প্রায় একঘণ্টা পর জেনারেল মহোদয় সামরিক আদালতে সপারিষদ প্রবেশ করলেন! টেবিলের পাশে তার মুষ্টিবদ্ধ আঙুলগুলো রেখে সমস্ত চেহারায় ভয়ানক গম্ভীরতা এনে দাঁড়ালেন তিনি। জানালেন, এবার তিনি ব্যাপারটা শুনতে রাজি আছেন। মুখপাত্রটি জানাল, আমরা ওদেরকে অনেক বুঝিয়েছি, আমাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্যে, অনেক আবেদন-নিবেদন করেছি ওদের কাছে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আত্মপ্রবঞ্চনার পক্ষপাতী নয় তারা। তারা মরবে, তবু ধর্মকে কলুষিত করবে না। ত্রাণকর্তার মুখমণ্ডল অকস্মাৎ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এল। কিন্তু তবু কিছু উচ্চারিত হল না তাঁর কণ্ঠ থেকে। কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, না, ওদের সবাইকে মরতে হবে না। তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে নেয়া হবে।
সমস্ত আদালতের মধ্যে একটা কৃতজ্ঞতার আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবার বললেন জেনারেল, ওদেরকে ডেকে পাঠাও। দেয়ালের দিকে মুখ করে ওদেরকে পাশাপাশি দাঁড়াতে আদেশ দাও। আর তাদের হাতগুলো ক্রশ করে পেছন থেকে বেঁধে রাখ। সবশেষে আমাকে খবর দাও যাতে সে অবস্থায় ওদের আমি দেখতে পারি।
সবাই যখন চলে গেল তখন জেনারেল বসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রহরীকে ডেকে বললেন, “যাও পথের ওপর যে শিশুকে প্রথম দেখবে তাকেই আমার কাছে নিয়ে এস।’লোকটি কিন্তু বাইরে যেতে-না-যেতেই ফিরে এল। কুচিকুচি বরফের কণায় আচ্ছন্ন পোশাকে আবৃত ছোট্ট অ্যাবিকে এক হাতে ধরে নিয়ে। এবি সোজা চলে এল সেই রাষ্ট্রপতির কাছে যার নাম শুনে দুনিয়ার জাঁদরেল ও ক্ষমতাবান লোকেরা ভয়ে কাঁপে।
অ্যাবি সোজা তার কোলে এসে বসল। বলল, : আমি আপনাকে জানি। আপনি রাষ্ট্রপতি, জেনারেল আমি কত দেখেছি আপনাকে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে। সবাই কিন্তু ভয় পায় আপনাকে দেখে। আমার কিন্তু একটুও ভয় করে না। কারণ আপনি আমার দিকে কোনোদিন সোজাসুজি তাকাননি।
মনে পড়ে আপনার? আমার সেই লাল ফ্রকটা মনে পড়ে আপনার? ফ্রকটার নিচের দিকে নীল। একটুকরো নরম হাসি এবার রাষ্ট্রপতির মুখের কাঠিন্যকে কিছুটা কমিয়ে দিল। কিন্তু তবু তিনি বিজ্ঞ রাজনীতিকের মতোই তার উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন, : কেন, আমি তো… : আমাদের বাড়ির পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আমাদের বাড়ি, মনে পড়ে না? : আমার সত্যি লজ্জিত হওয়া উচিত। তুমি বুঝতে পারছ না, মা… : এবার ছোট্ট অ্যাবি মিষ্টি তিরস্কার করে জেনারেলকে বাধা দিল তার কথায়। : আচ্ছা, তাহলে আপনার কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু আমি তো কিছুই ভুলে যাইনি।: আমি সত্যি লজ্জিত, মা। আমি তোমাকে কথা দিলাম। এবার নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। আমাকে তোমার বন্ধু বলে নেবে আজকের জন্যে, চিরদিনের জন্যে।
: নিশ্চয়ই আমি ক্ষমা করব যদিও আমি বুঝতে পারি না, কী করে আপনি সব ভুলে গেলেন। আপনি নিশ্চয়ই খুব ভুলোমন। আমারও কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলোমন হয়ে পড়ে। আমি নিশ্চয়ই আপনাকে ক্ষমা করতে পারব। কারণ, আপনি ভালো। আর দয়ালু। আপনি আমাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছেন না কেন? বাবা যেমনি নেয়। বাইরে এখন কী প্রচণ্ড শীত।
: মা লক্ষ্মী আমার, তোমাকে নিশ্চয়ই আমি আমার হৃদয়ের কাছে টেনে নেব। কিন্তু তুমি আমার ছোট্ট বন্ধু হবে তো, অনেক দিনের জন্য? জেনারেলের কণ্ঠ এবার কেমন ভারি হয়ে এল। অ্যাবিকে কাছে টেনে নিলেন আরো। বললেন, তোকে দেখে আমার নিজের ছোট্ট মেয়ের কথা মনে পড়ছে। অবশ্য এতদিনে সে আর ছোট্টটি থাকত না।
কিন্তু সে তোর মতোই মিষ্টি, প্রিয় আর আদরের ছিল। তোর মতোই সুন্দরী ছিল। তোর মতো ছোট্ট পরীর রূপ। শত্রু-মিত্র সবার ওপর প্রভাবশালী বিশ্ববিজয়ী আকর্ষণ ছিল তার। সে আমার দু-হাতের ভেতর শুয়ে থাকত ঠিক তোর মতো নিবিড় হয়ে। আমার হৃদয়কে আনন্দে শান্তিতে আপ্লুত করে দিত যেমন এখন তোকে পেয়ে আমার মন তেমনি এক আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেছে।
আমরা বন্ধু ছিলাম, খেলার সাথি ছিলাম। কত আগেকার ছিল এসব! কত আগেকার ঘটনা! এখন কোথায়, কোন স্বর্গে সব হারিয়ে গেছে। কিন্তু এতদিন পরে আবার তুই সব ফিরিয়ে এনেছিস, মা। আয় ছোট্ট মা, তুই আমার আশীর্বাদ নে। : তুমি কি সত্যি তাকে খুব ভালোবাসতে? খুব, খুব বেশি? : হ্যাঁ, মা তুই বুঝতে পাচ্ছিস না? সে আমাকে হুকুম দিত আর আমি মাথা পেতে নিতাম। পালন করতাম।
হ্যাঁ, মা তুই বুঝতে পাচ্ছিস না? সে আমাকে হুকুম দিত আর আমি মাথা পেতে নিতাম। পালন করতাম তার আদেশ।; আশ্চর্য, তুমি কী সুন্দর! তুমি আমাকে চুমু খাবে না? : নিশ্চয়ই। আনন্দের সঙ্গে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোকে চুমু খাব, মা। এই নে, এটা তোর জন্যে। আর এটা ওর জন্যে। তুই আমাকে অনুরোধ করেছিস, মা।
কেন তুই আমাকে হুকুম দিলি নে, আমার সেই মায়ের মতো। তাহলে আমি নিশ্চয়ই সে হুকুম পালন করতাম।ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি শুনে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। একটু পরেই তার কানে ভেসে এল সৈন্যদের সমবেত পায়ের শব্দ।: সৈন্য! সৈন্য, সৈন্যরা সব আসছে। আমি ওদেরকে দেখব।: অবশ্যই দেখবি মা। কিন্তু এক মুহূর্ত অপেক্ষা কর। আমি তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি, এটা তুই নে।
সহসা একজন অফিসার ঘরে প্রবেশ করল। ঈষৎ মাথা নত করে বলল, ধর্মাবতার, ওরা এসেছে। তারপর আবার মাথা একটু নত করে চলে গেল।রাষ্ট্রপতি অ্যাবিকে ছোট্ট তিনটি সিল-করা বাক্স দিলেন। এর মধ্যে দুটো সাদা আর একটি টকটকে লাল। আর এ লালটি কর্নেলদের মধ্যে যে পাবে তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।
: আহা, কী সুন্দর টকটকে লাল! এগুলো কি আমার জন্যে? : না মা, এগুলো অন্যের জন্যে। ওই পর্দার কোণটা সরিয়ে ফেল, মা। পর্দার ওপারে একটা ছোট্ট দরজা আছে। দরজার ভেতরে চলে যা—দেখতে পাবি, তিনটি লোক দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত তাদের পিছন দিকে বাঁধা। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই একটি হাতের মুঠো খোলা—ঠিক ছোট্ট পেয়ালার মতো।
এগুলোর একটি করে এক এক হাতে ফেলে দিয়ে তুই আমার কাছে ফিরে চলে আয়, মা।।রাষ্ট্রপতিকে একা ফেলে মুহুর্তে অ্যাবি সেই পর্দার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভক্তিআনত স্বগূতোক্তির মতো জেনারেল নিজে নিজেই এবার বলতে লাগলেন,
: চরম অনিশ্চয়তা আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার মধ্যে তার গোপন চির-শুভ-ইচ্ছের মতো এই চিন্তা আমার মাথার মধ্যে এল তাদের জন্যে, যারা তার ওপর আস্থাবান নয় কিন্তু তার সাহায্য চায়। তিনি জানেন, কার মৃত্যু হবে এবং এজন্যেই তার ছোট্ট প্রতিনিধি, নিস্পাপ দূতকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন তার ইচ্ছে পূরণের জন্যে। অন্যের ভুল হতে পারে কিন্তু তার ভুল হবে না। তার ভুল হয় না। আশ্চর্য, অচিন্ত্যনীয় তার পথ। সে-পথ জ্ঞানের। ধন্য হোক, তার পবিত্র নাম।
ছোট্ট নিস্পাপ পরীর মতো অ্যাবি পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মুহুর্তের জন্যে দাঁড়াল। খুব সতর্ক হয়ে, অদম্য কৌতূহল নিয়ে সে বন্দি সৈনিকদের স্থাণুর মতো শরীরগুলোর দিকে তাকাল। আর সহসা সমস্ত মুখমণ্ডল এক অপূর্ব আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দে অধীর হয়ে সে নিজের মনেই বলে উঠল, কী আশ্চর্য, এই তো ওদের মধ্যে বাবা রয়েছে।
ওই তো ওঁর পিঠ। সবচে সুন্দর সেই পিঠ। আনন্দে সে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। সিল-করা বাক্সগুলো খোলা হাতগুলোতে দিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল আর হাস্যোজ্জ্বল আনন্দে চিৎকার করে উঠল, : বাবা, বাবা, দেখ তোমাকে কী দিয়েছি! এটা আমি তোমার জন্যে এনেছি।
কর্নেল এবার নিজের হাতের সেই ভয়াবহ ছোট্ট উপহারটির দিকে তাকালেন। তারপর তার ছোট্ট নিস্পাপ হত্যাকারীকে টেনে আনলেন নিজের বুকের মধ্যে। ভালোবাসায়, শঙ্কায় আর সহানুভূতিতে তিনি কেঁপে উঠলেন। সমস্ত সৈনিক, অফিসার, মুক্ত কয়েদি—সবাই অবশ হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ এই করুণ মর্মান্তিক দৃশ্যের পরিব্যাপ্তি দেখে।
তাদের হৃদয় এই সকরুণ পরিস্থিতিতে সহানুভূতিতে ভরে এল। অশ্রুভারাক্রান্ত হল তাদের চোখ। কাঁদল সবাই। কিছুক্ষণের জন্যে একটা গভীর অবিস্মরণীয় ভক্তিপুত স্তব্ধতা নেমে এল সেখানে। তারপর প্রহরারত অফিসারটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে গেল বন্দি কর্নেলের দিকে।
তার কাধে হাত রেখে বলল, : শোক আমাকে আচ্ছন্ন করেছে সত্যি কিন্তু আমার কর্তব্য আমাকে করতেই হবে। আমাকে যে আদেশ… : আদেশ? কিসের আদেশ! বলল ছোট্ট এ্যাবি।: ওঁকে সরিয়ে নিতে হবে আমাকে। সত্যি আমি দুঃখিত।: ওঁকে সরিয়ে নিতে হবে? কোথায়? : হায় খোদা! ওকে সরাতে হবে… সরাতে হবে দুর্গের ওপাশে।
: না না, সে তুমি পারবে না! এবার চিৎকার করে উঠল অ্যাবি। আমার মা অত্যন্ত পীড়িত-বাবাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব।অ্যাবি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাবার পিঠের ওপর চড়ে বসে দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। বাবাকে নিবিড়ভাবে নিজের দিকে টেনে বলল, আমি তৈরি, বাবা, চল এবার আমরা যাই।
: না মা, আমাকে যেতে দেবে না। আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে।ছোট্ট অ্যাবি এবার বাবার পিঠ থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। নিজের চারদিকে তাকাল। তারপর দৌড়ে এসে অফিসারের সামনে গিয়ে ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে তার ছোট তুলতুলে পা দুটো মেঝেতে বারবার আঘাত করে চিৎকার করে বলে উঠল,
: তোমাকে আমি বলেছি, আমার মায়ের অসুখ। তোমার সে কথা শোনা উচিত। বাবাকে তোমার যেতে দিতেই হবে।: আহা, ছোট্ট শিশু! হায় খোদা, যদি পারতাম! কিন্তু ওঁকে যে আমায় নিয়ে যেতেই হবে।তারপর অফিসার পাহারারত তারপর অফিসার পাহারারত সৈন্যদের আদেশ দিলেন, ‘এটেনশন’। বিদ্যুতের মতো এবি সেখান থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার ফিরে এল মুহূর্তে।
নিজের ছোট হাত দিয়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেলকে জোর করে টেনে নিয়ে এল সেখানে।আর এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই সোজা হয়ে দাড়াল। অফিসাররা জেনারেলকে অভিবাদন জানালেন আর সৈন্যেরা রাইফেল নামিয়ে কুর্নিশ করল। অ্যাবি এবার জোরেলের দিকে তাকিয়ে বলল, : তুমি এদেরকে থামাও! আমার মা অত্যন্ত পীড়িত।
বাবাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। আমি সে কথা ওদেরকে বলেছি, কিন্তু ওরা আমার কথা শুনছে না। ওরা বাবাকে নিয়ে যেতে চায়। জেনারেল হঠাৎ হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার বাবা! ওই কি তোমার বাবা? ; কেন? নিশ্চয়ই! দেখছ না, বাবা বলেই-না সবচে সুন্দর লাল বাক্সটি আমি ওকে দিয়েছি।
একটা বেদনার্ত অনুভূতি জেনারেলের সমস্ত মুখমণ্ডলে রেখায়িত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, : হা প্রভু! এ কী আমি করেছি। মানুষের দ্বারা ঘটতে পারে, এমন নিষ্ঠুরতম কাজ আমি করেছি। নিশ্চয়ই শয়তান আমাকে পরিচালিত করেছে। প্রভু, আমার কী হবে! আমি কী করব? অ্যাবি এবার অধৈর্য হয়ে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল : কেন, তুমি ওদেরকে বল বাবাকে ছেড়ে দিতে।
তারপরই সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল— : বাবাকে ছেড়ে দিতে বল! তুমি-না একটু আগে বলেছিলে, তোমাকে হুকুম দিতে? আর আমি এখন যা করতে বলছি, তা তুমি করছ না! একটা নরম প্রীতির আলো সহসা সেই বৃদ্ধ বিক্ষত চেহারায় প্রথম উষার স্বর্ণাভার মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
জেনারেল এবার ছোট অ্যাবির মাথার উপর হাত রেখে বললেন, প্রভুকে ধন্যবাদ, এই আসন্ন দুর্ঘটনা থেকে—অচিন্তনীয় প্রতিজ্ঞা থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্যে। আয় মা, তার ইচ্ছায় তুই আমাকে সব বলে দিয়েছিস। তুই অনন্যা, মা।তারপর অফিসারদের বললেন, তোমরা এর আদেশ পালন কর। বন্দির অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে। একে মুক্ত করে দাও!
( সমাপ্ত )
Read more