প্রাইভেট কলেজে কলেজে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন বন্ধুদের দেখাদেখি জিআরই পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। জিআরই পরীক্ষা কি তা কি আপনি জানেন? গ্রাজুয়েট রেকর্ড একজামিনেশন।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হতে হলে এই পরীক্ষা দিতে হয়। ‘আমি জানি।”
‘এই পরীক্ষায় আমি আশাতীত ভাল করে ফেললাম। আমেরিকান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে আমন্ত্রণ চলে এল। চলে গেলাম। পি এইচ ডি করলাম প্রফেসর হােবলের সঙ্গে। আমার পিএইচডি ছিল গ্রুপ থিওরীর একটি শাখায় – নন এ্যাবেলিয়ান ফাংশানের উপর। পি এইচ ডির কাজ এতই ভাল হল যে আমি রাতারাতী বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অংক নিয়ে বর্তমান কালে যারা নাড়াচাড়া করেন। তারা সবাই আমার নাম জানেন। অংক শাস্ত্রের একটি ফাংশান আছে যা আমার নামে পরিচিত। আর কে এক্সপােনেনশিয়াল। আর কে হচ্ছে রাশেদুল করিম।
পি এইচ ডির পর পরই আমি মন্টানা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলাম। সেই বৎসরই বিয়ে করলাম। মেয়েটি মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের ছাত্রী – স্প্যানীশ আমেরিকান। নাম, জুডি বারনার।
‘প্রেমের বিয়ে?” ‘প্রেমের বিয়ে বলাটা বােধ হয় ঠিক হবে না। বাছাবাছির বিয়ে বলতে পারেন। জুডি অনেক বাছাবাছির পর আমাকে পছন্দ করল।
‘আপনাকে পছন্দ করার কারণ কি? . “আমি ঠিক অপছন্দ করার মত মানুষ সেই সময় ছিলাম না। আমার একটি চোখ পাথরের ছিল না। চেহারা তেমন ভাল না হলেও দুটি সুন্দর চোখ ছিল। আমার মা বলতেন, রাশেদের চোখে জন্ম, কাজল পরাননা। সুন্দর চোখের ব্যাপারটা অবশ্য ধর্তব্য নয়। আমেরিকান তরুনীরা প্রেমিকদের সুন্দর চোখ নিয়ে মাথা ঘামায় না – তারা দেখে প্রেমিক কি পরিমাণ টাকা করেছে এবং ভবিষ্যতে কি পরিমাণ টাকা সে করতে পারবে।
সেই দিক দিয়ে আমি মােটামুটি আদর্শ স্থানীয় বলা চলে। ত্রিশ বছর বয়সে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি পজিশন পেয়ে গেছি। ট্যানিউর পেতেও কোন সমস্যা হবে না। জুডি স্বামী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করল। আমার দিক থেকে আপত্তির কোন কারণ ছিল না। জুডি চমক্কার একটি মেয়ে। শত বৎসর সাধনার ধন হয়ত নয় তবে বিনা সাধনায় পাওয়ার মত মেয়েও নয়।
বিয়ের সাতদিনের মাথায় আমরা হানিমুন করতে চলে গেলাম সানফ্রান্সিসকো। উঠলাম হােটেল বেডফোর্ডে। দ্বিতীয় রাত্রির ঘটনা। ঘুমুচ্ছিলাম। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে দেখি জুডি পাশে নেই, ঘড়িতে রাত তিনটা দশ বাজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ সেখান থেকে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললাম, কি হয়েছে? জুডি কি হয়েছে? কান্না থেমে গেল। তবে জুডি কোন জবাব দিল না।
অনেক ধাক্কাধাক্কির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কি হয়েছে?
সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছি। ‘কিসের ভয়? ‘জানি না কিসের ভয়।
‘ভয় পেয়েছাে তাে আমাকে ডেকে তােলনি কেন? বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ছিলে কেন?
জুডি জবাব দিল না। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বলতাে?
‘সকালে বলব। ‘না এখনি বল। কি দেখে ভয় পেয়েছ?
জুডি অশষ্ট স্বরে বলল, তােমাকে দেখে। আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কি করেছি?
জুডি যা বলল তা হচ্ছে – রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। হােটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, এই আলােয় সে দেখে তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোন জীবন্তু মানুষ নয়। মৃত মানুষ। যে মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে ভয়ে কাঁপতে থাকে তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করেই চমকে উঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতই শীতল। সে পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছি। তার জন্যে এটা বড় ধরণের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়–টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হােটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়।
ঠিক তখন সে লক্ষ্য করে মৃত দেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে ধীরে খুলছে। সেই একটি মাত্র খােলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই হল ঘটনা। | রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরালেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। আমি বললাম, থামলেন কেন?
‘সাতটা বেজেছে। আপনি বলেছেন সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসে। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। চা খেয়ে শুরু করব। আমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে? | ‘ইন্টারেস্টিং। এই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরণ থেকে মনে হচ্ছে অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন।
‘আপনার অনুমান সঠিক। ছ‘ থেকে সাতজনকে আমি বলেছি। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। পুলিশের লােক আছে।
‘পুলিশের লােক কেন?” ‘গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লােক কি জন্যে।
চা চলে এল। চায়ের সঙ্গে পরােটা ভাজি। মিসির আলি নাশতা করলেন। রাশেদুল করিম সাহেব পর পর দুকাপ চা খেলেন।
‘আমি কি শুরু করব ?”
‘জি শুরু করুন।
“আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হল। জুডিকে নিয়ে পুরানাে জায়গায় চলে এলাম। মনটা খুবই খারাপ। জুডির কথা বার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। রােজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে উঠে। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন জেগে উঠি তাকে সান্তনা দিতে যাই তখন এমন ভাবে তাকায় যেন আমি একটা পিশাচ কিবা মূর্তিমান শয়তান। আমার দুঃখের কোন সীমা রইল না। সেই সময় নন এবেলিয়ান গ্রুপের উপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম। আমার দরকার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার মত পরিবেশ। মানসিক শান্তি। সব দূর হয়ে গেল। অবশ্যি দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিক। সে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডুবার পর থেকে। আমি তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম। | সাইকিয়াট্রিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগ ঘটিত।
হয়তাে জুডি ড্রাগে অভ্যস্ত। সেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এল এস ডি প্রথম এসেছে। শিল্প সাহিত্যের লােকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেন। বড় গলায় বলছেন – মাইণ্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছি। জুডি ফাইন আর্টস এর ছাত্রী। ট্রিপ নেয়া তারপক্ষে খুব অস্বাভাবিক না।
দেখা গেল ড্রাগ ঘটিত কোন সমস্যা তার নেই। সে কখনাে ড্রাগ নেয়নি। সাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোন সমস্যা ছিল কি–না তাও বের করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। জুডি এসেছে গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে। এ ধরণের পরিবারে তেমন কোন সমস্যা থাকে না। তাদের জীবন যাত্রা সহজ এবং স্বাভাবিক।
সাইকিয়াট্রিস্ট জুডিকে ঘুমের অষুধ দিলেন। কড়া ডােজের ফেনােবারবিটন। আমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখা পড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রীর প্রতি বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেয়া দরকার তা দিচ্ছেন না। আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর এক ধরণের ক্ষোভ জন্ম গ্রহণ করেছে। সে যা বলছে তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
জুডির কথা একটাই – আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্রাণ থাকে না। একজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে আমার শরীরও সে রকম পড়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে — আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলি না। গা হয়ে যায় বরফের মত শীতল।