ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

কার্বলিক এসিড আছে?দ্ধিনেত্রকোনার ফার্মেসী থেকে তিন বােতল নিয়ে আসছিআমার স্ত্রীরও খুব সাপের ভয়এই অঞ্চলে সাপ খােপ একটু বেশী। 

ভয়মসজিদের সামনে উচু চাতাল মতাে জায়গায় বসে আছিসাপের ভয়ে খানিকটা আতংকগ্রস্তআকাশে মেঘ ডাকছেবড় ধরনের বর্ষণ মনে হচ্ছে আন্নইমাম সাহেব বললেন, খাওয়া দিতে একটু দেরি হবেআমার স্ত্রী সব একা করছে লােকজন নাই। 

ভাব দেখে মনে হচ্ছেবিরাট আয়ােজনজিনা আয়ােজন কিছু না, দরিদ্র মানুষআপনারা এসেছেন শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশিকেউ আসে নাআমি বলতে গেলে একা থাকিসবাই আমাকে ভয় করে। 

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন? সবার একটা ধারণা হয়েছে আমি জ্বীন পুষিজ্বীনদের নিয়ে কাজ কর্ম 

করাই ...বলেন কি? সত্য না জনাবতবে মানুষ সত্যকে সহজে বিশ্বাস করেঅসত্য বিশ্বাস করা সহজ, কারণশয়তান অসত্য বিশ্বাসে সাহায্য করে| ইমাম সাহেব বেশ মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেনপ্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, সাধু কালু খ্ৰী সম্পর্কে কি জানেন

ইমাম সাহেব বললেন, তেমন কিছু জানি নাতবে আপনাদের মতাে দুর দুর থেকে উনার কাছে লােকজন আসে এইটা দেখেছিবিশিষ্ট ভদ্রলােকরাই আসে বেশিময়মনসিংহের ডিসি সাহেব উনার পত্নীকে নিয়ে এসেছিলেন। 

ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

উনার ক্ষমতা টমতা কিছু আছে

মনে হয় নাকুৎসিত গালাগালি করেনকামেল মানুষের এই রকম গালিগালাজ করার কথা নাতাছাড়া কালু খার কারণে অনেক বেদাতী কাণ্ডকারখানা হয়, এইগুলাও ঠিক না। 

কি কাণ্ড কারখানা হয়? | উনি নগ্ন থাকেন এইজন্য অনেকের ধারণা নগ্ন অবস্থায় তার কাছে গেলে তার মেজাজ ঠিক থাকেঅনেকেই নগ্ন অবস্থায় যান। 

সেকি” 

উনি পাগল মানুষসমস্যার কারণে যারা তার কাছে আসেন তারাও এক অর্থে পাগলপাগল মানুষের কাজকর্মতাে এই রকমই হয়সমস্যা হলে তার পরিত্রাণের জন্য আল্লাহপাকের দরবারে কান্নাকাটি করতে হয়মানুষ তা করে না, সাধুন্ন্যাসী, পীর ফকির খোজে। 

ইমাম সাহেবের কথাবার্তায় আমি অবাক হলামপরিষ্কার চিন্তাভাবনাগ্রাম্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এমন যুক্তি নির্ভর কথা আশা করা যায় নালােকটির প্রতি আমার এক ধরনের শ্রদ্ধাবােধ তৈরী হলতাছাড়া ভদ্রলােকের আচারআচরণেও সহজ সারল্য আছে যে সারল্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। 

রাত নটার দিকে ইমাম সাহেব বললেন, চলেন যাই, খানা বােধহয় এর মধ্যে তৈরি হয়েছেডাল ভাত এর বেশি কিছু নানিজ গুণে ক্ষমা করে চারটা মুখে দিবেন| ইমাম সাহেবের বাড়িটা ছােট্ট টিনের দুকামরার বাড়িএকচিলতে উঠোনবাড়ির চারদিকে দৰ্মার বেড়াআমাদের ঘরে নিয়ে বসানাে হলােমেঝেতে শতরঞ্জি বিছানােথালাবাসন সাজানােআমরা সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেলামখাবারের আয়ােজন অল্প হলেও ভালােসজি, ছােট মাছের তরকারি, ডাল এবং টক জাতীয় একটা খাবারইমাম সাহেব আমাদের সঙ্গে বসলেন না

ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

খাবার পরিবেশন করতে লাগলেনখাবারের শেষ পর্যায়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেনএবং শিশুর মতাে কৌতুহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেনব্যাপারটা এতাে আচমকা ঘটলাে যে আমি বেশ হকচকিয়েই গেলামঅজ পাড়াগাঁয়ে এটা অভাবনীয়কঠিন পর্দাপ্রথাই আশা করেছিলামআমি খানিকটা সংকুচিত হয়েই রইলামইমাম সাহেবকেও দেখলাম খুব অপ্রস্তুত বােধ করছেন। 

সফিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাে, আপনি কেমন আছেন

ইমাম সাহেবের স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভালাে নাইআমার সঙ্গে একটা জ্বীন থাকেজ্বীনটার নাম কফিলকফিল আমারে খুব ত্যক্ত করে। 

সফিক হতভম্ব হয়ে বললাে, আপনি কি বললেন বুঝলাম না। 

মেয়েটি যন্ত্রের মত বললাে, আমার সঙ্গে একটা জ্বীন থাকেজ্বীনটার নামকফিলকফিল আমারে বড় যন্ত্রণা করে| সফিক অবাক হয়ে তাকালাে আমার দিকেআমি নিজেও বিস্মিতব্যাপার কি কিছু বুঝতে পারছি নাইমাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, লতিফা তুমি 

একটু ভিতরে যাও। 

ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ক্যান? ভিতরে ক্যান? থাকলে কি অসুবিধা? উনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলবােতুমি না থাকলে ভালাে হয়সব কথা মেয়েছেলেদের শােনা উচিত না| লতিফা তীব্র চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলােখাওয়া বন্ধ করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে রইলামএকি সমস্যা। 

লতিফা মেয়েটি রূপবীশুধু রূপবতী নয় চোখে পড়ার মতাে রূপবতীহাল্কা পাতলা শরীরধবধবে ফর্সা গায়ের রঙলম্বাটে স্নিগ্ধ মুখবয়সও খুব কম মনে হচ্ছেদেখাচ্ছে আঠারােউনিশ বছরের তরুণীর মতােএতাে কম বয়স তার নিশ্চয় নয়যার স্বামীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স আঠারাে উনিশ হতে পারে নাআরাে একটি লক্ষ্য করার মতাে ব্যাপার হলাে মেয়েটি সাজগােজ করেছেচুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে কপালে লাল রঙের টিপগ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলেও জানতাম না। 

ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

ইমাম সাহেব আবার বললেন, লতিফা ভিতরে যাওমেয়েটি উঠে চলে গেলােইমাম সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন, লতিফার মাথা পুরাপুরি ঠিক নাওর দুটা সন্তান নষ্ট হয়েছেতারপর থেকে রকমতার ব্যবহারে আপনারা কিছু মনে করবেন নাআমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইকিছু মনে করবেন না আল্লাহর দোহাই। 

আমি বললাম, কিছুই মনে করিনিতাছাড়া মনে করার মতাে কিছু তাে উনি করেননি। 

ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, জ্বীনের কারণে এরকম করেজ্বীনটা তার সঙ্গে সঙ্গে আছেমাঝে মাঝে মাস খানিকের জন্যে চলে যায় তখন ভালাে থাকেগত এক মাস ধরে তার সাথে আছে। 

আপনি এসব বিশ্বাস করেন

বিশ্বাস করবে না কেন? বিশ্বাস না করারতাে কিছু নাইবাতাস আমরা চোখে দেখিনা কিন্তু বাতাস বিশ্বাস করিকারণ বাতাসের নানান আলামত দেখিসেই রকম জ্বীন কফিলেরও নানান আলামত দেখি। 

কি দেখেন? জ্বীন যখন সঙ্গে থাকে তখন লতিফা খুব সাজগােজ করেকথায় কথায় হাসেকথায় কথায় কাঁদে। 

জ্বীন তাড়াবার ব্যবস্থা করেননি?” 

করেছিলাভ হয় নাইকফিল খুব শক্ত জ্বীনদীর্ঘদিন লতিফার সঙ্গে আছেপ্রথম সন্তান যখন গর্ভে আসলাে তখন থেকেই কফিল আছে। 

জীন চায় কি

ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে বসে রইলেনতাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনাে কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছেনআমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলােজ্বীন বােধহয় লতিফামেয়েটিকেই স্ত্রী হিসেবে চায়বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে দেখে আমি নিজের উপরও বিরক্ত হলামইমাম সাহেব বললেন, এই জ্বীনটা আমার দুইটা বাচ্চা মেরে ফেলেছেআবার যদি বাচ্চা হয় তারেও মারবেবড় মনঃকষ্টে আছি জনাবদিনরাত আল্লাহপাকেরে ডাকিআমি গুনাহগার মানুষআল্লাহপাক আমার কথা শুনেন না। 

ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ

আপনার স্ত্রীকে কোন ডাক্তার দেখিয়েছেন

ডাক্তার কি করবেডাক্তারের কোন বিষয় নাজ্বীনের ওষুধ ডাক্তারের কাছে নাই

তবু একবার দেখালে হতাে না? আমার শশুর সাহেব দেখিয়েছিলেনএকবার লতিফাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিলামশ্বশুর সাহেব তারে ঢাকা নিয়ে গেলেনচিকিৎসাটিকিৎসা করলেনলাভ হল না। 

(চলবে)

ভয় (পর্ব-৭)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *