ভয় (পর্ব-১০)-হুমায়ূন আহমেদ

উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, মাদ্রাসা পাস করা লােক তােমারে আমি কি চাকরি দিবআই , বি পাস থাকলে একটা কথা ছিলােচেষ্টা চরিত্র করে দেখতামচেষ্টা করারওতাে কিছু নাই। 

ভয়আমি চুপ করে রইলামমনটা খুব খারাপ হয়ে গেলবড় আশা ছিল কিছু হবেএকটা পয়সা সংগে নাইউপােস দিচ্ছিরাতে নেত্রকোনা ষ্টেশনে ঘুমাই। 

মমতাজ সাহেব বললেন, তােমাকে চাকরি দেয়া সম্ভব নানেও এই বিশটা টাকা রাখােঅন্য কারাে কাছে যাওমসজিদে খোজ টোজ নাওইমামতি পাও কিনা দেখাে| আমি টাকাটা নিলামতারপর বললাম, ভিক্ষা নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নাযদি ঘরের কোনাে কাজকর্ম থাকে বলেন করে দেই। 

তিনি অবাক হয়ে বললেন, কি কাজ করতে চাও? যা বলবেন করবােবাগানের ঘাসগুলাে তুলে দেই? আচ্ছা দাও। 

আমি বাগান পরিষ্কার করে দিলামগাছগুলােকে পানি দিলামদুএক জায়গায় মাটি কুপিয়ে দিলামসন্ধ্যাবেলা কাজ লাম, জনাব যাইআপনার 

অনেক মেহেরবানীআল্লাহ পাকের দরবারে আমি আপনার জন্য দোয়া করি। 

মমতাজ সাহেব বললেন, এখন যাবে কোথায়? ইষ্টিশনেরাত্রে নেত্রকোনা ইষ্টিশনে আমি ঘুমাইএক কাজ করাে। রাতটা এইখানেই থাকোতারপর দেখি। 

আমি থেকে গেলামএকদিন দুইদিন তিনদিন চলে গেলােউনি কিছু বলেন নাআমিও কিছু বলি বাংলা ঘরের এক কোণায় থাকিবাগান দেখাশােনা করিচাকরির সন্ধান করিছােট শহর, আমার কোন চিনা পরিচয়ও নাইকে দিবে চাকরি ? ঘুরাঘুরি সার হয়মােক্তার সাহেবের সংগে মাঝেমধ্যে দেখা হয়আমি বড়ই শরমিন্দা বােধ করিউনিও এমন ভাব করেন যেন আমাকে চেনেন নামাসখানেক এইভাবে চলে গেলােআমি মােটামুটি তাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলামমােক্তার সাহেবের স্ত্রীকে 

মা ডাকিভেতরের বাড়িতে খেতে যাইতাদের কোনাে একটা উপকার করার সুযােগ পেলে প্রাণপণে করার চেষ্টা করিবাজার করে দেইকল থেকে পানি তুলে দেই। 

মােক্তার সাহেবের তিন মেয়েবড় মেয়ে বিধবা হয়ে বাবার সংগে আছেতার দুই বাচ্চাকে আমি আমপারা পড়াইবাজারসদাই করে দেইটিপ কল থেকে রােজ ছয় সাত বালতি পানি তুলে দেইমােক্তার সাহেবের কাছে যখন মক্কেলরা আসে তিনি ঘন ঘন তামাক খানসেই তামাকও আমি সেজে দেইচাকর বাকরের কাজআমি আনন্দের সংগেই করিমাঝে মাঝে মনটা খুবই খারাপ হয়দরজা বন্ধ করে একমনে কোরান শরীফ পড়িআল্লাহপাকরে ডেকে বলিহে আল্লাহ আমার একটা উপায় করে দেওকতােদিন আর মানুষের বাড়িতে অন্নদাস হয়ে থাকবাে

আল্লাহপাক মুখ তুলে তাকালেনসিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে এক ব্যবসায়ী বলতে গেলে সেধে আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেনচালের আড়তে হিসাবপত্র রাখামাসিক বেতন পঁচশ টাকা। 

মােক্তার সাহেবকে সালাম করে খবরটা দিলামউনি খুবই খুশি হলেনবললেন, তােমাকে অনেকদিন ধরে দেখতেছিতুমি সৎ স্বভাবের মানুষঠিকমতাে কাজ করাে তােমার আয়উন্নতি হবেআর রাতে তুমি আমার বাড়িতেই থাকোতােমার কোনাে অসুবিধা নাইখাওয়াদাওয়াও এইখানেই করবেতােমাকে আমি ঘরের ছেলের মতই দেখি। 

আনন্দে মনটা ভরে গেলচোখে পানি এসে গেলােআমি মােক্তার সাহেবের কথামত তার বাড়িতেই থাকতে লাগলামইচ্ছা করলে চালের আড়তে থাকতে পারতামমন টানলাে নাতাছাড়া মােক্তার সাহেবের বাগানটা নিজের হাতে তৈরি করেছিদিনের মধ্যে কিছুটা সময় বাগানে না থাকলে খুব অস্থির অস্থির লাগে। 

একমাস চাকরির পর প্রথম বেতন পেলামপঁচশ টাকার বদলে সিদ্দিকুর রহমান সাহে টাকা দিয়ে বললেন তােমার কাজকর্ম ভালােএইভাবে কাজকর্ম করলে বেতন আরাে বাড়িয়ে দিবাে। 

আমার মনে বড় আনন্দ হলােআমি তখন একটা কাজ করলামপাগলামিও বলতে পারেনবেতনের সব টাকা খরচ করে মােক্তার সাহেবের স্ত্রী এবং তার তিন মেয়ের জন্য তিনটা শাড়ি কিনে ফেললামটাঙ্গাইলের সুতী শাড়িমােক্তার সাহেবের জন্য একটা খদ্দরের চাদর। 

ভয় (পর্ব-১০)-হুমায়ূন আহমেদ

মােক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, তােমার কি মাথাটা খারাপ? এইটা তুমি কি করলা? বেতনের প্রথম টাকা তুমি তােমার আত্মীয়স্বজনের জন্য জিনিশ কিনবা, বাড়িতে টাকা পাঠাইবা| আমি বললাম, মা আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নাইআপনারাই আমার আত্মীয়স্বজন| তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, কই কোনােদিন তাে কিছু বলাে নাই| আপনি জিজ্ঞেস করেন নাইএইজন্যে বলি নাইআমার বাবামা খুব ছােটবেলায় মারা গেছেনআমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়এতিমখানা থেকেই উলা পাস করেছি। 

উনি আমার কথায় মনে খুব কষ্ট পেলেনউনার মনটা ছিলাে পানির মতােসবসময় টলটল করেউনি বললেন, কিছু মনে নিও নাআমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলােতুমি আমারে মা ডাকো আর আমি তােমার সম্পর্কে কিছুই জানি 

এইটা খুবই অন্যায় কথাআমার খুব অন্যায় হইছে। 

তিনি তাঁর তিন মেয়েরে ডেকে বললেন, তােমরা এরে আইজ থাইক্যা নিজের ভাইএর মতাে দেখবামনে করবা তােমরার এক ভাইতার সামনে পর্দা করার দরকার নাই। 

এরমধ্যে একটা বিশেষ জরুরী কথা বলতে ভুলে গেছি মােক্তার সাহেবের ছােট মেয়ে লতিফার কথা। এই মেয়েটা পরীর মতাে সুন্দরএকটু পাগল ধরনেরনিজের মনে কথা বলেনিজের মনে হাসেযখন তখন বাংলা ঘরে চলে আসেআমার সংগে দুই একটা টুকটাক কথাও বলেঅদ্ভুত সব কথাএকদিন এসে বললাে, এই যে মৌলানা সাব, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসছিআচ্ছা বলেন ততা শয়তান পুরুষ না মেয়েছেলে

আমি বললাম, শয়তান পুরুষলতিফা বললাে, আল্লা মেয়ে শয়তান তৈরি করেন নাই কেন

আমি বললাম, তা তাে জানি নাআল্লাহ পাকের ইচ্ছার খবর কেমনে জানবাে? আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। 

কিন্তু শয়তান যে পুরুষ তা আপনি জানেন? জানিআপনে ভুল জানেনশয়তান পুরুষও না স্ত্রীও নাশয়তান আলাদা এক জাত” 

আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হইএই রকম সে প্রায়ই করেএকদিনের কথাছুটির দিনদুপুরবেলাবাংলা ঘরে আমি ঘুমাচ্ছিহঠাৎ ঘুম ভেঙে 

গেলােঅবাক হয়ে দেখি লতিফা আমার ঘরেআমি ধড়মড় করে উঠে বসলামলতিফা বললাে, আপনেরে একটা ধাধা জিজ্ঞেস করতে আসছিআচ্ছা বলেন তাে – 

হেন কোনাে গাছ আছে ধরায় 

স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়আমি ধাধার জবাব না দিয়ে বললাম, তুমি কখন আসছাে

লতিফা বললাে, অনেকক্ষণ হইছে আসছিআপনে ঘুমাইতেছিলেন আপনারে জাগাই নাইএখন বলেন ধাধার উত্তর দেন

হেন কোনাে গাছ আছে ধরায় 

স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়আমি বললাম এইটার উত্তর জানা নাই| ‘উত্তর খুব সােজা উত্তর হইলাে পরগাছাআচ্ছা আরেকটা ধরি বলেনদেখি.....। 

পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায় 

কেমন ফল বলতাে আমায়? মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় আমার ভয় ভয় লাগতে লাগলাে

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৯)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *