেশিক ব্যক্তি অকস্মাৎ এরূপ প্রশ্ন করিলেন, কেন, ইহার মর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া, চিরঞ্জীব একদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন সোমদত্ত কহিলেন, তুমি নিতান্ত অপরিচিতের ন্যায় আমায় নিরীক্ষণ করিতেছ কেন; তুমি ত আমায় বিলক্ষণ জান। চিরঞ্জীব কহিলেন, না মহাশয়! আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না, এবং ইহার পূর্ব্বে কখনও আপনাকে দেখিয়াছি, এরূপ মনে হইতেছে না। সোমদত্ত কহিলেন, তোমার সঙ্গে শেষ দেখার পর, শোকে ও দুর্ভাবনায় আমার আকৃতির এত পরিবর্ত্ত হইয়াছে যে আমায় চিনিতে পারা সম্ভব নহে; কিন্তু তুমি কি আমার স্বর চিনিতে পারিতেছ না। চিরঞ্জীব কহিলেন, না মহাশয়! আমি আর কখনও আপনকার স্বর শুনি নাই। তখন সোমদত্ত কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন কিঙ্কর! তুমিও কি আমায় চিনিতে পারিতেছ না। কিঙ্কর কহিল, যদি আমার কথায় বিশ্বাস করেন, তবে বলি, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না। অনন্তর, সোমদত্ত চিরঞ্জীবকে কহিলেন, আমার নিশ্চিত বোধ হইতেছে, তুমি আমায় চিনিতে পারিয়াছ। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমারও নিশ্চিত বোধ হইতেছে, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না; চিনিলে অস্বীকার করিবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর, যখন আমি বারংবার বলিতেছি, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না, তখন আমার কথায় অবিশ্বাস করিবারও কোনও কারণ দেখিতেছি না।

চিরঞ্জীবের কথা শুনিয়া, সোমদত্ত বিষণ্ণ ও বিস্ময়াপন্ন হইয়া, কহিতে লাগিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সাত বৎসরে আমার স্বরের ও আকৃতির এত বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে যে একমাত্র পুত্র চিরঞ্জীবও আজ আমায় চিনিতে পারিল না। যদিও আমি জরায় জীর্ণ ও শোকে শীর্ণ হইয়াছি, এবং আমার বুদ্ধিশক্তি, দর্শনশক্তি ও শ্রবণশক্তির প্রায় লোপাপত্তি হইয়াছে; তথাপি, তোমার স্বর শুনিয়া ও আকৃতি দেখিয়া, আমার স্পষ্ট প্রতীতি জন্মিতেছে, তুমি আমার পুত্র; এ বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় হইতেছে না। শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, মহাশয়! আপনি সাত বৎসরের কথা কি বলিতেছেন, জ্ঞান হওয়া অবধি, আমি আমার পিতাকে দেখি নাই। সোমদত্ত কহিলেন, বৎস! যা বল না কেন, সাত বৎসর মাত্র তুমি হেমকূট হইতে প্রস্থান করিয়াছ। এই অল্প সময়ে এককালে সমস্ত বিস্মৃত হইয়াছ, ইহাতে আমি আশ্চর্য্য জ্ঞান করিতেছি। অথবা, আমার অবস্থার বৈগুণ্য দর্শনে, এত লোকের সাক্ষাতে, আমায় পিতা বলিয়া অঙ্গীকার করিতে তোমার লজ্জাবোধ হইতেছে। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহাশয়! আমি জন্মবচ্ছেদে কখনও হেমকুট নগরে যাই নাই; অধিরাজ বাহাদুর নিজে এবং নগরের যে সকল লোক আমায় জানেন, সকলেই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন; আমি আপনকার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করিতেছি না। তখন অধিরাজ কহিলেন, সোমদত্ত! চিরঞ্জীব বিংশতি বৎসর আমার নিকটে রহিয়াছে; এই বিংশতি বৎসরের মধ্যে, ও যে কখনও হেমকূট নগরে যায় নাই, আমি তাহার সাক্ষী। আমি স্পষ্ট বুঝিতেছি, শোকে, ও দুর্ভাবনায়, ও প্রাণদণ্ডভয়ে তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহাতেই তুমি এই সমস্ত অসম্বদ্ধ কথা বলিতেছ। সোমদত্ত নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া নিরস্ত হইলেন, এবং দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক অধোবদনে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।

এই সময়ে, দেবালয়ের কর্ত্রী, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে সমভিব্যাহারে করিয়া, অধিরাজের সম্মুখবর্ত্তীনী হইলেন, এবং বহুমান পুরঃসর সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, মহারাজ! এই দুই বৈদেশিক ব্যক্তির উপর যথেষ্ট অত্যাচার হইয়াছে, আপনাকে তাহার বিচার করিতে হইবেক। ভাগ্যক্রমে, ইঁহারা দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছিলেন; নতুবা, ইঁহাদের প্রাণহানি পর্য্য়ন্ত ঘটিতে পারিত।

এক কালে দুই চিরঞ্জীব ও দুই কিঙ্কর অবলোকনমাত্র, সমবেত ব্যক্তিবর্গ বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া অবিচলিত নয়নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। চন্দ্রপ্রভা, দুই স্বামী উপস্থিত দেখিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব সোমদত্তকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলেন, এবং তদীয় দুরবস্থা দর্শনে সজল নয়নে জিজ্ঞাসিলেন, পিতঃ! আমি সাত বৎসর মাত্র আপনকার সহিত বিয়োজিত হইয়াছি; এই স্বল্প সময়ের মধ্যে, আপনকার আকৃতির এত বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। সে যাহা হউক, আপনকার শরীরে বধ্যবেশ লক্ষিত হইতেছে কেন। হেমকূটবাসী কিঙ্করও তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া, ভূতলে দণ্ডবৎ পতিত হইয়া প্রণাম করিল এবং অশ্রুপূর্ণ নয়নে জিজ্ঞাসিল, মহাশয়! কে আপনারে বন্ধন করিয়া রাখিয়াছে, বলুন। দেবালয়ের কর্ত্রীও, কিয়ৎ ক্ষণ অনিমিষ নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া, সোমদত্তকে চিনিতে পারিয়াছিলেন; এক্ষণে কিঙ্করেব কথা শুনিয়া, বাষ্পাকুল লোচনে শোকাকুল বচনে কহিলেন যে বন্ধন করুক, আমি উঁহার বন্ধন মোচন করিতেছি। অনন্তর, তিনি সোমদত্তকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন মহাশয়! আপনকার স্মরণ হয়, আপনি লাবণ্যময়ী নাম্নী এক মহিলার পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন; ঐ দুর্ভগার গর্ভে সর্বাংশে একাকৃতি দুই যমজ কুমার জন্মগ্রহণ করে। আমি সেই হতভাগা লাবণ্যময়ী, অদ্যাপি জীবিত রহিয়াছি। এ জন্মে আর যে আপনকার দর্শন পাইব, এক মুহূর্ত্তের জন্যেও, আমার সে আশা ছিল না। যদি পূর্ব্ব বৃত্তান্ত স্মরণ থাকে—

এই বলিতে বলিতে, লাবণ্যময়ীর কণ্ঠরোধ হইল। চক্ষের জলে বক্ষঃস্থল ভালিয়া যাইতে লাগিল।

সহসা চিরঞ্জীবের মুখদর্শন ও তদীয় অমৃতময় সম্ভাষণবাক্য শ্রবণ করিয়া, সোমদত্তের হৃদয়কন্দর অনির্ব্বচনীয় আনন্দসলিলে উচ্ছলিত হইয়াছিল; এক্ষণে আবার লাবণ্যময়ীর উদ্দেশ পাইয়া, যেন তিনি অমৃতসাগরে অবগাহন করিলেন এবং বাষ্পাকুল লোচনে গদগদ বচনে কহিলেন, প্রিয়ে! আমি যেরূপ হতভাগ্য, তাহাতে পুনরায় তোমার ও চিরঞ্জীবের মুখ নিরীক্ষণ করিব, কোনও রূপে সম্ভব নহে। তোমাদিগকে প্রত্যক্ষ করিতেছি বটে, কিন্তু তুমি যে বাস্তবিক লাবণ্যময়ী, আর ও যে বাস্তবিক চিরঞ্জীব, এখনও আমার সে বিশ্বাস হইতেছে না। বলিতে কি, আমি এই সমস্ত স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ করিতেছি। যাহা হউক, যদি তুমি যথার্থই লাবণ্যময়ী হও, আমায় বল; যে পুত্রটির সহিত এক গুণবৃক্ষে বদ্ধ হইয়া সমুদ্রে ভাসিয়াছিলে, সে কোথায় গেল, সে কি অদ্যাপি জীবিত আছে। এই কথা শ্রবণমাত্র লাবণ্যময়ীর নয়নযুগল হইতে প্রবল বেগে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পর্য্য়ন্ত তাহার বাক্যনিঃসরণ হইল না। পরে, কিঞ্চিৎ অংশে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া, তিনি নিরতিশয় করুণ স্বরে কহিলেন, নাথ! তোমার কথা শুনিয়া, আমার চিরপ্রসুপ্ত শোকসাগর উথলিয়া উঠিল। তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। আমরা তীরে উত্তীর্ণ হইলে পর, কর্ণপুরের লোকেরা চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে লইয়া পলায়ন করিল। আমি তোমার ও তনয়দিগের শোকে, একান্ত বিকলচিত্ত হইয়া, অহোরাত্র হাহাকার করিয়া, পথে পথে কঁদিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কিয়ৎ কাল অতীত হইলে, কিঞ্চিৎ অংশে শোক সংবরণ করিয়া, তোমাদের অন্বেষণে নির্গত হইলাম। কত কষ্টে কত দেশ পর্য্য়টন করিলাম, কিন্তু কোনও স্থানে কোনও সন্ধান পাইলাম না। পরিশেষে, তোমাদের পুনর্দর্শন বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্বাস হইয়া, স্থির করিলাম, আমার প্রাণ ধারণের প্রয়োজন নাই। এত ক্লেশে অসার দেহভার বহন করা বিড়ম্বনামাত্র; অতএব, আত্মঘাতিনী হই, তাহা হইলে, এক কালে সকল ক্লেশের অবসান হয়। পরে, আত্মঘাতিনী হওয়া সর্ব্বথা অনুচিত বিবেচনা করিয়া, জীবনের অবশিষ্ট ভাগ তপস্যা ও দেবকার্য্যে নিয়োজিত করাই সৎপরামর্শ বলিয়া অবধারিত করিলাম। অবশেষে, জয়স্থলে আসিয়া, এই দেবালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, তপস্বিনীভাবে কালহরণ করিতেছি। জ্যেষ্ঠ চিরঞ্জীব ও তাহার সহচর কিঙ্কর অদ্যাপি জীবিত আছে কি না, আর যদিই জীবিত থাকে, কোথায় আছে, কিছুই বলিতে পারি না। অনন্তর, লাবণ্যময়ী ও সোমদত্ত উভয়ে নিষ্পন্দ নয়নে পরস্পর মুখ নিরীক্ষণ ও প্রভূত বাষ্পবারি বিসর্জন করিতে লাগিলেন।

দুই চিরঞ্জীব ও দুই কিঙ্কর সমবেত দেখিয়া, অধিরাজ বাহাদুরও, কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, সন্দিহান চিত্তে কত কল্পনা করিতেছিলেন, এক্ষণে লাবণ্যময়ী ও সোমদত্তের আলাপ শ্রবণে, সর্ব্বাংশে ছিন্নসংশয় হইয়া, সহাস্য বদনে কহিলেন, সোমদত্ত! তুমি প্রাতঃকালে যে আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিয়াছিলে, তাহার অনেক অংশে আমার বিলক্ষণ সংশয় ছিল; কিন্তু এক্ষণে, তোমাদের স্ত্রীপুরুষের কথোপকথন শুনিয়া, সকল অংশে সম্পূর্ণরূপে সংশয় নিরাকরণ হইল। লাবণ্যময়ীর উপাখ্যান দ্বারা তোমার বর্ণিত বৃত্তান্তের সম্পূর্ণ সমর্থন হইতেছে। এখন আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, দুই চিরঞ্জীব তোমাদের যমজ সন্তান; দুই কিঙ্কর তোমাদের ক্রীত দাস। আমাদের চিরঞ্জীব, অতি শৈশব অবস্থায়, তোমাদের সহিত বিয়োজিত হইয়াছিলেন, এজন্য তোমায় চিনিতে পারেন নাই। যাহা হউক, মনুষ্যের ভাগ্যের কথা কিছুই বলতে পারা যায় না। তুমি যাহাদের অদর্শনে এত কাল জীবন্মৃত হইয়া ছিলে, এক কালে সেই সকলগুলির সহিত অসম্ভাবিত সমাগম হইল। তুমি এত দিন আপনাকে অতি হতভাগ্য জ্ঞান করিতে; কিন্তু এক্ষণে দৃষ্ট হইতেছে, তোমার তুল্য সৌভাগ্যশালী পুরুষ অতি বিরল। শেষ দশায়, তোমার অদৃষ্টে যে এরূপ সুখ ও এরূপ সৌভাগ্য ঘটিবেক, ইহা স্বপ্নের অগোচর।

সোমদত্তকে এইরূপ কহিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জয়স্থলবাসী জ্ঞান করিয়া, অধিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন চিরঞ্জীব! তুমি প্রথম কর্ণপুর হইতে আসিয়াছিলে। তিনি কহিলেন, না মহারাজ! আমি নই; আমি হেমকূট হইতে আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, অধিরাজ সস্মিত বদনে কহিলেন, হাঁ, বুবিলাম, তুমি আমাদের চিরঞ্জীব নও; তুমি এই দিকে স্বতন্ত্র দাঁড়াও; তোমাদের কে কোন ব্যক্তি, চিনা ভার। তখন জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আমি কর্ণপুর হইতে আসিয়াছিলাম; আপনকার পিতৃব্য বিখ্যাত বীর বিজয়বর্ম্মা আমায় সঙ্গে আনিয়াছিলেন। জয়স্থলবালী কিঙ্কর কহিল, আমি উঁহার সঙ্গে আসি। বিজয়বল্লভ কহিলেন, তোমরা দুজনে এক সঙ্গে এক দিকে দাঁড়াও।

এই সময়ে, চন্দ্রপ্রভা চিরঞ্জীবদিগকে জিজ্ঞাসিলেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে কে আজ মধ্যাহ্নকালে আমার সঙ্গে আহার করিয়াছিলে। হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তুমি কি আমার স্বামী নও। তিনি কহিলেন, না, আমি তোমার স্বামী নই; কিন্তু তুমি, স্বামী জ্ঞান করিয়া, আমায় বল পূর্ব্বক বাটীতে লইয়া গিয়াছিলে, এবং সেই সংস্কারে আমায় অনেক অনুযোগ করিয়াছিলে। তোমার ভগিনীও আমায় ভগিনীপতি জ্ঞানে পূর্ব্বাপর সম্ভাষণ করিয়াছিলেন। আমি কিন্তু আদ্যোপান্ত বলিয়াছিলাম, জয়স্থলে আমার বাস নয়, আমি তোমার পতি নই, আমি এ পর্য্য়ন্ত বিবাহ করি নাই। তোমরা তৎকালে আমার সে সকল কথায় বিশ্বাস কর নাই। আমিই তোমার পতি, তোমার উপর বিরক্ত হইয়া ঐরূপ কহিতেছি, তোমরা দুই ভগিনীতেই পূর্ব্বাপর সেই জ্ঞান করিয়াছিলে। এই বলিয়া, তিনি বিলাসিনীকে সম্ভাষণ করিয়া সম্মিত বদনে কহিলেন, আমি তৎকালে পরিণয় প্রস্তাব করাতে, তুমি বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলে, এবং আমায় যথোচিত ভর্ৎসনা ও বহুবিধ আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলে; এখন, বোধ হয়, তোমার আর সে সকল আপত্তি হইতে পারে না। বিলাসিনী শুনিয়া, লজ্জায় নম্নমুখী হইয়া রহিলেন। কিন্তু, তদীয় আকার প্রকার দর্শনে সন্নিহিত ব্যক্তি মাত্রেই বুঝিতে পারিলেন, চিরঞ্জীবের প্রস্তাবে তাঁহার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। এই পরিণয়প্রসঙ্গ শ্রবণে নিরতিশয় পরিতোষ প্রদর্শন করিয়া, অধিরাজ বিজয়বল্লভ প্রীতিপ্রফুল্ল লোচনে কহিলেন, শুভ কার্য্য়ে বিলম্বে প্রয়োজন নাই; চিরঞ্জীব! বিলাসিনী কল্য তোমার সহধর্মিণী হইবেন।

অনন্তর, বসুপ্রিয় স্বর্ণকার হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জিজ্ঞাসিলেন, আমি আপনাকে যে হার দিয়াছিলাম, আপনার গলায় এ সেই হার কি না। তিনি কহিলেন, এ সেই হার বটে; আমি এক বারও তাহা অস্বীকার করি নাই। তখন জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব স্বর্ণকারকে কহিলেন, তুমি কিন্তু এই হারের জন্যে আমায় অবরুদ্ধ করাইয়াছিলে। বসুপ্রিয় লজ্জিত হইয়া কহিলেন, হাঁ মহাশয়! আমি আপনারে রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলাম। কিন্তু, পূর্ব্বাপর বিবেচনা করিয়া দেখিলে, আপনি আমায় অপরাধী করিতে পারেন না। চন্দ্রপ্রভা স্বীয় পতিকে জিজ্ঞাসিলেন, তোমার অবরোধের সংবাদ পাইয়া, কিঙ্কর দ্বারা যে স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইয়াছিলাম, তুমি কি তাহা পাও নাই। জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, কই আপনি আমা দ্বারা স্বর্ণমুদ্রা পাঠান নাই। তখন হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়া, পান্থনিবাসে বসিয়া, উৎসুক চিত্তে তাহার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিতেছি, এমন সময়ে সে আসিয়া, তোমার প্রেরিত বলিয়া, আমার হস্তে এই স্বর্ণমুদ্রার থলী দেয়; আমি, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, আপন নিকটে রাখিয়াছিলাম।

এইরূপে সংশয়াপনোদন কাণ্ড সমাপিত হইলে, জয়স্থলবালী চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আমি যেরূপ শুনিয়াছি, তাহাতে সায়ংকালের মধ্যে দণ্ডের টাকা দিলেও, আমার পিতা প্রাণদণ্ড হইতে নিষ্কৃতি পাইবেন, আপনি দয়া করিয়া এই আদেশ প্রদান করিয়াছেন, অনুমতি হইলে, ঐ টাকা আনাইয়া দি। বিজয়বল্লভ কহিলেন, চিরঞ্জীব! তোমাদের এই অসম্ভাবিত সমাগম দর্শনে আমি যে অনির্ব্বচনীয় প্রীতি লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমার সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য প্রাপ্তি অপেক্ষাও অধিকতর লাভ বোধ হইয়াছে; অতএব, তোমার পিতা দণ্ড প্রদান ব্যতিরেকেই প্রাণদান পাইলেন। এই বলিয়া তিনি, সন্নিহিত রাজপুরুষদিগকে সোমদত্তের বন্ধনমোচন ও বধ্যবেশের অপসারণ করিতে আদেশ দিলেন।

এই রূপে সকল বিষয়ের সমাধান হইলে, লাবণ্যময়ী, গলবস্ত্র ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিজয়বল্লভকে সম্ভাষণ করিয়া, কহিলেন, মহারাজ! আমার কিছু প্রার্থনীয় আছে; কৃপা করিয়া শ্রবণ করিতে হইবেক। বিজয়বল্লভ কহিলেন, লাবণ্যময়ি! যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে বল, সঙ্কুচিত হইবার অণুমাত্র আবশ্যকতা নাই; আজ তোমার কোনও কথাই অরক্ষিত হইবার বা কোনও প্রার্থনাই অপরিপূরিত থাকিবার আশঙ্কা নাই। শুনিয়া, সাতিশয় হর্ষিত ও উৎসাহিত হইয়া লাবণ্যময়ী কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! আমি এত কাল মনে করিতাম, আমার মত হতভাগা নারী আর নাই; কিন্তু আজ দেখিতেছি, আমার মত ভাগ্যবতী অতি অল্প আছে। চিরবিয়োগের পর, এই অতর্কিত পতি পুত্র সমাগম দ্বারা আমি যে আজ কি হইয়াছি, বলিতে পারি না; আমার কলেববে আনন্দপ্রবাহের সমাবেশ হইতেছে না। মহারাজ! আজ আমার কি উৎসবের দিন, তাহা আপনি অনায়াসে অনুভব করিতে পারিতেছেন। বলিতে কি, মহারাজ! এখনও আমার এই সমস্ত ঘটনা স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ হইতেছে। যাহা হউক, এক্ষণে, আমার প্রথম প্রার্থনা এই, অনুগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক আমায় পতি, পুত্র ও পুত্রবধূ লইয়া দেবালয়ে এই উৎসবরজনী অতিবাহনের অনুমতি প্রদান করেন; দ্বিতীয় প্রার্থনা এই, যে সকল ব্যক্তি আজ এই অদ্ভুত ঘটনার সংস্রবে ছিলেন, তাঁহারা সকলে, দেবালয়ে উপস্থিত থাকিয়া, কিয়ৎ কাল আমোদ আহ্লাদ করেন; তৃতীয় প্রার্থনা এই, মহারাজ নিজে উৎসবসময়ে দেবালয়ে অধিষ্ঠান করেন; চতুর্থ প্রার্থনা এই, আমার তৃতীয় প্রার্থনা যেন ব্যর্থ না হয়।

লাবণ্যময়ীর প্রার্থনা শ্রবণে, বিজয়বল্লভ সহাস্য বদনে কহিলেন, আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে আজ আমি যেরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছি, জন্মাবচ্ছেদে কখনও তাদৃশ আনন্দ অনুভব করি নাই, এবং উত্তর কালেও যে কখনও আর তদ্রূপ আনন্দ লাভ ঘটিবেক, তাহা সম্ভাবিত বোধ হইতেছে না। অধিক আর কি বলিব, তোমরা আজ বেরূপ আনন্দ অনুভব করিতেছ, আমিও নিঃসন্দেহ সেই রূপ, বরং তদপেক্ষা অধিক, আনন্দ অনুভব করিতেছি। চিরঞ্জীব! আমি যে তোমায় পুত্র নির্বিশেষে লালন পালন করিয়াছিলাম, আজ তা সর্ব্বতোভাবে সার্থক হইল। বোধ হয়, আমি পিতৃব্যের নিকট হইতে আগ্রহ পূর্ব্বক তোমায় গ্রহণ না করিলে, আজকার এই অভূতপূর্ব্ব সংঘটন দেখিতে, ও তন্নিবন্ধন এই অননুভূতপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করিতে পাইতাম না। যাহা হউক, লাবণ্যময়ি! আমি স্থির করিয়াছিলাম, তোমাদের সকলকে আমার আলয়ে লইয়া গিয়া, এবং রাজধানীর সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোককে সমবেত করিয়া, আমোদ আহ্লাদে এই উৎসব-রজনী অতিবাহিত করিব। কিন্তু তোমার ইচ্ছা শ্রবণ করিয়া আমার সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করিলাম। আজ তোমার যে সুখের দিন, তাহাতে কোনও অংশে তোমার মনে অসুখের সঞ্চার হইতে দেওয়া উচিত নহে। ইচ্ছা বিঘাত হইলে, পাছে তোমার অন্তঃকরণে অণুমাত্রও অসুখ জন্মে, এই আশঙ্কায় আমি তোমার প্রার্থনায় সম্মত হইলাম। আজ সকল বিষয়ে তোমার ইচ্ছাই বলবতী থাকিবে।

এই বলিয়া, রাজপুরুষদিগের প্রতি রাজধানীস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিমন্ত্রণ ও উপস্থিত মহোৎসবের উপযোগী আয়োজনের আদেশ দিয়া, অধিরাজ বিজয়বল্লভ সোমদত্তপরিবার সহিত দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন।

 

সম্পূর্ণ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *