ভয়ংকর ভুতুড়ে পর্ব – ২ হুমায়ূন আহমেদ

ভয়ংকর ভুতুড়ে পর্ব – ২

সত্যি কথাই বলছি স্যার। যেমন ধরুন বোকা ভূতদের নাম হচ্ছে–বোকা ১, বোকা ২, বোকা ৩, বোকা ৪… যে যত বোকা তার নাম্বার তত বেশি। নাম্বার দেখেই বলে দিতে পারবেন। সে কত বড় বোকা। মানুষের বেলায় এরকম কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তার নাম থেকে বোঝা যায় না। সে বোকা না বুদ্ধিমান।আখলাক সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। ভূতটা গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের ব্যবস্থা স্যার খুবই বৈজ্ঞানিক।তোমাদের নিয়মে তোমার নাম কী? লেখক ৭8।তুমি লেখক নাকি? একটু স্যার বদঅভ্যাস আছে।বদঅভ্যাস বলছি কেন?

লেখক হওয়া তো সহজ ব্যাপার না। লেখক ৭8, তার মানে কি তুমি অনেক বড় লেখক? দুএকটা ছোটখাট পুরস্কার স্যার পেয়েছি। গত বছর পেলাম তৃত শ্রেষ্ঠ পদক। লৌহ পদক। লৌহ পদক স্যার একটা বিরল ঘটনা।লৌহ পদক পেয়ে গেছ, বলো কী? আর স্যার আমার একটা রচনা ভুতস্কুলে পাঠ্য হয়েছে। এটাও একটা বিরল সম্মান।বিরল সম্মান তো বটেই। তুমি কি দাঁড়িয়ে আছ নাকি? বোস, চেয়ারটা টেনে বোস। এতক্ষণ তুমি তুমি করে বলায় আমার তো নিজেরই খারাপ লাগছে।আপনি স্যার লজ্জা দেবেন না।তুমি বোস, চেয়ারে বোস।চেয়ার টানার শব্দ হলো। কেউ একজন চেয়ারে বসল। ঘর অন্ধকার বলে তিনি কিছু দেখতে পেলেন না। আখলাক সাহেব যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভূতত্ত্বলে তোমার যে রচনাটা পাঠ্য সেটা কী?

একটা প্ৰবন্ধ।নাম কী প্ৰবন্ধটার? মানুষদের নিয়ে লেখা প্ৰবন্ধ, নাম হলো ইহা মানুষ।ইন্টারেস্টিং প্ৰবন্ধ বলে মনে হচ্ছে।স্যার, গবেষণামূলক প্রবন্ধ। শিশুভূতদের জন্যে একটু কঠিন হয়ে গেছে।তুমি কি প্ৰবন্ধই লেখ না গল্প-উপন্যাসও লেখ? গল্প লিখি। সম্প্রতি আমার একটা বই বের হয়েছে, মানুষের গল্প।তুমি ভূত আর তোমার সব লেখালেখি দেখি মানুষদের নিয়ে।মানুষরা যেমন ভূতের গল্প লেখে আমিও তেমন মানুষের গল্প লিখি।দেখি একটা গল্প পড়ে শুনাও তো।তাহলে স্যার বইটা নিয়ে আসি।নিয়ে আসা দেখি।ভূত বই আনতে গেল। আখলাক সাহেব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই রাতে তাঁর আর গল্প শোনা হলো না।

কলেজে আখলাক সাহেবকে সবাই চেনে গম্ভীর ধরনের মানুষ হিসেবে। যারা অঙ্ক শেখায় তাবা খানিকটা গন্তীব প্রকৃতির এমিতেই হয়ে থাকে। আখলাক সাহেব তাদের চেয়েও একটু গম্ভীব। যেদিন একটা ক্লাস থাকে তিনি ক্লাস নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। যেদিন দুটা কিংবা তিনটা ক্লাস থাকে সেদিন ক্লাসের মাঝখানের সময়ে শিক্ষকদের কমন রুমে বসে খবরের কাগজ পড়েন। শিক্ষকদের গল্প গুজব হৈচৈ-এ কখনো অংশ নেন না। তাঁর ভালো লাগে না।

আজ একটু ব্যতিক্রম দেখালেন। কমনরুমে আখলাক সাহেব যথাবীতি খবরেব কাগজ পড়ছিলেন, তার পাশে বসেছেন বাংলাব শিক্ষক শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি গল্প করছিলেন ঠিক তাঁর মুখোমুখি বসা লজিকের শিক্ষক দবিরুদিনের সঙ্গে। তাঁরা দুজনই খুব বন্ধু মানুষ। তবে রোজই কোনো একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল তর্ক বেঁধে যায়। একেকটা তর্ক শেষ পর্যন্ত রাগারগি হাতাহাতির পর্যায়েও যায়। প্রিন্সিপাল সাহেব তাদের দুজনকে কাছাকাছি বসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তারপরেও তাঁরা সামনাসামনি বসেন, সহজভাবে গল্প শুরু করেন, আরম্ভ হয় তর্ক, তর্ক থেকে গালাগালি।

তাঁদের আজকের গল্পের বিষয় হলো, নাম রাখা। শামসুদিন সাহেবের স্বভাব হলো যে-কোনো গল্পই করা হোক না কেন তাকে টেনে টুনে রবীন্দ্রনাথে নিয়ে যাওয়া। দবিরুদিনের দিন দশেক আগে একটি মেয়ে হয়েছে, তার নাম এখনো ঠিক কবা হয় নি। এই প্রসঙ্গে শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, নাম রেখে দিন মীনাক্ষী। রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দের নাম।দবিরুদ্দিন বললেন, মীনাক্ষীর অর্থটা কী?মীনের মতো অক্ষি, অর্থাৎ মাছের মতো চোখ।আমার মেয়ের চোখ তো মাছের মতো না। দিব্যি মানুষের মতো চোখ। তার নাম মীনাক্ষী রাখব কেন? মানুষাক্ষী বরং রাখার একটা যুক্তি আছে।রবীন্দ্রনাথের খুবই পছন্দের নাম। তিনি বুদ্ধদেব বসুর মেয়ের নাম রেখেছিলেন মীনাক্ষী।শামসুদ্দিন সাহেব চোখ লাল করে বললেন, বোয়াল মাছের মতো চোখ–এটা বলার অর্থ কী?

বোয়াল মাছের মতো না হলে অন্য কোনো মাছের মতো, রুই মাছের মতো কিংবা পুটি মাছের মতো। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ নিশ্চয়ই কোনো একটা মাছের চোখের সাথে নাম মিলিয়ে নাম রাখেন নি। হেলাফেলা করে নাম রাখার মানুষ তিনি না।তর্ক প্ৰায় বেঁধে যাচ্ছে এই পর্যায়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আখলাক সাহেব হঠাৎ বললেন, মানুষের নাম রাখার পদ্ধতির মধ্যে সমস্যা আছে। পদ্ধতিটা ত্রুটিপূর্ণ।শামসুদিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ত্রুটিপূর্ণ মানে? মানুষের নাম এমনটা রাখা যেতে পারে যা থেকে তার চরিত্র সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যাই।কী রকম?

যেমন ধরুন যারা বোকা, তাদের সবার নাম শুরু হবে বোকা দিয়ে; তবে নামের শেষে একটা সংখ্যা থাকবে, সে সংখ্যা থেকে সে কতটা বোকা সেই সম্পর্কে একটা তুলনামূলক ধারণা পাওয়া যাবে। যত বোকা, সংখ্যার মান তত বেশি।দবিরুদিন বললেন, যে একই সঙ্গে বোকা এবং জ্ঞানী, তার বেলা কী হবে? অনেক জ্ঞানী বোকাও তো সমাজে আছে। ওদের সংখ্যাই বরং বেশি।একটা পদ্ধতি তাদের বেলাতেও বের করতে হবে। যেমন ধরুন বোকা ৭০, জ্ঞানী ৪০, অর্থাৎ সে যতটা না জ্ঞানী তারচে বেশি বোকা।শামসুদ্দিন সাহেব হা হয়ে গেলেন। এরকম অদ্ভুত কথা তিনি এর আগে শোনেন নি। দবিরুদিন বললেন, এতে নাম অনেক বড় হয়ে যাবে না?

সংক্ষেপ করার পদ্ধতি বের করা যাবে। যেমন ধরুন বোকা ৭০, জ্ঞানী 8০ এটাকে সংক্ষেপে বলা যাবে বোজ্ঞা ৭০-৪০, বোকার বো, আর জ্ঞানীর জ্ঞা নিয়ে বোজ্ঞা, ৭০ এবং ৪০ এর মাঝখানে থাকছে একটা হাইফেন। বুঝতে পারছেন? পারছি।শামসুদিন এবং দবিরুদিন দুজনই পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলেন। দবিরুদ্দিন বললেন, আখলাক ভাই আপনি কি সম্প্রতি এই নিয়ে গবেষণা করছেন? আখলাক সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেছে, তিনি ক্লাসে চলে গেলেন। ক্লাস শেষ করে কমনরুমে ফিরলেন না, বাসার দিকে চলে গেলেন। কমনরুমে ফিরে এলে জানতেন যে এই এক ঘণ্টায় তাঁর নতুন নামকরণ করা হয়েছে–মিঃ বোজ্ঞা ৭০-৪০।

আখলাক সাহেব আজ আবার ছোট বোনের বাসায় গেলেন। মিলি তাকে দেখে প্ৰায় চেঁচিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে দাদা?আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, হবে। আবার কী! কিছু হয় নি তো।তৃণা বলছিল, একটা ভূত নাকি তোমার কাছে আসে। জার্মান ভাষায় তোমার সঙ্গে গল্প করে।আরে না। ব্যাপারটা স্বপ্ন।এইসব আজেবাজে স্বপ্নই বা তুমি দেখবে কেন? স্বপ্নের উপর কি কারো হাত আছে? আমি যে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করব সেই স্বপ্ন দেখব–তা তো কখনো হয় না।দাদা আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে। তুমি একা একা থাক, এই জন্যে এসব হচ্ছে। তুমি তোমার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমার এখানে এসে থাক। আমি তোমার ঘর আলাদা করে দেব। তৃণাকে বলে দেব যেন কখনো তোমাকে বিরক্ত না করে।

আহা যন্ত্রণা করিস না তো। সামান্য স্বপ্ন নিয়ে …

তোমার মুখও তো কেমন শুকনা শুকনা লাগছে।

আখলাক সাহেব খুবই বিরক্ত হলেন। কঠিন গলায় বললেন, মুখের আবার শুকনা ভেজা কী? মুখ কি তোয়ালে যে শুকনা থাকবে। আবার ভেজা থাকবে।মিলি বলল, দাদা শোন, বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তুমি আবেকটু ভাব। তোমার পায়ে পড়ি দাদা। প্লিজ। তোমার জন্যে যে মহিলার কথা আমি ভেবে রেখেছি তিনি অসাধারণ একজন মহিলা। খুব অল্প বয়সে তার স্বামী মাবা গিয়েছিল, তিনি আর বিয়ে করেন নি। তুমি যেমন নিঃসঙ্গ তিনিও নিঃসঙ্গ। তাছাড়া বাহান্ন কোনো বয়সই না। পিকাসো ৮২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন।

আমি কি পিকাসো? আমাকে কখনো ছবি আঁকতে দেখেছিস? এই নিয়ে আর একটা কথা না।আখলাক সাহেবের একটিই বোন। বোনের ভালোবাসা তার কাছে অত্যাচারের মতো লাগে। এ কারণেই তিনি মিলিদেব বাড়িতে কম আসেন। এটা তাকে বলাও যায় না। বললে মনে কষ্ট পানে দাদা, রাতে কী খাবে? রাতে কিছু খাব না।এটা তুমি কী বললে দাদা, তোমাকে আমি না খাইয়ে রাতে ছেড়ে দেব? ঐ দিন এলে, আমি ছিলাম না। বিয়ে বাড়িতে গিযেছিলাম। এত সুন্দর একটা মেয়ে বান্দরের মতো একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। কথাও বলে বান্দরের মতো কিচকিচ করে। আবার প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে একটা চন্দ্ৰবিন্দু লাগায়। মনে হয় নাকে প্রবলেম আছে। আমাকে দেখে বলল, আঁফা ভাঁলো আছেন?… .তুই আমাকে চিনিস না জানিস না, আমার সঙ্গে তোর এত কীসের কথা?

আখলাক সাহেব বড়ই বিরক্ত হচ্ছেন। মিলি একবার কথা শুরু করলে থামে না। ছেলেমেয়েরা মাকে দেখে শেখে, তৃণা মার স্বভাব পাচ্ছে এটা অত্যন্ত আশঙ্কার কথা। তবে মিলির স্বামী আবু তাহের কথা একেবারেই বলে না। তার বাক্যালাপ হ্যাঁ হঁর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটা আশার কথা। সবাই কথা বললে এ বাড়িতে আসাই সমস্যা হতো। আবু তাহের ডাক্তার। এম আর সি পি। হাসপাতালের বাইরে তার পশার এমন যে সে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে না। বাড়িতে সে বিশ্রাম করতে আসে বলেই বোধহয় কথাবার্তা বলে অকারণ পরিশ্রম করে না। সারাক্ষণ ঝিম ধরে থাকে।

রাতে আখলাক সাহেবকে খেয়ে যেতে হলো। মিলি শখ করে রোধেছে। সাধারণ খাওয়া না। পোলাও কোর্মা। পোলাও হয়েছে শক্ত চাল চাল। কোর্মা লবণের জন্যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না। এত আগ্রহ করে রোধেছে, কিছু বলা যাচ্ছে না। শুধু আবু তাহের মুখ শুকনো করে বলল, আবার তুমি রোধেছা? রান্নার জন্যে বাবুর্চি তো আছে। নিজে রাঁধতে গেলে কেন? মিলি বিরক্ত মুখে বলল, দাদা এসেছে আমি রাধব না তো কি পাড়ার লোকে এসে রোধে দিয়ে যাবে? বাবুর্চির রান্না আমি দাদাকে খাওয়াব? তোমার খেতে ইচ্ছে না হলে খেয়ো না। আমি তো তোমার পায়ে ধরে সাধি নি যে খেতেই হবে। খেতে কি খারাপ হয়েছে?

তাহের বলল, খেতে ভালোই হয়েছে। তবে পোলাও মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চাবাতে হয়। এতক্ষণ চাবানোর ধৈর্য থাকে না।মিলি স্বামীর দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ভাইয়ের পাতে পোলাও তুলে দিতে দিতে বলল, দাদা যে ভূতটা তোমার কাছে আসে তার নাম কী? আখলাক মনের ভুলে বলে ফেললেন, ওর নাম লেখক ৭8।ভূতের প্রসঙ্গটা তিনি আনতে চাচ্ছিলেন না। তারপরেও এসে গেল।মিলি কিছু বলার আগেই আবু তাহের বলল, ভূতের কী নাম বললেন? লেখক ৭8।এটা কী ধরনের নাম? ভূত সমাজের নাম রাখার এই ধারা। আমরা এই ধারার সঙ্গে পরিচিত নই বলে আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। ওদের কাছেও ঠিক এমনিভাবে আমাদের নামগুলিও খুব হাস্যকর লাগে।

মিলি বলল, হাস্যকর নাম তো আমাদের আছেই। আমার এক বান্ধবী তার ছেলের নাম রেখেছে–গুলকি। আমি বললাম কীরে এত নাম থাকতে গুলকি নাম রাখলি কেন? সে কিছু বলে না, শুধু হাসে।তাহের একবার বিরক্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। যে দৃষ্টির অর্থ হলো–চুপ কর তো, সব কিছুতে কথা বলবে না। মিলি সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, আমাদের পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটার নাম কী জানো দাদা? তার নাম তক্তি বেগম।তাহের বলল, একটু চুপ করবে? ভাইজানের সঙ্গে একটা জরুরি কথা বলছি। মিলি বলল, আমিও জরুরি কথাই বলছি। আমার কথাগুলি কম জরুরি না।তোমার জরুরি কথাগুলি একটু পরে বলো, আমারটা শেষ করে নিই। তুমিতে একবার কথা শুরু করলে শেষ করতে পার না। নদীর স্রোতের মতো চলতেই থাকে।

তাহের আখলাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান আপনার এই ভূতের ব্যাপারটা ঠিক কী বলুন তো। আমি ভাসাভাসা ভাবে শুনলাম। সত্যি কি কিছু দেখেছেন? বুঝতে পারছি না, মনে হয় স্বপ্ন।রোজই দেখছেন? পরপর দুরাত দেখলাম। মনে হয় আজও আবার দেখব।আজ রাতে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুবেন। যাবার সময় আমার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে যাবেন। বিছানায় যাবার আধা ঘণ্টা আগে খাবেন। ওষুধ খাবার পর ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাবেন। রোজ রোজ ভূত দেখা কোনো কাজের কথা না। শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক সমস্যা হয়ে যাবে। শুরুতেই সাবধান হওয়া ভালো।

মিলি বলল, তুমিও তো দেখছি কথা শেষ করতে পারছি না। বকবক করেই যাচ্ছি।আর করব না। এখন তুমি শুরু করতে পোর।মিলি বলল, দাদা তুমি আমাকে ভূতের ব্যাপারটা ভালোমতো বলো তো।আখলাক সাহেব বললেন, ভালোমতো বলার কিছু নেই। দুঃস্বপ্ন। আর কিছু না।দাদা তুমি পেট ঠাণ্ডা রাখবে। পেট গরম হলেই লোকজন দুঃস্বপ্ন দেখে। একবার কী হয়েছে শোন, আমি মুনার জন্মদিনের পাটিতে গিয়ে এক গাদা ভাজ্যভুজি খেয়েছি। বাসায় এসে আবার খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম।

পেট হয়ে গেল গরম। রাতে স্বপ্নে দেখি কী লক্ষ লক্ষ পিঁপড়া খুবলে খুবলে আমার গায়ের মাংস খেয়ে ফেলছে। কী যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। এখনো মনে হলে গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে যায়। তুমি দাদা এখন থেকে সহজপাচ্য খাবার খাবে। মশলা একেবারে দেবেই না। পোপে পেটের জন্যে ভালো, চেষ্টা করবে: বোজই পেঁপে খেতে। পেঁপে সিদ্ধ করে বেটে একটু কাঁচা মরিচ, পেয়াজ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে। সঙ্গে সরষে বেটে দিতে বলবে। নতুন সরষে, পুরনোটা দিলে তিতা লাগবে।

আবু তাহের ছটা ঘুমের ট্যাবলেট দিলেন। প্রতি রাতে শোয়ার আগে দুটা করে খেতে হবে। আখলাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভূতপ্ৰেত এইসব নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না ভাইজান। ভূত-প্রেতের সময় আমরা পার কবে এসেছি।আখলাক সাহেবকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। ভূত-প্রেতের সময় যে আমরা পার কবে এসেছি তা তার থেকে বেশি কেউ জানে না। অথচ তার কপাল এমন যে উপদেশগুলি তাঁকে শুনতে হচ্ছে।যে ভূতটার কথা বলছেন সেটা দেখতে কেমন?

দেখি নি তো কখনো। ঘর অন্ধকার থাকে, কাজেই দেখা হয় নি।ও আচ্ছা।আখলাক সাহেব বিষন্ন মুখে বললেন, ভূতটাকে যে এখনো দেখি নি সেটাই আমার কাছে একটা খটকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।কী রকম? স্বপ্ন হলে ভূতটাকে দেখতে কোনো অসুবিধা ছিল না। ভূত-টুত এইসব স্বপ্লেই বেশি দেখা যায়। অথচ এখনো দেখলাম না।স্বপ্ন অনেক রকম হয় ভাইজান। স্বপ্নে শুধু শব্দও শোনা যায়।তাও ঠিক।এটা হচ্ছে বিংশ শতাব্দী। আমরা এই শতাব্দীর প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদে মানুষ নেমে গেছে। মঙ্গল গ্রহে খুব শিগগিরই নামবে। আমাদের স্পেস প্ৰোব পাইওনিয়ার সৌর মণ্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে। আমরা ভাইরাস প্ৰায় জয় করতে যাচ্ছি, এই সময় আপনার মতো শিক্ষিত একজন মানুষ …

আখলাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলেন–তাহের যে মিলির চেয়ে কম কথা বলে তা তো না, বরং বেশিই বলে। মিলির কারণে কথা বলার সুযোগ পায় না বলে বোধহয় বলতে পারে না। খুবই খারাপ লক্ষণ। যে সব ডাক্তার বকবক করে তাদের পশার হয় না।বুঝলেন ভাইজান, ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বেন, লম্বা ঘুম দেবেন। ভূতের কথা মনে স্থান দেবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন–ভূতের বাস হচ্ছে মানুষের মনে। ভুল বললাম, আসলে মন বলেও কিছু নেই। যদিও আমরা কথায় কথায় মন বলি। আসল জিনিস হচ্ছে মস্তিষ্ক, দি ব্রেইন। ভূতের বাস হচ্ছে আমাদের ব্ৰেইনে, মস্তিষ্কে। আমাদের একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে 

আচ্ছা খেয়াল রাখব।প্রয়োজনে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আপনাকে নিয়ে যাব। আমার বন্ধু মানুষ।আচ্ছা ঠিক আছে।ভাইজান, কী বললাম মনে থাকবে তো? হুঁ। মনে থাকবে।রাতে তিনি ঘুমের ওষুধ খেলেন। ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি খেলেন। ওষুধ খাওয়ার আধা ঘণ্টা পর ঘুমুতে যাবার কথা, তার আগেই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। খুব কড়া ওষুধ, বোঝাই যাচ্ছে। দুটা না খেয়ে একটা খেলেই হতো। তিনি বিছানায় গেলেন প্রায় চোখ বন্ধ করে। বালিশে মাখা রাখতে না রাখতেই তাঁর ঘুম কেটে গেল। চোখে এখন আর একফোঁটা ঘুম নেই। অবশ্য তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হতে লাগল যে তিনি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে স্বপ্নে দেখছেন যে জেগে আছেন।স্যার কেমন আছেন?

আখলাক সাহেব পোশ ফিরলেন। কিছু দেখা যায় কিনা। না কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিক ফাঁকা।ঐ দিনের জন্যে স্যার খুবই লজ্জিত।ঐ দিন কী হয়েছিল? আপনি আমার লেখা পড়তে চাইলেন, আমার নিয়ে আসতে দেরি হলো। এসে দেখি আপনি আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। আর আপনাকে জোগালাম না। আপনার আবার সকালে ক্লাস থাকে। লেখা স্যার আজ নিয়ে এসেছি।কোনটা এনেছ? অনেকগুলি এনেছি।তোমরা কি বাংলা ভাষাতেই লেখা? আমরা স্যার বাঙালি ভূত। আমরা বাংলা ছাড়া কীসে লিখব? ভূত-ভাষা বলে কিছু নেই তাহলে? জি না।কথা বলার সময় তোমরা শুধু চন্দ্ৰবিন্দু বেশি ব্যবহার কর, তাই না?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *