মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

মাস তিনেক আগে বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছি। ভাল বাসা পাইনি, তাই এখনো ফ্যামিলি আনিনি। কিন্তু মোটর গাড়িটা আনতে হয়েছে। আমার যে ধরনের কাজ তাতে মোটর না হলে চলে না….কলকাতায় এসেই কিন্তু ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। অপরাধের মধ্যে একজনের প্রাণরক্ষা করেছিলাম। তার ফল যে এমন বিষময় হয়ে উঠবে তখন কে জানত! বিদ্যাসাগর ছিলেন মহাপুরুষ। লোক, তিনি জানতেন পৃথিবীতে কারুর উপকার করতে নেই। আমি অবাচীন, তাই আমার আজ। এই দুরবস্থা।

যার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম তার নাম মটর মাস্টার। মটর মাস্টারকে আপনারা চিনবেন না, কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছি। তার কৃতজ্ঞতার ঠেলায় এখন হাতে দড়ি না পড়লে বাঁচি।

একদিন কাজের সূত্রে কলকাতার বাইরে একটা ফ্যাক্টরীতে গিয়েছিলাম। বড় বড় ফ্যাক্টরীতে কার্য পরিচালনা সম্বন্ধে সুপরামর্শ দেওয়াই আমার কাজ। সেদিন ফ্যাক্টরীতে কাজ শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। রাত্রে ফ্যাক্টরীর কর্মকর্তা আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খুব খাওয়ালেন। তারপর রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময় মোটর চালিয়ে কলকাতায় ফিরে চললাম।

শহরতলিতে কিছুদূর এগিয়েছি, একটা বাঁক নিয়ে মোটরের হেডলাইটের ছটায় একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। সামনে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে রাস্তার ওপর কয়েকজন লোক একটা লোককে লাঠি দিয়ে মারছে। লোকটা নিরস্ত্র, কেবল দুহাত দিয়ে নিজের মাথা বাঁচাবার চেষ্টা করছে। আমার মোটরের আলো দেখে লোকটা আক্রমণকারীদের মধ্যে থেকে ছুটে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করল, আততায়ীরাও ক্ষণেকের জন্যে থমকে গেল, তারপর আমি সজোরে হর্ন বাজাতেই তারা রাস্তার দু পাশের অন্ধকারে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল।

অকুস্থলে গিয়ে মোটর দাঁড় করালাম। আক্রান্ত লোকটাকে ভাল করে দেখবার সুযোগ পেলাম না, সে তড়াক করে গাড়িতে আমার পাশে উঠে বসল, ব্যগ্রস্বরে বলল—চলুন চলুন, দেরি করবেন না।

আমি আবার গাড়ি চালিয়ে দিলাম, যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে নোকটাকে দেখলাম। নিম্নতর শ্রেণীর লোক, হাড়গিলের মতো আকৃতি; কপালের ওপর একটা হাত চেপে বসে আছে, বোধ হয় কপালে লাঠির চোট খেয়েছে। আমি বললাম—মাথায় লেগেছে? রক্তপাত হয়েছে? হাসপাতালে নিয়ে যাব?

সে বলল—আজ্ঞে না।

বললাম—থানায় যাবে?

সবেগে মাথা নেড়ে সে বলল—আজ্ঞে না।

তবে কোথায় যাবে?

তুলসীতলায়।

চকিতে তার পানে তাকালাম—তুমি তুলসীতলায় থাকো?

লোকটা খরদৃষ্টিতে আমার পানে চাইল। বলল—আপনাকে এতক্ষণ চিনতে পারিনি। আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন, ৪৫ নম্বরে থাকেন।

বললাম—হ্যাঁ। তোমাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

সে বলল——আমি আপনাকে দেখেছি, আমার নাম মটর মাস্টার।

মটর মাস্টার কোন বিদ্যার মাস্টারী করে বুঝতে পারলাম না। অতঃপর আর কোনও কথা হলো। আধঘণ্টা পরে গাড়ি আমার বাসার সামনে এসে থামল, সঙ্গে সঙ্গে মটর মাস্টার গাড়ি থেকে নেমে দুপুর রাতের আবছায়া রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

দিন তিনেক পরে একটা রবিবারে বাজারে যাব বলে বেরিয়েছি, একটা লোক বিপরীত দিক থেকে আসতে আসতে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল। লোকটাকে যেন কোথায় দেখেছি; সিড়িঙ্গে লম্বা হাড়বার করা চেহারা, তার শরীরে লালচে রঙের একটু আধিক্য আছে। চুল লালচে কালো, চোখ লালচে, দাঁত লালচে, গায়ের রঙের কালোর ওপর একটু লালচে আভা; দোলের সময় গায়ে রঙ ধুয়ে ফেলবার প্রও যেমন একটু ছোপ লেগে থাকে অনেকটা সেই রকম।

চিনি-চিনি করেও লোকটাকে চিনতে পারলাম না। অবশ্য এ পাড়ার কাউকেই ভাল করে চিনি না। পাড়াটা যেন কেমনধারা। যারা বড় কাজ করে তারা সকালবেলা মোটরে চড়ে কাজে চলে যায়, সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরে আসে; কারুর সঙ্গে মেলামেশা নেই। যারা মধ্যবিত্ত তারা পান চিবুতে চিবুতে অফিসে যায়, কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না। বেলা দশটার পর পাড়ায় থেকে যায় একদল যুবক। তাদের মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ে হাত কাটা গেঞ্জি ও ঢিলা পাজামা; বিড়ি সিগারেট টানতে টানতে তারা ফুটপাথে পায়চারি করে আর নিজেদের মধ্যে খাটো গলায় কথা বলে। তাদের স্কুল কলেজ আছে বলে মনে হয় না। পাড়ায় নতুন লোক দেখলে তাদের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে। আমি যখন প্রথম এ পাড়ায় আসি রাস্তায় বেরুলেই ওদের কুঞ্চিত চোখের দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করত; এখনো করে। ওরা কী ভাবে, ওদের মনের গঠন কি রকম কিছুই বুঝতে পারি না। অন্য পাড়ায় ভাল বাসা খুঁজছি, পেলেই চলে যাব।

আমি একটা শুকো চাকর রেখেছি, সে একাধারে আমার পাচক এবং চাকর। সেরাত্রে চাকরটা চলে যাবার পর আমি দোর বন্ধ করে নৈশাহার সারলাম, তারপর সিগারেট ধরিয়ে একটা বই নিয়ে বসলাম। দশটা বাজল; তখন বই বন্ধ করে শুতে যাব ভাবছি এমন সময় সদর দোরে খুটখুট করে কড়া নড়ল।

এত রাত্রে কে এল? উঠে গিয়ে দোর খুললাম, দেখি সেই লালচে লোকটা। সে সুট করে ঢুকে পড়ল, খপ করে পায়ের ধুলো নিয়ে বলল—আজ্ঞে আমি মটর মাস্টার।

এবার তাকে চিনতে পারলাম, সেই লোকটাই বটে। সেরাত্রে আবছা আবছা দেখেছিলাম, তাই চিনতে পারিনি।

ঘরে নিয়ে গিয়ে মটর মাস্টারকে বসালাম, সে আর এক খাবলা পায়ের ধুলো নিয়ে জোড় হাতে বলল-স্যার, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আপনি আমার বাপের তুলি।

ব্যস্ত হয়ে বললাম—আরে না না, আমি আর কি করেছি। তোমার বাঁচবার ছিল তাই বেঁচে গেছ।

মটর মাথা নেড়ে বলল—আজ্ঞে না স্যার! অন্য কেউ হলে গাড়ি দাঁড় করাত না, চোঁ চাঁ দৌড় মারত।

বললাম—তা সে যাক। কিন্তু তোমাকে ওরা ঠেঙাচ্ছিল কেন বল দেখি?

মটর একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল—ওরা আমার শত্রুর। সেরাত্রে লুকিয়ে ওদের এলাকায় ঢুকেছিলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম।

ভাল বুঝলাম না। ওদের এলাকা মানে কি? আর সেখানে ঢুকলে ওরা তোমাকে ঠেঙিয়েই বা মারবে কেন?

মটর তখন একটু কেশে গলা খাঁকারি দিয়ে যাব বলল তার মর্ম এই—

কলকাতার বিশেষ বিশেষ পাড়ায় একদল লোক আছে, যাদের অজ্ঞ ব্যক্তিরা গুণ্ডা বলে; কিন্তু আসলে তারা পাড়ার ধনী গৃহস্থদের রক্ষক। সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে তারা ধনী প্রতিবেশীর ধনপ্রাণ রক্ষা করে। যদি কেউ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এদের শরণাপন্ন না হয় তাহলে তাদের হাত-পা খোঁড়া হয়, বাড়িতে চুরি হয়, মোটর কারে আগুন লাগে এবং আরো নানা রকম দুর্ঘটনা হয়। তাই যারা বুদ্ধিমান তারা কোনও গণ্ডগোল করে না, নিঃসাড়ে রক্ষক-ভক্ষকদের পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে দেয়।

সব শুনে বললাম—খাসা ব্যবসা তোমাদের। তা এতদিন আমাকে রক্ষে করতে আসনি কেন?

মটর লালচে দাঁত বার করে বলল—আজ্ঞে, যারা দুহাজার টাকার কম রোজগার করে তাদের আমরা ছুঁই না।

কে কত রোজগার করে সব খবর তোমরা রাখো?

আজ্ঞে রাখতে হয়, নইলে ব্যবসা চলে না।

আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর মটর মাস্টার উঠল—আজ আসি স্যার। আপনার যদি কোনও উপকার করতে পারি কৃতার্থ হয়ে যাব।

বললাম-না না, আমার কোনও উপকার করতে হবে না। অপকার যদি না কর তাহলেই যথেষ্ট।

জিভ কেটে মটর বলল—বলেন কি স্যার! আমি আপনার অপকার করব! মনে রাখবেন, মটর মাস্টার যতদিন বেঁচে আছে আপনার গায়ে আঁচড়টি লাগতে দেবে না। আজ চলি। মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নিয়ে যাব।

আজকালকার দিনে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং প্রত্যুপকার করতে চায় দেখে মনে আনন্দ হলো।

তারপর থেকে মটর হপ্তায় নিয়মিত একবার আসে। রাস্তায় লোক-চলাচল যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন আসে। অভিসারিকার মতো নিঃশব্দসঞ্চার তার গতিবিধি।

মটর নিজের পাতাল-জীবনের গল্প বলে। সমাজে যে-স্তরে মটরের বাস সে-স্তর আমার একেবারে অজানা, শুনতে শুনতে মন বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়। ভ্রম হয়, যেন সৌর মণ্ডলের পরপারে কোনও উপগ্রহবাসী জীবের কাহিনী শুনছি।

যখনি আসে আমাকে বার বার প্রশ্ন করে স্যার, একবারটি বলুন আপনার জন্যে আমি কি করতে পারি। কিছুই কি করতে পারি না?

বলি—না মটর। দেখছ তো আমি একলা মানুষ, আমার আর কিসের দরকার?

আচ্ছা, আসুন তবে আপনার পা টিপে দিই।

সর্বনাশ! পা দুটোর যাও বা কিছু আছে, তুমি টিপলে আর কিছু থাকবে না।

আচ্ছা স্যার, আপনার নিশ্চয় শত্তুর আছে?

শত্তুর! শত্তুর থাকবে কোন দুঃখে! আমি কি লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে বেড়াই?

একটিও শত্তুর নেই?

না। থাকলেও আমি জানি না।

মটর মাস্টার মুষড়ে পড়ে।

একদিন সে কাগজে মোড়া একটি বাণ্ডিল বগলে করে এল। প্রশ্ন করলাম—বগলে ওটা কি।

মটর সলজ্জভাবে মোড়ক খুলে একটি বোতল আমার সামনে রাখল, বলল—আপনার জন্যে এনেছি স্যার। খাঁটি বিলিতি মাল।

বোতলটি তুলে নিয়ে লেবেল পড়লাম; খাঁটি মাল বটে, স্কটল্যান্ডে তৈরি মাল। প্রশ্ন করলাম—মটর, এর দাম কত?

মটর তাচ্ছিল্যভরে বলল—হবে শখানেক টাকা। আমি ফোকটে পেয়েছি।

তুমি খাও?

কালেভদ্রে খাই। মাতাল হই না।

তাহলে এটা তুমিই রাখো, আমার অভ্যেস নেই। বোতলটি ফেরত দিলাম। মটর দুঃখিত হলো, কিন্তু পীড়াপীড়ি করল না।

তারপর মটর মাস্টার আসে যায়। কোনোদিন এক রাশ ফল নিয়ে আসে; আঙুর আপেল পীচ; কোনোদিন আনে চন্দননগরের কড়া পাকের সন্দেশ। আমি বলি—মটর, তোমার কৃতজ্ঞতার ঋণ কি এখনো শোধ হয়নি।

সে বলে—সে কি কথা স্যার। সারা জীবন ধরে আপনার সেবা করলেও শোধ হবে না। আমি অস্বস্তি অনুভব করি। কোনও জিনিসেরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। মটরের কৃতজ্ঞতার অমৃত অতি-মন্থনের ফলে বিষ না হয়ে ওঠে!

তারপর একদিন একটি ব্যাপার ঘটল।

রাত্রে মটর এসেছিল, তার গল্প শুনতে শুনতে প্রায় দশটা বেজে গেল। সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না, হঠাৎ সদর দরজায় খটখট কড়া নড়ে ওঠাতে চমকে উঠলাম।

মটর উৎকণ্ঠিতভাবে আমার পানে চাইল, আমি তাকে চুপিচুপি বললাম—জানি না কে এসেছে, তুমি একটু আড়াল হও। তাকে বাড়ির পিছন দিকে আঙুল দেখালাম; সে বিড়াল-গতিতে অদৃশ্য হলো। গভীর রাত্রে গুণ্ডার সঙ্গে ধরা পড়া বাঞ্ছনীয় নয়।

উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। গুটি চারেক ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে; যাদের ঢিলা পাজামা আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে ফুটপাথে বিচরণ করতে দেখেছি, তাদেরি দলের ছেলে। কিন্তু আজ তাদের বেশভূষায় পারিপাট্য আছে : ধোপদস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি, বানিশ করা জুতো। তাদের মুখপাত্র হাত জোড় করে সবিনয়ে বলল—মাফ করবেন, অসময়ে বিরক্ত করতে এলাম।

ভাবলাম, বুঝি চাঁদা চায়। আসুন বলে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালাম।

মুখপাত্র ছোকরাটি বেশ চটপটে, বলিয়ে কইয়ে। মধুর হেসে বলল-আপনি আমাদের পাড়ায় বাসা নিয়েছেন আমরা সকলেই দেখেছি, কিন্তু অ্যাদ্দিন আলাপ করবার সাহস হয়নি। আমরা সামান্য লোক, বয়সেও ছোট

কি ব্যাপার বলুন দেখি!

মুখপাত্র বিনীত করুণ হেসে বলল—বড় বিপদে পড়েছি স্যার। আমার নাম হারু ঘোষ। আমাদের একটি ক্লাব আছে—বিবর। আমি বিবরের সেক্রেটারি। ক্লাবে বসে আমরা তাস পাশা খেলি, একটু-একটু গানবাজনা করি। কারুর সাতে-পাঁচে নেই।

তারপর?

কাল সন্ধ্যেবেলা আমরা ক্লাবে বসে তাস খেলছি, হঠাৎ একদল পুলিস এসে হাজির। ক্লাবেরই একজন মেম্বর—নাম কালাচাঁদ দত্ত—তাকে ধরে নিয়ে চলে গেল। বলে কিনা কালাচাঁদ দিনদুপুরে একজনের বাড়িতে ঢুকে একটি মেয়েলোকের মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে সব লুটপাট করে পালিয়েছে। দেখুন দেখি কি অত্যেচার। কালাচাঁদ ভদ্রলোকের ছেলে, সে যাবে ডাকাতি করতে?

পলকের মধ্যে আমার দিব্যচক্ষু উন্মীলিত হলো। এরা কাজকর্ম করে না, স্কুল কলেজে যায় না, হাত কাটা গেঞ্জি আর ঢিলা পাজাম পরে ফুটপাথে টহল মারে; অথচ এদের অন্নবস্ত্রের অভাব নেই। বুঝতে পারলাম এদের রসদ আসে কোথা থেকে। তাদের মুখের দিকে তাকালাম; তারা শিকারী বেড়ালের মতো খরদৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে আছে।

বললাম—ভারি অন্যায় পুলিসের। কিন্তু আমার কাছে এসেছেন কেন?

কি বলব স্যার, পুলিসের জুলুম। আপনি বিজ্ঞ ব্যক্তি, সবই তো জানেন। কালাচাঁদকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে রেখেছে, পাঁচ হাজার টাকা জমানত না পেলে তাকে ছাড়বে না। এ পাড়ায় যত পয়সাওয়ালা লোক আছে সকলের দোরে দোরে কাকুতি-মিনতি করেছি, কিন্তু এমন পাজি নচ্ছার ছোটলোক সব, কেউ আঙুল নেড়ে সাহায্য করবে না। তাই নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি মহাপ্রাণ ব্যক্তি, গরিব বেচারা বিপদে পড়েছে, আপনি নিশ্চয় তাকে পুলিসের কবল থেকে উদ্ধার করবেন।

অতঃপর ছোকরাদের মতলব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার জামিনে কালাচাঁদ মুক্তি পাবে এবং অচিরাৎ ফেরারী হবে; তখন জমানতের টাকার দায় আমার ঘাড়ে পড়বে। বিবরের সভ্যরা দাঁত বার করে হাসবে। যথাসম্ভব সহজভাবে বললাম—মাপ করবেন, আমি পারব না।

না স্যার, এ কাজটি আপনাকে করতেই হবে।

পারব না। অত টাকা আমার নেই।

নগদ টাকা দিতে হবে না স্যার। আপনি গণ্যমান্য লোক, মোটর আছে, মুচলেকা লিখে দিলেই হবে।

হবে না। মিছে উপরোধ করবেন না।

অনুনয় বিনয় ক্রমে তর্কে দাঁড়াল; তারপর ঝগড়ায় পরিণত হলো। শেষ পর্যন্ত হারু ঘোষ চোখ লাল করে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল—আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে পাড়ায় বাস করতে পারবে না, এটা জেনে রাখো। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না।

বললাম,—তোমরা কুমির নও, ছুঁচো–যাও, বিদেয় হও।

চারজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল, আগুনভরা চোখে আমার পানে চাইল। ভাবলাম, বুঝি আক্রমণ। করবে। আমি পকেটে হাত দিলাম। পকেটে যদিও কিছুই ছিল না, তবু বিবরের দল পেছিয়ে গেল; বোধ হয় ভাবল, আমার পকেটে ছোরা ছুরি পিস্তল কিছু আছে।

আচ্ছা দেখে নেব বলে তারা চলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। এদের মুখের দাপট যতটা বেশী সাহস ততটা নয়, তবু হয়তো অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে। মটরের কথা মনে পড়ে গেল। উঠে গিয়ে বাড়ির পিছন দিকে খোঁজ করলাম। দেখলাম মটর কখন খিড়কির দোর খুলে চলে গেছে।

অতঃপর তিন-চার দিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। একদিন সকালবেলা সবে মাত্র চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসেছি, একজন সাব-ইন্সপেক্টর এসে উপস্থিত। বললেন—একটু দরকার আছে।

ঘরে এনে বসালাম—কি দরকার বলুন।

আপনি হারু ঘোষ নামে কাউকে চেনেন?

হারু ঘোষের সঙ্গে পরিচয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম।

তার সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়েছিল?

ঝগড়ার ইতিহাস বললাম। শুনে তিনি বললেন—তাকে আপনি খুন করবেন বলে শাসিয়েছিলেন?

চোখ কপালে তুলে বললাম-সে কি কথা! হারু ঘোষই বরঞ্চ আমাকে দেখে নেব বলে শাসিয়েছিল। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন দেখি। কী হয়েছে?

সাব-ইন্সপেক্টর গাত্রোত্থান করে বললেন—গত রাত্রে হারু ঘোষকে কেউ ছুরি মেরে খুন করেছে। তার তিনজন বন্ধু—যারা তার সঙ্গে আপনার কাছে এসেছিল, তারা বলছে আপনি তাকে শাসিয়েছিলেন। আচ্ছা আজ চলি। দরকার হলে আবার আসব।

স্তম্ভিত হয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। তারপর মনের মেঘাচ্ছন্ন দিগন্ত ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে লাগল।

রাত্রি দশটার সময় মটর এল। দরজা জানলা বন্ধ করে তাকে সামনে বসালাম, কড়া সুরে বললাম-মটর, তুমি হারু ঘোষকে খুন করেছ।

মটর বলল—-হারু ঘোষ! সে আবার কে?

বললাম—ন্যাকামি কোরো না! সেদিন হারু ঘোষ দলবল নিয়ে এসেছিল, তুমি আমাদের কথাবার্তা শুনেছিলে; হারু ঘোষ আমাকে অপমান করেছিল, শাসিয়েছিল, তাই তুমি তাকে খুন করেছ!

মটর এবার এ্যাটম বোমার মতো ফেটে পড়ল——হ্যাঁ, মেরেছি হারামজাদাকে। এত বড় আস্পর্ধা। আমার এলাকায় থেকে আমার প্রাণদাতাকে হুমকি দেবে, চোখ রাঙিয়ে কথা বলবে! ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে! এখনি হয়েছে কি স্যার, ওদের দলের সবাইকে একে একে সাবাড় করব, তবে আমার নাম মটর মাস্টার। দেখে নেবেন আপনি?

আমি হাত জোড় করে বললাম-মটর, দোহাই তোমার, তুমি যাও, আর কখনো আমার কাছে এস না। কেউ যদি দেখে ফেলে আমার বাসায় তোমার যাতায়াত আছে, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না; পুলিস ভাববে আমি তোমাকে দিয়ে হারু ঘোষকে খুন করিয়েছি, দুজনেই খুনের দায়ে পড়ব। এমনিতেই আমার ওপর পুলিসের নজর পড়েছে।

মটর কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল, তারপর উঠে ভারী গলায় বলল—আচ্ছা স্যার, আর আসব না। কিন্তু আপনি আমার প্রাণদাতা, আপনার ঋণ কোনোদিন ভুলব না।

এক খাবলা পায়ের ধুলো নিয়ে মটর চলে গেল। তারপর আর আসেনি।

আমি কিন্তু ভয়ে ভয়ে আছি; ইতিমধ্যে দারোগাবাবু বার দুই তত্ত্বতল্লাস নিয়ে গেছেন। কোনদিন গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে হাজির হবেন। মটর মাস্টার যদি ধরা পড়ে–

 

১০ জানুয়ারী ১৯৬৮

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *