কার্বলিক এসিড আছে?” ‘দ্ধি। নেত্রকোনার ফার্মেসী থেকে তিন বােতল নিয়ে আসছি। আমার স্ত্রীরও খুব সাপের ভয়। এই অঞ্চলে সাপ খােপ একটু বেশী।
মসজিদের সামনে উচু চাতাল মতাে জায়গায় বসে আছি। সাপের ভয়ে খানিকটা আতংকগ্রস্ত। আকাশে মেঘ ডাকছে। বড় ধরনের বর্ষণ মনে হচ্ছে আন্ন। ইমাম সাহেব বললেন, খাওয়া দিতে একটু দেরি হবে। আমার স্ত্রী সব একা করছে লােকজন নাই।
‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে–বিরাট আয়ােজন। ‘জিনা আয়ােজন কিছু না, দরিদ্র মানুষ। আপনারা এসেছেন শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশি। কেউ আসে না। আমি বলতে গেলে একা থাকি। সবাই আমাকে ভয় করে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন? ‘সবার একটা ধারণা হয়েছে আমি জ্বীন পুষি। জ্বীনদের নিয়ে কাজ কর্ম
করাই ...‘ বলেন কি? ‘সত্য না জনাব। তবে মানুষ সত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। অসত্য বিশ্বাস করা সহজ, কারণশয়তান অসত্য বিশ্বাসে সাহায্য করে। | ইমাম সাহেব বেশ মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, সাধু কালু খ্ৰী সম্পর্কে কি জানেন?
ইমাম সাহেব বললেন, তেমন কিছু জানি না। তবে আপনাদের মতাে দুর দুর থেকে উনার কাছে লােকজন আসে এইটা দেখেছি। বিশিষ্ট ভদ্রলােকরাই আসে বেশি। ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব উনার পত্নীকে নিয়ে এসেছিলেন।
ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ
“উনার ক্ষমতা টমতা কিছু আছে?
‘মনে হয় না। কুৎসিত গালাগালি করেন। কামেল মানুষের এই রকম গালিগালাজ করার কথা না। তাছাড়া কালু খার কারণে অনেক বেদাতী কাণ্ডকারখানা হয়, এইগুলাও ঠিক না।
‘কি কাণ্ড কারখানা হয়? | ‘উনি নগ্ন থাকেন এইজন্য অনেকের ধারণা নগ্ন অবস্থায় তার কাছে গেলে তার মেজাজ ঠিক থাকে। অনেকেই নগ্ন অবস্থায় যান।
‘সেকি।”
“উনি পাগল মানুষ। সমস্যার কারণে যারা তার কাছে আসেন তারাও এক অর্থে পাগল। পাগল মানুষের কাজকর্মতাে এই রকমই হয়। সমস্যা হলে তার পরিত্রাণের জন্য আল্লাহপাকের দরবারে কান্নাকাটি করতে হয়। মানুষ তা করে না, সাধুন্ন্যাসী, পীর ফকির খোজে।
ইমাম সাহেবের কথাবার্তায় আমি অবাক হলাম। পরিষ্কার চিন্তা–ভাবনা। গ্রাম্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এমন যুক্তি নির্ভর কথা আশা করা যায় না। লােকটির প্রতি আমার এক ধরনের শ্রদ্ধাবােধ তৈরী হল। তাছাড়া ভদ্রলােকের আচার–আচরণেও সহজ সারল্য আছে যে সারল্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।
রাত নটার দিকে ইমাম সাহেব বললেন, চলেন যাই, খানা বােধহয় এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। ডাল ভাত এর বেশি কিছু না। নিজ গুণে ক্ষমা করে চারটা মুখে দিবেন। | ইমাম সাহেবের বাড়িটা ছােট্ট টিনের দুকামরার বাড়ি। একচিলতে উঠোন। বাড়ির চারদিকে দৰ্মার বেড়া। আমাদের ঘরে নিয়ে বসানাে হলাে। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছানাে। থালা–বাসন সাজানাে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। খাবারের আয়ােজন অল্প হলেও ভালাে। সজি, ছােট মাছের তরকারি, ডাল এবং টক জাতীয় একটা খাবার। ইমাম সাহেব আমাদের সঙ্গে বসলেন না।
ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ
খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। খাবারের শেষ পর্যায়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন। এবং শিশুর মতাে কৌতুহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপারটা এতাে আচমকা ঘটলাে যে আমি বেশ হকচকিয়েই গেলাম। অজ পাড়াগাঁয়ে এটা অভাবনীয়। কঠিন পর্দা–প্রথাই আশা করেছিলাম। আমি খানিকটা সংকুচিত হয়েই রইলাম। ইমাম সাহেবকেও দেখলাম খুব অপ্রস্তুত বােধ করছেন।
সফিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাে, আপনি কেমন আছেন?
ইমাম সাহেবের স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভালাে নাই। আমার সঙ্গে একটা জ্বীন থাকে। জ্বীনটার নাম কফিল। কফিল আমারে খুব ত্যক্ত করে।
সফিক হতভম্ব হয়ে বললাে, আপনি কি বললেন বুঝলাম না।
মেয়েটি যন্ত্রের মত বললাে, আমার সঙ্গে একটা জ্বীন থাকে। জ্বীনটার নাম। কফিল। কফিল আমারে বড় যন্ত্রণা করে। | সফিক অবাক হয়ে তাকালাে আমার দিকে। আমি নিজেও বিস্মিত। ব্যাপার কি কিছু বুঝতে পারছি না। ইমাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, লতিফা তুমি
একটু ভিতরে যাও।
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ক্যান? ভিতরে ক্যান? থাকলে কি অসুবিধা? ‘উনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলবাে। তুমি না থাকলে ভালাে হয়। সব কথা মেয়েছেলেদের শােনা উচিত না। | লতিফা তীব্র চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলাে। খাওয়া বন্ধ করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। একি সমস্যা।
লতিফা মেয়েটি রূপবী। শুধু রূপবতী নয় চোখে পড়ার মতাে রূপবতী। হাল্কা পাতলা শরীর। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। লম্বাটে স্নিগ্ধ মুখ। বয়সও খুব কম মনে হচ্ছে। দেখাচ্ছে আঠারাে–উনিশ বছরের তরুণীর মতাে। এতাে কম বয়স তার নিশ্চয় নয়। যার স্বামীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স আঠারাে উনিশ হতে পারে না। আরাে একটি লক্ষ্য করার মতাে ব্যাপার হলাে মেয়েটি সাজ–গােজ করেছে। চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে কপালে লাল রঙের টিপ। গ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলেও জানতাম না।
ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ
ইমাম সাহেব আবার বললেন, লতিফা ভিতরে যাও। মেয়েটি উঠে চলে গেলাে। ইমাম সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন, লতিফার মাথা পুরাপুরি ঠিক না। ওর দুটা সন্তান নষ্ট হয়েছে। তারপর থেকে এ রকম। তার ব্যবহারে আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। কিছু মনে করবেন না – আল্লাহর দোহাই।
আমি বললাম, কিছুই মনে করিনি। তাছাড়া মনে করার মতাে কিছু তাে উনি করেননি।
ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, জ্বীনের কারণে এরকম করে। জ্বীনটা তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। মাঝে মাঝে মাস খানিকের জন্যে চলে যায় তখন ভালাে থাকে। গত এক মাস ধরে তার সাথে আছে।
‘আপনি এসব বিশ্বাস করেন?
‘বিশ্বাস করবে না কেন? বিশ্বাস না করারতাে কিছু নাই। বাতাস আমরা চোখে দেখিনা কিন্তু বাতাস বিশ্বাস করি। কারণ বাতাসের নানান আলামত দেখি। সেই রকম জ্বীন কফিলেরও নানান আলামত দেখি।
‘কি দেখেন? ‘জ্বীন যখন সঙ্গে থাকে তখন লতিফা খুব সাজগােজ করে। কথায় কথায় হাসে। কথায় কথায় কাঁদে।
‘জ্বীন তাড়াবার ব্যবস্থা করেননি?”
‘করেছি। লাভ হয় নাই। কফিল খুব শক্ত জ্বীন। দীর্ঘদিন লতিফার সঙ্গে আছে। প্রথম সন্তান যখন গর্ভে আসলাে তখন থেকেই কফিল আছে।
‘জীন চায় কি?
ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনাে কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলাে–জ্বীন বােধহয় লতিফা। মেয়েটিকেই স্ত্রী হিসেবে চায়। বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে দেখে আমি নিজের উপরও বিরক্ত হলাম। ইমাম সাহেব বললেন, এই জ্বীনটা আমার দুইটা বাচ্চা মেরে ফেলেছে। আবার যদি বাচ্চা হয় তারেও মারবে। বড় মনঃকষ্টে আছি জনাব। দিন–রাত আল্লাহপাকেরে ডাকি। আমি গুনাহগার মানুষ। আল্লাহপাক আমার কথা শুনেন না।
ভয় (পর্ব-৮)-হুমায়ূন আহমেদ
‘আপনার স্ত্রীকে কোন ডাক্তার দেখিয়েছেন?
‘ডাক্তার কি করবে। ডাক্তারের কোন বিষয় না। জ্বীনের ওষুধ ডাক্তারের কাছে নাই।
‘তবু একবার দেখালে হতাে না? ‘আমার শশুর সাহেব দেখিয়েছিলেন। একবার লতিফাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। শ্বশুর সাহেব তারে ঢাকা নিয়ে গেলেন। চিকিৎসা–টিকিৎসা করলেন। লাভ হল না।
(চলবে)