মৌষলকাল – সমরেশ মজুমদার

মৌষলকাল – সমরেশ মজুমদার

০১-৫. কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি

কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সকাল থেকেই আকাশ কাদাটে মেঘ মেখে ঝিম ধরে আছে, গাছের পাতাগুলো মুখ নিচু করে, বাতাস পেলেই দুপাশে দুলছে, যে-কোনও মুহূর্তেই বৃষ্টি নামবে কিন্তু বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ঈশ্বরপুকুর লেনের এই বস্তির সকালটাও বেশ চুপচাপ। মাধবীলতা কয়েকদিন আগে বলেছিল, সারা বছর ধরে যদি এইরকম থমথমে বৃষ্টি না ঝরা মেঘ, চারদিক ছায়া ঘনিয়ে থাকত তা হলে শান্তিতে কাটানো যেত!

অনিমেষ অবাক হয়েছিল, তুমি রোদ্র চাও না?

না। মাথা নেড়েছিল মাধবীলতা।

সে কী!

রোদ উঠতেই এই বস্তির মানুষগুলো পালটে যায়। সারাক্ষণ চিৎকার, ঝগড়া, অশ্লীল কথার বন্যা বয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে তত লক্ষ করছি, ওসব বলার সময় কেউ মা-বোন-দিদির উপস্থিতি কেয়ার করে না। কিন্তু রোদ না উঠলে, আকাশে মেঘ থাকলে এদের চরিত্র বদলে যায়। তখন কেউ চেঁচামেচি, ঝগড়া করে না। মাধবীলতা বলেছিল।

জানালার পাশের তক্তপোশে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে মাধবীলতার কথাগুলো ভাবছিল অনিমেষ। কথাটা প্রায় সত্যি। অন্তত আজকের সকালে তো বটেই। এই সময় বস্তির কোথাও চিৎকার নেই। অথচ কাল রাত্রেও মনে হয়েছিল রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। বস্তির ওদিকের ঘরগুলোতে ইলেকট্রিকের কানেকশন দেয় সুরেন মাইতি। প্রতি পয়েন্টের জন্যে মাসে তিরিশ টাকা নেয়। ওর সঙ্গে ইলেকট্রিক কোম্পানির নাকি খুব ভাব আছে। তাই রাস্তার পেছনের লাইন থেকে হুক করে বিদ্যুৎ নিতে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। সেই বিদ্যুৎ ওদিকের ঘরে ঘরে বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করে প্রতি মাসে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা হল সুরেন মাইতি। কথাবার্তা চালচলন দেখে মনে হয় ও এই এলাকার মুখ্যমন্ত্রী। কখনও সখনও সুরেন মাইতি তার কাছে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, খুব খারাপ লাগে দাদা, আপনি এভাবে বসে গেলেন! সেদিন পার্টি অফিসে আপনার কথা বলছিলেন মিনিস্টার। ভুল রাজনীতি করে নিজের যে সর্বনাশ করেছিলেন তা শুধরে নেওয়ার প্রস্তাব নাকি দেওয়া হয়েছিল। আপনি রাজি হননি। এখন বলুন, কী লাভ হল তাতে?

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ভাবতে হবে।

ভাবুন। হেসে চলে গিয়েছিল সুরেন মাইতি।

আর একদিন দরজায় এসে পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল, আজ বিকেলে লোকাল পার্টি অফিসে মিনিস্টার আসছেন। আপনাকে চা খেতে ডেকেছেন। যাবেন তো?

দেখি।

এতে দেখার কী আছে? কজনকে মিনিস্টার চা খেতে ডাকে বলুন?

পায়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

দেখুন।

লোকটাকে একদম পছন্দ না হলেও নিজেকে চেপে রাখে অনিমেষ। আগে হলে মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দিত। তাতে লোকটার কী প্রতিক্রিয়া হত তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। বয়স এবং অর্থাভাব মানুষকে দুর্বল করে। এই সত্যিটা মেনে না নিয়ে কোনও উপায় নেই। গত রাত্রে ঝামেলাটা চরমে উঠেছিল। বস্তির দুটি ঘরের বাসিন্দা বিদ্যুতের দাম দিতে পারেনি বলে সুরেন মাইতির লোক কানেকশন কাটতে গিয়েছিল। যাদের ঘর তারা বাধা দিয়েছিল। লোকটা পার্টি অফিসে গিয়ে সুরেন মাইতিকে ব্যাপারটা জানায়। রাত এগারোটা নাগাদ দশজনের দলটা বস্তিতে ঢোকে। বেছে বেছে তারা ওই দুটি ঘরের বাসিন্দাদের বাইরে টেনে বের করে বেধড়ক মারে। ঘরের ভেতর যা ছিল তা আর আস্ত রাখেনি। বস্তির অন্য বাসিন্দারা এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাধা দিতে পারেনি। চারজনের হাতে অস্ত্র ছিল। অবাধ্য হওয়ার জন্যে শিক্ষা দিয়ে কয়েকটা বোমা ফাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে গিয়েছিল রেললাইনের দিকে। তার মিনিট দশেকের মধ্যে ছুটে এসেছিল সুরেন মাইতি সদলে। এসে নাটক করল। চেঁচিয়ে ভর্ৎসনা করল ভিড় করে আসা জনতাকে। বাইরের কিছু গুন্ডা এসে বস্তিতে হামলা করে গেল আর সবাই কী করে মুখ বুজে সেটা সহ্য করল সুরেন মাইতি ভেবে পাচ্ছে না। যে দুটি ঘরের বাসিন্দারা আঘাত পেয়েছিল তাদের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার ডাকিয়ে আনল সে। এই ভূমিকা দেখে জনতা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল।

জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হাসল অনিমেষ। সেই কবে থেকে একই খেলা চলে আসছে। মাঝে মাঝে তার মনে হত এই বস্তি, পার্টির নিচুতলার নেতাদের কীর্তিকাহিনি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের কানে পৌঁছোয় না। যাদের সঙ্গে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছে তাদের অনেকেই তো হয় কেন্দ্রীয় নেতা নয় মন্ত্রী। কিন্তু ক্রমশ ধারণা বদলে যাচ্ছে তার। আর যাই হোক নেতারা মূর্খ বা বধির নয়। এতদিনে খবরগুলো তাদের অজানা থাকতে পারে না।

দরজায় শব্দ হল। তারপরই প্রশ্ন, এখনও শুয়ে আছ?

অনিমেষ চোখ ফেরাল। মাধবীলতা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাজারের ব্যাগ।

অনিমেষ উঠে বসল, কী করব! এরকম ওয়েদারে কিছুই তো ভাল লাগে না।

ছেলে উঠেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

বোধহয় না। সাড়া পাইনি।

কাল কখন ফিরেছে জানো?

না।

পৌনে একটায়। কিছু খেল না, বলল ঘুম পাচ্ছে।

অনিমেষ কিছু বলল না। তক্তপোশ থেকে নামতে নামতে দেখল মাধবীলতা বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সে চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলের সব কালো মুছে গেছে। আজকাল দাড়ি কামাতেও ইচ্ছে হয় না কিন্তু মাধবীলতার তাড়ায় একদিন অন্তর কামাতে হয়। কিন্তু সে গোঁফ রেখেছে, কঁচাপাকা গোঁফ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। মাধবীলতা পালটে গিয়েছে অনেক। শরীর খুবই শীর্ণ হয়েছে, মুখের আদল বদলে গিয়েছে। চুলে সাদা ছোপ থাকলেও তা আগের মতন কোমরের নীচে থমকে আছে। এখন সে হাঁটে খুব শ্লথ গতিতে। অনিমেষের সন্দেহ হয় মাধবীলতা পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওকে অনেকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে সে, কিন্তু মাধবীলতার এক কথা, আমার কিছুই হয়নি। খামোক ডাক্তারকে পয়সা দিতে কেন যাব? অথবা, শরীর থাকলেই অসুখ থাকবে, যে অসুখ ঘুমিয়ে আছে, কোনও ঝামেলা করছে না, খুঁচিয়ে তাকে জাগাবার কোনও মানে আছে?

অনিমেষ ক্রাচ বগলে নিয়ে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে চিলতে উঠোনে নামল। এই বস্তির সেরা এলাকা এটা। প্রথমে যে বারোয়ারি বাড়ির ছোট্ট ঘরে ছিল ওরা তা থেকে একসময় সরে এসে এই বাড়িতে থাকছে কয়েক বছর আগে থেকে। দুটো ঘর, একচিলতে উঠোন, রান্নাঘর, আলাদা কল-পায়খানা। বস্তির মালিকের বদান্যতায় অনেক কম ভাড়ায় পেয়ে গেছে অর্ক। ফলে অন্যদের সঙ্গে একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে। একটু আড়াল, যার কারণে স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। কলের জলে মুখ ধুয়ে, প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে সে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

রান্নাঘর থেকে মাধবীলতার গলা ভেসে এল, ওকে ডেকো না!

কটা বাজে এখন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

যাই বাজুক। সারাদিন পরিশ্রম করে অত রাত্রে এসেছে, ঘুমোতে দাও।

চা করবে নাকি?

একটু দেরি হবে।

তা হলে আমি কালীবাবুর দোকান থেকে ঘুরে আসি।

যাও, কিন্তু কোনও মন্তব্য কোরো না।

কীসের মন্তব্য?

কাল রাত্রে সুরেন মাইতিরা যা করেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন ওখানে কথা হচ্ছে। সেসব কথার মধ্যে তোমার যাওয়ার দরকার নেই।

মাধবীলতা বলল।

অনিমেষ হাসল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছ?

আশ্চর্য! আমি কিছুই করি না। কোনওদিন কিছু করেছি? ওখানে পাঁচজনের সামনে যা বলবে তা রিলে তো হবেই, তার সঙ্গে অনেক রং মিশে নানান জায়গায় পৌঁছে যাবে। তাই তোমাকে সাবধান করলাম। স্বাধীনতা হরণ করার আমি কে? মাধবীলতার গলায় বিরক্তি স্পষ্ট। ঘর থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে উঠোনের খোলা দরজা দিয়ে গলিতে পা বাড়াল অনিমেষ। দুধারে একতলা টিনের চালাওয়ালা বাড়ি, উনুনের ধোঁয়া, বাচ্চাদের বসে থাকার মধ্যে দিয়ে বস্তির সামনে চলে এল অনিমেষ। কালীবাবুর চায়ের দোকানে এখন একদম ভিড় নেই। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। রোজ সকাল দশটা পর্যন্ত ভিড় উপচে পড়ে। খবরের কাগজ পড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। এখন যে দুজন বসে আছে তাদের বিলক্ষণ চেনে অনিমেষ। দুজনই বাড়ির দালাল। কাগজ মুখে নিয়ে বসে আছে।

বেঞ্চিতে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ খদ্দেরদের দেখা নেই কেন?

কালীবাবু নেই, তার পুত্রবধূ এখন দোকান চালায়। বলল, কী জানি!

চা পাওয়া যাবে?

দিচ্ছি!

অনিমেষ চুপ করে গেল। কালীবাবুর পুত্রবধূর বয়স বেশি নয়। স্বামী কাঠের কাজ যতটা না করে তার চেয়ে বেশি চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে। ফলে বউটির কথাবার্তায় অদ্ভুত নিরাসক্তি এসে গেছে। চেঁচিয়ে বলল, চায়ের দাম বাড়ছে।

কত?

তিন টাকা। আপনি তো বাজারে যান না, মাসি যায়। মাসিকে জিজ্ঞাসা করলে জানবেন জিনিসপত্রের দাম কীরকম বেড়ে গেছে। আমি তো চায়ের সঙ্গে চামড়ার গুঁড়ো মেশাতে পারব না। নিন। এক গ্লাস চা এগিয়ে ধরল বউটা।

উঠে গিয়ে সেটা নিতেই একজন দালাল কাগজ এগিয়ে ধরল।

পড়বেন?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না

সে কী!

কী হবে পড়ে? সেই একই খবর। খুন, জখম, রাহাজানি আর মিথ্যে কথার ফুলঝুরি। সাত দিন আগের কাগজকে তারিখ বদলে আজকের বলে চালালে কোনও তফাত পাব না। চায়ে চুমুক দিল অনিমেষ। চিনি কম। চাইতে গিয়ে থমকে গেল সে। বাড়িতে চা বানালে মাধবীলতা তত এর চেয়ে কম চিনি দেয়। বলে, চায়ের চিনি রক্তে জমুক তা নিশ্চয়ই চাও না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের মনে হাসল অনিমেষ। ষাট পেরিয়ে গেলেও শুধু পা ছাড়া এই শরীরের আর কোথাও রোগ ঢুকেছে বলে মনে হয় না। বাবা বা দাদুর রক্তে সুগার ছিল বলে ছেলেবেলায় সে শোনেনি। ওটা উত্তরাধিকারসূত্রে আসে অথবা টেনশনের কারণে তৈরি হয়। এখন সে যে জীবনযাপন করে তাতে টেনশনের কণামাত্র নেই। তবে খবরের কাগজ পড়লে মনখারাপ হয়ে যায়। একটু-আধটু রাগও হয়, কিন্তু সেটাকে নিশ্চয়ই টেনশন বলে না।

দুটো ছেলে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। একজন কালীবাবুর পুত্রবধুকে বলল, জলদি, দুটো চা ছাড়ো।

পাঁচটা টাকা বের করো। দিচ্ছি। কাল থেকে ছয় নেব।

দ্বিতীয়জন হাসল, পাগল নাকি!

পুত্রবধূ বলল, মানে?

বেলগাছিয়াতে কেউ আমাদের কাছে চায়ের দাম নেয় না।

যারা নেয় না তাদের কাছে যাও। আমার দোকানে সুরেনদা পর্যন্ত চা কিনে খায়।

সুরেনদা চা কিনে খায়? হি হি হাসল প্রথমজন, আমাদের চমকিয়ো বউদি।

পুত্রবধু এতক্ষণ বসে ছিল, এবার উঠে দাঁড়াল, আমি চমকাচ্ছি? ডাকব সুরেনদাকে?

সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেল ছেলে দুটো। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বলল, ফোট। দ্বিতীয়জন বলল, না। বউদির হাতের চা খেয়ে যাব।

পকেট থেকে খুচরো বের করে গুনে সামনের পাটাতনে রাখল, দিন বউদি।

অনিমেষ ওদের দেখছিল। কী দ্রুত নিজেদের বদলে ফেলতে পারে। চায়ের গ্লাস নিয়ে ওরা খানিকটা দূরে সরে যেতেই সে কালীবাবুর পুত্রবধূকে বলল, তোমার বেশ সাহস আছে।

সাহস না থাকলে এই কাকগুলো ঠুকরে শেষ করে দেবে কাকা। বউটি বলল।

কাকা! আজকাল কাকা শুনলে ভাল লাগে। বেশিরভাগ সময় হয় দাদু নয় জেঠু শুনতে হয়, তার তুলনায় কাকা শুনলে নিজেকে কমবয়সি বলে মনে হয়।

এইসময় মহেন্দ্র ঘটককে দেখা গেল। একসময় অভিজাত পরিবার বলে এই পাড়ার লোক ওঁদের খুব সম্মান করত। এখনও সাতসকালেও আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বের হন। হাতে দামি লাঠি থাকে। ওঁর বাবা তো

বটেই উনিও এককালে কংগ্রেসি ছিলেন। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর রাজনীতি ছেড়ে দিলেও মুখ খুললেই ইতিহাস বলেন। সেইসঙ্গে খিস্তিখেউড় করতে দ্বিধা করেন না। দোকানের সামনে এসে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে অনিমেষবাবু, কাল রাত্রে নাকি সুরেনের লোক দাঁত উপড়ে দিয়ে গেছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, যখন সবই জানেন, তখন প্রশ্ন করছেন কেন?

কনফার্ম করার জন্য প্রশ্ন করছি। আপনার গায়ে বিছুটি লাগছে কেন?

কালীবাবুর পুত্রবধূ গলা তুলল, দাদু, আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলবেন না।

কেন? এই রাস্তাটা তোমার কাকার নাকি! শোনো হে, তোমার শ্বশুরমশাই, আমাদের কালীপ্রসাদ, জীবনে কখনও আমাকে না বলেনি। এসেছিলাম ভাল করতে–! হ্যাঃ। এইজন্যে বলে কখনও কারও ভাল কোরো না। লাঠির ওপর ভর দিয়ে বৃদ্ধ মহেন্দ্র ঘটক চলে গেলেন ট্রামরাস্তার দিকে।

বাড়ির দালালদের একজন মন্তব্য করল, আজ কী হল? বুড়োর মুখে খিস্তি শুনলাম না।

চায়ের দাম দিয়ে ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ। ঠিক তখনই বস্তিতে ঢুকতে গিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল খবরের কাগজের হকার শ্যামল। এগিয়ে এসে বলল, জেঠু, আপনার একটা চিঠি ভুল করে আমাদের ঘরে দিয়ে গেছে। একটু দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।

মিনিট তিনেকের মধ্যে শ্যামল খামটা নিয়ে এসে অনিমেষের হাতে দিল।

কবে পেয়েছিলে এটা? খামটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল অনিমেষ।

গতকাল রাত্রে চিঠির বাক্সে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমাদের ওদিকের বস্তিতে তো একটাই চিঠির বাক্স। ভুল করে ওখানেই ফেলে গেছে। পিয়ন। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি।

শ্যামল দেরির কারণ ব্যাখ্যা করল।

অনেক ধন্যবাদ ভাই। অন্য কেউ হলে হয়তো এটা পাওয়াই যেত না।

অনিমেষ হাসলে শ্যামল আবার বস্তির ভেতর ঢুকে গেল। খামটা দেখল অনিমেষ। তার নাম-ঠিকানা লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, মহিলার হাতের লেখা। পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প দেখতে গিয়ে হতাশ হল। কলকাতারটা স্পষ্ট কিন্তু অন্য স্ট্যাম্প একদম ঝাপসা, কোথায় পোস্ট হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধল অনিমেষের, ওটা আপাতত পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। কিন্তু কে তাকে চিঠি দিল? সে মনে করতে পারছিল না শেষবার কবে তার নামে চিঠি এসেছে! শুধু তার নামে কেন, মাধবীলতা স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পরে কিছু কাগজপত্র ডাকে এসেছিল। এ ছাড়া ওকেও চিঠি লেখার কেউ পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয় না। আর অর্ক! ওর পকেটের মোবাইল কথা বলা এবং চিঠি লেখার দুটো কাজই করে দেয়। খাম পোস্টকার্ডের দরকার পড়ে না।

.

০২.

বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল অনিমেষ, পেছন থেকে একটি ছেলে জেঠু জেঠু বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়ালে ছেলেটি বলল, আপনাকে একটু দাঁড়াতে বলল।

কে?

সুরেনদা।

অনিমেষ মুখ তুলে তাকাতেই দূরে দাঁড়ানো সুরেন মাইতিকে দেখতে পেল। তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সে তাকালে হাত নেড়ে থামতে বলল। কথা শেষ করে এগিয়ে এল সুরেন মাইতি, গুড মর্নিং। চা খেতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

কাল রাত্রের ঘটনা শুনেছেন?

হ্যাঁ।

কী শুনেছেন? থামল সুরেন মাইতি।

ওপাশের দুটো ঘরে ভাঙচুর হয়েছিল। এইটুকু।

তা হলে এর বেশি কিছু শোনেননি! কিন্তু আমি শুনেছি। আমি নাকি ইলেকট্রিকের ভাড়া না পেয়ে ক্যাডার দিয়ে ওদের ঘরে হামলা করেছি, ওদের মেরেছি। আমি একটা কথা বুঝতে পারি না, এরা আমাকে কী ভাবে? আমি উজবুক? যে ডালে বসে আছি সেই ডাল কাটব? যাদের সঙ্গে থাকি, যাদের ভোটে আমার দল পাওয়ারে আছে তাদের ঘর ভাঙব? আরে, মুখের ওপর কিছু বলবে না কিন্তু ব্যালটে যখন ছাপ মারবে তখন তো আমি সামনে থাকব না। দুজনের ঘর ভাঙলে দুহাজার ভোট আমাদের বিরুদ্ধে যাবে। জেনেশুনে এই বোকামিটা আমি করব? বলুন? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

করা উচিত নয়।

একশোবার। খবর পেয়েই পার্টির মিটিং ছেড়ে আমি দৌড়ে এসেছিলাম। আমিই যদি ওটা করতাম তা হলে কি আসতাম? আপনি বলুন!

আপনার কথায় যুক্তি আছে। অনিমেষ ফিরে যাওয়ার জন্যে পাশ ফিরতেই সুরেন মাইতি বলল, এখন কথা হচ্ছে, হামলা যখন হয়েছে, তখন

কারা সেটা করল?

একটু অবাক হল অনিমেষ। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সুরেন মাইতি মাথা নাড়লেন, কাল রাত থেকে চেষ্টা করছি কারা কাজটা করল তা জানতে। আজ একটু আগে খবরটা পেলাম।

কী খবর?

হরিনাথ আর ক্ষিতিশ, ওই দুঘরে যারা থাকে, রোজ মালগাড়ির টানা মাল ক্যারি করে পৌঁছে দিত আড়তে। তার জন্যে দুজনে পার ট্রিপ দুশো করে পেত। কদিন থেকে নাকি ওরা ক্যারি করার সময় খানিকটা মাল সরিয়ে অন্যদের বিক্রি করে দিত। সেটা ধরতে পেরে ওয়াগন ব্রেকাররা যার কাছে খাটে, সে নোক পাঠিয়ে কাণ্ডটা করেছে। সুরেন মাইতি হাসল।

সে কী!

বুঝুন কাণ্ড। এলাকায় থেকে যাদের ভাল ভাবি তারা বাইরে গিয়ে এই কাণ্ড করছে তা বুঝব কী করে? কাল যে এখানে খুন হয়ে যায়নি তাই ওদের ভাগ্য। সুরেন মাইতি বলল, আমি কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইনি। কার মেয়ে আয়ার কাজ করতে যাওয়ার নাম করে শরীর বেচে পয়সা কামাচ্ছে তাতে আমার কী? যতক্ষণ না সেই সমস্যা সে এলাকায় টেনে আনছে ততক্ষণ আমার মুখ বন্ধ থাকবে। ঠিক কি না? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তার আর ওখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। সে বুঝতে পারছিল লোকটা সমানে মিথ্যে বলে যাচ্ছে কিন্তু সেটা বললে বোকামি করা হবে। এতদিনে অনেক দেখার পর এই সত্যিটাকে মানতে বাধ্য হচ্ছে সে।

দূরে গাড়ির আওয়াজ হতে সুরেন মাইতি বলল, এসে গেছে।

কে?

পুলিশ। আমিই খবরটা দিয়েছি। যারা মার খেয়েছে তারা থানায় যায়নি কেন, আমিই পুলিশকে বলেছি এসে তদন্ত করতে। সুরেন মাইতির কথা শেষ হতেই গাড়িটা এসে দাঁড়াল। আজকাল পুলিশের গাড়ি দূর থেকে দেখলে চেনা যায় না। সেই জিপগুলোকে বোধহয় আর ব্যবহার করা হয় না।

একটা আধুনিক গাড়ি থেকে নেমে এলেন যে ভদ্রলোক তার পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। হাতজোড় করে বললেন, সুপ্রভাত সুরেনবাবু। ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল?

ওই ওপাশের গলির ভেতর।

হরিনাথ এবং ক্ষিতিশকে এখন পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ। মনে হয় ওরা ঘরেই আছে। সুরেন মাইতি অনিমেষকে দেখাল, চেনেন?

মাথা নাড়লেন দুপাশে ভদ্রলোক।

সুরেন মাইতি বললেন, ইনি অনিমেষ মিত্র। এককালে বিখ্যাত নকশাল নেতা ছিলেন। আমাদের মন্ত্রীদের অনেকেই ওঁর বন্ধু ছিলেন তার আগে। দাদা, উনি থানার বড়বাবু।

নকশাল? এখনও ওসব করেন নাকি?

ওই আন্দোলন এখনও আছে নাকি? অনিমেষ না জিজ্ঞেস করে পারল না।

চেহারা বদলেছে, রং পালটেছে। তারা এখন মাওবাদী হয়েছে।

আমি ঠিক জানি না। আপনার পূর্বসূরিরা আমার এই পা-কে অকেজো করে দেওয়ার পর আর ওইসব নিয়ে ভাবার আগ্রহ চলে গেছে। অনিমেষ বলল।

সুরেন মাইতি বললেন, দাদাকে তো ছোট্টবেলা থেকে দেখছি, রাজনীতি থেকে সাত হাত দূরে থাকতেন। এলাকার বাইরে খুব কম যান। একসময় তো আমাদের পার্টিতে ছিলেন, তাই কতবার বলেছি, পার্টি অফিসে আসুন, আসেননি। মন্ত্রী খবর দিলেও যান না। থাকগে, চলুন স্যার, আপনাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাচ্ছি।

ওরা এগিয়ে গেলে অনিমেষ দেখল একটু একটু করে মানুষ বেরিয়ে আসছে বস্তির ভেতর থেকে। কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। ওরা ওপাশের গলিতে ঢুকতেই ভিড় পেছন পেছন চলল।

সুরেন মাইতি বুদ্ধিমান লোক। নিজের মুখোশটাকে মুখ প্রমাণ করতে থানার বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। বড়বাবু নিশ্চয়ই খুব জেরা করবেন হরিনাথ আর ক্ষিতিশকে। চোরাই মালের ক্যারিয়ার হওয়ার জন্যে খুব ধমকাবেন। হয়তো এও বলবেন, সুরেন মাইতির অনুরোধে এবার ছেড়ে দিচ্ছেন ওদের। কাজটা যে ওয়াগন ব্রেকাররা করিয়েছে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এইসব বলে যখন তিনি চলে যাবেন, তখন গোটা বস্তির লোক সুরেন মাইতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে।

কাকা, ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন?

অনিমেষ তাকাল। ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ। বি. এ. পাশ করে টিউশনি করে সারাদিন। সন্ধ্যায় কংগ্রেসের পার্টি অফিসে গিয়ে বসে। মাঝে মাঝে আসে তার কাছে। গাঁধী এবং মার্কসের মধ্যে তুলনা করে কথা বলে। বেশ সিরিয়াস ধরনের ছেলে।

এখন আর আমি কিছু বুঝতে চাই না বিশ্বজিৎ। হাসল অনিমেষ।

এটা কী বলছেন? আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে নেই। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আপনারও তো একটা ভূমিকা আছে।

অনিমেষ জবাব দিল না। এখনও রোদ ওঠেনি। সে আকাশের দিকে তাকাল।

জানি, আপনি ভোট দেন না। গত লোকসভা নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তার মানে হল, ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েনি। অঙ্কটা বিশাল। কিন্তু ওই ভোট না দেওয়া মানুষগুলোও কিন্তু ভারতের নাগরিক। বিশ্বজিৎ গম্ভীর গলায় বলল।

তুমি কী বলতে চাইছ?

সুরেন মাইতি একজন চুনোপুঁটি নেতা। কিন্তু দেখুন, তার কাছেও পুলিশ কীরকম বিক্রি হয়ে গেছে। ও যা ভাববে পুলিশ তাই বলবে।

তোমার মতো সবাই তো দেখছে, ভাবছে। তা হলে বামবিরোধীরা ভোট পায় না কেন?

সত্যি কথা বলব?

অনিমেষ তাকাল।

বিরোধী দলকে কেউ বিশ্বাস করে না। আমাদের একজন নেতা নেই যার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। থাকলে ওই ৪৬ শতাংশ মানুষের অর্ধেক ভোট বাক্সে পড়ত। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেত শাসকরা। আচ্ছা, চলি।

বিশ্বজিৎ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

ধীরে ধীরে বাড়িতে ফিরে এল অনিমেষ। উঠোনে পা রাখতেই দেখল অর্ক বাইরে যাওয়ার পোশাকে বেরিয়ে আসছে ওর ঘর থেকে।

বেরুচ্ছিস নাকি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অর্ক বলল, একটু দেরি হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কখন ফিরবি? দুপুরে একবার ঘুরে যাব। অর্ক উঠোনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

ওপাশের বস্তিতে সুরেন মাইতি থানার বড়বাবুকে নিয়ে ঢুকেছে। ওদিকে যাস না। অনিমেষ কথাগুলো বললে অর্ক কাধ নাচিয়ে বেরিয়ে গেল। বারান্দার চেয়ারে বসল অনিমেষ। একদম বদলে গিয়েছে ছেলেটা। এই বস্তির কারও সঙ্গে মেলে না, কথা বলে যতটা সম্ভব না বললে না, ততটাই।

চা খেয়েছ? মাধবীলতার গলা ভেসে এল রান্নাঘর থেকে।

হ্যাঁ। কাল থেকে চায়ের দাম বাড়ছে। অনিমেষ বলল।

অনেক আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। বাজারে গেলে বুঝতে পারতে জিনিসপত্রের দাম কোথায় পৌঁছেছে। আমাদের না হয় ছেলের রোজগার আছে। স্কুল থেকে পাওয়া টাকার ইন্টারেস্ট আছে কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, যাদের মাসিক রোজগার পাঁচ-ছয় হাজার তারা কী করে সংসার চালাচ্ছে। বলতে বলতে গরম রুটি আর আলু-পেঁয়াজের চচ্চড়ি প্লেটে নিয়ে বেরিয়ে এল মাধবীলতা, নাও।

অনিমেষ প্লেটটা ধরে বলল, তোমারটা?

কাল থেকে ঢেকুর উঠছে। আমি মুড়িজল খাব।

আমাকেও তাই দিতে পারতে। এসব করার দরকার ছিল না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, বাব্বাঃ। এত প্রেম! তা হলে তুমিও ঢেকুর তোলো, শুনি।

বললেই ঢেকুর তোলা যায় নাকি! এত করে বলছি, চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

প্লিজ আর উপদেশ দিয়ো না।

তোমার মুড়িজল নিয়ে এসো এখানে।

মাধবীলতা তাকাল। তারপর চলে গেল রান্নাঘরে। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল। ওকে এক বাটি জলে মুড়ি ডুবিয়ে আনতে দেখে রুটিতে হাত দিল। পাশের চেয়ারে বসে চামচে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে মাধবীলতা বলল, এটা খেতে তো আমার ভালই লাগে।

খবরের কাগজ দেয়নি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

দিয়েছিল। অর্ক ঘরে রেখে গেছে। আনব?

না। থাক। পরে পড়ব। তারপর সে সুরেন মাইতির সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা মাধবীলতাকে বলল। সব শুনে মাধবীলতা বলল, এইটেই তো স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক?

নয়তো কী? তুমি যদি তখন পড়তে পড়তে পার্টি ছেড়ে না-দিতে তা হলে নিশ্চয়ই এখন মন্ত্রী হতে হলে তুমি আরও বড়মাপের মিথ্যাচার করতে।

সেটাও স্বাভাবিক হত।

আমিও করতাম! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল।

শেয়ালদের দলে বাঘ যেমন থাকে না বেড়ালও থাকতে পারে না। মাধবীলতা বলল, তুমি সুরেন মাইতিকে মনের কথা বলে ফেলোনি তো?

হাসল অনিমেষ, নাঃ! আমি এখন অনেক বুদ্ধিমান হয়েছি।

হলে ভাল। অনেক লড়াই করার পর এখন স্বস্তিতে আছি। অর্ক বলত, চলো, কলকাতার কাছাকাছি অল্প দামে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাই। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর আমার ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করে না। এই উঠোন, রান্নাঘর, একদম আলাদা থাকতেই ভাল লাগে। বেশ মফসসল মফস্সল বলে মনে হয়। মাধবীলতা বলল।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু ছেলেটার কথা ভাবো।

ভেবে যখন সুরাহা করতে পারব না তখন মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?

ওরা এভাবেই আলাদা থাকবে? তার চেয়ে কোর্টে গিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলে অনেক ভাল হত। মেয়ে ডিভোর্স দেবে না তাই ছেলেও ওই পথে হটবে না। অদ্ভুত।

এই সময় কয়েক ফোঁটা জল আকাশ থেকে নেমে এল উঠোনে, ঘরের চালে। মাধবীলতা বলল, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নামল।

কোথায় বৃষ্টি! দ্যাখো, আর জল পড়ছে না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠতে গিয়ে মনে পড়ল তারা বলল, আমার পকেট থেকে খামটা বের করো তো।

কী খাম?

জানি না, শ্যামলদের লেটার বক্সে পিয়ন রেখে গিয়েছিল। খুলে দ্যাখো কে পাঠিয়েছে।

মাধবীলতা মুড়ির জল খেয়ে নীচে বাটি রেখে অনিমেষের পকেট থেকে খামটা বের করল। উলটে পালটে দেখে বলল, কালই তো এসেছে।

হাত ধুতে ধুতে অনিমেষ বলল, মেয়েলি হাতের লেখা, দ্যাখো।

মাধবীলতা খামের মুখ ছিঁড়ে সাদা কাগজটা বের করে চোখ রাখল। পড়ে নিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।

কাছে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কে লিখেছে?

ছোটমা।

অ্যাঁ। ছোটমা? কী লিখেছেন?

পড়ো।

তুমিই পড়ো।

মাধবীলতা পড়ল। স্নেহের অনিমেষ, স্নেহের মাধবীলতা। দীর্ঘকাল তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বড়দিদির কাজের সময় তোমরা এসেছিলে, ফিরে গিয়ে পৌঁছানোর সংবাদ দেওয়ার পর আর কোনও চিঠি লেখোনি। এতকাল এই বাড়ি ভূতের মতো আগলে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে বাড়িটির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আমার অবস্থাও করুণ। লোকজন এসে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে। জানি না এই চিঠি তোমরা পাবে কিনা। যদি পাও তা হলে কি একবার এখানে আসতে পারবে? তোমরা এবং অর্ক আমার আশীর্বাদ জেনো। ইতি, ছোটমা।

অনিমেষ বিড়বিড় করল, আমি জানতাম এই দিনটা একদিন আসবে।

মাধবীলতা কাগজটা ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে বলল, সত্যি তো, আমাদের খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটের দেওয়া টাকায় বেশ চলে যাবে বলেছিলেন, তাই বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ওঁরও তো বয়স হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, দাদু এবং পিসিমা চলে যাওয়ার পর ওই বাড়ির কথা আর ভাবিনি, টানও চলে গিয়েছিল। তা ছাড়া, আমরা গিয়েই বা কী করতে পারি।

যেতে লিখেছেন– মাধবীলতা থেমে গেল।

লিখে দাও, উনি যেন বাড়িটা বিক্রি করে দেন। আমাদের আপত্তি নেই।

সেটা চাইলে তো নিজেই করতে পারেন। আমাদের চিঠি লিখবেন কেন?

কিন্তু আমরা ওখানে গিয়ে কী করব?

হয়তো কিছুই করব না। কিন্তু একদিন যোগাযোগ না রেখে যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তো কিছুটা করা হবে। মাধবীলতা উঠল, আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। যদি টিকিট পাও তা হলে আজই চলে যাও।

আমি? একা?

তুমি তো একাই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে কলকাতায় এসেছিলে?

তখন আমি তরুণ। আর এখন? তুমি যাবে না কেন?

আমি গেলে ছেলের কী হবে? ওর খাওয়া দাওয়া–।

আশ্চর্য! একটা মাঝবয়সি ছেলের জন্যে তোমাকে থেকে যেতে হবে? না, তুমি সঙ্গে না গেলে আমি যাব না। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

এই সময় ভেতরের ঘরে মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা দ্রুত ঘরে ঢুকে সেটাকে তুলে নিয়ে অন করল, হ্যালো। বল। দুপুরে আসতে পারবি না? কেন? ও। ঠিক আছে। আর হ্যাঁ, তুই দুটো ট্রেনের টিকিট কেটে আনতে পারবি? জলপাইগুড়ির, সঙ্গে টাকা আছে! জোগাড় করে নে, কাল দিয়ে দিবি। হ্যাঁ, কালকের টিকিট। রাখছি।

বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতা বলল, ছেলে ফোন করেছিল।

তোমার কথায় সেটা বুঝলাম। কিন্তু তুমি কালই টিকিট কাটতে বললে কেন?

ওই চিঠি পড়ার পরে দেরি করার কোনও যুক্তি আছে?

যাওয়ার আগে তো কিছু কাজ থাকে। অর্ক আসুক, ওর সঙ্গে কথা বলা তো দরকার। টাকাপয়সার ব্যাপারটাও তো আছে। অনিমেষ বলল।

তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। মেঝে থেকে প্লেট বাটি তুলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল মাধবীলতা।

এই সময় উঠোনের দরজায় শব্দ হল। বাসনগুলো নামিয়ে রেখে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কে? ভেতরে এসো।

মেয়েটি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে উঠোনে কয়েক পা এগোল, মাসিমা আর পারছি না। মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। ভগবান! ঠোঁট কামড়াল মেয়েটি।

আবার কী হল? মাধবীলতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমাকে শেষ না করে ও ছাড়বে না।

তোকে এর আগেও বলেছি সুজাতা, থানায় যা। ওর বিরুদ্ধে ডায়েরি কর।

গিয়েছিলাম। ডায়েরি নেয়নি। মেয়েটি কেঁদে ফেলল।

কেন?

আমরা স্বামী-স্ত্রী নই শুনে এমন হাসাহাসি করল যে পালিয়ে এসেছিলাম। ব্যঙ্গ করছিল, যার সঙ্গে ঘর ছেড়েছ এখন সে-ই তোমার শত্রু হয়ে গেল! জিজ্ঞাসা করল, কী করো তুমি? বললাম, কারখানায় কাজ করি। বিশ্বাসই করল না। সুজাতা বলল, আমি কী করব?

এখন ও কী চাইছে?

রোজ সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসে মদ গিলবে আর সমানে খিস্তি করে যাবে। কিছু বললেই চেঁচাবে। তারপর জোর করে দশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। ওর পকেটে অনেক টাকা থাকলেও দশ টাকা ওর চাই-ই। আমি কারখানা থেকে রোজ ষাট টাকা পাই। তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে খেতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার ওপর এই অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না।

সুজাতা কথা শেষ করতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ কাজে যাওনি?

না। আজ কারখানা বন্ধ। মালিক হাসপাতালে ভরতি হয়েছে কাল। সুজাতা বলল।

বন্ধ কারখানা যদি না খোলে–? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি জানি না কী হবে। দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা।

এখন একটা কথা বল তো। মুখ থেকে হাত সরা–!

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। আঙুল দিয়ে জল মুছল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তুই কি এখনও লোকটাকে ভালবাসিস?

দ্রুত মাথা নাড়ল সুজাতা, না। একদম না।

ঠিক আছে এখন যা। বিকেল বিকেল এখানে চলে আসিস ঘরে তালা দিয়ে। আশপাশের লোকজন যেন না জানতে পারে তুই এখানে এসেছিস। যা।

সুজাতা মাথা নেড়ে চলে গেল।

অনিমেষ বলল, একদিন লুকিয়ে রেখে তুমি ওর কী উপকার করবে? এইসব মেয়েরা কেন যে ঘর ছাড়ার আগে ভালবাসার মানুষটাকে চিনতে পারে না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হাসছ যে? মাধবীলতা বলল, সবাই তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

.

০৩.

বিকেল বিকেল চলে এল সুজাতা। মাধবীলতা তখন সুটকেসের সামনে বসে।

অনিমেষ বলেছে দিন সাতেক ওখানে থাকবে। সেই হিসেবে জামাকাপড় নিতে গিয়ে দেখল বছরে একবার, পুজোর সময় ছাড়া জামাকাপড় কেনা

না হওয়ায় ভালর সংখ্যা বেশ কম। এই কয় বছরে অনিমেষ বস্তির বাইরে একদম যায় না। তাই ভাল পোশাকের প্রয়োজন হয় না ওর। মাধবীলতার অবশ্য কয়েকটা ভাল শাড়ি জামা আছে। হঠাৎ খেয়াল হল, অর্কর জামা তো অনিমেষের গায়ে খুব একটা বেমানান হবে না, মনে হওয়াতে স্বস্তি এল।

দরজায় সুজাতাকে দেখে মাধবীলতা বলল, ও, এসো।

সুটকেস গোছাচ্ছেন? সুজাতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, কাল আমরা জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি।

সে কী। চমকে উঠল সুজাতা।

অবাক হয়ে তাকাল মাধবীলতা।

আমি আজ সারাদিন ভাবছিলাম আপনাকে পাশে পেলে ওর বিরুদ্ধে। লড়াই করতে পারব।

লড়াই করতে হলে অন্যের সাহায্য ছাড়া করা যায় না?

আমি আর পারছি না। নিজের ওপর এক ফোঁটা ভরসা নেই আমার।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুজাতা। তারপর আঁচলে চোখ ঢাকল।

বসো। ওই মোড়াটা টেনে নাও। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কীভাবে আলাপ হয়?

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। তারপর বলল, আমাদের স্কুলের টিচার।

তোমার থেকে কত বড়?

বারো-তেরো বছর।

একটু পরিষ্কার করে বলো তো!

পড়ানোর সময় দেখতাম অন্য মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে বেশি তাকাতেন। এই নিয়ে আমাকে ওরা খ্যাপাত। বলত স্যার তোর প্রেমে পড়ে গেছেন। আমি বিশ্বাস করতাম না। আমি তো মোটেই সুন্দরী নই। গায়ের রং শ্যামলা। ক্লাস টেনে আমার বাবা মারা যান। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। দাদা তখন বি. এ. পড়ে। অনেক চেষ্টার পর বাবার অফিসে দাদার একটা চাকরি হওয়ায় আমরা উপবাস থেকে বেঁচে গেলাম। চাকরি পাওয়ার পর দাদা পালটে গেল। ও যা বলবে তা আমাদের শুনতে হত। স্কুল ফাইনালে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়নি। পড়া বন্ধ করে বাড়ির কাজ করাতে চাইল মা। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। টিউশানির টাকায় পড়তে চাইলাম। সেই সময়ে এই মাস্টারমশাই আমাকে খুব সাহায্য করতে লাগলেন। আমাকে আলাদা করে পড়তে সাহায্য করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার পর দাদা আমার বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। মা-ও ওকে সমর্থন করল। কিন্তু আমি কলেজে ভরতি হয়ে আরও পড়তে চাইছিলাম। দাদা তার বিরুদ্ধে। এইসময় মাস্টারমশাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে হাওড়ায় একটা ঘর ভাড়া করে রাখলেন। মা-দাদা দুজনেই জানিয়ে দিল যে তারা আর আমার মুখ দর্শন করবে না। সুজাতা চোখ বন্ধ করল।

তারপর? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি কলেজে ভরতি হলাম। নিজে রান্না করে খেয়ে কলেজে যাই। দুবেলা ছেলেমেয়ে পড়াই। তাতেও কুলায় না। মাস্টারমশাই সাহায্য করেন। কখন যে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম জানি না। তিনি আমার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতে লাগলেন কিন্তু কখনওই রাতে থাকতেন না। যেখানে থাকতাম সেই অঞ্চলটা বিহারি শ্রমিকদের এলাকা বলে কেউ ওঁর আসা যাওয়া নিয়ে আপত্তি করত না। কিছুদিন পরে আমি তাকে বিয়ের কথা বললাম। শুনেই খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমাদের দুজনের বয়েসের অনেক পার্থক্য, বিয়ে করলে লোকে হাসাহাসি করবে। অথবা, আমাকে বিয়ে করলে ওঁর মা-ভাই-বোন প্রচণ্ড দুঃখ পাবে। ঝগড়া শুরু হয়ে যেত উনি এলেই। তখন, এক বিকেলে তিনি মদের বোতল নিয়ে এলেন। ঘরে বসে অনেকটা মদ খেয়ে গায়ের জোরে সাধ মিটিয়ে চলে গেলেন। আমার খুব ঘেন্না করতে লাগল এবং এটাই চালু হয়ে গেল। আমি ওঁর টাকা নেওয়া বন্ধ করলাম। আধপেটা খেয়ে থাকতাম। ছেলেবেলা থেকে আমার লেখালেখির শখ ছিল। তখন সময় কাটাতে যা মনে আসে তা লিখতাম। ওর বিরুদ্ধেও কত কথা লিখেছি। একদিন সেই লেখা হাতে পেয়ে আমাকে খুব মারলেন মদ খাওয়ার পরে।

তার পরদিন তিনি এলেন না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপরে অনেকদিন তার দেখা পেলাম না। আমার হাতে তখন একটা টাকাও নেই। টিউশনিগুলো কী কারণে জানি না হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আমার পাশের ঘরে একজন বয়স্ক বিহারি মুসলমান থাকতেন। তাকে চাচা বলতাম। তার স্ত্রীকে চাচি। চাচি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে চাচাকে বললেন কিছু একটা করতে। চাচা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা কারখানায়। সেখানে তিনি কাজ করেন। চাচার অনুরোধ সত্ত্বেও মালিক প্রথমে রাজি হচ্ছিল

চাকরি দিতে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা কারখানায় চাচা আমাকে কাজ পাইয়ে দিলেন। মাল বইতে হত, ঝাড় দিতে হত। প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করলে ষাট টাকা পাওয়া যেত। না করলে টাকা পাওয়া যেত না। মাসে পনেরোশো টাকার মতো হত। ঘরভাড়া দিয়ে দুবেলা খেতে পারতাম। কিন্তু অতবড় কারখানায় আমি একমাত্র মেয়ে, কর্মচারীদের বেশিরভাগই বিহারি। খুব অসুবিধে হত। আমার সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার চেষ্টা করত। মালিককে বললে শুনতে হত, এই জন্যেই আমি মেয়েমানুষ রাখতে চাইনি। কাজ ছেড়ে দাও।

একমাস কাজ করে ছেড়ে দিলাম। একজন শ্রমিক আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আর একটা কারখানায় কাজ খুঁজে নিলাম। এই সময় মাস্টারমশাই উদয় হলেন। বললেন, বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হল বলে এতকাল আসতে পারিনি। এখন থেকে আসব।

আমি চিৎকার করলে পাশের ঘরের চাচা-চাচি থেকে অন্যান্যরা ছুটে এলেন। তাঁরা মাস্টারমশাইকে শাসালেন, আমার ওপর অত্যাচার করলে ভবিষ্যতে ছেড়ে দেবেন না। মাস্টারমশাই আমাকে হুমকি দিয়ে চলে গেলেও পরের দিন ফিরে এসে জানালেন, আর আমি তোমাকে কিছু বলব না, শুধু বসে বসে কাজ করে চলে যাব।

আমি আর পারলাম না। যে কারখানায় কাজ করতাম সেখানকার একজন এই বস্তির ঘরের খবরটা দিল। আমি পালিয়ে এলাম এখানে। কিন্তু শনি আমাকে ছাড়ল না। ঠিক এই ঠিকানার খোঁজ পেয়ে গেল। তার নাকি বউয়ের চেয়ে আমাকে বেশি ভাল লাগে। কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে এসব কথা শোনায় আমাকে। সুজাতা চুপ করল।

আজ এখানে আসবে বলেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তুমি বসো। মাধবীলতা উঠে পড়ল। পাশের ঘরের চেয়ারে বসে অনিমেষ তখন কিছুর হিসেব লিখছিল, মাধবীলতা ঘরে ঢুকে বলল, এখন সুরেন মাইতিকে পাওয়া যাবে?

সে কী? তাকে কী দরকার? মুখ তুলল অনিমেষ।

সুজাতাকে যন্ত্রণা দিতে একটা লোক এখানে আসবে। লোকটা যাতে আর না আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সুরেন মাইতি সেটা পারবে। মাধবীলতা বলল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তুমি আমাকে সুরেন মাইতির সাহায্য চাইতে বোলো না।

অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা হেসে ফেলল।

আমি কি হাস্যকর কিছু বললাম? অনিমেষ বিরক্ত হল।

তুমি এখনও মৌলবাদী রয়ে গেছ।

আমি? মৌলবাদী? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ।

নয়তো কী? ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে যারা গোঁড়ামি করে তাদেরই তো মৌলবাদী বলা হয়, তাই না? সেই কবে কমিউনিজমের মন্দিরে ঢুকেছিলে, বেরুনো দূরের কথা, দরজা জানলাগুলো খুলতে চাইছ না। এদিকে পৃথিবীর আবহাওয়া কত বদলে গিয়েছে তা জেনেও চোখ খুলছ না। আবার দ্যাখো, এই তুমি রোজগার করতে পারছ না এই আক্ষেপে রেসের পেনসিলার হতে চেয়েছিলে। তখন ওই কাজটাকে সর্বহারার শ্রম বলে ভেবেছিলে। মাধবীলতা ধীরে ধীরে বলল।

এত কথা বলছ কেন?

সুরেন মাইতিকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। কমিউনিস্ট পার্টির নীচতলার এক নেতা হয়ে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। যে কারণে তুমি বা তোমরা পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলে বহু বছর আগে। অথচ সেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হতে তোমাকে পাঁচ মিনিট ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে হয়। উত্তর দাও। তাকে এড়িয়ে চলে আসতে পারো না। কিন্তু একটা ভাল কাজের জন্যেও সুরেন মাইতিকে অনুরোধ করতে গেলে তোমার মনে থেকে যাওয়া কমিউনিজমের অভিমান বড় হয়ে ওঠে। মাধবীলতা বলল, থাক, তোমাকে বলতে হবে না। আমিই যাব।

অনিমেষ বলল, আমি বুঝতে পারছি না, এসব ঝামেলায় না গিয়ে মেয়েটাকে আমাদের কাছেই থাকতে বলল। লোকটা এসে দরজা বন্ধ দেখে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকবে না।

আজ থাকবে না, কাল কী করবে সুজাতা? পরশু? মাধবীলতা বলল, ভালবাসার জন্য অনেক মাশুল দিয়েছে মেয়েটা। তুমি কখনও ভেবেছ, একটা মোটামুটি শিক্ষিত মেয়ে দুটো ভাতের জন্যে কারখানায় চাকরি করছে? কী চাকরি? না, মাথায় করে মাল বইছে আর তার চারপাশের পুরুষ শ্রমিকগুলো সারাক্ষণ লোভী চোখে ওর শরীর গিলছে। আমি আসছি।

চুলে চিরুনি বোলাতে গিয়ে বিরক্ত হল মাধবীলতা। তার চুলে এখনও অনিমেষের মতো সাদা ছড়িয়ে পড়েনি বটে কিন্তু অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। আয়নার সামনে এসে নিজের মাথার দিকে তাকালেই মন বিরক্ত হয়।

উঠোনের দরজা টেনে দিয়ে মাধবীলতা দ্রুত গলি দিয়ে হেঁটে বস্তির বাইরে বেরিয়ে এল। যখন প্রথম এই বস্তিতে এসেছিল, তখন যারা সদ্য জন্মেছিল তাদের চেহারা এখন প্রৌঢ়ের হয়ে গিয়েছে। যারা এখন তরুণ অথবা যুবক, পাড়ার রকগুলো যাদের দখলে, তারা কোনও কারণ ছাড়াই তাকে কিছুটা সমীহ করে। খিস্তি খেউড় করার সময় তাকে দেখলে চুপ করে যায়। অবশ্য অর্কও একটা কারণ হতে পারে। অর্কর পরিকল্পনায় যে এই বস্তিতে কমিউনিটি কিচেন করার চেষ্টা হয়েছিল তা বাবা মায়ের মুখে ওরা শুনেছে। এই বস্তির মানুষের জন্যে কাজ করতে গিয়ে অর্ক পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছিল, তিনমাস পরে ছাড়া পেয়েছিল, এই ঘটনাগুলো ওদের জানা। ওদের একজন

এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা, কাউকে খুঁজছেন?

ছেলেটিকে দেখল মাধবীলতা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসভ্যতা মাখানো। সাত-আটটা পকেট জিনসে, হাঁটুর কাছে সযত্নে ছিঁড়েছে, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি।

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ। তোমরা কি এখানে অনেকক্ষণ আছ?

হ্যাঁ। সেই দুপুর থেকে।

সুরেনবাবুকে দেখেছ?

সুরেনদা এইমাত্র বাসায় ঢুকল। ডেকে দেব? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

যদি ওর কোনও অসুবিধে না থাকে!

আপনি আসুন–! ছেলেটি এগিয়ে গেল।

বস্তির একপাশে সুরেন মাইতিদের টালির বাড়ি ছিল আশি সাল পর্যন্ত। ওঁর বাবা এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হওয়ার পর সেই বাড়ি ভেঙে ছাদ ঢালাই করে একতলা বানিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরে সুরেন মাইতি দোতলা করেছে। বাড়িতে ঢোকার পথ বস্তির দিক থেকে সরিয়ে রাস্তার দিকে করেছে।

রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ছাড়া সুরেন মাইতি কখনও একা থাকে না। ওর নীচের ঘরে এখন জনা তিনেক লোক।

ছেলেটি দরজার বাইরে থেকে ডাকল, সুরেনকাকা, একবার আসবেন?

কে? কে ডাকে? ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, আবার কে ডাকছিস?

এবার দরজায় যে দাঁড়াল তাকে কখনও দ্যাখেনি মাধবীলতা। কিন্তু সে লক্ষ করল ছেলেটা বেশ নুয়ে পড়ল। আমি না, উনি, সুরেনকাকার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

কে আপনি? লোকটা প্রশ্ন করেই জানিয়ে দিল, উনি এখন ব্যস্ত আছেন।

অর্কদার মা। ছেলেটি জবাব দিল।

আই বাপ। ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, সর, সর, একটু দাঁড়ান বউদি।

লোকটি দরজা থেকে ভেতরে চলে যেতে ছেলেটি বলল, এ সুরেনকাকার বডিগার্ড। সবসময় যন্ত্র রাখে সঙ্গে। নতুন এসেছে।

সুরেন মাইতি বেরিয়ে এল, আচ্ছা, আপনি কেন এলেন? ডেকে পাঠালে আমি নিজেই চলে যেতাম। ভেতরে গিয়ে বসবেন?

না, তার দরকার নেই। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।

অনুরোধ কেন বলছেন? অ্যাই, ছোঁড়া ভাগ এখান থেকে, শুধু পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা গেলা। যা! ছেলেটিকে সুরেন মাইতি ধমকাতেই সে দ্রুত সরে গেল।

হ্যাঁ, বলুন। দুটো হাত জোড়া করে মুখের সামনে তুলল সুরেন মাইতি।

সুজাতা নামের একটি মেয়ে আমাদের গলিতে থাকে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

আমি তো বউদি, মেয়েদের নাম বললে বুঝতে পারব না, বাবা বা স্বামীর নাম কী?

ও একাই থাকে। কারখানায় চাকরি করে।

ও হ্যাঁ। বাঙালি মেয়ে যে এত স্ট্রাগল করতে পারে আগে জানতাম না। শুনেছি, বেশ ভদ্র মেয়ে, কারও দিকে মুখ তুলে তাকায় না। মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

ভুল শোনেননি।

এনি প্রবলেম?

হ্যাঁ। ওকে বিয়ে করবে বলে যে লোকটা বাড়ি থেকে বের করে এনেছিল, এনে পথে বসিয়েছে, ও এখন তার হাত থেকে বাঁচতে চায়। কিন্তু লোকটা খোঁজ করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। ওর ঘরে বসে মদ খাবে, ওর ওপর অত্যাচার করবে, মেয়েটা আর সহ্য করতে পারছে না। আপনি যদি ব্যাপারটা দেখেন– মাধবীলতা বলল।

নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে হাসল সুরেন মাইতি। ভালবাসা হল ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক অসুখ। ক্যান্সার হয়, লোক মারা যায়। ভালবাসা না মেরে সারা জীবন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বার করে যায়। বুঝলেন বউদি, এইজন্যে আমি ভালবাসা থেকে দশ হাত দূরে থাকি। সুরেন মাইতি কথা বলার সময়েও যেন নিঃশব্দে হাসছিল।

কিন্তু সুজাতার ব্যাপারটা–। মাধবীলতার গলার স্বর বদলে গেল।

কোনও চিন্তা করবেন না। কখন আসবে লোফারটা।

সন্ধেবেলায়।

বেশি দেরি নেই। মেয়েটাকে বলবেন, লোফারটা এলে ঘরে যেন বসতে দেয়। কিন্তু যেই মদের বোতল খুলবে অমনি যেন খুব জোরে চিৎকার শুরু করে। ব্যস, তার পরের কাজটা আমার ছেলেরা করে দেবে। গম্ভীর হল সুরেন মাইতি।

প্রস্তাবটা একদম পছন্দ হল না মাধবীলতার। এ যেন ছাগলটাকে টোপ সাজিয়ে বাঘ মারা। সুরেন মাইতি কথা শেষ করতে চাইল, ঠিক আছে?

সুজাতা এত ভয় পেয়ে গেছে যে লোকটাকে ঘরে ঢোকানো দূরের কথা, মুখোমুখি হতে চাইছে না। মাধবীলতা বলল।

তা বললে কী করে হবে? লোকটাকে তো মদের বোতল সমেত হাতেনাতে ধরতে হবে। উইদাউট ব্লু-তে অ্যাকশন নেওয়া যায় না। সুরেন মাইতি বলল।

ঠিক আছে, ওকে বলে দেখছি। মাধবীলতা বলল, আপনার সময় নষ্ট করলাম।

না না ঠিক আছে। দেখুন কী হয়। সুরেন মাইতি বলল।

গলিতে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। যে ছেলেটি মাধবীলতাকে সুরেন মাইতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল, সে এবং তার পাশে বিশ্বজিৎ। ছেলেটি বলল, মাসিমা বিশ্বজিৎদাকে চেনেন তো?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে কথা হয় না, কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তো দেখে আসছি।

হয়েছে? বিশ্বজিৎ বেশ ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করল।

না। হল না।

কিছু যদি মনে করেন তা হলে ব্যাপারটা কী জানতে পারি?

একটু ইতস্তত করছিল মাধবীলতা। ততক্ষণে বস্তির পাঁচ-ছয়জন মহিলা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সুজাতার সমস্যাটা বিশ্বজিৎকে বলল মাধবীলতা। সুরেন মাইতির প্রস্তাবটাও বাদ দিল না।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, মহিলাকে তো রোজ দেখি। খুব নরম টাইপের মনে হয়। উনি এখন কোথায়?

আমাদের বাড়িতে।

ওখানেই থাকুন এই সন্ধেটা। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যান।

কী করবে তোমরা?

আমরা কিছুই করব না। যা করবেন মা-বোনেরাই করবেন। বলে এতক্ষণ যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের দিকে তাকাল সে। আপনারা তো সব শুনলেন।

একজন মহিলা বললেন, এসব কথা তো আমরা জানতামই না। ওকে বলুন, আমরা ওর সঙ্গে আছি।

ওর কথা শুনে অন্য মেয়েরাও মাথা নাড়তে লাগলেন।

বাড়িতে ফিরে এল মাধবীলতা। অনিমেষ বসে ছিল বারান্দায়। মাধবীলতাকে দেখে বলল, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেঁদে চলেছে, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিচ্ছে না।

.

০৪.

মাধবীলতা সুজাতার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সুজাতা মাথা নাড়ল। সে কথা বলতে চাইছে না দেখে মাধবীলতা অনিমেষকে ইশারা করল ঘরের ভেতরে চলে যেতে। মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, এবার তুমি আমায় বলতে পারো। অর্কের বাবা এখানে নেই।

আমার ভয় লাগছে। কাঁপা গলায় বলল সুজাতা।

কীসের ভয়? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

যদি লোকজন এমন মার মারে যে ও মরে যায় বা পঙ্গু হয়ে যায়!

অবাক হয়ে গেল মাধবীলতা। যে জন্তুটা জীবন নরক করে দিচ্ছে, তার চূড়ান্ত ক্ষতি করতে চাইছে না মেয়েটা? খুব রাগ হয়ে গেল মাধবীলতার, বিরক্ত হয়ে বলল, তখন এসে ওইভাবে বললে কেন? আমার কী দরকার ছিল সুরেন মাইতির কাছে যাওয়ার?

আমি যে ওকে ভয় পাচ্ছি। আমি চাই না ও এখানে আসুক।

অথচ তুমি এও চাইছ লোকটাকে যেন বেশি মারধর করা না হয়।

মাথা নিচু করল সুজাতা, আসলে, উনি তো একসময় আমার অনেক উপকার করেছিলেন, সেসব মনে পড়লে–।

বেশ। তুমি গলিতে গিয়ে দ্যাখো বিশ্বজিৎকে পাও কি না? ওই যে ছেলেটা কংগ্রেস করে, ও-ই উদ্যোগ নিচ্ছে। যদি ওকে না পাও তা হলে ওই গলির মহিলাদের গিয়ে বলো তুমি চাও না ওই লোকটাকে কিছু করা হোক।

মাধবীলতা উঠে যাচ্ছিল, সুজাতা তার হাত ধরল, আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না।

আমার ন্যাকামি পছন্দ হয় না।

আমি ন্যাকামি করছি না, সুজাতা বলল।

যাও, বাইরে গিয়ে কথা বলো ওদের সঙ্গে।

সুজাতা গেল না। বারান্দায় বসে রইল।

ঈশ্বরপুকুর লেনের দৈনন্দিন জীবনে সেদিন অন্যরকম ঘটনা ঘটল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর থেকে ধীরে ধীরে পার্টির নব্য নেতারা সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁরা যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা, তার জন্য জেলা কমিটির অনুমোদনও দরকার নেই। বামবিরোধী দলগুলো মাঝে মাঝে গলা খুললেও বেশির ভাগ সময় তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। ঈশ্বরপুকুর লেনে সুরেন মাইতিই শেষ কথা। মাসের এই সময়টা তাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। পাশের বেলগাছিয়ায় রেললাইনের কর্মবীরদের সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে নেওয়া থেকে অর্থ আসছে এমন সব লাইনগুলোর তদারকি করতে হয় মাসের এই সময়।

সুরেন মাইতি যখন খবরটা পেল তখন রাত সাড়ে নটা। প্রথমে বিশ্বাসই করেনি সে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তির মহিলারা নাকি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটা লোককে আড়ংঘোলাই দিয়েছে। লোকটা মারা যায়নি কিন্তু প্রচণ্ড আহত হয়ে আর জি করে ভরতি হয়েছে। সুরেন মাইতির প্রথম প্রশ্ন ছিল, এটা কে অর্গানাইজ করল? আমাকে না জানিয়ে আমাদের কেউ কি করেছে?

একজন কমরেড জানালেন, না সুরেনদা। আমাদের কেউ লিড করেনি।

বুঝতে পেরেছি। ওই অর্কর মা-ই মেয়েদের খেপিয়েছে। ওর স্বামী নকশাল হওয়ায় চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, তাও হুঁশ হল না। আমরা যদি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিতাম তা হলে এখনও জেলে পচে মরত। সুরেন মাইতি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন।

না দাদা। অর্কদার মাকে ধারেকাছে দেখা যায়নি।

একজন জানাল।

চালাক মেয়েছেলে। সামনে না এসে আড়াল থেকে মেয়েদের খেপিয়েছে।

সুরেন মাইতি নির্দেশ দিল, ওকে নয়, ল্যাংড়াটাকে ডেকে নিয়ে আয়।

.

এখনও উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে ঈশ্বরপুকুর লেনে। জটলাগুলোতে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। মেয়েরা যে ওই ঘরের সামনে অপেক্ষা করবে এবং লোকটা আসামাত্র প্রশ্ন শুরু করবে, এরকম দৃশ্য আগে এলাকার মানুষ দেখেছে। শুধু তাই নয়, মাধবীলতাদের বাড়ি থেকে সুজাতাকে ডেকে এনে মেয়েরা লোকটার সামনে জানতে চেয়েছিল ঠিক কী করেছে সে। লোকটাকে দেখামাত্র সুজাতার সব মন খারাপ উধাও হয়ে গিয়েছিল। যা সত্যি তাই বলেছিল সে। মিনিট পাঁচেক মার খাওয়ার পর লোকটা ধরাশায়ী হয়। পাড়ার ছেলেরা একটা ট্যাক্সি ডেকে আর জি করে পাঠিয়ে দেয়। মেয়েরাই বলেছিল আজকের রাত্রে সুজাতার নিজের ঘরে থাকা ঠিক হবে না। ওপাশের এক প্রৌঢ়া তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে।

হঠাৎ উত্তেজনা মানুষের শেষ আড়াল যখন একবার ভেঙে ফেলে তখন সে আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ওই লোকটা সুজাতার ঘরে বসে নাকি মদ্যপান করত। এ কথা প্রচার হতেই সবার মুখে একটা কথা ফিরতে লাগল, ঘরে বসে বস্তির কোনও পুরুষের মদ খাওয়া তো চলবেই না, নেশা করে টলতে টলতে কেউ যদি বাড়ি ফিরে আসে তা হলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কথাটা চাউর হলে অনেক বয়স্ক থেকে তরুণের মুখ কালো হয়ে গেল। একজন প্রৌঢ় বললে, কত দেখলাম, আজকের বাঘ কাল মিনি বেড়াল হয়ে যাবে, দেখো।

মাধবীলতা খুশি হয়েছিল। লোকটিকে মেয়েরা শাস্তি দিয়েছে বলে শুধু নয়, সুজাতা তার কান্না ভুলে সত্যি কথা বলতে পেরেছে বলে। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলছিল সে। এই সময় একজন কমরেড খবর নিয়ে এল, মেসোমশাই, সুরেনদা আপনাকে একবার দেখা করতে বললেন।

কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

জানি না। এখনই চলুন।

মাধবীলতা বলল, এত রাত্রে ডাকলেই যেতে হবে নাকি? কাল সকালে যেয়ো। ভাই, সুরেনবাবুকে একটু বলবে–।

মাধবীলতাকে থামাল অনিমেষ, না, ঘুরেই আসি। চলো।

কমরেড যে অনিমেষকে সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে থাকা জটলা করা মানুষগুলো দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

সুরেন মাইতির বাইরের ঘরে তখন কয়েকজন মানুষ। তার দেহরক্ষীও রয়েছে। অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? এত রাত্রে তলব করেছেন।

সুরেন মাইতি হাসল, আমারই যাওয়া উচিত ছিল। এত ঝামেলা, এই এরা তো যে যাঁর সমস্যা নিয়ে বসে আছেন–।

বলুন।

আজ বস্তিতে মেয়েরা যে কাণ্ড করেছে তা কি জানেন?

এখানেই যখন থাকি, না জেনে উপায় কী!

বটে। যে লোকটাকে এরা আড়ংধালাই দিয়েছে, সে গুরুতর আহত। পুলিশ গিয়েছিল ওর কাছে কী ঘটেছিল তা জানতে। হাসল সুরেন মাইতি, লোকটার জ্ঞান পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে পুলিশ।

এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশ মার্ডার চার্জ আনলে আমি অবাক হব না। এখানে খবর হল, আপনার স্ত্রীর কাছে মেয়েটি আশ্রয় নিয়েছিল। আপনার স্ত্রী যে আমার কাছে এসে লোকটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন, সেটাই তো সত্যি। আমি বলেছিলাম, লোকটা যে লম্পট তার প্রমাণ চাই। কিন্তু আপনার স্ত্রী অধৈর্য হয়ে বস্তির মেয়েদের এমন খেপিয়ে দিলেন, এবং নিজে সামনে না এসে নির্বোধ মহিলাদের এগিয়ে দিলেন, সেটা ঠিক করেননি। লোকটির বয়ান পেয়ে গেলেই পুলিশ আপনার স্ত্রীকে গ্রেফতার করবে। অনিমেষবাবু, আপনি নকশাল আন্দোলন করতেন, জেলে গিয়েছিলেন, মানুষের সম্মান আপনি পেয়েছেন। কিন্তু একজনকে খুন করার ষড়যন্ত্রের জন্যে আপনার স্ত্রী যদি জেলে যান–ছি ছি ছি! মুখ মুছলেন সুরেন মাইতি।

এইভাবে মামলাটাকে সাজানো হবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশকে আপনি আমার চেয়ে ভাল চেনেন। ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। লোকে বলে, আমাদের দলের মন্ত্রীরা আপনার নাকি সহপাঠী ছিলেন। যান, কথা বলুন, তারা যদি সাহায্য করে আপনাকে!

আর কী বিকল্প আছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সুরেন মাইতি বলল, লোকটা যদি আজ রাত্রে হাসপাতালের বিছানায় মরে যায় তা হলে পুলিশ ওর কাছে কোনও বয়ান পাবে না। কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতেও পারবে না। কিন্তু ঘটনাটা একটু খরচসাপেক্ষ এবং ঝুঁকিও নিতে হবে। তার চেয়ে আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। একসঙ্গে কাজ করলে দুজনেরই উপকার হবে।

এইসময় একটি ছেলে এসে দাঁড়াল দরজায়, দাদা খবর পেয়েছি।

বল।

ব্যাপারটা বিশ্বজিতের মাথা থেকে এসেছে। যারা লোকটাকে আজ মেরেছে তাদের তিনজন যে কংগ্রেসকে ভোট দেয় তা আমি জানি। ছেলেটা বলল।

চোখ বড় হয়ে গেল সুরেন মাইতির, সে কী রে! কেঁচো ফণা তুলেছে? ঠিক আছে। এখন চুপ করে থাক। আমরা যেন কিছু জানিই না। এক সপ্তাহ কেরোসিনের ব্ল্যাক বন্ধ। মানুষ যেন ঠিকঠাক তেল পায়। মনে থাকবে?

একদম বন্ধ? পাশের ছেলেটার গলা সরু হল।

একদম। এই মুহূর্তে কিছুদিন মানুষের আস্থা পাওয়ার মতো কাজ করতে হবে। যাক গে, অনিমেষদা, আপনাকে মিছিমিছি কষ্ট দিলাম। বউদিকে বলবেন কোনও চিন্তা না করতে। মার্ডার চার্জটায় ওই বিশ্বজিৎই পড়বে। যান। এই, কেউ দাদাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

অনিমেষ বলল, না না, আমি নিজেই যেতে পারব। ঠিক আছে।

.

অনিমেষ এবং মাধবীলতা বসেছিল মুখোমুখি। অনিমেষ বলল, যত দিন যাচ্ছে তত এরা মানুষের শত্রু হয়ে উঠছে। কিন্তু এই শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ থেকে তো বের হওয়ার উপায় নেই।

মাধবীলতা বলল, তোমার মনে আছে, সাতষট্টি সালের নির্বাচনের আগে পশ্চিমবাংলার কেউ ভাবতেই পারত না কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে চলে যাবে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, কিছুটা ঠিক। ততদিনে একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের, আন্দোলনের ভাবনা তো ওই সময়েই।

তোমার ভাবনাটা সঠিক নয়। বামপন্থী দলকে যুক্তফ্রন্ট করতে হয়েছিল কেন? কারণ তারা জানত মানুষ তাদের ওপর আস্থাবান নয়। প্রফুল্ল ঘোষ বা অজয় মুখোপাধ্যায়কে সামনে রাখতে হয়েছিল। অজয়বাবুকে দেখেই মানুষ ভোট দিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু তবু যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারল না। তারপর আর একবার চেষ্টা হয়েছিল, সেটাও টিকল না। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল বলেই কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

মাধবীলতা বলল, বামফ্রন্ট জিতেছিল মানুষের নেগেটিভ ভোট পেয়ে। প্রথম কয়েক বছর তো মানুষ বেশ ভালই ছিল। এখন মানুষ হাঁসফাঁস করছে। অথচ কাকে ভোট দেবে তা বুঝতে পারছে না।

দ্যাখো জলের চাপ বেড়ে গেলে সে নিজেই পাহাড়ের ফাটল খুঁজে নেয়। আমি তাই ও নিয়ে ভাবি না। অনিমেষের কথা শেষ হওয়ামাত্র উঠোনের দরজায় শব্দ হল। মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল সেটা খুলতে।

অর্ক মায়ের পাশ দিয়ে উঠোনে পা রেখে অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশে বলল, খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।

দুপুরে কিছু খাসনি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

খেয়েছি। অর্ক ঢুকে গেল তার ঘরে।

দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলবে তারও সময় নেই। এখন খাওয়া শেষ করেই বিছানায় পড়ে মড়ার মতো ঘুমাবে। অনিমেষ বিড়বিড় করল।

মাধবীলতা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেল। গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে লাগল। হাতমুখ ধুয়ে পাজামা গেঞ্জি পরে অর্ক রান্নাঘরে এল, কই দাও।

কী ওটা?

তোমাদের ট্রেনের টিকিট।

সেকী! তুই যাবি না?

ছুটি পাব না। প্রচণ্ড চাপ। খামটা একটা কৌটোর ওপর রেখে দিয়ে হাত বাড়াল অর্ক, থালাটা দাও, দাঁড়িয়েই খেয়ে নিচ্ছি।

এত তাড়া কেন? পিঁড়ি এগিয়ে দিল মাধবীলতা, বসে খা।

পিঁড়ির ওপর বাবু হয়ে বসল অর্ক, বসে হাসল, এখন কলকাতা শহরে আর কোনও বাড়িতে পিঁড়িতে বসে খাওয়ার রেওয়াজ আছে কি না জানি না।

আছে কি নেই জানি না, আমার তো পিঁড়িতে বসে খেতে বেশ ভাল লাগে, মাধবীলতা হাসল, কিন্তু কাল ছুটি না পেলে দুদিন বাদে ছুটির জন্য বল।

বলব। তবে লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি ভুল করেছিলাম, পার কেস একটা টাকা নিতাম, কোনও কোনও সময় কেস না এলে চিন্তায় পড়তাম তাই ওরা যখন চাকরির অফার দিল তখন লুফে নিয়েছিলাম। তারপরেই চাপ বাড়তে লাগল। পার কেস যে টাকা পেতাম তা এখন নিলে মাইনের দ্বিগুণ হয়ে যেত! খাওয়া শুরু করল অর্ক।

বেশি লোভ করে কী দরকার। যা পাচ্ছিস তা থেকেও তো কিছু জমে যাচ্ছে।

বাবা খেয়েছে? বসে আছে কেন? শুয়ে পড়তে বলল।

ঘুম পেলে নিজেই শুতে যাবে। মাধবীলতা বলল, আজ এখানে কী হয়েছে শুনেছিস? তুই তো আবার কারও সঙ্গে কথা বলিস না।

শ্যামবাজারের মোড়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

ও। ছেলেটা বেশ ভাল। সুরেন মাইতি যখন জালিয়াতি করছিল তখন ওই ছেলেটাই বস্তির মেয়েদের ব্যাপারটা জানায়।

মা, এইসব ব্যাপারে একদম ইন্টারেস্টেড নই। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকাল, কোনও মেয়ে বিপদে পড়লে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল অর্ক, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি অনুরোধ করব ওই খাম থেকে টিকিট বের করে কখন ট্রেন ছাড়ছে তা দেখে রাখো।

অর্ক কলতলা থেকে বেরুতে না বেরুতে মাধবীলতার গলা শুনতে পেল, সে কী রে, কাল দুপুরবেলায় ট্রেন? আমি ভেবেছিলাম, রাতের ট্রেনের টিকিট হবে।

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, টিকিট কাউন্টারের বাবুরা কম্পিউটার দেখে বলেছেন ওসব ট্রেনে কোনও জায়গা খালি নেই। তাই তিস্তা তোর্সায় কাটলাম। তখন বাড়ি ফেরার সময় শিয়ালদা স্টেশনের পাশ দিয়ে আসার সময় কৌতূহল হল। গিয়ে দেখলাম, অর্ডিনারি স্লিপারের অর্ধেক আর এসি থ্রি টায়ারের ওয়ান থার্ড খালি পড়ে আছে। রহস্যের সমাধান ফেলুদাও পারবে না।

রাতের সব কাজ শেষ করে শুতে এসে মাধবীলতা দেখল অনিমেষ ঘুমে কাদা হয়ে রয়েছে। ওপাশের ঘরে অর্কও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।

আজ ওষুধ খেতে ভুলে গেছে সে। আজকাল ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। মাঝরাত্রে কাল দুপুরের জন্যে সুটকেস গোছাতে লাগল মাধবীলতা।

.

০৫.

শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছাড়ল দশ মিনিট দেরিতে। এসি থ্রি-টায়ারের টিকিট কেটেছে অর্ক। একটা কুপেতে ছয়জন। অনিমেষের উলটোদিকে একজন খাটো চেহারার হাসিহাসি মুখ ভদ্রলোক স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন। যেচে আলাপ করলেন তিনি।

কিছু মনে করবেন না, আপনাকে ওটা নিশ্চয়ই জন্ম থেকে বহন করতে হচ্ছে না?

হেসে ফেলল অনিমেষ, না।

গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল তো? উঃ কলকাতায় দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু রাস্তা তো বাড়ছে না। আমি বলি কমছে। হকাররা দখল করে নিয়েছে যে। ভদ্রলোক এবার হাত জোড় করলেন, আমার নাম ভারতচন্দ্র দত্ত। এনি কোয়েশ্চেন?

নো। সুন্দর নাম।

এই মধ্যযুগীয় নামটা আমার পিতামহ নির্বাচন করেছিলেন। এই নাম যার সে মাস্টারি ছাড়া আর কী করতে পারে বলুন? স্কুলে দুপুরটা কেটেছে, সকাল বিকেল সন্ধে প্রাইভেট টিউশনি। রোজগার খারাপ করিনি। দুটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এটি থার্ড। ভারতচন্দ্র চোখের ইশারায় মেয়েকে দেখালেন।

মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল।

মা বললেন, তোমার মুশকিল কী জানো, কেউ শুনতে চাইছে কি চাইছে জানার আগেই ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করা।

মাস্টারি করার অভ্যেস। হাসলেন ভারতচন্দ্র, টিকিট কবে কেটেছেন?

মাধবীলতা জবাব দিল, ছেলে কেটে দিয়েছে।

বুদ্ধিমান ছেলে।

অনিমেষ হাসল, কীসে বুঝলেন?

এসি থ্রি-টায়ারে টিকিট করেছে। টু-টায়ারে করেনি।

বেশি ভাড়া দিতে হল না, তাই?

দূর! এসি টু-তে একটা কুপেতে চারজন। ট্রেন ছাড়লেই দুজন মদ্যপান শুরু করেন। পরদা টানা থাকে। একবার আমি আর আমার ওয়াইফ এসি টু টায়ারে যাচ্ছিলাম, কী বলব মশাই, ছেলের বয়সি ছোঁড়াগুলো, বোতলে বাড়ি থেকেই জলে সাদা মদ মিশিয়ে নিয়ে এসেছে দেখলে ধরতে পারবেন না, ভাববেন জল খাচ্ছে, আমাকেই অফার করেছিল। ভারতচন্দ্র বললেন।

স্বাদ নিলেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

নো, জীবনে খাইনি তো! তবে আই ওয়াজ টেম্পটেড। তারপর থেকে আর এসি টু টায়ারে যাই না। ওই যাঃ, আপনার নামই জানা হল না।

অনিমেষ মিত্র।

ছেলে কী করে?

হেলথ অ্যান্ড কেয়ারে চাকরি করে।

ম্যারেড? আপনার ছেলে যখন, তখন–। ভারতচন্দ্র শেষ করলেন না। মাধবীলতা বলল, দ্যাখো তো চা পাওয়া যায় কিনা?

এই চা খাবে? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

ভাল চা কোথায় পাবে?

দেখি।

দরজা টেনে বাইরে এসে স্বস্তি পেল অনিমেষ। ভাগ্যিস মাধবীলতা কথা ঘুরিয়ে দিল! এই লোকটার সঙ্গে কাল ভোর পর্যন্ত থাকতে হবে।

মিনিট খানেক বাদে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল কামরায় বসেই মাধবীলতা একটা চা-ওয়ালাকে পাকড়েছে।

তুমি খাবে?

না অনিমেষ জানলার পাশের খালি জায়গাটায় বসল।

আপনারা? ভারতচন্দ্রের স্ত্রী বললেন, আপনি নিন, আমরা নিচ্ছি।

আমার তো নেওয়া হয়ে গিয়েছে–।

ভদ্রমহিলা স্বামীকে বললেন, এই যে শুনছ–।

আমি আবার কী শুনব! উনি অফার করছেন, তুমি অ্যাকসেপ্ট করবে কি না সেটা তুমি ঠিক করবে। দাও ভাই, আমাকে এক কাপ দাও।

ভদ্রমহিলা এবং তাদের মেয়ে চা খেল না। দুটোর দাম দিয়ে দিল মাধবীলতা। ছেলেটা প্রথমে ছটাকা কাপ চেয়েছিল। তারপর কী মনে হতে বলল, ঠিক আছে, পাঁচ করেই দিন। বাইরে বেরোলে বুঝতে পারা যায় জিনিসপত্রের দাম আর কোনও সীমায় আটকে থাকছে না।

ট্রেনটা চলছিল মাঠ পেরিয়ে। মাঠে এখন শস্য নেই। ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে তা অনেকটাই অস্পষ্ট। এই যে মাঠ, গ্রাম, পঞ্চায়েত এগুলোর সঙ্গে বামফ্রন্ট একসময় আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিল।

থাকলে এতগুলো বছর ধরে ওরা ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এখন একটা শতাব্দীর শেষ আর একটার শুরু। ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট চার চারটে নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে। বিরোধীরা বলেছেন গত দুটো নির্বাচনে বামফ্রন্টের ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট করেছে। তা হলে স্বীকার করতে হয় প্রথম দুটো নির্বাচন, ওই দশ বছর বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষের আজকের অভিযোগ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া গত দুই নির্বাচনে যদি ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট দিয়ে থাকে, অন্যকে ভোট না দিতে দেয়, তা হলে তার সংখ্যা কত? খুব বেশি হলে পনেরো থেকে কুড়ি ভাগ। ওইভাবে ভোট না করলেও বামফ্রন্ট স্বচ্ছন্দে জিতে যেত। একটা সময় আসবে যখন গালাগালি দিতে গিয়ে মানুষ বামফ্রন্টের সাতাত্তর সালের সরকারকেও কাঠগড়ায় তুলবে। খারাপ অনুভূতি খুব দ্রুত ভাবার স্মৃতিকে নষ্ট করে দেয়। এসব নিয়ে ভাবার কোনও মানে নেই জেনেও ভাবনাগুলো আপনি চলে আসে। সংসদীয় রাজনীতিকে এখন না মেনে উপায় নেই। কিন্তু ভারতবর্ষে কোনও নাগরিক ভোট না দিয়ে, রাজনীতি থেকে দুরে সরে গিয়ে দিব্যি থাকতে পারে। হঠাৎ কানে এল, এই যে স্যার, চলবে?

মুখ ফিরিয়ে তাকাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র তার সামনে একটি স্টিলের বাটি ধরে আছে, যাতে কয়েকটা পাটিসাপটা পড়ে আছে। ভারতচন্দ্রের হাসি আরও বিস্তৃত হল। অসময়ের পাটিসাপটা বলে অবহেলা করবেন না, নেবেন?

অনিমেষ অস্বস্তি নিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা বলল, ওঁর মিষ্টি খাওয়া বারণ।

ও হো। তা হলে বেঁচে থাকার অর্ধেক আনন্দ থেকেই আপনি বঞ্চিত!

যা বলেছেন।

বাটির ঢাকনা বন্ধ করে স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন ভদ্রলোক।

কিছুক্ষণ ট্রেনের দুলুনি উপভোগ করার পর ভারতচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের সঙ্গে তো কথাবার্তা হল না, সঙ্গে মোবাইল নেই?

আছে, ভুল করে সুটকেসে রেখেছিলাম। ওখানে গিয়ে বের করব।

কী দরকার? নাম্বারটা বলুন। আমার মেয়ে আবার মোবাইলের ব্যাপারটা ভাল বোঝে। হারে, নাম্বারটা ধরে দে তো? ভারতচন্দ্র মেয়েকে বললেন।

মাধবীলতা হাত নাড়ল, না না। তোমাকে একটুও কষ্ট করতে হবে না। এখন আমার ছেলের কাজের সময়। এখন ও কিছুতেই ফোন ধরবে না।

সিরিয়াস টাইপ? ভাল ভাল। আপনারা পৌঁছাবেন ভোরবেলায়?

হ্যাঁ।

জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার এমন কোনও দূরত্ব নয়। চলে আসুন বেড়াতে বেড়াতে। কী বলে?

মহিলা হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।

অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। যারা অকারণে বেশি কথা বলে, অপরিচিতর সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘনিষ্ঠজনের মতো ব্যবহার শুরু করে তারা হয় সোজা সরল অথবা ভয়ংকর ধান্দাবাজ হয়। এরকম আচরণ করার সময় নিশ্চয়ই টের পায় না যে পাশের মানুষ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। যেহেতু এঁর সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যা আছেন সন্দেহটা একটা জায়গা অবধি গিয়ে আটকে যাবে।

এই সময় মাধবীলতা বলল, এসি কামরায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। জানলা খোলা যাচ্ছে না। বাইরের পৃথিবীটা দ্যাখো এর মধ্যেই ঝাপসা হয়ে গেল।

গায়ে ধুলোবালি লাগছে না, সেটা ভাবো। অনিমেষ বলল।

ট্রেনটা চলছে দুলতে দুলতে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কামরায় আলোগুলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ভারতচন্দ্রবাবু হঠাৎ নিঃশব্দে উঠে গেলেন কামরার বাইরের টয়লেটের দিকে। মিনিট পাঁচেক পরে অনিমেষের নজরে পড়ল ভদ্রলোক দূরে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন। আসছি বলে ক্রাচ নিয়ে অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে ভদ্রলোক চোখের আড়ালে চলে গেলেন। শক্ত দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই ভারতচন্দ্র বললেন, এই দেখুন, এখানে নোটিশ টাঙিয়েছে, ধূপমান করলে এত টাকা ফাইন দিতে হবে।

ঠিক কথা।

মানছি। প্রশ্ন হচ্ছে একবার ধূমপান করলে যে অপরাধ তিনবার করলেও তো তাই। ফাইন কি তিনগুণ হয়ে যাবে? সমস্যায় আছেন ভদ্রলোক।

বোধহয় একবার দিলেই হবে।

গুড। ওখানে ধূমপানের কথা লেখা হয়েছে। কী ধরনের ধূম? বিড়ি, সিগারেট, চুরুট। গাঁজা খাওয়াও তো ধূমপান।

এটার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। অনিমেষ বলল।

এটা ধাঁধা না পাবলিক নোটিশ, আপনিই বলুন?

এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? বিরক্ত হল অনিমেষ। সামনে পিছনে তাকিয়ে নিল ভারতচন্দ্র, আপনাকে সত্যি কথাই বলি। এই যে অফিসের পর বাড়ি এসে যখন বাথরুমে ঢুকি তখন কিছুতেই পটি হতে চায় না। ওটা না হলে শরীর ফুলতে থাকে, আরাম করে শোওয়া যায় না। তখন সবে অফিসে ঢুকেছি। এক সহকর্মী বলল, ও কিছু নয়। একটু নেশার ছোঁয়া লাগালে পটি পেট ছেড়ে বেরুবার পথ পাবে না। ব্যস, অভ্যেস হয়ে গেল। সিগারেট থেকে সিকি ইঞ্চি তামাক বের করে সেই জায়গায় গাঁজা পুরে দিই। কয়েকটা টানেই তো পুড়ে যায়–! কিন্তু–

এখানে খেলে জেল হতে পারে।

সর্বনাশ! জেলের কথা অবশ্য এখানে লেখা নেই।

ড্রাই ড্রাগের মধ্যে পড়ে। গম্ভীর গলায় বলল অনিমেষ।

কী যে বলেন। সর্বত্র পাওয়া যায়। আমি আর পারছি না। এই বাথরুমের ভেতরে ঢুকে থাকি। আপনি একটু দাঁড়ান এখানে। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবেন লোক আছে। প্লিজ!

ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিলেই তো হয়? অনিমেষ বলল।

অ। তা হলে তো ঘনঘন ধাক্কাবে। ভদ্রলোক সুট করে টয়লেটের দরজার ফাঁক গলে ভেতরে চলে গিয়ে ওটা বন্ধ করে দিলেন। একটা লোক গোটা দিনে কোনও নেশা করে না শুধু বিকেলের পর সিকি ইঞ্চি গাঁজা খায়। ভাবা যায়?

তিনি কোথায়? পেছন থেকে ভেসে আসা মহিলার কণ্ঠে মুখ ফেরাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্রবাবুর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে ইশারায় টয়লেটটা দেখিয়ে দিল অনিমেষ। ভদ্রমহিলা দরজার গায়ে পৌঁছে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি যেতে পারেন।

খুশি হল অনিমেষ চলে আসতে পেরে। এসে দেখল, মাধবীলতা একটা বই পড়ছে।

ভারতচন্দ্রবাবুর মেয়ে চোখ বন্ধ করে গাড়ির তালে ঢুলছে।

সে মেয়েটিকে বলল, বসে কেন, শুয়ে পড়ো তুমি।

মেয়েটা মাথা নেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ওদিকের সব বাথরুম বন্ধ?

না। যেতে পারো।

মেয়েটি চোখের আড়ালে যেতেই অনিমেষ ঘটনাটা ঝটপট মাধবীলতাকে জানাল। চোখ বড় করল মাধবীলতা, সে কী! দেখে বোঝাই যায় না।

প্রত্যেক মানুষের হয়তো এরকম নিজস্ব ব্যাপার থাকে।

তোমার কী আছে?

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। তারপর বলল, যা তোমার নেই।

সেটা কী?

ভেবে বের করো। জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর লিখে কেউ একটা মানেবই আজ অবধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে অনিমেষ দেখল ভারতচন্দ্রবাবু ভিতরে ঢুকে তাকে ইশারা করছেন কাছে যাওয়ার জন্য। বাধ্য হল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র বললেন, একশো টাকা ফাইন নিত বুক ফুলিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখে দেখে খেয়ে নিতাম। ভয় পেয়ে মশাই আর একটা সিগারেট যখ গেল। ডাবল লোকশান!

সে কী, কে নিল?

গৃহকত্রী। মাঝে মাঝে কয়েকবার শখ করে এই সময় তাকে দু-তিনটে টান দিতে দিয়েছি কলকাতায়। সন্দেহ করে ঠিক চলে গিয়েছে বাথরুমে। আমারটা শেষ করে ফেলেছিলাম, আর একটা বের করে দিতে হল।

ভারতচন্দ্র খুব বিরক্ত।

একটা সিগারেটের ওইটুকু গাঁজার দাম একশো টাকা!

উঃ মাথা নাড়লেন ভারতচন্দ্র। যেখানে সেখানে ও জিনিস পাওয়া যায় না। টাকা ফেললে তো লাভ হবে না, আর একশো কেন তার বেশিও রাখা যেতে পারে। বেঞ্চিতে বসে গজগজ করতে লাগলেন ভারতচন্দ্র।

ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন, মুখে লালচে ভাব।

.

ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। অনিমেষ নিশ্চয়ই ভাবল মাধবীলতা মাঝখানে। ওপরেরটা খালি, পাশেরটার নীচে বাবা, মাঝখানে মা, ওপরে মেয়ে। ট্রেন তখন নিউ জলপাইগুড়ি ছেড়েছে। অনিমেষ উঠল। আবার বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নীরবে মাধবীলতাকে তুলল, আর বড়জোর পঁচিশ মিনিট। ওদের ঘুমাতে দাও।

পুরো ট্রেন ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু বাণীনগর স্টেশন থেকে আচমকা ব্যস্ততা ছড়াল কামরায়। দেখা গেল জলপাইগুড়ি শহরে নামার লোক অনেক রয়েছে। অনিমেষ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ, এত বছর পরেও তার শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। সমস্ত আকাশ, রোদ এখনও গায়ে না পাওয়া গাছেরা, ভেজা ঘাস যেন বলতে লাগল, আহা কী ভাল, কী ভাল।

চোখের সামনে চায়ের বাগান, ধানখেত, দূরের হাইওয়ে যেটা ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, স্বর্গছেঁড়া হয়ে ডুয়ার্সে চলে গিয়েছে যে রাস্তায় সে যাতায়াত করেছে কতবার তা হিসেবে নেই, যেন বুকের গভীর গভীরতর অংশ থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে ওইখানে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। মাধবীলতা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনিমেষ বলল, দেবী চৌধুরানির মন্দিরটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

একদিন রিকশায় চেপে দেখে যাব।

ট্রেন থামল। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন। কুলিরা একটু হতাশ হল। ওরা বেশ ভারী হওয়া সত্ত্বেও মালপত্র বয়ে নিয়ে এল রিকশা পর্যন্ত।

কোথায় যাবেন বাবু?

হাকিমপাড়া। টাউন ক্লাব মাঠের কাছে।

উঠুন।

০৬-১০. ভোরের রোদ

তখন সবে ভোরের রোদ উঠেছে। জলপাইগুড়ি শহর থেকে এই রোড স্টেশনটা বেশ দূরে, রাস্তাও নির্জন। একটা হাইওয়ে পেরিয়ে রাজবাড়ির রাস্তা ধরল রিকশাওয়ালা। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল লাস্ট কবে এসেছেন?

রিকশাওয়ালার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মাধবীলতা। বলল উনি এখানেই জন্মেছেন।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক এই শহরে নয়। এখান থেকে অন্তত পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের চা-বাগানে। আপনি কতদিন সাইকেল রিকশা চালাচ্ছেন?

রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তিরিশ বছর হয়ে গেল বাবু।

অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল। ওই সময়ের অনেক আগে থেকেই তার সঙ্গে জলপাইগুড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তখন হাকিমপাড়ায় রিকশাচালকদের ঠেক ছিল। সারাদিন রিকশা চালিয়ে মালিককে ভাড়া দিয়ে তারা কাঠের আগুনে রুটি সেঁকত। দৃশ্যটি মনে পড়ে যাওয়াতে সে খুব সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল, হাকিমপাড়ায় থাকো নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক চাপল লোকটি, আপনি জানলেন কী করে? ওর এই অবাক হওয়াটা আরও বিস্মিত করল অনিমেষকে। সে লোকটার প্রৌঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাবাও কি রিকশা চালাত?

হ্যাঁ। দ্রুত মাথা নাড়ল লোকটা।

ওর নাম কি দশরথ?

আরেব্বাস। আপনি আমার বাবাকে চেনেন? বাবু, আমি দশরথের ছেলে। লছমন। বাবা মরে গেছে তিন বছর হয়ে গেল।

এখানেই?

হ্যাঁ বাবু। আমাদের তো দেশ বলে কিছু নেই। সমস্তিপুরে যা খেতিজমি ছিল তা বাবা বিক্রি করে দিয়ে এসে বলেছিল, এখন থেকে এই জলপাইগুড়িই আমাদের জায়গা। আমার বাবাকে আপনার মনে আছে বাবু? লছমনের মুখটা হঠাৎ অন্যরকম দেখাচ্ছিল।

হ্যাঁ। আবছা লাগছিল। তোমাকে দেখার পর স্পষ্ট হল। চলো।

আবার রিকশা চলতে শুরু করল। এখনও পথে মানুষের ভিড় তৈরি হয়নি। অবশ্য রাজবাড়ির এই অঞ্চলটাকে শহরের ভিতর বলা যায় না।

বাঁ দিকে রাজবাড়ির দিঘি। অনিমেষ বলল, বাঁ দিকের পথটা ধরে এগিয়ে গেলে তরুদার বাড়ি পড়বে।

তরুদা কে?

ওঃ। তরু রায়। জলপাইগুড়ির সুরের রাজা। কত ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন তার হিসেব নেই। খুব গুণী মানুষ।

তুমি গান বাজনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলে নাকি?

তখন আমাদের যা বয়স তাতে যা টানত তাতেই আগ্রহী হয়ে যেতাম।

ক্রমশ রিকশা চলে এল দিনবাজার পুলের কাছে। মাঝে মাঝে করলা নদী দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু পুলের দিকে বাঁক না নিয়ে হাসপাতালের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনিমেষকে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, হাকিমপাড়ায় কোন বাড়িতে যাবেন বাবু?

আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকের জেলাস্কুলের রাস্তা ধরে। বলতে বলতে দুপাশের বাড়ি, করলা নদী, গাছগাছালি দুচোখ ভরে গিলছিল অনিমেষ। সেটা খেয়াল হতেই হাসি পেয়ে গেল তার। অনেক বদলে গেছে সেই চেনা পৃথিবীটা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতগুলো বছর, দিনের পর দিন কলকাতায়। থাকার সময় তো এদের কথা একবারও মনে আসেনি। কেউ যেন দুহাত তুলে আড়াল করে রেখেছিল এই চেনাপথ, বাড়ি, নদী। আজ এদের সামনে এসে আবেগে ভাসার কোনও যুক্তি নেই।

মিলছে না? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। বয়সের ছাপ মাধবীলতার গলায়, মুখে। হাঁটুর ওপর পড়ে থাকা হাতটা তুলে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এই হাওয়া কি তিরিশ বছর আগের মতো একই রয়ে গেছে?

অস্বস্তি কাটাতে হাত সরিয়ে নিল মাধবীলতা। আশ্চর্য। এক থাকতে পারে নাকি!

তা হলে আর জিজ্ঞাসা করলে কেন মিলছে কি না?

মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

বহু বছর আগে সে একবার জলপাইগুড়িতে এসেছিল অনিমেষের সঙ্গে। নিজের জন্য যতটা নয়, অর্কর জন্যে মনে হয়েছিল, আসাটা জরুরি ছিল। এখন সে কিছুই চিনতে পারছে না, কারণ তখন মনে রাখার মতো করে দেখে রাখেনি।

ডানদিকে চলল। অনিমেষ বলল।

রিকশাওয়ালা একটা গলির মধ্যে খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি দাদুর বাড়িতে যাবেন?

দাদুর বাড়ি? অনিমেষ অবাক।

ওই বাড়ি। এখন মাসিমা ছাড়া আর কেউ থাকে না। দেখুন না, বাড়ির কী চেহারা হয়েছে। প্লাস্টার খসে গেছে, জঙ্গল তৈরি হয়েছে বাড়ির ভেতর। লোকে বলে সন্ধে নামলেই ভূতপ্রেত এখানে ঘুরে বেড়ায়।

ওপাশে ভাড়াটে ছিল না?

ও, হ্যাঁ, তারা এখনও আছে। উলটোদিক দিয়ে যাওয়া আসা করে। তারা এদিকে আসে না। মাসিমার তো ওই ভাড়ার টাকায় চলে। রিকশাওয়ালা বলল।

আমাকে একটু ধরো, নামব।

প্রথম অনিমেষ নেমে ক্রাচ ধরতে মাধবীলতা নেমে এল, কত দিতে হবে?

রিকশাওয়ালা অনিমেষের দিকে তাকাল, আপনি দাদুর কে হন বাবু?

তুমি আমার বাবাকে দাদু বলছ কি না জানি না, তবে আমি এখানে আমার ঠাকুরদার সঙ্গে থাকতাম। তাকেই দাদু বলতাম। অনিমেষ বলল।

রিকশাওয়ালাই জোর করে সুটকেস আর ব্যাগ নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছিল এখানে মানুষ থাকে না। আগাছায় ছেয়ে গিয়েছে চারধার। দালানবাড়ির যে ঘরটিকে ঠাকুরঘর হিসেবে ব্যবহার করা হত সেই ঘরের দরজা খোলা। রিকশাওয়ালা তার সামনে পৌঁছে হাঁকল, মাসিমা, ও মাসিমা।

অ্যাঁ? মাসিমা। তোর মা কে তা আমি জানিই না, তোর মাসিমা হতে যাব কোন দুঃখে? ভাগ, ভাগ এখান থেকে। ঘরের ভেতর থেকে কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রিকশাওয়ালা মালপত্র নামিয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দশরথের ছেলে লছমন।

অ। কী হয়েছে?

একবার তো বাইরে এসে দেখুন, কে এসেছেন? দাদুর নাতি! উত্তরটা প্রশ্নের সঙ্গে দিয়ে দিল রিকশাওয়ালা। অনিমেষ এবং মাধবীলতা তখন লম্বা বারান্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ঠাকুরঘর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁর চেহারা দেখে হতভম্ব অনিমেষ। এত শীর্ণ মানুষ হয়? ছোটমা দরজায় একটা হাত রেখে পঁড়িয়ে।

মাধবীলতা এগিয়ে গেল, আমরা পরশু আপনার চিঠি পেয়েছি। এ কী চেহারা হয়েছে আপনার?

ছোটমা হাসল, কেন? আমি তো ভালই আছি। তুমি কেমন আছ?

মাধবীলতা তাকাল। চারটে চোখ একসঙ্গে পরস্পরকে দেখল।

ছোটমা বলল, আসতে পারো ভেবে নিয়ে ওই পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রেখেছি। রাত জেগে এসেছ। যাও, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। মাধবীলতা ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। তবু একটু ঝুঁকতেই ছোটমা বলল, ও ঘর থেকে ঘুরে এসে আগে তোমার পিসশাশুড়ি, নিজের শাশুড়িকে নমস্কার করো, তারপর কথা শেষ হল না। মাধবীলতা বারান্দা দিয়ে হেঁটে ওপাশের দরজাটা খুলল। তারপর ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। এতক্ষণ অনিমেষ চুপচাপ দেখছিল। হঠাৎ সংবিৎ ফিরতে সে রিকশাওয়ালার দিকে তাকাল। লছমন, কত দিতে হবে?

কী বলব বাবু! যা ইচ্ছে তাই দিন। লছমন মাথা নাড়ল।

দ্যাখো, আমি বহুবছর সাইকেল রিকশায় উঠিনি। এখন কীরকম ভাড়া তা জানি না।

অনিমেষের কথা শেষ হতেই ছোটমার গলা শুনতে পেল, কোত্থেকে আসছিস লছমন?

রোড স্টেশন থেকে মাসিমা। লছমন বলল, যা দেওয়ার দিন।

ওখান থেকে তো অনেক ভাড়া। তিরিশ-চল্লিশ তো হবেই। ছোটমা বলল।

অনিমেষ পকেট থেকে চারটে দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরল। লছমন মাথা নাড়ল, না, না, পাবলিকের কাছ থেকে যা নিই তা আপনার কাছে নেব কেন? আপনি তিরিশ দিন।

আমি তো তোমার কাছে পাবলিক ছিলাম। কেউ কাউকে চিনতে পারিনি। রাখো।

টাকাটা নিল লছমন। তারপর সুটকেসটা তুলে মাধবীলতা যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল তার সামনে রেখে ছোটমায়ের দিকে কয়েক পা এগোল, মাসিমা, বাবাকে কি দেখা করতে বলব?

ভাল হয়।

লছমন ঘাড় নেড়ে নীচে নেমে গেল। একদা যা ছিল ফুলের বাগান তা এখন বুনো ঝোঁপের জঙ্গল। তাকে আর দেখা গেল না।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ভাড়াটে নেই?

আছে। আছে বলেই এখনও দাঁড়িয়ে আছি। ছোটমা বলল।

বাড়ির অবস্থা থেকে সব বুঝতে পারছি। এতদিন জানাওনি কেন?

ছোটমা বোধহয় না হেসে পারল না। বলল, এতদিন মৃত্যুভয় হয়নি, তাই–। বলে ভেতরে চলে গেল।

মৃত্যুভয়? আচমকা অনিমেষের মনে হল শব্দটার মধ্যে সত্যতা আছে। এই বাড়িতে আজ ঢোকামাত্র একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। অপরিচিত গন্ধ অনুভব করছিল। এই গন্ধ যে মৃত্যুর গন্ধ তা বুঝে নিথর হল সে। এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন সরিশেখর মিত্র। তখন অনিমেষের শৈশব। তিনি চলে গিয়েছেন। এই বাড়ির ছাদে এক বন্যা-বৃষ্টির রাত্রে অনিমেষের মা মাধুরী পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন অসহায়ভাবে। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনিমেষের ভাই অথবা বোন পৃথিবীতে আসত। এখানেই চলে গিয়েছেন বড়পিসিমা যার স্পর্শ সর্বত্র ছড়ানো ছিল। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে অবসর নিয়ে এসে বাবা এই বাড়িতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই যে এতগুলো মানুষ, কেউ মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও ভাবতে পারেননি তাঁরা এখান থেকেই বিদায় নেবেন। পঞ্চাশ বছর পরে কেউ পৃথিবীতে থাকবেন না। আজ তাদের মৃত্যুর গন্ধ যদি এই বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে থাকে তা হলে সেটা কি অস্বাভাবিক?

অনিমেষ তাকাল। বুনো ঝোঁপের আড়ালে ওটা কী ঝুলছে? ফল? সে ধীরে ধীরে ক্রাচ নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই হেসে ফেলল অনিমেষ। সেই পেয়ারা গাছটা। আগের মতো বড় নেই। ঝড় বাদলে ডাল ভেঙেছে হয়তো। ঝোঁপের আড়ালে পড়ে গেছে। সেই কোন শীতের মধ্যরাত চোখের সামনে ফিরে এল। দাদু-পিসিমাকে লুকিয়ে রূপশ্রীতে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে গিয়েছিল নাইট শো-তে। যাওয়ার আগে দরজার মাঝখানে কাগজ গুঁজে গিয়েছিল যাতে বন্ধ দেখায়। রাতটা ছিল কনকনে শীতের। বারোটার পর পেছনের তারের বাউন্ডারি ডিঙিয়ে এই পেয়ারা গাছের নীচে এসে ধড় থেকে যেন প্রাণ উড়ে গিয়েছিল। দরজা হাট করে খোলা, ভেতরটা অন্ধকার, অর্থাৎ সে ধরা পড়ে গিয়েছে। ওই অন্ধকার ঘরের ভেতরে দাদু নিশ্চয়ই লাঠি হাতে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। পা বাড়াতে সাহস হয়নি তার। শিশিরে ভিজে চুপসে থাকা পেয়ারা গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল ঝরে পড়ছিল মাথায়, কাঁধে। সেই ঠান্ডা সহ্য করা যখন সম্ভব হল না তখন সে মরিয়া হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। কী অবাক কাণ্ড!

ঘরে কেউ ছিল না। ভাঁজ করা কাগজটা পড়ে ছিল দরজার নীচে মেঝের ওপর। তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে লেপের তলায় ঢোকা সত্ত্বেও শরীর থেকে ঠান্ডাটা যাচ্ছিল না।

প্রিয় সিনেমার একটি দৃশ্য যেন আবার নতুন করে দেখতে পেল অনিমেষ। তারপর সংবিৎ ফিরতেই কোনওরকমে ডাল থেকে পেয়ারাটা টেনে ছিঁড়ে নিল। আঃ। অনিমেষের মনে হল, এরকম একটা শব্দ শুনল সে। ডালটা ততক্ষণে নড়েচড়ে আবার স্থির হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ ফিসফিস করে বলল, সরি।

মাধবীলতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল শাড়ি জামা বদলে। ঘরে ঢুকতেই অনিমেষকে দেখতে পেল, মুগ্ধ হয়ে পেয়ারাটাকে দেখছে।

সাতসকালে পেয়ারা খাবে নাকি? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই পেয়ারা খাওয়ার জন্য নয়।

তা হলে ছিড়লে কেন?

ভুল করেছি। উত্তরটা শুনে মাধবীলতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর চুলে চিরুনি বুলিয়ে বলল, অর্ককে একটা ফোন করে দিয়ে।

ঠিক আছে।

আর শোনো, এখানে কি খুব লোডশেডিং হয়?

জানি না। কেন?

একটা আলোও জ্বলছে না। আমি ওঁর কাছে যাচ্ছি। তুমি বাথরুম সেরে নাও।

মাধবীলতা বেরিয়ে গেলে অনিমেষ ঘরটাকে দেখল। স্কুলের শেষ ধাপে তো বটেই, কলকাতার কলেজের ছুটিতে ফিরে এসে এই ঘরেই থেকেছে সে। কিন্তু তখন এই বড় পালঙ্কটা ছিল না। আলমারিগুলোও না। বাড়ির সব জিনিসপত্রও যেন এই ঘরে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাধবীলতা এবং ছোটমা কথা বলছিল। দাঁত মেজে, পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরে অনিমেষ দরজায় দাঁড়াতেই ছোটমা বলল, ওকে মোড়াটা দাও।

এখানে বসবে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ছোটমা হাসল, বা রে। এখানে না বসলে কথা বলব কী করে?

মাধবীলতা একটা মোড়া বের করে দরজার সামনে রেখে বলল, তোমরা কথা বলো, আমি চা করে নিয়ে আসি। শোনো, উনি রোজ চা খান না, আমরা আসলেও আসতে পারি ভেবে চায়ের পাতা আনিয়ে রেখেছেন।

আনিয়ে? রেখেছেন কানে লাগল অনিমেষের।

যদ্দিন তোমার বাবা বেঁচে ছিলেন তদ্দিন চা-বাগান থেকে বিনা পয়সায় বছরে দুবার চা আনত। এখন খেতে হলে কিনে খেতে হয়। ছোটমা বলল।

ভাবা যায়? অনিমেষের মনে পড়ল, বড়পিসিমা বাগান থেকে আসা চা পাড়ার লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

মাধবীলতা যেতে গিয়ে থমকাল, যায়! ভাবা যায়।

তুমি বুঝতে পারো না, অনিমেষ মাথা নাড়ল।

খুব পারছি। এই যে একটু আগে তুমি গাছ থেকে একটা পেয়ারা ছিঁড়ে মুগ্ধ হয়ে ঘরে ঢুকলে, কলকাতা হলে ওটা করতে পারতে? পারতে না। কিন্তু কখনওই বলতে না, ভাবা যায়! বদলে যাওয়া সময়কে সহজভাবে নেওয়াই ভাল। মাধবীলতা চলে গেল।

মোড়ায় বসল অনিমেষ। তাকে ভাল করে দেখল ছোটমা। বয়সে অনিমেষের সঙ্গে তার বিরাট পার্থক্য নেই। অনিমেষ বলল, বলো।

তোমাদের কি এখনও কলকাতায় থাকা দরকার?

দরকার কিনা তা জানি না, অভ্যেসে আছি।

একসময় তো এখানে থাকতেই অভ্যস্ত ছিলে।

কী ব্যাপার যদি একটু বুঝিয়ে বলল।

আমি এই ভূতের বাড়ির বোঝা বইতে পারছি না। ছোটমা মুখ নামাল।

বিক্রি করে দাও।

হেসে ফেলল ছোটমা, ভাল বললে! কিন্তু কেউ কিনতে চায় না, পেতে চায়।

মানে?

আমার শরীর খারাপ। ডাক্তার বলেছিল রোগটাকে নিয়েই থাকতে হবে। তা পাড়ার কয়েকজনকে বলেছিলাম বাড়ি বিক্রি করার কথা। একজন বলল, যেমন আছেন তেমন থাকুন। আপনার খাওয়া থাকা চিকিৎসার সব দায়িত্ব। আমার। বিক্রি করার কী দরকার, আপনি আমাকে অনেককাল চেনেন। তাই গিফ্ট করে দিন। ছোটমা মুখ তুলল, পাড়ার কাউন্সিলার এসেছিল খবরটা শুনতে পেয়ে। বলল, তার সঙ্গে কথা না বলে কাউকে যেন লিখে না দিই। অনিমেষের মনে হল সে কোনও অজপাড়াগাঁয়ে বসে আছে, জলপাইগুড়ি শহরে নয়।

.

০৭.

এত আগাছা, এত লতানো জঙ্গল কতদিন ধরে প্রশ্রয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। অনিমেষ সেই গাছগাছালির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার মনে পড়ল, বাল্যকালে এই বাড়ির বাগানে শেয়াল আসত। তখন বাগান ছিল খুব পরিষ্কার, দাদুর যত্নে তৈরি। তবু বড়পিসিমা সেই সাতসকাল অথবা ভর সন্ধ্যায় রান্নাঘরের ওপাশে দাঁড়িয়ে শিবা শিবা বলে চেঁচিয়ে ডাকতেন, অমনি তিস্তার দিকের মাঠ থেকে ছুটে আসত দুটো শেয়াল। বড়পিসিমার রেখে দেওয়া এঁটোকাটা গপগপ করে খেয়ে এই বাগানে বসে ল্যাজ নাড়ত। দেখে কুকুরের সঙ্গে তাদের আচরণের তেমন পার্থক্য বোঝা যেত না। পরের দিকে দুটোর বদলে একটা শেয়াল আসত পিসিমার ডাক শুনে। তখন তিস্তা নদী আর এই বাড়ির মাঝখানে যে পি ডব্লু ডি-র মাঠ ছিল তার অর্ধেকটাই বুনো ঝোপে ঢাকা। দিনের বেলায় সাহস করে সেখানে গিয়ে শেয়ালের গর্ত দেখে এসেছিল অনিমেষ। যেই তিস্তার জল বাড়ত, বাঁধ তৈরির আগের সেইসব দিনে শেয়ালেরা তুমুল চিৎকার করত। বড়পিসিমা বলত, আহা রে! গর্তে বোধহয় নদীর জল ঢুকে গেছে।

আজ এত বছর পরে এই জঙ্গলের বাগানে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল, এখানে শেয়ালদের আস্তানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। ঠিক তখনই সে সাপটাকে দেখতে পেল। কুচকুচে কালো মোটা সাপ, অন্তত সাত-আট ফুট লম্বা, জিভ বের করতে করতে এই গাছের ডাল থেকে আর এক গাছের ডালে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছে। সরে এল অনিমেষ। ছোটমা এদের সঙ্গে এখানে বাস করছে!

বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মাধবীলতা, ইশারায় কাছে যেতে বলল। ক্ৰাচটা এখন শুধু পায়ের বিকল্প নয়, অস্ত্রের প্রয়োজনও মেটাচ্ছে। একটা বিছেকে ক্রাচ দিয়ে মেরে ফেলে অনিমেষ মাধবীলতার কাছে গিয়ে বলল, ভয়ানক ব্যাপার। আজই এই জঙ্গল পরিষ্কার করানো দরকার।

কেন? মাধবীলতা সামনে তাকাল।

ভয়ংকর বিষধর সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কী করে বুঝলে বিষধর? তুমি কি সাপ চেনো?

দেখে তো মনে হল–!

তা হলে তোমার ছোটমা বলতেন। উনি তো সাপ যদি থাকে তা হলে তাদের চরিত্র ভাল করে জানেন। যাক গে, মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি খুব টায়ার্ড?

না। কেন? অনিমেষ অবাক হল।

একটু বাজারে যাওয়া দরকার। আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না, অবশ্য একটা রিকশা নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু তোমার ছোটমা সেটা কীভাবে নেবেন তা বুঝতে পারছি না।

মাধবীলতা বলল।

আমিই যাচ্ছি। কী আনতে হবে বলো।

মাধবীলতা একটা কাগজ এগিয়ে দিল, লিস্ট রেডি, তোমার কাছে যা আছে তাতে হয়ে যাবে।

আমার পকেটে টাকা আর হিসেব তুমি রাখছ। একটা কথা, তখন থেকে শুনছি, ওঁর কথা বলতে গেলে তুমি বলছ, তোমার ছোটমা, কেন?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হেসে ফেলল মাধবীলতা। বা রে! উনি তো তোমারই ছোটমা। তাই?

তোমার কে হন?

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মাধবীলতা। তারপর হাসল, ঠিক আছে, আমারও উনি ছোটমা। হয়েছে? যাও। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এখন এখানে বাজার খোলা থাকে কি না তা জানি না।

কিন্তু ছোটমা বললেন আমরা আসব ভেবে–

তার পরেও তো দরকার হতে পারে। লিস্টটা দেখলেই বুঝতে পারবে। কিন্তু বাজার করতে হলে একটা ব্যাগ দরকার হবে। মাধবীলতা পরামর্শ দিল, ওটা বাজার থেকে কিনে নিয়ো।

একটু বাদে অনিমেষ বাড়ির উলটোদিক দিয়ে বেরিয়ে এল। এদিক দিয়ে অল্প হাঁটলেই বড় রাস্তায় পড়া যাবে। ওখান থেকে রিকশা নিলে কয়েক মিনিট বাজার। এ পাশের সেই লোহার গেটটা এখনও রয়েছে।

কে? কী চাই?

গলা কানে যেতেই অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল। একজন বৃদ্ধ, পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি, হাতে খুরপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

অনিমেষ হাসল, আমি এই বাড়িতেই এসেছি, কাউকে চাই না।

বুঝতে পারলাম না।

বলছি। আপনি নিশ্চয়ই এদিকটায় ভাড়া নিয়ে আছেন?

হ্যাঁ।

যাঁকে আপনি ভাড়া দেন তিনি সম্পর্কে আমার মা হন। গেট খুলে বাইরে পা বাড়াতে বাড়াতে অনিমেষ লক্ষ করল বৃদ্ধের মুখের চেহারাটা বদলে গিয়েছে।

টাউন ক্লাবের মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই অনিমেষের মনে হল জলপাইগুড়ি শহরের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। একের পর এক যেভাবে রিকশা, সাইকেল, গাড়ি ছুটে যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট, শহরের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছে, এই অঞ্চলে শহরের মানুষ আসত দুটো কারণে। টাউন ক্লাব মাঠে খেলা খেলতে অথবা জেলা স্কুলে বাচ্চাদের পৌঁছাতে। শহরের দোকানপাট, ব্যাবসাবাণিজ্য, সব ওদিকে। এদিকটায় দিনভর ঘুঘু ডাকত। অথচ এখন একটাও খালি রিকশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক সওয়ারি নিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে। অনিমেষ চারপাশে তাকাল। একটা চায়ের দোকানও সাজিয়েছে এখানে। যতদূর মনে পড়ছে, এখানে একটা কয়লার দোকান ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে বলল, চা পাওয়া যাবে?

যাবে। একটু দেরি হবে, জল ফুটছে।

ঠিক আছে। অনিমেষ চারপাশে তাকাল। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর চেহারা প্রায় একইরকম রয়ে গেছে। শুধু সেই সময়ের মানুষগুলো এখন নেই। ওপাশের বেঞ্চিতে বসে একজন খবরের কাগজ পড়ছিল, সেটাকে ভাঁজ করে রেখে চলে গেল। যে ছেলেটি চা দিতে এল তাকে ইশারায় কাগজটা দিতে বলল অনিমেষ। ছেলেটি কাগজটা দিলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা কখন আসে?

সকাল সকাল। চায়ের দোকানদার জবাব দিল, কলকাতার কাগজ আসে দুপুর বেলায়। সেরকম কাগজ করতে পারেনি কিন্তু খবরটা তো আগে জানা যায়।

মাথা নাড়ল অনিমেষ। প্রথম পাতায় নজর বোলাতেই খবরটা পড়ল সে, ঝাড়গ্রামের কাছে পুলিশ-উগ্রপন্থী সংঘর্ষ, মৃত দুই? কিছুকাল ধরে এই ধরনের সংঘর্ষের খবর কাগজে পাওয়া যাচ্ছে। মূলত, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার গ্রামগুলোতে যেসব উগ্রপন্থী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত তাদের ইতিমধ্যে মাওবাদী বলা হচ্ছে। কেন মাওবাদী? ভারতবর্ষে তো মাওবাদ কখনওই তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয়নি। তারা যখন আন্দোলনের কথা ভেবেছিল তখন মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করেছিল। কেউ কেউ উচ্ছ্বাসের আধিক্যে স্লোগান তুলেছিল, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। একটু অস্বস্তি হত তখন, এখন ব্যাপারটাকে শুধু বোকামি বললে কম বলা হয়, অশিক্ষিত ভাবনা বলাই ঠিক হবে। তারপর তো বহুবছর চলে গেল। হঠাৎ মাও সে তুং-এর নামে নিজেদের চিহ্নিত করে যারা আত্মপ্রকাশ করল তারা ঠিক কারা?

চা ঠান্ডা হয়ে গেল যে!

চা-ওয়ালা বেরিয়ে এসেছে দোকানের ভেতর থেকে। চায়ের কাপ তুলে নিল অনিমেষ, ওহো।

কাগজের প্রথম পাতা পড়েই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন দেখলাম?

না, না। আপনার দোকান কত দিনের?

আর দোকান! এটাকে দোকান বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? লোকটি বিড়ি ধরাল।

হাসপাতালের সামনে কুড়ি বছর দোকান করেছি। হঠাৎ সরকারের মনে হল বেআইনি দোকান হঠানো দরকার। বেছে বেছে তুলে দিল কয়েকজনকে। আমাকেও।

বেছে বেছে মানে?

লাল পার্টির বাইরের লোকদের ওখানে আর রাখেনি।

আপনি লাল পার্টি করেন না?

আমি কোনও পার্টিই করি না। অবশ্য এখানে যেসব পার্টি আছে তাদের কারও রং গাঢ় লাল, কারও ফিকে লাল। বাকিরা সব ইলেকশনের আগে উঁকি মারে। বিড়ি নিভিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল চা-ওয়ালা, আপনাকে আগে দেখিনি।

অনেক বছর পরে এলাম।

আগে আসতেন?

হ্যাঁ। চায়ের দাম কত?

একটা টাকা দিন।

বেশ কম দাম তো!

তা-ই দিতে চায় না কেউ কেউ। চায়ের দাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ, খালি রিকশা পাওয়া দেখছি খুবই মুশকিল।

এই সময়টায়। অফিস কাছারির সময় তো। যাবেন কোথায়?

বাজারে। খোলা আছে নিশ্চয়ই।

মাছ ছাড়া সব দিন রাত খোলা থাকে। একটু দাঁড়ান, রিকশা পেয়ে যাবেন।

অনিমেষের খেয়াল হল। সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, বাগান পরিষ্কার করার লোক কোথায় পাওয়া যাবে বলুন তো!

বাগান মানে?

বাড়ির ভেতর বাগানটা জায়গায় জায়গায় আগাছা জমে জমে জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। কেউ না থাকলে যা হয়।

কোন বাড়ি বলুন, পাঠিয়ে দেব।

অনিমেষ বাড়িটার হদিশ জানাতেই চা-ওয়ালা মাথা নাড়ল, বুঝতে পেরেছি। একজন বৃদ্ধা থাকেন বোধহয়। আপনি ওঁর কে হন?

আত্মীয়।

অ। শুনেছি বড্ড মুখ ওঁর। ধারে কাছে কাউকে দেখলেই গালিগালাজ করেন। এসব শোনা কথা। ঠিক আছে, আপনি তো আছেন, পাঠিয়ে দেব। এই রিকশা। চিৎকার করে খালি রিকশা থামাল চা-ওয়ালা।

রিকশায় বসে ছোটমায়ের কথা ভাবল সে। বোঝাই যাচ্ছে এখানে খুব ভালভাবে ওঁকে গ্রহণ করছে না প্রতিবেশীরা। কোনও মানুষ যখন একা থাকতে বাধ্য হন তখন কীভাবে থাকবেন তা তিনিই ঠিক করবেন। বাইরে থেকে এসে উপদেশ দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

আশ্চর্য ব্যাপার। এত বেলাতেও মাধবীলতার লিস্টের সবকটা জিনিসই পেয়ে গেল অনিমেষ। নতুন ব্যাগে সেগুলো বইতে অসুবিধে হচ্ছিল। লিস্টে মাছ ছিল না। ডিম ছিল। সেগুলোকে সাবধানে ব্যাগে রাখতে হয়েছে।

বাজার থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্যে দাঁড়াতেই একটা সাইকেল তার সামনে দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেল চালাচ্ছেন একজন বৃদ্ধ। বুক অবধি সাদা দাড়ি, মাথায় টাক, সরু চশমা। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট।

সাইকেল থেকে নেমে একটু পিছিয়ে এলেন বৃদ্ধ। তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, এরকম মিল হয়?

অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ভদ্রলোক কী ভাবছেন। ব্যাগটা আর বইতে না পেরে মাটিতে রাখল সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ। তাকে শেষ দেখেছিলাম প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। তখন তার দুটো পা ঠিকঠাক ছিল। কানে এসেছিল, পুলিশ সে দুটোকে খুব ভালবেসেছে। তারও পরে শুনেছিলাম, সে মরে গেছে। কিন্তু মুখের গড়নে মিল পাচ্ছি। মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, নামটা জানতে পারি কি?

অনিমেষ মিত্র।

যাঃ শালা! বৃদ্ধের মুখটা বালকের হয়ে গেল। হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, বুঝলাম না। ততক্ষণে সাইকেল দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধ হাত বাড়ালেন, ব্যাগটা দে।

আমি এখনও চিনতে পারছি না।

চিনবি কী করে? মাথায় টাক, দাড়ির আড়ালে মুখ।

নামটা তো এক আছে।

না। সেটাও পালটেছে। গাঁয়ের লোক ডাকে পাগলা মাস্টার। অথচ আমি কোনওদিন স্কুলে পড়াইনি। হাসলেন বৃদ্ধ, তোর বড়পিসিমা কি আছেন?

না বিস্ময় বাড়ছিল অনিমেষের।

তোর বড়পিসিমার স্বামীর নাম মনে আছে?

সঙ্গে সঙ্গে নামটা ছিটকে উঠে এল গলায়, দেবেশ?

একদম চেনা যাচ্ছে না, না?

একদম না।

কবে এসেছিস?

আজই। উঃ, কী পালটে গিয়েছে তোর চেহারা।

এই তো জীবন! তোদের বাড়িতেই উঠেছিস তো?

হ্যাঁ।

তা হলে যাব তোদের বাড়িতে। তোকেও নিয়ে যাব আমার গাঁয়ে। এইসময় রিকশাটা কাছে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ দেখল রিকশাওয়ালা নেমে এসে তার ব্যাগটাকে নিয়ে বলল, বাড়িতে যাবেন তো?

দেবেশ বলল, এ কী! তুমি ওকে চেনো?

লছমন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু।

দ্যাখো কাণ্ড। দেবেশ আবার সাইকেলে উঠল, বিকেলে যাব।

আসিস।

সাইকেল চোখের আড়ালে চলে গেলে রিকশায় উঠল অনিমেষ। লছমন বলল, আপনি কেন বাজারে এলেন? মাসিমার বাজার তো আমি করে দিই।

এটা মাসিমার বাজার নয় ভাই।

রিকশা চলতে শুরু করল। করলা নদী পেরিয়ে যেতে না যেতেই অনিমেষ সেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। বিকেলে, খেলার মাঠ থেকে বন্ধুদের নিয়ে আসত সে। দাদু তখন হাঁটতে বেরিয়ে গেছেন। বড়পিসিমা তাদের সবাইকে বসতে বলে নাডু খাওয়াত। তার মুখে নাম শুনে পিসিমা অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল প্রথম দিন। তারপর থেকে দেবেশ গেলেই অন্যদের থেকে বেশি খাবার পেত। দেবেশ খেতে না চাইলে বড়পিসিমা খুব অনুরোধ করত। পরে অনিমেষ জানতে পেরেছিল এগারোতে বিয়ে হওয়া বড়পিসিমা বিধবা হয়েছিল সাড়ে এগারোতে। তারপর থেকে বাপের বাড়িতে। সেই ছয় মাসের স্বামীর নাম ছিল দেবেশ। অনিমেষের ক্লাস সেভেনের বন্ধু দেবেশকে কেন অন্য চোখে দেখেছেন তা তখন বুঝতে পারত না। দেবেশও জেনে গিয়েছিল।

এখন বড়পিসিমার জন্যে বুকের ভেতরটা যেন নড়ে উঠল অনিমেষের।

.

০৮.

লছমনই ব্যাগটাকে রান্নাঘরে পৌঁছে দিল। মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিল ছোটমার পাশে। হেসে বলল, বাপ রে! আমরা ভাবছিলাম বাজার নিয়ে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে।

হজম করল অনিমেষ, তারপর লছমনকে বলল, দুটো লোক চাই লছমন। এই বাগানের যত আগাছা, ফালতু জঙ্গল পরিষ্কার করে দেবে। জোগাড় করে দেবে?

লছমন হাসল, কোনও অসুবিধা নেই। কত করে দেবেন?

আমি তো এখানকার রেট জানি না। অনিমেষ বলল।

ছোটমার আপত্তি, কী দরকার এসব করার? যদি বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারো তা হলে যে কিনবে চিন্তাটা তার হবে।

অনিমেষ বলল, বিক্রি করতে চাই বললে তো কেউ সঙ্গে সঙ্গে কিনবে না। এক বছরও লেগে যেতে পারে। তদ্দিন ওরা এখানে থাকবে?

কারা থাকবে? মাধবীলতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সাপ। অনিমেষ বলল।

ছোটমা প্রতিবাদ করলেন, আছে তো কী হয়েছে? বহুদিন ধরেই আছে, কিন্তু কখনও কাউকে কামড়ায়নি। আমাকে দেখলেই ওরা সামনে থেকে সরে যায়।

ওরা সবাইকে এত সম্মান করবে তা ভাবার কোনও কারণ নেই। অনিমেষ মাথা নাড়তেই মাধবীলতা ছোটমার দিকে ফিরল, আপনি আপত্তি করবেন না, সাপের চেহারা মনে এলেই আমার শরীর কীরকম ঝিমঝিম করে ওঠে।

ছোটমা বললেন, ঠিক আছে। লছমন, আমার ফুলগাছগুলো যেন না মরে।

অনিমেষ অবাক হল, ছোটমা বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছেন অথচ ফুলগাছের ওপর তার মায়া যাচ্ছে না। বিক্রি হওয়ার পর গাছগুলো তো নাও থাকতে পারে। কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। কী হবে আঘাত করে।

লছমন বলল, আড়াইশো টাকা দেবেন, বাগান সাফ করে দেব।

দরাদরি করল না অনিমেষ, তা হলে কাল সকালেই পাঠিয়ে দাও।

লছমন মাথা নেড়ে চলে গেল।

.

দুপুরের খাওয়া মন্দ হয়নি। মাধবীলতাই বেঁধেছিল। কলকাতাতেও ওই রাঁধে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এখানে রান্নার অন্যরকম স্বাদ পেল সে। অবশ্য এটা জলের কারণে হতে পারে। জল স্বাদ বদলে দেয়। কথাটা মাধবীলতাকে বলতে সে চোখ বড় করল, সত্যি, আমার রান্না তোমার ভাল লেগেছে। আমি তো রাঁধতেই জানি না। শেখার সুযোগ পাইনি। আজ তোমার ছোটমা যেভাবে রাঁধতে বলেছেন সেইভাবে বেঁধেছি। কিন্তু তোমার পছন্দ হয়েছে কেন জানো?

অনিমেষ তাকাল।

তুমি এই বাড়িতে বসে খেয়েছ। এখানে তোমার বহু বছর কেটেছে। খেতে বসে সেই পরিবেশটা তোমার মনে হয়তো তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া যেসব মশলা দিয়ে তোমার ছেলেবেলায় এই বাড়িতে রান্না হত আজ খেতে গিয়ে তার গন্ধ পেয়েছ, এর মধ্যে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। মাধবীলতা বিছানার ওপাশে শুয়ে পড়ল। আমি ভাবছি এই ভদ্রমহিলার কথা। একা একা এতগুলো বছর এত বড় বাড়িতে কী করে বাস করছেন। জানো, ওঁর মধ্যে অদ্ভুত একটা নিরাসক্তি এসে গিয়েছে। কীরকম উদাস উদাস।

অনিমেষ কিছু বলল না।

যেদিন বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল সে। বরযাত্রীদের পেছন পেছন অনেকটা হেঁটেছিল বালক

অনিমেষ। মা মাধুরীর মৃত্যুশোক সে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত তার হাতে লেগে গিয়েছিল। চিতায় আগুন দেওয়ার সময় তা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। তাই বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে বড়পিসিমা যতই ছোটমা বলতে বলুক, মন থেকে মা বলতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কলকাতায় পড়তে যাওয়া পর্যন্ত সে ওই মহিলাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। তখন স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানে বাবার কাছে যেতেই ইচ্ছে করত না। তারপর যখন বাবা মদ্যপান শুরু করল, দাদুর কাছে খবরটা এল, তখন স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়ে ছোটমাকে দেখে প্রথমবার হোঁচট খেয়েছিল সে। ওই বাড়িতে কীরকম ন্যাতার মতো পড়ে থাকতেন অল্পবয়সি মহিলা।

আজ মনে হচ্ছে, বাবাকে বিয়ে করে ছোটমা এই জীবনে কিছুই পাননি। না সন্তান, না সম্মান। এই বাড়ির একটি কাজের লোক হয়েই বেঁচে থাকলেন এতদিন। বাবা অবসর নিয়ে জলপাইগুড়িতে চলে আসার পর হয়তো বড়পিসিমা ওঁকে কিছুটা স্নেহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারও তো দেওয়ার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ যেমন তাকে কখনওই মা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, তাকেও তিনি ছেলে বলে ভাবতে পারেননি, ভাবার সুযোগই পাননি। তা ছাড়া দুজনের বয়সের ব্যবধানও তো তেমন বেশি নয়। প্রশ্ন হল, বাবা এবং বড়পিসিমা মারা যাওয়ার পরে ছোটমা যখন একা হয়ে গেলেন, যখন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেন তখন কেন এই বাড়িতে আটকে থাকলেন? কথাটা পরদিন সকালে চা খাওয়ার সময় ছোটমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল অনিমেষ। প্রশ্নটা শুনে হাসলেন ছোটমা। মহিলা তেমন সুন্দরী ছিলেন না কখনও, এখন শরীর অতিরিক্ত শীর্ণ হয়ে গেছে, মুখের সর্বত্র তারই ছাপ। কিন্তু ঠোঁট এবং চিবুকে অপূর্ব মিষ্টিভাব এখনও ফুটে ওঠে যখন এইরকম হাসেন।

ছোটমা বললেন, কী করতে পারতাম আমি?

অনিমেষ বলল, এতবড় বাড়ি পাহারা না দিয়ে তখনই বিক্রি করে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে থাকা যেত।

বা রে! এটা কি আমার বাড়ি যে বিক্রি করব?

তা হলে কার বাড়ি?

ছোটমা মাধবীলতার দিকে তাকালেন, কার সঙ্গে ঘর করছ? একটুও বাস্তব বুদ্ধি নেই। সরিৎশেখর মিত্রের ছেলে মহীতোষ মিত্র। দুজনেই আজ নেই। তাদের একমাত্র বংশধর অনিমেষ মিত্র থাকতে এই বাড়ির মালিকানা আর কে পাবে? আমি তো যক্ষের মতো এসব পাহারা দিয়ে যাচ্ছি।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, কিন্তু আইন বলছে, মহীতোষ মিত্রের স্ত্রী হিসেবে আপনার এই বাড়ির ওপর অর্ধেক অধিকার আছে।

অধিকার! মাথা নাড়লেন ছোটমা, কী জানি!

অনিমেষ বলল, এতদিনে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, এই বাড়ি সম্পর্কে কোনও আগ্রহ আমার নেই। এর সঙ্গে যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেটা একদম আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিলতিল করে যা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যাকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, তাকে আগলে রেখে কী লাভ।

বেশ তো, যখন এসেই গেছ, যা ভাল বোঝো তাই করো। ছোটমা বললেন।

.

একটু বাদে লছমন চলে এল। সঙ্গে একটি তরুণ যার হাতে লম্বা দা, কাটারি, ঝুড়ি। অনিমেষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ও একা এই জঙ্গল কাটবে?

লছমন হাসল, না বাবু, আমরা দুজনে মিলে জঙ্গল সাফা করব।

সেকী! তুমি আজ রিকশা চালাবে না?

নাঃ। এখান থেকে কামাই হয়ে গেলে তো লোকসান নেই।

ভাল লাগল অনিমেষের। টাকা রোজগার করার সুযোগ পেলে এই শ্রমিকেরা সেটা হাতছাড়া করতে চায় না।

ওরা কাজ শুরু করে দিল। অনিমেষ লছমনকে মনে করিয়ে দিল সাপের কথা। কোনও গাছ কাটার আগে তরুণটি একটি লম্বা লাঠি দিয়ে ডালপালা জোরে নাড়াচ্ছিল। তারপর নিশ্চিত হয়ে দা অথবা কাটারি চালাচ্ছিল। অনিমেষ বারান্দায় এলে মাধবীলতা বলল, আমি আজ বাজারে যাব।

তুমি?

খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে।

তুমি তো এখানকার কিছুই চেনো না।

চিনে নেব।

কাল যা এনেছি তা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি!

না। একটু ভাল চাল আর মাছ নিয়ে আসব।মাধবীলতা বলল, টিপিক্যাল পুরুষদের মতো কথা বোলো না তো! হঠাৎ লছমনরা চেঁচামেচি শুরু করল। অনিমেষ এবং মাধবীলতা বাগানে নেমে আসতেই লছমন গলা তুলে বলল, বাবু, এখানে শেয়ালের বাচ্চা আছে। দুটো। মা-টা পালিয়ে গেল।

কোনওরকমে জায়গাটায় পৌঁছে ওরা দেখতে পেল একটা গর্তের মধ্যে দুটো শেয়ালছানা শুয়ে আছে। একজন ওঠার চেষ্টা করেও পারল না।

অনিমেষ বলল, কাণ্ড দেখো! ছোটমায়ের এই বাগানে শেয়ালও সংসার করছে।

এইসময় ছোটমায়ের গলা শোনা গেল, কী হয়েছে ওখানে?

লছমন জবাব দিল, এখানে শেয়ালের বাচ্চা আছে।

ওমা। তাই শেয়ালটা ঘুরঘুর করছে কয়েকদিন। কিন্তু ওখানে ওদের থাকতে দে। বড়দিদি ওদের খুব ভালবাসত। ছোটমা জানিয়ে দিলেন।

মাধবীলতা লছমনকে বলল, তোমরা অন্যদিকের জঙ্গল পরিষ্কার করো। এখন এদিকে আর হাত দিয়ো না। ওরা যেমন আছে, তেমনই থাক।

অনিমেষ বলল তেমনই থাক মানে? এ বাড়িতে শেয়ালের বাসা থাকবে?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, থাকবে না। মা শেয়ালটা নিশ্চয়ই দুর থেকে লক্ষ রাখছে। সুযোগ পেলেই সে বাচ্চাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে। বলল।

মাধবীলতা বাজারে চলে গেল। অনিমেষ তাকে বারংবার বলে দিল যে টাউন ক্লাবের মোড় থেকে যেন রিকশা নেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে পরপর দুটো সাপ মারল লছমনের সঙ্গে আসা তরুণ। ছোটমা বললেন, দুটোই শঙ্খচুড়। ছোবল মারলে বাঁচার সম্ভাবনা কম।

অনিমেষ বলল, এদের সঙ্গে বাস করা সহজ ব্যাপার নয়।

ছোটমা মাথা নাড়লেন, অথচ এরা কখনওই আমাকে কামড়ায়নি।

সাপের ওপর এত আস্থা রাখা বোধহয় ঠিক নয়।

কার ওপর আস্থা রাখব? মানুষের ওপর? মানুষ তো সাপের চেয়েও ভয়ংকর। সাপ ভয়ে ছোবল মারে, আত্মরক্ষার জন্যে। মানুষ ছোবল মারে আনন্দ পেতে, মজা লুঠতে। দশ বছর একা থেকে কত কী তো দেখলাম। কথাগুলো বলে ছোটমা চলে গেলেন তার ঘরে।

আধঘণ্টা বাদে কেউ বাইরে থেকে চিৎকার করল। অনিমেষ! অনিমেষ?

ডাক শুনে কাজ ফেলে লছমন এগিয়ে গেল ওপাশের গলিতে। তারপরই তাকে দেখা গেল দেবেশকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। দেবেশের হাতে সাইকেল।

অনিমেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, আয়। আমার কেবলই দেরি হয়ে যায়। কাল আসার কথা ছিল, আজ এলাম। বারান্দায় দুটো চেয়ার রাখা ছিল, তার একটায় বসল দেবেশ। অন্যটায় অনিমেষ।

দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কদ্দিন পরে এলি?

বহু বছর পরে।

একাই?

না। মাধবীলতাও এসেছে।

কই, ডাক, আলাপ করি।

বাড়িতে নেই। বাজারে গিয়েছে।

বাজারে? তোর বউ বাজারে গেছে?

কেউ যদি গিয়ে খুশি হয় তো যাক না।

জলপাইগুড়িতে এখন কোনও কোনও মহিলা বাজারে যান বিকেল বেলায়। এইসময় কাউকে তো যেতে দেখিনি। তোর ছেলেমেয়ে কজন?

একজন। তোর কী খবর?

এসেছি একা। যাব একা। পৃথিবীর কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি, তাই করা হয়নি। তুই যখন স্বর্গভেঁড়া থেকে আসতিস তখন দোমহনি নামে একটা জায়গা পড়ত, মনে আছে?

দোমহনি নয়, ময়নাগুড়ি থেকে বার্নিশঘাটে চলে আসতাম। তবে দোমহনি কোথায় তা আমি জানি।

তার কাছেই আমার আস্তানা। দশজন বুড়োবুড়িকে নিয়ে। দেবেশ বলল।

বুঝলাম না।

দশ বিঘে জমি বহুদিন আগে খুব অল্পদামে পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে চালাঘর বানিয়ে আছি আমরা। যেসব মানুষের রোজগার নেই, খাবার দেওয়ার কেউ নেই, মরার পর মুখে আগুন দেওয়ার মতো কোনও আত্মীয় স্বজন নেই, তারা আমার সঙ্গে থাকে। বছর দশেক হয়ে গেল। এর মধ্যে চারজন চলে গেল, তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে এনেছি। মনে হচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজনের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। দেবেশ বলল।

এই দশজনের থাকা-খাওয়ার খরচ তুই চালাচ্ছিস? অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।

থাকার খরচ তো নেই। খাওয়ার খরচ–। হাসল দেবেশ, আয় না। একদিন। নিজের চোখে দেখে আসবি।

যাব। খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।

ভাই। আমি তো একা বিপ্লব, সমাজসেবা কিছুই করতে পারব না। জীবনভর কোনও রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারিনি। শুনেছি তুই বিপ্লব করতে গিয়েছিলি, জেলে ছিলি। নিজের একটা পা তার জন্যে সেলামি দিতে হয়েছে, আমার সে সব করার ক্ষমতা বা সাহস ছিল না। আমি একটা কথা বুঝেছি। সেই বোঝার কাজটা করে বেশ শান্তি পাই। যাদের নিয়ে করি তারা পরের দিনের স্বপ্ন দেখে, যা আগে দেখত না। কবে যাবি বল? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।

এই তো এলাম। একটা বড় কাজ করতে হবে। সেটা আগে করি।

কী কাজ?

এই বাড়িতে আমার ছোটমা একা থাকেন। ওঁর পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করতে হবে।

ছোটমা– আমার দ্বিতীয় মা। দাদু,বাবা, বড়পিসিমা চলে গেছেন। উনি আছেন।

তাই বাগান পরিষ্কার করাচ্ছিস?

প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। না না। সাপখোপ জন্মাচ্ছে, শেয়াল বাচ্চা দিয়েছে ওখানে, তাই। ভাবছি এখানকার কাগজে বিজ্ঞাপন দেব।

তুই এক কাজ কর, কদমতলার মোড়ে একটা স্টেশনারি দোকান আছে। দোকানের মালিক জগদীশবাবু। সবাই চেনে। লোকটা বাড়ি কেনা-বেচার দালালি করে। ওর কাছে যা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তোর চেনা?

আগে চিনতাম। অনেক বছর যোগাযোগ নেই।

এই সময় অনিমেষ দেখল ছোটমা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইশারায় তাকে ডাকছেন। সে ক্রাচ নিয়ে এগিয়ে যেতেই ছোটমা বললেন, চা করেছি। সঙ্গে কি থিন অ্যারারুট বিস্কুট দেব।

ক্রাচ সামলে দুটো কাপ হাতে নেওয়া সম্ভব নয়। অনিমেষ ডাকল, দেবেশ, এদিকে আয়। দেবেশ উঠে এলে বলল, এর নাম দেবেশ। আমরা সহপাঠী ছিলাম।

মাথা নেড়ে ছোটমা ভেতর থেকে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এলেন।

অনিমেষ লক্ষ করল, একদিকে চিড় লাগা-কাপটা তাকে দিলেন ছোটমা।

বিস্কুট লাগবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

না না। মাথা নাড়ল দেবেশ, আমি চা খাই না। কিন্তু উনি নিজের হাতে দিলেন বলে আজ খাব।

অনিমেষ লক্ষ করল ছোটমায়ের মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।

.

০৯.

দেবেশের তাড়া ছিল। সে নিজের টেলিফোন নাম্বার লিখে দিল অনিমেষকে। বারংবার অনুরোধ করল একটা ফোন করে ওর ওখানে যাওয়ার জন্যে।

ওকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য টাউন ক্লাবের মোড় অবধি হেঁটে গেল অনিমেষ।

সাইকেলে চেপে দেবেশ চলে যাওয়ার পর অনিমেষ একটু চিন্তায় পড়ল। এতক্ষণে মাধবীলতার ফিরে আসার কথা। সে বাজারের রাস্তার দিকে তাকাল। এমনও হতে পারে, এই সময় রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। মাধবীলতা এসে গেলে দেবেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া যেত। হঠাৎ খেয়াল হল, দেবেশ তাকে ওর ওখানে যেতে বলেছে কিন্তু মাধবীলতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। কেন?

খুব চেনা চেনা লাগছে! এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।

অনিমেষ তাকাল। স্মৃতি ঝাপসা।

কবে আসা হয়েছে? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন। গতকাল।

যাঁরা ছিলেন তারা একজনকে রেখে চলে গিয়েছেন। বাড়িটার কী দশা হয়েছে! মহীতোষবাবু যখন বেঁচে ছিলেন তখন ভাবতেই পারতেন না এরকম হবে!

আপনাকে ঠিক–!

কয়েকবার দেখেছি। মহীতোষবাবুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন। অবসর নিয়ে এখানে এসে সময় কাটাতে আমাদের সঙ্গে তাস খেলতেন। তখন তার সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়। বন্ধুত্ব বলা বোধহয় ঠিক হবে না। বৃদ্ধ বললেন।

ও।

ছেলে নকশাল হয়ে জীবন নষ্ট করেছে, খুব আপশোস করতেন তিনি। যখন শরীরটা অকেজো হয়ে গেল তখন কলকাতায় পড়ে না থেকে এখানে চলে এলে ভাল হত না? মানুষটা শান্তি পেতেন। বাড়িটার হাল এমন হত না!

অনিমেষের মনে হল বৃদ্ধ অনধিকারচর্চা করছেন কিন্তু সেটা বলতে ইচ্ছে করল না। সে হাসল, আপনি কোন বাড়িতে থাকেন?

জেলা স্কুলের দিকে যেতে ডানদিকে ব্যানার্জিদের বাড়ি ছিল, মনে আছে?

হ্যাঁ। অরুণ ব্যানার্জি। দারুণ ক্রিকেট, হকি খেলতেন।

হ্যাঁ। অরুণ তো কবেই মারা গিয়েছে। ওই বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি।

মন্টুদের বাড়ি?

হ্যাঁ। মন্টু আমার ছোটভাই। দুবছর আগে মেয়ের বিয়ে দিল ডিসি অফিস থেকে রিটায়ার করে। গত বছর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল।

মন্টুর মুখটা ঝাপসা মনে হল। ফণীন্দ্রদেব স্কুলে পড়ত। খুব ভাল ছেলে ছিল না। অনিমেষ দেখতে পেল মাধবীলতা আসছে। রিকশার পাদানিতে বাজারের ব্যাগ। তাকে দেখে রিকশা দাঁড় করাল মাধবীলতা।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এত দেরি হল?

মাধবীলতা হাসল, পরে বলব। তুমি এখানে?

কথা খুঁজে না পেয়ে কাঁধ নাচাল অনিমেষ।

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি?

আমার স্ত্রী।

ও! বুঝলাম। আচ্ছা, চলি। যাওয়ার আগে বলি, সৎ মা হলেও তিনি তো মা। তার জন্যেও তো মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকা দরকার। বৃদ্ধ লাঠি নিয়ে চলে গেলেন।

রিকশায় বসে শুনছিল মাধবীলতা, জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি?

বাবার পরিচিত।

তুমি কি এখন বাড়িতে ফিরবে?

মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ। অনিমেষ বলল, না, তুমি যাও, আমি একটু ঘুরে আসছি।

সঙ্গে টাকা এনেছ?

খেয়াল হল। দেবেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে বাড়িতে যে পাঞ্জাবি পরে ছিল তাই পরেই বেরিয়ে এসেছে। পকেটে কিছু নেই।

ওঃ। তাই তো! অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল।

ততক্ষণে মাধবীলতা পার্স খুলে দুটো দশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালাকে বলল, ওকে দিয়ে এসো তো!

৬৭

নোট দুটো হাতে নিয়ে অনিমেষ বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

কথা না বাড়িয়ে মাধবীলতা রিকশাওয়ালাকে বলল, চলো।

.

মিনিট পনেরো পরে অনিমেষ কদমতলায় রিকশা থেকে নামল। সামনেই চৌধুরী মেডিকেল স্টোর্স। রামদার এই দোকানে এককালে দিনের পর দিন আড্ডা মেরে গিয়েছে সে। অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ রামদা, রাম চৌধুরী। কথা বলার ভঙ্গি ছিল বেশ মিষ্টি। রামদা কি বেঁচে আছেন? দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল অনিমেষ। দুজন কর্মচারীকে নিয়ে একজন যুবক দোকান সামলাচ্ছে। তারই ফাঁকে তাকে দেখতে পেয়ে যুবক জিজ্ঞাসা করল, কী ওষুধ নেবেন?

ওষুধ নয়। আমি বাহান্ন বছর বাদে এসেছি। এটা তো রাম চৌধুরীর দোকান?

হ্যাঁ। উনি আমার বাবা। যুবক হাসল।

উনি?

খুব অসুস্থ, শরীর ভাল থাকলে মাঝে মাঝে দোকানে আসেন। বলেই যুবক চোখ ছোট করল। আপনি কিছু মনে করবেন না ভুল হলে, আপনি কি অনিমেষ কাকু?

হ্যাঁ, ভাই। অনিমেষ জবাব দিল।

আরে। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। বলতে বলতে যুবক বেরিয়ে এসে অনিমেষের হাত ধরল।

না না। এখন তোমাদের কাজের সময়।

ছাড়ুন তো, ছেলেবেলায় আপনাকে দেখেছি এখানে বাবার সঙ্গে গল্প করতে। বাবা আপনার কথা খুব বলেন। এই, ভাল করে চা নিয়ে এসো তো! কর্মচারীকে আদেশ দিয়ে টেলিফোনের নাম্বার ঘোরাতে লাগল যুবক।

আহা! আবার চা কেন?

ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে যুবক বলল, বাবা, অনিমেষ কাকা এইমাত্র দোকানে এসেছেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনিই। তুমি পারবে? ঠিক আছে। সাবধানে এসো। হাঃ হ্যাঁ। চা বলে দিয়েছি।

যুবক রিসিভার নামিয়ে হাসল, বাবা আসছেন। দেখুন, আপনার নাম শুনেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, চা দিতে বলেছি কিনা!

উনি যখন অসুস্থ তখন আসার কী দরকার ছিল?

জানি না। আপনার নাম শুনেই বাবা বোধহয় অসুস্থতা ভুলে গেলেন।

তোমার নাম কী?

ছেলেটি জবাব দেওয়ার আগেই চা এসে গেল। তাই পরিবেশন করতে করতে খদ্দের সামলাতে হল। চায়ের কাপ মুখে তুলে অনিমেষ দেখল চিনি নেই বললেই চলে। মাধবীলতা আজকাল চায়ে চিনি তো কমই, দুধও দিতে চায় না। এরকম চা একদম পছন্দ নয় অনিমেষের। চা খেতে খেতে অনিমেষ ছেলেটির দোকানদারি দেখছিল। চল্লিশ বছর আগে সে যখন এই দোকানে এসে বসত, তখন রামদা ওইভাবে দোকান সামলাতেন। খদ্দের না থাকলে সামনের চেয়ারে এসে বলতেন, বলেন? আবার চা বলি?

সেসময় এই দোকানে বসে সে অনেক ওষুধের নাম শিখে গিয়েছিল। লক্ষ করেছিল, খদ্দেরদের অনেকেই যেমন ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে দোকানে ওষুধ কিনতে আসে, তেমনি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে সোজা দোকানে এসে কেউ কেউ বলেন তাঁর অসুবিধের কথা। সেটা খুব গুরুতর না হলে দোকান থেকেই ওষুধ দিয়ে দেওয়া হয়।

চা শেষ হলে রিকশাটা এসে দাঁড়াল দোকানের সামনে। রিকশাওয়ালা হাত ধরে অতিবৃদ্ধ যে মানুষটিকে নামাল তাকে রামদা বলে চেনা মুশকিল। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্থবির পা ফেলে কোনওমতে দোকানে ঢুকলেন বৃদ্ধ। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। যুবক ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে, কোনও কষ্ট হয়নি তো?

হাত নেড়ে না বললেন বৃদ্ধ। তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, আর কোনওদিন দেখা পাব ভাবিনি। বলেন, কেমন আছেন?

আছি। আপনি?

কিছুক্ষণ বাঁচি, দিনের বাকি সময়টায় মরে থাকি। বসুন। বৃদ্ধ বসলেন।

চেয়ারে বসে অনিমেষ বলল, বুঝলাম না।

হাসলেন বৃদ্ধ। আজকাল শুধু ঘুম পায়। জেগে থাকি আর কতটুকু। একদিকে ভাল। ঘুমাতে ঘুমাতে চলে যাব। আমি তো আর এই দোকানে আসতে পারি না। নিজে নিজে রিকশায় ওঠা-নামাই করতে পারি না। ওঃ, কতদিন পরে আপনাকে দোকানে দেখছি। কবে এসেছেন? কতদিন থাকবেন?

কাল এসেছি। কবে যাব জানি না। টিকিট কাটা হয়নি।

উদ্দেশ্য আছে কিছু?

ছিল না, আসার পর হয়েছে। আমার দ্বিতীয় মা বাড়িতে একা থাকেন। তিনি আর পারছেন না। বাড়ি বিক্রি করে দিতে বলছেন। বাড়িটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি দাম পেলে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চাই। অনিমেষ বলল।

অনিমেষবাবু, এখন চাই বললেই তা করা যায় না। আপনি তো বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন? এখন বাড়ি করা যেমন কঠিন ব্যাপার, বিক্রিও তেমনি। এই, চা দিয়েছিস?

অনিমেষ হাত তুলল, দোকানে ঢোকামাত্র চা বলে দিয়েছিল আপনার ছেলে।

রামদা হাসলেন, ও, কতদিন পর!

অনিমেষ লক্ষ করল কথাগুলো বলার পরেই যেন ঝিমিয়ে গেলেন রামদা। তার চোখ বন্ধ হল, মাথা একটু সামনে ঝুঁকল। ওঁর কিছু হয়ে যেতে পারে এই ভয় পেয়ে সে হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধের হাত স্পর্শ করতেই তিনি আবার আগের মতো সোজা হয়ে বসলেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? ওহো, বাড়ি বিক্রি করবেন। কিছু ভেবেছেন?

ভেবেছিলাম কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। কিন্তু কাল অনেকদিন পরে এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার মুখে শুনলাম এই কদমতলায় জগদীশবাবু নামে এক ভদ্রলোক আছেন যিনি বাড়ি কেনাবেচার ব্যাপারে সাহায্য করেন। ভাবছি তার সঙ্গে কথা বলব।

জগু? খুব ভাল। ওর অনেকদিনের মনোহারি দোকান থাকলেও বাড়ির দালালিও করে। রামদা বললেন।

অনেকদিন মানে? ষাট-পঁয়ষট্টি সালেও ছিল?

না না। তার কিছু পরে। আপনি দেখেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু শুনেছি ওর ব্যবহার ভাল, কেউ ওকে ঠকানোর অপবাদ দেয়নি। কথাগুলো বলে রামদা ছেলেকে বললেন, দ্যাখ তো, জগু দোকানে আছে কি না, থাকলে একবার আসতে বল।

যুবক একজন কর্মচারীকে পাঠাল জগদীশবাবুর সন্ধানে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোমার নামটা জানা হল না ভাই।

সুদীপ। যুবক বলল।

রামদা বললেন, পুরো নাম বলতে হয়।

সুদীপ চৌধুরী, বলে যুবক আর একজন খদ্দেরকে ওষুধ দিতে গেল।

আপনার ছেলেটি বেশ ভদ্র, চটপটে।

লেট ম্যারেজ আমার। ঠিক সময়ে বিয়ে হলে ওই বয়সের নাতি হওয়াই উচিত ছিল। চোখ বন্ধ করলেন বৃদ্ধ, বুঝলেন, এখন চোখ বন্ধ করে থাকতেই ভাল লাগে। কেন জানেন? চোখ বন্ধ করলে সারাজীবনে যত ঘটনা ঘটেছিল তা সিনেমার মতো দেখতে পাই। তখন তো প্রায়ই রূপশ্রী নয় আলোছায়াতে নাইট শো দেখতে যেতাম। যেসব শিল্পীরা অভিনয় করতেন তাঁদের প্রায় সবাই চলে গেছেন। এই যে শহর, বীরেন ঘোষ, এস পি রায়, চারু সান্যাল কী দারুণ জীবন্ত মানুষ ছিলেন। আজ তারা নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তাদের দেখতে পাই। কেন পাই?

রামদা হাসিহাসি মুখ করে তাকালেন।

আপনার মুখেই শুনি! অনিমেষ বলল।

কারণ এখন আমার চোখে আগামীকালের কোনও স্বপ্ন নেই। আগামী বছর দূরের কথা, আগামী সপ্তাহে কোথাও যাব, কিছু করব, তা ভাবতেই পারি না। তাই যেদিন চলে গিয়েছে তার স্মৃতিতে ডুবে থাকি। বৃদ্ধের কথা শেষ হতেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, আর একটু চা বলি কাকা?

অনিমেষ মাথা নেড়ে না বলল।

সুদীপ বলল, বহুদিন পরে বাবাকে এত কথা বলতে শুনছি। বাড়িতে তো কথাই বলতে চান না আজকাল। আপনাকে দেখে–!

রামদা হাসলেন, ওর নাম যেই তুই টেলিফোনে বললি অমনি আমি পুরনো দিনে চলে গেলাম। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। আমার তখন পঁচিশ কি ছাব্বিশ, উনি এসে ভেতরে বসতেন, চা খেতেন, সিগারেট খেতে হলে পেছনের স্টোর রুমে যেতেন। তখন ওঁর কত বয়স, ষোলো কি সতেরো।

অনিমেষ প্রতিবাদ করল, না রামদা, অত কম বয়সে সিগারেট খেতাম না। খেলে বন্ধুদের সঙ্গে তিস্তার চরে, কাশবনের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা সিগারেট চারজন মিলে টানতাম।

আহা সতেরো না হোক, কুড়ি। খেতেন তো!

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তখনও কি ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল? দোকানে বসে খাওয়া যাবে না তাই স্টোর রুমে যেতেন?

দূর! এখানে বসে খাবেন কী করে? মামা কাকা জ্যাঠারা আসছেন ওষুধ কিনতে। তারা দেখতে পাবেন না? তখন বড়দের সামনে সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবা যেত না। যদিও আমি ওঁর চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু আপত্তি করিনি। বৃদ্ধ হাসলেন।

এই শহরে আপনার অনেক আত্মীয় বুঝি?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, একমাত্র ঠাকুরদা ছাড়া এই শহরে আমার কোনও বয়স্ক আত্মীয় ছিলেন না। কিন্তু তখন যে-কোনও বয়স্ক মানুষকে আমরা মামা-কাকা-জ্যাঠা বলেই ভাবতাম। তাদের সামনে সিগারেট খেতাম না।

আপনি দোকানে এসেছেন শুনে খুব ভাল লাগল দাদা। বলতে বলতে এক প্রৌঢ় এসে ভেতরে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের পরনে হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি এবং ধুতি, মুখে দুদিন না কামানো দাড়ি।

এসো জগু। বসো। মন চাইলেও শরীর নড়ে না ভাই। এই ইনি এসেছেন। শুনে কোনওরকমে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে এলাম। রামদা বললেন।

বলুন, কী ব্যাপার? জগদীশবাবু বললেন।

আমার নাম অনিমেষ মিত্র। হাকিমপাড়ার বাঁধের কাছে বাড়ি। কলকাতায় থাকি। ওই বাড়িতে যারা থাকতেন তারা একে একে চলে গেছেন, একজন ছাড়া। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করে দিতে চাই। অনিমেষ বলল।

কোন বাড়িটা বলুন তো? জগদীশবাবু চোখ বন্ধ করলেন।

অনিমেষ বাড়ির লোকেশন বুঝিয়ে দিতে চোখ খুললেন ভদ্রলোক, বেশ বড় বাড়ি। আপনার ঠাকুরদা কি সরিশেখর মিত্র?

হ্যাঁ।

তাকে ছেলেবেলায় দেখেছি। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করার আগে আপনাকে কয়েকটা সমস্যার সমাধান করে নিতে হবে।

বলুন।

দাদার সামনে বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন যা নিয়ম তা না মেনে উপায় কী! প্রথমে আপনাকে আপনার পাড়ার সিপিএমের কাউন্সিলারের কাছে গিয়ে তাকে তুষ্ট করে অনুমতি নিতে হবে। আপনাদের পাড়ায় সিপিএমের ছেলেদের যে ক্লাব আছে তাদের সঙ্গে কথা বলুন। ওদের আপত্তি না থাকলে আমি সাতদিনে বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারব। জগদীশবাবু হাত কচলাচ্ছিলেন কথা বলতে বলতে।

.

১০.

অনিমেষ রামদার দিকে তাকাল। আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে বৃদ্ধের। সে জগদীশবাবুকে বলল, এখন এখানে এই নিয়ম চলছে?

এখানে? ও দাদা, শুনছেন? গলা তুললেন জগদীশবাবু।

চোখ খুললেন রামদা, সব কানে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ দেখে ভাববেন না যে কান ঘুমাচ্ছে। ওই আপনাদের কলকাতাকে বাদ দিলে গোটা বাংলায় নাকি এই নিয়ম এখন চালু হয়েছে।

জগদীশবাবু বললেন, নাকি নয়। এটাই ঘটনা!

আমি যদি আমার বাড়ি নিজের ইচ্ছেমতো বিক্রি করতে চাই ওরা কী করতে পারে?

বিক্রি করবেন কার কাছে? কেউ কিনবে না।

কেন?

আগে অনুমতি নিলে আপনাকে যতটা প্রণামী দিতে হত তা না দিলে যিনি কিনবেন তাকে ওই প্রণামী দিতে হবে। তা আপনার করা অন্যায়ের শাস্তি তিনি ভোগ করবেন কেন বলুন? জগদীশবাবু জানবেন।

এটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। কলকাতায় বসে আমরা তো এসব খবর পাই না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ওরা কেড়ে নিয়েছে?

কিছু মনে করবেন না, আপনার কথা শুনে অল্পবয়সে পড়া একটা গল্পের কথা মনে হল। নাম ভুলে গিয়েছি। সেই যে একটা লোক ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন বহু বছর কেটে গিয়েছে। লোকটা কিছুই চিনতে পারছে না। তাই জিজ্ঞাসা করছি, এতদিন কি আপনি ঘুমাচ্ছিলেন? জগদীশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

হ্যাঁ, আমার জানা উচিত ছিল। পাড়ায় ওদের দাদাগিরি দেখেছি। ভেবেছি ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলে যেসব অন্যায় অভ্যেস তৈরি হয়ে যায় এটাও তেমনি। মার্কসবাদ আমার পড়া আছে। এখন মার্কসবাদীরা যা করছে তা জানলে উনি কবরেও কেঁপে উঠতেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতে থাকায় ওরা এই পর্যায়ে চলে যাবে তা কল্পনা করিনি। আচ্ছা, মানুষ, পাড়ার মানুষ এক হয়ে আপত্তি করলে তো ওরা এত সাহস পেত না। অনিমেষ তাকাল।

মানুষ? কখনও দেখেছেন জল ঢালুর দিকে না গড়িয়ে ওপরে উঠছে? দুটো কারণে মানুষ মুখ খুলবে না। এক, ভয়ে। প্রতিবাদ করলে পাড়াছাড়া হতে হবে। মারধর তো বটেই, প্রাণও যেতে পারে। দুই, লোভ। প্রতিবাদ না করলে ছিটেফোঁটা হলেও চাইলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। জগদীশবাবু ঘড়ি দেখলেন, এবার আমাকে উঠতে হবে।

পুলিশও কি ঘুমিয়ে আছে?

অন্ধদের দেশে গেলে চোখ খুলে হাঁটতে খুব খারাপ লাগবে আপনার। তখন চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। পুলিশের তাই অবস্থা। উঠে দাঁড়ালেন জগদীশবাবু, সরকারকে চটিয়ে তো দেশে থাকা যায় না। আপনার পাড়ার কাউন্সিলারের সঙ্গে আলাপ আছে?

তিনি কে, কী নাম, কিছুই জানি না। অনিমেষ গম্ভীর হল।

হরু সেন, এই নামেই সবাই চেনে। ভাল নাম, হরেন্দ্রনাথ সেন। চিনতে পারছেন?

একটু ভাবল অনিমেষ। না, স্মৃতিতেও ওই নামের কেউ উঁকি দিচ্ছে না।

চোখ খুললেন রামদা, আঃ জগু, তখন থেকে কেবলই এক কথা বলে যাচ্ছ! তোমার সঙ্গে তো লোকটার পরিচয় আছে। তুমিই অনিমেষবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যাও। দেরি করার দরকার নেই। আজ বিকেলেই যাও।

জগদীশ হাসল, ঠিক আছে, আপনি বলছেন যখন, তখন যাব। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব। আমি সন্ধে ছটা নাগাদ আপনাকে ডেকে নেব। তার আগে তো ওকে পাওয়া যাবে না। চলি। জগদীশবাবু বেরিয়ে গেলেন।

রামদা মাথা নাড়লেন, এখন যে পুজোর যা মন্ত্র না আউড়ে উপায় নেই। কথা বলে দরাদরি করা ছাড়া তো কোনও উপায় নেই।

.

রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছিল অনিমেষ। বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় লোকজন এখন কম। রূপশ্রী সিনেমাহলের সামনে দিয়ে আসার সময় মনে হল, এখন কোনও ছবি দেখানো হচ্ছে না। গেট বন্ধ, কী ব্যাপার কে জানে! বাঁ দিকে রুচি বোর্ডিং-এর গলি, ডানদিকে যোগমায়া কালীবাড়ি। চোখ বন্ধ করলেও সে এইসব রাস্তার ম্যাপ এঁকে দিতে পারে।

রামদার শরীরের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। রিকশায় ওঠার আগে রামদা হাত ধরে বলেছিলেন, যে কটা দিন এখানে আছেন, একটু খোঁজখবর নেবেন। এরপরে তো আর দেখা হবে না।

অন্য কেউ হলে প্রতিবাদকরত অনিমেষ, আজ পারেনি। মানুষটার অর্ধেকটা যেন পৃথিবীতে নেই। স্মৃতিগুলো যেন আচমকা নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দিল। থানার সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে বলল, ওই দোকান থেকে সিগারেট কিনে এনে দেবে ভাই?

কী সিগারেট?

ফিল্টার উইলস। বলেই খেয়াল হল, প্যাকেট নয়, তুমি একটা নিয়ে এসো, সঙ্গে দেশলাই। টাকা নিয়ে চলে গেল রিকশাওয়ালা। বেশ কিছুদিন সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করেছে। বলা যেতে পারে মাধবীলতা তাকে বাধ্য করেছে। একেবারে পুঁদে গোয়েন্দার মতো পেছনে লেগে থাকত, টিকটিক করত। শেষে ধুত্তোরি বলে খাওয়া বন্ধ করেছিল সে। আজ যদি প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে ফেরে তা হলে আর রক্ষা থাকবে না। কিন্তু অনিমেষের মনে হচ্ছিল, এসবের থেকে বেরিয়ে আসতে তার সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। এটা মাধবীলতা বুঝবে না। রিকশাওয়ালা সিগারেট, দেশলাই এবং ফিরতি পয়সা ফেরত দিল। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইটা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দিল সে, এটা তুমিই রাখো। আর হ্যাঁ, যতটা পারো আস্তে রিকশা চালাও।

বাবু আস্তে চালালে আমার রোজগার কমে যাবে। পুষিয়ে দেবেন তো?

রিকশাওয়ালার কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ। সদ্য টানা ধোঁয়া গলায় আটকে গেল। খক খক করে কাশতে কাশতে অনিমেষ ইশারা করল জোরে চালাতে।

.

দুপুরের খাওয়ার সময় ছোটমা ছিলেন না। প্রশ্ন করতে মাধবীলতা তথ্য দিল, উনি এখনও পুজোর ঘরে।

সেকী! খাবেন না?

বললেন, তোমরা খেয়ে নাও।

পিসিমার পথে হাঁটছেন নাকি! তিনি দুপুরের খাবার খেতেন বিকেল সাড়ে তিনটের সময়। ফলে অ্যাসিড হত, বলতেন অম্বল হয়ে গেছে। তাই রাত্রে একটু মুড়ি ছাড়া কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হত না। অনিমেষ বলল।

এত রোগা কেন হয়ে যাচ্ছেন তা তো বোঝাই যাচ্ছে। মাধবীলতা গম্ভীর।

পয়সা বাঁচানোর জন্যে এটা করছেন না তো?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, জানি না। এ কথা তো জিজ্ঞাসা করা যায় না।

একটা কিছু করা দরকার।

পথ তো একটাই। এই বাড়ি বিক্রি করে ওঁকে একটা ভাল জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা। তোমাকে সেটাই করতে হবে। মাধবীলতা বলল।

অসম্ভব। জোর গলায় বলল অনিমেষ।

তার মানে? মাধবীলতা অবাক।

অনিমেষ জগদীশবাবুর বলা কথাগুলো মাধবীলতাকে জানাল। বলল, আমার পক্ষে বেআইনি কাজ করা সম্ভব নয়।

বেআইনি মানে?

আমার বাড়ি আমি বিক্রি করতে পারব না। তার জন্যে সিপিএমের কাউন্সিলারের অনুমতি নিতে হবে। তাদের ক্যাডারদের ক্লাবে গিয়ে হাতজোড় করতে হবে। কেন? আমার বাড়ি তো তাদের সম্পত্তি নয়। অনিমেষ উত্তেজিত।

ওদের কাছে না গিয়ে সরাসরি বিক্রি করার চেষ্টা করো।

শুনলাম কেউ কিনতে চাইবে না। সবাই জানতে চাইবে অনুমতি নিয়েছি কিনা। আমরা যখন রাজনীতি করতাম তখন কোনও বামপন্থী পার্টি এসব করার কথা চিন্তাও করত না। এমন ভয়ংকর পরিবর্তন মানুষ বেশিদিন মেনে নিতে পারে না।

মাধবীলতা বলল, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। এখন কি কলকাতার জন্যে এক নিয়ম আর বাকি পশ্চিমবঙ্গে অন্য নিয়ম চলছে। এই তো, আমার সঙ্গে কাজ করতেন শীলাদি, বাগবাজারের বাড়ি বিক্রি করে ছেলের কাছে থাকতে দিল্লি চলে গেলেন। কই, তাকে তো কারও কাছে অনুমতি নিতে হয়নি। তুমি যা শুনেছ তা সত্যি নাও হতে পারে। তোমাদের এই পাড়ায় যিনি কাউন্সিলার তাঁকে চেনো?

না। লোকটা কে তাই জানি না।

একবার যাও না ওঁর কাছে।

কোনও দরকার নেই। থাক পড়ে বাড়ি। ছোটমাকে রাজি করাও কলকাতায় গিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে। অনিমেষ বলল।

আশ্চর্য! আমাদের তো দুটো ঘর। উনি কোথায় থাকবেন? ওঁর ঠাকুর কোন ঘরে থাকবেন? অন্তত চার ঘরের ফ্ল্যাট দরকার। কত ভাড়া জানো?

বিকেল চারটে নাগাদ লছমনের গলা শোনা গেল, বাবু!

শুয়ে ছিল অনিমেষ। ক্র্যাচ নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলে লছমন বলল, একবার দেখে নিন বাবু। যদি বলেন নীচের ঘাসগুলো কাল এসে তুলে দিয়ে যেতে পারি।

অনিমেষ বাগানটার দিকে তাকাল। একমাথা ঝাকড়া চুলের কোনও মানুষকে কদমছাঁট দিলে যেমন দেখাবে বাগানটাকে তেমনই দেখাচ্ছে। বুনো ঝোঁপ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, কিছু গাছের বাড়তি ডাল কেটে ফেলেছে লছমন। ওদিকে যে দুটো নারকোল গাছ প্রায় আড়ালে পড়ে গিয়েছিল তারাও অনেক নারকোল নিয়ে দৃশ্যমান। সুপুরি গাছগুলো এখন ছিমছাম।

ফুলের গাছগুলো কেটে ফেলোনি তো?

না বাবু। মাসিমা মেরে ফেলবেন। লছমন হাসল।

বাগানে নেমে এল অনিমেষ। এত অল্পসময়ে এই দুজন যে কাজ করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। নীচের ঘাসগুলো তুলে ফেললে দেখতে হয়তো ভাল লাগবে কিন্তু বৃষ্টি পড়লেই কাদা হয়ে যাবে।

লছমন বলল, শেয়ালটা বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে ওই ওধারে গেছে।

যেদিকটা হাত দিয়ে লছমন দেখাল সেদিকটা বাড়ির পিছন দিকে। বেশ ঝোঁপ রয়েছে।

অনিমেষ বলল, বাঃ, ভাল হয়েছে।

কিন্তু দেখবেন, রাত্রে ও বাচ্চাদের এখানে নিয়ে আসবে।

কী করে বুঝলে?

মাসিমা যে সন্ধের সময় ওকে খেতে দেয়।

বড়পিসিমার কথা মনে পড়ে গেল। একজন চলে গিয়েছেন, অন্যজন তার অভ্যেসগুলো রপ্ত করেছেন।

লছমন এগিয়ে গিয়েছিল তারের বেড়ার কাছে, বাবু, দেখুন।

অনিমেষ কাছে পৌঁছে দেখতে পেল গোটা চারেক কালো রঙের বড় সাপ, সঙ্গে অনেকগুলো বাচ্চার মৃত শরীর পড়ে আছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী করে ওদের মারলে?

আমি মারিনি, ও মেরেছে। দুরে দাঁড়ানো তরুণকে দেখাল।

বাব্বা! দারুণ সাহস তো, এসব খুব বিষধর সাপ। খুব ঝুঁকি নিয়েছে ও। কামড়ালে বাঁচানো খুব কষ্টকর হত। অনিমেষ বলল।

লছমন হাসল, ও এর আগেও সাপ মেরেছে। বাগানে আর সাপ নেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল লছমন বলতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা লছমন, তোমাদের এই পাড়ার কাউন্সিলার কে জানো?

হ্যাঁ। ভোম্বলবাবু।

কোথায় থাকেন?

জেলা স্কুলের পেছনের রাস্তায়।

ভোম্বল তো কারও ভাল নাম হতে পারে না। আসল নাম কী?

তা জানি না। ছেলেবেলা থেকে শুনেই লোকে ওঁকে ওই নামে ডাকে। টাউন ক্লাবে ফুটবল খেলতেন ওঁর দাদা। তার নাম ছিল কমল।

কমল? অনিমেষের মনে পড়ল সে যখন স্কুলে পড়ত তখন টাউন ক্লাবে ব্যাক খেলত কমল নামে এক তরুণ যার বাড়ি ছিল সেনপাড়ায়।

লছমন বলল, বাবু, কাজ তো হয়ে গেছে, যদি আমাদের ছেড়ে দেন।

দাঁড়াও।

মাধবীলতার কাছ থেকে টাকা এনে লছমনকে দিল অনিমেষ। তারপর বলল, তুমি যদি আজ রিকশা বের করে তা হলে একবার এসো তো!

আপনি কোথাও যাবেন?

হ্যাঁ। ওই ভোম্বলবাবুর কাছে যেতে হবে।

ঠিক আছে। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে নিয়ে আসছি। সঙ্গে নিয়ে আসা সরঞ্জাম নিয়ে লছমন আর তরুণ চলে গেল।

মাধবীলতা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। ছোটমা বেরিয়ে এলেন। মুখে আঁচল চাপা। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

কিছু না। আঁচল না সরিয়ে বললেন ছোটমা, মাঝে মাঝে দাঁতে ব্যথা হয়।

ডাক্তার কী বলছে?

দূর! ছোটমা আবার তার ঘরে চলে গেলেন।

অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, বোঝো!

মাধবীলতা কথা ঘোরাল, তুমি তা হলে কাউন্সিলারের কাছে যাচ্ছ। মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলবে। যদি চাও তা হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

না, আমি একাই যাই। গিয়ে শুনি কী বলেন তিনি!

১১-১৫. কুড়ি মিনিট পরে

কুড়ি মিনিট পরে লছমন একটি সুন্দর দোতলা বাড়ির সামনে রিকশা থামিয়ে বলল, এইটা ভোম্বলদার বাড়ি।

পাশেই জেলা স্কুল। ছেলেবেলায় এই পাড়াটায় দোতলা বাড়ি দেখেনি অনিমেষ। বোঝাই যাচ্ছে পরে চেহারা বদলেছে। লছমনের সাহায্যে সে রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে বাগানের ভেতরে ঢুকল। দোতলার বারান্দা থেকে একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?

ভোম্বলবাবু আছেন?

এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরে আসুন।

অনিমেষ ইতস্তত করছিল, এই সময় একজন বৃদ্ধ গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। বয়স বাড়লেও মুখটা বদলায়নি। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কমলবাবু–?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি অনিমেষ মিত্র। জেলাস্কুলের ছাত্র ছিলাম।

অনিমেষ, অনিমেষ, নাঃ, মনে পড়ছে না। ডোম্বলের কাছে এসেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।

আসুন। নীচের একটি ঘরে অনিমেষকে বসিয়ে কমলবাবু চলে গেলেন। তার মিনিট পাঁচেক বাদে টাক মাথা, লম্বা যে লোকটি ঘরে এলেন তিনি পান চিবোচ্ছেন। চেয়ারে বসে চোখ ছোট করে বললেন, আরে কী খবর? কেমন আছেন?

আপনি আমাকে চিনতে পারছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হে হে। এতবছর রাজনীতি করছি ব্রেনটা তো এমনি এমনি স্ট্রং হয়নি। আমাদের এই পাড়ার কাউকে ক্রাচ হাতে চলতে দেখিনি। গতকালই শুনলাম এক ভদ্রলোক এসেছেন যাকে ওইটের ওপর নির্ভর করে হাঁটতে হয়। কে ভদ্রলোক? না, তিনি আমাদের পাড়ার মিত্তির বাড়িতে উঠেছেন। তখনই মনে পড়ে গেল। আমাদের বঙ্কিমদার মুখে শুনেছিলাম, মিত্তিরবাড়ির একজন আমাদের পার্টি করতেন, পরে নকশাল হয়ে গিয়ে জেলে যান, পুলিশের অত্যাচারে একটা পা খোয়া যায়। সেটা অবশ্য সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমল। আমরা ক্ষমতায় এসে আপনাদের জেল থেকে ছেড়ে দিই। কী? ঠিকঠাক বলছি কি না? ভোম্বলবাবু হাসলেন।

তথ্যে একটু ভুল থেকে গেল!

কীরকম? কীরকম?

বামফ্রন্ট আমাদের ছেড়ে দেয় বন্দিমুক্তি আন্দোলন হয়েছিল বলে!

দুর মশাই। আন্দোলন ফান্দোলন করে কিছু পাওয়া যায় নাকি? সরকার যদি বলে আমি রাজি নই, কোনও আন্দোলনই তাকে রাজি করাতে পারবে না। ভোম্বলবাবু বললেন।

কী আশ্চর্য। আপনি কমিউনিস্ট হয়েও এমন কথা বলছেন?

না না ভুল কথা। আমি কমিউনিস্ট নই। আমি পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। যাক গে, নকশাল আন্দোলন করে জেল থেকে বের হওয়ার পর আপনি বসে গিয়েছেন?

আমি এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই।

কেন? শরীরের জন্যে?

না। মন নিতে পারছে না।

যাক। কেন এসেছেন সেটা শোনা যাক।

এখানকার বাড়িতে আমার মা ছাড়া আর কেউ থাকেন না। তার বয়স হচ্ছে, আর একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য একটি পরিবার ভাড়াটে হিসেবে আছে, তাতে কোনও সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বোধহয় জানেন, উনি বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চান। অনিমেষ যতটা সম্ভব সবিনয়ে জানাল।

বিলক্ষণ জানি। আমি তো গিয়েছিলাম মাসিমার কাছে, বলেছিলাম, আপনার থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব আমার। প্রতিদিন দুবেলা আমার লোক এসে জেনে নেবে আপনার কী কী দরকার। এ পাড়ার কোনও মা একা থাকতে পারছেন না বলে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবেন, এ তো আমারই লজ্জা। তা উনি রাজি হলেন না। ভোম্বলবাবু আপশোসের ভঙ্গি করলেন।

অনিমেষ বলল, কীভাবে বাড়িটা বিক্রি করা যায়?

ডিফিকাল্ট। গম্ভীর হলেন ভোম্বলবাবু।

কেন?

মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার হিসেবে আমি জানি, গত বারো বছর ধরে আপনারা বাড়ির ট্যাক্স দেননি। জমতে জমতে সুদে আসলে ঠিক কী পরিমাণে পৌঁছেছে তা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে। এতদিন দেননি বলে মিউনিসিপ্যালিটি পেনাল্টিও করতে পারে। এই অবস্থায় কে বাড়ি কিনবে বলুন?

এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না।

ঠিক আছে, আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

বাড়ির ট্যাক্স কি খুব বেশি?

না, না। সামান্য। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।

তা হলে–!

শুনুন। আমাদের পাড়ায় মা-কালীর কোনও মন্দির নেই। মানুষকে এখনও অনেকটা হেঁটে যোগমায়া কালীবাড়িতে যেতে হয়। তাই সবাই চাইছে একটা মন্দির তৈরি করতে। এর জন্যে আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা জমিও পেয়ে গেছি। কিন্তু শুধু জমি পেলেই তো মন্দির হয় না। বলুন হয়?

নীরবে মাথা নাড়ল অনিমেষ।

আর চারটে দেওয়ালের ওপর ছাদ করে তার মধ্যে তো মাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি না। লোকে বলবে ভোম্বলবাবু দায়সারা কাজ সারল। এমন একটা মন্দির তৈরি করতে হবে যার প্রশংসা পুরো নর্থ বেঙ্গলের মানুষের মুখে মুখে ছড়াবে। আর শুধু মন্দির করলেই তো হল না, মায়ের মূর্তিটাও ফাটাফাটি হওয়া চাই। প্রচুর খরচ। লোকে অবশ্য চাঁদা দিচ্ছে। তা, আপনি যদি সাহায্য করেন। ভোম্বলবাবু হাত জোড় করলেন।

আপনি বললেন কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করেন, পার্টির কর্মী। আপনি কী করে কালীমন্দির তৈরির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা না করে পারল না।

কিছু মনে করবেন না অনিমেষবাবু, অনিমেষই তো, হা, দুঃখ হয় যখন দেখি আপনারা এখনও একশো বছর পিছিয়ে আছেন। গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেল, কিন্তু আপনাদের কোনও পরিবর্তন হল না। আপনারা বলেছিলেন, চিনের চেয়ারম্যান নাকি আপনাদের চেয়ারম্যান। পাবলিক আপনাদের অ্যাকসেপ্ট করেনি। কিন্তু যদি বলতেন, চৈতন্যদেব আপনাদের চেয়ারম্যান– বাংলা-ওড়িশা আপনাদের মাথায় করে রাখত। মার্কস সাহেব তার দেশে বসে কমিউনিজম নিয়ে ভেবেছেন, সেটা যেসব দেশ আঁকড়ে বসে ছিল সেখান থেকে কমিউনিজম হাওয়া হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব পরিমণ্ডল আছে, মানুষের মানসিকতাও আলাদা। আমি আপনি রাতারাতি বদলাতে পারব? পারব না। তাই আমাদের আদর্শকে সেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া একটা মন্দিরকে আপনি অন্ধ সংস্কারের প্রতীক হিসেবে দেখছেন কেন? তাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হবে, তাদের কাছে পৌঁছোবার জন্যেও তো আমরা মন্দিরটাকে ব্যবহার করতে পারি।

ভোম্বলবাবু এতক্ষণ বক্তৃতার ঢঙে বলে যাচ্ছিলেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করুন, আমি অল আউট করব।

কীভাবে?

আপনাদের বাড়িটা বিক্রি করলে কত পাবেন? অনেকটা জমিও তো আছে!

আমার কোনও ধারণা নেই। অনিমেষ বলল।

চোখ বন্ধ করে একটু ভাবলেন ভোম্বল রায়, অ্যারাউন্ড টোয়েন্টি। আঠারো তো পাবেনই। একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। এই টাকা কীভাবে খরচ হবে?

মায়ের নামে ব্যাঙ্কে থাকবে, ওঁর যা ইচ্ছে তাই করবেন।

উনি থাকবেন কোথায়?

এখনও জিজ্ঞাসা করিনি। ইচ্ছে হলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন। নইলে সুদের টাকায় স্বচ্ছন্দে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকবেন।

খুব ভাল কথা। উনি তো সন্তানহীনা। ওঁর যা কিছু তা আপনিই পাবেন। দেখুন অনিমেষবাবু, এই বাড়ি বিক্রি না হলে আপনি কিছুই পেতেন না। আর একটা সমস্যা আছে। শুনেছি বাড়ি বানিয়েছিলেন আপনার ঠাকুরদা। তিনি আপনার বাবাকে আইনসম্মতভাবে দিয়ে গিয়েছেন? আপনার বাবা কি কোনও উইল করে মাসিমাকে বাড়ি জমি দিয়েছেন? ভোম্বলবাবু তাকালেন।

আমি ঠিক জানি না। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

তা হলে খোঁজ করুন, কোনও উইল আছে কিনা? না থাকলে মাসিমা এবং আপনি উত্তরাধিকারী হবেন। অবশ্য সেটা আইনসম্মত করে নিতে হবে। এমন কিছু সমস্যা নয়। কিন্তু উইলে যদি আপনার বাবা আপনাকে বঞ্চিত করে যান তা হলে মাসিমার অবর্তমানে তার সম্পত্তি আপনি পেতে পারেন না। আশা করি তা হয়নি। হ্যাঁ, প্রায় পড়ে পাওয়া চৌদ্দো আনার মতো আপনি লক্ষ লক্ষ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। আমার অনুরোধ, তার অতি সামান্য অংশ দিয়ে মায়ের মূর্তিটি আপনি কিনে দিন। খাস ফেললেন ভোম্বলবাবু।

মায়ের মূর্তি? অনিমেষ অবাক।

হ্যাঁ, মন্দিরের ভেতরে যে মা কালীর মূর্তি থাকবে, যাঁকে লক্ষ লক্ষ মানুষ পুজো করবে, তা আপনি দিয়ে পুণ্য অর্জন করুন। মাথায় দুটো হাত ঠেকালেন ভোম্বলবাবু।

অনিমেষ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। খরচ এমন কিছু বেশি নয়। অষ্টধাতুর মূর্তি। একটু বড় না হলে তো চোখে পড়বে না। মায়ের পায়ের মল আর রুপোর খাড়া। লাখ পাঁচেক আমাকে দিলে আমি কিনে নেব। আরে মশাই, আপনি যা পাচ্ছেন তার টোয়েন্টি পার্সেন্টে জনগণের সেবা করবেন। ঠিক আছে? আপনার স্ত্রী এসেছেন তো? তার সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে খদ্দের নিয়ে আসব। আচ্ছা, আমাকে একটু পার্টি অফিসে যেতে হবে। উঠে দাঁড়ালেন ভোম্বলবাবু।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনি যে এসব করছেন, তা আপনার পার্টি জানে?

দেখুন মশাই, আমি কি চুরি করছি যে লুকিয়ে করব? নৃপেনদাকে মনে আছে? ছেলেবেলা থেকে সিপিআই করতেন, পরে সিপিএমে। জেলা সম্পাদক হয়ে আছেন বহু বছর। তাঁকে নিয়ে এসে মন্দিরের জমিটাকে দেখিয়েছি। পার্টি থেকে কোনও সাহায্য নেব না বলেই তো আপনাদের কাছে হাত পাতছি। মন্দিরের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে মাসিমার নাম লিখে জানিয়ে দিতে পারি তিনিই দান করেছেন। চলুন। বাইরে বেরিয়ে রিকশাটাকে দেখলেন ভোম্বলবাবু। চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই, দাঁড়িয়ে আছিস বলে ওয়েটিং চার্জ নিবি না। আমার লোক।

লছমন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। অনিমেষ রিকশায় না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মোটরবাইকে চেপে বেরিয়ে গেলেন ভোম্বলবাবু।

রিকশা চালাতে চালাতে লছমন বলল, উনি বাইক চালান, গাড়িতে ওঠেন না। গাড়ি চড়েন ওঁর ছেলে, বউ।

অনিমেষ গম্ভীর হয়ে বসে ছিল।

.

বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ দেখল ছোটমা বারান্দায় বসে একটি বালকের সঙ্গে বেশ হাসিমুখে গল্প করছেন। অনিমেষকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? মুখ গম্ভীর কেন?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। পেছন পেছন আসছিল লছমন। চেঁচিয়ে বলল, বাবা, বাবুকে প্রণাম কর।

বালক এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চাইলে অনিমেষ তাকে বাধা দিল, না না। প্রণাম করতে হবে না। তুমি কে?

লছমন পাশে এসে বলল, আমার ছেলে। মাসিমা ওকে খুব ভালবাসেন।

ছোটমা বললেন, লক্ষ্মী ছেলে। আমার কথা খুব শোনে। আয় বাবা।

তোমার নাম কী?

অর্জুন। ডাকনাম, বাবা। বালক বলল।

বাঃ। এরকম ডাকনাম তো কখনও শুনিনি।

জন্মাবার পরে ওকে বাবা বলে ডাকা শুরু হয়। সেটাই ওর ডাকনাম হয়ে গেছে। লছমন বলল। আঁচলের খুঁট থেকে এক টাকার কয়েন বের করে বাবার হাতে দিয়ে ছোটমা বললেন, লজেন্স কিনে খাস।

আপত্তি করল লছমন, না না দেবেন না। অভ্যেস খারাপ হবে।

তুমি চুপ করো। ধমক দিলেন ছোটমা, যা বাবা। সন্ধে হয়ে আসছে। বাড়ি গিয়ে পড়তে বস। লছমন, অন্ধকার হয়ে আসছে, তুমি ওর সঙ্গে যাও।

লছমন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলে মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কী হল?

সংক্ষেপে ভোম্বলবাবুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ।

মাধবীলতা বলল, সেকী? পার্টির অবস্থা এখানে এইরকম হয়েছে?

এখানে? রেগে গেল অনিমেষ, কোথায় নয়? কলকাতায় দেখোনি? আমাদের পাড়ায় ভোম্বলবাবু নেই?

কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে যিনি ভোটে লড়াই করেন তিনি কালীবাড়ির জন্যে চাপ দিয়ে টাকা তুলবেন? এক পয়সা দেবে না ওঁকে। বেশ জোরে কথাগুলো বলল মাধবীলতা।

আমি কি দিতে চাইছি? কিন্তু এমনভাবে জাল বিছিয়ে রেখেছে যে তা কেটে বাড়ি বিক্রি করা কতটা সম্ভব হবে তা জানি না। অনিমেষ বলল।

এই যে পার্টির জেলা সম্পাদক, একে তুমি চেনো?

এককালে চিনতাম। বারীনদার স্টুডিয়োতে আসতেন।

ওঁর সঙ্গে কথা বলবে?

দেখি, ওঁর মদত না পেলে ভোম্বলবাবু এত সাহস পাবে?

তোমার সঙ্গে কথা বললে ভদ্রলোকের মন বদলাতে পারে।

কী জানি! ছোটমা এতক্ষণ শুনছিলেন, বললেন, থাক। এত ঝামেলা হচ্ছে যখন তখন বাড়ি আর বিক্রি করতে হবে না। আমি এখানেই মরব। ওই লছমন আছে, বাবাও আসে, ওরা নিশ্চয়ই আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবে।

মাধবীলতা ধমক দিল, পাগলের মতো কী যা তা বলছেন?

মা, তুমি এখানে আমার মতো মাস দুয়েক থেকে দেখো, তুমিও পাগল হয়ে যাবে। ছোটমা আঁচলে মুখ মুছলেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ির মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স দেওয়া হয় না?

হত। তোমার বাবা বেঁচে থাকতে নতুন করে ট্যাক্স চাইল। তোমার বাবা প্রতিবাদ করলেন, অন্যায়ভাবে বেশি ট্যাক্স চাওয়া হয়েছে। না কমালে ট্যাক্স দেবেন না। সেই যে বন্ধ হল, আর দেওয়া হয়নি। ছোটমা বললেন।

আগের রশিদগুলো আছে?

সব একটা ফাইলে তোমার বাবা রেখে গেছেন। প্রতিবাদের চিঠিও ওখানে আছে।

আমাকে দেখতে হবে।

মাধবীলতার মনে পড়ে গেল, ওহো! অর্ক ফোন করেছিল।

কী বলল?

আমরা এখানে কতদিন আছি জানতে চাইল।

কতদিন থাকব তা বলা সম্ভব নয়। আমি এর শেষ দেখতে চাই।

আমিও আন্দাজে বললাম, এখনই ফিরছি না। শুনে বলল, ও ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে এখানে আসতে পারে। মাধবীলতা বলল।

ছোটমা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ওকে আসতে বলেছ তো?

মাধবীলতা হেসে উঠল, হ্যাঁ।

অনিমেষ ভিতরের ঘরে চলে গেলে ছোটমা বললেন, একটু বসো। মাধবীলতা একটা মোড়া টেনে বসল, কিছু বলবেন? হ্যাঁ। তোমরা তো বিয়ে করোনি, না সই করে, না মন্ত্র পড়ে। তাই তো?

হ্যাঁ। মাধবীলতা বলল।

ছেলে তো জানে।

জানে। কিন্তু মেনে নিয়েছে।

আমিও এর মধ্যে অন্যায় দেখিনি। তুমি অনির জন্যে যা করেছ তা কটা মন্ত্র পড়া, সই করা বউ স্বামীর জন্যে করে থাকে। কিন্তু! ছোটমা থামলেন।

কিন্তু কী?

তোমার শ্বশুরমশাই মানতে পারেননি। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম কিন্তু তিনি গোঁ ছাড়েননি। আর সেইজন্যে একটা অন্যায় করে গেছেন।

কী অন্যায়?

ছোটমা উঠে মাধবীলতার হাত ধরে বললেন, এসো। নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি খুললেন ছোটমা। তারপর লকার থেকে একটা বড় খাম টেনে এনে স্ট্যাম্প পেপার সমেত তিনটি কাগজ বের করলেন। বললেন, যক্ষের মতো পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। আজ মুক্তি চাই। এই উইলে তোমার শ্বশুর তার যাবতীয় সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। শর্ত দিয়েছেন, অনিকে কিছু দিতে পারব না। দেখো।

মাধবীলতা পড়ল। পড়ে হেসে ফেরত দিতেই ছোটমা দ্রুত উইলটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে লাগলেন। মাধবীলতা চেঁচিয়ে উঠল, একী! কী করছেন আপনি?

.

১২.

উইলের ছোঁড়া টুকরোর কয়েকটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, মাধবীলতা সেগুলো তুলে ছোটমায়ের সামনে ধরতে তিনি সবগুলোই তার হাতে দিয়ে দিলেন।

মাধবীলতা বললেন, কাজটা আপনি ঠিক করলেন না।

এটা করতে চাই বলেই তোমাদের আসতে বলেছিলাম। আমি ঠিকই করেছি। করেননি তোমার শ্বশুরমশাই। আমি কে? ওঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হিসেবে এই বাড়িতে এসেছিলাম। তারপর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে

আছি। একটুও ভাল লাগত না। ছোটমা বললেন।

এখন এগুলো নিয়ে কী করব?

পুড়িয়ে ফেলো, ছাই হয়ে যাক। বলেই তার মনে পড়ল, আর একটা কাজ করতে হবে। তিনি তো শুধু উইল করেই চুপ করে যাননি। উকিলকে দিয়ে কী সব করিয়েছেন। আমাকে কপি দিয়েছেন। আসলটা আছে উকিলের কাছে। অনিকে ডাকো তো! ছোটমা ঘরের বাইরে এসে বারান্দার আলো জ্বেলে মোড়ায় বসলেন।

মাধবীলতা শঙ্কিত হল, আমার মনে হয় উইল ছেঁড়ার কথা ওকে না বলাই ভালো।

কেন? ছোটমা তাকালেন।

ও মানতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমি যা ভাল মনে করেছি তাই করেছি। বেশ জোরে কথাগুলো বললেন।

ডাকতে হল না মাধবীলতাকে, অনিমেষ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। জিজ্ঞাসা করল, নেলকাটার আনোনি?

মাধবীলতা কিছু বলার আগেই ছোটমা বললেন, সন্ধের পর নখ কাটতে হবে না। কাল সকালে কেটো। তুমি একটু এখানে এসো, কথা আছে।

কাছে এসে অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাতেই লক্ষ করল তার দুটো হাত একত্রিত, সেখানে কিছু কাগজের টুকরো রয়েছে। সে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, ওসব কী? মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ঠিক কী বোঝাতে চাইল তা বোঝা গেল না।

অনি। তুমি কি রায়বাবুকে চিনতে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

কোন রায়বাবু?

ওকালতি করেন। বাবুপাড়ায় থাকেন। তার বাবাও ওকালতি করতেন।

অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল। ঝাপসা মনে পড়ল যাঁর কথা, তার মুখ অস্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কোথায় থাকেন?

আমি জানি না। তোমার বাবা যেতেন। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন ভদ্রলোক একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। ছোটমা বললেন।

কোনও দরকার আছে তার সঙ্গে?

হ্যাঁ, ছোটমা বললেন, তোমার বাবার করা উইলের কপিটা তার কাছ থেকে নিয়ে আসবে। বাবুপাড়ার সবাই রায় উকিলকে চেনে।

অনিমেষ হাসল, তিনি আমাকে দেবেন কেন?

আমি একটা চিঠি লিখে দেব। সেটা তাকে দিলে না দেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তোমার বাবা বলতেন ওঁর কাছে সকাল আটটায় যেতে হয়। তারপর নাকি কোর্টের জন্যে তৈরি হন। তুমি ওই সময়েই যেয়ো।

.

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ছোটমা।

কিন্তু উইলটা কী জন্যে দরকার?

আমার দরকার আছে। তুমি যেতে না পারলে আমাকেই যেতে হবে। ছোটমা নিজের ঘরে চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ঘরে চলো।

ঘরে ঢুকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলো তো?

মাধবীলতা উইলের টুকরো কাগজগুলো টেবিলের ওপর রাখল।

ওগুলো কী?

এখন বাতিল কাগজ।

আঃ, হেঁয়ালি করছ কেন? মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল, তোমার বাবা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা উইল করে গিয়েছেন। তাতে তিনি যাঁকে তার সম্পত্তি দিতে চান তাঁকেই দিয়ে গেছেন। কিন্তু যাঁকে দিয়েছিলেন তিনি ওটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেই উইলটা ছিঁড়ে ফেলেছেন, এগুলো তার টুকরো।

ছোটমা তোমার সামনে কাজটা করলেন?

হ্যাঁ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

আর তুমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখলে?

আমি আপত্তি করেছিলাম, উনি শোনেননি। ওঁর মনে হয়েছে এই সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা ওঁর নেই। আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে যখন মানুষ কিছু পাওয়ার জন্যে লালায়িত হয়ে আছে তখন এই অসহায় মহিলা কী অবলীলায় অন্তত কুড়ি লাখ টাকার সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। ওঁর সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। মাধবীলতা খাটের ওপর বসল।

বাবা যদি আমাকে কিছু দিতে না চেয়ে থাকেন তো ঠিক মনে করেই করেছেন।

হ্যাঁ। কিন্তু তার কারণ তুমি নও, আমি।

তুমি?

আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি।

তাতে আমাদের তো কিছু এসে যায়নি!

যায়নি। কিন্তু ছোটমার মন মানেনি। উনি আমাদের এখানে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মাধবীলতা বলল।

এখন কী চাইছেন ছোটমা?

আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

আমি কিন্তু এসবের মধ্যে নেই। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

আমার কিছু বলার নেই। তোমার যেটা করতে ইচ্ছে হবে সেটাই করবে। কিন্তু কাল মিস্টার রায়ের বাড়িতে যেয়ো। মাধবীলতা বলল।

আমার যেতে ইচ্ছে করছে না লতা।

ভেবে দেখো। ওঁর যা শরীরের অবস্থা–!

বেশ। যাব। উইলটা যদি ভদ্রলোক দেন, এনে দেব। কিন্তু আমি যে এসবের মধ্যে নেই তা ওঁকে জানিয়ে দেব। অনিমেষ বলল।

.

লছমনের দেখা পাওয়া গেল না। টাউন ক্লাবের মোড় থেকে অন্য একজনের রিকশা নিল অনিমেষ। এখন সকাল পৌনে আটটা। আজ বাজারে যাওয়ার ঝামেলা নেই।

আগে করলা নদীর ওপর ঝুলনা ব্রিজ ছিল। সেটা ভেঙে অনেকদিন আগেই কংক্রিটের সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতুর ওপর রিকশা উঠতেই মন খারাপ হয়ে গেল অনিমেষের। এখন করলাকে আর নদী বলা যাবে না। এমনকী খালও নয়। মজে গিয়ে জল না থাকলে নয় এমন অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আগে মানুষ জাল ফেলে মাছ ধরত, করলার বুকে নৌকো চলত, বিজয়াদশমীর রাত্রে তো প্রতিমা নিয়ে প্রচুর নৌকো উৎসবটাকে আরও সুন্দর করে তুলত। এখন সেসব উধাও। দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। করলার পাশ ধরে থানাকে ডানদিকে রেখে অনিমেষ বাঁদিকে ঘুরতেই লম্বা লোকটিকে দেখতে পেল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই মানুষটির চেহারার পরিবর্তন তেমন হয়নি। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। অনিমেষ চিনতে পারল। সে যখন স্কুলের শেষ ধাপে এবং তারপরে কলেজের ছাত্র তখন এই মানুষটি টাউন ক্লাব দলের গোলকিপার ছিলেন। দারুণ খেলতেন তখন।

রিকশাওয়ালাকে একটু থামতে বলে অর্জুন গলা তুলল, কেমন আছেন সন্তুদা?

ভদ্রলোক তাকালেন। বোঝাই যাচ্ছিল, চিনতে পারছেন না। বললেন, ঠিক–!

আপনার সঙ্গে বহু বছর আগে কয়েকবার কথা হয়েছিল। আপনার খেলা দেখতে খুব ভাল লাগত তখন। আমি অনিমেষ, অনিমেষ মিত্র, একসময় হাকিমপাড়ায় থাকতাম। অনেকদিন ধরে কলকাতায় আছি। অনিমেষ বলল।

অনিমেষ! দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কি রাজনীতি করতেন? নকশাল রাজনীতি? সন্তুবাবু মনে পড়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন।

কিছুদিন ওই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তারপর পুলিশ। হেসে নিজের পা দেখিয়ে দিল অনিমেষ।

আমি আপনার কথা শুনেছি। কোথায় কার কাছে শুনেছি জানেন? চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সের রামবাবুর কাছ থেকে। উনি আপনাকে খুব স্নেহ করেন।

ঠিকই।

কবে এসেছেন?

এই তো সবে।

আপনাদের বাড়ি তো হাকিমপাড়ায়-?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, শুনেছি এখন যাঁরা সিপিএমের মন্ত্রী, নেতা তারা একসময় আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আপনিও তখন সিপিএম করতেন। এখন আপশোস হয় না?

কীসের আপশোস? কোনও আপশোস নেই। আচ্ছা, আপনাদের পাড়ায় মিস্টার রায়, যিনি ওকালতি করেন, কোথায় থাকেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

বলাইদা। সোজা যান। এস পি রায়ের বাড়ির আগে ডান দিকের গলিতে ঢুকে দেখবেন গেটে ওঁর নাম লেখা আছে। সন্তুবাবু বললেন।

থ্যাঙ্ক ইউ। মাথা নেড়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে চলতে বলল।

বাড়িটাকে খুঁজে পেতে এবার আর অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়ে অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে এগিয়ে গেল ক্রাচ নিয়ে। বাইরের ঘরে অন্তত জনা আটেক মানুষ অপেক্ষা করছেন। পাশের ঘরের দরজায় পরদা রয়েছে। অতএব অনিমেষকে বসতে হল। সাড়ে আটটার মধ্যে যাঁরা ভেতরে যেতে পেলেন তার সমান সংখ্যার মানুষ বাইরে বসে থাকলেন। সাড়ে আটটায় বেরিয়ে এলেন শ্রীযুক্ত বলাই রায়। মাথায় টাক, আশির আশেপাশে বয়স। সামনে দাঁড়িয়ে বলাইবাবু বললেন, জরুরি দরকার মনে করলে কোর্টে আসুন। আজ একটা থেকে দেড়টা ফাঁকা আছি। এখন আর কথা বলতে পারছি না।

বাকিরা মাথা নেড়ে মেনে নিলেও অনিমেষ বলল, একটা কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই, বলুন।

অনিমেষ ছোটমায়ের লেখা চিঠি এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক সেটা খুলে পড়লেন, আপনি অনিমেষবাবু, মহীতোষবাবুর ছেলে?

হ্যাঁ।

এই চিঠি মহীতোষবাবুর স্ত্রী লিখেছেন?

হ্যাঁ, চিঠিতে তিনি সেটা জানিয়েছেন।

কিছু মনে করবেন না। মহীতোষবাবুর স্ত্রীর হাতের লেখা আমি চিনি না। এই চিঠি যে তিনিই লিখেছেন তা বুঝব কী করে? বলাইবাবু হাসলেন।

মুশকিল হল, ওঁর পক্ষে আসা বেশ কষ্টকর ব্যাপার।

বুঝলাম। কিন্তু উইল নিয়ে তিনি কী করতে চান?

আমার জানা নেই।

দেখুন ভাই, মহীতোষবাবুর মৃত্যুর পরে আমি তার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম যাতে তিনি উইলের প্রবেট নিয়ে নেন। কিন্তু তখন তিনি রেসপন্ড করেননি।

আমি এসব কিছুই জানি না।

ঘড়ি দেখলেন বলাইবাবু, যদি ধরে নিই, চিঠিটা তিনিই লিখেছেন, তা হলে আপনাকে আমার কাছে পাঠানোটা বিস্ময়কর। কেন তা আপনাকে বলছি না। সেই জন্যে আমার মনে চিঠির জেনুইনিটি নিয়ে সন্দেহ জাগছে। মহীতোষবাবুর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তাই আজ কোর্ট থেকে ফেরার সময় আমি নিজে ওঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আচ্ছা, নমস্কার। একটানা কথাগুলো বলে বলাইবাবু ভেতরে চলে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। তবে মনে হচ্ছিল বলাইবাবু যা বলেছেন তাতে একটুও অন্যায় নেই। যাকে উইলে কিছু দিতে নিষেধ করে যাওয়া হয়েছে তাকেই কেন উইলের অরিজিন্যাল কপি নিতে পাঠাবেন ছোটমা? বিশ্বাস করাটা তো সত্যি স্বাভাবিক নয়। রিকশাওয়ালাকে সিপিএমের জেলা সম্পাদক নৃপেনবাবুর কথা বলতেই সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ চিনি, চলুন। তবে ওখানে পৌঁছে ছেড়ে দেবেন।

কেন?

আপনি কখন ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন তা ভগবানও জানেন না। আমি যদি ওয়েটিং চার্জ চাই তা হলে আপনি আর কত দেবেন। রিকশাওয়ালা বলল।

কদমতলা হয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় পৌঁছে একটি তিনতলা বাড়ির সামনে রিকশা পঁড় করিয়ে লোকটা বলল, আসুন বাবু, নামিয়ে দিচ্ছি।

ভাড়া নিয়ে রিকশাওয়ালা চলে গেলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হল। অন্তত জনা পঁচিশেক মানুষ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে সবাই নৃপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে এগিয়ে কাছে যেতেই একটি ছেলে সামনে এসে বলল, এই নিন, আপনার নম্বর।

একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল ছেলেটা, তাতে লেখা সাতাশ।

আমার নম্বর সাতাশ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, আপনি হ্যাঁন্ডিক্যাপড লোক, তাই বলি, আজ চলে যান, দাদা ঘণ্টাখানেক পরে শিলিগুড়িতে চলে যাবেন, কলকাতা থেকে মন্ত্রী আসছেন।

তা হলে?

বুঝতেই পারছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে আপনি চান্স পাবেন না।

ও। অনিমেষ ইতস্তত করল।

ছেলেটা বলল, এক কাজ করুন। কাল ভোর পাঁচটায় এসে লাইন দিন। তা হলে প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে পারবেন।

অনিমেষ মাথা নেড়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে গেটের দিকে এগোতেই এক বৃদ্ধ গেট দিয়ে ঢুকে বললেন, চেনা লাগছে, অনিমেষ না?

হ্যাঁ। কিন্তু–!

আরে! আমাকে চিনতে পারছিস না? বারীনদার আড্ডায় যেতাম। তোর মনে নেই? এসি কলেজে পড়ার সময় নান্দীমুখ নামে একটা কাগজ বের করতাম। বারীনদা কভার আঁকতেন। তুই তো নকশাল হয়ে গিয়েছিলি, আমি ভাই তখন থেকেই সিপিএমেই আছি। আমি স্বপন।

যাক! তুই সিপিএমে এতদিন থেকেও আমাকে চিনতে পারছিস?

হাসল স্বপন, খোঁচা দিলি। আমি কিন্তু কোনওদিন কোনও পদে যাইনি। তাই সব জায়গায় যেতে পারি। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না। আজ আমার সাতাশ নম্বর। এরা বলছে কাল ভোর পাঁচটায় আসতে। অনিমেষ বলল।

তুই আয় আমার সঙ্গে।

স্বপন সাবলীলভাবে অনিমেষকে ভেতরে নিয়ে গেল। একেবারে নৃপেনবাবুর সামনে। তিনি তখন একজনকে বলছিলেন, না না, পুলিশের কাজে আমি ইন্টারফেয়ার করি না। আপনি দরকার হলে আদালতে যান।

স্বপন বলল, নৃপেনদা, একে চিনতে পারছেন? নৃপেনবাবুর যথেষ্ট বয়েস। হয়েছে কিন্তু চুল এখনও কালো। অনিমেষের মনে হল কালো রং ব্যবহার করেন উনি।

কে ভাই? আগে দেখেছি? নৃপেনবাবু বললেন।

আমি অনিমেষ মিত্র। অনিমেষ নমস্কার করল।

কিছুই স্বচ্ছ হল না। নৃপেনবাবু বললেন।

স্বপন বলল, অনিমেষ আগে আমাদের পার্টি করত। পরে নকশাল হয়।

ওরে বাব্বা। আপনি? আমার কাছে? নৃপেনবাবু চমকে উঠলেন।

.

১৩.

নৃপেনদার যথেষ্ট বয়স হয়েছে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। অনিমেষ যখন স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে তখন উনি কলেজ শেষ করে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনীতি করছেন। যেহেতু ওঁর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন এবং নৃপেনদা তখন সিপিআই করতেন তাই তাকে নিয়ে শহরে আলোচনা হত।

আজ নৃপেনদার চেহারা দেখে অনিমেষের মনে হল উনি এখন বেশ ভাল আছেন।

অনিমেষ বলল, আপনার কাছে খুব জরুরি প্রয়োজনে এসেছি।

তা তো বুঝতেই পারছি। দেখো অনিমেষ, তুমি এককালে আমাদের সঙ্গে ছিলে, কী যে মতিভ্রম হল তোমার! শুনেছি জেল থেকে বেরুবার সময় তোমাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা তুমি প্রত্যাখ্যান করেছিলে। আরে, কত নকশাল তাত্ত্বিক আটাত্তর সালের পরে আমাদের সৌজন্যে সরকারি কলেজে চাকরি করেছে অথচ তুমি! যাক গে, প্রয়োজনটা কী, বলো!

এই শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে।

আরে বাবা জানি! তোমার দাদু আমার বাবার কাছে আসত।

ওই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিতে চাইছি।

আমরা মানে?

আমার মা আর আমি।

তোমার আসল মা তো মারা গিয়েছেন?

অনিমেষ অবাক হল, নৃপেনদার স্মৃতিশক্তি দেখে। সে বলল, হ্যাঁ। ইনি খুব অসুস্থ, আর একা থাকতে পারছেন না। আমাদের পক্ষেও জলপাইগুড়িতে পার্মানেন্টলি থাকা সম্ভব নয়।

স্বাভাবিক। অসুবিধে হচ্ছে যখন তখন বিক্রি করে দাও।

দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কেন?

আমাদের পাড়ার ভোম্বলবাবু বলছেন বিক্রি করতে হলে উনি যে কালীবাড়ি বানাবেন তার ফান্ডে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে হবে।

অ। চোখ বন্ধ করলেন নৃপেনদা।

উনি একথাও বললেন, যে জমিতে মন্দির হবে সেখানে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ এত করে বলল যে না গিয়ে পারিনি। আফটার অল, আমাদের পার্টির ছেলে!

আমার প্রশ্ন, মার্কসবাদী পার্টির সদস্য বা সমর্থক হয়ে কালীমন্দিরের জন্যে এত চাঁদা চাইছেন তা হলে আদর্শ বলে কি কিছু নেই?

প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন নৃপেনদা, আদর্শ? আদর্শ মানে কী? যার নড়ন চড়ন নেই? যুগ যুগ ধরে যাকে এক জায়গায় মাথায় নিয়ে থাকতে হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যদি আদর্শকে না মিশিয়ে দেওয়া হবে তা হলে তার জায়গা হবে ওয়েস্ট পেপার বক্সে। তা ছাড়া ওই কালীমন্দির হলে জনতাকে আরও কাছে পাওয়া যাবে। তাই না?

অবাক হওয়ার সীমা আর নেই, অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। তার দিকে তাকিয়ে নৃপেনদা বললেন, দেখো অনিমেষ আমিও তো প্রথম দিকে ক্লাস করেছি। যা শিখতাম তাই বক্তৃতায় বলতাম। কিন্তু একথাও তো

সত্যি, সাধারণ মানুষ আমাদের শিখে বলা অনেক শব্দের মানেই বুঝতে পারত না। আচ্ছা, ধরো বুর্জোয়া শব্দটির কথা। কজন সাধারণ কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ এই শব্দটির মানে জানে? আমাদের মুখে শুনে শুনে তারা ভেবে নিয়েছে খুব খারাপ মানুষদের বুর্জোয়া বলা হয়। অর্থাৎ আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যতই যেতে চাই, যতই তাদের হয়ে কাজ করি তারা আমাদের ভাষা পুরো বুঝতে পারে না। অন্তত অনেক কথা তো বটেই। সেটা কি উচিত? তাই মানুষের সহজ ভাষায় কথা বলাই উচিত। তাদের ভালোগার, তারা যাকে শ্রদ্ধা করে তাদের সম্মান জানালে ক্ষতির বদলে লাভ বেশি।

একটু চুপ করে থেকে নৃপেনদা বললেন, আমি ডোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। কত টাকা চাঁদা দিতে বলেছে?

অঙ্কটা বলল অনিমেষ।

কততে তোমাদের বাড়ি বিক্রি হবে?

কুড়ি লাখ টাকার বেশি পাওয়া যাবে কিনা জানি না।

মাথা নাড়লেন নৃপেনদা, একটু বেশি চাইছে। ও কী বলছে?

এই টাকা শেষপর্যন্ত আমি পাব আর আমার টাকাটা পাওয়ার কথা নয়। তিরিশ বছর যখন আমার সঙ্গে বাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিলেন নৃপেনদা। বাড়ি তুমি পাচ্ছ উত্তরাধিকারী হিসেবে। কিন্তু এটাও সত্যি তিরিশ বছর ধরে তুমি বাড়িটাকে যত্ন করা দূরের কথা কতটা দেখেছ তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য তুমি একা নও, তোমার সৎমাও সমানভাবে পাবেন। ঠিক আছে। আমি তোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। ও যেন কোনও চাপ না দেয় তা দেখব। তবে তোমাদের সাধ্যমতো চাঁদা দিলে মন্দিরের কাজ দ্রুত শেষ হবে, মানুষের উপকারে লাগবে। ঠিক আছে?

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আমাকে এখনই উঠতে হবে। ডি এম সাহেবের সঙ্গে মিটিং আছে। কোনও প্রয়োজন হলেই চলে এসো।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আজকে কপাল ভাল ছিল ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই আপনার কাছে পৌঁছাতে পারলাম। শুনলাম ভোর পাঁচটার

সময় লাইন না দিলে আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।

কী করি বলো! শহরের মানুষের নানান সমস্যা, তারা দেখা করতে আসে। আমি যথেষ্ট কো-অপারেট করি! এক কাজ করো। সামনের টেবিল থেকে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে তার একপাশের সাদা অংশে কিছু লিখে এগিয়ে দিলেন। অনিমেষ দেখল, ওটা টেলিফোন নাম্বার।

নৃপেনদা বললেন, খুব জরুরি হলে আমাকে ওই নাম্বারে ফোন কোরো। সকালে সাড়ে সাতটা থেকে আটটা আর রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে ফোন এলে কথা বলতে অসুবিধে হবে না আমার। আচ্ছা!

.

নৃপেনদার বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে কদমতলার মোড়ে আসতেই একটা দোকানের সামনে জগদীশবাবুকে দেখতে পেল অনিমেষ। দোকান বন্ধ করছে। কর্মচারী, তিনি লক্ষ রাখছেন। রিকশা দাঁড় করিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে ডাকতেই তিনি দেখতে পেয়ে কাছে এলেন, ও আপনি! বলুন?

এবার খদ্দের এনে দিন। অনিমেষ বলল।

মানে? আপনাকে যে বলেছিলাম–।

মনে হচ্ছে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। ভোম্বলবাবু মোটা টাকা চাদা চেয়েছিলেন, নৃপেনদা সেটা যাতে না দিতে হয় তা দেখবেন।

ওঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ, আমি এখন নৃপেনবাবুর বাড়ি থেকেই আসছি।

আপনি তো কামাল করে দিলেন! একদিনের মধ্যে এই শহরে এই সাফল্য কেউ পায়নি। আপনি শিয়োর তো?

সেরকম আশ্বাস পেয়েছি।

তা হলে ঠিক আছে। ঘড়ি দেখলেন জগদীশবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বাড়ি ফিরছেন?

হ্যাঁ।

আমি যদি মিনিট দশেকের জন্যে এখন যাই, মানে, বাড়িটাকে ভাল করে দেখে আসি তা হলে আপত্তি নেই তো? খদ্দেরদের তো বর্ণনা দিতে হবে।

জগদীশবাবু বললেন।

চলে আসুন, কোনও অসুবিধে নেই। রিকশায় উঠবেন?

না না। আমার দুচাকা আছে। সাইকেল।

জগদীশবাবু রিকশার পেছন পেছন সাইকেলে চেপে এলেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে বাগান দেখে বললেন, বাঃ, প্রচুর গাছগাছালি, বেশ পরিষ্কার করে রাখা আছে। কতটা জমি?

বোধহয় এক বিঘে। অনিমেষ বলল, কাগজ দেখে ঠিক বলব।

ওতেই হবে। ওপাশেও তো বাড়ি আছে দেখছি!

আমাদের ভাড়াটেরা থাকেন।

উঠবেন তো?

মানে?

ভাড়াটে সমেত বাড়ি অনেকেই কিনতে চায় না। কিনলে দাম যথেষ্ট কমে যায়। পার্টি করে নাকি?

আমি জানি না। কথা বলতে হবে ওঁদের সঙ্গে।

বলুন। এটা জরুরি।

মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছিল ভেতরের বারান্দায়। সদ্য স্নান সেরেছে। অনিমেষ অবাক হল, বহুকাল পরে মাধবীলতা হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় হাতখোঁপা।

অনিমেষ জগদীশবাবুকে বলল, আমার স্ত্রী।

ও। নমস্কার, নমস্কার। এই অসময়ে কেউ বাড়িতে এলে যে বেশ অসুবিধে হয় তা আমি জানি। কটা ঘর আছে? জগদীশ জিজ্ঞাসা করলেন।

একটা বিশাল হলঘর ছাড়া সাতটা। বেশিরভাগ ঘরই তালাবন্দি। মাধবীলতা স্মিত মুখে বলল।

ব্যস। এতেই হবে। কোনও ফোন নাম্বার আছে?

মাধবীলতা নাম্বারটা বললে জগদীশবাবু নোট করে নিয়ে বললেন, আমিই ফোন করব। এই ধরুন, দিন তিনেকের মধ্যে। আচ্ছা, চলি।

জগদীশবাবুকে এগিয়ে দিয়ে এল অনিমেষ। বারান্দায় উঠতেই দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে আছেন মাধবীলতার পাশে। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

অনিমেষ বিরক্ত গলায় বলল, এখন পার্টি কালীপূজা করবে, বলিও দেবে। কারণ পশ্চিমবাংলার মানুষ সেটাই চায়।

কী উলটোপালটা বলছ। উনি কী বললেন? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ।

আমার অনুরোধ শোনার পর অনেক কথা বললেন নৃপেনবাবু। তারপর যেন একটু সদয় হলেন। বললেন, ভোম্বলবাবুকে বলে দেবেন যেন আমাদের ওপর চাপ না দেন। অনিমেষ জানাল।

যাক বাবা! ছোটমা কপালে দুটো হাত জোড় করে ঠেকালেন।

অনিমেষ হাসল, শুনে কী মনে হল জানো?

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী?

হরিণের অনুরোধে বাঘ কথা দিয়েছে কয়েকদিন অম্বুবাচী করবে ফল খেয়ে। আমার খুব খিদে পেয়েছে। স্নান করে আসছি।

মাধবীলতার স্থির চোখের সামনে দিয়ে অনিমেষ চলে গেল।

.

বিকেলে ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলতে গেল অনিমেষ। তাদের বাইরের ঘরের দরজায় পৌঁছাতেই বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। অনিমেষ বলল, ছোটমার কাছে জানলাম আপনার নাম নিবারণবাবু। আমি অনিমেষ।

আচ্ছা, আসুন। বসুন। বসার ঘরের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি।

চেয়ারে বসে অনিমেষ বলল, আমরা কয়েকদিন হল এসেছি।

হ্যাঁ। শুনলাম। কী করে পা ভাঙল? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

পুলিশের কল্যাণে।

সে কী! পুলিশ মেরেছে? কেন মারল?

এমন কিছু বড় ঘটনা নয়। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি জরুরি কথা বলতে। আপনি জানেন এই বাড়িতে আমার মা একাই থাকেন। কিন্তু তার বয়স হচ্ছে। শরীরও খারাপ। আর তার পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়।

আপনারা এসে থাকবেন?

সেটাও তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যত্ন নেওয়ার কেউ না থাকায় বাড়ির অবস্থাও ভাল নেই। অনিমেষ বলল।

হ্যাঁ। আমাদের রান্নাঘরে জল পড়ছিল, সারিয়ে নিতে হয়েছে। বৃদ্ধ বললেন।

ও। মা চাইছেন, আমরাও একমত, বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। এর জন্যে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। তিনমাস সময় পাবেন। এর মধ্যে যদি অন্য বাড়িতে উঠে যান তা হলে ভাল হয়। অনিমেষ বলল।

অন্য কোথায় উঠে যাব ভাই! এতদিন এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছি। এখন নতুন জায়গায় ভাড়া নিতে গেলে যে টাকা চাইবে তা দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। বৃদ্ধ বললেন।

কিন্তু ভাড়াটে হয়ে কারও বাড়িতে সারাজীবন কি থাকা যায়?

একথা কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া আপনার মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, প্রতি মাসের ঠিক সময়ে তাঁকে ভাড়া দিয়ে গেছি কিনা! উনি একবার খুব অসুস্থ হয়ে ঘরেই পড়ে ছিলেন, আমার ছোটবউমা গিয়ে দিনরাত সেবা করে তাকে দাঁড় করিয়েছে। এসবের কোনও মূল্য নেই ভাই? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করার সময় এই অংশ তো বাদ যাবে না। যিনি কিনবেন তিনি পুরোটাই নেবেন। অনিমেষ বলল।

আপনি তাদের বলুন ভাড়াটে হিসেবে আমাদের রেখে দিতে।

নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তিনি যদি রাজি না হন–!

তা হলে আপনি আমাদের এরকম বাড়ি এই ভাড়ায় দেখে দিন। উঠে যাব।

আমি কোথায় যাব বাড়ি খুঁজতে?

আপনি আমাদের এই অংশের জন্যে টাকা পাবেন, পাবেন তো?

হ্যাঁ।

নিজে খুঁজে দিতে না পারেন, এই অংশের মূল্য থেকে কিছু আমাদের দিন, আমরা তার সঙ্গে বাড়তি ভাড়া দিয়ে অন্যত্র উঠে যাব। বৃদ্ধ বললেন।

ঠিক আছে। ভেবে দেখি। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ক্রাচে ভর রেখে।

আচ্ছা, উঠছেন কেন? চা খাবেন না?

না।

এই প্রথম এখানে এলেন–!

এই প্রথম নয়। এই অংশের বাড়িতে আমি বাল্যকালে এসে থেকে গিয়েছিলাম। এর প্রতিটি ইট আমার চেনা। অনিমেষ বেরিয়ে এল।

.

১৪.

গেটের কাছে আসতেই বাইকের আওয়াজ কানে এল। অনিমেষ বাঁদিক থেকে একটি মোটরবাইককে এগিয়ে আসতে দেখল। পাড়ায় দুদিকে যাওয়ার জন্যে অনেকেই শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করে এই রাস্তাটাকে কিন্তু বাইকটা সামনে এসে থামলে হেলমেট খুললেন চালক, অনিমেষ দেখল ভোম্বলবাবু হাসছেন।

আপনি? অনিমেষের মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

আরে মশাই, আপনি কি নাবালক? রসিকতা বোঝেন না? হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন ভোম্বলবাবু।

অনিমেষ দেখল কথা বলতে বলতে ভোম্বলবাবু গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তার বাইক বাইরেই রইল। কাছে এসে বললেন, আরে, আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করেছিলাম। আপনি সেটা সিরিয়াসলি নিয়ে নৃপেনদার কানে তুললেন। তার ফলে নৃপেনদা আমাকে ডেকে পাঠিয়ে হেভি ধমক দিলেন। অনিমেষের মুখ থেকে একটি আওয়াজ বের হল, ও!

মাসিমা আছেন তো? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

আছেন।

চলুন, এলাম যখন, তখন দেখা করে যাই।

দুই পা এগোতেই নিবারণবাবু বেরিয়ে এলেন বাইরে, দুটো হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে ওপরে তুলে চেঁচিয়ে বললেন, এক মিনিট দাঁড়ান ভোম্বলবাবু–।

আবার কী হল? ভোম্বলবাবু চোখ ছোট করলেন। নিবারণবাবু কাছে এসে বললেন, এই ভদ্রলোক আমাদের খুব বিপদে ফেলে দিয়েছেন। বলছেন, বাড়ি বিক্রি করে দেবেন, তাই আমাদের উঠে যেতে হবে। এতদিন এখানে থাকলাম, হুট করে চলে যেতে বলাটা কি অত্যাচার নয়?

হুট করে চলে যাবেন কেন? এ তো আলু পটল বিক্রির মতো নয়। সময় লাগবে। ততদিনে বাড়ি খুঁজে নিন। ভোম্বলবাবু বললেন।

নতুন বাড়ি ভাড়া চাইলে এখন যা দিচ্ছি তার তিনগুণ দিতে হবে। কোথায় পাব অত টাকা! নিবারণবাবু হাত জোড় করেই থাকলেন।

আপনার ছেলে তো ডি এম-এর অফিসে চাকরি করে।

হ্যাঁ। সে আর কত মাইনে পায়। আমার পেনশনের টাকা দিয়ে–!

আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার কত?

সাতজন। ছোট ছেলের বিধবা বউটা তো বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি।

বেশ করেছে। ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কত ভাড়া দেন?

দেড় হাজার টাকা।

হাসলেন ভোম্বলবাবু, বেশ সুখেই আছেন দেখছি।

ভোম্বলবাবু, আপনি আমাদের পাড়ার নেতা। বাড়ির সবাই আপনার পার্টিকেই ভোট দিই। আপনি যদি আমাদের না দেখেন কে দেখবে বলুন?

ভোম্বলবাবু কোনও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

নিবারণবাবু বললেন, আমার ছেলে বলছিল, সেনপাড়ার শেষে এরকম বাড়ির ভাড়া প্রায় চার হাজার টাকা। আমরা দেড় দিচ্ছি বাকিটা যদি ইনি দেন!

মানে? ভোম্বলবাবুও অবাক হলেন, কী বলতে চাইছেন?

উনি যদি বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে তিন লক্ষ টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে ফিক্সড করে দেন তা হলে মাসে আড়াই হাজার সুদ পেয়ে যাব। তা হলে আর চিন্তা থাকবে না। দেড় প্লাস আড়াই মানে চার হয়ে যাবে।

আপনি তো ভাল অঙ্ক জানেন। ভোম্বলবাবু বললেন।

হেঁ হেঁ। স্কুল ফাইনালে লেটার পেয়েছিলাম।

ঠিক আছে আমরা পার্টিতে আলোচনা করে আপনাকে জানাব। চলুন অনিমেষবাবু।

ভেতরের বাগানের কাছে এসে ভোম্বলবাবু বললেন, লোকটা আপনাকে সমস্যায় ফেলবে। ম্যানেজ করবেন কীভাবে?

এখনও ভাবিনি। প্রস্তাবটা একটু আগে শুনলাম।

মুশকিল হল, পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়ে যাবে তোকটা। তা ছাড়া পার্টি থেকে বলা হয়েছে, বাড়িওয়ালা ভাড়াটের ঝগড়ায় আমরা যেন না ঢুকি। ব্যাপারটা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। দেখুন, কেউ ভাড়াটে সমেত বাড়িটাকে কেনে কি না। তারপর তার হেডেক। বলতে বলতে বারান্দায় উঠে পড়লেন ভোম্বলবাবু। চারপাশে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, মাসিমা, ও মাসিমা, কোথায়?

ছোটমা বেরিয়ে এলেন তার ঘর থেকে, অর্ধেক মাথা ঘোমটায় ঢাকা।

নমস্কারের ভঙ্গিতে দুটো হাত এক করে ভোম্বলবাবু বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন তো? আমি ভোম্বল।

ছোটমা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বললেন।

আপনার তো আর কোনও চিন্তা নেই। ছেলে, ছেলের বউ এসে গিয়েছে। কিন্তু আমার একটা দুঃখ হচ্ছে।

দুঃখ! ছোটমার মুখ থেকে শব্দটা বের হল।

হ্যাঁ। আপনারা তো বাড়ি বিক্রি করে আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন। অথচ এই পাড়ায় অনেক কষ্ট করে আমরা কালীবাড়ি করছি, আপনার মতো ধর্মপ্রাণ মানুষকে সঙ্গে পেলে জোর বাড়ত। দুঃখ সেই কারণে।

ভোম্বলবাবুর কথা শুনে অনিমেষের মনে হল একটি আধবুড়ো দামড়া খোকা সাজতে চাইছে।

তা আমি অনিমেষবাবুকে রসিকতা করে বলেছিলাম চাদা দিতে। উনি যা ইচ্ছে দেবেন আমরা মাথা পেতে নেব। চাদা তো জোরজুলুম করে চাওয়ার ব্যাপার নয়। শুনেছি আপনি রোজ পুজো করেন। আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন। তা আপনার বউমা কোথায়? তার সঙ্গে একটু কথা বলে যাই। ভোম্বলবাবু অকারণে হাসলেন।

অনিমেষের মনে হল কোনও প্রাণী এত দ্রুত রং পালটাতে পারে না।

মাধবীলতা অনেকক্ষণ তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সংলাপ শুনছিল। ছোটমা তাকে বললেন, ইনি আমাদের পাড়ার জনপ্রতিনিধি।

ভোম্বলবাবু ঘুরে তাকিয়ে মাধবীলতাকে দেখে বললেন, নমস্কার, নমস্কার। আপনি আর একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন, তাই তো?

হ্যাঁ।

সব শুনেছি। খুব স্যাক্রিফাইস করেছেন। তা আপনিও কি নকশাল ছিলেন? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

না।

তা হলে? সিপিএম না কংগ্রেস? আমি রাজনীতি করিনি।

ভোট দেন তো? না।

সে কী। কেন?

ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

তা বটে। এখন তো একজন মহিলা পশ্চিমবাংলার নেত্রী হওয়ার জন্যে ছটফট করছেন। ভাবছেন, সব মেয়েরাই ওঁকে সমর্থন করবে। কোনও আদর্শ নেই, শুধু আমাদের গালাগালি দিয়ে পাবলিককে ভোলাতে চাইছেন। হাস্যকর ব্যাপার। তা আপনি জলপাইগুড়ির দ্রষ্টব্যস্থানগুলো ঘুরে দেখেছেন?

সুযোগ এবং সময় হয়নি।

সময় বের করুন, আমি সুযোগ করে দেব। গোরুমারা, চাপড়ামারি, হলং ফরেস্ট দেখলে মন ভরে যাবে। আচ্ছা, চলি। মাসিমা, ভাল থাকবেন। চলি অনিমেষবাবু, কোনও চিন্তা করবেন না। একটা কথা জানবেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটাকে একটু বেঁকা করতে হয়। সব বলে দেব। ভোম্বলবাবু নিজেই বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই বাইকের আওয়াজ কানে এল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কেন এসেছিল?

জানি না, বলল মাসিমার সঙ্গে দেখা করে যাই।

এই লোক সুরেনবাবুর চেয়ে অনেক বেশি শয়তান। তোমাকে কাল টাকা দিতে বলেছিল যে সে আজ বলছে রসিকতা করেছে।

নৃপেনদার জন্যে।

ছোটমা বললেন, তিনিও যে অভিনয় করছেন না তা কে বলতে পারে। কিন্তু একটা কথা ঠিক, তুমি তো কোথাও বেড়াতে যাওনি। যাও না, নিজেরাই ঘুরে এসো।

মাধবীলতা হাসল, আপনি যদি সঙ্গে যান তা হলে যেতে পারি!

আমি? এই শরীর নিয়ে? মাথা নাড়লেন, আমার তো সব দেখা।

কী কী দেখেছেন?

ছোটমায়ের মুখটা করুণ হয়ে গেল। মাধবীলতা এগিয়ে এল, বাড়িটার বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে যাক, তারপর আমরা সবাই বেড়াতে যাব। এর মধ্যে অর্কও এসে যাবে। ও তো কিছু দেখেনি।

ছোটমা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন।

অনিমেষ বলল, আমার তো মনে হয় বিয়ের পর স্বৰ্গছেঁড়ার কোয়ার্টার্সে ঢুকেছিলেন, বেড়াতে আসা বলতে এই জলপাইগুড়ির বাড়িতে। এর বাইরের কোনও কিছুই ওঁর দেখা হয়নি।

তুমি তো বলেছিলে ওঁর বাপের বাড়ি এই শহরেই?

হ্যাঁ।

তারা কেন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি?

তাঁদের কেউ আছেন কি না তাই জানি না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করো।

না। উনি নিজের থেকে বলেননি যখন তখন জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। ঘরে যাও, আমি চা করছি। মাধবীলতা রান্নাঘরে চলে গেল।

.

দুদিন বাদে বাজার থেকে বের হওয়ার সময় দেবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাইকেল থেকে নেমে দেবেশ বুঝিয়ে দিল কীভাবে ওর ডেরায় পৌঁছোতে হবে। নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল, যেদিন যাবি তার আগে আমাকে ফোন করবি। সকালের দিকে আয়, দুপুরে একসঙ্গে ভাত খাব।

সঙ্গে যদি মাধবীলতা যায়?

কুছ পরোয়া নেই। আমরা তো ডাল ভাত তরকারি খাই। হয়ে যাবে।

দেবেশ, তুই বেশ ভাল আছিস। না?

হো হো করে হাসল দেবেশ। তারপর সাইকেলে উঠে চলে গেল।

.

বাড়িতে ফেরামাত্র মাধবীলতা বলল, শোনো, জগদীশবাবু ফোন করেছিলেন।

কী বললেন?

উনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একজনকে নিয়ে আসছেন বাড়ি দেখাতে।

বেশ করিতকর্মা লোক তো!

কিন্তু ওঁর সঙ্গে তোমার কথা বলে নেওয়া উচিত। মাধবীলতা বলল।

কী ব্যাপারে?

আশ্চর্য মানুষ তুমি! ওঁকে পারিশ্রমিক দেবে না?

ওহো! অনিমেষ হেসে ফেলল।

হাসছ যে!

তুমি দালালি না বলে পারিশ্রমিক বললে, তাই। তা ওঁদের নিশ্চয়ই ফিক্সড রেট থাকে। বাড়িভাড়া পেতে গেলে দালালকে একমাসের ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু ওঁকে এত কিছু জিজ্ঞাসা করব কী করে? দেখি, রামদা কী বলেন, উনি নিশ্চয়ই জানেন। অনিমেষ বলল।

কেন? তুমি ওঁকেই জিজ্ঞাসা করো কত দিতে হবে? মাধবীলতা বলল, তুমি যদি না পারো আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারি।

.

জগদীশবাবু যাঁকে সঙ্গে নিয়ে এলেন তার বয়স বেশি নয়। পঞ্চাশের এপাশেই। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরনে। নমস্কার করে বললেন, আমি স্বপ্নেন্দু দত্ত। জগদীশবাবু বললেন, আপনারা বাড়ি বিক্রি করবেন!

হ্যাঁ।

বাড়ির মালিক কে?

আমার ঠাকুরদা বাড়িটা বানিয়েছেন। তার কাছ থেকে আমার বাবা বাড়িটা পেয়েছিলেন। এখন আমার মা এখানে থাকেন। তিনিই মালিক বলতে পারেন।

কেন? ছেলে হিসেবে আপনারও তত অর্ধেক পাওয়ার কথা। কোর্টে গিয়ে আইনসম্মত করে নেননি? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।

জগদীশবাবু বললেন, অনিমেষবাবু কলকাতায় থাকেন বলে ওসব করা হয়নি। এখন হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।

আপনার আর কোনও ভাইবোন নেই?

জগদীশবাবু মাথা নাড়েন, না, উনিই একমাত্র ছেলে।

গুড। চলুন, দেখা যাক। স্বপ্নেন্দু বললেন।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে স্বপ্নেন্দু দত্ত জগদীশবাবুকে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলেন। এমনকী ভাড়াটের দিকটাও।

জগদীশবাবু অনিমেষকে বলেছিলেন, আপনি বসুন। আমিই ওঁর সঙ্গে আছি।

বাড়ি দেখার পর সবাই বারান্দার চেয়ারে বসল ওরা। স্বপ্নেন্দু দত্ত কোনও ভণিতা না করে বললেন, আপনারা এই বাড়ির কোনও যত্ন করেননি। মনে হয় বহু বছর মেরামত করা হয়নি।

হ্যাঁ। কথাটা ঠিক।

আমি যদি কিনি তা হলে এই বাড়ি ভেঙে ফেলব।

ভেঙে ফেলবেন? প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

দেখুন, এই বাড়ি তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়াই। যিনি তৈরি করেছেন তার ইচ্ছে ছিল পরিবারের সবাই একসঙ্গে থাকবে। এখন অত বড় পরিবার কোথায়? থাকলেও একসঙ্গে থাকে না। আমাকে মাল্টিস্টোরিড তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। ওপাশে অনেকটা জায়গা ছাড়তে হবে রাস্তার জন্যে। কিন্তু দুটো কথা জানতে চাইব। আপনার ভাড়াটে কি উঠে যাবেন?

সবে কথা শুরু হয়েছে। উনি তিন লক্ষ টাকা চেয়েছেন।

সেটা আপনার হেডেক। আমি চাইব ভাড়াটেহীন বাড়ি কিনতে। আমি কিনে তুলতে গেলে অনেক ঝামেলা হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।

অনিমেষ চুপ করে থাকল।

দুই নম্বর, লোকাল সরকারি পার্টি কি আপনাকে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন? স্বপ্নেন্দু তাকালেন।

হ্যাঁ। জগদীশবাবু বলায় আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। নৃপেনবাবু এবং ভোম্বলবাবু সম্মতি দিয়েছেন। অনিমেষ বলল।

আপনি ভাগ্যবান। খুব ভাল খবর। এখন বলুন, এই বাড়ি জমির জন্যে আমাকে কত টাকা দিতে হবে? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ জগদীশবাবুর দিকে তাকাল, আপনি বলুন। জগদীশবাবু বললেন, এই পাড়ার জমির কাঠা যে দামে বিক্রি হয় সেই দামের সঙ্গে বাড়ির দাম যোগ করলেই অঙ্কটা বের হতে পারে।

স্বপ্নেন্দু বললেন, বাড়ির দাম তত ঠিক করাই যাবে না। জমির দামই আসল ব্যাপার। ঠিক আছে। আপনি ভাড়াটের ব্যাপারটা দেখুন। আমি কেনার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। আপনাকে কোনও ফ্ল্যাট দেব না। স্রেফ আন্দাজে লাখ কুড়ির অফার দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, বাড়ির প্ল্যানের একটা কপি আমার চাই আর কোর্ট থেকে মালিকানা আইনসম্মত করে নিন। উইল থাকলে কোনও সমস্যা হবে না।

স্বপ্নেন্দুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন জগদীশবাবু, অনিমেষ তাকে বলল, আপনি একটু পরে গেলে অসুবিধে হবে?

না না। ঠিক আছে, স্বপ্নেন্দুবাবু, আপনি যান, আমি পরে আসছি।

.

১৫.

গাড়ি চলে গেলে জগদীশবাবু কাছে এলেন, বলুন।

অনিমেষ সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আপনার পারিশ্রমিক নিয়ে আমরা কথা বলিনি। আমি কি রামদার কাছে জেনে নেব?

কী কাণ্ড! আমি কী নিই তা তিনি জানবেন কী করে? তার সঙ্গে তো কোনও কাজ করিনি। হাসলেন জগদীশবাবু, এসব নিয়ে একটুও ভাববেন না। অলিখিত একটা কমিশনের কথা যাঁরা কেনাবেচা করেন তাদের সবাই জানেন। স্বপ্নেন্দু দত্ত যে দাম দিতে চাইছেন তা তো জানা হল, যদি অন্য কেউ ওঁর চেয়ে বেশি দাম দিতে রাজি হন তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এতে আপনাদের যেমন লাভ, তেমনি আমারও।

অনিমেষ বলল, আমি এসব ব্যাপারে নিতান্তই অজ্ঞ। কমিশনের ব্যাপারটা যদি বলেন।

সিম্পল। আমি মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট নিই। তাও ভাগাভাগি করে। যিনি কিনছেন তিনি আড়াই, যিনি বিক্রি করছেন তিনি বাকি আড়াই। আপনি না হয় দুই দেবেন, আমি বায়ারের কাছ থেকে তিন চেয়ে নেব। আমাকে বিক্রির ব্যাপারটা একটু প্রচার করতে হবে। জগদীশবাবু মাথা নেড়ে বললেন।

প্রচার করবেন? কীভাবে?

লোকাল কাগজগুলোতে বিজ্ঞাপন ছাপব। এর জন্যে আপনাকে কিছু দিতে হবে না। খরচ যা হবে তা আমিই দেব। আপনি কোর্টের ব্যাপারটার ফয়সালা করে ফেলুন। এখানকার কোনও উকিলকে চেনেন? জগদীশবাবু তাকালেন।

মিস্টার রায়ের মুখ মনে পড়ায় অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

গুড। তা হলে চলি। প্রয়োজন হলেই ফোন করব। জগদীশবাবু চলে গেলেন।

.

ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়াতেই মাধবীলতা এগিয়ে এল, কী কথা হল? অনিমেষ স্বপ্নের কথাগুলো জানালে মাধবীলতা বলল, বাব্বা। খুব খুঁতখুঁতে লোক তো। অবশ্য টাকা দিয়ে যে কিনবে সে তো সব দিক দেখে নেবেই।

তিনটে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, একটা হল মালিকানা ঠিক করে নেওয়া, দ্বিতীয়টা ভাড়াটেদের তুলে দেওয়া। তৃতীয়টা কী?

দাদুর বানানো এই বাড়ি ভদ্রলোক ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবেন। ছেলেবেলায় চোখের ওপর বাড়িটাকে তৈরি হতে দেখেছি। শোনার পর কেমন লাগছে? অনিমেষ বলল।

এই সময় পেছন থেকে ছোটমার গলা শোনা গেল, তা হলে থাক।

মাধবীলতা হাসল, আচ্ছা, তোমার যদি একটা মেয়ে থাকত এতদিনে তার অনেকদিন আগে বিয়ে হয়ে যেত। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে তাদের নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে। তাকে যদি বিকেল চারটের সময় ভাত খেতে হয় তুমি কী বলবে, ওই বাড়িতে থাকিস না?

দুটো এককথা হল? অনিমেষ বিরক্ত।

প্রায়। যে বাড়ি কিনবে সে কী করবে তা বিক্রেতা ঠিক করবে? মাধবীলতা বলল, এটা কোনও সমস্যা নয়। আমরা বাধ্য হয়ে বাড়ি বিক্রি করতে চাইছি আর ওরা তাজমহল কিনছে না যে ভেঙে ফেলতে পারবে না।

ছোটমা বললেন, ঠিক কথা। কিন্তু ভাড়াটেদের কি ভোলা যাবে? ওদের ছোট বউটা খুব বিপদে পড়ে যাবে।

অনিমেষ অবাক হল, কেন? তার কী হল?

ছোটমা বলল, বাপ মা ভাই নেই। স্বামী যাওয়ার পর ভাশুরের সংসারে থাকতে পারছে দিনরাত কাজ করে বলে। রান্নাঘরটা বেশ বড় বলে ওখানেই রাত্রে শোয়। ওরা যদি ছোট বাড়িতে ভাড়া নিয়ে চলে যায় তা হলে ওর নিশ্চয়ই জায়গা হবে না।

যিনি তোমার সেবা করেছিলেন?

হ্যাঁ। খুব ভাল মেয়ে।

তাকে নিয়ে চিন্তা আমাদের করার কথা নয়। অনিমেষ বলল।

ছোটমা বললেন, ওরা যা চাইছে তা দিয়ে দিলে যদি ভাল বাড়ি ভাড়া পায়, যেখানে মেয়েটা থাকতে পারবে, তাই দেওয়া উচিত। কুড়ি লক্ষ টাকা থেকে কিছু কমলে কি খুব অসুবিধে হবে মাধবীলতা?

আপনি চাইলে নিশ্চয়ই দেওয়া যেতে পারে। মাধবীলতা বলল।

ওহো, একটা কথা, অনিমেষ বলল, মিস্টার রায়, মানে বাবার উকিল, বলেছিলেন কোর্ট থেকে ফেরার পথে আমাদের বাড়িতে আসবেন। সেদিন তো আসেননি। পরে আমি যখন বাইরে গিয়েছি তখন কি এসেছেন?

তোমার কী হয়েছে বলো তো? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

কেন? অনিমেষ তাকাল।

ভদ্রলোক এলে আমরা কি তোমাকে জানাতাম না?

তা বটে।

এরপরে ভাত খেয়ে উঠে বলবে খাইনি তো! মাধবীলতা হেসে ফেলল।

ছোটমা যোগ করলেন, ওর বাবাও এই একই কথা বলত।

.

বিকেলে মিস্টার রায়ের বাড়িতে রিকশা নিয়ে গেল অনিমেষ। জলপাইগুড়িতে আসার পর বেরোলেই রিকশাভাড়া দিতে হচ্ছে। খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে একটু একটু করে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। ক্রাচ নিয়ে টানা মিনিট দশেক তো সে হাঁটতে পারে। চেম্বার খোলা ছিল। একটি তরুণ, সম্ভবত মিস্টার রায়ের সহকারী, বললেন, কদিন ধরে স্যার কোর্টে যাচ্ছেন না।

প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। কী দরকার?

উনি আমার বাবার উইল করেছেন। বাবার নাম মহীতোষ মিত্র। সেই ব্যাপারে কিছু বলার ছিল। উনি বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতে যাবেন। অনিমেষ বলল।

জানি। সেদিন উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাঁড়ান, দেখছি। তরুণ ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল কয়েক মিনিটের মধ্যে, বসুন। স্যার আসছেন।

মিস্টার রায়কে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বসে বললেন, আমি খুব দুঃখিত, হঠাৎই প্রেশারটা–।

ঠিক আছে। এখন কেমন আছেন?

কিছুটা ভাল। সারাজীবন এত টেনশন–। যাক গে, উইলটা নিয়ে মিসেস মিত্র কী করবেন বলেছেন? মিস্টার রায় বললেন।

না। আমি চাই বাবার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী উইলটা আইনসম্মত হোক। অনিমেষ পরিষ্কার বলল।

তা হলে সেটা তো আমিই করব। হাসলেন ভদ্রলোক, নাকি অন্য কোনও ল-ইয়ারের কাছে উনি যেতে চাইছেন?

আপনি ছাড়া এই শহরের অন্য কোনও ল-ইয়ারকে উনি বোধহয় জানেন না।

তা হলে?

উনি উইলটা ফেরত চাইছেন কেন তা আমি জানি না।

মিস্টার রায় একটু চিন্তা করলেন। তারপর তরুণ সহকারীকে বললেন, দেখো তো, বাহাদুর এখনও আছে কি না!

আছে। একটু আগে দেখেছি। তরুণ বলল।

তা হলে গাড়ি বের করতে বলল।

সে কী! আপনি এই শরীর নিয়ে বাইরে যাবেন?

শরীর এখন ভাল আছে। তা ছাড়া আমি তো মহীতোষবাবুর স্ত্রীকে আমার কাছে আসতে বলতে পারি না। মিস্টার রায় বললেন।

একটা বড় খাম নিয়ে তরুণ সহকারী সামনে বসেছিল। অনিমেষ পেছনে, মিস্টার রায়ের পাশে।

হাঁটাচলা করতে কি খুব কষ্ট হয়?

বেশিক্ষণ হাঁটলে হয়।

এখন কি মনে হয় না, কী বিরাট ভুল করেছেন?

অনিমেষ হাসল, মানুষের অগ্রগতি হয়েছে যেসব আবিষ্কারের জন্যে তা করতে অনেকবার ব্যর্থতা এসেছে। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই শেষপর্যন্ত সফল হয়েছেন আবিষ্কারকরা। তাই না?

মিস্টার রায় আর কথা বাড়ালেন না।

বাড়ির মেইন গেটে গাড়ি না রেখে পেছনের দিকে গাড়িটাকে পার্ক করতে বলল অনিমেষ। ভেতরে ঢুকে মিস্টার রায় বললেন, বাঃ, বাগানটা বেশ পরিষ্কার রেখেছেন দেখছি। কত বছরের বাড়ি?

পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। অনিমেষ বলল, আসুন।

গাড়ির শব্দ পেয়ে মাধবীলতা বারান্দায় এসেছিল। অনিমেষ তাকে বলল, মিস্টার রায় অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছেন। ওঁকে বলো।

মাধবীলতা দ্রুত চলে গেল ভেতরে।

মিস্টার রায় বললেন, ইনি আপনার–! থেমে গেলেন তিনি।

আমার স্ত্রী।

আচ্ছা! আপনারা যে বিয়ে করেছেন তা মহীতোষবাবু জানতেন?

আমরা মন্ত্র পড়ে বা সই করে বিয়ে করিনি।

ও। তাই বলুন। আমি মহীতোষবাবুকে বলেছিলাম উইলে ছেলেকে বঞ্চিত করছেন কেন? তিনি আপনাদের মেনে নিতে পারেননি। চলুন।

বারান্দার চেয়ারে বসলেন মিস্টার রায়। আরও দুটো চেয়ার এনে দিল মাধবীলতা। অনিমেষের ইচ্ছে করল না মিস্টার রায়ের সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিতে। কিন্তু মাধবীলতা বলল, উনি এখনই আসছেন। আমি চা করছি। আপনি নর্মাল চা খাবেন তো?

অ্যাঁ? না, আমি চা খাই না। মিস্টার রায় বললেন।

আপনি? তরুণ সহকারীর দিকে তাকাল মাধবীলতা।

না না। আমি একটু আগেই চা খেয়েছি। তরুণ জানাল।

মিস্টার রায় অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি উইলটা দেখেছেন?

মাধবীলতা বলল, ওর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না। আমি পড়েছি। কিন্তু ও দেখার আগেই উনি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।

ছিড়ে ফেলেছিলেন? মিস্টার রায় অবাক।

হ্যাঁ?

ওটা অবশ্য মূল উইলের কপি। ছিড়লেও কোনও অসুবিধে হবে না। মাথা নাড়লেন মিস্টার রায়, কিন্তু–।

মাধবীলতা বলল, উনি আসছেন।

দুটো চেয়ার খালি ছিল। অনিমেষ এবং তরুণ সহকারী বসেনি। একটা চেয়ার মাধবীলতা তুলে মিস্টার রায়ের মুখোমুখি কিছুটা দূরত্বে রাখল।

ছোটমা সামনে এসে হাত জোড় করলেন, নীরবে।

মিস্টার রায় বললেন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারিনি। আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি উইলের মূল কপি ফেরত চেয়েছেন। কারণটা জানতে পারি?

ওটা আমার দরকার। ছোটমা বসলেন না, নিচু গলায় বললেন।

কী করতে চান? উইলের প্রবেট নিতে চাইছেন?

না।

তা হলে?

ওই উইল আমার দরকার নেই।

আপনার স্বামীর শেষ ইচ্ছে–!

আমারও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে। বেশ জোর দিয়ে বললেন ছোটমা।

আপনি ভেবেচিন্তে বলছেন তো? কোনও প্রেশার নেই?

আমি ছেলেমানুষ নই।

বেশ, ওঁকে খামটা দিয়ে দাও। সহকারী তরুণকে বললেন মিস্টার রায়।

তরুণ এগিয়ে এসে খামটা দিল ছোটমাকে। তিনি খাম খুলে স্ট্যাম্প পেপারের ওপর টাইপ করা উইল বের করলেন। তারপর চারটি বিস্মিত চোখের সামনে খুব যত্ন করে ছিঁড়ে ফেললেন। টুকরোগুলো খামের মধ্যে ঢুকিয়ে মাধবীলতার দিকে এগিয়ে ধরলেন তিনি, এগুলো পুড়িয়ে ফেলো তো!

মিস্টার রায় মাথা নাড়লেন, এমন ঘটনা আমি আগে কখনও দেখা দূরের কথা, শুনিওনি। মানুষ সম্পত্তি পাওয়ার জন্যে মামলা করে, আপনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন।

ছোটমা বললেন, আমি আর কদিন! ধরুন, তিনি যদি কোনও উইল না করে যেতেন তা হলে এই বাড়ির ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে হত?

আদালতে গিয়ে ওঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা নিজেদের দাবির সপক্ষে প্রমাণ দিতে পারলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তারপর কোর্ট অর্ডার দেবেন।

তবে তাই করুন।

বেশ। নামগুলো বলুন।

আপনি অনিমেষের নামেই আবেদন করুন।

ছোটমা কথাগুলো বলতেই অনিমেষের মুখ থেকে ছিটকে বের হল, অসম্ভব।

মিস্টার রায় অবাক হয়ে তাকালে অনিমেষ বলল, আমি এই বাড়ির মালিকানা পেতে একদম রাজি নই।

আপনি তো মহীতোষবাবুর একমাত্র ছেলে। মিস্টার রায় বললেন।

হতে পারি। কিন্তু আমাকে তিনি বঞ্চিত করেছেন ভেবেচিন্তে। তার শেষ ইচ্ছে ছিল আমাকে কিছু না দিতে চাওয়া। আর ছেলে হিসেবে আমি তো কখনওই এই বাড়ির জন্যে কিছু করিনি। দীর্ঘকাল এই বাড়ির ছায়াও মাড়াইনি। তাই এই বাড়ি পাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। অনিমেষ বলল।

মিস্টার রায় মাথা নাড়লেন, সত্যি কথা।

মাধবীলতা বলল, তা হলে এই বাড়ি বিক্রি হবে কী করে?

বাড়ি বিক্রির কথা ভাবা হয়েছে? মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

হ্যাঁ। ওঁর পক্ষে আর একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ওঁর বয়স বাড়ছে, শরীরও খারাপ হচ্ছে। তাই বাড়ি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা ওঁর নামে ব্যাঙ্কে রেখে একটা ভাল ফ্ল্যাট ভাড়া করে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হয়েছে। মাধবীলতা বলল।

সেখানেও তো ওঁকে একা থাকতে হবে? মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

এত বড় বাড়িতে একা থাকা যায় না, যেটা ফ্ল্যাটে সম্ভব।

ওর মৃত্যুর পরে টাকাটার কী হবে?

উনিই ঠিক করবেন।

কী আশ্চর্য! উনি তো বাড়ির মালিকানা নিতে রাজি হননি। বাড়ি বিক্রি করার টাকার মালিকানা নেবেন কী করে?

মাধবীলতা চুপ করে গেল। ছোটমা বললেন, অনি যখন রাজি হচ্ছে না তখন ওর ছেলে অর্ককে এই সবকিছু দিয়ে দেওয়া হোক।

তার বয়স কত?

প্রায় চল্লিশ। ছোটমাই জবাব দিলেন।

অ। তিনি এখানে এসেছেন?

না। কিন্তু আসবে।

বেশ, তিনি এলে এবং রাজি হলে তো কোনও সমস্যাই নেই। মিস্টার রায় উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা, আমি চলি।

অনিমেষ তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল। গাড়িতে ওঠার আগে মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলে অর্ক কী করেন?

চাকরি। কলকাতায়। অনিমেষ জবাব দিল।

১৬-২০. অর্কর সঙ্গে একদিন

অর্কর সঙ্গে একদিন অন্তর কথা হয় মাধবীলতার। মিনিট খানেকের মধ্যেই দুজায়গার খবরাখবর নিয়ে ফোন বন্ধ হয়। অর্ক সকালে ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, মাখন দিয়ে খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাত্রের খাবার বাইরে খেয়ে আসে। এতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

গতকাল তার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল। আজ মাধবীলতা সে কথা জিজ্ঞাসা করল। অর্ক বলল, হ্যাঁ মা, ও এসেছে। কলকাতায় থাকার জায়গা নেই ওর, আর তোমরাও এখন জলপাইগুড়িতে বলে থাকতে দিয়েছি। ও আমার ঘরেই শোয়।

কোথায় থাকে সে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ওর বাড়ি হাজারিবাগে।

বাঙালি তো?

আশ্চর্য! তুমি এই প্রশ্ন করছ? ও যদি সাঁওতাল হত তাতে কী এসে যায়। ভদ্র মানুষ, এটাই শেষ কথা।

অর্ক হেসে বলেছিল।

শোন, তোকে আজকালের মধ্যে জলপাইগুড়িতে আসতে হবে।

আমি তো বলেছি, যাব, হঠাৎ আজকালের মধ্যে কেন?

খুব দরকার আছে, তুই না এলে হবে না। মাধবীলতা গম্ভীর।

মা, হুট করে তো কাজ ছেড়ে যাওয়া যায় না। আমি দেখছি!

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, শোন, তুই এই সপ্তাহের মধ্যেই আয়। তোকে কোর্টে গিয়ে সইসাবুদ করতে হবে।

সে কী? আমি কী জন্যে কোর্টে যাব? অবাক হল অর্ক।

তুই এলে সব বলব। আচ্ছা, এক কাজ কর, এখানে কাগজপত্র সব রেডি হয়ে গেলেই আমি তোকে জানাব। তুই রাতের ট্রেন ধরে এসে সারাদিন কাজ শেষ করে ফিরে যাবি। মানুষের তো প্রয়োজনে একটা দিন ছুটি নেওয়া দরকার হয়। আর একটা কথা, তুই যখন এখানে আসবি তখন তোর বন্ধু কি ওই বাড়িতে থাকবে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ও তোমরা ফিরে আসার আগেই চলে যাবে।

আরে, আমি জিজ্ঞাসা করছি তুই এলে ও কোথায় থাকবে?

একদিন আমি না থাকলে ওর অসুবিধে হবে না।

তুই ওকে সঙ্গে নিয়ে আয়, নতুন জায়গা দেখে যাবে।

না না, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। দুই সেকেন্ড চুপ করে থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোর এই বন্ধু পুরুষ না মেয়ে?

শব্দ করে হাসল অর্ক, যত বয়স বাড়ছে তত তুমি বাঙালি-মা হয়ে যাচ্ছ। তোমার মোবাইলের বিল বাড়ছে তা খেয়ালেই রাখছ না। আচ্ছা, এখন রাখছি।

মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল মাধবীলতা। অর্কর কথাবার্তা তার মোটেই ভাল লাগছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল ও কিছু লুকোতে চাইছে। এই এতগুলো বছর ধরে যে ছেলেকে সে দেখেছে তার সঙ্গে আজকের অর্ক যেন একটু আলাদা। সেই কমিউন গড়ার স্বপ্ন চোখ থেকে চলে যাওয়ার পর ও অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ওকে বুঝতে অসুবিধা হত না মাধবীলতার।

ঘর থেকে বেরিয়ে অনিমেষকে দেখতে পেল সে।

অনিমেষ বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর ক্রাচ তুলে তার তলা দিয়ে কিছু স্পর্শ করল।

মাধবীলতা বারান্দা থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ওখানে কী করছ?

অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল, এদিকে এসো।

মাধবীলতা গাছগাছালি বাঁচিয়ে কাছে গেলে অনিমেষ বলল, দ্যাখো।

একটা একরত্তি কুকুরের বাচ্চা মাটিতে শুয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এটা কোত্থেকে এল? কোনও কুকুরকে তো দেখিনি।

ইনি সারমেয় শাবক নয়। শেয়ালছানা। জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় একে ওর মা নিয়ে গিয়েছিল, এখন নিরাপদ ভেবে ফিরিয়ে এনেছে। মা নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে। আমাদের দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছে বাচ্চার ক্ষতি না করি। পৃথিবীর সব প্রাণীর মায়েরা একইরকম। শুধু জলে যারা বাস করে তারা ছাড়া। অনিমেষ যেন নিজের মনেই কথা বলছিল।

মাধবীলতা বলল, সরে এসো। ওর মাকে আসতে দাও। ওরা বারান্দায় উঠে আসতেই বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু কি বাড়িতে আছেন?

অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, ওপাশ দিয়ে ভেতরে আসুন।

একটু পরেই মিস্টার রায়ের সহকারী তরুণটিকে দেখা গেল। হাসিমুখে বলল, নমস্কার, স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। সে-ব্যাপারে কিছু কথা জেনে নেবেন। আপনি কি আজ সন্ধের পরে যেতে পারবেন?

সন্ধের পরে শুনেছি, জলপাইগুড়িতে রিকশা পাওয়া একটা সমস্যা।

তা ঠিক। তবে যে রিকশায় যাবেন তার রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বললে করবে। কিছু বাড়তি টাকা নেবে। আসলে ওই সময়ে স্যার ফ্রি থাকেন।

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, আপনি এসে বসুন, চা আনছি।

না না, এখন একটুও সময় নেই। তরুণ মাথা নাড়ল।

ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যাবেলায় আমরা যাব। মাধবীলতা বলল।

তরুণ মাথা নেড়ে চলে গেলে বাবাকে দেখা গেল। হাতে একটা দড়ি আর কাটারি নিয়ে ঢুকছে। মাধবীলতা হাসল, কী রে তুই?

এর মধ্যে ছোটমা বেরিয়ে এসেছিলেন, বললেন, এসে গেছিস? পারবি তো?

ছেলেটি বেশ জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ছোটমা বললেন, ওর বাবাকে বলেছিলাম কয়েকটা নারকোল পেড়ে দিতে, বলল, ছেলেই পারবে। পাইকাররা এসে সব নারকোল কিনে নিয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটা ঘর বলতে রাখি।

অনিমেষ বলল, ওইটুকু ছেলে গাছে উঠে নারকোল কাটবে?

ততক্ষণে বাবা চলে গিয়েছে যে গাছটার নীচে, সেটা একটু বাঁকা হয়ে ওপরে উঠেছে। গাছের মাথায় অনেকগুলো পুরুষ্ট নারকোল ঝুলছে। কোমরের সঙ্গে গাছে দড়ি বেঁধে তরতর করে ওপরে উঠে গেল বাবা। তারপর স্বচ্ছন্দে গোটা পাঁচেক নারকোল কেটে নীচে ফেলে দিল। ছোটমা চেঁচিয়ে বললেন, আর লাগবে না, নেমে আয়।

বাবা হাসিমুখে নারকোলগুলোকে তিনবারে তুলে নিয়ে বারান্দায় রাখতে মাধবীলতা বলল, এই, তোর বাবাকে বলবি আমরা একটা জরুরি কাজে সন্ধের সময় বের হব। সে যেন সাড়ে ছটার মধ্যে রিকশা নিয়ে চলে আসে।

বাবা ঘাড় নাড়তেই ছোটমা একটা নারকোল তুলে তার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তুই বাড়িতে নিয়ে যা। আমি নাডু বানালে এসে খেয়ে যাবি।

বাবা চলে গেলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, রিকশা যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন আমি একাই যেতে পারতাম। তুমি কেন কষ্ট করবে?

মাধবীলতা কিছু বলার আগেই ছোটমা বললেন, ও গেলে খুব ভাল হবে।

কেন? অনিমেষ তাকাল।

তোমাকে এ ব্যাপারে আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। গিয়ে এমন সব কথা বলবে যে সব ভেস্তে যাবে। মাধবীলতা মাথা ঠান্ডা করে কথা বলতে পারবে।

চমৎকার। সেই ছেলেবেলা থেকে আমায় দেখছ তুমি, মেনে নিলাম তুমি ভাবছ আমার মাথা ঠান্ডা নয়। কিন্তু মাধবীলতাকে তো আগের বার খুব অল্প সময়ের জন্যে দেখেছ, আর এবার এই কদিন। তার মধ্যেই জানতে পারলে ওর মাথা ঠান্ডা? একটু অবিচার হয়ে যাচ্ছে না?

অনিমেষ ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল।

ছোটমা গলা তুললেন, শোনো, ভাত হয়ে গিয়েছে কি না তা বোঝার জন্যে হাঁড়ির সব চাল টিপতে হয় না, একটাতেই বোঝা যায়।

.

মাধবীলতা বুঝতে পারছিল অনিমেষ পছন্দ করছে না ওর সঙ্গে সে উকিলের কাছে যায়। ওর সম্পর্কে মহীতোষের মনোভাব জানার পর এই বাড়ি সম্পর্কে আগ্রহও কমে গেছে। উকিলকে যে সহযোগিতা করবেই এমন ভরসা হচ্ছে।, কিন্তু এ নিয়ে অনিমেষের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না মাধবীলতা। ছোটমাকে এই বাড়িতে একা ফেলে রেখে কলকাতায় ফিরে যাওয়া অত্যন্ত অমানবিক কাজ হবে। এতদিন দূরে ছিল, এখানে চোখের আড়ালে কী ঘটেছে তা জানাও ছিল না, কিন্তু দেখার পর একটা ব্যবস্থা না করে সে যেতে পারবে না। পরে অনিমেষকে না হয় বোঝানো যাবে।

খাটের একপাশে বসে মাধবীলতা বলল, কলকাতার বাড়িতে একজন।

অতিথি এসেছে।

মানে? অনিমেষ তাকাল।

অর্ককে ফোন করেছিলাম। বলল, ওর কোনও এক বন্ধু নাকি থাকছে।

বন্ধু? কে? তুমি চেনো?

না। বলল, হাজারিবাগে বাড়ি। কলকাতায় কেউ নেই, তাই কয়েকদিন আমাদের ওখানে থাকছে। আমরা ফেরার আগেই চলে যাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক শুনেছ তো?

একদম ঠিক।

কোনওদিন শুনিনি হাজারিবাগে ওর একজন বন্ধু আছে। অর্ক কখনও সেখানে যায়নি। তা ছাড়া গত দশ-বারো বছরে ওর কোনও বন্ধুকে বাড়িতে দেখেছ?

না, দেখিনি। মাথা নাড়ল মাধবীলতা।

আমরা যেই চলে এলাম অমনি তার এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কলকাতায় এল যে তাকে সে বাড়িতে থাকতে দিল? লতা, আমার ভাল লাগছে না। অনিমেষ বলল।

ভাল আমারও লাগছে না। আমি ওকে এখানে আসতে বলেছিলাম।

সে তো নিজেই আসতে চেয়েছিল।

হ্যাঁ। তখন সময় বলেনি। আমি বলেছিলাম এই সপ্তাহেই কয়েকদিনের জন্যে আসতে। কিন্তু বলল, ছুটি পাবে না।

অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল, ছুটি পাবে না? গত তিন বছরে ও কখনও দু-একদিনের অসুখ ছাড়া অফিস কামাই করেনি। তাই ছুটি চাইলে এক সপ্তাহের জন্যে ওকে ছুটি দেওয়া হবে না, তুমি বিশ্বাস করছ?

না

কিছু একটা করছে ও!

ভেবে কোনও লাভ নেই। সবচেয়ে যেটা আমাকে অবাক করেছে তা হল, আমি চাপ দিতে বলল, সে একদিনের জন্যে আসতে পারে, কিন্তু বন্ধুকে বাড়িতে রেখে আসবে। বললাম, তাকে নিয়েই আয়। বলল, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। মাধবীলতা জানাল।

ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া দরকার লতা।

পাগল! ও জানলে ভাববে গোয়েন্দা লাগিয়েছি।

হুম। পাড়ার কারও ফোন নাম্বার জানি না। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে পড়াতেন যে ভদ্রমহিলা, মাঝে মাঝে আসতেন, শীলাদি, হা, তার ফোন নাম্বার জানো? অনিমেষ তাকাল।

কী হবে?

জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, আমি শীলাদিকে বলব তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে এসো ছেলে কী করছে? কার সঙ্গে আছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ঠিক। আমি যদি কলকাতায় চলে যাই? খাট থেকে নেমে পড়ল মাধবীলতা, নাঃ, বেশ কিছুদিন ধরে একটু-আধটু উলটোপালটা বলছিলে, আজ দেখছি একদম মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এখানে এসেছি কেন? যে জন্যে এসেছি তা না শেষ করে তুমি ফিরে যাবে? কার জন্যে যাবে? যার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, যাকে কয়েক বছর বাদে প্রৌঢ় বলা হবে, সে কার সঙ্গে আছে তা দেখার জন্যে? অর্ক ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হত তা হলে যে তুমি কী করতে আমি ভেবে পাচ্ছি না। যা ইচ্ছে করুক ও, ছেলেবন্ধু হোক বা মেয়েবন্ধু হোক আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু এমন কিছু যেন না করে যা নিয়ে পাঁচজন কথা বলবে। আমাদের তো ওইখানেই ফিরে যেতে হবে।

মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষের মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তাদের অনুপস্থিতিতে অর্ক কোনও মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। ওর আচরণ দেখে কখনওই মনে হয়নি ও কাউকে ভালবেসেছে। আজ এতদিন পরে মনে পড়ল নিজেদের কথা। শান্তিনিকেতনে সে মাধবীলতার সঙ্গে দেখা করে একটা রাত কাটিয়েছিল। মাধবীলতা সে সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। না এলে ওর বাবা মায়ের মনের অবস্থা কী হত তা সে আজ অনুমান করতে পারে। তখন তাদের বয়স খুব কম ছিল। আবেগই শেষ কথা হওয়ায় বাস্তব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি।

.

তখন দুপুর একটু একটু করে বিকেল হতে চলেছে।

মাধবীলতা ছোটমার ঘরে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল বাগান থেকে বেরিয়ে বারান্দার কাছে এসে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে একটা শেয়াল, যাকে কুকুর বলে ভুল করা যায়। মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, কী রে? সঙ্গে সঙ্গে লেজ নাড়ল শেয়ালটা।

মাধবীলতা রান্নাঘরে গিয়ে দুপুরের বেঁচে যাওয়া কিছুটা ভাত একটা কাগজে মুড়ে বারান্দার সিঁড়িতে রেখে সরে আসতেই শেয়ালটা সেটা মুখে তুলে নিয়ে দৌড়ে বাগানের ভেতরে চলে গেল। মাধবীলতার মনে হল গাছের আড়ালে তখন উত্তেজনা, নিশ্চয়ই ভাতগুলো গোগ্রাসে গিলছে শেয়ালটা। ওর ছানার তো ভাত খাওয়ার বয়স হয়নি। হয়তো সারাদিন কিছু জোটেনি শেয়ালটার, তাই মরিয়া হয়ে চলে এসেছিল এদিকে। পেট ভরলে শান্ত হয়ে ছানাকে দুধ খাওয়াবে। তারপরেই মনে হল, এই ছানা আর একটু বড় হলে, নিজে খাবার সংগ্রহ করতে শিখলেই মাকে ছেড়ে চলে যাবে। মায়ের এই ভূমিকার কথা বেমালুম ভুলে যাবে সে। হয়তো মা-ও ওর কথা আর ভাববে না, যা মানুষ পারে না। পারে না বলেই কষ্টে থাকে।

ছোটমার ঘরের দরজায় এসে থমকে গেল সে। ছোটমা খাটে বসে। তাঁর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে কাঁদছে ভাড়াটেদের ছোটবউ। মাধবীলতা ফিরে আসছিল কিন্তু ছোটমা ডাকলেন, এসো।

মাধবীলতা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকল।

একে বলা হয়েছে থাকার জায়গা খুঁজে নিতে। ছোটমা বললেন।

সে কী?

বেচারার কেউ নেই। স্বামী মরে যাওয়ার পর আঠারো ঘণ্টা ধরে যাদের সংসারের কাজ করে করে এই চেহারা তৈরি করেছে, আজ তারাই ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। বলছে, ফ্ল্যাটে উঠে গেলে সেখানে ওর জায়গা হবে না।

ছোটমায়ের কথার মধ্যেই বউটি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।

মাধবীলতা বলল, এই ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে গেলে ওরা শুনবে কেন? উলটে অপমান করতে পারে।

এই কথাই তো ওকে বলছিলাম। বাড়ির সবাই একটু বেশি খেলে ওর ভাগ্যে যা জুটত তাতে চার বছরের বাচ্চারও পেট ভরবে না। আমার কাছে এলে আমি ভাতে ভাত যা রাঁধতাম, তা থেকে ওকে জোর করে খাইয়ে দিতাম। এর বেশি তো আমার সামর্থ্য নেই। এই যে ও কাঁদছিল তা দেখে নিজের জন্যেই কষ্ট হচ্ছিল। ছোটমা বউটির মাথায় হাত বোলালেন, ওঠ। ভগবান যা করবেন তা মেনে নিতে হবে।

মাধবীলতা বলল, আমি একটা কথা বলছি। যদি সত্যি ওঁর কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, তা হলে এই বাড়ি বিক্রি হওয়ার পর আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানেই তো উনি থাকতে পারেন।

ছোটমায়ের মুখ উজ্জ্বল হল, বাঃ। এই মেয়ে শুনলে তো? এবার মন হালকা হোক। আমার বউমা তোমার সমস্যার সমাধান করে দিল।

.

১৭.

লছমনের রিকশায় উঠে অনিমেষ বলল, ঝুলনা পুল দিয়ে বাবুপাড়ায় চলো।

মাধবীলতা একটু কাত হয়ে বসেছিল, বলল, অন্য রাস্তায় যাওয়া যায় না? এই বাঁ দিক দিয়ে? দেখতে দেখতে যাই।

অনিমেষ বলল, লছমনকে খামকা বেশি পথ রিকশা চালাতে হবে। শুনে লছমন বলল, না না, কোনও অসুবিধে নেই, আমি বাঁ দিক দিয়েই যাচ্ছি।

এখন জলপাইগুড়ি শহরের বুকে অন্ধকার ঘন হচ্ছে। অনিমেষ দেখল তার ছেলেবেলার মতন এখনও রাস্তার আলো টিমটিমে। তখনকার সঙ্গে একটাই পার্থক্য চোখে পড়ছে, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। কয়েকটা সাইকেল দ্রুত যাওয়া আসা করছে। রিকশা এক-আধটা। অথচ ষাট সালেও এই শহরের মানুষ নাইট শো-তে সিনেমা দেখে রিকশায় বা হেঁটে বাড়ি ফিরত।

এটা স্টেডিয়াম, না? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। টাউনক্লাব স্টেডিয়াম। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন তৈরি হয়নি। বাঃ, এদিকে দেখছি একটা বড় হলঘর তৈরি হয়েছে। ওই যে বাড়িটা দেখছ, ওখানে পার্থ থাকত। বন্যার সময় একবার ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনিমেষ অন্যরকম গলায় কথাগুলো বলল।

পার্থ কে?

আমরা একই স্কুলে সহপাঠী ছিলাম। অনিমেষ বলল, এই যে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, সোজা গিয়েছে কিং সাহেবের ঘাটের দিকে। ওদিকেই আদালত বসত। আমরা বলতাম কাছারিপাড়া। আর এই যে, রিকশা যেদিকে যাচ্ছে তার শেষ হবে স্টেশনে।

তুমি কিছু ভোলোনি। মাধবীলতা অনেকদিন পরে অনিমেষের হাতে হাত রাখল।

অনিমেষ বলল, ডানদিকে দেখো, সুভাষচন্দ্র বসু স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেবেলায় স্ট্যাচুটাকে বেশ বড় মনে হত। আমার যত বয়স বাড়ছে স্ট্যাচু যেন তত ছোট হয়ে যাচ্ছে।

নদীর ওপর ব্রিজে উঠে মাধবীলতা বলল, করলা নদী তো!

লছমন আফশোসের গলায় বলল, ও আর নদী নেই। পানি কোথায়?

অনিমেষ বলল, এইভাবেই সময় সব কিছু কেড়ে নেয়।

সে হাত সরাল।

মাধবীলতা বলল, হাতটা সরালে কেন?

এসে গেছি, নামতে হবে তো। অনিমেষ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল।

সত্যি কথাটা বললে না!

সত্যি কথা!

হ্যাঁ। এখানে একটু বেশি আলো, দোকান খোলা। তাই আমার হাতে হাত রেখে বসতে তোমার সংকোচ হল। হাতে হাত থাকলে কি জলপাইগুড়ির মানুষ অশ্লীল বলে ভাবে? মাধবীলতার গলার স্বর ধারালো।

ভুল বুঝছ। একদম ভুল। লছমন, বাঁ দিকের ওই উকিলবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়াও। তোমাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ভাই।

মাধবীলতার মনে হল মিস্টার রায়ের বাড়িটা এসে যাওয়ায় যেন বেঁচে গেল অনিমেষ।

মিস্টার রায় তার চেম্বারে আর একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তার সহকারী এখন ওই ঘরে নেই। ইশারায় বসতে বললেন ভদ্রলোক।

দূরের চেয়ারে বসে মাধবীলতা দেখল দেওয়াল ভরতি মোটা মোটা বই। এত মোটা মোটা ইংরেজি বই ভদ্রলোক পড়েন কখন? বইগুলো যে ইংরেজিতে লেখা তা মলাটের একপাশে ছাপা নামেই বোঝা যাচ্ছে। সে নিচু গলায় বলল, একজন উকিলকে কত বই পড়তে হয় দেখো।

অনিমেষ দেখছিল, বলল, এইগুলো কিনে উকিলরা বোধহয় চেম্বার সাজিয়ে রাখে যাতে লোকে ভাববে উনি খুব বড় উকিল।

তোমার সবটাতেই সন্দেহ। আজকাল এটা বেড়েছে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক চলে গেলে মিস্টার রায় ডাকলেন, আসুন।

ওরা এগিয়ে গিয়ে ওঁর টেবিলের এপাশে বসল।

মিস্টার রায় হাসলেন, আমি প্রথমবার যখন আপনাদের বাড়িতে যাই তখন মহীতোষবাবুর দিদি বেঁচে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওই বাড়ি যিনি বানিয়েছিলেন মানে, আপনার ঠাকুরদা, আপনাকেই মালিকানা দিতে চেয়েছিলেন। তবে যতদিন আপনার পিসিমা বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনিই ভোগ করবেন কিন্তু বিক্রি করতে পারবেন না। তাঁর চলে যাওয়ার পরে আপনি পাবেন। এইরকম একটা ইচ্ছে তার ছিল যা পরে তিনি কার্যকর করে যাননি।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমিও এইরকম শুনেছিলাম, কিন্তু নিতে রাজি হইনি। মনে হয়েছিল দাদু সুবিচার করছিলেন না।

শুনে ভাল লাগল। কিন্তু আপনার এই মা উইল ছিঁড়ে ফেলে সব ভজকট করে দিলেন। মহীতোষবাবুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে এবং আপনার ছেলেকে আদালতে আবেদন করতে হবে। ভেবে দেখুন, আপনি কি সত্যি মালিকানা নিতে চান না?

ভেবেই তো বলেছি।

বেশ, আমি কাগজপত্র দিন তিনেকের মধ্যে তৈরি করে আপনাদের বাড়িতে পাঠাব। আপনার মা আর ছেলে যেন সই করে দেন। তার সঙ্গে একটি প্রচারিত খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে যে এই ব্যবস্থায় কারও আপত্তি থাকলে যেন দিন পনেরোর মধ্যে আদালতকে জানান। মিস্টার রায় বললেন।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ জানান?

তা হলে সমস্যা হবে। তিনি মামলা করতে পারেন।

মাধবীলতা বলল, তার সমাধান তো বহুদিন পরে হবে।

স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে খরচও কম হবে না। মিস্টার রায় বললেন, আবার বিজ্ঞাপন না দিয়েও তো উপায় নেই। এক কাজ করতে পারেন, যে কলকাতার কাগজ শিলিগুড়ি থেকে ছাপা হয় না, নর্থ বেঙ্গলে খুব কম আসে তাতেই বিজ্ঞাপনটা দিন। এতে ঝুঁকি কম থাকবে।

কম হলেও তো থাকবে। কেউ বদমায়েশি করতেও তো পারে। মাধবীলতা বলল।

মিস্টার রায় হাসলেন, সেজন্য আমি অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী?

সেদিন আপনাদের বাড়িতে আমি যে উইল নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা একটা ডুপ্লিকেট উইল! স্ট্যাম্প পেপারে টাইপ করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে মহীতাষবাবুর পুরো সই যেমন ছিল না, ফিঙ্গার প্রিন্টও নেই। আপনারা কেউ সেটা লক্ষ করেননি। মহীতোষবাবুর অরিজিন্যাল উইল আমার কাছে আছে। যদি দেখি মামলা জটিল হচ্ছে তা হলে ওই উইল আদালতে পেশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার মায়ের নামেই সম্পত্তি যাবে, তিনি চাইলে পরে আপনার ছেলেকে গিফ্ট করতে পারেন। মিস্টার রায় বললেন, এই খবরটা দয়া করে ভদ্রমহিলাকে এখন জানাবেন না।

তা হলে ছেলেকে কবে এখানে আসতে বলব?

ঠিক দুদিন পরে এলেই হবে।

মাধবীলতা ব্যাগ খুলল, আমি জানি না, এখন কত টাকা দিতে হবে?

মিস্টার রায় বললেন, কী বলি বলুন তো? লোকে বলে একশোটা শকুন মারা গিয়ে একজন উকিল হয়। আমিও নিশ্চয়ই তার বাইরে নেই। আপাতত পাঁচশো দিন। আমার জন্য নিচ্ছি না, কেস ফাইল করতে যা খরচ হবে তাই দেবেন।

অনিমেষ বলল, যদি একটা আন্দাজ দেন।

কী ব্যাপারে? মিস্টার রায় তাকালেন।

এখনই কী করে বলব ভাই! যদি শুধু উইলের পজেশনের ব্যাপার হত তা হলে বলা সহজ ছিল। বিজ্ঞাপন আর অন্যান্য খরচ বাবদ হাজার দশেক ধরে রাখতে পারেন।

মিস্টার রায় বললেন।

রিকশায় উঠে মাধবীলতা বলল, দশ হাজার। কী করবে?

ভেবে পাচ্ছি না।

একটা কিছু তো করতে হবে। মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।

অর্কর ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে?

জানি না। কোনওদিন খোঁজ নিইনি।

নাও। ও যা দেয় তাই তো চুপচাপ নিয়ে নাও। এবার যখন দরকার পড়ছে। তখন তো জিজ্ঞাসা করতে হবেই।

মাধবীলতা চুপ করে থাকল।

.

রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি দুজনের। মাধবীলতা রাত সাড়ে এগারোটায় শেষবার ফোন করেছে অর্ককে, ওর মোবাইলের সুইচ অফ করে রেখেছে। এরকমটা কখনও হয় না। নানান দুশ্চিন্তা ভিড় করছিল মনে। অনিমেষ বলেছিল ওর ওই বন্ধু আসার পর সব উলটো পালটা হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় না মেয়েবন্ধু, তা হলে ওখানে নিয়ে যেতে সাহস পেত না।

মাধবীলতা চুপ করে ছিল। অনিমেষের স্বভাব হল আগ বাড়িয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার সঙ্গে বাস্তব মেলে না।

সকালের চা-পর্ব শেষ হলে মাধবীলতা আবার অর্ককে ফোন করল। এবারে রিং হচ্ছে, একটু বাদেই অর্কর গলা কানে এল, বলো মা।

কী রে? কাল ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলি কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

চার্জে বসিয়েছিলাম মোবাইল।

ও। শোন, এখানে তোকে খুব দরকার। কালই তোকে রওনা হতে হবে।

কী দরকার সেটা বলবে তো?

ফোনে অত বলা যাবে না। আমি রাখছি। কথা বাড়াতে চাইল না মাধবীলতা।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। হঠাৎ আমাকে এরকমভাবে দরকার পড়ল কেন?

আমি তো তোকে বললাম, এখানে এলে জানতে পারবি।

তুমি আমাকে সমস্যায় ফেলে দিচ্ছ মা!

কোনও সমস্যায় ফেলছি না। তোর বাবা জানতে চাইছিল, যাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছিস তার সঙ্গে কী করে আলাপ হল?

আমার সঙ্গে যত লোকের পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়, তাদের প্রত্যেককে কি বাবা বা তুমি চেনো? ও খুব ভদ্র এবং শান্ত। তোমাদের ঘরে একবারও ঢোকেনি। বাবাকে চিন্তা করতে নিষেধ কোরো। অর্ক কথাগুলো বলতেই মাধবীলতা ফোনের লাইন কেটে দিল।

অনিমেষ তাকিয়ে ছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, কেন ফোন বন্ধ ছিল?

তুমি তো সাতপাঁচ ভেবে নিয়েছিলে। ওর মোবাইলের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছিল বলে চার্জে বসিয়েছিল। আগ বাড়িয়ে ভাবাটা এবার বন্ধ করো। বেশ জোরে পা ফেলে মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ নয়, অর্ক তাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না।

বেলা সাড়ে নটার সময় গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। অনিমেষ একটু কৌতূহলী হয়ে বারান্দা থেকে নেমে আসতেই স্বপ্নেন্দু দত্তকে দেখতে পেল। সঙ্গে দুজন মধ্যবয়সি মানুষ। স্বপ্নেন্দু বললেন, নমস্কার। আপনাদের বাড়িটাকে এঁদের দেখাতে চাই। আপত্তি নেই তো?

এঁরা?

আমার কোম্পানির লোক। সমস্ত কাজকর্ম এঁরাই করেন।

ও ঠিক আছে।

স্বপ্নেন্দু লোক দুজনকে বললেন, এই যে বাগান, ওই ওপাশের বাড়ি আর এই দিকের বড় বাড়িটা, ভালভাবে ঘুরে দেখুন। ওপাশের গলির রাস্তাটা কুড়ি ফুটের বেশি নয়। ফলে আমাদের জায়গা ছাড়তে হবে। সব দেখে শুনে নিন।

লোকগুলো মাথা নেড়ে বাগানের ভেতর চলে গেল। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, জগদীশবাবু আর কাউকে আনেননি তো?

অনিমেষ হাসল। স্বপ্নেন্দু বললেন, আরে বাব্বা, আমি এই জমির দালালদের বিশ্বাস করি না। যত দাম বাড়াতে পারবে তত তো ওদের লাভ। আপনাদের আইনি ব্যবস্থা ঠিক করে নিতে কত দেরি হবে?

উকিলবাবু বলছেন বেশি দেরি হবে না। অনিমেষ বলল।

বেশ। আমার খুব তাড়া নেই। বর্ষা চলে না গেলে তো কাজে হাত দেব না। স্বপ্নেন্দুর কথা শেষ হওয়ামাত্রই ওরে বাবা রে বলে চেঁচিয়ে উঠল বাগানে ঢোকা লোক দুটোর একজন। তারপর দুজনই প্রায় দৌড়ে চলে এল কাছে।

স্বপ্নেন্দু বললেন, কী হল? বাঘ দেখেছেন নাকি?

না। শেয়াল। আমাকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসছিল।

উঃ। একটা শেয়াল দেখেই এত ভয় পেয়ে গেলেন? অনিমেষবাবু, বাগানটাকে আগে পরিষ্কার করতে হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।

আপনি যদি কিনে নেন তা হলে যাতে সুবিধে হয়, তাই তো করবেন। অনিমেষ বলতে বলতে দেখল, মাধবীলতা একটা কিছু কাগজে মুড়ে বারান্দা থেকে ঘুরে বাগানের ভেতর ঢুকে গেল।

স্বপ্নেন্দু বললেন, উনি জানেন না বোধহয় ওখানে শেয়াল আছে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ও নিজের চোখে দেখে এসেছে।

মাধবীলতা বেরিয়ে এসে স্বপ্নেন্দুকে দেখে হাত জোড় করে নমস্কার করল। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে কি শেয়ালটাকে দেখলেন?

হ্যাঁ। ছানাটার সঙ্গে আছে।

আপনাকে কিছু বলল না?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ওকে কালকের বাসি খাবার দিয়ে এলাম। প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের তফাত হল, যে খাবার দেয় ওরা তার অনিষ্ট করে না। জগদীশবাবু আসেননি?

না। এই যে, আপনারা ওই জায়গাটা ছেড়ে বাকিটা ঘুরে দেখে নিন। স্বপ্নেন্দু বলাতে লোক দুটো বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগল।

মাধবীলতা বলল, কী স্থির করলেন?

আমার তো ইচ্ছে হয়েছে। এ পাড়ায় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি নেই। পাড়াটার খুব সুনামও আছে। আপনারা যেন অন্য কাউকে বিক্রি করবেন না।

অনিমেষ বলল, দেখুন, জগদীশবাবু যা বলবেন– ।

না না। দালালের কথায় কান দেবেন না। আমি না হয় আরও লাখখানেক টাকা ওঁকে না জানিয়ে আপনাদের দেব। স্বপ্নেন্দু বললেন, একটা প্রাথমিক লেখাপড়া হয়ে যাক। মালিকানা স্থির হয়ে গেলে কেনাবেচা হবে। আপনাদের আপত্তি নেই তো?

মাধবীলতা বলল, দেখুন, এই ব্যাপারে আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আপনি যখন জগদীশবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে নিষেধ করছেন, তখন আমাদের উকিলবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলে নিই।

নিশ্চয়ই নিন। স্বপ্নেন্দু পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে ধরলেন, এটা রাখুন। পঁচিশ হাজার অগ্রিম হিসেবে দেওয়া থাকল। রশিদ দিতে হবে না। ভদ্রলোকের চুক্তি।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না, কী বলবে। মিস্টার রায় দশ হাজারের কথা বলেছেন। সেই সমস্যার সমাধান–।

স্বপ্নেন্দু দত্ত বললেন, আরে মশাই রাখুন তো।

খামটা অনিমেষের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি।

.

১৮.

স্বপ্নেন্দু দত্ত টাকা দিয়ে গিয়েছেন, আগাম হিসেবে, শুনে ছোটমায়ের মুখে হাসি ফুটল, যাক, তা হলে এই বাড়ির হিল্লে হচ্ছে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হিল্লে হচ্ছে মানে? ছোটমা বললেন, আর কিছুদিনের মধ্যে তো বাড়িটা ভূতের বাড়ি হয়ে যেত। তোমরা কলকাতায় চলে গেলে আমি হয়তো ঘরেই মরে পড়ে থাকতাম।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, টাকাটা নেওয়া বোধহয় উচিত হল না। এখনও অনেক সিঁড়ি ভাঙার পর বাড়িটা বিক্রি করা যাবে।

মাধবীলতা চুপচাপ শুনছিল, বলল, সেই সিঁড়িগুলো ভাঙতে যে টাকার দরকার হবে, তা যদি আমরা জোগাড় করতে না পারতাম, তা হলে?

ছোটমা মাথা নাড়লেন, তোমরা বোধহয় মানো না, আমি মানি। ঈশ্বরের ইচ্ছে বাড়িটা বিক্রি হোক, তাই ওই ভদ্রলোক যেচে টাকাটা দিয়ে গেলেন।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। তাই দেখে ছোটমা যে বিরক্ত হলেন তা তার মুখের অভিব্যক্তিতেই বোঝা গেল। মাধবীলতা বলল, যাক গে, আপনি মন থেকে চেয়েছিলেন বলেই প্রথম বাধাটা পার হওয়া গেল।

এইসময় মাধবীলতার মোবাইল জানান দিল। সে দ্রুত উঠে ভেতরে চলে গেল। অনিমেষ বলল, টাকাটা খরচ হয়ে যাওয়ার পর যদি দেখা যায় কোনও বাধায় বাড়ি বিক্রি করা যাচ্ছে না, তখন ফেরত দেওয়া সমস্যা হয়ে যাবে।

মাধবীলতা মোবাইল হাতে বেরিয়ে এল, তোমার ফোন।

কে? অর্ক? অনিমেষ হাত বাড়াল।

না, জগদীশবাবু। মোবাইলটা দিয়ে দিল মাধবীলতা।

হ্যালো, অনিমেষ বলছি।

জগদীশবাবুর গলা কানে এল, এটা কী হল মশাই?

কী ব্যাপারে বলছেন?

ক্লায়েন্ট লোকজন নিয়ে বাড়ি দেখতে গেল, অথচ আমাকে জানালেন না।

উনি আসার আগে আমাকে জানাননি। আপনাকে যে জানাব তার সুযোগ তো ছিল না।

অ। এইসব লোকগুলোর স্বভাব হল ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া। কোনও পাকা কথা দেননি তো?

আপনি থাকতে যে কথা হয়েছিল–।

সেটা তো কথার কথা থামিয়ে দিলেন জগদীশবাবু, আমি চেষ্টা করছি অন্য ক্লায়েন্ট জোগাড় করার যে বেশি দাম দেবে।

কিন্তু ইনি যে জোর করে আগাম দিয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, করেছেন কী! সই করে টাকা নিয়েছেন নাকি?

না। সইসাবুদ করাননি।

ওঃ। বাঁচা গেল। বেশি দামের ক্লায়েন্ট পেলে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবেন। আমাকে ভদ্রলোক কিছু বলেননি, ওঁর কর্মচারীর কাছে শুনলাম আজ আপনার বাড়িতে গিয়ে পাকা করে এসেছেন। এখন থেকে যা হবে আমাকে জানাবেন। আরে, বেশি দাম পেলে আপনার যেমন লাভ, তেমনি আমার মঙ্গল। রাখছি। জগদীশবাবু ফোন রেখে দিলেন।

.

সকালে বাজারে যাচ্ছিল অনিমেষ। টাউন ক্লাবের মোড় অবধি রিকশা নেই। লছমনকে রোজ রোজ আসতে বলা শোভন নয় বলে এটুকু হেঁটে অন্য রিকশা ধরে সে, কিন্তু এই সকাল আটটায় হাকিমপাড়ার রাস্তা শুনশান। হঠাৎ চোখে পড়ল চারটে তরুণ তার দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে তাদের একজন বলল, কাকা, আপনি তো বাজারে যাচ্ছেন, কোনও সাহায্য লাগলে বলতে পারেন।

না ভাই, কিন্তু তোমরা কি এই পাড়ায় থাকো?

হ্যাঁ। ওই তো ওপাশেই আমাদের ক্লাব। তরুণ সঙঘ।

ও। আমি তো অনেকদিন পরে এলাম। তাই–!

আপনি কি রিকশা খুঁজছেন?

হ্যাঁ। পেয়ে যাব।

এবার দ্বিতীয় ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বাড়ি বিক্রি করছেন?

হ্যাঁ। চেষ্টা হচ্ছে।

ভাড়াটে কি উঠে যাচ্ছে?

একটু অসুবিধে হচ্ছে। ওই যে, রিকশা–

ছেলেরাই চেঁচামেচি করে খালি রিকশাটাকে দাঁড় করাল। একটু সাহায্য করল তারা। রিকশায় বসে বাজারের দিকে যেতে যেতে অনিমেষের মনে হল এই ছেলেগুলো সত্যি ভাল, হয়তো এদের বাবা বা জ্যাঠাদের সে চেনে, ওরা সেই পরিচয় দেয়নি বলে কথা বাড়ায়নি সে। এখনকার তরুণদের সবাই যে অভদ্র, শিষ্টাচার জানে না তা নয়। এদের দেখে সেটা বোঝা গেল।

আজ বাজারে দেবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দু-তিনটে কথার পর দেবেশ তাকে একটু ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, মাওবাদী আর নকশালদের মধ্যে পার্থক্য কতখানি?

হঠাৎ এই প্রশ্ন?

একটা ইংরেজি কাগজে লিখেছে নকশালরা হচ্ছে গৃহপালিত আর মাওবাদীরা ওয়াইল্ড ডগ। দেবেশ বলল।

অশিক্ষিত লোকরাই এই ধরনের কথা বলতে পারে।

আবার তৃণমূল নেত্রী বলছেন মাওবাদী বলে কিছু নয়। সব নাকি সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী, দেবেশ হাসল।

এদেশে বাক স্বাধীনতা চালু আছে। অনিমেষ বলল, আমার ওখানে কবে আসছিস?

যাব।

তুই তো একবার ফোনও করলি না। দেবেশ বলল, আয় একবার দেখে যা, রাজনীতি ছাড়াও মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, অবশ্য খুব স্বল্প পরিসরে। তবুও–।

ফেরার পথে রিকশায় বসে অনিমেষ ভাবছিল, সাতাত্তর সালে জেল থেকে বেরিয়ে দেখেছিল পশ্চিমবাংলার মানুষ লালস্রোতে ভাসছে। বামপন্থী দলগুলো একত্রিত হয়ে যে সরকার গঠন করেছে তাকে জনগণের সরকার বলা হত। দুটো নির্বাচনের পর থেকে নেতাদের চেহারা বদলাতে শুরু করল। মফস্সলে, গ্রামে, গঞ্জে ক্যাডার বাহিনীর নেতারা এক-একজন চেঙ্গিজ খাঁ হয়ে উঠল। বিস্ময় লাগে, তার পরের নির্বাচনগুলোতেও বামফ্রন্ট জিতে চলেছে, একটা বড় অংশের ভোটার তাদের ভোট দেয়নি, কিন্তু নির্বাচন জেতার অন্য কায়দাগুলো আয়ত্তে থাকায় ফ্রন্টের জিততে অসুবিধে হয়নি। এখন অধিকাংশ মানুষ বামফ্রন্টকে অপছন্দ করলেও বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। জাতীয় কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় প্রায় মেরুদণ্ডহীন। বিজেপি-র কথা মানুষ ভুলেও ভাবে না, বারো মাসে তেরো পার্বণ করে, মাটির পুতুলকে ভগবান ভেবে একটার পর একটা পুজো করে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার মানুষ মৌলবাদী নয়। এই অবস্থায় কাকে ভোট দিয়ে সরকারের পরিবর্তন করবে সাধারণ মানুষ? কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিবাদ করছে, মিছিল বের করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি।

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করতেই সে রাজি হয়ে গেল বাজারের ব্যাগটা বাড়িতে পৌঁছে দিতে। যে পথ দিয়ে ওরা এখন সচরাচর বাড়িতে ঢোকে, সেই পথে না গিয়ে ভাড়াটেদের দিকের গেট খুলে পা বাড়াতেই দেখল, নিবারণবাবু পড়ি নয় মরি করে ছুটে আসছেন। বৃদ্ধকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।

অনিমেষ দাঁড়াতেই বৃদ্ধ এসে দুই হাত জড়ো করে প্রায় কঁদোকাঁদো গলায় বললেন, আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আপনি আমার এরকম সর্বনাশ করলেন কেন?

অনিমেষ অবাক হয়ে বলল, আপনি কী বলছেন?

বৃদ্ধ বললেন, আপনি বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন বলেছেন, আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম যে এই ভাড়ায় এখন কোথাও বাড়ি ভাড়া পাব না। আপনি যদি কিছুটা সাহায্য করেন তা হলে উপকৃত হব। আপনি আমার অনুরোধ নাকচ করেননি। তাই না?

হ্যাঁ। অনিমেষ মাথা নাড়ল, এতে কী সর্বনাশ করা হল?

তা হলে আপনার আমার ব্যাপারে পার্টির ছেলেদের টেনে আনলেন কেন? এই পাড়ায় ওরা দিনকে রাত করে দিতে পারে।

আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না।

এ কী বলছেন! কিছুক্ষণ আগে ওরা আমাকে শাসিয়ে গেল। আপনার কাছ থেকে কিছু না জেনে? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? নিবারণবাবু বললেন।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, কাউকে আপনার কথা আমি বলিনি।

আপনি কি তরুণ সঙ্ঘের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেননি?

এতক্ষণে স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। অনিমেষ বলল, ওরা বাজারে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিল। জানতে চেয়েছিল বাড়িটা বিক্রি করছি কি না, ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে কি না? আমি ওদের একবারও বলিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে। অদ্ভুত ব্যাপার তো! ওরা কি পার্টির ক্যাডার?

হ্যাঁ। ওটা সিপিএমের ছেলেদের ক্লাব। ওদের কেউ চটাতে চায় না। ভোম্বলবাবুও ওদের এড়িয়ে যান। হাতে না রাখলে ভোটে জিতবেন না তাই খোশামোদ করেন। নিবারণবাবু বললেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এই যখন অবস্থা তখন এলাকার মানুষ কেন ভোম্বলবাবুকে ভোট দেন?

কাকে দেবে? কেউ আছে নাকি? তা ছাড়া ওই তরুণ সঙ্ঘই তো আমাদের ভোট দিয়ে দেয়। এখন আমি কী করি বলুন তো?

ওরা আপনাকে কী বলেছে?

দশ দিনের মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে হবে। শ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ।

সে কী?

এই অর্ডার না মানলে আমার পরিবারের লোকজনের কী কী হতে পারে তার লিস্টও শুনিয়ে গিয়েছে। আমি তখন প্রায় ওদের হাতে পায়ে ধরলাম, তা দেখে ওরা বিকল্প প্রস্তাব দিল। শুনবেন?

বলুন।

আমাকে কোনওদিন এই বাড়ি ছাড়তে হবে না। কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। শুধু প্রতিমাসে ওদের ক্লাবে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ নিবারণবাবু।

অনিমেষ হতভম্ব। বাজারে যাওয়ার সময় যে ছেলেদের অত্যন্ত ভদ্র বলে তার মনে হয়েছিল, তাদের যে এরকম ভয়ংকর চেহারা হতে পারে, তা এখন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এরকম সময়ে নিজেকে বাতিল মানুষ বলে মনে হয়। সে বলল, নিবারণবাবু, ওদের কথায় বিচলিত হবেন না। অল্পবয়সি ছেলে, কী ক্ষমতা আছে ওদের? আমি তো আপনাকে কোনও চাপ দিচ্ছি না।

অল্পবয়সি ছেলে। ওরা পিরানহা মাছের মতো। ওই যে, বইয়ে পড়েছিলাম, এক আঙুলের মতো লম্বা কিন্তু ওদের ঝকে একটা হাতি গিয়ে পড়লে দশ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা হাড় ছাড়া কিছু ফেলে রাখে না। আবার শ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক।

আরও কিছুটা সাহস জুগিয়ে বাড়ি ফিরে এল অনিমেষ। ছোটমা বারান্দায় বসে তরকারি কাটছিলেন, বললেন, বাজার পাঠিয়ে দিয়ে কোথাও গিয়েছিলে নাকি?

নিবারণবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলাম।

কবে উঠে যাবেন, কিছু জানতে পারলে?

অনিমেষ হেসে ফেলল, সবে তো শুনছেন, একটু সময় দিতে তো হবে।

রান্নাঘর থেকে মাধবীলতার গলা ভেসে এল, জলখাবার রেডি।

.

অনিমেষ ঠিক করল পাড়ার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলবে। একসময় এই পাড়ার অর্ধেক মানুষকে চিনত সে। কাকা জ্যাঠা বলে সম্বোধন করত। তাদের এখন আর পৃথিবীতে থাকার কথা নয়। কিন্তু তাঁদের ছেলেরা নিশ্চয়ই আছে। মাধবীলতা বলল, তারা তোমাকে চিনতে পারবে কি না সন্দেহ হচ্ছে। আর চিনতে পারলেও তরুণ সঙঘ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইবে না।

আশ্চর্য! তুমি একথা বলছ লতা? অন্যায়ের প্রতিবাদ করব না? হেসে ফেলল মাধবীলতা।

হাসছ কেন? অনিমেষ বিরক্ত হল।

প্রতিদিন আমাদের চারপাশে হাজার হাজার অন্যায় হচ্ছে, তার একটারও প্রতিবাদ আমরা করি? বা করতে পারি? মাধবীলতা বলল।

তা হলে?

তুমি পাড়ার মানুষদের বললে তারাই তরুণ সঙেঘর ছেলেদের জানিয়ে দেবে। ওরা তো এই পাড়ার ছেলে। হয়তো তুমি যাকে বলবে তার ছেলেই ওদের একজন। উনি খুশি হবেন? মাধবীলতা বলল।

মাধবীলতার কথায় যুক্তি আছে। হঠাৎ নৃপেনদার কথা মনে পড়ল। নৃপেনদা এই জেলার সম্পাদক। দীর্ঘদিন পার্টি করছেন। তাকে বলার জন্যই ভোম্বলবাবু রাতারাতি বদলে গেলেন।

চিরকুটটা খুঁজে পাওয়া গেল। নৃপেনদাই লিখে দিয়েছিলেন তার নাম্বার। মাধবীলতার মোবাইল ফোনে ওই নাম্বারের বোতাম টিপতেই কানে এল, ব্যস্ত আছে। প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পর ওপাশে গান শুরু হল, ধন ধান্য পুষ্প ভরা… বেশ চমকপ্রদ ব্যাপার। সত্তর সালেও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও অনুষ্ঠানে এসব গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথ বাতিল ছিলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল তো দূরের কথা। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরেও বেশ কয়েক বছর ধরে শুধু গণনাট্যের গান অথবা পল রবসন গাওয়া হত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ গৃহীত হলেন। তারা বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় না নিলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তাই বলে নৃপেনদার মতো কট্টর সিপিএম নেতা, যিনি জেলার সম্পাদক হয়ে আছেন দীর্ঘকাল, যাঁর বক্তৃতায় এমন সব শব্দ থাকত যা সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারত না, তার মোবাইলের রিংটোনে ধন ধান্য পুষ্প ভরা? ভাবাই যায় না।

গান থামতেই নৃপেনদার গলা শোনা গেল, কে ভাই?

নৃপেনদা, আমি অনিমেষ।

কোন অনিমেষ?

অনিমেষ মিত্র। হাকিমপাড়ায় বাড়ি। এখন কলকাতায় থাকি।

ওহো। বলো, কোনও দরকার আছে?

আপনার সঙ্গে দেখা করে বলতে চাই। খুব জরুরি।

এই তো, আমাকে সমস্যায় ফেললে হে! আমি তো আজই রাতের ট্রেনে কলকাতায় যাচ্ছি। এখনই চলে আসতে পারবে? আধঘণ্টার মধ্যে? এসো। নৃপেনদা ফোনের লাইন কেটে দিলেন।

.

১৯.

আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে রিকশা ধরে নৃপেনদার বাড়িতে পৌঁছোনো অনিমেষের পক্ষে একটু কঠিন ব্যাপার। মাধবীলতা বলল, চলো, আমিও যাব। তুমি যাবে? অনিমেষ খাটে বসে পাঞ্জাবি শরীরে গলিয়ে বলল, উনি বলেছেন আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোতে। তোমার তৈরি হতে সময় লাগবে।

মানে? রেগে গেল মাধবীলতা, আমি কি বিয়েবাড়িতে যাচ্ছি যে একঘণ্টা ধরে সেজে যাব? তা ছাড়া তুমি আমাকে কবে সাজতে দেখেছ?

অনিমেষ জবাব দিল না। এ কথা ঠিক মাধবীলতা পোশাক বা প্রসাধনের যেটুকু দরকার সেটুকুতেই সন্তুষ্ট। এটা আজকের কথা নয়, কলেজজীবন থেকে একটা হলুদ শাড়ি আর কখনও কখনও কপালে ছোট্ট চন্দনের ফোঁটা ছাড়া ওকে দেখা যেত না।

মিনিট চারেক বাদে পাশের ঘর থেকে মাধবীলতা বেরিয়ে এসে বলল, চলো। অনিমেষ দেখল পরিষ্কার সাদার ওপর হালকা নীল কাজ করা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরেছে মাধবীলতা। সে হাসল।

হাসছ কেন?

বলা যাবে না। ক্রাচ টেনে নিয়ে এগোল অনিমেষ।

এমন কী কথা যা তুমি আমাকে বলতে পারবে না?

কোনওদিন যখন বলিনি তখন এখন বলি কী করে? মাধবীলতার দুই স্র এক হল ক্ষণিকের জন্যে। বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটমায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আমরা নৃপেনবাবুর বাড়িতে যাচ্ছি, উনি আজ কলকাতায় চলে যাচ্ছেন, না গেলে সমস্যা হবে।

এসো। বাবা এসেছে, ওর সঙ্গে গল্প করছি।

লছমন কি এসেছে?

না। ঘণ্টাখানেক পরে এসে বাবাকে নিয়ে যাবে।

.

কপাল ভাল ছিল, কয়েক পা হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেল ওরা। রিকশায় উঠে মাধবীলতা বলল, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

সেটা কী? অনিমেষ তাকাল। পাশাপাশি বসায় মাধবীলতার শরীরের চাপ কিছুটা মেনে নিতে হচ্ছিল।

বাড়িটা বিক্রি করতে যখন এত সমস্যা হচ্ছে, তখন থাক না।

মানে? অবাক হল অনিমেষ, ছোটমার কথা ভুলে যাচ্ছ?

ভুলিনি।

তা হলে?

এবার তোমাদের এই শহরে এসে মনে হচ্ছে আমাদের কলকাতায় থাকার কোনও মানে হয় না। যখন স্কুলে পড়াতাম তখন ওখানে থাকার দরকার ছিল। এখন তো সারাদিন বাড়িতেই কেটে যায়! অথচ দেখো, এই শহরটা কী শান্ত, বাড়ি বিক্রির চেষ্টা না করলে কোনও টেনশন থাকবে না। আমরা যদি এখানে থাকি তা হলে ছোটমায়ের দেখাশোনা করতে পারব। ওঁকে অন্য কোথাও যেতে হবে না। মাধবীলতা বলল।

খুব অবাক হয়ে অনিমেষ বলল, তুমি কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে চাও?

কলকাতা কি আমাদের কিছু দিয়েছে যে ছেড়ে আসতে কষ্ট হবে?

আর অর্ক?

ও ওখানেই থাকুক। চাকরি করছে, অসুবিধে হবে না। এই যে এতবার বললাম, এখানে আসার জন্য, নানান বাহানা দেখাতে লাগল।

এখানে সংসার চালাতে পারবে?

পেনশনের টাকা তো আছে, কয়েকটা ছেলেমেয়েকে না হয় পড়াব।

বাঃ। তা হলে আর নৃপেনদার কাছে গিয়ে কী হবে? রিকশা ঘোরাতে বলি?

একদম না। আমি আমার ভাবনার কথা বললাম। তার মানে এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। আমরা কয়েকদিনের জন্য এসেছি। ছোটমা ডেকে এনেছেন। কিন্তু মাসের পর মাস উনি তো আমাদের সঙ্গে থাকতে নাও চাইতে পারেন। তা ছাড়া ক্লাবের ছেলেদের অত্যাচারের একটা বিহিত তো করা দরকার। বেশ গম্ভীর গলায় বলল মাধবীলতা।

এখন নৃপেনদার বাড়ির সামনে কোনও লাইন নেই। বাড়ির দরজায় একটা নোটিশ টাঙানো হয়েছে–জেলা সম্পাদক আগামী তিনদিন বাহিরে থাকিবেন। দয়া করিয়া লাইন দিবেন না।

নৃপেনদা নিজে তাদের আসতে বলেছেন শুনে একজন তাদের বাইরের ঘরে বসতে দিল। এর আগের দিন অনিমেষ লক্ষ করেনি, পেছনের দেওয়াল জুড়ে লেনিনের বিশাল ছবি টাঙানো আছে। কী করে সেদিন ওটা চোখ এড়িয়ে গেল কে জানে।

বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেমে এলেন নৃপেনদা। মাধবীলতাকে দেখে তার চোখ ছোট হল। অনিমেষরা উঠে দাঁড়িয়েছিল, নৃপেনদা ওদের বসতে বলে সামনের চেয়ারে বসলেন, খুব দেরি হয়ে গেছে। দুমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে ট্রেন মিস করব। বলো, কী ব্যাপার?

অনিমেষ সংক্ষেপে তরুণ সঙ্ঘ ক্লাবের ছেলেদের কথা বলে শেষ করল, ওরা আপনাদের দলের কর্মী।

নৃপেনদা বললেন, কর্মীদের গায়ে কি দলের ছাপ মারা থাকে? এঁকে তো চিনলাম না! মাধবীলতার দিকে তাকালেন তিনি।

আমার স্ত্রী। মাধবীলতা মিত্র।

ওহো। আপনার কথা কে যেন বলছিল। নকশালদের ধরতে পুলিশ আপনার ওপর খুব অত্যাচার করেছিল বোধহয়। ঘড়ি দেখলেন নৃপেনদা, কিন্তু অনিমেষ, তুমি আমাকে কী করতে বলছ?

ওদের বলুন যেন ওই ব্যাপারে নাক না গলায়।

তোমার কাছে ওরা সরাসরি টাকা চেয়েছে কি?

না। নিবারণবাবু, যিনি আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাঁর কাছে চেয়েছে। ভদ্রলোক খুব ভয় পেয়ে গেছেন।

কী বলব বলো! আজকালকার ছেলেরা যা ভাল বোঝে তাই করে। এই যে আমার শ্বশুরমশাই মারা গেলেন, বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। আমার স্ত্রী একমাত্র মেয়ে। ওঁর মা চলে গেছেন বছর দশেক আগে। খালি বাড়ি ফেলে রাখার কোনও মানে হয় না বলে বিক্রি করতে চাইলেন আমার স্ত্রী। অমনি ও পাড়ার ছেলেরা এসে পুজোর চাদা হিসেবে এক লক্ষ টাকা চাইল। তুমি ভাবো ব্যাপারটা! আমি পার্টির এতদিনের সম্পাদক, আমার স্ত্রীর কাছেই ওরা টাকা চাইছে। যদি না দিতাম, যদি শাসন করতাম তা হলে পরের নির্বাচনে কেউ আমাদের ক্যান্ডিডেটের হয়ে খাটত না। তবে হ্যাঁ, আমি বলে-কয়ে ওটা পঞ্চাশ হাজারে নামিয়েছিলাম। হাসলেন নৃপেনদা।

আপনি সম্পাদক হয়ে ক্যাডারদের প্রশ্রয় দিয়েছেন?

অনিমেষ হতভম্ব।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই করতে হয় অনিমেষ। আচ্ছা উঠছি। নৃপেনদা উঠে দাঁড়ালেন।

এতক্ষণে মাধবীলতা কথা বলল, আপনারা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। আপনাদের দলের ছেলে আমাদের উপরে অত্যাচার করছে দেখেও আপনি কোনও সাহায্য করবেন না! তা হলে তো বুঝতে হবে আমরা জঙ্গলে বাস করছি।

নৃপেনদা বললেন, এর আগে যখন অনিমেষ আমার কাছে এসেছিল। তখন আমি ভোম্বলকে বলে দিয়েছিলাম। কারণ ভোম্বলকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, এক কাজ করুন। আপনারা সৌমেনবাবুর সঙ্গে দেখা করুন। উনি এদের ব্যাপারটা দেখেন। আমি বলে দেব। আচ্ছা ভাই আর দেরি করা যাবে না। নৃপেনদা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

দরজার বাইরে পা রাখতে না রাখতেই নৃপেনদার গাড়িটাকে চলে যেতে দেখল ওরা। অনিমেষ বলল, চলো, রিকশার খোঁজ করি।

গেটের পাশে একটি যুবক দাঁড়িয়ে ছিল, কথাটা তার কানে গিয়েছিল। যেতেই বলল, এখানে দাঁড়ান, এখনই রিকশা পেয়ে যাবেন। কোথায় যাবেন?

অনিমেষ বলল, হাকিমপাড়ায়।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সৌমেনবাবু কোথায় থাকেন?

আমাদের জেলা কমিটির সৌমেনদার কথা বলছেন?

আন্দাজে বুঝে নিয়ে মাথা নাড়ল মাধবীলতা, হ্যাঁ।

বাবুপাড়ায়। থানার উলটোদিকে। এই খানিক আগে নৃপেনজ্যাঠার সঙ্গে মিটিং করে বাড়িতে গিয়েছেন। উনি আটটা নাগাদ পার্টি অফিসে যান।

যুবক হাত নেড়ে একটা রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল। ওরা রিকশায় উঠে বসলে অনিমেষ বলল, হাকিমপাড়ায় চলো।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না। আগে বাবুপাড়ায় যাব।

অনিমেষ মুখ ফেরাল, কেন?

সৌমেনবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাব।

নাঃ। লোকটিকে আমি চিনি না। তা ছাড়া নৃপেনদা বলেছেন, ওর সঙ্গে কথা বলবেন। আগে বলুন, তারপর দেখা যাবে।

উনি আজ কলকাতায় চলে যাচ্ছেন, যদি শেষ পর্যন্ত ভুলে যান, তা হলে তরুণ সঙ্ঘের সমস্যাটা একই জায়গায় থেকে যাবে। তার চেয়ে আমরাই সৌমেনবাবুর সঙ্গে কথা বলি। মাধবীলতা শক্ত গলায় কথাগুলো বলল।

অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে বলল, বাবুপাড়া হয়ে যাবে ভাই।

দিনবাজার দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হত। রিকশাওয়ালা বলল।

একই হত। তুমি আমাকে জলপাইগুড়ির রাস্তা চেনাবে নাকি? বিরক্ত হল অনিমেষ। মাধবীলতা আড়চোখে তাকাল, কিছু বলল না।

থানার সামনে এসে সৌমেনবাবুর বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। একটি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করতেই রিকশাওয়ালা বলে ফেলল, আরে! আগে বললে আমিই নিয়ে যেতাম। চলুন।

তুমি ওঁকে চেনো?

কে চেনে না? রিকশাওয়ালা একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামল।

দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর যে ভদ্রলোক হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তাঁকে অনিমেষ আগে কখনও দেখেনি। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, আপনাদের আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বলবেন?

একটা সমস্যার কারণে এসেছি। মাধবীলতা বলল। পাশের ঘরের দরজা ঠেলে আলো জ্বালিয়ে সৌমেনবাবু বললেন, এই শহরের লোকজন সমস্যায় পড়লে ডাক্তারের কাছে যায়, উকিলের কাছে। যায়। সব শহরের লোকজনই যায়। তবে এই শহরের লোক সমস্যায় পড়লে থানায় না গিয়ে উলটো দিকের এই বাড়িটায় আসাই পছন্দ করে। বসুন। আগে আপনাদের পরিচয়টা জানি।

অনিমেষ বলল, আমি অনিমেষ, ও আমার স্ত্রী। নৃপেনদা আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন, ওঁকে আমি ছাত্রাবস্থা থেকে চিনতাম।

আচ্ছা। আপনি এখন কোথায় থাকেন?

কলকাতায়।

সমস্যাটা কী?

মাধবীলতা মুখ খুলল, পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বেশ গুছিয়ে বলল সে। চোখ বন্ধ করে শুনলেন সৌমেনবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেগুলোর নাম বলুন।

মাধবীলতা তাকাল অনিমেষের দিকে। অনিমেষ মাথা নাড়ল, নাম তো জানি না। ওরা কথা বলেছিল, নাম বলেনি।

নাম না জানলে আমি অ্যাকশন নেব কী করে? ওরা যে আমাদের লোক সে ব্যাপারে আমাকে নিঃসন্দেহ হতে হবে। আজকাল অনেকেই পার্টির কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে দুপয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে তাকেই এই আবর্জনার দায় বইতে হয়। আপনারা খোঁজ নিয়ে আমাকে নামগুলো বলুন। সৌমেনবাবু মিষ্টি হাসলেন।

মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, আপনি তরুণ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।

মাথা নাড়লেন সৌমেনবাবু, না, পারতাম না। আমিই ওদের প্রেসিডেন্ট, আমাকে জানিয়ে ওরা এই কাজটি করেনি। পার্টি থেকে বলা হয়েছে, ভাড়াটে এবং বাড়িওয়ালার ঝগড়ার মধ্যে কেউ যেন নাক না গলায়। যারা নাক গলাচ্ছে তারা যে পার্টির কর্মী নয় তা আমি জোর গলায় বলতে পারি। নকশালদের মধ্যে কংগ্রেস প্রচুর বদ ছেলেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যারা নিজেদের নকশাল বলে পরিচয় দিয়ে কনস্টেবলদের মেরেছে, স্কুল পুড়িয়েছে। ফলে মানুষ নকশালদের সমর্থন করেনি। এটাই ছিল কংগ্রেসের কৌশল। এখন দুই কংগ্রেস মিলে আমাদের বদনাম করার জন্য এইসব ছেলেদের রিক্রুট করেছে যারা আমাদের কর্মীদের সঙ্গে মিশে দলের বদনাম করবে। তবু, আমি দেখব।

রিকশায় উঠে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, কোনও লাভ হল না এখানে এসে। একটা কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা কোথায় নেমে এসেছে। এতবছর ক্ষমতায় থেকেও মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দলটা।

নতুন কথা বলছ নাকি?

মানে?

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তোমার পায়ের গুলির দাগ দেখিয়ে ওরা তোমাকে বিপ্লবী সাজিয়েছিল, মনে নেই? মাধবীলতা বলল।

আছে, কিন্তু তখনও ওদের চক্ষুলজ্জা ছিল। অনিমেষ বলল।

ক্ষমতা দীর্ঘদিন হাতে পেলে লজ্জা ভয় দূর হয়ে যায়।

মাধবীলতা বলল, এখন তো আমার আরও বেশি মনে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে এখানে থাকতে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, সেটা পরের কথা। এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা করা যায় কি না ভাবতে হবে।

মাধবীলতা বলল, ছোটমাকে শুধুনৃপেনবাবুর কথাই বলবে, সৌমেনবাবুর কাছে গিয়েছিলাম বলার দরকার নেই।

.

রাত্রের খাওয়ার পর শুতে এসে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এখন বলো তো, তখন বেরোবার সময় তুমি ওইভাবে হাসছিলে কেন? তুমি দেখছি ভোলোনি। অনিমেষ বিছানায় বসেছিল।

ওইরকম হাসি কখনও দেখিনি তো!

বললে তুমি রেগে যেতে পারো।

তাই! শোনাই যাক।

সাদা শাড়ি সাদা জামাও যে কখনও কখনও পুরুষের মন চঞ্চল করে দিতে সক্ষম তা তোমাকে দেখে তখন মনে হয়েছিল।

মাধবীলতা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, এ কী কথা শুনি মন্থরার মুখে! তোমার ওসব হয় নাকি?

ঠিক তখনই ওর মোবাইল জানান দিল। সেটা তুলে অন করে কিছু শুনে সে বলল আচ্ছা। ঠিক আছে। মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে মাধবীলতা বলল, অর্কর ফোন। ও এখন ট্রেনে। এখানে আসছে।

.

২০.

জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে নেমে পরে পড়ল অর্ক। ছেলেবেলায় যখন এসেছিল, এই স্টেশনেই নেমেছিল কিন্তু সেই স্মৃতি মুছে গিয়েছে। ট্রেনেই শুনেছিল, জলপাইগুড়িতে দুটো স্টেশন আছে। একটা শহরের বুকের মধ্যে আর এই রোড স্টেশনটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

নামতেই দেখল প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ছেলে, সঙ্গে সিপিএমের পতাকা। বোঝা গেল ওরা কোনও বড় নেতাকে রিসিভ করতে স্টেশনে এসেছে।

অর্ক ফঁপরে পড়ল, কারণ স্টেশনের বাইরে রিকশা ছাড়া আর কিছু নেই, যাতে উঠলে সে শহরে যেতে পারে। কোনও রিকশাওয়ালাই যাত্রী নিতে রাজি হচ্ছে না, বলছে, ভাড়া হয়ে গিয়েছে। বলছে, বাবু, পার্টির দাদারা বলে গেছে ওয়েট করতে যেতে পারব না।

স্টেশনে কোনও বাস আসে না, ট্যাক্সির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। একটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ধ্বনি দিতে দিতে বড় দুই নেতাকে নিয়ে বেরিয়ে এল পার্টির দাদারা। সঙ্গে আরও কয়েকজন যারা নেতাদের সঙ্গে এসেছে। দাদাদের গাড়িতে তুলে বাকিরা রিকশায় উঠে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলে অর্ক প্রশ্নটা শুনতে পেল, কোথায় যাবেন?

জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়া। কঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িমুখো প্রৌঢ়কে উত্তর দিল অর্ক। প্রৌঢ় হাসল, এখানে নতুন মনে হচ্ছে।

কী করে মনে হচ্ছে?

এখানে যাওয়া-আসা থাকলে বলতেন, হাকিমপাড়ায়। তার আগে জলপাইগুড়ি শব্দটা জুড়তেন না। যাক গে, আপনার সামনে দুটো রাস্তা আছে। এক, প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে থাকুন। ঘণ্টা চারেক বাদে একটা বড় ট্রেন আসবে এই স্টেশনে। তখন কিছু রিকশাওয়ালা পৌঁছে যাবে তোক নিয়ে। তার একটায় হাকিমপাড়ায় যেতে পারবেন। আর দ্বিতীয়টা খুব সহজ। পয়সা খরচ হবে না। সঙ্গে যখন কাঁধঝোলা ব্যাগ তখন সমস্যা নেই, হাঁটতে হাঁটতে চলে যান। মাইল আড়াই হাঁটতে হবে।

চার ঘণ্টা বসে থাকার চেয়ে আড়াই মাইল হেঁটে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে হল অর্কর। সে হেসে বলল, অনেক ধন্যবাদ, আমি হেঁটে যাব।

ধন্যবাদ দেওয়ার কোনও দরকার নেই। আমি হেঁটেই ফিরব। আপনার ইচ্ছে হলে সঙ্গে হাঁটতে পারেন।

প্রৌঢ়ের পোশাক বলে দিচ্ছে তার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। পরনে ময়লাটে ধুতি আর রং ওঠা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, এখন খুব কম বাঙালি পরে থাকেন। হাঁটা শুরু করে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এই স্টেশনে কি বেশি লোক যাওয়া-আসা করে না?

আগে খুব কম লোক এদিকে আসত। এখন কয়েকটা ভাল ট্রেন রোড স্টেশনে দাঁড়ায় বলে মানুষ আসছে। জলপাইগুড়ির লোক ট্যাক্সিতে চড়ে না, শহরের মধ্যে তো নয়ই। রিকশাই একমাত্র ভরসা। আপনি কোত্থেকে আসছেন? প্রৌঢ় তাকালেন।

কলকাতা থেকে। অর্ক জবাব দিল।

সে কী! আমি ভাবলাম শিলিগুড়ি থেকে আসছেন। কলকাতার কেউ আপনার মতো কাপড়ের কাঁধব্যাগ নিয়ে তো এখানে আসে না। প্রৌঢ় বললেন।

আমি সম্ভবত আজই ফিরে যাব। খুব বেশি হলে আগামীকাল।

মনে হচ্ছে আসাটা খুব জরুরি ছিল।

হ্যাঁ।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা একটা চওড়া পিচের রাস্তার সামনে পৌঁছোল। প্রৌঢ় বললেন, বাঁ দিকে গেলে তিস্তা ব্রিজ এবং তারপরে ডুয়ার্স, ডানদিকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা। সোজা জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে রায়কতপাড়া, মানে শহরে পৌঁছাবেন। আপনার ইতিহাসে আগ্রহ আছে?

অল্পস্বল্প।

দেবী চৌধুরানির নাম শুনেছেন?

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র।

হ্যাঁ, কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন। ডান পাশে একটু হাঁটলেই একটা কালীবাড়ি দেখতে পাবেন। দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ি। ওর চেহারা-চরিত্র অন্য যে-কোনও কালীবাড়ির থেকে আলাদা। সোজাই চলুন। প্রৌঢ় পা চালালেন।

আপনার নাম শুনতে পারি? হাসলেন প্রৌঢ়, কী নাম বলব? বাবা-মা যে নাম রেখেছিলেন সেই নাম বললে কেউ তো আর আমাকে চিনতে পারে না। সেই নামটা হল বলরাম দত্ত।

কী নামে সবাই আপনাকে চেনে?

রেডক্রশ দত্ত।

মানে? অর্ক হকচকিয়ে গেল।

ওই নামের যোগ্যতা আমার নেই। কেউ একজন শুরু করেছিল, সেটাই মুখে মুখে চাউর হয়ে চালু হয়ে গেছে। বলরাম দত্ত মাথা নাড়লেন।

এটা কী করে হল?

জুনিয়ার স্কুলে মাস্টারি করতাম। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। চাকরির শেষদিকে একদিন জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি বউ হাউহাউ করে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে নতুন দৃশ্য নয়। কেউ মারা গেলে মানুষ ওইভাবে কাঁদে। কিন্তু শুনলাম কান্নার কারণ অন্য। হাসপাতাল বলেছে পেশেন্টকে এখনই শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে, এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। অথচ পেশেন্টপার্টির কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই। মৃত্যু অনিবার্য বলে বউটি কাঁদছে তার স্বামীর জন্য। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কীরকম ঘোর লাগল মনে। আধঘণ্টার মধ্যে ধারধোর করে টাকা জোগাড় করে পেশেন্ট আর তার বউকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেলাম। যমে ডাক্তারের মধ্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যম হেরে গেল। হাসপাতালে পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। একটা ওষুধের দোকানের মালিক, যিনি আমার ছাত্রের বাবা, পাশে দাঁড়ালেন। ছেলেটি সুস্থ হল সাড়ে ছয় হাজার টাকার বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে। হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল। ওর বউয়ের কাছে আমি তখন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কী বলব ভাই, বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে আছি, সাড়ে ছয় হাজার আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কোনও বিকল্প জীবনে পাইনি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরা আপনাকে টাকাটা শোধ করেনি?

কী করে করবে? কোনওরকমে যাদের দিন চলে তাদের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গরিবদের অসুখ হলে চিকিৎসা করানো বিলাসিতা। কিন্তু আমি মুশকিলে পড়লাম। বলরামবাবু হাসলেন।

কীরকম?

লোলাকে এসে আমাকে অনুরোধ করতে লাগল। প্রত্যেকের কোনও আত্মীয়ের খুব অসুখ, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে না। এমনকী সেখানকার ইসিজি মেশিনও খারাপ। ডাক্তাররা পাঠাচ্ছে নার্সিংহোমে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। না না বললেও কেস খারাপ দেখলে রাজি হয়ে যেতাম। বলতাম, যা খরচ হবে তা আপনারা জোগাড় করে আনুন, চিকিৎসা যাতে ভালভাবে হয় সেটা আমি দেখব। তবু শেষ মুহূর্তে আটকে গেলে পকেট থেকে বের করতে হয়। তখন একজনের পরামর্শে শহরের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করলাম। দশজনের মধ্যে একজন সাহায্যের হাত বাড়ালেন। কিন্তু ততদিনে আমার নাম হয়ে গেছে রেডক্রশ দত্ত। বলরাম বললেন।

কিন্তু এসব করলে আপনার নিজের সংসার কী করে চলবে?

আমার সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করিনি, মা-ও চলে গিয়েছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, অথচ লোকবল নেই, জানাশোনা কম, তারা নিজেরাই খুশি হয়ে আমাকে কিছু দেন। আর ডাক্তাররা তো বটেই, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির হাসপাতালের স্টাফরাও আমাকে এখন সাহায্য করেন। ওঁরা সব জেনে গেছেন। বলরাম বললেন, এই তো, আলিপুরদুয়ার থেকে একজন এসেছিল তার মাকে নিয়ে, গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করিয়ে আজ ফিরে গেলেন। ওঁদের পৌঁছে দিতেই স্টেশনে এসেছিলাম।

আপনি কোন পাড়ায় থাকেন?

সেনপাড়ায়। আমার মনে হয় এখানে রিকশা পেয়ে যাবেন। ওই তো একটা আসছে। ডানদিকে জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। আর-একটু এগিয়ে বা দিকে চলে যাব। ভাল থাকবেন ভাই।

বলরামবাবু রিকশাওয়ালাকে বললেন হাকিমপাড়ায় যেতে। রিকশাওয়ালা বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কত ভাড়া দিতে হবে?

রিকশাওয়ালা হাসল, রেডক্রশদার লোক আপনি, বেশি ভাড়া কি নিতে পারি?

বিদায় নিয়ে রিকশায় ওঠার কিছুক্ষণ পরে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে?

কী বলছেন বাবু, চিনব না? আমাদের অসুখ হলে উনি ছাড়া আর কে আছেন এখানে?

রিকশা চলছে। হঠাৎ অর্কর মনে হল যেসব রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতারা দেশসেবার কথা বলেন, নিজের এবং দলের কর্মীদের স্বার্থ ঠিকঠাক রেখে মানুষের উপকার করতে বক্তৃতা দেন, তারা হয় বলরামবাবুদের দলে টানতে চাইবেন, নয় এড়িয়ে চলবেন। দারিদ্র্যসীমার নীচে যারা বাস করে তারা প্রয়োজনে ছুটে যাবে বলরামবাবুদের কাছে কিন্তু তাদের বিপদের সময় কজন পাশে দাঁড়াবে তাতে খুব সন্দেহ থাকছে।

ডানদিকের লম্বা বাড়িগুলো যে হাসপাতাল তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কেমন গুম হয়ে আছে চারধার।

একটা মজা খালের ওপর ছোট ব্রিজ। দেখলেই বোঝা যায় জল খুব নোংরা। নিশ্চয়ই নিয়মিত মশারা ডিম পাড়ে ওখানে। সেটা পার হয়ে এসে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, বাবু, হাকিমপাড়ার কোনখানে যাবেন?

তিস্তার চরের কাছে বাড়ি।

রিকশা দাঁড় করিয়ে লোকটা হাসল, হাকিমপাড়ার একটা দিক তো তিস্তার পাড়েই। কার বাড়ি বলুন তো?

অর্ক বুঝল বাবার নাম বললে কোনও কাজ হবে না। সে বলল, যাঁর বাড়ি তিনি নেই। মহীতোষ মিত্র।

রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে নামটা বললে তিনি বললেন, উনি তো বহুদিন হল দেহ রেখেছেন। তবে ওঁর বিধবা স্ত্রী এখনও আছেন বলে শুনেছি। তুমি বাঁ দিকের রাস্তা ধরো। বিপুল ব্যানার্জির বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা যখন বাঁ দিকে জেলা স্কুলের দিকে বাঁক নিচ্ছে তখনই দেখতে পাবে ডান দিকে একটা গলি আছে যেটা টাউন ক্লাবের দিকে গেছে। ওই গলিতে ঢোকার পর বাঁদিকের দ্বিতীয় বাড়ি।

রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘোরাল। অর্ক মাথা নাড়ল। বাবার কাছে শুনেছিল এই শহরে ঠাকুরদার বাবা সরিশেখর দীর্ঘকাল ছিলেন। তাঁকেই সবার চেনার কথা। তুলনায় ঠাকুরদা বেশিবছর থাকেননি। তবু ওই বৃদ্ধ চিনতে পারলেন। এঁরা বোধহয় অনিমেষ মিত্রকে চিনতেই পারবেন না।

একটা গাছপালায় ঘেরা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড়াল। অর্ক মনে করতে পারছিল না। তার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আছে একটা লোহার গেট যেটা খুলে ঢুকতে হয়। সে জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ি?

হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা বলল।

কত দিতে হবে তোমাকে?

কী বলব! পাঁচটা টাকা দিন।

২১-২৫. অর্ক এগোল

টাকাটা দিয়ে অর্ক এগোল। এদিকে কোনও গেট নেই। সোজা হেঁটে সে বাড়ির ভেতরের বাগানে পৌঁছে গেল। ডানদিকে উঁচু লম্বা বারান্দা। এবার যেন চেনা চেনা মনে হল। হঠাৎ কানে এল মহিলা কণ্ঠের চিৎকার, কে? কে ওখানে? না বলে-কয়ে ভেতরে চলে এসেছে। থতমত হয়ে অর্ক দেখল বেশ জীর্ণ একজন বৃদ্ধা বারান্দার প্রান্তে এসে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বললেন। সে দুপা এগিয়ে গিয়ে অনুমান করল ইনিই ছোট ঠাকুমা। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ওপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মাধবীলতা। অর্ককে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

কী আবার হবে! এদিকে তো গেট নেই, একটা কাঠের দরজা ছিল যেটা তিন বছর আগে চুরি হয়ে গিয়েছে। এতদিন রাতবিরেতে চোর আসত নারকোল চুরি করতে এখন দিনদুপুরে উটকো লোক ঢুকে পড়ছে। কথাগুলোতে ছোটমার যাবতীয় বিরক্তি ঝরে পড়ল, এত কথা বলছি, দেখো না, ঠুটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাধবীলতা কপট ধমক দিল, এই, এগিয়ে এসো।

অর্ক সামনে আসতেই আবার হুকুম হল, ওঁকে প্রণাম করো।

ছোটমা ছুটে হাত সামনে বাড়িয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন, না না, এসবের কোনও দরকার নেই, তুমি এখান থেকে বিদায় হও!

এবার মাধবীলতা হেসে ফেলল, এই, তুই নিজের পরিচয় দিতে পারছিস না?

সুযোগ পাচ্ছি না। তারপর ছোটমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি অর্ক, এইমাত্র কলকাতা থেকে এসেছি।

অ্যাঁ? ছোটমায়ের চোখ কপালে উঠল, তুমি অর্ক?

ততক্ষণে অর্ক প্রণাম সেরে নিয়েছে।

ছি ছি ছি। চিনতে না পেরে কী সব বললাম। আর চিনবই বা কী করে? কোনও সম্পর্ক তো রাখোনি! আমার কী দোষ! বাপ-মা আসতে পারেনি, ঠিক আছে, তুমি তো আসতে পারতে। সেই কত ছোট অবস্থায় দেখেছিলাম! হঠাৎ গলা ভিজে গেল ছোটমার।

বাবা কোথায়? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খাটে শুয়ে বই পড়ছে। তার বাবার পছন্দের বই। মাধবীলতা হাসল।

ছোটমা বললেন, যাও, ভেতরে গিয়ে ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। ট্রেনের কাপড় পরে ঘরে থাকতে নেই। তুমি ওকে কিছু খেতে দাও।

মাধবীলতার পাশাপাশি যেতে যেতে অর্ক নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, খুব পিটপিটে, না?

চুপ! চাপা ধমক দিল মাধবীলতা, একদম না!

ঘরে ঢুকে অর্ক বলল, আমার সবকিছু ঝাপসা মনে পড়ছে।

অনিমেষ শুয়ে ছিল, উঠে বসল যাক, আসতে পারলি শেষ পর্যন্ত।

একটা চেয়ারে বসে অর্ক বলল, মা যা তাগাদা দিচ্ছিল তাতে না আসাটা–। যাক গে, কী ব্যাপার বলো তো?

মাধবীলতা বলল, এখনই সব জানতে হবে? চল, তোকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি, হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নে। ধীরে সুস্থে কথা হবে।

অর্ক তাকাল, মনে হচ্ছে বেশ গুরুতর ব্যাপার?

অনিমেষ বলল, আজ রাত্রে তোকে আমার সঙ্গে উকিলের বাড়িতে যেতে হবে।

রাত্রে? অসম্ভব! আমি তো সন্ধের ট্রেন ধরে ফিরে যাব। অর্ক গলা তুলে বলল।

অনিমেষ অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাল, তুই আজই চলে যাবি? তা হলে এলি কেন?

বাঃ। মা বলেছিল সকালে এসে কী সব কাজ আছে তা করে বিকেলে ফিরে যাস। কী মা, তুমি এ কথা বলোনি?

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এ কথাও বলেছিলাম যে কবে আসতে হবে তা তোকে জানিয়ে দেব। আজ সেই দিন নয়।

কাজটা কী? অর্ক জানতে চাইল।

এসব কথা পরে ধীরে সুস্থে আলোচনা করলে ভাল হয় না? মাধবীলতা বলল, আগে হাত মুখ ধুয়ে নিবি চল। আমি চা খাবার করি।

অর্ক মাথা নাড়ল, এখন কিছু খাব না।

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, কেন?

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পুরি তরকারি আর চা খেয়ে নিয়েছি। অর্ক বলল, খুলে বলো তো, কাজটা কী?

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ বলল, যা বলার তুমিই বলো। আমার এখন কথা বলতে ভাল লাগছে না।

মাধবীলতা বলল, তোর ছোট ঠাকুমাকে তো দেখলি! এত বড় বাড়িতে ওঁর পক্ষে আর একা থাকা সম্ভব নয়। এই বাড়ি বিক্রি করতে হবে। বিক্রির সময় এই বাড়ির আইনসম্মত মালিক চাই। উনি নিজে সেটা হতে চাইছেন না। উনি চাইছেন তোর নামে মালিকানা লিখে দিতে।

গম্ভীর হয়ে শুনছিল অর্ক। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমি কেন? বাবা তো রয়েছে। বাবার নামে লিখে দিতে বলো।

অনিমেষ আবার শুয়ে পড়ল। সেদিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে মাধবীলতা বলল, তোর ঠাকুরদার তেমন ইচ্ছে ছিল না।

কথাটা তোমরা জানলে কী করে?

তোর ছোট ঠাকুমা বলেছেন।

মাথা নাড়ল অর্ক, তোমরা আমাকে এসবের সঙ্গে জড়িয়ো না।

তার মানে? মাধবীলতা অবাক হল।

ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? ছোট ঠাকুমা আমাকে মালিকানা দিচ্ছেন যাতে এই বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারি। আমার কোনও মতামত থাকছে না মালিক হওয়া সত্ত্বেও। নিজেকে পুতুল ভাবতে আমি আর রাজি নই মা। অর্ক বলল।

পুতুল? কী বলছিস তুই? মাধবীলতার শরীরে কাঁপুনি এল।

নয়তো কী? আমি মালিক হব আর তোমরা আমাকে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করাবে। আমার অন্য প্ল্যান থাকলেও করতে পারব না। অর্ক বলল।

কী প্ল্যান? অনিমেষ আবার উঠে বসল।

এই তো শুনলাম। ভাবার সময় পেলে ভেবে বলব।

বেশ। তোমার ছোটঠাকুমার কথা ভেবে আমাদের জানাও।

তুই কী ভাবছিস বাড়ি বিক্রির টাকা আমরা ভোগ করব? হঠাৎ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল মাধবীলতা।

আমি কিছুই ভাবিনি। বললাম তো ভাবার সুযোগ পাইনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

অনিমেষ ছেলেকে বোঝাতে চাইল, ওই টাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হবে ছোটমাকে। বাকি টাকা ওঁর নামেই ব্যাঙ্কে রাখা হবে যার সুদে ওঁর দিব্যি চলে যাবে। বুঝতে পেরেছিস?

তা হলে একটা সহজ ব্যাপারকে তোমরা জটিল করছ কেন? অর্ক তাকাল।

জটিল করছি? উত্তপ্ত হল অনিমেষ।

ঠাকুরদার বাড়ি ছোট ঠাকুমা পেয়েছেন। তিনি মালিক হিসেবে বিক্রি করে দিলে তোমরা পাশে দাঁড়িয়ে যা যা করতে চাও করে দিতে পারো। তা না করে আমাকে শিখণ্ডীর মতো দাঁড় করাচ্ছ কেন? অর্ক কথাগুলো বলতেই মাধবীলতা চিৎকার করল, অর্ক! তার গলার শিরা ফুলে উঠেছিল। মাথা ঘুরে যেতেই সে বিছানার ওপর টলতে টলতে বসে পড়ল। অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, লতা!

অর্ক দৌড়ে এল মায়ের কাছে, শুয়ে পড়ো, তুমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছ। মাধবীলতাকে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল মাধবীলতা। মুখ রক্তশূন্য।

অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল, এই পাড়ায় ডাক্তার পাওয়া যাবে?

অনিমেষ জবাব না দিয়ে ক্রাচে ভর করে নীচে নামল। ততক্ষণে শ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, মাধবীলতা হাত নেড়ে নিষেধ করল।

অনিমেষ বলল, লতা, তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি, একবার দেখানো দরকার।

মাধবীলতা এবার উঠে বসল, না। দরকার নেই। আমি এখন ঠিক আছি। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যা, হাত মুখ ধুয়ে নে। তুমি ওকে বাথরুমটা দেখিয়ে দাও।

অর্ক বলল, না না, আমিই দেখে নিচ্ছি।

অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মাধবীলতার পাশে বসল অনিমেষ, সত্যি বলো তো, এখন কোনও কষ্ট নেই তো?

অনিমেষের গলার স্বরে চোখ তুলল মাধবীলতা, তারপর তার ঠোঁটে হাসি ফুটল, অনেকটা ভাল লাগছে। তখন চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল।

প্লিজ, এত উত্তেজিত হোয়ো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব বলো তো? ভাবলেই পৃথিবীটা কীরকম ফাঁকা হয়ে যায়। অনিমেষ গাঢ় স্বরে বলল।

একটা লাভ হল। মাধবীলতা বলল।

লাভ? মানে?

ওরকম না হলে তোমার এই কথাগুলো শুনতে পেতাম না। আজকাল আমরা কথা বললে শুধু কাজের কথাই বলি। তাই না? মাধবীলতা বলল, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অর্কর কিছু একটা হয়েছে। যে ছেলে এতগুলো বছর মুখ বুজে থাকত সে আজ কী কথা শোনাল!

অনিমেষ বলল, ছেড়ে দাও। আমার মনে হয় ওকে আজ বাড়ির ব্যাপারে আর কথা বলার দরকার নেই।

.

দুপুরের খাওয়া সেরে অর্ক গিয়েছিল তার ছোটঠাকুমার ঘরে। মাধবীলতা এখন অনেকটাই সুস্থ। ওদের পাশের ঘরটি অর্ককে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির প্রসঙ্গ আর তোলেনি কেউ। অনিমেষ শুয়ে ছিল, তার হাতে বই। একটু দূরে খাটের ওপর মাধবীলতা বসে কাগজ পড়ছিল। এ বাড়িতে এসে খবরের কাগজ পড়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ছোটমার অভ্যেস না থাকায় কাগজ আসে না। সকালে নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশন থেকে কাগজটা কিনেছিল অর্ক। পড়ে ব্যাগে রেখেছিল। ছোটঠাকুমার ঘরে যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রেখে গিয়েছিল।

কাগজে চোখ রেখে মাধবীলতা বলল, ডেবরা, গোপীবল্লভপুর তো মেদিনীপুর জেলায়, কখনও গিয়েছ?

না বইয়ে চোখ রেখে অনিমেষ বলল।

নন্দীগ্রামে?

হেসে ফেলল অনিমেষ, গেলে তো তোমাকে নিয়ে যেতাম।

উঁহু। যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলে তখন কোথায় কোথায় গিয়েছ তা কি আমি জানি? তখন আমাকে নিয়ে যাবে কী করে? মাধবীলতা বলল।

ও। নন্দীগ্রামের কথা জিজ্ঞাসা করলে কেন?

এই যে, কাগজের প্রথম পাতায় নাম বেরিয়েছে। সেখানকার কৃষকরা সরকারকে জমি দখল করতে দেবে না। উত্তেজনা দানা বাঁধছে। মাধবীলতা বলল।

বামফ্রন্ট যদি জোর করে জমি দখল করতে চায় তা হলে ওরা এতদিনে নিজের কবরের জন্যে গর্ত খোঁড়া শুরু করেছে। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা কাগজ ভাঁজ করল, আমার তো মনে হয় না আগামী কয়েকটা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে গদিচ্যুত করা যাবে। এত মেজরিটি, এত মানুষ বছরের পর বছর ওদের ভোট দিয়ে যাচ্ছে, যতই অত্যাচার করুক, রাতারাতি ওদের সরানো সম্ভব না।

অনিমেষ বলল, কী ব্যাপার? তুমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছ! হঠাৎ কী হল?

কলকাতার বাড়িতে কাগজ এলে চোখ বুলিয়ে রেখে দিতাম। একই খবর প্রত্যেক দিন। মনে হত দুদিন আগের কাগজ আজ আবার ছাপা হয়েছে। এখানে কয়েকদিন কাগজ না পড়ে কিছুই মিস করিনি। আজ হঠাৎ হাতে পেয়ে মনে হল ভাল করে পড়ি। পড়তেই ভাবনাটা চলে এল। মাধবীলতা বলল। অর্ক ফিরে এল। এসে চেয়ারে বসল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বললাম।

ওরা তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

আমি বললাম, আপনি বাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইছেন আর একা থাকতে পারছেন না বলে। ঠিক আছে। যদি একা না থাকেন তা হলে কি বাড়িটা বিক্রি করবেন? উনি প্রথমে বুঝতে পারেননি, আমি বুঝিয়ে বললে জানতে চাইলেন সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বললাম, যদি এই বাড়িতে বৃদ্ধাদের জন্যে একটা আশ্রম খোলা যায় তা হলে তো আর আপনাকে একা থাকতে হচ্ছে না। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকায় কথাটা ওঁর মনঃপূত হল বলে মনে হচ্ছে না। তোমরা কি এ ব্যাপারে কথা বলবে?

এই বাড়িতে বৃদ্ধাশ্রম? অনিমেষের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ। শুধু বৃদ্ধাদের জন্যে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা বলল, খুব ভাল প্রস্তাব। এতে তোর পূর্বপুরুষের তৈরি বাড়িটা থেকে যাবে। কিন্তু তোকে যে দায়িত্ব নিতে হবে।

মানে? অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

দেখ, এই বাড়িতে যত ঘর আছে তার দুটো বাদ দিলে অন্তত পনেরো জন বৃদ্ধাকে জায়গা দেওয়া যাবে। তারপর তাদের চারবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিকঠাক করতে হবে। বয়স্কা মানুষরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। এসব তো ছোটমা করতে পারবেন না। তোকেই দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। এতে মানুষের উপকার করাও হবে। শান্তিও পাবি। মাধবীলতা বলল।

এসব তো তোমরা করতে পারবে। তুমি রিটায়ার করেছ, কলকাতায় তোমাদের করার কিছুই নেই। এখানে এসব কাজের মধ্যে ইনভলভড় হয়ে থাকলে সময় ভালভাবে কেটে যাবে। অর্ক বলল।

খুব ভাল বলেছিস। আমরা এটা নিয়ে ভাবব। মাধবীলতা বলল।

আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আজই আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম বলরাম, কিন্তু রেডক্রশ বললে শহরের সবাই চিনতে পারে। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে না। অর্ক বলল।

বাঃ। খুব ভাল হল। তোর ট্রেন কখন?

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে জেনেছি এখানকার সন্ধেবেলার লোকাল ট্রেন ধরলেই হবে। ওখানে ট্রেন পেয়ে যাব।

তা হলে যা, একটু ঘুমিয়ে নে।

আমাকে আর উকিলের বাড়িতে যেতে হচ্ছে না তো? অর্ক হাসল।

আর কী দরকার। তুই যে পরামর্শ দিলি– ।

হ্যাঁ। এসব কথা অবশ্য টেলিফোনেও বলা যেত কিন্তু তুমি বুঝতে চাইতে না। এসে লাভ হল, ছোটঠাকুমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। অর্ক উঠে দাঁড়াল।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার উঠে বসল, আর একটু বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।

আবার বসল অর্ক, বলো।

তোর সঙ্গে হাজারিবাগের লোকটির আলাপ হল কী করে?

অর্ক আচমকা প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়ল, ঠিক সরাসরি আলাপ আগে হয়নি। আমার পরিচিত একজনের মাধ্যমে ফোনে কথা হয়েছিল। মাস তিনেক আমরা কথা বলেছি।

তাতেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল? এমন বন্ধুত্ব যে লোকটাকে তুই বাড়িতে থাকতে দিলি? যার মাধ্যমে আলাপ হল তার ওখানে উঠল না কেন?

ওর বাড়িতে জায়গা নেই। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল।

ও। মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমরা যদি জলপাইগুড়িতে না আসতাম তা হলে ওকে কোথায় রাখতিস তোরা? বাড়িতে নিয়ে আসতিস?

আচ্ছা, একটা মানুষ আমাদের বাড়িতে কদিন আছে, এতে তোমার এত অসুবিধে হচ্ছে কেন তা আমি বুঝতে পারছি না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

পরিচিত কেউ থাকলে অসুবিধে হত না। বাঙালি?

না।

পুরুষ না মহিলা?

আশ্চর্য! ও যদি মহিলা হয় তাতে কী এসে যায়?

এবার মাধবীলতা কথা বলল, আমরা আলাদা আমাদের মতো থাকি ঠিকই কিন্তু সেটা বস্তির এলাকার মধ্যে। যখন ফিরে যাব তখন লোকে জিজ্ঞাসা করবে, তার তো জবাবটা দিতে হবে।

অর্ক হাসল, মা, তুমিই তো বলতে অতি উচ্চবিত্ত আর বিত্তহীন মানুষরা মধ্যবিত্তদের মতো সংকীর্ণ হয় না। তা হলে জবাব দিতে হবে কেন? যাক গে, ও পুরুষ। ঝাড়খণ্ডের মানুষ। পাটনা থেকে বি এ পাশ করেছিল। তোমরা যখন কলকাতায় নেই তখন ফাঁকা বাড়িতে ও থাকলে কী অসুবিধে তোমাদের?

অনিমেষ অবাক হল, আমরা যদি ছমাস এখানে থাকি তা হলে সে অতদিন তোর সঙ্গে থাকবে! কী করছে সে কলকাতায়?

ওর কাজকর্ম আছে। নানান মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

অর্ক উঠে দাঁড়াল, তা হলে আমি আজ চলে যেতে পারি?

অনিমেষ বা মাধবীলতা কোনও কথা বলল না। ঠিক তখনই বাইরে থেকে উত্তেজিত কয়েকটি কণ্ঠ ভেসে এল।

মাধবীলতা বলল, কারা এইভাবে চেঁচাচ্ছে?

অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে নীচে নামল, দেখছি।

কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে ভাড়াটেদের ঘরের সামনে থেকে। অনিমেষ সেদিকে এগিয়ে গেল। মাঝখানের দরজা খুলে ওপাশে যেতেই দেখল নিবারণবাবু হাতজোড় করে বলছেন, ভাই, তোমাদের অনুরোধ করছি আমাদের বিপদে ফেলো না।

সঙ্গে সঙ্গে সামনে দাঁড়ানো তিনটে ছেলের একজন চেঁচিয়ে বলল, বিপদ? আমরা আপনাকে বিপদে ফেলছি? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন, আপনাকে আমরা সাহায্য করছি। কোনও শালা আপনাদের এই বাড়ি থেকে তুলতে পারবে না। আপনার যতদিন ইচ্ছে এই বাড়িতে থাকবেন। ঠিক আছে?

দ্বিতীয় ছেলেটি চেঁচাল, আর যা বললাম, প্রত্যেক মাসের দুতারিখে ক্লাবে গিয়ে বাড়ির ভাড়া দিয়ে আসবেন। আর কাউকে ভাড়ার টাকা দেবেন না।

এইসময় নিবারণবাবুর চোখ পড়ল অনিমেষের ওপর। কাতর গলায় তিনি বললেন, এই দেখুন, এরা কী বলছে। হঠাৎ এদের কী হল?

কাকে বলছেন? কী করবে ওই ল্যাংড়া? যা বললাম তা মনে রাখবেন। না রাখলে আপনাকে উঠিয়ে অন্য ভাড়াটে বসাব আমরা। তৃতীয় জন বলল।

পেছন থেকে অর্কর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, এরা কারা?

.

২২.

অনিমেষ দেখল ছেলেগুলো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অর্ক কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল।

অনিমেষ বলল, ওরা এখানকার একটা ক্লাবের মেম্বার। ইনি নিবারণবাবু, ছোটমা এঁকেই বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন।

অর্ক নিবারণবাবুকে দেখল, বেশ অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তা হলে ওঁর কাছে এঁরা ভাড়া চাইছেন কেন?

নিবারণবাবু কাছে এলেন। অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে?

আমার ছেলে। অর্ক। একটু আগে কলকাতা থেকে এসেছে। অনিমেষ বলল।

অ। কী বিপদ বলুন তো। এখন আমি কী করি?

ওরা কি আপনাকে শাসাচ্ছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

শাসাচ্ছে? বুকে বসে দাড়ি উপড়ে নেবে বলছে। নিবারণবাবু বললেন।

আপনি এসব কথা শুনছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

কী করব তা হলে? জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করব?

শোনামাত্র অর্ক এগিয়ে গেল বাড়ির গেটের দিকে। ছেলেগুলো যেন অবাক হল। গেটের এপাশে দাঁড়িয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ভাই, আপনাদের সমস্যা কী?

আমাদের যে সমস্যা আছে এই খবর আপনাকে কে দিল?

তা হলে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝামেলা করছেন কেন?

তার আগে বলুন আপনি কে? এর মধ্যে নাক গলাচ্ছেন কেন?

নাক গলাতে আমি বাধ্য। উনি আমার ঠাকুমার ভাড়াটে।

ওই হ্যাঁন্ডিক্যাপড ভদ্রলোক আপনার বাবা?

এইভাবে কথা বলছেন, উনি কে তা জানেন?

যে তর্ক করছিল তাকে দ্বিতীয়জন থামাল, এই চেপে যা। কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলা উচিত নয়, জানিস তো।

তৃতীয়জন বলল, জানি জানি। সিপিএম থেকে ডিগবাজি খেয়ে উনি নকশাল হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু উনি কবে সিপিএমের ঘি খেয়েছিলেন, এখনও গন্ধ লেগে থাকতে পারে তাই ওঁকে কিছু বলিনি আমরা।

বলার কী ছিল সেটাই জানতে চাইছি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আপনি কোন পার্টি করেন? প্রথমজন জানতে চাইল।

আমি এখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই।

কেন? দ্বিতীয়জন হাসল।

কারণ পশ্চিমবঙ্গের–। বলে থেমে গেল অর্ক, হাত নাড়ল, থাক ওসব। কেন এসেছিলেন আপনারা?

দ্বিতীয়জন বলল, ওই ভদ্রলোককে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আমরা। বাবা জ্যাঠাদের সময়ে পাড়ায় ছিলেন, এখনকার হালচাল জানেন না, পাখির মতো বেড়াতে এসেছেন বলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তার ওপর একসময় তো সিপিএম করতেন সেটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। ভাড়াটে থাকলে বাড়ির দাম উঠবে না তাই ওকে ওঠাবার বিনিময়ে একটু খাওয়াদাওয়া করতে চেয়েছিলাম। উনি সোজা চলে গেলেন জেলা সম্পাদকের কাছে, নালিশ করলেন আমাদের বিরুদ্ধে। ভাবলেন তিনি ধমক দিলেই আমরা ভয়ে গর্তে ঢুকে যাব! উনি জানেন না রাজ্য কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার ঝামেলার মধ্যে পার্টি নাক গলাবে না। লোকাল পার্টির কাছে গেলে যদি তারা নাক গলাত তা হলে জেলাসম্পাদকের ধমক খেয়ে সরে যেত। কিন্তু আমরা তো একটা আলাদা ক্লাব। এই ক্লাবের সঙ্গে পার্টির ডিরেক্ট কোনও সম্পর্ক নেই। এই কথাটা ওঁর মাথায় আসেনি, তাই কমপ্লেন করে আমাদের বদনাম করলেন। এখন আমরা ভাড়াটের পক্ষে, যদি তিনি আমাদের কথা শুনে চলেন।

ছেলেগুলো চলে গেলে অর্ক ফিরে এসে বলল, কী অবস্থা!

নিবারণবাবু বিড়বিড় করলেন, এদের হারিয়ে যদি অন্য দল পাওয়ারে আসতে পারত। কিন্তু কাদের ভোট দেবে মানুষ? কংগ্রেস তো মেরুদণ্ডহীন। বিজেপি এখানে কখনওই হালে পানি পায়নি। রইল বাকি তৃণমূল। নতুন দল। তার ওপর ওই একজন মহিলার মুখ চেয়ে কতটা ভরসা পাওয়া যায়? বাকিরা সব– ।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও সঙ্গে কথা বলছেন?

নিবারণবাবুর যেন সংবিৎ ফিরল, আঁ! না, মানে, কী করি বলুন তো?

অনিমেষ বলল, একমাত্র উপায় বাড়িটাকে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে আপনাকে মুক্তি দেওয়া। আপনি যা চেয়েছেন তাই পাবেন।

নিবারণবাবু এগিয়ে এসে হাত ধরলেন, তা হলে তাড়াতাড়ি করুন। নেক্সট ভাড়াটা যেন ওদের দিতে না হয়।

ঘরে ফিরে এসে অর্ক বলল, এখানে তো সাংঘাতিক অবস্থা। এরকম ব্যাপার কলকাতাতে কখনও হয়নি।

হয়নি। হবে। অনিমেষ বলল।

কিন্তু মানুষের তো সহ্যশক্তির সীমা আছে। যখন সেটা ছাড়িয়ে যাবে তখন এই বামফ্রন্ট সরকারকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্ক বলল।

মাধবীলতা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। সম্ভবত, আড়ালে থাকলেও তার কানে সব কথা পৌঁছেছে। এবার মুখ খুলল, মানুষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। যা যা করলে ব্যক্তিগত লাভ হয় সেটা শিখতে একটুও দেরি করে না।

মানে বুঝলাম না। অর্ক বলল।

নকশাল আন্দোলনের সময় একটা ছেলে বোমা হাতে নিয়ে পাড়া কপাত। লোকে জানলা দরজা বন্ধ করে ভয়ে বসে থাকত। বস্তির বাচ্চাগুলো

অবাক হয়ে সেই ছেলেকে হিরো বলে ভেবে নিত। তারপর নকশালরা যখন হারিয়ে গেল, যুব কংগ্রেসিরা এল, তখন ওই বাচ্চাগুলো সামান্য বড় হয়ে বোমা ছোঁড়াছুড়ি আরম্ভ করল হিরো হওয়ার জন্যে। তারপর যখন বামফ্রন্ট এল তখন তাদের হার্মাদবাহিনী সেই শিক্ষাকে আরও ধারালো করে নিল। মাধবীলতা হাসল, আমার মনে হয়, বামফ্রন্টকে সরিয়ে যদি কোনও দল ক্ষমতায় আসে তাদের নিচুতলায় এই ধারা আরও বেশি ক্ষমতা দেখাতে গজিয়ে উঠবে। এ বড় সংক্রামক রোগ।

অনিমেষ কাঁধ নাচাল, কবে কী হবে তা নিয়ে এখন ভেবে কী লাভ। তুই তা হলে আজই চলে যাচ্ছিস। তফাত কী জানিস, আমার বাবা-মা তাঁদের প্রয়োজনে ডাকলে আমি সকালে এসেই বিকেলে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না।

অর্ক হাসল, মানতে পারছি না।

তার মানে? অনিমেষ অবাক।

তুমি তোমার দাদু-পিসিমা-বাবা-ছোটমায়ের কথা ভুলে গিয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলে। কখন কোথায় আছ তা জানাবার প্রয়োজন মনে করোনি। এমনকী মাকেও অন্ধকারে রেখেছিলে। অর্ক হাসল।

এসব কথা তোকে কে বলেছে? যারা তোমাকে জানে তাদের কাছে শুনেছি। তাই বলে ভেবে নিয়ো না, মা এসব বলেছে। আজ পর্যন্ত মা তোমার বিরুদ্ধে একটা শব্দও আমাকে বলেনি।

অর্ক বলামাত্র মাধবীলতা বলল, অনেক হয়েছে। এবার তোমরা থামো।

মোবাইলে রিং শুরু হল। মাধবীলতা সেটা অন করতেই কানে এল, স্বপ্নেন্দু দত্ত বলছি। অনিমেষবাবু আছেন?

মাধবীলতা বলল, একটু ধরুন।

মোবাইল ফোন অনিমেষের হাতে দিয়ে বলল সে, স্বপ্নেন্দু দত্ত।

অনিমেষ যন্ত্রটাকে কানে চেপে বলল, হ্যাঁ। বলুন।

অনিমেষবাবু?

হ্যাঁ।

আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন?

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

আপনি বলেছিলেন পার্টির সঙ্গে আপনার কথা হয়ে গেছে। পশ্চিম বাংলার অন্য কোথায় কী হচ্ছে জানি না, এই শহরে পার্টির সঙ্গে কথা না বলে কাজ করা অসম্ভব। আপনার কথায় বিশ্বাস করে আমি অ্যাডভান্স দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি যদি আমাকে সত্যি কথা বলতেন তা হলে আমিই ওদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিতাম। বেশ জোর গলায় কথাগুলো বললেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

আপনি এসব কেন বলছেন আমাকে?

আজ একটু আগে আপনার পাড়ার ছেলেরা এসেছিল আমার কাছে। তারা কীভাবে জেনেছে তা জানি না। বলছে, বাড়ি কিনতে হলে ওদের ক্লাব ফান্ডে পাঁচ লাখ ক্যাশ দিতে হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।

তারপর? অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল।

ওরা বলল, আপনি নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গিয়েছিলেন। এখন দুটো রাস্তা আছে। এক, আপনি অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দিন। আমি বাড়িটা কিনব না। দুই, আপনার অংশ থেকে পাঁচ লাখ ওদের দিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের

সেটা মেনে নিতে হবে।

ওদের কেন দিচ্ছেন? ওরা তো কোনও রাজনৈতিক দল নয়।

ওরা রাজনৈতিক দলের অস্ত্র যার সাহায্য ছাড়া পার্টি ভোটে জিততে পারবে না। যদি সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, সিপিএম হেরে যায়, তা হলে জানবেন এই অস্ত্র তাদের হারিয়ে যেদিকে হাওয়া বইছে সেদিকে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু হাসলেন, এবার বলুন দুটোর মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ?

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। অনিমেষ বলল।

ও হ্যাঁ, আপনাদের কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে তো?

হয়ে যাবে।

দেখুন, বেশি দেরি করবেন না। আমি চাই না ওদের দাবি পাঁচ থেকে দশ লাখে উঠুক। পরে ফোন করব। লাইন কেটে দিলেন স্বপ্নেন্দু দত্ত।

মাধবীলতা তাকিয়ে ছিল। টেলিফোনে কথা বলার সময় অনিমেষ লক্ষ করছিল অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

মাধবীলতা বলল, কোনও সমস্যা হয়েছে।

স্বপ্নেন্দুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ। মাধবীলতার চোখ কপালে উঠল, কী সর্বনাশ!

একটু আগে ওই ছেলেগুলো আমাকে হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলে গেল। ক্রাচ ছাড়া যখন চলতে পারি না তখন তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু আমি নই, আমার মতো যারা সাধারণ জীবনযাপন করে তাদের সবাই হ্যাঁন্ডিক্যাপড। বিষণ্ণ গলায় বলল অনিমেষ।

সব দিক দিয়েই তো এক অবস্থা। মাধবীলতা বলল, এই যে অর্ক তার নিজের মতন চলছে, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা তো হ্যাঁন্ডিক্যাপড বলেই।

ওকে যেতে দাও। মিস্টার রায়কে বলব আর কারও নামে প্রপার্টি ট্রান্সফার করার দরকার নেই। অনিমেষ বলল।

ছোটমা অর্কর মুখে খবরটা শুনে অবাক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, মাধবীলতা, ও মাধবীলতা, এদিকে এসো।

অর্ক বলল, আরে! মাকে ডাকছ কেন?

মাধবীলতা বেরিয়ে এল, বলুন।

তোমার ছেলে সকালে এসে বিকেলে চলে যাচ্ছে কেন?

ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।

অর্ক বলল, প্রথমত, এখানে আমার করণীয় কিছু নেই। উলটে কলকাতায় প্রচুর কাজ পড়ে আছে।

তোমার বাবা-ঠাকুরদা-বড়দাদুর এই বাড়ির জন্য কোনও টান নেই?

দেখো, এখানে তো আমি একবারই ছিলাম। তখন বয়স খুব কম ছিল আর সেটা কয়েকদিনের জন্যে। কিন্তু বাবা তো পুরো স্কুলজীবন এই বাড়িতে থেকেছে। তারপর কি টান অনুভব করেছিল? কোনও কাজ ছাড়াই কলকাতায় থেকে গেছে। এই যে এখানে এবার এসেছে, তুমি একা আছ তাই। বলতে পারত এখানেই থেকে যাবে। অনেক ভাল থাকত তা হলে। তা না করে বাড়িটাই বিক্রি করে দিতে চাইছে। তার মানে ওরও কোনও টান নেই। অর্ক বলল।

মাধবীলতা কথা বলতে যাচ্ছিল হাত তুলে তাকে থামতে বলল ছোটমা, বুঝেছি বাবা। এটা বোঝার জন্য হয়তো এতদিন বেঁচে আছি।

অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কথা শুনছিল। এবার ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোর কী হয়েছে বল তো?

মানে? পেছন ফিরল অর্ক।

এতগুলো বছর ধরে একসঙ্গে থেকে আমরা তোর মুখে প্রয়োজনের বাইরে কোনও কথা শুনিনি। তোর মা বলত, তুই নাকি নিজের মধ্যে থাকিস। এখানে এসে যেসব কথা বলছিস তা–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিল অর্ক, অস্বীকার করতে পারো? একটাও মিথ্যে বলেছি?

মাধবীলতা বলল, না। বলিসনি।

তোমাদের ভাবনাচিন্তাগুলো যে পুরনো হয়ে গিয়েছে সেটা কেউ বোঝে না। এই যে এখানে সিপিএমের দাদাগিরি দেখছ, দেখে কী করছ? গুমরে মরছ। কেউ ভেবেছে এর প্রতিবাদ করা উচিত? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি তোর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাই না।

বলার কিছু থাকলে তো বলবে। তুমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে, তা সিপিএম হোক বা নকশাল হোক, তার সঙ্গে এদেশের মাটির কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু ধার করা শব্দ উচ্চারণ করে ভেবেছ দেশে কমিউনিজম এনেছ, আর তোমাদের নীচের কর্মীরা সেই সুযোগে লুটেপুটে খাচ্ছে। আজ তাদের হাত তোমাদের ওপর পড়লে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছ। এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তোমরাই তৈরি করেছ। অর্ক বলল।

তুই এসব কথা বলছিস কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই তথাকথিত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিপ্লব আসতে বাধ্য। তার বেশি দেরি নেই। অর্ক বড় বড় পা ফেলে বাগানে নেমে গেল।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ও হঠাৎ খেপে গেল কেন? প্রসঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও এসব কথা বলছে কেন?

আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

ঠিক বলেছ। ওই লোকটার সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে।

বিশেষ কোনও রাজনীতি করা লোক নয় তো? মাধবীলতা নিজের সঙ্গে কথা বলছিল, আমার ভয় করছে।

যা শুনলে তার পরেও ওর জন্য ভয় পাচ্ছ? অনিমেষ হাসল।

.

হঠাৎ দৌড়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অর্ক, একটা লাঠি দাও তো, তাড়াতাড়ি। সে বেশ উত্তেজিত।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

একটা সাপ, বেশ বড়–।

উঠে এসো। উঠে এসো বলছি। ছোটমার গলা ওপরে উঠল।

মানে? সাপটা–।

ওটা আমার বাগানে আছে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। উঠে এসো। ছোটমা মাধবীলতার দিকে তাকাল, আমি ঠাকুরঘরে যাচ্ছি।

.

২৩.

লছমনের রিকশা পাওয়া গিয়েছিল। মাধবীলতা এবং অনিমেষ রোদ মরতেই মিস্টার রায়ের বাড়িতে চলে এল। অর্ক তখন তার ঘরে পা গুটিয়ে শুয়ে ছিল। মাধবীলতা বলল, শোন, আমরা বেরোচ্ছি।

ও। আমিও একটু পরে বের হব। শোওয়া অবস্থাতেই বলছিল অর্ক।

তা হলে চলেই যাচ্ছিস!

হ্যাঁ। মিছিমিছি দৌড় করালে। এই বাড়িতে একটা সাপের গুরুত্বও আমার চেয়ে বেশি। ঠিক আছে, কলকাতায় ফেরার আগে ফোন করবে। অর্ক বলল।

কেন? ফোন না করে গেলে তোর কী অসুবিধে হবে? মাধবীলতা শক্ত হল।

হাসল অর্ক, আমার নয়, তোমাদের অসুবিধে হবে। দরজায় তালা দেখলে বাইরে বসে থাকতে হবে আমি না ফেরা পর্যন্ত।

আসছি। মাধবীলতা আর দাঁড়ায়নি।

অনিমেষ ততক্ষণে বাড়ির সামনে রিকশায় উঠে বসেছে লছমনের সাহায্যে। মাধবীলতা উঠলে রিকশার প্যাডেল ঘোরাল লছমন।

আজ ছুটির দিন তাই মিস্টার রায়কে বাড়িতেই পাওয়া গেল। কাজের লোক চেম্বারের দরজা খুলে ওদের বসতে বলার পাঁচ মিনিট পরে এলেন ভদ্রলোক, কী ব্যাপার? হঠাৎ! ছুটির বিকেলে আমি চেম্বার করি না, কিন্তু আপনারা এসেছেন বলে টেবিলের ওপাশের যে চেয়ারে উনি বসেন সেটায় না বসে আর-একটা চেয়ার টেনে নিলেন ভদ্রলোক।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আসলে বাড়ির মালিকানা আইনত ঠিক না হলে অনেক সমস্যা হচ্ছে। রাজনীতি এসে গেছে এর মধ্যে। মাধবীলতা কথাগুলো না বলে পারল না।

তাই বলুন। পার্টি কি চাইছে বাড়ির দখল নিতে? মিস্টার রায় হাসলেন।

না। ঠিক তা নয়। অনিমেষ বলল, আমরা নৃপেনদার কাছে গিয়েছিলাম, তিনি সৌমেনবাবুর কাছে পাঠালেন। তার কাছেও কোনও সাহায্য পাইনি।

তা হলে? হার্মাদ বাহিনী?

পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা যারা পার্টির সমর্থক, সদস্য নয়। অনিমেষ কথাগুলো বলে মাধবীলতার দিকে তাকাল।

মাধবীলতা বলল, ওর বাবার উইলটাকে আইনসংগত করে দিন।

আপনার শাশুড়ি অ্যাকসেপ্ট করবেন?

মনে হচ্ছে এখন করবেন।

তা হলে তো কোনও সমস্যা নেই। কালই মুভ করছি।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা করতে কতদিন লাগবে?

পয়সা খরচ করলে খুব দ্রুত হয়ে যাবে। নইলে–।

পয়সা খরচ মানে, ঘুষ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আচ্ছা ভাই, পৃথিবীতে এত রকমের পরিবর্তন হয়েছে দেখছেন, ঘুষ শব্দটাও যে বাতিল হয়ে গেছে তা জানেন না। তৎকাল শব্দটা শুনেছেন? ট্রেনের বার্থ যখন আর বিক্রির জন্য পড়ে থাকে না তখন রেল কোম্পানি যে কয়েকটা বার্থ হাতে রেখে দেয় সেগুলো অতিরিক্ত চার্জ বসিয়ে বিক্রি করে। লোকে বলে তৎকালে টিকিট কেটেছি। এটা অবশ্যই সরকারি আইনে হয়ে থাকে। এই আইনটা একদম বেসরকারি করে নিয়েছেন যাঁরা তাঁদের আনুকূল্যে কাজটা দ্রুত হয়ে যেতে পারে। মিস্টার রায় চোখ বন্ধ করে হাসলেন।

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাত নেড়ে থামিয়ে মাধবীলতা বলল, এর জন্য আমাদের কত দিতে হবে?

খুব বেশি নয়। আপনাদের যে টাকার কথা বলেছিলাম তার মধ্যেই হয়ে যাবে। কমও হতে পারে। আপনারা কি চা খাবেন? মিস্টার রায় তাকালেন।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না।

একটা সময় ছিল, এই শহরের মানুষ সমস্যায় পড়লে সিপিএমের নেতাদের কাছেও যেমন যেত তেমনি কংগ্রেসের নেতাদেরও সাহায্য নিত। দুই দলের নেতারা নির্বাচনের আগে যত যুদ্ধই করে থাকুন না কেন বাকি সাড়ে চার বছর সৌজন্যবোধ হারাতেন না। তখন চা-বাগানে আর এস পি-র প্রভাব খুব বেশি ছিল। কংগ্রেস বা সিপিএমের সংগঠন সেখানে খুব দুর্বল ছিল। কিন্তু কোনও মানবিক প্রয়োজনে খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যদি ননী ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করতেন তা হলে ননীবাবু মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। এখন তো এখানে কংগ্রেস একটা সাইনবোর্ডের পার্টি। নতুন পার্টি তৃণমূল কলকাতায় মাথা চাড়া দিচ্ছে। মা দুর্গা যখন দশ হাতে যুদ্ধ করেছিলেন তখন দেবতারা তাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। তৃণমূল যাঁর স্বপ্ন তার পাশের কারও ওপর তো ভরসা করা যাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের উচিত প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন মিস্টার রায়।

প্রশাসন আমাদের সাহায্য করবে?

সচরাচর করে না। ভয় পায়। জলপাইগুড়ি থেকে সুন্দরবনের রামগঙ্গাতে ট্রান্সফার করে দিতে পারে। পুলিশের ট্রেনিং তো মিলিটারিদের মতো নয় যে প্রয়োজনে দেশের সব জায়গায় যেতে তৈরি থাকবে। একটা কাজ করা যায়। আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন উত্তরবাংলার পুলিশের এক নম্বর কর্তা। সরকার তার সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বছর খানেকের মধ্যেই অবসর নেবেন। আমি তাঁকে টেলিফোনে ব্যাপারটা বলছি। দেখা যাক কী হয়। আচ্ছা? মিস্টার রায় উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে দিলেন দরজা পর্যন্ত।

তখন সবে সন্ধে হয়েছে। লছমনের রিকশায় ওঠার পর অনিমেষ বলল, তোমার কী মনে হয়, পুলিশ সাহায্য করবে?

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তুমি এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?

হুঁ। অনিমেষ অন্যদিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে ফিরে অর্ককে দেখতে পাব। ও নিশ্চয়ই মত পালটাবে।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, সত্যি, তুমি খুব পালটে গেছ।

মানে? অনিমেষ তাকাল।

শান্তিনিকেতনের ওই রাতের পর যে তুমি স্বচ্ছন্দে আমার কথা ভুলে যেতে পেরেছিলে, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বিন্দুমাত্র দুর্বল হওনি, সেই তুমি ছেলে ফিরে যাবে শোনার পরেও ভাবছ আমাদের ছেড়ে ও যাবে না। পালটে যাওনি, বলো?

লতা, ও চলে গেলে কি তোমার ভাল লাগবে?

আমি এসব নিয়ে আর ভাবি না।

সে কী?

জীবনে দুবার প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলাম। এক, লালবাজারের পুলিশ যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা দেখেও জামাকাপড় খুলে অত্যাচার করেছিল, দুই, জেল থেকে বেরিয়ে যখন শুনলে আমি সন্তানের মা তখন অদ্ভুতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে। মাধবীলতা শ্বাস ফেলল।

লতা, আমি তো অনেকবার বলেছি, কথাটা বলা ভুল হয়েছিল!

যখন মনে পড়ে তখন খারাপ লাগাটা ঘিরে ধরে। হ্যাঁ, তারপর এই এতগুলো বছর, প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা একসঙ্গে আছি। তুমি যে অসাধারণ থেকে ক্রমশ সাধারণ বাবা এবং স্বামীতে চলে এলে তা দেখে, বিশ্বাস করো, স্বস্তি পেয়েছি। গোটা জীবন ঘরের মধ্যে বাস করতে কোনও মেয়ে চায় না। তার চেয়ে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমের দুপুর, সেও ভাল। আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমার পাশে আছি। কিন্তু জোর করে দুঃখে জড়াতে চাই না। মাধবীলতা বলল।

বাড়িতে ঢোকামাত্র ওরা দেখল আলো জ্বালিয়ে বারান্দায় মোড়ার ওপর চুপচাপ বসে আছে ছোটমা। চারদিক শব্দহীন। মাধবীলতা সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এভাবে বসে আছেন?

তোমাদের ছেলে চলেই গেল। কান্না ছোটমার গলায়। মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল।

ছোটমার মোড়ার পাশে মেঝের ওপর বসে পড়ল মাধবীলতা। তারপর নিচু গলায় বলল, যে যাওয়ার সে যাক না।

এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা। মাধবীলতা তাঁর হাত ধরল, কাঁদবেন না।

তুমি বুঝবে না, বুঝবে না।

আপনি বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝব।

আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম দ্বিতীয়পক্ষ হয়ে। এসে দেখলাম স্বামী তার মৃত স্ত্রীর কথা একটুও ভুলতে পারছেন না। মদ খাচ্ছেন, অদ্ভুত আচরণ করছেন। আমাকে বিয়ে করেছেন অথচ–। তোমাকে কী বলব–। আবার কাঁদলেন ছোটমা। অনিমেষ ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে গেল।

বিয়ের আগে আমি যা ছিলাম বিয়ের পরেও তাই থেকে গেলাম। এমনকী অনিও প্রথম কয়েক বছর আমার সঙ্গে সহজ ছিল না। কিন্তু আমি জেদ ধরলাম। নাই বা হল আমার সন্তান, তবু এই পরিবারকে আমি নিজের করে নেবই। একদিন বড়দি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমার সন্তান হচ্ছে না কেন? আমি তাকে সত্যি কথা বলতে পারিনি। উনি ভেবে নিয়েছিলেন আমার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয় বলেই হতে পারছি না। বলেছিলেন, তার ভাইকে বলতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার কথা ওঁকে বলতে পারিনি। এবার মাধবীলতার হাত জড়িয়ে ধরলেন ছোটমা, আমি এই পরিবারে আসার পর অনি কলকাতায় পড়তে চলে গেল। ওর বাবা-দাদু খুব আশা করেছিলেন। পড়া শেষ করে এখানেই ফিরে আসবে। কিন্তু সে এল না। তারপর একে একে ওর ঠাকুরদা বাবা বড়পিসিমা আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। কেন? কেন আমি পড়ে রইলাম, আর ওঁরা। ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলতে চাইলেন ছোটমা। তার রুগণ শরীর কেঁপে উঠছিল বারংবার।

এসব কথা আজ, এতদিন পরে কেন মনে এল? মাধবীলতা বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরতেই তিনি তার কাঁধে মাথা রাখলেন। মাধবীলতা অনুভব করল তার শরীরে ওঁর কাপুনি ছড়িয়ে পড়ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছিল ছোটমার। তারপর একটু শান্ত হলে ছোটমা বললেন, আজ মনে হচ্ছে, সত্যি আমি অপয়া।

ছিঃ। এমন কথা বলবেন না। কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ এ কথা বলে।

কেন মনে করব না বলো? আজ অর্কও চলে গেল। সোজা হলেন বৃদ্ধা।

কলকাতায় ওর কাজ আছে তাই গিয়েছে।

যাওয়ার আগে বলে গেল, আপনি কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। এই বাড়ি যদি বিক্রি না হয় তা হলে পুরোটাই ভাড়া দিয়ে দিন। সেই টাকায় দিব্যি থাকা যাবে বৃদ্ধাশ্রমে। আমি বললাম, আমি তা হলে এতদিন এই বাড়ি আগলে রাখলাম কেন? সে জবাব না দিয়ে হেসে চলে গেল। এই যাওয়াটাকেও আমাকে দেখতে হল। ছোটমা এবার আঁচলে চোখ মুছলেন।

আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার আজ মনে হচ্ছে আমরা কোথাও ভুল করেছিলাম। মাধবীলতার গলা ধরে এল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজন হাতে হাত রেখে। অন্ধকার আকাশে এখন ফিকে আলো। হয়তো অনেক পরে চাঁদ উঠবে।

ছোটমা বললেন, আচ্ছা মাধবীলতা, তুমি তো এতটা কাল অনিকে আগলে রাখলে, তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কি কোনও সম্পর্কই নেই?

শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আমি খবর রাখতাম। কিন্তু বাবা আমাকে মেনে নিতে পারেননি। মা আগেই গিয়েছিলেন।

তুমি জানতে?

হ্যাঁ। এ কথাগুলো আপনার ছেলেকেও বলিনি। আমাকে একজন খবর দিতে ছুটে গিয়েছিলাম শ্মশানে। আমাকে দেখে বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। তখন মনে হল থাকলে উনি আরও অসন্তুষ্ট হবেন। তার কয়েক বছর পরে বাবার চলে যাওয়ার খবর পেয়েছিলাম।

তোমার বাবা-মা সম্পর্কে অনি কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাধবীলতা বলল, ও অত বাস্তববাদী নয়।

তা অবশ্য। নইলে ঠাকুরদা, বাবার কথা বাদ দিলাম, যে বড়পিসিমার ও প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল, পেটে না ধরেও যিনি নিজেকে ওর মা ভাবতেন, তাঁর সম্পর্কে ও উদাসীন হয়ে থাকত না। এবার মাধবীলতার মাথায় হাত বোলালেন ছোটমা, তুমি অনিকে খুব ভালবাসো, তাই না?

মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, বিশ্বাস করুন।

এইভাবে জীবনটা কাটিয়ে এখন কি আফশোস হয়?

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল মাধবীলতা, সবার তো সব হয় না।

যাও, ওঠো। অনিকে চা করে দাও। ছোটমা বললেন।

গলার কাছে একটা ভারী কিছু এসে ঠেকেছিল, শ্বাস ফেলল মাধবীলতা, আপনার জন্যও করি?

আলাদা করে করতে হবে না। আমার রান্নাঘরে দুকাপ চা বানিয়েছিলাম। এক কাপ অর্ক খেয়ে গেছে, আমারটা খাওয়া হয়নি। ওটাই গরম করে দাও। ছোটমা বললেন।

হেসে ফেলল মাধবীলতা। তারপর উঠে ঘরে গিয়ে দেখল অনিমেষ চুপচাপ শুয়ে আছে। সে কোনও কথা না বলে শাড়ি পালটে তিন কাপ চা তৈরি করে এককাপ অনিমেষকে দিয়ে বাকি দুকাপ নিয়ে ছোটমার পাশে এসে বসল, নিন।

তুমি আবার মেঝেতে বসলে কেন?

এখানে বসতে ভাল লাগছে। আপনি অর্ককে চা করে দিলেন?

আমার খেয়াল ছিল না। ও খেতে চাইল।

অদ্ভুত। মাধবীলতা চাপা স্বরে বলল, একটা কথা রাখবেন?

বলো।

শ্বশুরমশাইয়ের ইচ্ছেটাকে মেনে নিন।

তার মানে?

উনি তো উইল করে বাড়িটা আপনাকে দিয়ে গেছেন–।

একটু চুপ করে থেকে ছোটমা বললেন, সেই উইলের দুটো কপি তো ঘেঁড়া হয়ে গেছে।

দেখুন, এই বাড়ি নিয়ে যা সমস্যা হচ্ছে, মানে অর্ক বা আপনার অনিকে দেওয়া নিয়ে, তার সমাধান হতে অনেক সময় লাগবে। আমরা উকিলবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, চেষ্টা করলে তিনি শ্বশুরমশাইয়ের উইলটার আর একটা কপি উদ্ধার করতে পারবেন। আপনার আপত্তি না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সমস্যা মিটে যাবে। তারপর আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন, আমি কোনও কথা বলব না।

মাধবীলতা বলতেই ছোটমা হেসে ফেললেন, তুমি, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

এই সময় মোবাইলের রিং শোনা গেল। তারপর চুপচাপ। একটু পরে অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে বেরিয়ে এল বারান্দায়, শোনো, দেবেশ ফোন করছে। বলছে কবে ওর ওখানে যাবে? সবাইকে নিয়ে যেতে বলছে।

দেবেশ কে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওর ছেলেবেলার বন্ধু। কাছাকাছি কোথাও নাকি আশ্রম করেছে। চলুন, সবাই মিলে একবার বেড়িয়ে আসি। মাধবীলতা বলল।

.

২৪.

সাতসকালে একটা লোক সাইকেলে চেপে চলে এল বাগানের ধারে, এসে গলা চড়িয়ে বলল, এখানে অনিমেষবাবু থাকেন?

মাধবীলতা সেইমাত্র বাসি কাপড় বালতির জলে ডুবিয়ে পরিষ্কার হয়ে বাথরুমের বাইরে পা রেখেছিল, অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, থাকেন। কী ব্যাপার?

লোকটা সাইকেলে বসেই বলল, এস পি সাহেব ওঁকে এখনই ডেকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, দেরি যেন না করেন। কোনও কারণে এখন যেতে না পারলে রাত দশটা নাগাদ যেতে পারেন। আচ্ছা! লোকটা সাইকেল ঘোরাচ্ছিল।

দাঁড়ান। এস পি মানে পুলিশের–।

হ্যাঁ। কাছারির দিকে গেলে ওঁর বাংলো দেখতে পাবেন। আশ্চর্য, জলপাইগুড়িতে থাকেন আর এস পি-র মানে জানেন না! সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে লোকটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

ছোটমা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। অর্কর সঙ্গে কারও কোনও ঝামেলা হল নাকি?

কী হয়েছে বলবে তো?

এস পি, পুলিশের বড়কর্তা ওকে এখনই দেখা করতে বলেছেন।

সর্বনাশ। পুলিশে ছুঁলে কী হয় তা তো তুমি জানো।

কিন্তু ওকে কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে? কদিন থেকে মনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে এসে ওর কথাবার্তার ধরন সেটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথা নাড়ল মাধবীলতা, জানি না, ভবিষ্যতে আর কী দেখব। ওকে বলি গিয়ে, যায় তো যাবে।

এখনও এই বয়সে অনিমেষের ঘুমাবার সময় শরীরে শিশুসুলভ ভঙ্গি তৈরি হয় যা দেখলে ডাকতে ইচ্ছে করে না মাধবীলতার। তবু আজ ওকে ডেকে তুলতে হল। ক্রাচ এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

কেন? এখন কটা বাজে? বিরক্ত হল অনিমেষ।

তোমাকে শহরের এস পি সাহেব এখনই দেখা করতে বলেছেন।

মানে? কোনও মানে জানি না। আরদালি গোছের একটা লোক বাড়িতে এসে তাই বলে গেল। এখন যেতে না পারলে রাত দশটার পর যেতে হবে। সে সময় বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত হবে না।

কিন্তু পুলিশ সুপার আমাকে কেন ডাকবেন?

তার উত্তর আমি কী করে দেব বলো? শুধু ভয় হচ্ছে, অর্ক কিছু করেনি তো! যে লোকটাকে ও আশ্রয় দিয়েছে সে কে? অপরাধ জীবনের সঙ্গে যুক্ত কোনও লোক? না, সেটা জেনে ও থাকতে দেবে না বলে এখনও বিশ্বাস করি। যাক গে, গিয়ে শুনে এসো।

বিছানা থেকে নামতে এখনও একটু অসুবিধে হয়। নেমে ক্রাচে ভর করে সোজা হয়ে অনিমেষ বলল, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।

উনি তোমাকে ডেকেছেন। আমাকে নয়।

বেশ। তুমি বাইরে অপেক্ষা করতে পারো, আমি ভেতরে গিয়ে কথা বলব।

অনিমেষ বাথরুমের দিকে চলে গেলে মাধবীলতা উঠল। একটা পরিষ্কার কাপড় হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের মুখটাকে এই সকালে দেখল। অভ্যেসের দৈনিক চুল আঁচড়ানোর সময় আয়নার সামনে দাঁড়ানো থেকে আজ একটু আলাদা হয়ে নিজেকে দেখল। না, এখন চুলে ঈষৎ রুপোর ছোঁয়া লাগলেও কালোর আধিক্য আছে। কিন্তু চোখের তলায়, কপালের রেখায় আর গলার ভাঁজে সময়ের হাতুড়ি বেশ সক্রিয়। নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মাধবীলতা। না, এখনও তার চিবুক এবং হাসিকে বয়স দখল করতে পারেনি। সে চুল আঁচড়ে নিল।

অনিমেষ ঘরে ঢুকে বলল, এ কী! এখনও তুমি এখানে?

নিজেকে দেখছিলাম। তোমার চেহারা যতটা বদলেছে আমারটা তত হয়নি।

কী আশ্চর্য। কত যুগ পরে দেখে দেবেশ একবারেই চিনতে পারল। চুল

হয় সাদা হয়ে গেছে। যাক গে, যাওয়ার আগে এককাপ চা হবে?

নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু ছোটমা তো ঠাকুরঘর থেকে বের হওয়ার পর চা খান। ততক্ষণে আমরা ফিরে আসব। চলো, আজকে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ভাঁড়ের চা খাই। বেশ লাগবে।

এখানে কি কলকাতার মতো দুহাত দূরে দূরে ওই দোকান আছে? আচ্ছা। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।

বলা না থাকায় এই সকালে লছমনকে পাওয়া যাবে না। ওরা মিনিট দশেক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে রিকশা পেল। অনিমেষ লক্ষ করছিল ক্লাবের ছেলেদের দুজন কয়লার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। একজন হঠাৎ হাত নাড়ল। অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

এস পি-র বাংলোর গেটে রিকশা আটকে দিল পাহারাদার। অনিমেষ তাকে বলল, এস পি সাহেব আমাদের দেখা করতে বলেছেন।

লোকটি বলল, এখন ভিজিটার্সদের সঙ্গে উনি দেখা করেন না। দশটার পরে আসুন। রিকশাওয়ালা বলল, বাবু, আমাকে ছেড়ে দিন।

ভাড়া মিটিয়ে দিল মাধবীলতা। এই এলাকাটায় মানুষের বসতি বলতে কয়েকটি সরকারি বাংলো। ওরা কী করবে বুঝতে পারছিল না।

অনিমেষ বলল, রিকশা পাওয়া মুশকিল হবে। চলো ফিরে যাই। পরে জানতে চাইলে বলব আপনার গার্ডই ঢুকতে দেয়নি। ওদের রিকশাওয়ালা রিকশা ঘোরাচ্ছিল, তাকে দাঁড়াতে বলল সে।

কথাগুলো গার্ডের কানে গিয়েছিল। সে চেঁচিয়ে ডাকল, আবদুলভাই। বাগানের ওপাশ থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে চিনতে পারল মাধবীলতা। সে গলা তুলে বলল, আপনি খবর দিয়েছিলেন তাই এসেছিলাম।

আবদুল নামক ব্যক্তিটি বলল, গেট খুলে দে। সাহেব ওঁদের ডেকেছেন। আসুন আপনারা আমার সঙ্গে।

অনেকটা হেঁটে ব্রিটিশ আমলের বিশাল বাংলো বাড়ির একতলার ঘরে তাদের বসতে বলে আবদুল ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাউকে বলল, সাহেব যাঁকে আসতে বলেছেন তিনি এসেছেন। তারপর সে বাইরে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, অনিমেষ মিত্র?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনি আসুন।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে যেতে বলল। বাংলোর পেছনের নেট-ঘেরা বারান্দায় মধ্যবয়সি ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। অনিমেষকে আসতে দেখে হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার। সরি, আমি জানতাম না আপনাকে ক্রাচের ওপর নির্ভর করে হাঁটতে হয়। আসতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হল। বসুন।

সুন্দর বেতের চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে উলটোদিকে বসলেন ভদ্রলোক।

অনিমেষ ক্রাচ দুটো চেয়ারের পাশে রেখে বলল, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কেন ডেকে পাঠালেন।

আমরা মানে?

আমার স্ত্রীও সঙ্গে এসেছেন।

সে কী! ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। এই প্রথম স্বস্তি পেল অনিমেষ। আর যাই হোক, অর্কর জন্য তাকে ডেকে পাঠাননি ইনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাধবীলতাকে নিয়ে ফিরে এসে ভদ্রলোক বললেন, ছি ছি। এরা আমাকে বলেইনি যে আপনিও ওঁর সঙ্গে এসেছেন। বসুন। আমি পঙ্কজ দত্ত। এস পি-র চাকরি করি। কী খাবেন? চা না শরবত?

মাধবীলতা হাসল, আপনার লোক এমন তাড়া দিয়েছে যে ভেবেছিলাম রাস্তায় চা খেয়ে নেব। কিন্তু এই এলাকায় কোনও চায়ের দোকান দেখতে পেলাম না। ও বলল এটা নাকি সাহেবপাড়া ছিল। চা–।

চায়ের হুকুম দিয়ে পঙ্কজ বললেন, এবার বলুন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী বলব?

সে কী! আমার বস কাল রাত্রে টেলিফোনে বললেন যে আপনারা খুব বিপদে পড়েছেন। ওঁর বন্ধু, এখানকার বিখ্যাত ল-ইয়ার মিস্টার রায় ফোনে ওঁকে জানিয়েছেন। তারপরে আমি মিস্টার রায়কে ফোন করে কিছুটা জেনে নিয়েছি। বাকিটা আপনার মুখে শুনতে চাই। পঙ্কজ দত্ত ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন।

অনিমেষ সমস্ত ঘটনাটা ওঁকে জানাল।

একটু চুপ করে থাকলেন পঙ্কজ দত্ত। ইতিমধ্যে চা এবং বিস্কুট এসে গেল। পঙ্কজ নিজে মাধবীলতার হাতে কাপ প্লেট তুলে দিয়ে বলল, আপনাদের এত সকালে আসতে বলার কারণ ছিল। আমি চাইনি আপনারা যে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন তা সবাই জানুক। নিন, চা খান।

চায়ে চুমুক দিয়ে মাধবীলতা বলল, আমরা এখন কী করব?

আপনাদের তো কিছু করার নেই। নৃপেনবাবুরা হাত গুটিয়েই থাকবেন। থানায় গিয়ে যদি বলেন ক্লাবের ছেলেরা আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে তা হলে আপনারা বাড়িতে ফেরার আগেই ওদের কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপচাপ। হঠাৎ মাধবীলতার মনে কথাটা আসায় জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমরা আদালতে গেলে কি কোনও সুরাহা হবে?

হেসে নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন পঙ্কজ দত্ত, তা হলে তো মিস্টার রায় পরামর্শটা দিতেন। আদালতে গিয়ে আপনারা কীভাবে প্রমাণ করবেন ওই ছেলেরা হুমকি দিচ্ছে, ভাড়াটেকে শাসাচ্ছে? কোনও লিখিত বা রেকর্ডের প্রমাণ নেই। তা ছাড়া কেস লড়বার জন্যে কোনও উকিল এগিয়ে আসবেন কিনা সন্দেহ।

অনিমেষ বলল, ভাড়াটে মানে, নিবারণবাবু তো সত্যি কথা বলবেন।

না। বলবেন না। চাপে পড়ে উনি বিচারককে বলতে পারেন তাঁর কাছে কেউ যায়নি। এরকম কোনও ঘটনার কথা তিনি জানেন না। সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখলেন পঙ্কজ দত্ত, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আচ্ছা, অনিমেষবাবু, আপনারা তো কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ।

কী প্রফেশনে ছিলেন?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, আমি শিক্ষকতা করতাম। এখন অবসরে। আর ওর পায়ের অবস্থার কারণে–।

মাথা নাড়লেন পঙ্কজ দত্ত, আপনার সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের আর সম্পর্ক নেই?

না। পরিষ্কার বলল অনিমেষ।

কিছু মনে করবেন না, মাওবাদীদের কেউ যোগাযোগ করেনি?

অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

কারণ মাওবাদীদের শুভানুধ্যায়ীরা কলকাতায় আছেন। তাঁদের কেউ সমাজসেবী, কেউ ডাক্তার, আবার কেউ প্রাক্তন নকশাল।

না। আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তা ছাড়া আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওদের ব্যাপারে। অনিমেষ বলল।

ঠিক আছে। আমার এই কার্ডটা রাখুন। খুব জরুরি দরকার হলে ফোন করবেন। আচ্ছা, নমস্কার। পঙ্কজ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন, আপনারা বাংলোর সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে যেতে পারবেন। কষ্ট করে তিস্তার বাঁধে উঠতে হবে। অনিমেষবাবু কি পারবেন?

চেষ্টা করব। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

আবার বলছি, আমার কাছে আপনারা এসেছেন তা গোপন রাখার জন্যই এভাবে যেতে বলছি। পঙ্কজ দত্ত একজন পরিচারককে বললেন, ওঁদের বাঁধে তুলে দিয়ে এসো।

পেছনে এক চিলতে বাগান, যার পরে উঁচু তারের বেড়া। বেড়ার মাঝখানে। একটা শক্ত কাঠের দরজা। লোকটি ওদের নিয়ে এসে দরজা খুলে বলল, সামনেই বাঁধ। বাঁ দিকে গেলে জেলাস্কুল, ডানদিকে জুবিলি পার্ক। ওই ধাপে পা ফেলে উঠলে সুবিধে হবে।

বাঁধ কেটে সিঁড়ির মতো করে রাখা হয়েছে বলে অনিমেষ ওপরে উঠতে পারল। সামনেই তিস্তার চর ধু ধু করছে। বালির ওপর বেশ মজবুত ঘরবাড়ি শুধু নয়, চাষ আবাদও শুরু হয়েছে। অনিমেষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। মাধবীলতা পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছ?

যখন স্কুলে পড়তাম তখন বর্ষার সময়ে তিস্তার ঢেউ এই বাঁধে ছোবল মারত। এখন কোথাও তো জল দেখতে পাচ্ছি না। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা বলল, ওই ওপাশে, অনেক দূরে বোধহয় জল আছে, চিকচিক করছে। তিস্তায় বোধহয় বর্ষাতেও বেশি জল বয়ে যায় না, নইলে এই এত বাড়িঘর করে মানুষ থাকতে পারত না।

অনিমেষ বলল, সবকিছু কীভাবে বদলে গেল। চারপাশে তাকাল মাধবীলতা, এখানে তো রিকশা পাওয়া যাবে না। ওদিকে বলল কী একটা পার্ক আছে, ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে।

দূর! তার চেয়ে চলো বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই।

কতটা দূর?

খুব বেশি নয়।

পারবে?

অনিমেষ হেসে ফেলল, ঠিক তো, সেই আমি আর নেই আমি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখি। চলো।

ওরা ধীরে ধীরে বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ডানদিকে তিস্তার শুকনো চর, বাঁ দিকে বিশাল বাগানঘেরা ব্রিটিশদের তৈরি সরকারি বড়কর্তাদের বাংলো। প্রচুর পাখি ডাকছে সেইসব বাগানে।

অসুবিধে হলে বলবে। মাধবীলতা বলল।

কী করবে? অনিমেষ তাকাল।

তা হলে এই বাঁধের ওপর বসে জিরিয়ে নিতে পারবে।

ঠিক আছে। অনিমেষ বলল, আচ্ছা, এই ভদ্রলোক কি সত্যি পুলিশ? মাধবীলতা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এত ভদ্র, সুন্দর ব্যবহার কোনও পুলিশ অফিসার করতে পারেন তা আমার ধারণায় ছিল না। বোধহয় এখন শিক্ষিত ভদ্র ছেলেরা পুলিশে আসছে। অন্তত আই পি এস-এ।

হয়তো। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। অনিমেষ বলল, কোনওভাবেই তো উনি উৎসাহিত করলেন না। এমনকী সবার চোখের সামনে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেও চাননি। হয়তো ভয় পেয়েছেন। মন্ত্রীদের কাছে খবর গেলে পঙ্কজবাবুকে বিপদে পড়তে হবে। কী করা যায়? পুলিশ কিছু করবে না, আদালতে গেলে সাক্ষী পাব না, পাড়ায় মানুষ পাশে দাঁড়াবে না। যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাক বাড়িটা।

কিন্তু একটা কথা পঙ্কজবাবু বলেছেন, আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দিন। কেন বললেন? নিশ্চয়ই ওঁর মাথায় কিছু আছে। মাধবীলতা কথা শেষ করামাত্র তার মোবাইল ফোন বেজেই থেমে গেল। মিস কল দিয়েছে কেউ। ব্যাগ থেকে সেটা বের করে দেখল মাধবীলতা। নাম্বারটা একদম অজানা।

.

২৫.

জলপাইগুড়ি-নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় সুস্থভাবে পৌঁছাতে হলে অনেক আগে রিজার্ভেশন কাউন্টারে দাঁড়াতে হয়। যাওয়ার দিনে স্টেশনে গিয়ে যে কয়েকজন যাত্রী ঠিকঠাক দাম দিয়ে শোওয়ার জায়গা পেয়ে যান তাদের পেছনে দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের হাত থাকে।

মাস খানেক আগে অগ্রিম টিকিট কেনা যাত্রীরা ওয়েটিং লিস্টের নাম্বার সম্বল করে ট্রেনের কামরার সামনে ভিড় করতে পারেন কিন্তু রেলের পরিভাষায় আর এ পি-তে উন্নীত না হলে ভেতরে পা রাখতে পারবেন না। জলপাইগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে অর্ক বুঝতে পারল, সংরক্ষিত কামরায় শুয়ে কলকাতায় যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তার নেই।

প্ল্যাটফর্মে দালাল ঘুরছিল। কোনও রেলকর্মীর পকেট ভারী করে জায়গা পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিচ্ছে না। আজ নাকি সংরক্ষিত কামরার একটি বার্থও খালি না থাকায় কনডাক্টর গার্ডদের কিছু করার নেই। একজন বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে দালালকে সাহায্য করতে বললে সে জানাল, কোনও চিন্তা নেই। দিদিমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলুন। আপনি আমার সঙ্গে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একেবারে কনফার্মড টিকিট নিয়ে আসবেন।

স্টেশনের বাইরে কেন? বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন।

অফিসটা তো ওখানেই। শয়ে শয়ে টিকিট পাবেন। হাতে তো অনেক সময় আছে, ট্রেন ছাড়বে দেড় ঘণ্টা পরে। চলুন। দালাল হাসল।

অর্ক চুপচাপ শুনছিল, জিজ্ঞাসা করল, কত এক্সট্রা নেবে?

টিকিটের দাম আর সার্ভিস চার্জ।

বৃদ্ধ বললেন, আমার তো টিকিট হয়ে গিয়েছে। ওয়েটিং-এ।

রিফান্ড নিয়ে নেবেন কাউন্টার থেকে।

জনা পাঁচেক লোক দালালের অনুগামী হলে অর্ক ওদের অনুসরণ করল। কলকাতা থেকে আসার সময় এসি থ্রি টায়ারে জায়গা না পেয়ে অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে উঠে কনডাক্টর গার্ডকে অনুরোধ করেছিল বার্থের জন্যে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, আপনার আগে যারা রিকোয়েস্ট করেছে তাদের সবাইকে দিতে পারব না। আপনি আমার জায়গায় আপাতত বসুন।

সেই আপাতত-র সময়সীমা শেষ হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ওভারব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের বাঁ দিকে গিয়ে রেলের আলোর নীচে টেবিল পেতে দুজনকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাদের আশেপাশে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান মানুষ। দালাল বলল, পাঁচজন, হবে?

বসে থাকাদের একজন বলল, হবে। আরও তিনটে আনতে পারিস।

দালাল বলল, আপনারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। জলদি।

বৃদ্ধ অর্কর আগে, লাইনের প্রথমে দাঁড়ালেন, আমাকে দুটো টিকিট, দার্জিলিং মেলের টিকিট তো?

হ্যাঁ দাদু, সাইডের লোয়ার আপার। কী নাম হবে?

এস কে সেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস।

ঠিকানা বলুন। বৃদ্ধ বললেন।

এক হাজার পাঁচশো পঞ্চাশ করে দুটো টিকিট, মানে একত্রিশ শো দিন।

অ্যাঁ? কোন ক্লাস? এসি টু টায়ার নাকি? আমরা তো সিনিয়ার সিটিজেন।

দাদু, আপনি সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধে পাবেন রেলের কাউন্টারে। আমরা এই যে স্পেশ্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি তার জন্যে এত টাকা বেরিয়ে গেছে যে কনসেশান দেওয়া সম্ভব নয়। না যেতে চান, নেক্সট লোককে চান্স দিন।

আমার মেয়ে খুব অসুস্থ! পকেট থেকে পার্স বের করে গুনে গুনে টাকা দিলে লোকটি বলল, একেবারে শেষ দিকে কামরা। দেখবেন লেখা

আছে ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট। লোকটি টিকিট দিল।

বৃদ্ধ সেটাকে লক্ষ করতে লাগলেন, এ তো আমাদের নামে নয়।

নামে কী এসে যায় দাদু। ওটা আমাদের কামরা, কেউ প্রশ্ন করবে না।

এটা কি এসি কামরা?

আশ্চর্য! লোকটা রেগে গেল, আপনি সরে যান তো। ট্যুরিস্ট কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছেন তবু। নেক্সট।

অর্ক টেবিলের সামনে দাঁড়াল।

অর্ডিনারি থ্রি টায়ারের যা ভাড়া তার তিনগুণ নিচ্ছেন কেন?

পুরো কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করতে হয়েছে যে। দিন–।

আপনারা কি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দালাল লাগিয়ে ট্যুরিস্ট ধরে ব্যাবসা করছেন? অর্ক চেঁচিয়ে বলতেই স্বাস্থ্যবান লোকগুলো এগিয়ে এল, একজন চেঁচিয়ে লাইনে দাঁড়ানো লোকদের বলল, এই লোকটা ফালতু ঝামেলা করছে, এর জন্যে আপনাদের টিকিট দেওয়া যাবে না, আপনারা তাই চান?

সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদ উঠল, জোর করে সরিয়ে দেওয়া হল অর্ককে। পরের যাত্রীরা এবার টিকিট কিনতে লাগল তৃপ্ত মুখে।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে অর্ক চলে এল স্টেশন মাস্টারের ঘরে। সেখানে তিনি নেই। বেরোতেই রেলের একজন অফিসারকে দেখতে পেয়ে ঘটনাটা জানাল সে। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, আমরা জানি, কিন্তু কিছু করার নেই।

সে কী! ট্রেনের টিকিট চড়া দামে বিক্রি করছে আর আপনি বলছেন কিছু করার নেই। এতে রেলের ক্ষতি হচ্ছে না?

হচ্ছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে লোক ওয়েটিং লিস্টে থাকছেন কিন্তু আমরা তাদের জায়গা দিতে পারছি না। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

আপনারা অতিরিক্ত কামরার ব্যবস্থা করছেন না কেন?

দেখুন, একটা ট্রেনের বহন ক্ষমতা অনুযায়ী কামরার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এই ট্রেনে সেই সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

তা হলে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দিলেন কেন? ওই জায়গায় স্বচ্ছন্দে আর একটা কামরা দিয়ে ওয়েটিং লিস্টের যাত্রীদের তুলে দিতে পারতেন।

অবশ্যই পারতাম। কিন্তু অনেক ওপরের কর্তাদের হুকুমে ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে কামরা দেওয়া হচ্ছে। ওঁরা পুরো পেমেন্ট দিয়ে কামরা ভাড়া করে নিচ্ছেন। অভিযোগ না এলে ওই কামরায় রেল নাক গলায় না। ধরুন, আপনি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন দশ হাজার টাকায়। আপনি যদি সেই ফ্ল্যাটে গেস্ট রাখেন পার ডে হাজার টাকায় তা হলে বাড়িওয়ালা কী করতে পারে, যদি না সেই গেস্টরা বেআইনি কিছু করেন। এও তেমনি। আপনি কোথায় যাবেন?

কলকাতায়।

ও। আচ্ছা, নমস্কার। ভদ্রলোক চলে গেলেন।

ট্রেনের দিকে তাকাল অর্ক। তারপর হাঁটতে লাগল। তারপর একটা কামরা যার গায়ে কোনও রিজার্ভেশনের নোটিশ নেই, উঠে পড়ল। শোওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই, যাত্রীদের চেহারা দেখে বোঝা যায় বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন। দু-তিন জন দাঁড়িয়ে আছেন, বাকিরা ঠাসাঠাসি বসে। একেবারে কোনার দিকে একজন মধ্যবয়সের সন্ন্যাসিনী তিনজন শিষ্যকে নিয়ে বসে আছেন। সন্ন্যাসিনীর পাশে ত্রিশূল রাখা। গায়ের রং বেশ ফরসা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে গেরুয়া কাপড় জামা। কপালে বিশাল টিপ। দুটো চোখে কাজল এমনভাবে টানা যেন দুর্গা ঠাকুরের নয়ন। অর্ক দেখল ওই বেঞ্চিতে আরও একজন স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। সন্ন্যাসিনী বলে কেউ ওদিকে যায়নি।

অর্ক এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বসতে পারি?

তিন শিষ্য নড়ল না। কিন্তু সন্ন্যাসিনী বললেন, ওরে, জায়গা দে, বাছা আমার বসতে চেয়েছে। বসো বসো। কেউ তো বলল না, তুমি মুখ ফুটে চাইলে।

শিষ্যরা এবার নড়েচড়ে বসার জায়গা করে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়ার যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। ট্রেন ছাড়ল। অর্ক ভাবছিল মাকে ফোন করে জানাবে কিনা। সে একবার চেষ্টা করে জানল এখন সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক বছর পরে এবার জলপাইগুড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সত্যি কথাগুলো বলতে বাধ্য হল সে। অবশ্য সে যাকে সত্যি ভাবছে ওঁরা তা ভাবছেন না, এটাও স্পষ্ট। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে দেখে এসেছে বাবা শরীরের কারণে কোনও কাজ করছেন না, মায়ের রোজগারে সংসার চলছে। কিন্তু সংসারে বাবার প্রায় সব কথাই মা মেনে চলছেন। তার মনে হয়েছিল, পৃথিবীর অনেক মানুষ বাবার মতো প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কাজকর্ম করছে। পা না থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ চ্যানেল পার হচ্ছে। বাবা তার ওই প্রতিবন্ধকতার দোহাই দিয়ে অলস হয়ে থাকলেন এতগুলো বছর। আর মা সেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে এলেন।

মা চাকরির শেষে বাবাকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে জলপাইগুড়িতে চলে এলে ছোট ঠাকুরমার উপকার হত। খামোকা কলকাতায় থাকার তো দরকার ছিল না। জলপাইগুড়ির বাড়িতে থাকতে বাবার যে আপত্তি ছিল তার কারণ সে অনুমান করতে পারে। আজ বাড়ি বিক্রি করে ছোট ঠাকুরমার নামে টাকা নিলে সেই টাকা কয়েক বছর পরে অনাথ আশ্রমে দান করে দেবেন না বাবা। তখন ওই আপত্তির কথা কেউ যদি মনে করিয়ে দেয় তা হলে কি অন্যায় হবে? খুব খারাপ লাগছিল অর্কর। কমিউন ভেঙে যাওয়ার পর থানা থেকে বেরিয়ে বহুকাল সে চুপচাপ থেকেছে। পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছে। কারও সঙ্গে আর নিবিড় যোগাযোগ রাখেনি। একটু একটু করে বাবার ওপর অভিমান জমতে শুরু করেছিল কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি।

ট্রেন ছুটছে হু হু করে। চোখ বন্ধ করল অর্ক।

এই যে বাছা, শুকনো মুখে বসে আছ কেন? আমাদের সঙ্গে খাবে এসো। গলা শুনে তাকিয়ে দেখল সন্ন্যাসিনী হাসছেন।

না, ঠিক আছে। অর্ক বলল।

কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তা কি তুমি ঠিক করবে বাছা?

মানে? অর্ক অবাক হল।

এটুকু বুঝলে না। আচ্ছা বলো, এই পৃথিবীতে কি তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছ?

অর্ক হাসল, না।

সন্ন্যাসিনী বললেন, লোকে বলে অমুক জন্মগ্রহণ করলেন। যেন, যিনি পৃথিবীতে এলেন তিনি স্ব-ইচ্ছায় এলেন। অথচ তা তো নয়। শিশু মায়ের পেট থেকে বের হতে চায় না। মা তাকে জোর করে বের করে দেয়। তাতে সম্ভব না হলে ডাক্তাররা তাকে বের করে নিয়ে আসে। অর্থাৎ মানুষের জন্মটা তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। সারা জীবন সে যা করছে তাও কি তার ওপর নির্ভর করছে? না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সে ঠোক্কর খাবে, আবার চেষ্টা করবে আর এই করতে করতে যখন তার সময় শেষ হয়ে আসবে তখন অতীতের দিকে তাকালে তার দুঃখ হবে, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ভয় পাবে। আর শরীর ফেলে চলে যাওয়াটাও তো তার ওপর নির্ভর করে না। এমনকী ঠিক কোন সময়টা চলে যাচ্ছে তাও সে অনুভব করতে পারে না। বলো, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক?

মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অর্ক। এবার হেসে বলল, দিন, খাব।

এই তো ভাল ছেলের মতো কথা বললো সন্ন্যাসিনী ইশারা করলে একজন শিষ্য ঝোলার ভেতর থেকে কাপড়ে মোড়া সসপ্যান বের করে শালপাতার ওপর রুটি, আলুর তরকারি আর ক্ষীর সাজিয়ে এক এক করে সবাইকে দিল। সন্ন্যাসিনী বললেন, এই আলুর তরকারিতে কিন্তু পেঁয়াজ রসুন নেই।

আপনারা ওসব খান না? অর্ক খাওয়া শুরু করল।

না না। কেন খাব না। নিশ্চয়ই খাই। কিন্তু মাটির নীচে যা ফলে তার সঙ্গে পেঁয়াজ রসুন মেশাই না। ওরাও তো মাটির নীচে জন্ম নেয়। মাছ মাংসের সঙ্গে খাব না কেন? তাই বলে কচুর সঙ্গে খাব না। হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। সন্ন্যাসিনী খাওয়া শুরু করলেন।

বেশ লাগছে। অর্ক বলল। খাওয়া শেষ হলে শিষ্যের এগিয়ে দেওয়া বোতল থেকে জল খেল অর্ক। কিছুক্ষণ পরে সব যখন চুপচাপ, পাশে বসা শিষ্য ফিসফিস করে বলল, এখন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? উনি কি ঘুমাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

না। এখন উনি উপলব্ধি করবেন। শিষ্যটি বলল।

কীসের উপলব্ধি?

আত্ম-উপলব্ধি। আপনি ওটা বুঝবেন না।

অর্ক দেখল সন্ন্যাসিনী একটা গেরুয়া ওড়নায় নিজের মাথা মুখ ঢেকে নিলেন। মনে মনে হাসল অর্ক। সবার সামনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বদলে মাথা মুখ ঢেকে একটা বাহানা করে ঘুমানোটা ঢের সহজ।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম আসছিল অর্কর। পরের স্টেশনে টিকিট চেকার উঠলেন। অর্ক দেখল অনেকেই টিকিট দেখাচ্ছেন, যারা দেখাতে পারছে না তাদের সঙ্গে কথা বলছিল চেকারের সঙ্গে আসা সিঁড়িঙ্গে চেহারার একজন। দরাদরি করে লোকটা টাকা আদায় করছিল। চেকার নির্বিকার। ওসব তার চোখেই পড়ছিল না।

এগোতে এগোতে অর্কর সামনে চলে এসেছিলেন চেকার। অর্ক তাকে ইশারায় কাছে ডাকতেই তিনি বললেন, আরে না না। টিকিট না থাকলে কেন্টুর সঙ্গে কথা বলুন।

পকেট থেকে জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কেনা অসংরক্ষিত ক্লাসের টিকিট বের করে দেখাল অর্ক। সঙ্গে সঙ্গে চেকারের মুখ বিকৃত হল। তিনি উলটোদিকের লোকটির টিকিট দেখতে চাইলে অর্ক বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

বলুন। চেকার ফিরে দাঁড়ালেন।

ট্রেনের ভাড়া মন্ত্রী বাড়াচ্ছেন নাকি? না না, কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না।

তা হলে ভারতীয় রেলওয়ের বিপুল খরচ কীভাবে মিটবে?

চলে তো যাচ্ছে।

যাচ্ছে না। খোঁড়াচ্ছে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো। এই যে গোটা ভারত জুড়ে ট্রেন লাইন, তাতে কত মেল, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছুটছে প্রতি মিনিটে, তাতে কত টিকিট চেকার কাজ করে মাইনে নিচ্ছেন?

চেকারের চোখ ছোট হল, আপনার কথার মানে বুঝলাম না।

সংখ্যাটা কত তা জানেন?

না।

অন্তত হাজার আষ্টেক? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বললাম তো আমি জানি না। চেকার রেগে গেলেন।

ধরে নিলাম আট হাজার। ধরে নিচ্ছি তাদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ আপনার মতো কেন্দ্রবাবুদের পেছনে নিয়ে টিকিট চেক করতে ট্রেনে ওঠেন না। আচ্ছা, প্রতিদিন কেন্টুবাবুরা যা সংগ্রহ করেন তাকে দুহাজার দিয়ে গুণ করলে যে টাকাটা পাওয়া যায় তাকে তিনশো পঁয়ষট্টি দিয়ে গুণ করলে তো মাথা ঘুরে যাবে। সেই টাকা যদি রেলমন্ত্রী হাতে পেতেন তা হলে ভারতীয় রেলের কী বিপুল উপকার হত বলুন তো? ভাড়া বাড়ানোর দরকারই হত না। অর্ক শান্ত গলায় বলল।

জ্ঞান দেবেন না, জ্ঞান দেবেন না। চেকার ফিরলেন।

এবার সন্ন্যাসিনী মুখের আড়াল সরালেন, আমাদের টিকিট দেখবেন না?

সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আমি টিকিট চাই না। চেকার ট্রেনের অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় কেন্টুকে ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে।

মালদা স্টেশনে নেমে গেলেন ভদ্রলোক সঙ্গীকে নিয়ে।

সন্ন্যাসিনী একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি বসে ঘুমাতে পারো না বাছা?

না।

ভাবো তো কোন প্রাণী সারাজীবন দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। কে বলো তো?

ঘোড়ার কথা বলছেন।

বাঃ। এ বাছা তো অনেক খবর রাখে। কলকাতায় যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

সংসার করোনি?

কী করে মনে হল?

মুখ দেখলেই তো বোঝা যায়।

আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

বোলপুরে নামব। নেমে ট্রেন ধরব।

এক শিষ্য বলল, মা, ফাস্ট বাস ধরলে ভাল হয়।

বেশ তো। বাসেই উঠব। ওদিকে গেলে দেখা করে যেয়ো। যদি কষ্ট করে থাকতে পারো তা হলে শেষ পর্যন্ত ভাল লাগবে।

জায়গাটা কোথায়?

পাশে বসা শিষ্যটি বুঝিয়ে দিল অর্ককে। জানাল তাদের আশ্রমের সামনে অজয় নদ।

ভোররাতের আগেই ওঁরা নেমে গেলেন। নামার সময় সন্ন্যাসিনী অর্কর কাঁধে হাত রাখলেন, মন যা চাইবে তাই করবে। যদি ভুল হয় হবে। বুঝলে বাছা। তোমাকে আমার মনে থাকবে।

অর্কর মহিলাকে ভাল লাগল।

শেয়ালদা থেকে উত্তর কলকাতার শেষপ্রান্তে আগে ট্রামেই আসা যেত। এখন ট্রাম চলছে না। মোড়ে বাস থেকে নেমে পাড়ায় ঢুকল সে। বস্তির মুখে আসতেই বিশ্বজিৎকে দেখতে পেল অর্ক। তাকে দেখে হাত তুলে দাঁড়াতে বলছে। অর্ক দাঁড়াল। বিশ্বজিৎ কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বাইরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। কেন বলো তো?

আপনার মা-বাবা তো জলপাইগুড়িতে গিয়েছেন। পরশু সন্ধে থেকে আপনিও বাড়িতে ছিলেন না। অথচ একজন অবাঙালি ভদ্রলোক আপনাদের বাড়িতে যে একা থাকবেন তা পাড়ার কাউকে বলে যাননি। ফলে সবাই টেনশন করছিল। তবে আপনার সঙ্গে আগে ওঁকে দেখা গিয়েছে বলে কেউ কিছু বলেনি। বিশ্বজিৎ বলল।

আশ্চর্য। আমার কোনও গেস্ট বাড়িতে থাকতে পারে না?

নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু আপনার গেস্ট বাংলা বলতে পারেন না। কেউ কেউ প্রচার করছে উগ্রপন্থীরা নাকি কলকাতায় গা ঢাকা দিয়ে আছে। যাক আপনি এসে গেছেন, আর সমস্যা নেই। বিশ্বজিৎ চলে গেল।

একটু অবাক হল অর্ক। বিশ্বজিৎ সিপিএম করে না, আগে কংগ্রেসি ছিল, এখন কি তৃণমূলে?

২৬-৩০. দরজা বন্ধ

দরজা বন্ধ। কড়া নাড়তেই শব্দ ছড়াল। সেকেন্ড দশেকে পৃথিবীর কেউ কেউ একশো মিটার দৌড়ে যায়, কিন্তু দরজা খুলল না। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তেই পেছন থেকে এক বিধবা বুড়ি বলল, চোরের মতন থাকে, সহজে সাড়া দেয় না।

এই বুড়ি বৃষ্টি না হলে গলির পাশে দরজার গায়ে বসে থাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। কে যাচ্ছে, কে আসছে তা নাকি শকুনের মতো খুঁটিয়ে দেখে। এক রাত্রে কাজ থেকে ফিরছিল অর্ক, বস্তির একটি যুবতী বউ তার কিছুটা সামনে হেঁটে এখান দিয়ে ফিরছিল। বুড়ি ডাকল, ও বউ! যখন বেরোস তখন তো পাই না। ফেরার সময় এত ফুলের বাস ছড়িয়ে কোত্থেকে ফিরিস?

বউটি থমকাল, উঃ, সব গেছে কিন্তু নাক আর চোখ গেল না। মরলে বস্তির লোক বেঁচে যাবে। বউটি চলে গেলে বুড়ি অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল, সত্যি কথা আজকাল কারও ভাল লাগে না। অর্ক জবাব দেয়নি। দরজা খুলল রামজি, খুলে অর্ককে দেখে হেসে হিন্দিতে বলল, সরি, ল্যাট্রিনে ছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?

দরজা বন্ধ করে উঠোনে দাঁড়িয়ে অর্ক বলল, ওখানে তেমন কোনও কাজ ছিল না। আপনি কেমন ছিলেন? অসুবিধে হয়নি তো?

হাসলেন রামজি, তেমন কিছু নয়। যা হয়েছে তা স্বাভাবিক। চা বানাই?

মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকে গেল অর্ক। চারপাশে তাকিয়ে খুশি হল সে। মা বাড়িতে থাকতেও এই ঘর এত গোছানো থাকত না। রামজির রুচি খুবই ভাল।

বাড়িতে যেহেতু কোনও মহিলা নেই তাই রামজি বারমুডা আর গেঞ্জি পরে থাকে। প্রথম দিনেই সে অর্কর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে হলে হয় হিন্দি নয় ইংরেজি বলতে হয়। অর্ক হিন্দিতে স্বচ্ছন্দ নয়, বলার সময় কোনও কোনও শব্দের হিন্দি জানা না থাকায় বাধ্য হয়ে বাংলাটাই বলে। রামজির গুণ হল শব্দ না বুঝলেও প্রশ্ন করে না।

শরীর আরাম চাইছিল। বাথরুমে ঢুকে একেবারে স্নান করে বেরিয়ে এল অর্ক। রামজি দুটো প্লেটে রুটি তরকারি নিয়ে এল। অর্ক খুশি হল, বাঃ, খুব খিদে পেয়েছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।

জলপাইগুড়িতে যাওয়ার আগে সে রামজিকে খাবার বানাতে দেয়নি। সকালে ভাতে-ভাত নিজেই করত। রাত্রের খাবার বেলগাছিয়ার মোড়ের ঠাকুরের দোকান থেকে কিনে আনত। এখন খেতে খেতে বুঝল রামজিরা নিশ্চয়ই মোটা মোটা রুটি খায়। মোটা হলেও সুস্বাদু।

পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে আপনাকে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। রামজি হাসল, তেমন কিছু না। আমি কে? কোত্থেকে আসছি? আপনার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? এইসব। এই গলিতে যে বুড়ি বসে থাকে সে আমার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছে।

কী বলেছে?

আমি ভালমানুষ, বাড়ির ভিতর চুপচাপ থাকি। আমার কাছে এখন পর্যন্ত কোনও লোককে আসতে দিইনি। বস্তির কোনও মেয়ের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাই না। রামজি হাসল।

পাড়ার ছেলেদের কী জবাব দিয়েছেন?

একটু মিথ্যে বলতে হল। আমার ভোটার কার্ডে লেখা আছে আমি বলরাম মাহাতো। তাই বললাম, নাম বলরাম। থাকি হাজারিবাগে। আমার পাশের বাড়ির বাঙালিদাদার অনুরোধে অর্কদাদা থাকতে দিয়েছেন। ওঁরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তেন। আমি এখানে এসেছি চাকরির খোঁজে। ইন্টারভিউ দিয়েই চলে যাব।

রামজি উঠে ঘর থেকে ভোটার কার্ড নিয়ে এসে অর্ককে দিল, এই কার্ড দেখে ওরা আর কোনও প্রশ্ন করেনি। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?

এ পাড়ার একটি ছেলে যে আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূলে আছে, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। অর্ক বলল। রুটি শেষ হলে রামজি রান্নাঘরে গিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে এল। চা খেতে খেতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, জীবনদার কাছে গিয়েছিলে?

না। ওঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। উনি সন্দেহ করছেন বাড়ির ওপর ওয়াচ রাখা হচ্ছে। ফোন করতে বলেছেন। কিন্তু মোবাইল অফ করা আছে। রামজি নিচু গলায় বলল, আমি বাঙালি নই বলে কারও সন্দেহ হতে পারে, আপনি যদি একবার খোঁজ নেন–। এভাবে চুপচাপ কতদিন বসে থাকব?

অর্ক মাথা নাড়ল, জীবনদা আমাকেও যেতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, দরকার হলে তিনিই ফোন করবেন।

তা হলে আমি কি মেদিনীপুরে চলে যাব?

মেদিনীপুরের কোথায়?

হলদিয়ায়। ওখানে রামপ্রকাশ আছে।

রামপ্রকাশ কে?

রামপ্রকাশ মাহাতো, আপনি চিনবেন না।

আমার মনে হয় আপনি আরও দু-তিন দিন অপেক্ষা করে যান।

আপনার পেরেন্টস কবে আসবেন?

দেরি আছে। ওদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। অর্ক উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কে?

অল্পবয়সি গলায় জবাব এল, অর্কদা, আপনাকে সুরেনদা এখনই যেতে বললেন। খুব জরুরি।

কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল অর্ক, ঠিক আছে।

সুরেন মাইতির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কথাবার্তাও হয় না। লোকটা একশোভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত, উদ্ধত। বস্তির লোকেরা ভয় পায় বলে চুপ করে থাকে। সে রামজির দিকে তাকাল, আপনার সঙ্গে যারা কথা বলতে এসেছিল তারা কোন পার্টির লোক?

রামজি বলল, আমি তো ওদের চিনি না–!

খুব উদ্ধত, মানে, মেজাজ দেখিয়ে কথা বলেছে?

না না। অস্বাভাবিক ব্যবহার করেনি। রামজি বলল।

একটু চিন্তায় পড়ল অর্ক। শুধু ঈশ্বরপুকুর লেন কেন গোটা পশ্চিমবঙ্গে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার সুরেন মাইতির পার্টি ছাড়া আর কারও এই মুহূর্তে নেই। অথচ রামজি বলছে পাড়ার যেসব ছেলে এসেছিল তারা স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। কী করে সম্ভব? সে বলল, দরজাটা বন্ধ। করে দিন, আমি একটু ঘুরে আসছি।

কোথায় যাচ্ছেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

এই এলাকার সিপিএমের সর্বময় নেতা সুরেন মাইতির কাছে হাজিরা দিতে।

এখনই সংঘাতে যাবেন না। রামজি বলল। হেসে বাইরে বেরিয়ে দরজা টেনে দিল অর্ক।

গলিতে পা বাড়াতেই সেই বুড়ি ডাকল, ও ছেলে, খবর শুনেছ?

কী খবর?

ওই যে মেয়েটা, যাকে তোমার মা আশ্রয় দিয়েছিল, সে পালিয়ে গেছে।

পালিয়ে গিয়েছে মানে? অর্ক অবাক হয়ে গেল।

পালিয়ে যাওয়া মানে বোঝে না? সরল কথা। বুড়ি বলল।

ওপাশের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল একটি অল্পবয়সি বউ। সে ঝঝিয়ে উঠল, তোমার দোষ কী জানো? তুমি অর্ধেক বলো অর্ধেক পেটে রেখে দাও। সুজাতা এখানে নেই। আমাদের বলেছে এখানে থাকতে তার ভয় করছে। কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় কলকাতার বাইরে থাকে, তার কাছে চলে গেছে। পালিয়ে যায়নি। অবশ্য কোথায় গিয়েছে তার ঠিকানা বলেনি। বউটি বলল।

অর্ক আর দাঁড়াল না। তার মনে হল, এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ এই মুহূর্তে বেঁচে আছে। প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনও সমস্যায় কম বেশি ভুগছে। এক-একজনের এক এক রকমের সমস্যা। কেউ সম্পূর্ণ সমস্যা মুক্ত হয়ে বেঁচে নেই। কোটি কেন, আশেপাশের দশজনের সমস্যা শুনে যদি কেউ সমাধানের চেষ্টা করে তা হলে তাকে পাগল হয়ে যেতে হবে। অথচ রাস্তাঘাটে বা বাড়িতে ওইসব মানুষগুলো এমন মুখ করে থাকে যে মনে হবে তাদের কোনও সমস্যা নেই। অন্যের সঙ্গে তো বটেই, এখন নিজের সঙ্গেই অভিনয় করতে মানুষ বেশ পটু হয়ে গিয়েছে। অর্ক বস্তি থেকে বেরিয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সুরেন মাইতির গলা রাস্তায় পৌঁছোচ্ছিল। কাউকে খুব ধমকাচ্ছে। অর্ক দরজায় পৌঁছে দেখল একজন মধ্যবয়সিনি মহিলা বালিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সুরেন মাইতি তার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল, আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান মা। আপনি কাকে বাড়ি ভাড়া দেবেন সেটা নিয়ে কেউ আপনাকে কোনও কথা বলবে না। যদি বলে তা হলে তাকে এ পাড়া ছেড়ে যেতে হবে। মা-বোনেদের ইজ্জত সবার আগে। যান আপনি।

কী বলে যে ধন্যবাদ দেব– ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞ গলায় বললেন।

ছি ছি ছি। এসব কী বলছেন। আসুন।

ভদ্রমহিলা বালিকাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ঘরের একপাশের বেঞ্চিতে বসা ছেলেদের একজনকে বলল, অ্যাই! উঠে দাঁড়া। ছেলেটা উঠল।

অর্ক দেখল একেবারে লপেটামার্কা চেহারা। পরনে জিন্স আর গেঞ্জি। শরীরে মাংস নেই কিন্তু হাতে বালা আর গলায় হার আছে।

অ্যাই! হাঁড়ির জলে চাল ফেললেই ভাত হয়ে যায়? সুরেন জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়ল ছেলেটা, না।

ভাতটা হওয়ার জন্য সময় দিতে হয়। কিছু বুঝলি? ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

গুড। যা এখান থেকে। তর সইছিল না।

অর্ক বুঝতে পারল একেই একটু আগে ধমকাচ্ছিল সুরেন মাইতি।

আমাকে ডেকেছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আরে। আসুন আসুন। কিন্তু আপনি এটা কী বললেন? আমি কি আপনাকে ডাকতে পারি? আপনার বাবা কত বড় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন, আপনার মায়ের মতো মানুষ বস্তিতে ছিলেন এটাই ভাগ্যের কথা। আর আপনি, কত অল্প বয়সে বস্তিতে কমিউন করার চেষ্টা করেছিলেন। আপনাদের পরিবারের যে ইতিহাস তাতে আমারই উচিত ছিল দেখা করতে যাওয়া। যেতামও। কিন্তু মাঝখানে ওই ভদ্রমহিলার কেস এসে পড়াতে–, বসুন বসুন। অ্যাই, চা বল। সুরেন মাইতি হাঁক দিল।

আমি কয়েক মিনিট আগে চা খেয়েছি। অর্ক বলল।

অ। ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে কী ব্যাপারে কথা বলব যেন–। টেবিলে টোকা মারল সুরেন মাইতি, ও হ্যাঁ, আপনার বাবা-মা তো এখন জলপাইগুড়িতে। আপনিও গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ।

পৈতৃক বাড়ি। যাবেনই তো। আপনার কোনও বন্ধু বোধহয় এখানে ছিল!

হ্যাঁ। ছিল। অর্ক বলল, এখনও আছে।

থাকতেই পারে। আমার বাড়িতে আমি কাকে রাখব সেটা আমিই ঠিক করব। কিন্তু পাড়াপড়শির তো ঘুম নেই। আমি শুনলাম ওই যে ছোকরা, আগে কংগ্রেস করত এখন তৃণমূল করে, সে নাকি ছেলে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। আমরা সিপিএম পার্টির কর্মীরা ডিসিপ্লিন মেনে চলি কারণ আমাদের পার্টির একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। যাকে সংবিধানও বলতে পারেন। ওদের কী আছে? নাথিং। একজন মহিলা হয়ে দলটাকে বহন করছেন। তিনি যা বলবেন তা এদের কানে কতটা পৌঁছাবে কে জানে! তা শোনামাত্র মনে হল আমার উচিত আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করা। আপনার ব্যাপারে নাক গলিয়েছে ওরা, আপনি ক্ষমা করে দিন। খুব বিনীত গলায় কথাগুলো বললেন সুরেন মাইতি।

ওরা এমন কিছু বলেনি যে আপনাকে এসব কথা বলতে হবে।

বলেনি?

না।

আপনাদের বলেনি কিন্তু প্রচার করছে। আমরা নাকি অবাঙালি বাইরে থেকে এনে পাড়ায় লুকিয়ে রাখছি। সময় হলেই তাদের কাজে লাগাব। শব্দ করে হাসল সুরেন মাইতি। তারপর মুখে খানিকটা পানবাহার ছুঁড়ে দিয়ে বলল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বাইরে থেকে লোক আনতে হবে কেন? সুরেন মাইতি তো মরে যায়নি। যাক গে, শুনলাম, লোকটা নাকি অবাঙালি?

হ্যাঁ।

কোথায় বাড়ি?

আপনার কি সেটা জানার খুব দরকার?

আরে না না। কথার পিঠে কথা বলছি। আপনি শুধু বলুন, ওকে বিলক্ষণ চেনেন কি না!

চিনি।

এই তো সমস্যায় ফেললেন।

কেন?

আপনি তো বেলগাছিয়ার বাইরে মাত্র দুবার গিয়েছেন। তাও জলপাইগুড়িতে। একজন অবাঙালিকে চেনার স্কোপ পেলেন কী করে?

আমার স্কুলের এক বন্ধু চাকরি নিয়ে হাজারিবাগে গিয়েছে। ও থাকে এই ছেলেটির পাশের বাড়িতে। তার কাছেই এর কথা শুনেছি। ও ফোনে বলেছিল ছেলেটি চাকরির পরীক্ষা দিতে কলকাতায় আসবে কিন্তু থাকার জায়গা নেই। আমি যদি থাকতে দিই তা হলে ও খুশি হবে। আমি রাজি হলে ও এসে ওর ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, অ্যাডমিট কার্ড দেখায়। বুঝতেই পারছেন, আমি কোনও উটকো লোককে বাড়িতে ঢোকাইনি। অর্ক স্পষ্ট করে কথাগুলো বলল।

হয়ে গেল। জলের মতো সহজ হয়ে গেল। সুরেন মাইতি দুরে দাঁড়ানো পার্টির ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, নেই কাজ তো খই ভাজ। যত উলটোপালটা কথা কানে ঢোকাচ্ছে। সরি, আপনাকে কষ্ট দিলাম।

অর্ক যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা বলুন তো, এই যে আপনি এলেন, আমি কি খারাপ ব্যবহার করেছি? আপনার সঙ্গে উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলেছি?

একদম নয়।

গুড। এই কথাটা যদি বস্তির মানুষকে বলেন তা হলে খুব খুশি হব। উঠে দাঁড়াল সুরেন মাইতি, অপপ্রচার। আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। দেশের উন্নতি করতে শিল্পস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শিল্প তো আকাশে তৈরি হতে পারে না। কলকারখানা করতে জমি দরকার। মানেন তো?

নিশ্চয়ই।

তা হলে? আপনি বুঝলেন। কিন্তু ওরা কৃষকদের খেপাচ্ছে। কারখানার জন্যে শিল্পপতিদের জমি চাই। কৃষকদের সমস্ত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে একফসলি জমি যদি কারখানার জন্যে নিতে চাই তা হলে বলা হচ্ছে আমরা তাদের গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছি। এক বিঘে জমিতে খরচ করে চাষের পর যে ধান হয় তার দাম কত? একজন কৃষককে সেই এক বিঘের জন্যে যে টাকা দেওয়া হবে তা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদের পরিমাণ পাঁচ গুণ হবে। আরও ভালভাবে বাঁচতে পারবে তারা। কিন্তু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে জমিকে মা বানিয়ে ভূমি রক্ষা আন্দোলন করানো হচ্ছে। মানুষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল কেউ যদি তার সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেয় তা হলে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দেখুন, এত বছর গেল, কংগ্রেসকে কোথাও দেখেছেন? সাইনবোর্ডের দল হয়ে গেছে। ওই সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে নতুন দলটা দাঁড়াতে চাইছে।

অর্ক হাসল, আমাকে এসব বলছেন কেন? আমি শহরের মানুষ, জমিজমা নেই। রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখি না। চলি।

হুম। আমাদের বড় শত্রু হল মাওবাদীরা। ওরা মদত পাচ্ছে এদের কাছ থেকে। এখন কলকাতা শহর হল মাওবাদীদের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। একটা প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন আপনার অতিথির রেকর্ড থানায় থাকা উচিত। আমি বড়বাবুকে বলে দেব যাতে আপনি গেলে ভাল ব্যবহার করেন। না বললে, বুঝতেই পারছেন, পুলিশের চরিত্র বদলায় না।

অর্ক আর দাঁড়াল না। সুরেন মাইতিকে তার এতকাল মনে হত একজন গোঁয়ার, অশিক্ষিত, উদ্ধত মানুষ যে নেতাদের পায়ে তেল দিয়ে ক্ষমতা হাতে রেখে চলেছে। আজ বুঝতে পারল, পার্টি ওর ব্রেনওয়াশ এমনভাবে করেছে যে শিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলা রপ্ত করতে পেরেছে।

গলিতে ঢোকার পরেই বুড়ির গলা কানে এল, ও বাবা, দাঁড়িয়ে যাও।

আবার কী হল? অর্ক দাঁড়াল।

বস্তির ওপাশের অলকা দুবার তোমার দরজা থেকে ঘুরে গেছে। আমি যত বলি তোমরা বাড়ি নেই, বিশ্বাস করে না। ভগবান শরীর দিয়েছে বলে বড্ড দেমাক ওই মাগির। আবার নিশ্চয়ই আসবে। কী বলে তা আমাকে জানিয়ো তো! বুড়ি চকচকে চোখে কথাগুলো বলল।

দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ার পর অর্ক একটু জোরে বলল, খোলো।

রামজি দরজা খুলে বলল, একজন মহিলা দুবার দরজায় শব্দ করে ডেকেছিল। আমি খুলতে ভরসা পাইনি।

ঠিক করেছ।

কী কথা হল?

অনেক আলতু ফালতু কথা। আচ্ছা, রামপ্রকাশের কোনও ফোন নাম্বার আপনার জানা আছে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ মোবাইল নাম্বার জানি।

আপনি ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করুন আজকালের মধ্যে ওর কাছে। যেতে পারেন কি না?

অর্কর কথা শুনে রামজির চোখ ছোট হল। বোতাম টিপে যন্ত্রটা কানে চেপে বলল, সুইচ অফ। ঠিক তখনই ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। অর্ক অবাক হয়ে দেখল একজন মহিলা দাঁড়িয়ে হাসছেন।

.

২৭.

অর্ক কিছু বলার আগেই মহিলা ভেতরের উঠোনে চলে এল। তার বাঁ হাত কপাল থেকে চুল সরাল, মাসিমাকে ডেকে দিন না।

আপনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি অলকা।

মা এখন এই বাড়িতে নেই। অর্ক বলল।

যাঃ। আপনিও ওই বুড়ির মতো কথা বলছেন।

আশ্চর্য! অর্ক বারান্দায় বসা রামজির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে সত্যি কথা বলছি। মা এখন কলকাতাতেই নেই।

এবারে মহিলার মুখের অবিশ্বাসের হাসি মিলিয়ে গেল, কবে আসবেন?

কোনও ঠিক নেই।

উনি তো কখনও বাইরে যান না!

দরকার বলে গিয়েছেন।

মহিলা অকারণে বুকের আঁচল টানল। অর্ক লক্ষ করল এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না মহিলা। শরীরের ভার কখনও বাঁ পায়ে কখনও ডান পায়ের ওপর রাখছে। এবার বলল, এখন আমি কী করব?

বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল মহিলা খুব হতাশ হয়ে পড়েছে, সেটা বুঝেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মায়ের সঙ্গে কী দরকার ছিল তা যদি বলেন।

চোখ তুলে কাতর গলায় বলল মহিলা, পারবেন আমায় সাহায্য করতে?

না শুনলে কী করে বলব?

আ-আমি একটু বসতে পারি?

অর্ক ঘর থেকে একটা মোড়া এনে বারান্দায় রাখলে মহিলা সেখানে বসে রুমালে গলা এবং কাধ মুছল। তারপর রামজির দিকে তাকাল, উনি–!

বাংলা বোঝেন না। ওঁর সামনে কথা বলতে পারেন। অর্ক বলল।

আমার মেয়েটাকে মাসিমার স্কুলে ভরতি করতে চাই। নিজে গিয়েছিলাম, বলছে, ক্লাস টু-তে ভরতি হবে না। কিন্তু ভেতর থেকে জানতে পারলাম তিনটে সিট খালি আছে। শুনলাম হেডমিস্ট্রেসের কোটা আছে। মাসিমা যদি হেডমিস্ট্রেসকে আমার মেয়ের কথা বলে দেন তা হলে খুব উপকার হবে।

মা অবসর নিয়েছেন অনেকদিন হয়ে গেল!

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহিলা বলল, তাতে কী হয়েছে। আমি স্কুলে গিয়ে শুনে এলাম সবাই এখনও মাসিমার কথা বলে। একজন তো বলেই দিল, মাধবীলতা দিদিকে ধরুন, উনি বললে হয়ে যাবে।

অর্ক হেসে ফেলল, তা হলে মায়ের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আপনি বলছেন কবে ফিরবেন ঠিক নেই!

ঠিকই বলেছি।

আপনার সঙ্গে হেডমিস্ট্রেসের চেনা নেই?

না।

কিন্তু নাম বললে তিনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। মহিলা করুণ চোখে তাকালেন।

বেশ অবাক হয়ে গেল অর্ক। মহিলার সমস্যা প্রবল বলে দিশেহারা হয়ে এইরকম কথা বলছেন। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মেয়ে এখন কোন স্কুলে পড়ে?

দত্তবাগানের একটা স্কুলে।

সেখানে কী অসুবিধে হল?

ওখানে সমস্যা হয়েছে বলেই তো।

সমস্যা কী?

দেখুন, আমার স্বামী অফিসে কংগ্রেসি ইউনিয়ন করেন। পইপই করে বলেছি, করতে হলে সিপিএমের ইউনিয়ন করো, কিন্তু শোনেনি। সেই মহাত্মা গাঁধীর ঘি হাতে মেখে গন্ধ শুঁকে চলেছে। আদর্শে বিশ্বাস করে। একবার ইউনিয়নের ইলেকশনে জিতেছিল বলে মাথা ঘুরে গেছে। অথচ ওর সঙ্গে যারা কাজ করে তারা সিপিএমের লোক বলে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। মহিলা শ্বাস ফেলল।

আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। অর্ক বলল।

হ্যাঁ। ওই দত্তবাগানের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ডেকে পাঠিয়ে বলল, মেয়েকে অন্য স্কুলে নিয়ে যান। এখানে রাখা যাবে না।

কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

প্রথমে কিছুতেই বলতে চায় না। তারপর আমাকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি কংগ্রেসি ফ্যামিলি? আমি না বললে তিনি মাথা নাড়লেন, সত্যি বলছেন না। আপনার স্বামী এতদিন কংগ্রেসি করতেন এখন তৃণমূলে ঢুকেছেন। এর বেশি আপনাকে কিছু বলতে পারব না। এখন ভরতি চলছে, মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়িতে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসা করে আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। উনি যে পার্টি বদলেছেন তা আমাকেই জানাননি অথচ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস জেনে গেছেন। আমি চেঁচামেচি করলে বলল, কংগ্রেস এখন মরা পার্টি হয়ে গিয়েছে। তৃণমূল উঠছে। আর পার্টির সঙ্গে কংগ্রেস নামটা তো রয়েছে। তুমি চিন্তা কোরো না, অন্য স্কুলে ভরতি হয়ে যাবে।

তা হলে আপনি চিন্তা করছেন কেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ছাই হবে। দুদিন সময় নষ্ট করে শেষ পর্যন্ত আপনার মায়ের কথা বলল। আপনি আমার সঙ্গে চলুন না!

কোথায় যাব?

স্কুলে। আপনি বললে হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না।

আমি একটু ভাবি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মা রাজি হলে যেতে পারি। তা ছাড়া মা চাইলে হেডমিস্ট্রেসকে ফোনও করতে পারেন। আমি এই প্রথম শুনলাম, বাবা বিরোধী পার্টি করে বলে মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হচ্ছে। কী ভয়ংকর অবস্থা। অর্ক বলল।

মহিলা গলা নামাল, আমি সুরেন মাইতির কাছেও গিয়েছিলাম।

ও। কী বললেন তিনি?

প্রথমে খুব খেপে গেলেন ও কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গিয়েছে বলে। বললেন, কংগ্রেসে ছিল, ওটা থাকা আর না থাকা তো একই কথা, কিন্তু কোন আকেলে তৃণমূলে গেল? এ তো আমাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামা! আমি বললাম, এ কথা কেন বলছেন। আমি বা আমরা কি কখনও আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি? তা ছাড়া ও তো কোনওভাবে রাজনীতি করে না। বস্তিতে কখনও কি দেখেছেন আপনাদের বিরুদ্ধে মিটিং করতে? আপনার ওপরই ভরসা করি।

অর্ক হাসল, কী বললেন তিনি?

অনেক বলার পর একটু নরম হলেন। বললেন, স্কুলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন। একদিন সন্ধেবেলায় ওঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে যেতে হবে।

গিয়েছিলেন?

না না। ওকথা বলার সময় উনি যেভাবে তাকিয়েছিলেন তারপর যেতে সাহস হয়নি। মেয়েরা পুরুষের কিছু কিছু চাহনি চিনতে পারে। মহিলা আবার জোরে শ্বাস ফেলল, বুকের আঁচল টানল। অর্ক বুঝল ওটা ওর অভ্যেস।

ঠিক আছে তা হলে? অর্ক কথা শেষ করতে চাইল।

আপনি এখানে এখন একাই থাকেন?

একা কোথায়? আমার এই বন্ধু তো আছেন।

ও। রান্না করেন আপনারা?

দুর। যা করি তাকে রান্না বলে না!

আমি তো বস্তির ওপাশে থাকি। মাঝে মাঝে এসে একটা-দুটো পদ যদি বেঁধে দিই তা হলে নিশ্চয়ই না খেয়ে ফেলে দেবেন না!

তার কোনও দরকার নেই।

মহিলা উঠে দাঁড়াল, আমার নাম নিশ্চয়ই আপনার মনে নেই? অর্ক বলল, অলকা। ওই বুড়ি আগেই বলেছিল।

ওঃ, ওই বুড়ি আপনার কান ভারী করেছে, মহা শয়তান বুড়ি। শুধু ওইখানে বসে শকুনের মতো চারপাশে খুঁটিয়ে দেখে। আমাকে বলে কিনা, ভগবান তোমাকে এমন শরীর দিয়েছে, এই বস্তিতে পড়ে আছ কেন? ও যাই বলুক আমি কিন্তু ওরকম না। আমার পুরো নাম হল অলকা দাস, মেয়ের নাম করিনা দাস। হাসল অলকা।

করিনা? এ তো অবাঙালি নাম!

আজকাল আর বাঙালি অবাঙালির পার্থক্য নেই। আপনি তা হলে আজই মাসিমার সঙ্গে কথা বলবেন, চলি। যেতে ইচ্ছে ছিল না তা বুঝিয়ে অলকা চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে অর্ক রামজির দিকে তাকাল, এই মহিলা যা বলে গেল তার কিছু বোঝা গেল? হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল সে।

রামজি কাধ নাচাল, না।

না বোঝাই ভাল। কিন্তু রামজি, একটা ঘোঁট পাকছে আপনাকে নিয়ে। তৃণমূল তত বলেছে, এখন সিপিএমও খোঁজ নিচ্ছে। আমার মনে হয় আর দেরি না করে হলদিয়াতে চলে যাওয়াই ভাল। অর্ক বলল।

মাথা নাড়ল শ্রীরাম। কিন্তু বোঝা গেল সে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

.

শেষ পর্যন্ত রামপ্রকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল শ্রীরাম। তখন অনেক রাত। অর্ক ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে বসে কথা বলছিল শ্রীরাম। রামপ্রকাশ বলল, এখনই এখানে আসা ঠিক হবে না। মোবাইলে কম কথা বলা ভাল। তুমি কয়েকটা দিন তালসারিতে গিয়ে থাকো। ওখানে শ্রীনিবাস আছে। সাত নম্বরটা কল্পনা করে নেবে। তার কয়েক মিনিট পরে এসএমএস এল–নাইন ফোর ড্যাশ, থ্রি টু ড্যাশ, ওয়ান ওয়ান, ড্যাশ, ড্যাশ।

ড্যাশের জায়গায় সাত বসিয়ে নাম্বারটা মুখস্থ করে ফেলল রামজি। তারপর এস এম এস মুছে ফেলে আর একটা নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হচ্ছে। এখন রাত দুটো। কিন্তু লোকটা সাড়া দিল। শ্রীরাম বলল, শ্রীনিবাসের কাছে যাওয়ার অর্ডার হয়েছে।

বাসে যাও। দিঘার বাসস্ট্যান্ডে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে। হাতে সাদা রুমাল রেখো। লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। শ্রীরাম বুঝতে পারে না সবাই এত সতর্ক কেন? এই রাত্রে কে জেগে থেকে যত মোবাইল ফোন হচ্ছে তার সবগুলোর কথা শুনবে। সে বিড়ি ধরাল। অর্ক বলেছে বিড়ির পোড়া অংশ যেন এক জায়গায় জমা করে রাখে। একটা ভাঁড় সংগ্রহ করে নিয়েছিল সে ওই কারণে।

ভোর চারটের সময় অর্ককে ঘুম থেকে তুলল সে, আমি চলে যাচ্ছি।

এখন? এই রাত্রে? অর্ক একটু বিরক্ত।

রাত কোথায়? ভোর হয়ে আসছে। দিনের আলোয় যেতে চাই না।

কিন্তু এখন হলদিয়াতে কীভাবে যাবেন? এত সকালে কি বাস পাবেন?

হলদিয়াতে যাচ্ছি না। তালসারি নামের এক জায়গায় যাব। ওটা কোথায় তা আপনি কি জানেন? শ্রীরাম তার জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছিল।

মনে পড়ছে না।

দিঘা কোথায়? সমুদ্রের ধারে, না?

হ্যাঁ। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কোথায় যেন পড়েছি। তালসারিও সমুদ্রের ধারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ওড়িশায়। দিঘা হয়ে যেতে হয়। অর্ক বলল।

সেইজন্য আমাকে দিঘায় যেতে বলা হয়েছে।

এখান থেকে বেরিয়ে ট্রাম পেয়ে যাবেন। হাওড়া স্টেশনের পাশ থেকে দিঘার বাস ছাড়ে। মনুমেন্টের ওখান থেকেও পেতে পারেন।

আপনি দয়া করে সাহায্য করবেন?

কী করতে হবে, বলুন।

মুখ ধুয়ে নিন। আমাকে একটু এগিয়ে দিন। এখন রাস্তায় লোক থাকবে না। একা হেঁটে যেতে চাই না। রামজি বলল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে পকেটে কয়েকটা টাকা নিয়ে অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রামজি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ক অনেকদিন পরে শুকতারা দেখতে পেল। দরজায় তালা দিয়ে কয়েক পা হাঁটতেই কণ্ঠস্বর কানে এল, কে যায়?

অর্ক জবাব না দিয়ে আধা অন্ধকারে রামজির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল, বুড়ি চেঁচিয়ে বলছে, আ মরণ, কথার জবাব দেয় না যে, মর, মর! অর্ক হেসে ফেলল।

ঈশ্বরপুকুর লেনের আলোগুলো এখন হলদেটে। দু-তিনজন মানুষ ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। এখনও ঘুম সর্বত্র জড়ানো। রামজির পাশাপাশি হাঁটছিল অর্ক। সে মুখ তুলে দেখল মোড়ের বড় বটগাছটায় এখনও অন্ধকার সেঁটে আছে। রামজি নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, এখন ট্রাম পাব তো?

প্রথম ট্রাম তো এই সময় ডিপো থেকে বের হয়। অর্ক জবাব দিল।

গলি থেকে বের হতেই চোখে পড়ল ভ্যানটাকে। অর্ক কিছু বলার আগেই রামজি জিজ্ঞাসা করল, ভ্যানের পাশ দিয়ে যেতে হবে নাকি?

হ্যাঁ, চলুন। জিজ্ঞাসা করলে বলব আর জি কর হাসপাতালে যাচ্ছি।

সেটা কোথায়?

ব্রিজ পার হয়ে ডান দিকে। নিশ্চয়ই দেখেছেন। আপনি কথা বলবেন না। অর্ক গম্ভীর গলায় বলল। ভ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে কোনও পুলিশকে দেখতে পেল না। এমনকী ড্রাইভারও সিটে বসে নেই।

ডিপোর মুখে ট্রামস্টপে দাঁড়াল ওরা।

হাওড়া স্টেশনের কতদুরে বাসস্ট্যান্ড? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

একদম গায়ে। বলামাত্র ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক। ডিপো থেকে বেরিয়ে আসছে সামনে আলো জ্বেলে। রামজি তৈরি হচ্ছিল ওঠার জন্যে। অর্ক বলল, এটা এক নম্বর ট্রাম, এসপ্ল্যানেড যাচ্ছে, হাওড়ায় নয়।

ও। পিছিয়ে এল রামজি।

আচ্ছা, উঠুন। ট্রাম দাঁড়াতেই রামজির সঙ্গে উঠে পড়ল অর্ক।

একদম ফাঁকা ট্রাম। সামনের দিকে বসে রামজি জিজ্ঞাসা করল, আপনি উঠলেন কেন? আমি নিজেই যেতে পারতাম।

নিশ্চয়ই পারতেন। হঠাৎ মনে হল, এখন ফিরে গেলে আর কেউ না দেখুক, ওই বুড়ি চেঁচাবে। অত ভোরে আমি বেরিয়েই কেন ফিরে এলাম তা নিয়ে বস্তির মানুষের কৌতূহল বাড়বে। যদি কেউ এর মধ্যে জেগে বাইরে আসে সে জানতে চাইবে কোনও বিপদ হয়েছে কিনা! তার চেয়ে একটু বেলা করে ফেরাই ভাল। কেউ প্রশ্ন করবে না। অর্ক বলল।

রামজি হাসল, আপনি তত খুব ভাবেন।

অর্ক কথা বলল না। ট্রাম তখন খাল পেরিয়ে শ্যামবাজারের দিকে ছুটছে। অর্ক লক্ষ করল এখনকার ট্রামের চলনের সঙ্গে দিনের অন্য সময়ের ট্রামের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এখন ঝড়ের মতো ছুটছে ট্রাম, স্টপে লোক না থাকলে দাঁড়াবার প্রয়োজন বোধ করছে না। গোটা দিনে যদি ট্রাম এইরকম রাস্তা পেত।

একবার তালসারিতে আসুন। সমুদ্রের গায়ে যখন তখন ভাল লাগবে। রামজি কথাটা বলতেই ওর দিকে তাকাল অর্ক। বলার ভঙ্গিতে বেশ আন্তরিকতা রয়েছে। হঠাৎ প্রশ্নটা করে ফেলল সে, কিছু মনে করবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, হাজারিবাগ ছাড়ার পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

রামজি হাসল, আমি হাজারিবাগ থেকে এসেছি কিন্তু আমার বাড়ি ওখানে নয়। আমি দুমকার লোক। বাবা-মা মারা গিয়েছেন, এক বোন আছে জামসেদপুরে। ম্যারেড। তাকে অনেকদিন দেখিনি।

তা হলে হাজারিবাগে কী করতেন?

ট্রেনিং। বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল রামজি। হেদুয়ার স্টপ থেকে কয়েকজন ট্রামে উঠে নিজেদের মধ্যে উঁচু গলায় কথা বলতে লাগল। অর্ক বুঝল এরা সবাই ময়দানে যাচ্ছে হাঁটার জন্যে। সামনে পেছনে ওরা বসতেই রামজি গুটিয়ে গেল। কন্ডাক্টর এলে টিকিট দুটো কাটল অর্ক।

এসপ্ল্যানেডের ট্রামডিপো থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজ নিতেই জানা গেল ঠিক পাঁচটার সময় দিঘার বাস ছাড়ছে। সাধারণ চেহারার প্রাইভেট বাস, ভাড়া কম। অর্ধেকও ভরতি হয়নি, রামজি নিজের টিকিট কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়ল, সিটে বসে হাত নাড়ল।

কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়াবার পরে অর্ক দূরে চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। এখন কলকাতায় অন্ধকার সরে গিয়ে ছায়া নেমেছে, সূর্য ওঠেনি। চায়ের দোকানে ভিড় জমেনি। আড়াই টাকায় এক ভাঁড় চা কিনে চুমুক দিতে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হল।

দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? পাশ থেকে একজন প্রশ্ন করলে অর্ক তাকাল, লোকটা একদম অচেনা। বলল, কোথাও না।

কাউকে কি ছাড়তে এসেছেন?

কী ব্যাপার বলুন তো?

না না কোনও ব্যাপার নয়। চারধারে প্রচুর খোচড় ঘুরছে তো। দেখে মনে হল আপনি ভদ্রলোক, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। লোকটা বেশ দ্রুত সরে পড়ল। দিঘার বাস বেরিয়ে গেছে। চা শেষ করে ভাঁড়টা একটা টিনে ফেলতেই চা-ওয়ালা বলল, আপনাকে কী বলছিল?

এখন খদ্দের মাত্র গোটা চারেক। অর্ক হেসে বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি, কাউকে ছাড়তে এসেছি কিনা, যত ফালতু প্রশ্ন।

এই হয়েছে মুশকিল। লোকটা পুলিশ। পাঁচজনের দল রোজ ভোরে আসে। একটু সাবধানে যাবেন। চা-ওয়ালা মাথা নাড়ল।

অর্ক শক্ত হল। লোকটা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে রামজিকে দেখেছে। তা না হলে জিজ্ঞাসা করবে কেন কাউকে ছাড়তে এসেছে কিনা! লোকটা কি রামজিকে সন্দেহ করেছে? একবার মনে হল রামজির মোবাইলে ফোন করে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু মোবাইলের সুইচ অফ থাকাই স্বাভাবিক।

কিছুই হয়নি এমন ভাব করে শিয়ালদার ট্রাম ধরতে এগোল সে। লোকটা যদি তাকে অনুসরণ করে তা হলে কিছুতেই বেলগাছিয়ার হদিশ যেন না পায়। এই সময় হকাররা ভোরের খবরের কাগজ নিয়ে হইহই করে চলে এল। একজন চেঁচিয়ে বলছিল, জোর খবর, জোর খবর, নন্দীগ্রামে জোর আন্দোলন চলছে। মাটি ছাড়বে না মানুষ। জোর খবর।

একটা কাগজ কিনে নিয়ে শিয়ালদার ট্রামে উঠল অর্ক।

.

২৮.

ট্রামের জানলার পাশের সিটে বসে খবরের কাগজ খুলল অর্ক। প্রথম পাতা জুড়ে নন্দীগ্রামের খবর। মুখ্যমন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিং-এ ঘোষণা করেছেন, নন্দীগ্রামের মানুষদের সম্মতি ছাড়া সেখানকার জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, কিন্তু এই ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারছেন না গ্রামের মানুষ। সিপিএমের সঙ্গে ভূমিরক্ষা কমিটির সংঘাত মাঝে মাঝেই হচ্ছে। এই প্রথমবার গ্রামের মানুষ সিপিএমের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। সংঘর্ষে সিপিএম কর্মীরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলেও মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না। মাটি যাদের কাছে মায়ের মতো তারা কিছুতেই বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়। পুলিশ শান্তি স্থাপনের জন্যে গ্রামে ঢুকতে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না, কারণ মাটির পথগুলোকে গ্রামবাসীরা কেটে রেখেছে। গাড়ি ঢুকতে পারছে না। এই অগ্নিগর্ভ পরিবেশকে শান্ত করতে বামফ্রন্ট সরকার এখনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এই অবস্থায় তৃণমূলনেত্রীর সমর্থন পাওয়ায় জমি রক্ষা কমিটি নতুন উদ্যমে প্রস্তুত হচ্ছে।

অর্কর পাশে এসে বসলেন একজন ভদ্রলোক। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে বললেন, আবার একটা ঝামেলা–!

অর্ক কোনও মন্তব্য না করে কাগজটাকে ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল মৌলালির মোড়ে। এই লোকটা পুলিশের লোক কিনা তা কে জানে?

বাসস্টপে মানুষ নেই। বেলগাছিয়ার বাস আসতেই উঠে পড়ল অর্ক। সে নিশ্চিত, কেউ এখন তাকে অনুসরণ করেনি। দু-তিন জন যাত্রী নিয়ে বাস যাচ্ছিল শামুকের গতিতে। অর্ক এবং আর একজন যাত্রী জোরে চালাতে বললেও বধিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল কন্ডাক্টররা। বাসের চালক সম্ভবত আধঘুমে। শেষ পর্যন্ত প্রচুর সময় নিয়ে শ্যামবাজার ইলেকট্রিসিটি অফিসের সামনে এসে বাস থেমে গেল। ড্রাইভার দু-তিনবার ইঞ্জিনে শব্দ করে বেরিয়ে এল, বাস খারাপ হয়ে গেছে। নেমে যান।

ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত বোঝা গেলেও কিছু করার নেই। অর্ক নেমে পড়ল। অন্য যাত্রীটি নাছোড়বান্দা। তিনি বেলগাছিয়াতে যাওয়ার জন্যে বাসে উঠেছিলেন। আবার আর একটা বাসের ভাড়া দেবেন না। অর্ক হেঁটে চলে এল শ্যামবাজারের মোড়ে। আজ পর্যন্ত ছুটি নেওয়া আছে, কাল অফিসে যেতে হবে। সে নেতাজির মূর্তির দিকে তাকাল। মাত্র সত্তর বছর আগেও ভদ্রলোক বেঁচে ছিলেন এখানে। তখনকার মানুষের সঙ্গে এখনকার মানুষের কী বিপুল পার্থক্য হয়ে গেছে। এখনকার কোনও মানুষের মূর্তি বড় রাস্তায় ওইভাবে বসিয়ে পঞ্চাশ বছর পরের জনতা দেখতে চাইবে? অনেক ভেবেও সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কারও নাম মনে এল না।

ওমা! আপনি এখানে?

মহিলার গলা পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অলকাকে দেখতে পেল অর্ক। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে বলল, কাজে এসেছিলাম।

এই, অ্যাত্তো সকালে! চোখ বড় করল অলকা।

অর্ক জবাব না দিয়ে ভাবল ট্রাফিক সিগন্যাল বদলে গেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে বাস ধরবে। অলকা বলল, আপনি তো অদ্ভুত মানুষ!

কেন? না জিজ্ঞাসা করে পারল না অর্ক।

একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না আমি এই সময় এখানে কেন!

নিশ্চয়ই কোনও দরকারে এসেছেন। অর্ক বলল।

উঃ। আমার মেয়ের বাবা রাতে বাড়ি ফেরেননি। মেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে দেখে ওর অফিসের একজনের বাড়িতে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম তিনি নাকি মেদিনীপুরে গিয়েছেন। অথচ বাসায় বলে যাওয়ার কথা মনে রাখেননি। ভাবুন, আমার সকাল থেকে চা খাওয়াও হয়নি।

মেদিনীপুরে যদি কেউ থাকেন তা হলে ফোনে খবর নিতে পারেন।

কেউ থাকে না। ওর বাপ, চৌদ্দ পুরুষ বরিশালের। ও হ্যাঁ, আজ কী হয়েছিল বলুন তো? আপনি কখন বেরিয়েছেন? অলকার মনে পড়ে গেল যেন!

কেন? কিছুই তো হয়নি। অর্ক বলল।

বাপ রে! বুড়ির চিৎকারে সমস্ত বস্তি জেগে উঠেছিল। সবাই ভিড় করে গেল আপনাদের গলিতে। লোক ছুটল সুরেন মাইতিকে ঘুম থেকে তুলতে। ওই বুড়িকে বিশ্বাস নেই। কল্পনা করে নিয়ে যা মনে আসবে তাই বলবে। চোখে হাসি ছড়িয়ে মুখ ঘোরাল অলকা।

সর্বনাশ। বুড়ি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল ঠিকই কিন্তু চলে আসার পরে বস্তিতে যে লোক জমা করবে তা ভাবেনি অর্ক! কিন্তু বুড়ি কি তাদের উদ্দেশে এইসব করেছে। বস্তিতে ফিরে যাওয়ার আগে জানলে সাবধান হওয়া যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কী হয়েছিল তা জানেন?

উঁহু! ভীষণ চা-তেষ্টা পেয়েছে। একা একা দোকানে ঢুকে চা খেতে খুব সংকোচ হয়। কটা মেয়ে একা চা খেতে পারে বলুন। আপনি সঙ্গে থাকলে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে!

কিন্তু এই সকালে তো চায়ের দোকান খোলেনি!

খুলেছে। ওপাশের একটা দোকান খুলে গেছে।

ঘটনাটা জানার জন্যেই অলকার পাশে হেঁটে সেই দোকানটায় ঢুকল অর্ক। চায়ের অর্ডার দিল অলকাই। জিজ্ঞাসা করল, শিঙাড়া আছে?

না নেই। লোকটা চলে গেল।

মুখোমুখি বসে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে বলুন তো?

বলছি। মাসিমার সঙ্গে কথা হয়েছে?

মাসিমা–!

ওঃ। আপনি তা হলে মাসিমাকে ফোন করেননি? আমার মেয়ের ভরতির ব্যাপারটা একদম ভুলে গেলেন?

মায়ের ফোন বন্ধ ছিল। একটু বেলা হলে করব। বলুন!

আমি তো বিছানা ছেড়ে ওই ভিড়ের মধ্যে যাইনি। চিৎকার কানে আসছিল। পরে ঘুম থেকে উঠে পাশের ঘরের স্বস্তিকার কাছে শুনতে পেলাম বুড়ি নাকি শেষ রাত্রে দুজন লোককে দৌড়ে বস্তি থেকে বের হতে দেখেছে। বুড়ি তাদের থামতে বললেও তারা থামেনি। অল্প আলোয় বুড়ি তাদের স্পষ্ট দেখতে পায়নি। নিশ্চয়ই কারও সর্বনাশ করে গেছে ভেবে সে তোক জড়ো করেছে।

তারপর? অর্ক শ্বাস চাপল।

সুরেন মাইতি আসার আগেই বিশ্বজিৎ এসে গিয়েছিল। ওকে চেনেন তো? এখন তৃণমূলের নেতা হয়েছে। আমার স্বামী আর ওর একই পার্টি। দেখা হলেই বউদি বউদি করে ভাব জমাতে আসে। মরণ! কথা থামিয়ে চায়ের কাপ টেনে নিল অলকা। আলতো চুমুক দিয়ে বলল, ওই বিশ্বজিৎ নাকি সবাইকে বলেছিল যে যার ঘর পরীক্ষা করে দেখুন কিছু চুরি গিয়েছে কিনা! সেটা করে যখন কেউ কান্নাকাটি করল না তখন কয়েকজন ছুটল ট্রামরাস্তার দিকে, যদি লোকগুলোকে পাওয়া যায়। কিন্তু খানিকক্ষণ পরে তারা ফিরে এসে যখন বলল কাউকে দেখা যায়নি তখন গুলতানি শুরু হল। কেউ বলল, বুড়ি স্বপ্ন দেখেছিল, কেউ বলল বুড়িকে ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে যেন এরকম চেঁচামেচি করে পাবলিকের ঘুম না ভাঙায়। অলকা চা খেল।

অর্ক একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, আমার কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন কেন?

আরে তারপরই তো সুরেন মাইতি এল, সব শুনে প্রথমে আপনার সঙ্গে কথা বলতে গেল। গিয়ে দেখল বাইরের দরজায় তালা ঝুলছে। অথচ কেউ বলতে পারল না আপনি কোথায় গিয়েছেন। আপনি যে বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন, ওই বাড়িতে আপনার বন্ধু ছিল, এ কথা সবাই জানে। তা হলে গেলেন কোথায় আর কখন গেলেন? কেউ মনেই করতে পারল না আপনাদের যেতে দেখেছে কিনা! তবে আপনাদের বাড়িতে চুরি হবে না, হলে বাইরের দরজায় তালা থাকত না। চা শেষ করতে গিয়ে থমকে গেল অলকা, এ কী! চা খাচ্ছেন না কেন?

খাচ্ছি। কাপ তুলল অর্ক।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? অলকা তাকাল।

আপনি তো পাড়ার কারও সঙ্গে মেশেন না। কেন?

চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ক হাসল, সময় পাই না।

আপনি কি সবসময় এইরকম কম কথা বলেন?

কী জানি!

আমি কথা না বলে থাকতে পারি না। অলকা বলল, হ্যাঁ, সংসার চালানোর জন্যে মাসের প্রথমে ঠিকঠাক টাকা আমায় স্বামী দেন। কিন্তু সমস্ত ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হয়। তিনি তো টাকা দিয়েই খালাস। মেয়ের পড়াশোনা থেকে বাজার-রান্না এক হাতে করতে হয় আমাকে।

অর্ক মুখ তুলে তাকাল, ও!

এখন আমাদের সম্পর্ক দাদা-বোনের মতো। অলকা বলল।

সেটা খারাপ নয়। অর্ক গম্ভীর মুখে বলল।

আপনি অদ্ভুত লোক তো! মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যাই। বাবা নেই কিন্তু বউদির কথা ভেবে যেতে পারি না। ও হ্যাঁ। যে কথা বলছিলাম, আমি তো কথা না বলে থাকতে পারি না। মেয়ের বাবা বলত আমি নাকি বড় বেশি কথা বলি। কিন্তু একটা কথা কখনও বলিনি তাকে। অলকা হাসল।

ওঁকে যখন বলেননি তখন মনে রেখে দেওয়াই ভাল।

কিন্তু আমি যে সমস্যায় পড়েছি। বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে ভাবতে হত না। দাদা-বউদিকেও বলা যাবে না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?

দেখুন, আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার হলে আমাকে বলবেন না। আমার সঙ্গে আপনার মাত্র দুদিন কথা হয়েছে, কেউ কাউকে চিনি না–

শুনুন মশাই, অবিবাহিতা মেয়েরা অনেক সময় অন্ধ হয় কিন্তু যে বিবাহিতা মেয়েকে সব সামলাতে হয় সে মানুষ চিনতে ভুল করে না।

অলকার কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল অর্ক, বেশ, বলুন।

বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার নামে কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন কাউকে না জানাতে। অলকা বলল।

বাঃ, ভাল কথা।

কিন্তু সময়টা শেষ হয়ে গিয়েছে। টাকাটাও দ্বিগুণ হয়েছে। অলকা বলল, মেয়ের বাবা ব্যাপারটা জানেই না। আমি এখন বুঝতে পারছি না ওই টাকাটা নিয়ে কী করব?

আপনার বাবা বলেছিলেন কাউকে না জানাতে, আমাকে জানালেন কেন?

বললাম না সমস্যায় পড়েছি, মাথায় কিছু ঢুকছে না।

আপনি সমস্যা ভাবছেন তাই–আসলে কোনও সমস্যাই নেই। ব্যাঙ্কে গিয়ে আবার পুরো টাকাটাই এমন সময়ের জন্যে ফিক্সড করে দিন যাতে অঙ্কটা আরও বেড়ে যায়। আপনার মেয়ে যখন বড় হবে তখন ওর পড়াশোনার প্রয়োজনে খরচ করবেন। অর্ক বলল।

হাসি ফুটল অলকার মুখে। বলল, ঠিক বলেছেন, ওর দাদুর টাকা ওর পড়াশোনায় লাগুক। আর একটা কথা, বাবার কথা আমি পুরোটা অমান্য করিনি।

মানে?

উনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে। আমি পুরোটা বলিনি। উনি কত টাকা আমার নামে রেখেছিলেন তা কি আপনি জানেন?

না।

ব্যস। কথা রাখা হয়ে গেল।

হেসে ফেলল অর্ক। তার মনে হল অলকা আদৌ জটিল নয়। চায়ের দাম দিয়ে অর্ক বলল, আপনি এখোন, আমি পরে যাব।

উঁহু। আপনি আগে যান, আমি বাজার করে বাসায় যাব। অলকা উঠে দাঁড়াল, মনে করে ফোন করবেন কিন্তু।

করব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই বাস পেয়ে গেল অর্ক। খালি বাস। উঠেই বসে পড়ল সে। জানলার বাইরে তাকাতেই পাঁচ মাথার মোড়ে মানুষের চলাফেরা নজরে এল। এইসব মানুষ প্রত্যেকেই সমস্যা নিয়ে চলাফেরা করছে। আলাদা আলাদা সমস্যা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখে একটা ছোট বাজার প্রতি সকালে বসে। সেখান থেকে আলু পেঁয়াজ আদা রসুন আর ডিম কিনে নিল অর্ক। একদম টাটকা পাবদা মাছ চোখে পড়তে এক মুহূর্ত থমকে ছিল সে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ! মাছ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে যদি ফেলে দিতে হয়! তার চেয়ে যেটা পারে সেটা করাই ভাল।

বস্তির মুখে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকদিন আগেও ছেলেটাকে প্রকাশ্যে কথা বলতে দেখা যেত না। নন্দীগ্রামের আন্দোলন এবং তৃণমূলের সক্রিয় সমর্থনের পর কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা বিশ্বজিতের সাহস বোধহয় একটু বেড়েছে। এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছে সে। অর্কর অনুমান, সিপিএম পার্টি ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

বাজার করে এলেন? বিশ্বজিৎ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।

প্ল্যাস্টিকের থলে একটু ওপরে তুলে অর্ক বলল, যদি এটাকে বাজার বলা যায়! খেতে হবে তো!

মাসিমারা কবে ফিরবেন? তদ্দিন তো আপনাকেই রাঁধতে হচ্ছে!

ফিরবেন। তবে দিন ঠিক হয়নি।

আপনাদের দরজায় তালা দেখলাম। গেস্ট চলে গেলেন?

হ্যাঁ। আজ ভোরের বাসে চলে গেল। ওকে পৌঁছাতে গিয়েছিলাম।

দেখুন কাণ্ড!

কেন? কী হয়েছে? প্রশ্ন করার ফাঁকেই অর্ক দেখছিল তাদের আশেপাশে মানুষ জমছে।

আরে, আপনাদের গলির ওই বুড়ি, ভোররাতে চিৎকার করছিল, বস্তিতে চোর ঢুকেছে। কারও কিছু চুরি যায়নি কিন্তু বুড়ি নাকি স্পষ্ট দেখেছে দুটো লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার ঠিক আছে শুধু আপনাদেরটা জানা হয়নি, কারণ দরজায় তালা রয়েছে। তালা যখন ভাঙেনি তখন ভেতরে চোর ঢুকবে কী করে? তখন কথা উঠল, আপনারা গেলেন কোথায়? বিশ্বজিৎ বলল।

তারপর? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমি বললাম, উনি কোথায় যাবেন তা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাঙালি সবচেয়ে ভালবাসে সন্দেহ করতে। হঠাৎ বড়দাদা হাওয়ায় কথা ভাসালেন। আপনার মা-বাবা আজ ফিরে আসছেন বলে গেস্টকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছেন। কারণ হল, আপনার গেস্টকে ওঁরা একদম পছন্দ। করবেন না। ছেলের গেস্টকে অপছন্দের কারণ কী? এই নিয়ে জল্পনা চলেছে। আপনি যান, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ নাক গলাক তা আমরা চাই না। বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল বিশ্বজিৎ।

গলিতে ঢুকল অর্ক। বুড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গলা ভেসে এল, অই তো। এসে গেছ? কখন গেলে তা তো দেখলাম না। তোমার বাড়ির সেই উটকো লোকটাও নাকি আর নেই। দেখো, চুরি করে পালাল কিনা!

.

ডিমের ঝোল মোটামুটি ম্যানেজ করতে পারে অর্ক। সেটা নামাতেই বাইরের দরজায় শব্দ হল। সাড়া দিয়ে গেট খুলতেই সুরেন মাইতির হাসিমুখ দেখতে পেল অর্ক। পেছনে দুটো চামচে দাঁড়িয়ে আছে।

আরে! আপনি? আসুন। অর্ক সরে দাঁড়াল।

চামচেদের ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকল সুরেন মাইতি। চার পাশে তাকিয়ে বলল, এই বস্তিতে এরকম বাড়ি আর একটাও নেই। নিজস্ব উঠোন, দুটো শোওয়ার ঘর, কিচেন, টয়লেট, বারান্দা। ওটা কী গাছ?

ডুমুর।

অদ্ভুত গাছ। ফুল হয় না কিন্তু ফল হয়। ইন্টারেস্টিং। বারান্দায় চেয়ার এগিয়ে দিতে সুরেন মাইতি বসল, তা হলে আপনার মা-বাবা আজ ফিরছেন? ভাল ভাল।

অর্ক হাসল, এখনও ফেরার দিন ঠিক হয়নি।

তাই নাকি? ও। তা হলে আপনার গেস্টকে তো কদিন থাকতে বলতে পারতেন।

কেউ না থাকতে চাইলে তাকে কি জোর করে রাখব?

তা বটে। থাকতে চাইল না কেন?

ওর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।

কোথায় যেন বাড়ি?

হাজারিবাগে।

ওইসব অঞ্চলে তো মাওবাদীরা থিকথিক করছে।

আমি যাইনি কখনও–

আরে জানতে গেলে কি সবসময় যেতে হয়? রানিগঞ্জে যে কয়লা পাওয়া যায় তা জানতে কি লোকে সেখানে যায়! মুশকিল কী জানেন, এই মাওবাদীরা ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দলে দলে চলে আসছে কলকাতায়। লুকিয়ে থাকার জন্যে এমন চমৎকার শহর তো ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে না। এসে মিশে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে। আর সেই কাজটা সহজ করে দিচ্ছে এই শহরের কিছু বাঙালি। তাদের মধ্যে লেখক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তারও আছেন। যে-কোনও দিন এরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করতে পারে।

কী যা তা বলছেন! অর্ক প্রতিবাদ করল।

বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এরাই গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে একটা রাজনৈতিক দলের মদতে। সেই দলের সবাই উপনেতা, একজনই প্রধান নেত্রী। তিনি তো বলেই দিয়েছেন মাওবাদী বলে কিছু নেই। পড়েননি? তা হলে গ্রামে খুন করছে কারা? আকাশ থেকে খুনিরা নামছে? যাক গে, আপনার বাড়িতে যে ছিল আশা করি সে মাওবাদী নয়। সুরেন মাইতি কথা শেষ করে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল অর্ক। মা বলত, মধ্যবিত্তরা প্রতিবেশীর সম্পর্কে বেশি আগ্রহী হয়। উচ্চবিত্ত এবং বিত্তহীনরা এই ব্যাপারে একদম উদাসীন। মা তাই এই বস্তিতে চলে এসেছিল। তা হলে কি সময়টা বদলে গিয়েছে?

.

২৯.

গত সন্ধ্যায় দেবেশ ফোন করেছিল। বলেছিল, কোনও অজুহাত শুনব না, কাল সকালে আমার এখানে চলে আয় তোরা। সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে ফিরে যাবি।

ফোন বন্ধ করে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলতেই তার মুখে হাসি ফুটল, গেলে খারাপ হয় না। একটা অন্যরকম দিন কাটবে।

কিন্তু মিস্টার রায় যদি ডেকে পাঠান। উইলের প্রবেট নিতে নিতে মাস আটেক লাগবে, প্রবেটের ফি-ও দিতে হবে। মিস্টার রায় তাই চাইছেন ছোটমা একটা এফিডেবিট করুন যাতে তিনি বলবেন বাবার সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী তিনি। দরকার হলে কোর্ট থেকে সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। আর এইসবের জন্যে যদি বলেন আগামীকালই দেখা করতে হবে, তা হলে? অনিমেষ মাথা নাড়ল।

আশ্চর্য! তোমার কী হয়েছে বলো তো? শুনেছি নীরদ সি চৌধুরী একশো বছর বয়সেও অবাস্তব কথা বলতেন না। তোমার এখনই সেটা হয়ে গেল! মাধবীলতা বলল।

কী বলতে চাইছ? বিরক্ত হল অনিমেষ।

এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আমি হলে মিস্টার রায়কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম আগামীকাল তিনি আমাদের ডাকবেন কিনা! ওঁর উত্তরটা দেবেশবাবুর ওখানে যাওয়া বা না যাওয়াটা সহজ করে দিত।

অনিমেষ শ্বাস নিল, সত্যি! আমার মাথায় এত খেলে না! মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করে মাধবীলতার কথাগুলো বলতেই মিস্টার রায় হাসলেন, আমি ডাকলেও কোনও কাজ হবে না। কাল কোর্ট মহরমের জন্যে বন্ধ।

শুনে মাধবীলতা বলল, হল তো?

তুমি জানতে কাল মহরম? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

স্কুলে যখন চাকরি করতাম তখন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের ধর্মীয় কারণে যেসব দিন ছুটি বলে ঘোষণা করা হয় তার হিসেব রাখতাম। তা হলে আমরা যাচ্ছি। শোনো, ওঁকেও নিয়ে যাব। মাধবীলতা উঠে পড়ল।

যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি জোগাড় করতে হবে।

দেবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করো। উনি স্থানীয় মানুষ, সস্তায় ব্যবস্থা করবেন।

ছোটমা তখন ঠাকুরদের রাত্রের জন্যে বিশ্রাম দিয়ে প্রণাম করে উঠেছেন, মাধবীলতা দরজায় এসে দাঁড়াল। ছোটমা বললেন, কিছু বলবে?

ওর বন্ধু দেবেশের কথা বলেছিলাম আপনাকে, ওই যে যার ওখানে সবাই মিলে যাওয়ার কথা হয়েছিল। সে ফোন করেছিল। কাল যাবেন?

মাধবীলতা দেখল ছোটমায়ের মুখটা যেন পালটে গেল। খুশি চেপে রেখে বললেন, গেলেই হয়, কিন্তু–!

কিন্তু কী?

এই বাড়ি পাহারা দেবে কে? ঠাকুর আছেন, তোমাদের জিনিসপত্র আছে। বাগান আছে। সব যে ভোলা পড়ে থাকবে।

দরজায় তালা দিয়ে দেব। আর বাগানে তো নারকেল ছাড়া কিছু নেই।

নেই কী বলছ? শেয়ালছানারা নেই! সাপও আছে। আমরা নেই জানতে পারলে কেউ এসে ওদের মেরে ফেলবে। দেখো। ছোটমা বললেন।

মাধবীলতা অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল। ওই শেয়াল অথবা সাপও ওঁর কাছে এত মূল্যবান হয়ে গিয়েছে। মায়া বড় গভীরে শেকড় ছড়ায়।

মাধবীলতা বলল, ভাড়াটেদের ছোটবউকে বললে হবে না? মাথা নাড়ল ছোটমা, ঘুম থেকে উঠে কাজের চাপে মাথা তুলতে পারে না বেচারা। দুপুরের পর চোরের মতো আমার কাছে আসে। একটা উপায় আছে, লছমন একটু পরে আসবে। ওকে বাতাসা আনতে দিয়েছি। ওকে বলব যদি কাল ওর বউ ছেলেকে এই বাড়িতে আসতে বলে। কিন্তু যদি রাজি হয় তা। হলে ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে তো হবে।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ভোরবেলায় উঠে ওদের দুবেলার খাবার করে দিয়ে যাব। সকাল আর দুপুর। বিকেলে তো ফিরেই আসব। মাধবীলতা ছোটমাকে আশ্বস্ত করল।

.

দেবেশই গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিল। দিনবাজার থেকে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ছেলেটি পৌঁছে গেল সকাল সাতটায়। মাধবীলতা গতরাত্রে বলেছিল, গাড়ির ভাড়া কত দিতে হবে তা জেনে নাওনি, কী যে করো!

অনিমেষ বলেছিল, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও বলেছিল ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে নিতে। দেবেশের পরিচিত, কিন্তু ও তো গাড়ি ভাড়া নেয় না, তাই জানে না।

ওর ওখানে যেতে হলে বাস থেকে নেমে অনেক হাঁটতে হবে?

মাধবীলতার প্রশ্ন শুনে অনিমেষ তাকাল। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না মাধবীলতা টাকার কথা চিন্তা করছে। সে বলেছিল, বাসে যাওয়ার সুবিধে থাকলে দেবেশ গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পরামর্শ দেবে কেন?

মাধবীলতা কথা বাড়ায়নি।

সকালে গাড়ি আসার আগেই বাবা তার মাকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল লছমনের রিকশায় চড়ে। মাধবীলতা দেখল বউটিকে। বিহারের গ্রামের মেয়ে, প্রায় নাক পর্যন্ত ঘোমটা টানা। লম্বা, ছিপছিপে। শাড়ি পরার ধরন এবং রঙে বাঙালিয়ানা নেই।

ছোটমা খুশিমুখে ডাকলেন, আয়, আয়। তোর বর, ছেলে আসে, তুই তো আসিসই না। কী যেন নাম তোর?

লছমন পেছন থেকে বলল, রাধা।

অ্যাঁ। সে তো আয়ান ঘোষের বউ। বলে হাসলেন ছোটমা। তারপর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

মাধবীলতা বলল, ওকে সব বুঝিয়ে দিন।

লছমন মাথা নাড়ল, আমি সব বলে দিয়েছি। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আজ বাবার স্কুল ছুটি। ও মায়ের সঙ্গে থাকবে।

তৈরি হতে আটটা বেজে গেল। দেরি করলেন ছোটমা, বেরোবার সময় একটা না একটা কাজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। ক্রাচ বগলে নিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে গাড়ির পাশে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী নাম ভাই? বছর পঁচিশের ভদ্র চেহারার ছেলেটি হাসল, আমাকে খোকন বলে ডাকবেন।

আচ্ছা। এবার বলো, আমরা কোথায় যাচ্ছি তা কি জানো?

হ্যাঁ। খোকন বলল।

তোমাকে গাড়িভাড়া বাবদ কত দিতে হবে?

কাকাবাবু, আপনারা কতক্ষণ গাড়িটাকে রাখবেন তার ওপর নির্ভর করছে। যদি সারাদিন রাখেন তা হলে তো বেশি পড়বে। আর যদি ড্রপ করে চলে আসি আর ফেরার টাইম বললে নিয়ে আসতে যাই তা হলে অনেক কম চার্জ লাগবে। দুই লিটার তেলের দাম এক্সট্রা দিয়ে দেবেন।

কেন?

দু-দুবার যেতে আসতে হবে যে!

তা হলে দ্বিতীয়টাই করো। অনিমেষ বলল।

পেছন থেকে মাধবীলতা কথা বলল, একটা সমস্যা হতে পারে। যদি কোনও কারণে আমাদের আগেই চলে আসতে হয় তা হলে?

খোকন বলল, চিন্তা করবেন না কাকিমা। আমাকে মোবাইলে ডেকে নেবেন। আমি চলে যাব।

অনিমেষ ছোটমাকে দেখে খুশি হল। এখানে এসে ওঁর পরনে ময়লাটে কাপড়, যা হয়তো কখনও সাদা ছিল তাই দেখে এসেছে। মাধবীলতার অনুরোধ সত্ত্বেও সেগুলো ছাড়তে রাজি হননি। বলেছেন, ঘেঁড়েনি যখন তখন ফেলে দেব কেন? কিন্তু এখন ধবধবে সাদা শাড়ি যার সরু পাড়ে হালকা নীল রং, সাদা জামায় ছোটমায়ের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। মাধবীলতা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, বসুন। অনিমেষ লক্ষ করল, ছোটমায়ের হাতে ভাঁজ করা ঘিয়ে রঙের চাদর রয়েছে।

গাড়িটা মারুতি ওমনি ভ্যান। ড্রাইভারের পেছনে মুখোমুখি সিটে ওরা তিনজন উঠে বসল। বাবা আর তার মা দাঁড়িয়ে ছিল যাত্রা দেখতে। গাড়ি বাড়ি থেকে গলি দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে না গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এদিকে তো জেলা স্কুলে যাওয়া যায়, তুমি তো হাসপাতালের দিকে যাবে।

খোকন বলল, আপনি বোধহয় অনেকদিন আসেননি কাকা। এদিক দিয়ে গেলে রাস্তা কম হয়।

কৈশোরের পরিচিত বাড়িগুলো দেখতে দেখতে অনিমেষ নিজের মনেই বলল, সব একইরকম আছে!

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।

জেলা স্কুলের হস্টেলের পেছন দিয়ে সেনপাড়ার ভেতর দিয়ে খোকন গাড়িটাকে নিয়ে রাজবাড়ির কাছে চলে এল। তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে তিস্তা ব্রিজে উঠে টিকিট কাটল। ছোটমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার বাইরে তাকিয়ে বললেন, এই নদীটা কত বড় ছিল, এখন দেখো, ছোট হয়ে গিয়েছে।

মাধবীলতা বলল, তিস্তা আর নদী কোথায়! জলই নেই। ওই ওপাশে অল্প একটা ধারা। তাও যাচ্ছে কি যাচ্ছে না বোঝা যাবে না!

তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে খানিকটা আসার পর হাইওয়ে ছেড়ে মেঠো রাস্তায় গাড়ি নামল। দুপাশে চাষের খেত, রাস্তাটা গর্তে ভরতি। একটা গোরুর গাড়ি সেটা আটকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলছে। খোকন চিৎকার চেঁচামেচি করেও যখন হুশ ফেরাতে পারল না তখন তার মুখ থেকে একটা অশ্লীল শব্দ ছিটকে বের হল। অনিমেষের মনে হল দুকান দিয়ে গরম সীসে শরীরে ঢুকল। তার সামনে মাধবীলতা এবং ছোটমা বসে আছে। সে চোখ বন্ধ করল যাতে ওদের মুখ দেখতে না হয়। একবার ভাবল খোকনকে খুব ভর্ৎসনা করবে। কিন্তু তখনই গোরুর গাড়ির চালক একপাশে সরে দাঁড়াল। তাকে পেরিয়ে যাওয়ার জায়গা পেয়ে খোকন চিৎকার করল, গালি না দিলে ভাল কথা শুনতে পাও তোমরা?

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল, খোকনের উচ্চারণ করা অশ্লীল শব্দটা সে, মাধবীলতা এবং ছোটমা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে থাকলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ড্রাইভাররা গালিগালাজ দিতে অভ্যস্ত এই তথ্যটা মেনে নিলে সব চুকে যাবে।

দোমহনি একটি ক্ষুদ্র জনপদ। ছোটখাটো কিছু দোকান, গরিব মানুষদের ঘরবাড়ি, দু-তিনটে ইট সিমেন্টের দোতলা বলে দিচ্ছে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা আদৌ ভাল নয়। অনিমেষের মনে পড়ছিল, ছেলেবেলায় সে শুনত দোমহনির কথা। বেশ জাঁকজমক ছিল। একটা রেলওয়ে জংশন ছিল।

খোকন, তুমি দেবেশের ওখানে আগে গিয়েছ?

না কাকা। জিজ্ঞাসা করতে হবে। খোকন গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজন প্রৌঢ়কে ডেকে বলল, আচ্ছা, দেবেশবাবুর বাড়ি কোথায়?

দেবেশ? ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল।

অনিমেষের জানলার কাছে মুখ এনে বলল, যিনি এখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম চালান। সাইকেলে ফেরেন।

ও, তা বাড়ি বলছেন কেন? আশ্রম বলুন। ডানদিক ধরে সোজা চলে যান। রেললাইন পেরিয়ে খানিকটা গেলে যাকে জিজ্ঞাসা করবেন সে-ই বলে দেবে। দেবুদার আশ্রম। হাসলেন প্রৌঢ়।

ডানদিকে ঘুরে খানিকটা যেতেই রেললাইন দেখা গেল। একটাই লাইন, দেখে বোঝা যাচ্ছে ট্রেন চলাচল করে। ডানদিকে কিছুটা দূরে খোলা মাঠের ওপর একতলা ঘরটা বোধহয় স্টেশন। কোনও বাউন্ডারি নেই।

লাইন পার হতেই এগিয়ে আসা সাইকেল আরোহী হাত তুলে থামতে বলল, তারপর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

দেবেশকে দেখে খুশি হল অনিমেষ, তুই কোথায় যাচ্ছিস?

তোদের দেরি দেখে এগোচ্ছিলাম। ড্রাইভারভাই, তুমি আমার পেছনে এসো। কাছেই আশ্রম। সাইকেল ঘোরাল দেবেশ।

গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। তারের বেড়ার ভেতরে অনেকটা জমিতে শাকসবজির চাষ হয়েছে। তার ওপাশে টিনের চাল ইটের দেওয়াল দেওয়া লম্বা লম্বা ঘরবাড়ি। দুপাশে খোলা মাঠ, পেছনে জঙ্গলের আড়াল।

গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় খোকন ডাকল, কাকা।

অনিমেষ তাকালে সে একটা কাগজ এগিয়ে দিল, আমার মোবাইল নম্বর।

মাধবীলতা সেটা নিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ ভাই।

দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, তুই কি গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছিস?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, সারাদিন আটকে রেখে লাভ কী? খরচ বাড়বে। দেবেশ খোকনের দিকে তাকাল, ফোন পেলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে।

মাথা নেড়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল খোকন। দেবেশ ছোটমায়ের সামনে গিয়ে বলল, আপনারা যে শেষ পর্যন্ত আমার এখানে এসেছেন, খুব ভাল লাগছে। আসুন, আসুন আপনারা!

আর একটু এগোতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। আশ্রমের বাসিন্দা বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা পরিষ্কার জামাকাপড় পরে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। দেবেশ একে একে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মাধবীলতা মহিলাদের দিকে তাকিয়েছিল। ছয়জন আছেন। অতি বৃদ্ধা যিনি তার বয়স আশির ওপরে, লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার হাত ধরল, আপনি কেন কষ্ট করে উঠে এলেন? চলুন, বসে কথা বলব।

বৃদ্ধা খালি হাতটা মাধবীলতার গালে ছোঁয়ালেন, কেউ তো খবর নিতে আসে না। ওই ছেলে ছিল বলে এখনও বেঁচে আছি। তা শুনলাম তোমরা আসছ। ছেলের স্কুলের বন্ধু আর তার মা-বউ। না এসে কি পারি?

দেবেশ বলল, চলুন, আমরা সবাই কমনরুমে গিয়ে বসি।

কমনরুম বলতে বাঁধানো মেঝের ওপর বাঁশের খুঁটিতে খড়ের ছাউনি আটকানো, চারধার খোলা। মেঝের ওপর চারদিক জুড়ে বেঞ্চি পাতা। সবাই বসলে দেবেশ বলল, অনিমেষ আর আমি একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। মাসিমা, আপনার সঙ্গে তখন আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ওদের বাড়িতে আমি সপ্তাহে একদিন অন্তত যেতাম। কেন জানেন?

মাধবীলতা হাসল, আমি জানি।

বেশ আপনিই বলুন। দেবেশ বলল।

না, আপনার মুখে শুনতে চাই।

আমরা কয়েকজন প্রথম গিয়েছিলাম স্কুল ছুটির পর। তখন ওই বাড়ি বড়পিসিমার কন্ট্রোলে। অনিমেষকে খুব ভালবাসতেন। বালবিধবা মহিলা। প্রথম দিনে সবার নাম জিজ্ঞাসা করলে যেই তিনি আমার নাম শুনলেন অমনি আমার খাতির বেড়ে গেল। অন্যরা যা খাবার পেত আমি তার দ্বিগুণ পেতাম। কারণটা খুব মিষ্টি। বড়পিসিমার এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, বারোর আগে তার স্বামী মারা যান। কিন্তু প্রৌঢ়া মহিলা তার স্বামীর নাম ভোলেননি। দেবেশ শুনেই আমার প্রতি তার মন নরম হয়ে গিয়েছিল। দেবেশ খুব গাঢ় গলায় কথা বলছিল।

ইতিমধ্যে জলখাবার এসে গেল। গরম গরম রুটি আর আলুর তরকারি। ছোটমা মাধবীলতাকে নিচু গলায় বললেন, আমাকে দিতে নিষেধ করো।

মাধবীলতার চোখে প্রশ্ন দেখে বললেন, সকালের এই সময়ে আমি তো খাই না।

পাশে বসা একজন বৃদ্ধা বললেন, কিছু মনে করবেন না দিদি, আপনি নিশ্চয়ই এই সময় বাড়ির বাইরে আসেন না, আজ যেমন এসেছেন।

না। কত বছর পরে এলাম তাও মনে নেই। ছোটমা বললেন।

তা হলে দিদি, আজ নিয়ম ভাঙলে কোনও ক্ষতি হবে না। খেয়ে নিন।

মাধবীলতা দেখল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোটমা খাবারের থালা নিলেন।

কথা শুরু হল। এখানে যারা আছেন তাদের সবাই যে খুব অসহায় অবস্থা থেকে এসেছেন তা নয়। ছেলে প্রবাসে বাড়িঘর করে আছে। জলপাইগুড়িতে কখনওই থাকবে না, আবার বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় দুটো কারণে। এক, প্রবাসে গিয়ে বাবা এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। দুই, জলপাইগুড়ির পরিচিত পরিবেশে থাকতে তিনি অনেক বেশি স্বস্তি অনুভব করবেন। ফলে, ছেলে এসে পৈতৃক বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাবাকে এখানে রেখে গেছে। ভাড়ার টাকা প্রতিমাসে খরচ বাবদ আশ্রমকে দেওয়া হয়ে থাকে। কয়েকজন বৃদ্ধবৃদ্ধা, যাঁরা স্বামী-স্ত্রী, শুধু পেনশনের ওপর নির্ভর করে এখানে আছেন, আবার কয়েকজন আছেন, যাঁরা কোনও আর্থিক সাহায্য আশ্রমকে দিতে পারেন না। কিন্তু সেই কারণে দেবেশ কোনও শ্রেণিভাগ করেনি।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আপনারা সারাদিন কী করেন?

একজন প্রৌঢ় বললেন, আমরা সকাল ছটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে ওই বাগানে গিয়ে বসি। তখন সবে সূর্য উঠছে। যে যার মতো পনেরো মিনিট ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সূর্যের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টি পড়লে এই কমনরুমে এসে প্রার্থনা করে নিই। তারপর চা বিস্কুট খেয়ে নিই। এরপরে, সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুরুষরা বাগানের কাজ করি। মাটি কোপানো, সার বীজ লাগানোর কাজ করতে দেবেশবাবুকে লোক ভাড়া করতে হয়। আমাদের যা শরীরের অবস্থা তাতে ওই পরিশ্রম সম্ভব নয়। কিন্তু সবজি এবং ফলের গাছগুলো মাটির ওপরে উঠে এলে আমরাই দেখাশোনা করি। বছরের নয়-দশ মাসের তরিতরকারি এই বাগান থেকেই পেয়ে যাই। মহিলারা তরিতরকারি কাটা, রান্নার ব্যাপারে ঠাকুরকে সাহায্য করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। কারও জামাকাপড় সেলাই করার দরকার হলে তা করে দেন। তারপর জলখাবার খেয়ে বিশ্রাম। দেবেশ একটা ছোট লাইব্রেরি করে দিয়েছে। সেই বই পড়ি যা পড়তে চাই। তারপর স্নান খাওয়া সেরে বিশ্রাম। তিনটের সময় একজন ডাক্তার এসে আমাদের শরীরের খবর নেন। পাগল ডাক্তার, নইলে রোজ আসত না। তারপর সবাই মিলে হাঁটতে বের হই। বড়দিদি হাঁটতে পারেন না বলে বাগানে বসে থাকেন।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তা হলে কি বুঝব আপনারা এখানে ভাল আছেন?

বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, খুব ভাল আছি মা। একসঙ্গে ভাল আছি।

এইসময় মোবাইল বেজে উঠতেই মাধবীলতা হকচকিয়ে গেল। সবাই কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাধবীলতা মোবাইল অন করে বলল, হ্যালো?

অর্কর গলা শোনা গেল, মা, তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?

.

৩০.

মাধবীলতা আড়চোখে অনিমেষের দিকে তাকাল। মোবাইলের রিং শুনে সে মুখ ঘুরিয়েছিল এদিকে। মাধবীলতা বলল, খুব জরুরি কিছু?

তুমি কি ব্যস্ত আছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। চোখ বন্ধ করল মাধবীলতা, কী বলতে চাইছিস, বল!

আমাদের এই বস্তির একটা বাচ্চা খুব সমস্যায় পড়েছে। ও যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুল থেকে বলেছে ওকে অন্য জায়গায় ভরতি করতে। শুনতে পাচ্ছ?

হঠাৎ একটা বাচ্চাকে কেন এ কথা বলবে? সে কি কোনও সমস্যা করেছে?

না না, তার সমস্যা করার বয়সই হয়নি। ওর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিল। বোধহয় তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। সেই অপরাধে বাচ্চাটাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

অদ্ভুত ব্যাপার! মাধবীলতা বলল।

সত্যি অদ্ভুত। কিন্তু এটা ঘটনা। অর্ক বলল।

আমি এই ঘটনার কথা বলছি না।

তা হলে?

সেই কমিউনের ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তোকে কোনও পরিবারের সঙ্গে মিশতে দেখিনি। বস্তির কোনও মানুষের সঙ্গে কথাও বলতিস না। শুধু শোওয়ার জন্যে বাড়িতে আসতিস। আজ হঠাৎ তাদের একটা বাচ্চার জন্যে তোর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল কী করে তাই বুঝতে পারছি না।

খুব সহজ ব্যাপার। আজকাল তুমি বা বাবা যে-কোনও স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে অস্বাভাবিকতা খোঁজো। বাচ্চার মা তোমার কাছে এসেছিল। ভেবেছিল, তুমি বললে তোমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস না বলতে পারবেন না। তুমি এখন জলপাইগুড়িতে আছ, কবে আসবে জানা যাচ্ছে না শুনে ভদ্রমহিলা আমাকে অনুরোধ করেছেন তোমাকে ফোন করতে। তুমি যদি হেডমিস্ট্রেসকে একটা ফোন করে দাও! অর্ক খুব স্থির গলায় কথাগুলো বলে গেল।

এই মহিলা কে? কী নাম?

অলকা। তুমি বোধহয় চিনতে পারবে না।

অলকা–? তুই আগে দেখেছিস?

না। বস্তির পেছন দিকে থাকত।

ওই অলকা তোর কাছে এসেছিল? ওর স্বামী আসেনি?

মা, তুমি–।

আমি ঠিকই জিজ্ঞাসা করছি। মেয়ের সমস্যা দূর করতে বাবারই তো আসার কথা। আমি কলকাতায় নেই শুনে তোর কাছে স্বামীকেই পাঠানো কি উচিত কাজ নয়?

আমার কাছে ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ফোনটা যেহেতু তুই আমাকে করতে বলেছিস তাই আমি যা ভাবছি তাই বললাম। শোন অর্ক, যাকে চিনি না, জানি না, তার জন্যে আমি কাউকে অনুরোধ করতে পারব না কৃপা করতে। আমার ছেলে হয়েও তুই যে এতদিনে আমাকে বুঝিসনি দেখে খারাপ লাগছে। যাক গে, আমি, আমরা বাড়িতে নেই এখন। রাখলাম। মাধবীলতা ফোন বন্ধ করল। বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, তোমার মুখ এত শক্ত হয়ে গেল কেন মেয়ে?

মাধবীলতা হাসার চেষ্টা করল, কই, না তো!

বৃদ্ধা বড়দিদি মাধবীলতার কাঁধে হাত রাখলেন, তোমার কথাটা আমার ভাল লেগেছে। যাকে জানো না তার জন্যে কেন সুপারিশ করবে? ঠিক কথা।

দেবেশ বলল, অনিমেষ, আমাদের বড়দিদি চমৎকার গান করেন।

বৃদ্ধা বড়দিদি দ্রুত হাত নাড়লেন, না না এ কী কথা। এই বয়সে কি গলায় সুর আসে? গান গেয়েছি বিয়ের আগে। আর তারপর তোমরা ধরো বলে এই আশ্রমে এসে। আমি কি গাইতে পারি?

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি বিয়ের পর গান গাওয়ার সুযোগ পাননি?

এবার আর একজন প্রৌঢ়া কথা বললেন, আমি বলি। বড়দিদি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে খুব অস্বস্তি বোধ করেন। প্রৌঢ় বৃদ্ধা বড়দিদির দিকে তাকালেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি।

পড়েছি মোগলের হাতে, বলো। বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন।

প্রৌঢ়া বললেন, বড়দিদির বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। ওঁর বাবা খুব ভাল গাইতেন। অতুলপ্রসাদের গান, রজনীকান্তের গান। অদ্ভুত ব্যাপার। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন না।

বৃদ্ধা বড়দিদি বললেন, বাবা বলতেন, সবার গলায় গুরুদেবের গান মানায় না।

প্রৌঢ়া বললেন, বাবার কাছেই গান শিখেছিলেন বড়দিদি। বিয়ের পরে একান্নবর্তী সংসার ওঁকে বেশিদিন করতে হয়নি। ওঁর স্বামী পাটনায় চাকরি করতেন বলে ওঁকে সেখানে যেতে হয়েছিল। তখন সংসার সাজাতে ব্যস্ত তিনি, কিন্তু মাত্র ছয় মাস পরেই ওঁর স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। বাধ্য হয়ে পাটনায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। ওঁর বাবা যতবার ওঁকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ততবার ওঁর শ্বশুর একটা না একটা বাহানা দেখিয়ে ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রলোকের ভয় হয়েছিল বিধবা পুত্রবধূকে তার বাবা আবার বিয়ে দিতে পারেন।

বৃদ্ধা বড়দিদি হাসলেন, একটু বলি। আমার শ্বশুর ছিলেন ঠিক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, মহর্ষি?

বৃদ্ধা বড়দিদি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ গো। তুমি সাহানা দেবীর নাম শুনেছ? যাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের এক পাগল ছেলের সঙ্গে। সেই পাগলকে ঘুম পাড়াতে বেচারাকে সারা রাত গাইতে হত! তা সেই পাগল মারা যাওয়ার পর সাহানা দেবীর বাবা মেয়েকে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা মনে নেই। হয় এলাহাবাদ বা লখনৌ। কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তিনি অনুমতি চাইলেন, মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চান। দেবেন্দ্রনাথ খুব রেগে গিয়ে সমরেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বললেন সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে আনতে। ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ বিধবা হলেও সসম্মানে বাড়িতেই থাকবেন। তাঁকে আবার বিয়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু নিয়ে আসতে হলে অসত্য কথা বলতে হবে। দেবেন্দ্রনাথের ছেলেরা, সত্যেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাবার আদেশ পালন করতে যখন চাইলেন না তখন রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ল। বাবার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুর্বল হয়ে গেলেন। তিনি গিয়ে সাহানা দেবীকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বড়দিদি হাসলেন, এসব ব্যাপার আগেকার দিনে খুব স্বাভাবিক ছিল।

মাধবীলতা অবাক হয়ে শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন? রবীন্দ্রনাথ–!

তখন তো ওঁর অল্প বয়স। যুবকও হননি। পিতৃভক্ত ছিলেন। এরকম হয়।

প্রৌঢ়া বললেন, রবীন্দ্রনাথের সময় মানে একশো তিরিশ বছর আগেকার কথা। সে সময় যা হতে পারত তা বড়দিদির সময়েও হয়েছিল। ওঁর বাবা অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে আবার সংসারী করতে পারেননি। শ্বশুরবাড়িতে একাদশী-অমাবস্যা আর অম্বুবাচী করেই জীবনের অনেকটা পার করে দিয়েছিলেন।

বড়দিদি মাথা নাড়লেন, না না, সবকিছুর জন্যে ওঁদের দায়ী করা ঠিক নয়। আসলে কী জানো, তিন-চার বছর বিধবার জীবনযাপন করার পর আমিই আপত্তি করেছিলাম। আবার একটা পুরুষমানুষের সঙ্গে ঘর করব! এক স্বামীর ঘর ছেড়ে আর এক স্বামীর ঘরে? কীরকম ঘেন্না লাগার বোধ তৈরি হল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা এখন মেয়েরা বিবাহিত জীবনে অসুখী হয়ে বিয়ে ভেঙে আবার আর একজনকে ভালবেসে বিয়ে করে সংসার করছে, এটা নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ নয়?

ওমা! কে বলল? একটা মেয়ের বুকে যতদিন নিজের জন্য আবেগ থাকবে, যতদিন সে ভাববে আমার সংসার আমি নিজের ইচ্ছেয় তৈরি করতে পারি ততদিন সে পথ তৈরি করে নিতেই পারে। আমার মনে ওই ইচ্ছেটাই ছিল না। বড়দিদি বললেন, আসলে কী জানো, চিরকাল জেনে এসেছি আমার কোনও ঘর নেই। এই সেদিনও মেয়েদের কোনও ঘর ছিল না। হয় বাপের বাড়ি, নয় শ্বশুরবাড়ি। তারপর ছেলের বাড়ি। নিজের বাড়ি কোথায়? মেয়ে জামাই দুজনে যদি সংসার করে তা হলে সেটা হত জামাইয়ের বাড়ি। হাজার মাইল দূরে হলেও সেখানে গিয়ে তেরাত্তিরের মধ্যে চলে আসতে হত। মেয়ের বাড়ি বলে ভাবত না কেউ।

এতক্ষণ সবাই চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু কেশে নিয়ে বললেন, আমি একটা কথা বলব?

ওমা! এ কী কথা? বড়দিদি হাসলেন, শুনি।

আমার মনে হয় এর জন্যে তখনকার সামাজিক ব্যবস্থাই দায়ী। প্রৌঢ় বললেন, একান্নবর্তী পরিবারে যুবক বাবার সঙ্গে তার ছেলেমেয়েদের কোনও যোগাযোগ থাকত না। অভিভাবক-অভিভাবিকারাই দেখাশোনা করতেন। বিশেষ করে মেয়ের সঙ্গে মা-ঠাকুমা-পিসিদের সম্পর্কই বেশি ঘনিষ্ঠ হত। বাবা যেমন দুরের মানুষ, যোগ্য মেয়েও বাবার কাছের মানুষ ছিল না। বিয়ের পরে সেই দূরত্ব আরও বেড়ে যেত বলে বাবা মেয়ের সম্পর্কে ততটা টান অনুভব করতেন না। ছেলেমেয়েরা কথা বলার সুযোগ হলে বাবাকে আপনি সম্বোধন করত। কিন্তু গত চল্লিশ বছরে ছবিটা একদম বদলে গেল। একান্নবর্তী সংসার ভেঙে যাওয়ায় বাড়িতে মা এবং বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ে বাবার সঙ্গে শৈশবে খেলেছে, কাঁধে মাথায় চড়েছে, তুমি সম্বোধন করাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাবা ক্রমশ বন্ধু হয়ে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক তার চাইতে বাবার সঙ্গে বেশি নিকট সম্পর্ক। সে পড়াশুনা করেছে। যা পড়লে ভাল চাকরি পাওয়া যায় তাই পড়ে চাকরি করছে। বিয়ের পর তাই তাদের বাড়িটা আর বাবার কাছে জামাইয়ের বাড়ি নয়, মেয়েরও বাড়ি। আর আপনারা তো সবাই জানেন, এখন বৃদ্ধ বাবা মায়ের পাশে ছেলেরা যতটা না থাকছে তার অনেক বেশি মেয়েরা দাঁড়াচ্ছে। প্রৌঢ় হাসলেন।

দেবেশ বলল, খবরের কাগজে আদালতের খবর তো তাই বলে।

একজন প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন, ঠিক। বাবাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, মাকে খেতে দিচ্ছে না, বাড়ি লিখে দিতে বলছে, নইলে অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে, এইসব মামলা হাতে পেলেই বিচারক ছেলেকে ডেকে ভর্ৎসনা করছেন। খোরপোেষ দিতে বলছেন। মেয়ে এরকম করছে বলে খবর পড়িনি।

দেবেশ হেসে ফেলল, তা হলে দেখুন, মেয়েদেরই জয়জয়কার। বুঝলি অনিমেষ, এই যে মায়েরা এখানে আছেন, এঁদের সংখ্যা কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এই যে আপনারা এখানে আছেন, এতদিন যে সংসারে ছিলেন তা ছেড়ে এসে এখানে কেমন লাগছে?

একজন বছর পঞ্চাশেকের মহিলা বললেন, দেখে কী মনে হচ্ছে?

মাধবীলতা হেসে ফেলল, তা হলে দেখে যা মনে হচ্ছে তা সত্যি?

মহিলা বললেন, পুরোপুরি। আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, কিছু হারালে এ ওকে সন্দেহ করি, আবার কারও শরীর খারাপ হলে সবাই পালা করে তার পাশে দিন রাত থাকি। কিন্তু সবার মনে একটাই ভয়–!

কীসের ভয়?

যে মানুষটার জন্যে আমরা এখানে এসে শান্তি পেয়েছি তার যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমাদের কী হবে! মহিলার মুখ অন্যরকম দেখাল।

সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ প্রতিবাদ করল, এ কী কথা? আমি তাড়াতাড়ি মরছি । আর দুর্ঘটনা যদি কিছু হয়েই যায় তা হলে আমার অবর্তমানে আপনারা যাতে ঠিকঠাক চালাতে পারেন সে ব্যবস্থা করেই দিয়েছি। চল, অনিমেষ, তোকে আমাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে আনি। হাঁটতে পারবি তো?

নিশ্চয়ই। অভ্যেস এমন একটা ব্যাপার যার কোনও বিকল্প নেই।

দেবেশ এবং অনিমেষ উঠতেই পুরুষরাও বেরিয়ে গেলেন। মাধবীলতা বড়দিদিকে জিজ্ঞাসা করলে, এঁরা চলে গেলেন কেন?

বাগানে যাচ্ছে কাজ করতে। রোদ চড়া হয়ে গেলে তো পারবে না। ছেলেরাই তো শাক সবজি থেকে সমস্ত আনাজ তৈরি করে। বড়দিদি বললেন, কিন্তু মা, তখন থেকে আমরাই কথা বলে যাচ্ছি, উনি কিছু বলছেন না।

ছোটমা মাথা নাড়লেন, আমাকে আপনি বলবেন না। আমার কিছু বলার নেই।

ও কী কথা! আমাদের কাছে এসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?

আপনারা সবাই একসঙ্গে আছেন দেখে ভাল লাগছে। ছোটমা বললেন, আমি তো বহু বছর একা একা থাকছি, এখন একা থাকতেই ভাল লাগে।

বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, সবাই মিলে হইচই করতে ইচ্ছে হয় না?

একসময় খুব হত। এখন হয় না। এই যে ওরা এত বছর পরে কলকাতা থেকে এসেছে, ভাল লাগছে আবার–! জানি আমারই ত্রুটি। ওদের সঙ্গে একটু কথা বলেই নিজের ঘরে চলে আসি। অথচ ওরা আমার ভাল চায়–! ছোটমা বললেন।

এইসময় রান্নার লোক এসে বলল, এখনও তরকারি কাটা হয়নি!

দুজন মহিলা উঠলেন। একজন জিভ কেটে বললেন, এই যাঃ!

হঠাৎ ছোটমা বললেন, আমি যেতে পারি? বড়দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়?

তরকারি কাটতে আমার ভাল লাগে।

তাই? যাও। এই, ওকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।

মাধবীলতা একটু অবাক হয়ে তাকাল। এখানে আসার পর একদিনও সে ছোটমায়ের মুখে এমন কথা শোনেনি!

দেবেশের সঙ্গে আশ্রমের অনেকটা দেখে একটা মাঝারি পুকুরের পাশে এসে দাঁড়াল অনিমেষ, মাছ আছে?

আছে। তিন কেজির ওপর হয়ে গেলে বিক্রি করে দিই। খানিকটা আয় হয়। দেবেশ হাসিমুখে বলল।

এই যে এতগুলো মানুষ, কয়েকজন কর্মচারী, এদের খাওয়াদাওয়া ছাড়াও তো অনেক খরচ আছে, চালাচ্ছিস কী করে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

চলে যাচ্ছে। আসলে সবাই মিলে চালাচ্ছি। এখানে আসার সময় এঁরা কিছু টাকা যে যার মতো পারেন দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিইনি। কিন্তু টাকাগুলো একটা নতুন অ্যাকাউন্ট করে ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছি যা থেকে প্রতিমাসে সুদ পাওয়া যায়। সিনিয়ার দুজন আবাসিক সই করে টাকা তোলেন। তা ছাড়া শাকসবজি তো ওঁরাই পরিশ্রম করে পেয়ে যান। গোয়ালে যে চারটে গোরু দেখলি তাদের দেখাশোনা করে যে রাখাল সে খুব ভাল ছেলে। মাত্র তিনশো টাকা মাইনে নেয় আর থাকা-খাওয়া। প্রায় সব মাসেই দুধ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আমি জলপাইগুড়ির তিনজন ধনী মানুষের সাহায্য পাই। এই করেই চলে যাচ্ছে। দেবেশ বলল।

তৃপ্তি পাস?

খুউব। সংসারে যাঁদের কেউ নেই, জীবনের উপান্তে যাঁরা চলে এসেছেন, তাদের মুখে হাসি দেখতে পেলে খুব আনন্দ হয়। জানিস, একটা কাণ্ড হয়েছে। ওঁরা সবাই মিলে কলকাতার বিখ্যাত লেখক এবং প্রকাশকদের কাছে আবেদন করেছিলেন বইয়ের জন্যে। বেশিরভাগই পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাকে এখন দুটো কাঠের আলমারি কিনতে হবে। দেবেশ বলল।

তুই ভাল আছিস দেবেশ। নিচু গলায় বলল অনিমেষ।

হ্যাঁ। তা ঠিক। তুই কতদিন জলপাইগুড়িতে আছিস?

ঠিক নেই। বাড়িটা ছোটমায়ের নামে আদালত করে দিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উনি ওটা বিক্রি করে দেবেন কিনা! সেই অবধি তো আছি। অনিমেষ কথা শেষ করতেই দেখল একটা গাড়ি আশ্রমের দিকে আসছে।

দেবেশ বলল, কেউ আসছেন। চল, দেখি।

ওরা যতক্ষণে সামনের বাগানে এল ততক্ষণে তিনজন মানুষ গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল দেবেশ, কী সৌভাগ্য, আপনি! আসুন, আসুন।

আর আসুন! আপনি তো আমাদের বাদ দিয়েই এসব করছেন।

আমার একার পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব?

নয় তো কী? লাস্ট কবে ময়নাগুড়িতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন? ভোটার লিস্টে এদের নাম তুলেছেন?

বিশ্বাস করুন, বলেছিলাম, এঁরা কেউ রাজি হননি!

সে কী! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট না দেওয়া অপরাধ, ওঁরা জানেন না?

বলেছিলাম। আসলে সব ত্যাগ করে এসে আর পেছনে তাকাতে চান না। বলুন, কী করতে পারি?

এই যে গুরুচরণবাবু, আমাদের পার্টির একজন প্রবীণ কর্মীর কাকা। খুব কষ্টে আছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন। এঁকে আপনার আশ্রমে রাখুন। কিন্তু দেবেশবাবু, উনি পয়সাকড়ি দিতে পারবেন না।

আমরা খুব টানাটানির মধ্যে আছি–!

আরে! আপনার কাছ থেকে আমরা কখনও ডোনেশন চাইনি। ওকে রাখা মানে পার্টিকে সাহায্য করা। গুরুচরণবাবু, আপনার কিছু জানার থাকলে দেবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন।

অন্ধের কী বা দিন কী বা রাত! কী জিজ্ঞাসা করব? একটা আলাদা শোওয়ার ঘর, খাট বিছানা, চারবেলা খাওয়া। নিরামিষ দরকার নেই, একটু মাছের ঝোল আর ভাত হলেই হবে। বছরে চারটে পাঞ্জাবি আর পাজামা। আর হ্যাঁ, রোজ একটা খবরের কাগজ, এইটুকু। গুরুচরণবাবু বললেন।

আমাদের এখানে সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ হয়। দেবেশ বলল।

তা হলে সেই তিনদিন ডিম দেবেন। গুরুচরণবাবু বললেন।

দেবেশ বলল, আপনাকে দিন দশেক অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানাব।

মাতব্বর ভদ্রলোক বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। কোনও দরকার হলে বলবেন।

ওঁরা গাড়িতে উঠে পড়লেন, হাত নাড়লেন, চলে গেলেন।

দেবেশ বলল, এই প্রথম।

লোকটা কে?

পার্টির লোকাল নেতা। ওই গুরুচরণবাবুকে লক্ষ করেছিলি? আশ্রমে ঢুকলে পরিবেশ বিষাক্ত করে দেবে। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

নৃপেনদা বোধহয় কারও উপকার করেন না। অনিমেষ বলল।

দেবেশ হাসল, তুই ভুলে গিয়েছিস। ওঁর স্ত্রী আমার জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে।

৩১-৩৫. অর্ক অলকাকে বলতে বাধ্য হল

শেষপর্যন্ত অর্ক অলকাকে বলতে বাধ্য হল, মা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি এই বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

কেন? চোখের কোণে তাকাল অলকা।

আপনি বুঝেও প্রশ্ন করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে অলকা যখন হাসল তখন তার পেছনে বস্তির বালক-বালিকারা কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে। অলকা মাথা নাড়ল, আমি শুনেছি আপনি নাকি একসময় এই বস্তির সব পরিবারকে বাঁচাবার জন্যে একসঙ্গে রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সিপিএম পার্টি সেটা পছন্দ করেনি বলে শেষপর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে যায়। আপনাকে পুলিশ ধরেছিল বলে বস্তির অনেক মানুষ থানায় গিয়ে আপনার মুক্তির জন্যে ধর্না দিয়েছিল। সেই আপনি বস্তির একজন বউয়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলতে এত ভয় পাচ্ছেন?

না। আমি ভয় পাইনি। মানুষের মুখ কিছু একটা বানিয়ে গল্প তৈরি করতে উসখুস করে। আপনার নামে বদনাম ছড়াক আমি চাই না।

আমার কথা ভেবে বলছেন না নিজের কথা ভাবছেন?

ঠিক আছে। এটা নিয়ে ঝগড়া করে তো কোনও লাভ নেই। আমি আপনার মেয়ের কথা মাকে বলেছিলাম কিন্তু ডেফিনিট কিছু শুনিনি। অতদূরে থেকে ওঁর পক্ষে কিছু করা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে স্কুলে যেতে বলুন। ডাইরেক্ট অ্যাপ্রোচে কাজ হলেও হতে পারে। অর্ক বলল।

অলকা বলল, আপনার যদি মেয়ে থাকত তা হলে আপনি যেতেন?

নিশ্চয়ই। তাই তো স্বাভাবিক। অর্ক বলল।

অলকা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। ওকে ওর অফিস মালদায় বদলি করে দিয়েছে। ওখানেই আছে। তবে প্রতিমাসে আমাদের যা দিলে কোনও অসুবিধে হয় তা ও পাঠায়।

উনি আসেন না?

প্রথম দুই মাসে এসেছিল। গতমাসে আসেনি। আমার যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে সেই ব্যাঙ্কের মালদা ব্রাঞ্চে টাকা জমা দিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাই। এবার অর্কর দিকে সরাসরি তাকাল অলকা, আপনি আমার সঙ্গে স্কুল যাবেন?

আমি? অর্ক অবাক।

নতুন স্কুলে যেতে বলছি না। ওখানকার টিচাররা হয়তো আপনাকে চিনতে পারবেন। মেয়ে যে স্কুলে এতদিন পড়ছিল তার হেডমিস্ট্রেসের কাছে গিয়ে অনুরোধ করবেন? আমার মেয়েটার কথা ভেবে বলুন, প্লিজ।

এখন গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত নই। উনি পাত্তাই দেবেন না।

আমাকে একটু মিথ্যে বলতে হবে। আমার স্বামী সঙ্গে থাকেন না, মেয়েকে নিয়ে আমি একাই থাকি শুনলে হয় তো…। থেমে গেল অলকা।

স্কুলের নাম কী?

অলকা নাম বললে অর্ক বলল, ঠিক আছে। আপনার মেয়ের জন্যেই আমি যাব। তাতে যদি শান্তি পান–দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওই স্কুলে আসুন।

.

স্কুলের হেডমিস্ট্রেস খুব ব্যস্ত বলে আধঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। অলকা আর অর্ক অপেক্ষাঘরে বসে ছিল। আধঘণ্টা পরে দুজন মধ্যবয়সি মানুষ হেডমিস্ট্রেসের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হেডমিস্ট্রেস তাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন এক ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আসতে হবে না ম্যাডাম। যা বললাম তা মনে রাখবেন।

এক মিনিট প্লিজ–! হেডমিস্ট্রেস রোগা, লম্বা, গালভাঙা। ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্কদের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন, সরি ভাই। আজ আমি খুব ব্যস্ত আছি। আপনারা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসবেন। ঠিক আছে?

তখনই মধ্যবয়স্কদের একজনের নজর পড়ল অর্কদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে! অর্ক না? তুই তো একইরকম রয়েছিস। ভদ্রলোক এগিয়ে এলে অর্ক উঠে দাঁড়াল, অপূর্ব না?

ইয়েস। সেই অপূর্ব, যে স্কুলে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।

হাত মেলাল ওরা। হেডমিস্ট্রেস জিজ্ঞাসা করলেন, বহুদিন পরে দেখা হল?

বহুত দিন। ওর নাম অর্ক মিত্র। অন্যরকম রাজনীতি করতে গিয়ে এক বছর নষ্ট করেছিল স্কুলে। অন্যরকম বলতে নকশাল বা মাওবাদী ভেবে নেবেন না। ও বস্তির সব মানুষকে এককাট্টা করে অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিল। এই দেশে তা সম্ভব নয় বোঝার পর বসে গেছে। অথচ ও যদি আমাদের সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতিতে আসত তা হলে কত ওপরে উঠে যেত। তা তুই এখানে কেন?

অর্ক বলল, একটা বাচ্চার পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।

অপূর্ব হেডমিস্ট্রেসকে বলল, আপনি দশ মিনিট অর্কর সঙ্গে কথা বললে খুব অসুবিধে হবে কি? আমি চাই ও আমাদের সঙ্গে আসুক।

হেডমিস্ট্রেস মাথা নাড়ল, আসুন আপনি।

অলকা উঠে দাঁড়াল কথাটা শুনে। অপূর্ব তার দিকে তাকিয়ে হাসল, নমস্কার। অনেকদিন দেখা হয়নি অর্কর সঙ্গে তাই আপনার খবরও পাইনি।

অলকা হাতজোড় করল।

অপূর্ব চলে যাওয়ার আগে বলল, আমি সেই পৈতৃক বাড়িতেই আছি। আসিস একদিন ওঁকে সঙ্গে নিয়ে।

অর্ক প্রতিবাদ করার আগেই অপূর্ব সঙ্গীকে নিয়ে চলে গেল। হেডমিস্ট্রেসের ঘরে বসার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার বলুন। অলকার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মেয়েকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিল তাই না!

অলকা পুরো ঘটনাটা হেডমিস্ট্রেসকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বললেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার। অর্কবাবু, আমরা শুনেছিলাম আপনি প্রথমে কংগ্রেস করতেন এখন তৃণমূলে গিয়েছেন। আপনাদের এলাকার পার্টির লোকাল কমিটি থেকেও অন্যরকম কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অপূর্ববাবু যা বললেন তাতে বুঝতে পারছি বিরাট ভুল হয়ে গেছে।

অর্ক মনস্থির করে নিল। এরা সবাই তাকে অলকার স্বামী বলে ধরে নিয়েছে। সেটা চালিয়ে গেলে হয়তো অলকার মেয়েটা এই স্কুলে ফিরে আসতে পারবে কিন্তু। সে মাথা নাড়ল, না, যা সত্যি তাই বলাই উচিত।

অর্ক বলল, ম্যাডাম, আমার নাম অর্ক মিত্র। ইনি অলকা, আমার প্রতিবেশী, মেয়েটা ওঁর মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না ভিন্ন রাজনৈতিক দল করার জন্যে আপনারা ওঁর স্বামীকে অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি তো কোনও অন্যায় করেনি। ও কেন শাস্তি পেল।

আচ্ছা, উনি আপনার স্ত্রী নন?

আমি অবিবাহিত। হেডমিস্ট্রেসের ঠোঁটে হাসি ফুটল, আপনারা প্রতিবেশী?

অর্ক বলল, হ্যাঁ।

হেডমিস্ট্রেস বললেন, তা তিনি এলেন না কেন? মেয়েটির বাবা?

এবার অলকা কথা বলল, উনি আর আমাদের সঙ্গে থাকেন না।

সে কী? কেন?

জানি না। ট্রান্সফার নিয়ে মালদায় চলে গেছেন।

অদ্ভুত। কী দায়িত্ববোধ! ডিভোর্সের কথা ভাবছেন?

নিজের পায়ে দাঁড়াতে একটু সময় লাগবে, তারপর– অলকা বলল।

হেডমিস্ট্রেস একটু ভাবলেন, অর্কবাবু, ওঁর স্বামী লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে ঘেরাও করে অনৈতিক দাবি আদায় করা চেষ্টা করেছিল বলে গভর্নিং বডি এই স্টেপ নিয়েছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে এর যখন কোনও সম্পর্ক নেই। তখন বিষয়টা নতুন করে ভাবতে হবে। গভর্নিং বডিতে অপূর্ববাবু আছেন। ওঁর সঙ্গে আপনার যে সম্পর্ক দেখলাম তাতে মেয়েটিকে আবার নিয়ে নিতে অসুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার নাম কী?

অলকা।

আপনি কালই মেয়ের জন্যে দরখাস্ত দেবেন। তাতে লিখবেন মেয়ের বাবার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। দেখুন গিয়ে, লোকটা মালদায় নতুন করে সংসার পেতেছে কিনা। এটা দরখাস্তে লিখবেন না। ওটা কাল পেলে বিকেলে গভর্নিং বডির সভায় অনুমোদন করিয়ে নেব। অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল। মাঝে মাঝে এলে আরও খুশি হব। হেডমিস্ট্রেস হাতজোড় করলেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক অলকাকে বলল, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। সকালে এসে দরখাস্ত জমা দিয়ে যাবেন।

যদি হয় আপনার জন্যে হবে। অলকা বলল।

বেশ তো, একদিন খাইয়ে দেবেন।

কী খাবেন? যা চান তাই পাবেন। অলকা হাসল।

অর্ক কথা না বলে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। অলকা বলল, হেডমিস্ট্রেস আপনাকে বললেন মাঝে মাঝে দেখা করলে খুশি হবেন। উনি কিন্তু সত্যিকারের ডিভোর্সি। বুঝে সুঝে যাবেন।

অর্ক হাসল। অলকা জিজ্ঞাসা করল, আপনার মোবাইলের নাম্বারটা বলবেন?

অর্ক তাকাল। অলকা হাসল, আপনার বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন, খুব দরকার হলে ফোনে তো কথা বলতে পারি!

মাথা নেড়ে অর্ক নিজের নাম্বারটা জানাল। অলকা বলল, আমাকে একটু বউবাজারে যেতে হবে। বাস আসছে। অলকা এগিয়ে গেল। ওপরে উঠে হাত নাড়ল।

অলকাকে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল অর্কর। বেশি হাসে, মনে হবে একটু গায়েপড়া, কিন্তু বোঝা যায়, এই ব্যাপারটা বানানো নয়। এটা ওর ভেতর থেকেই আপনিই তৈরি হয়। কিন্তু মেয়ের প্রয়োজনে স্বামী সম্পর্কে ও হেডমিস্ট্রেসকে যা বলল তা আগে বলেনি। চটজলদি ওখানে অভিনয় করল, না তাকে যা বলতে পারেনি সেই সত্যি কথাটা বলে ফেলল?

মাথা নাড়ল অর্ক, এসব ভেবে তার কী লাভ! মোবাইলটা জানান দিতে সে পকেট থেকে ওটা বের করে অন করল। দাদা, আমি শ্রীরাম বলছি।

অর্ক খুশি হল, বলুন রামজি। কী খবর?

খবর ভাল না। আমি এখন ধরমতলায়।

ধরমতলা মানে? আপনি তো বাসে চেপে–।

ফোনে সব বলা যাবে না। আপনি কি বাসায় আছেন? তা হলে আমি আপনার ওখানে যাচ্ছি। রামজি বলল।

আপনি ঠিক কোন জায়গায় আছেন?

একটা সিনেমা হলের সামনে। মেট্রো। মেট্রো হল।

ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।

লাইন কেটে দিয়ে অর্ক তাকাল। এসপ্ল্যানেডে যাওয়ার বাস আসছে। দ্রুত উঠে পড়ল সে। খুব ভিড়। কোনওমতে দাঁড়াবার জায়গা পেতেই কানে কথা ভেসে এল। নন্দীগ্রামে ঢোকার সব রাস্তা কেটে দিয়েছে গ্রামের লোক। দূর মশাই! গ্রামের কৃষকরা এতটা অর্গানাইজড হতে পারে নাকি। পেছনে কোনও পার্টি কাজ করছে। আচ্ছা, এই যে কাগজে পড়লাম, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, বেরুচ্ছে না, এরকম কদিন চলতে পারে? খাবারদাবার তো একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন? মরিয়া হয়ে করছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেওয়ালে, এখন বাঁচার জন্যে মরিয়া হয়ে গেছে মানুষ। যাই বলুন, ওদের হাতে আমস আছে নিশ্চয়ই। আপনি কি পাগল? গ্রামের সাধারণ মানুষ আর্মস কোথায় পাবে? যারা পায় তারা ওদের মদত দিচ্ছে। সবাইকে ছাপিয়ে একটা গলা সোচ্চার হল, মুশকিল কী জানেন, আপনারা কল্পনাও করতে পারছেন না, নন্দীগ্রাম একটা বিপ্লবের জন্ম দিচ্ছে।

অর্ক চোখ বন্ধ করল। তারপর চট করে তার পকেটে ঢোকা আঙুলগুলো ধরে বলল, এক সেকেন্ডের মধ্যে নেমে যাও। নইলে প্যাদানি খাবে।

বলমাত্র ছেলেটি ছিটকে চলে গেল বাসের পাদানিতে। তারপর বাসের গতি কমতেই লাফিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

অর্ক মাথা নাড়ল, কিছু না।

মেট্রো সিনেমার সামনে এখন পাতলা ভিড় কিন্তু সেখানে রামজিকে দেখতে পেল না অর্ক। লোকটা কলকাতার রাস্তাঘাট না চিনলেও নিজেই বলেছিল মেট্রো সিনেমার সামনে তখন ছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করার পর সে যখন ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন রামজির গলা কানে এল, দাদা!

অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল, ফুটপাথের অর্ধেকটা জুড়ে স্টল বানিয়ে যে দোকান করে বসেছে হকাররা তার আড়াল থেকে মুখ বের করে ডাকছে রামজি। সে অবাক হয়ে এগিয়ে গেল, কী ব্যাপার?

পেছনে লোক লেগেছে। আপনি চট করে ট্যাক্সি ডেকে আনুন। রামজি বলল।

যেন রামজিকে দেখেনি এমন ভান করে রাস্তায় নেমে ডানদিকে তাকাতেই একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে সেটা দাঁড় করাতেই প্রশ্ন শুনল, কোথায় যাবেন?

খুব রাগ হয়ে গেল। এই দিনদুপুরেও লোকটা নিজের পছন্দমতো জায়গায় যেতে চাইছে। সে পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ে বলল, নরকে।

মাথা নাড়ল লোকটা, কোন রাস্তায় যাব, বলে দেবেন।

আপাতত একটু এগিয়ে বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ান। লোক উঠবে!

ট্যাক্সি দাঁড়াতেই রামজি তিরের মতো ছুটে এসে পেছনে বসে পড়ল। অর্ক বলল, সোজা চলুন।

ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি চালু করলে রামজি পেছন ফিরে বারংবার দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

না। বুঝতে পারেনি।

কী ব্যাপার বলুন তো?

রামজি ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে কঁধ নাচাল। আকাডেমির সামনে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ভিক্টোরিয়ার বাগানে রামজিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল অর্ক। রামজি চারপাশে তাকিয়ে বলল, এখানে ঢুকলেন? বহুত খিদে পেয়েছে। কোনও দোকানে গিয়ে বসলে ভাল হত।

অতএব রাস্তা পেরিয়ে রবীন্দ্রসদনের পেছনের ক্যান্টিনে পৌঁছাল ওরা। খাওয়া হলে অর্কই দাম দিল। রামজি বলল, আমার জন্যে আপনার খরচ হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক কোনও কথা না বলে নন্দনের পেছনে একটা নির্জন বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এখনই নন্দন চত্বরে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জমায়েত শুরু হয়ে গিয়েছে। রামজি কথা বলা শুরু করল।

দিঘায় বাস থেকে নেমে সে শ্রীনিবাসকে ফোন করেছিল। কিন্তু ওর ফোন সুইচ অফ করা ছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল রামজি, তালসারিতে যাওয়ার কোনও সরাসরি বাস নেই। আধঘণ্টা দুরের ওড়িশা সীমান্তে গিয়ে অটো ধরে যেতে হয়। সে বাসে চেপে সেখানে গিয়ে শেয়ারের অটোতে উঠেছিল। সমুদ্রের ধারে পৌঁছে বারংবার ফোন করেও সে শ্রীনিবাসকে ধরতে পারেনি। অথচ তাকে রামপ্রকাশ বলেছে হলদিয়ায় না গিয়ে আপাতত শ্রীনিবাসের কাছে ওই তালসারিতে থাকতে। সমুদ্রের ধারে যেসব হোগলার ছাউনি দেওয়া দোকান আছে তাদের একজনকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, শ্রীনিবাসকে চেনে কিনা! শ্রীনিবাস কোথায় থাকে। এই জিজ্ঞাসা করেই বিপদে পড়েছিল সে। লোকটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আর একজনকে নিচু গলায় কিছু বলেছিল। সেই লোকটা তার সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি শ্রীনিবাসের কেউ হন?

না। পরিচিত। উত্তর দিয়েছিল রামজি।

কী দরকার?

তেমন কিছু নয়। এমনি দেখা করব? কোথায় থাকে সে?

ওকে তো এখন পাবেন না। আপনি কোথায় উঠেছেন?

আমি ভেবেছিলাম ওর বাড়িতেই উঠব। এখনও–।

কোনও চিন্তা নেই। আপনি এই দোকানে বসুন। আমরা শ্রীনিবাসকে ডেকে নিয়ে আসছি। তাকে একটা দোকানের সামনে বালিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসিয়ে লোকদুটো দ্রুত চলে যেতেই দোকানদার হাসল, যাকে ডাকতে গেল সে এখন জেলের ভাত খাচ্ছে। যাকে বলেছিল সে একটা বাচ্চা ছেলে, দোকানের কাজ করে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই আমার খুব পায়খানা পেয়েছে।

যান না, ওপাশে সমুদ্রের ধারে আড়াল দেখে বসে পড়ুন।

দোকানদার বলমাত্র সে আর দাঁড়ায়নি। ব্যাগটা নিতে গেলে দোকানদার বলল, ওটা রেখে যান। চুরি যাবে না।

বাধ্য হয়ে ব্যাগ রেখে সে সমুদ্রের ধারে ছুটে গিয়েছিল। তারপর ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মাইল খানেক এসে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। যখন রাত নামল তখন ঝাউবন ছেড়ে সমুদ্রের বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিঘার দিকে চলে এসেছিল ভোরের একটু আগে।

দিঘা থেকে বাস ধরতে গিয়ে বুঝতে পারল তার পেছনে লোক লেগেছে। বাস যখন চলছে তখন একজন গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন? সে বলেছিল, খঙ্গপুর। লোকটা হেসে বলেছিল, ভুল বাসে উঠেছেন। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু মেছেদাতে বাস থেকে নেমে চা খাওয়ার জন্যে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে আড়ালে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আর একটা বাস ধরে কলকাতায় নামতেই দেখতে পেল একজন তোক তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। সে হাঁটতে শুরু করলেই লোকটা পেছন পেছন হাঁটছিল। কিছুতেই যখন ওকে কাটাতে পারা যাচ্ছিল না তখন সে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দেখে লোকটা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকে চলে যায়। তারপর সে অর্ককে ফোন করে।

কাহিনি শুনে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, শ্রীনিবাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন বলে পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করেছে বলে যদি মনে করেন তা হলে কলকাতা অবধি খবর চলে আসতে পারে কি?

আমি জানি না। মাথা নেড়েছিল রামজি।

কিন্তু রামজি, আপনার সম্পর্কে আমাদের ওখানেও খুব কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় আপনার উচিত হলদিয়ায় রামপ্রকাশকে ফোন করা।

অর্কর কথা শুনে মোবাইল বের করল রামজি।

.

৩২.

কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করে রামজি মাথা নাড়ল, আউট অব রেঞ্জ বলছে। অর্ক চারপাশে তাকাল, নন্দন চত্বর এখন অল্পবয়সিদের দখলে। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে যদি কারও মাথা ব্যথা হয়ে থাকে তা হলে এখানে বসে তর্ক করেই সেটা দূর হয়ে যাবে। অবশ্য ওই বিষয়ের চেয়ে পরনিন্দা অথবা আত্মপ্রচারেই ব্যস্ত থাকবে এরা। কী অসাড়ে এদের সময় কেটে যায়। রামজি বেশ হতাশ গলায় বলল, কী করা যায় বলুন তো!

অর্ক বলল, যদি পুলিশ সন্দেহ করে থাকে, আপনাকে অনুসরণ করে ধর্মতলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তা হলে বলব, কলকাতায় থাকা আপনার পক্ষে আদৌ নিরাপদ নয়। আপনি হাজারিবাগে ফিরে যেতে পারেন না?

অসম্ভব, ওখানে যে কজনের নাম ওয়ান্টেড লিস্টে আছে তাদের দেখলে পাবলিকই ধরিয়ে দেবে। রামজি বলল।

এই কথাটাই কদিন ধরে আমার মাথায় পাক খাচ্ছে। অর্ক বলল।

কী কথা?

আপনারা যে কাজটা করতে চাইছেন তা যদি পাবলিক পছন্দ না করে তা হলে সেটা কার জন্য করছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি মাথা নাড়ল, মানুষের একটা বড় শত্রু হল তার অভ্যস্ত জীবন। সেই জীবন ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন সে তার মধ্যেই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে। আমাদের বাইরে যেতে তার খুব স্বস্তি হয় না। তেতো ওষুধ অনেকেই খেতে চায় না স্বাদের কারণে। কিন্তু আমরা বোঝাতে চাইছি, তেতো ওষুধ শরীরের রোগ সারায়। এই বোঝাটা যখন পাবলিক বুঝবে তখন আর তারা ভুল করবে না, আমাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে।

পাশে না বলে পেছনে বললেন কেন?

কারণ জনতার চরিত্র হবে নেতৃত্ব দেওয়া নয়, পেছনে থেকে সমর্থন করা। যাক গে, আমি এখন কী করব। তালসারির সোর্স জেলে, হলদিয়ার ফোন আউট অব রিচ। উঃ! রামজি চোখ বন্ধ করল।

আচমকা অর্কর মনে পড়ে গেল। সে বলল, আমি একটা জায়গার কথা বলতে পারি, সেখানে গেলে কেউ আপনাকে সন্দেহ বোধহয় করবে না।

কোথায়? চোখ খুলল রামজি।

বীরভূমে।

জায়গাটা কোথায়? আমি নাম শুনিনি।

বীরভূম একটা জেলার নাম। সেখানে একজন সন্ন্যাসিনীর আশ্রম আছে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার এবারই আলাপ হয়েছে, জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে আসার সময়। সন্ন্যাসিনী হলেও বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। যেতে বলেছিলেন ওঁর আশ্রমে। আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি কীভাবে যেতে হবে! অর্ক বলল।

কতটা সময় লাগবে যেতে? রামজি দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

এখান থেকে বড়জোর ঘণ্টা পাঁচেক।

রামজি বলল, আমার সামনে কোনও বিকল্প নেই। আপনি যখন ভরসা দিচ্ছেন তখন নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু সন্ন্যাসিনী নিশ্চয়ই হিন্দু?

তার মানে? অর্ক হাসল।

খ্রিস্টানদের মধ্যেও সন্ন্যাসিনী রয়েছেন।

না না। ইনি হিন্দু। খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী হলে তো গির্জায় থাকতেন, আশ্রম তৈরি করতেন না। অর্ক বলল।

বুঝতে পারছি না, ম্যানেজ করতে পারব কিনা। রামজি বলল।

সমস্যা কী?

আমি তো হিন্দু ধর্মের অনেক কিছুই জানি না।

আমিও জানি নাকি? ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত কোনও ধর্মাচরণ কখনও করিনি। অর্ক বলল।

কিন্তু আপনি দেখেছেন আর আপনার রক্তেও নিশ্চয়ই কিছুটা আছে।

আপনার নেই কেন?

দাদা, আমি খ্রিস্টান। রামজি বলল।

হকচকিয়ে গেল অর্ক, কী বলছেন? আপনার নাম তো রামজি?

ঠিকই। আমাদের পূর্বপুরুষদের পাদরিরা খ্রিস্টান করে দিয়ে গিয়েছিল। গরিব মানুষগুলো কিছু পাওয়ার লোভে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু তারা হিন্দু নাম ত্যাগ করেনি। এখন অনেক খ্রিস্টান ওখানে আছে যারা চার্চে যায় না, ছেলেমেয়ে হলে হিন্দু-খ্রিস্টান মিশিয়ে নাম রাখে। রামজি বলল।

অদ্ভুত ব্যাপার।

সেইজন্যই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমি খ্রিস্টান জানলে ওঁরা যদি আশ্রমে থাকতে না দেন? রামজি বলল, একটা অনুরোধ করব। আপনি আমাকে নিয়ে ওখানে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ফিরে আসুন। তাতে আমার থাকাটা সহজ হবে।

কিন্তু আমার চাকরি? যা ছুটি নিয়েছিলাম তা আজই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে পড়ল অর্ক।

আমি আপনাকে সমস্যায় ফেলছি। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। আপনি সঙ্গে থাকলে ভয় থাকবে না। রামজি আচমকা অর্কর হাত ধরল।

.

রাত্রে খাটে বসে মাধবীলতা আর অনিমেষ কথা বলছিল। একটু আগে মিস্টার রায়ের ফোন এসেছে। তিনি জানিয়েছেন ছোটমার সঙ্গে সম্পত্তি হস্তান্তরের সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সামনের শুক্রবারে ওঁকে নিয়ে কোর্টে গেলেই সমস্য মিটে যাবে। খবরটা পেয়ে ওরা খুশি হয়েছিল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, এবার কী করবে?

যা ভেবেছিলাম তাই করা উচিত।

তোমার কি মনে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করতে কোনও অসুবিধে হবে না?

সেটা স্বপ্নেন্দু দত্ত সামলাবেন। আমি আর ভাবতে পারছি না।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু?

মাধবীলতা বলল, কেউ তোমাকে ডাকছে।

এত রাত্রে। ঘড়ির দিকে তাকাল অনিমেষ, রাত নটা।

ডাকটা আবার ভেসে এল।

অনিমেষ উঠল। ক্রাচ বগলে নিয়ে বারান্দায় আসতেই সে ভাড়াটে নিবারণবাবুর গলা শুনতে পেল, অনিমেষবাবু, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? এখানে কাউন্সিলার সাহেব এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কণ্ঠ বলে উঠল, সাহেব টাহেব বলছেন কেন? বলুন, ভোম্বল এসেছে।

অনিমেষ বারান্দার শেষ প্রান্তের দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখতে পেল ওদের। নিবারণবাবু তো আছেনই, রয়েছেন কাউন্সিলার এবং আরও তিনজন তরুণ। সে জিজ্ঞাসা করল, বলুন?

কাউন্সিলার বললেন, এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু এদের অনুরোধে না এসেও পারলাম না।

আমি জেগেই ছিলাম। কী হয়েছে?

আর বলবেন না, এদের ক্লাবের চারজন ছেলেকে পুলিশ অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে। জবাবে কেস সাজিয়েছে ওদের বিরুদ্ধে। ভদ্র ঘরের ছেলে ওরা। বাবা-মা কান্নাকাটি করছে খুব। বেশ বিমর্ষমুখে কাউন্সিলার খবরটা দিলেন।

অনিমেষ বলল, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?

না না, আপনাকে আমার সত্যি কিছু বলার নেই। ব্যাপারটা হল, যে চারটে ছেলেকে পুলিশ ধরেছে তারা ক্লাবের নেতা। আর ওই চারজনই আপনার আর নিবারণবাবুর সমস্যা মেটাতে এ বাড়িতে এসেছিল। কাউন্সিলার তরুণদের দিকে তাকালেন, কী, তাই তো?

ছেলেগুলো নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছি না। নিবারণবাবুর সঙ্গে আমার তো কোনও সমস্যা হয়নি। উনি যা চেয়েছেন তা আমি মেনে নিয়েছি। অনিমেষ নিবারণবাবুর দিকে তাকাল, কী নিবারণবাবু?

নিবারণবাবু এমনভাবে মাথা নাড়লেন তাতে হ্যাঁ বা না বোঝা গেল না।

কাউন্সিলার বললেন, দেখুন, আগেও বলেছি, পার্টির নির্দেশ আছে ভাড়াটে বাড়িওয়ালার সমস্যার মধ্যে না যেতে। তাই আমি আসিনি। কিন্তু–।

ওঁকে থামিয়ে দিল অনিমেষ, আবার বলছি, আমাদের সমস্যা ছিল না।

ওহো! আমি একটু অন্যভাবে বলি। আপনারা বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবেন, এখানে থাকবেন না শুনে পাড়ার ক্লাব আপনাদের কাছে কিছু ডোনেশন চেয়েছিল। আপনারা দিতে রাজি হননি। খুব স্বাভাবিক। তা শুনে অল্পবয়সি ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে কিছু কথা বলেছিল। এখনও ম্যাচিওরিটি আসেনি। প্র্যাকটিক্যাল সেন্সের তো অভাব হবেই। কয়েক মাসের মধ্যে এই কাজটা ছাড়া ওদের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। কাউন্সিলার অমায়িক হাসি হাসলেন।

দেখুন, ওদের কথা আমি নৃপেনদা এবং আপনাকে জানিয়েছিলাম। তারপর আর ওদের সঙ্গে কোনও ঝগড়া হয়নি। আপনার কি মনে হচ্ছে আমি পুলিশের কাছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আমি কেন ভাবব? আপনার তো পুলিশের ওপর আস্থা থাকার কারণ নেই। ওরা যেভাবে আপনার পা ভেঙেছে, অত্যাচার করেছে তা তো আমরা জানি। কিন্তু এই ছেলেদের মনে হচ্ছে আপনি হয়তো রেগে গিয়ে নালিশ করলেও করতে পারেন। আমি অবশ্য বলেছি উনি এমন ভুল করতে পারেন না। পাড়ায় বাস করে কেউ পাড়ার ছেলেদের জেলে পাঠাবে? কাউন্সিলার বললেন।

অনিমেষ বলল, দেখুন, আমি যদি অভিযোগ জানাই, যার ভিত্তিতে পুলিশ ওদের ধরেছে তা হলে সেটা থানায় ডায়েরিতে রেকর্ড করা থাকবে। আপনি ওদের বলুন সেরকম কিছু ওখানে আছে কিনা?

মাথা নাড়লেন কাউন্সিলার, ঠিক এই কথাই ওদের বলেছিলাম। ওরা গিয়েছিল। না, আপনি কোনও ডায়রি করেননি।

তার পরেও আপনি ওদের নিয়ে এখানে এসেছেন? এখন কাউকে খুন বা রেপ করলে থানা ডায়েরি নিতে চায় না যদি দেখে অভিযুক্তের পেছনে আপনাদের পার্টি আছে। হাজার হাজার অভিযোগ পুলিশ ধামাচাপা দিয়েছে। আমি গিয়ে পুলিশকে বললাম আর পুলিশ সেটা নথিভুক্ত না করে ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে মারধর করল, এ কথা কোনও শিশু বিশ্বাস করবে? আমি কে? অনিমেষ বেশ উত্তেজিত হল।

কাউন্সিলার হাত নাড়লেন, আমি তো তাজ্জব হয়ে গেছি।

ওসিকে জিজ্ঞাসা করুন।

ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অতীব ভালমানুষ। হাতজোড় করে বললেন, উনি কিছুই জানেন না। একদম অন্ধকারে আছেন।

উনি কি আমার কথা বলেছেন?

না। আপনাকে চেনেন না।

তা হলে? কাউন্সিলার ছেলেদের দিকে তাকালেন, শুনলে তো? তখনই বলেছিলাম অনিমেষবাবু এমন কাজ করতেই পারেন না? কী করে হল?

অনিমেষ বলল, আমিও অবাক হচ্ছি। পুলিশের কোন অফিসার এতটা সাহস দেখালেন? কোনও পুলিশ এসেছিল?

সন্ধেবেলায় ঘটেছে ঘটনাটা, খোঁজ পেয়ে যাব।

তারপরেই ভদ্রলোককে আপনারা সুন্দরবনে বদলি করবেন।

দেখুন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। তবে যেই করুক, এসপি সাহেবকে না জানিয়ে করতে পারবে না।

ছেলেগুলোকে রেখেছে কোথায়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

একটি তরুণ নিচুগলায় জবাব দিল, জানি না। মারতে মারতে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওদের।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?

কাউন্সিলার বললেন, বুঝতে পারছি আপনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এরা আপনাকে ভুল বুঝেছে। একটা অনুরোধ করব?

বলুন। অনিমেষ তাকাল।

আপনি এই পাড়াতেই ছেলেবেলায় ছিলেন। এখনও আছেন। আর পাড়ার ছেলেরা বিপদে পড়েছে। মানছি, ওরা আপনার সঙ্গে একটু ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওরা ছেলেমানুষ বলে ক্ষমা করে দিন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে এসপি সাহেবের বাংলোতে একবার যান তা হলে খুব ভাল হয়। কাউন্সিলার বললেন।

অনিমেষ অবাক হল, আমি গিয়ে কী করব?

দেখুন, পুলিশ যখন কাজটা করেছে আর ওসিকে না জানিয়ে করা হয়েছে। তখন ওপরতলা থেকে নির্দেশ এসেছে। সেই নির্দেশটি এসপি অবশ্যই জানেন। আপনি যদি এসপিকে অনুরোধ করেন ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তা হলে পাড়ায় সবাই খুব খুশি হবে। কাউন্সিলার বললেন।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। অনিমেষ বলল।

কেন?

এসপি কেন, কোনও ডিআইজি, আইজির সাহস হবে না পার্টির বিরুদ্ধে কাজ করার। কলকাতার কোনও মন্ত্রী ফোন করলে এসপি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবেন ছেলেগুলোকে। অনিমেষ বলল।

ঘড়ি দেখলেন কাউন্সিলার, নাঃ, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি আর একবার নৃপেনদার সঙ্গে কথা বলি। উনি কলকাতায় আছেন। যদি ওখান থেকেই কাজ হয়ে যায় তো ভাল নইলে কাল একবার দয়া করে যাবেন আমাদের সঙ্গে। এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। চলি নমস্কার। ছেলেগুলোকে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন কাউন্সিলার।

নিবারণবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, ওঁরা গেট পেরিয়ে চলে যেতেই উৎফুল্ল হলেন, ওঃ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।

কেন?

এদের জমানায় পুলিশ এদেরকেই ধরে মেরেছে, তুলে নিয়ে গিয়েছে। এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কী হল বলুন তো? নিবারণবাবু গলা নামালেন, আপনি কি মুখ্যমন্ত্রীকে চিনতেন?

মানে?

একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলে ওপরতলার পুলিশ এই কাজ করতে পারে। চেনাজানা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী এই নির্দেশ দেবেন কেন?

অনিমেষ হাসল, নিবারণবাবু, অনেক রাত হয়ে গেছে। যান খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। আসছি।

দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল অনিমেষ। সে জিজ্ঞাসা করল, সব শুনলে?

বিশ্বাস হচ্ছে না। মাধবীলতা নিচু স্বরে বলল।

এখনও এদেশে ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন। অনিমেষ ঘরের দিকে এগোেল।

খাটে বসে মাধবীলতা বলল, ওরা তোমাকেই সন্দেহ করেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ পায়নি।

এর পরে কী হবে?

আমার মনে হয়, ভালমতো শিক্ষা দিয়ে ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

শিক্ষা পেলে যদি এরা শোধরায়।

এর পরে ওই ক্লাবের ছেলেরা চুপচাপ থাকবে?

কিন্তু তুমি কি এসপির কাছে ওদের সঙ্গে যাবে?

এটা কাউন্সিলারের চালাকি। না, আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব।

হ্যাঁ। যেয়ো না। গেলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে যাবেন।

এসপি যে এতটা সাহসী হবেন ভাবতে পারিনি। সেদিন মনে হয়েছিল এসে কোনও লাভ হল না। সত্যি মানুষ চেনা সহজ নয়। কিন্তু লতা, আমার উচিত ফোন করে ওঁকে ধন্যবাদ জানানো। অনিমেষ বলল, মিস্টার রায়ের কাছে নম্বরটা পেতে পারি।

কাল সকালে কোরো। যাই খাবারের ব্যবস্থা করি।

ছোটমা খেয়েছেন?

আগে তো রাত্রে খেতেন না। এখন আটটা নাগাদ দই মুড়ি খাচ্ছেন। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। মাধবীলতা উঠেই দাঁড়িয়ে গেল, আচ্ছা। অর্ক তো আর ফোন করল না।

দরকার নেই তাই করেনি। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা মোবাইল তুলে নাম্বার ডায়াল করল। বস্তুটাকে কানে চেপে শুনল, আউট অব রেঞ্জ। অবাক হয়ে বলল, গেল কোথায়? বলছে আউট অব রেঞ্জ।

সত্যি কথাই তো বলছে। কাল সকালে কোরো। অনিমেষ বলতেই দরজায় শব্দ হল। ফোন নামিয়ে মাধবীলতা ছোটমাকে দেখতে পেয়ে বলল, আসুন? কী ব্যাপার, আপনি এখনও ঘুমোননি?

না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ছোটমা হাসলেন।

আপনি কিছু বলবেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অনেকদিন পরে, ঠিক কতদিন তা নিজেই জানি না, ওই আশ্রমে সারাদিন থেকে আমার খুব ভাল লেগেছে। দিদিরা আমাকে অনেক বার বলেছেন ওখানে যাওয়ার জন্য। আমি মাঝে মাঝে যেতে পারি না?

কেন পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। মাধবীলতা বলল।

আর তারপর যদি মনে হয় ওঁদের সঙ্গে থেকে গেলে ভাল থাকব, তা হলে? ছোটমা এবার অনিমেষের দিকে তাকালেন।

.

৩৩.

রাত দশটায় ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে বোলপুরে পৌঁছোয় মধ্যরাতে। ওই ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় রামজিকে নিয়ে উঠেছিল অর্ক। আশ্চর্য ব্যাপার, সংরক্ষিত কামরার কোনও সিট যখন খালি নেই, টিটির পেছনে যাত্রীরা ঘুরছে করুণা পাওয়ার জন্যে তখন ওই অসংরক্ষিত কামরায় পা ছড়িয়ে বসা গেছে। মাঝখানে বর্ধমান, তার পরেই বোলপুর। এই ট্রেনে যাত্রীরা সচরাচর বোলপুরে যায় না। যারা ওঠার তারা উঠে গেলে ট্রেন যখন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন প্লাটফর্ম শুনশান।

রামজি বলল, এত রাত্রে তো কোথাও যাওয়া যাবে না।

ওয়েটিংরুমে চলুন। ভোর অবধি থাকতে হবে। অর্ক হাঁটল।

ওখানে গেলে পুলিশের নজরে পড়ব না তো?

আচ্ছা, পুলিশ কি আপনার ছবি ছাপিয়ে হুলিয়া জারি করেছে যে বোলপুরের রেল পুলিশ দেখলেই চিনতে পারবে?

না না। মাথা নাড়ল রামজি।

ওয়েটিং রুমের চেয়ারগুলো দখল করে যাত্রীরা ঘুমোচ্ছে। মাটিতেও কয়েকজন শুয়ে। ওরা তাদের পাশেই বসে পড়ল। ঝিমুনি আসছিল। ধুলোটে মেঝের ওপর শোওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, এই সময় দুজন লোক ঘরে ঢুকল। তারা চারপাশে তাকিয়ে দেখল। একজন বলল, দূর শালা, হাউজফুল।

ওই লোকটা দুটো চেয়ার দখল করে আছে? বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাটা পা রেখেছে একটাতে, তোল ওকে। দ্বিতীয়জন বলল।

না, কাউকে ডিস্টার্ব করবি না। ফালতু গোলমাল হবে। এই মেঝের ওপর বসে পড়া যাক। প্রথমজন মেঝেতেই বসে একটা সিগারেট বের করল বুকপকেট থেকে, আগুন দে।

দেশলাই দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, দুটো টান দিয়ে।

ধোঁয়া ছেড়ে প্রথমজন বলল, লক্ষ্মণদা নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। সব শালাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। দেখবি, দুদিনেই সব বেলুন চুপসে যাবে।

দেখো দাদা, কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার দাদার চাকরিটা দরকার। বিন্টুদা বলেছে ওটা হয়ে যাবে। পার্টি থেকে নাম পাঠিয়েছে। তা বিদা যখন বলল তোমার সঙ্গে নন্দীগ্রামে যেতে তখন

বলতে পারলাম না। না গেলে যদি দাদার চাকরি কেঁচে যায়? দ্বিতীয়জন বলল।

এটাই মুশকিল। তোরা কেউ পার্টির কথা ভাবিস না। শুধু পার্টিকে ভাঙিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। নে– প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে সিগারেট এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে লম্বা টান দিয়ে দ্বিতীয়জন বলল, কিছু মনে কোরো না, নিজের পেট ভরে গেলে উপদেশ দেওয়া যায়। এই যে তোমার বাইক, দোতলা বাড়ি, তোমার দাদার প্রোমোটারি বিজনেস, এসব তো আকাশ থেকে পড়েনি। সিগারেট ফেরত দিল দ্বিতীয়জন।

প্রথমজন হাসল, তোর কথা শুনে একটুও রাগলাম না। পার্টি করছিস মাত্র দুবছর। লেগে থাকলে তোরও হবে। এই যে আজ যারা বীরভূম থেকে নন্দীগ্রামে যাচ্ছে তাদের সবাই তো ওই আশা নিয়ে যাচ্ছে, একদিন তাদেরও হবে।

দাদা, অনেকে বলছিল, খুব মারপিট হতে পারে। সত্যি?

দূর! বন্দুকের সামনে কে আসতে সাহস করবে? আমাদের সঙ্গে তো পুলিশ আছে। সব শালাকে লাশ বানিয়ে দেবে। প্রথমজন সিগারেট নেভাল।

ওখানকার গাঁয়ের লোক নাকি রাস্তা কেটে পুলিশের গাড়িকে ঢুকতে দিচ্ছে না। মেয়েরাও শুনলাম এককাট্টা হয়েছে? দ্বিতীয়জন একটু নার্ভাস।

পেপারে পড়েছিস নিশ্চয়ই। তুই এতদিনে জানলি না যে পেপার খবর তৈরি করে, পাবলিককে খ্যাপাতে হলে তৈরি খবর চাই। প্রথমজন মোবাইলে সময় দেখল, তিনটে নাগাদ স্টেশনের বাইরে যেতে হবে। বাস আসবে।

কতক্ষণ লাগবে?

যতক্ষণ লাগুক তোর তাতে কী? সেই সন্ধে থেকে বীরভূম জেলার ক্যাডারদের তুলে নিয়ে বাসে করে নন্দীগ্রামে। ওঠ। প্রথমজন উঠে দাঁড়াল।

কোথায় যাবে?

চল, দেখি, ঠেকটা এখনও ভোলা আছে কি না।

বলমাত্র হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয়জন। ওরা ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজির চোখ বন্ধ। ওইসব সংলাপ ওর কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। ঢুকলেও মানে বোঝা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই ছেলেদের নন্দীগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? সেখানে ভূমি সংরক্ষণ সমিতির সঙ্গে সিপিএমের লড়াই চলছে। সিপিএমকে তাড়িয়ে গ্রামের মানুষ এখন দলবদ্ধভাবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রাস্তা কেটে দিয়েছে যাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে না পারে। বলা হচ্ছে, ওইসব গ্রামগুলোতে প্রশাসনিক কাজকর্ম একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুরাবস্থায় পড়া সত্ত্বেও মানুষ তাদের পৈতৃক জমি ছাড়তে রাজি নয়। তৃণমূল পার্টি তাদের সাহস জোগাচ্ছে। এই ঘটনাগুলো তো খবরের কাগজের দৌলতে সবাই জানে। কিন্তু এই যে বীরভূমের মতো জেলা থেকে নিচুতলার কর্মীদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওখানে, এই খবর এখনও প্রকাশিত নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওখানকার শক্তিহীন দলের শক্তি বাড়াতেই এই ব্যবস্থা। যারা যাচ্ছে তারা অবশ্যই কিছু পাওয়ার আশায় বাড়ি ছাড়ছে। এই দেশের রাজনীতি মানেই পাওয়ার আশায় হাঁটা।

ভোর চারটে নাগাদ রামজিকে ডেকে বাইরে বেরিয়ে এল অর্ক। এখনও পৃথিবীতে অন্ধকার চেপে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই লোকজন জেগে উঠেছে, রিকশায় যাত্রীরা স্টেশনে আসছে। একটু হাঁটতেই সদ্য খোলা চায়ের দোকান থেকে ওরা চা কিনে খেয়ে জেনে নিল বাস টার্মিনাস কত দূরে।

খানিকটা যেতেই রামজির মোবাইলে রিং শুরু হল। রামজি দ্রুত সেটা বড় করে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, রামপ্রসাদ। তারপর দেহাতি হিন্দিতে কথা বলে যেতে লাগল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছু কিছু শব্দ বুঝতে পারল অর্ক। ফোন বন্ধ করে কাছে এসে রামজি বলল, রামপ্রসাদ ফোন করেছিল। রামগঙ্গা জায়গাটা কোথায়?

কোন রামগঙ্গা?

সুন্দরবনের কাছে। বলল, নদীর একদিকে রামগঙ্গা, অন্যদিকে পাথর, পাথর, –যাঃ ভুলে গেলাম নামটা। রামজি বলল।

পাথরপ্রতিমা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেক লাগবে যেতে? কেন?

ঠিক চারদিনের মাথায় ওই রামগঙ্গায় যেতে হবে আমাকে। রামজি বলল, কীভাবে যাব তা দয়া করে বলে দেবেন।

এর জন্যে দয়া করার কী আছে? কিন্তু চারদিনের জন্য আশ্রমে যাবেন, এখানকার কোনও হোটেলে থাকবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আমার কাছে তো বেশি টাকা নেই। আর হোটেলে উঠলে তো মানুষের নজর পড়বে। রামজি বলল।

কথাটা ঠিক।

.

বাসে উঠে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল ওরা। অর্ক সেই ছেলেদের কথা ভাবছিল যারা আজ নন্দীগ্রামে চলে গিয়েছে, আবার তার পাশে বসে আছে যে সে কদিন পরে সুন্দরবনে যাবে। এই যে রামজিকে সে সাহায্য করছে তা কি শুধু যে লোকটি ওকে পাঠিয়েছে তার কথা ভেবে? এই যে এতদিন রামজির সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছে তাতে তার মনেও কি একই ভাবনা জন্ম নেয়নি? কিন্তু ভাবনা জন্ম নেওয়া এক কথা, আর সেই ভাবনাকে বাস্তব করতে ঝাঁপিয়ে পড়া আর এক কথা। সেটা করতে গেলে মানসিক প্রস্তুতির দরকার। যারা নন্দীগ্রামে গিয়েছে তাদের আসল লক্ষ্য নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা। চাকরি, টাকা, ক্ষমতা হাতে পাওয়া। কিন্তু এই রামজি এবং তার মতো ছেলেরা পশ্চিমবাংলার বাইরে থেকে যে অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদের তো এখান থেকে কিছু পাওয়ার নেই।

বাবার কথা সে মায়ের কাছে ছেলেবেলায় কিছু কিছু শুনেছে। ওই আন্দোলন যাকে নকশাল আন্দোলন বলা হত, তার উদ্দেশ্য ছিল বন্দুকের মাধ্যমে শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি করা। ভারতীয় সংবিধান বা গণতন্ত্রকে তারা নাকি সোনার পাথরবাটি বলে মনে করত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা গ্রাস করে বড়লোক হয় আর গরিব আরও নিঃস্ব হয়ে যায়। নকশাল আন্দোলন এর উলটো পথে দেশকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের না ছিল সংগঠন, না অস্ত্রবল না উপযুক্ত নেতা। ফলে সেই আন্দোলনকে চুরমার করে দিতে সরকারের বেশি সময় লাগেনি।

বাবার দিকে তাকিয়ে অর্কের অনেকবার মনে হয়েছে এই মানুষটা যে আবেগ নিয়ে সব ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, জেল খেটেছিল, পুলিশ যাকে পঙ্গু করে দিয়েছে সে আজ কী অসহায় হয়ে বেঁচে আছে। সেই আবেগের কথা ভুলেও বোধহয় আর ভাবে না। আগুন যতক্ষণ দাউদাউ করে জ্বলে ততক্ষণ তার চেহারায় যে অহংকার তা ছাই হয়ে যাওয়ার পর খুঁজতে চাওয়া বোকামি।

কিন্তু রামজির সঙ্গে কথা বলে অর্ক বুঝেছে ওদের সংগঠন এখন বেশ মজবুত। ভারতবর্ষের কয়েকটি প্রদেশে ওরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সব কথা রামজি খোলাখুলি না বললেও অর্কর অনুমান ও কয়েকমাস ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। দলের ওপরতলার সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই, ওই রামপ্রকাশের সঙ্গেই তাকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই যে সে কলকাতায় এসে অর্কর সঙ্গে আছে, অর্কর সাহায্য পাচ্ছে তা দল অবশ্যই জেনে গেছে।

তরুণ বয়সে বস্তির মানুষকে নিয়ে কমিউন তৈরি করতে চেয়েছিল অর্ক। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সেই কমিউনে বস্তির মানুষদের একত্রিত করে দুবেলা ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। ব্যাপারটা যখন ভাল দিকে এগোচ্ছিল তখনই তার ওপর আঘাত নেমে আসে কারণ সে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি। কমিউনের ভোটগুলো ওদের ব্যালট বাক্সে চালান করতে রাজি হয়নি। এতটা কাল ক্ষোভের ঘোলা জল একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে মনের ভেতর পাক খেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারছিল না কোন পথে সে হাঁটবে। অথবা হাঁটাটা দরকার, না বসে। থেকে দেখে যাওয়াটাই স্বস্তির?

.

বাস থেমে নেমেই ওরা নদী দেখতে পেল। এর মধ্যে অন্ধকার সরে গেছে, নবীন সূর্য আকাশে স্পষ্ট। হালকা রোদে পৃথিবী ঝলমল। জায়গাটার একেবারেই বীরভূমি নাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে আশ্রমের সন্ধান জানা গেল।

গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে সন্ন্যাসিনীর আশ্রম। এমন কিছু বড়সড় নয় কিন্তু একটি মন্দির এবং অনেকগুলো টিনের চালাঘর রয়েছে। বাখারির বেড়া দেওয়া আশ্রমের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই দুজন শিষ্য কৌতূহলী চোখে তাকাল। অর্ক দুই হাত জোড়া করে বলল, নমস্কার।

জয় গুরুমা। আসুন। আপনাদের পরিচয়? একজন শিষ্য জানতে চাইলেন।

দেওয়ার মতো পরিচয় কিছু নেই। আমরা কলকাতা থেকে আসছি। অর্ক বলল।

এইসময় আর একজন প্রবীণ শিষ্য ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অর্কর দিকে তাকিয়ে বললেন, মহাশয়কে মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি। নামটা…?

আমার নাম অর্ক, ওর নাম রামজি।

বাঃ! কী সৌভাগ্য। এই প্রভাতে সূর্যদেব এবং ভগবান শ্রীরামের নামধারীরা আমাদের আশ্রমে পদার্পণ করেছেন, কিন্তু কোথায় দেখেছি?

আপনি বোধহয় ট্রেনে দেখেছেন। নর্থ বেঙ্গল থেকে ফিরছিলাম।

ও তাই তো। বয়স মানুষের স্মৃতিকে দুর্বল করে দেয়। তা হলে আপনি এলেন। গুরুমা আমাকে আপনার কথা বলেছিলেন। আমাদের বলেছেন, দ্যাখ ও ঠিক আসবে। গুরুমায়ের কথা বৃথা হয় না। তারপর অন্য দুজনকে বললেন, তোমরা ওঁদের সাত নম্বর ঘরে নিয়ে যাও। হাতমুখ ধুয়ে একটু জলযোগ করুন। তারপর গুরুমার আদেশ হলে দর্শন করতে যাবেন।

.

টিনের চাল, ইটের দেওয়াল, মেঝেতে ইট পাতা, দুটো তক্তপোশে বিছানা। হাতমুখ ধুয়ে রুটি তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়ল রামজি। বলল, খুব ঘুম পাচ্ছে।

অর্ক কথা বলতে গিয়ে শুনল ঘণ্টা বাজছে। আর তার পরেই শুরু হয়ে গেল প্রার্থনাসংগীত। যারা গাইছে তাদের সবাই পুরুষ, কোনও নারীকণ্ঠ নেই। ঘরের দরজায় তরুণ শিষ্যদের একজন এসে দাঁড়াল, আপনারা নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে এসেছেন তাই এখন প্রার্থনায় যেতে হবে না। বিশ্রাম করুন। বেলায় গুরুমা দর্শন দেবেন।

অর্ক মাথা নাড়লে তরুণ চলে গেল।

দরজা ভেজিয়ে অর্ক বলল, ভদ্রমহিলা বেশ বাস্তববোধসম্পন্ন।

কী বললেন? রামজি পাশ ফিরল।

হিন্দিতে বাক্যটির অর্থ বুঝিয়ে দিল অর্ক।

কিন্তু এটা তো একেবারে ধর্মস্থান। আশ্রম শুনে ভেবেছিলাম হয়তো অনাথ আশ্রম অথবা বৃদ্ধাশ্রম। রামজি শ্বাস ফেলল।

আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অর্ক শুয়ে পড়ল।

আপনার হচ্ছে না? কিন্তু যদি ওরা জানতে পারে আমি হিন্দুনই তা হলে? তখন কী করবে ওরা জানি না।

কেন এসব ভাবছেন?বরং ভাবুন, এখানে আপনি একদম নিরাপদ। পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না যে আপনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এইসব আশ্রমে পুলিশ কখনওই আসে না। তা ছাড়া, মনে হচ্ছে এই গুরুমায়ের বেশ ভাল নামডাক আছে। আপনি আরামে থাকবেন। অর্ক বলল।

বুঝলাম। কিন্তু আমি তো কখনও হিন্দুদের প্রেয়ার করিনি।

আপনার কি ধারণা আমি করেছি?

করেননি?

না। আমার মতো লক্ষ লক্ষ জন্মসূত্রে হিন্দু মন্দিরে যায় না। সকাল বিকেল পুজো করে না। এমনকী বেশিরভাগ বাড়িতে ঠাকুরঘরও নেই। আর আজকের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় তারা বিনোদনের মজা পেতে চায়। অতএব, আমি যা করব আপনি তাই অনুসরণ করবেন। হেসে ফেলল অর্ক, একটা গান আপনি শোনেননি, তাতে বলা হয়েছে কৃষ্ণ এবং খ্রিস্ট একই। চোখ বন্ধ করে আপনি ভাববেন যিশুখ্রিস্টকে স্মরণ করছেন।

.

বেলা সাড়ে দশটায় যখন ডাক পড়ল তখন রামজি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছ। বেলগাছিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তালসারি ছুঁয়ে আবার কলকাতা হয়ে এখানে আসা পর্যন্ত যে টেনশনে ছিল তাতে এখন এই ঘুম খুব স্বাভাবিক। ওকে না তুলে অর্ক তরুণ শিষ্যটিকে একাই অনুসরণ করল।

মন্দিরটি বেশ সুন্দর। ছোট কিন্তু সাজানো। মায়ের মূর্তিটিও বেশ। মুখের আদলে স্নেহ জড়ানন। শিষ্য প্রণাম করায় অর্ক হাতজোড় করল। শিষ্য বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন না আমাদের মা খুব জাগ্রত।

আপনি কি গুরুমায়ের কথা বলছেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্রুত মাথা নাড়ল শিষ্য, তিনি তো বেঁচেই আছেন, তা ছাড়া তাকে আমরা গুরুমা বলে সম্বোধন করি। মা বলি এই দেবীকে। বহু বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাটির দশহাত নীচ থেকে এই দেবীমূর্তিকে তুলে আনা হয়েছে। আগে রোজ খুব ভিড় হত বলে গুরুমায়ের নির্দেশে শুধু শনি এবং মঙ্গলবারে সাধারণ ভক্তদের এখানে আসতে দেওয়া হয়। চলুন।

.

৩৪.

মন্দিরের সামনে কোলাপসিবল গেট ছাড়াও দেবীমূর্তির দুপাশে আর একটি দরজা আছে যা সম্ভবত মন্দির বন্ধ করার সময় টেনে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই দেবীমূর্তির সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্রম কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সতর্ক। অর্কর মনে হল মূর্তিটি নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান।

মন্দিরের পেছনে একটি সুন্দর একতলা বাড়ি যার পাশেই অজয় নদী। নদীর জল এখন বেশ কম। চর দেখা যাচ্ছে, ওরা বাড়িটির সামনে যেতেই একজন বেশ বৃদ্ধ শিষ্য এগিয়ে এলেন, আসুন। আপনার সঙ্গী এলেন না?

না। ওর শরীর বেশ দুর্বল। ঘুমোচ্ছে বলে নিয়ে এলাম না।

সে কী? কী হয়েছে? বৃদ্ধ উদ্বিগ্ন হলেন।

না না। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ও। মায়ের আশীর্বাদে নিশ্চয়ই উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনি আসুন। গুরুমা আপনার জন্যে অপেক্ষায় আছেন। বৃদ্ধ শিষ্য কথাগুলো বলমাত্র তরুণ শিষ্য ফিরে গেল।

ঘরের পরদা সরিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, ভেতরে যান।

ভেতরে ঢুকেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল না অর্ক। ছিমছাম এই ঘরটিতে আসবাবের বাহুল্য নেই। তখনই মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, কই, এদিকে এসো, আমি বারান্দায়।

ওপাশের দরজা দিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পেল অর্ক। বারান্দার ওপাশে ফুলের বাগান, তারপরেই নদীর জল। সন্ন্যাসিনী বসে আছেন একটা বেতের মোড়ায়। ট্রেনে যে পোশাকে সে ওঁকে দেখেছিল পরনে সেই একই পোশাক। হেসে বললেন, ওই মোড়া টেনে নিয়ে বসো।

অর্ক বসতে বসতে ভাবল প্রণাম করা ঠিক হবে কিনা। সে দুই হাত জোড় করে বলল, নমস্কার।

তা তো বুঝলাম, তবে আমি ভেবেছিলাম অনেক আগেই তোমার দেখা পাব। আমাকে বেশ অপেক্ষায় রাখলে তুমি।

সন্ন্যাসিনী হাসলেন। হাসলে ওঁকে খুব সুন্দর দেখায়।

আপনি কী কারণে এটা ভেবেছিলেন?

তোমার চোখ দেখে। মা মানুষকে চোখ দিয়েছেন পৃথিবীকে দেখার জন্যে। মানুষ তো নিজের চোখ দেখতে পায় না। তুমি বলতে পারো, তা কেন, আয়নায় তো দিব্যি দেখা যায়। কিন্তু আয়নায় মানুষ নিজের মুখ দেখে, কজন আর শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু সেই চোখ দেখলে আমি তার মনের খবর পেয়ে যাই। তোমার চোখ দেখে বুঝেছিলাম, তুমি আসবেই। আসবে। হাসলেন সন্ন্যাসিনী।

অর্ক অবাক হয়ে শুনছিল। একটু চুপ করে থেকে সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞাসা করলেন, এই দ্যাখো, কী ভাবছ তুমি?

আপনিই বলুন। আমার চোখ দেখে বলুন কী ভাবছি। অর্ক বলল।

বলছি। তুমি ভাবছ এ কোথায় এসে পড়লাম। এরকম কথা তো কখনও শুনিনি। বলতে বলতে সন্ন্যাসিনী বললেন, তোমার নামটা ভুলে গেছি।

আমি কি আপনাকে নাম বলেছিলাম? মনে পড়ছে না। তারপরেই দুষ্টুমি করতে চাইল অর্ক, আচ্ছা, নামে কী এসে যায়!

তা ঠিক। আমরা অবশ্য গৃহপালিত পশুদের একটা নাম দিই, কিন্তু তাদের চেহারা বেশ বড়সড়। হাঁস মুরগির কেউ নাম রাখে না। এখন বলো, তোমার এখানে আগমনের উদ্দেশ্য কী? সন্ন্যাসিনী বড় চোখে তাকালেন।

আমাদের কদিন একটু নির্জনে থাকার ইচ্ছে হল। আপনি বলেছিলেন নদীর ধারে আশ্রম। এখানে আসতে বলেছিলেন। তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ। তুমি কি ঠাকুর দেবতা মানো?

না মানলে এখানে থাকতে দেবেন না?

ওমা! এ কথা কখন বললাম?

বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করছি।

দেখো, তুমি যদি না মানো তা হলে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তুমি যদি আমার ওপর ওই না মানাটাকে চাপিয়ে দিতে চাও তা হলে অবশ্যই তোমাকে সঙ্গ ত্যাগ করতে বলব।

মাথা নাড়ল অর্ক, ঠাকুর দেবতা নিয়ে কখনওই মাথা ঘামাইনি।

জোর করে মাথা ঘামাবে কেন? আচ্ছা, এই যে তুমি বসে আছ, একটু চেষ্টা করো তো, বসে বসে মাথায় ঘাম আনতে পারো কিনা?

অসম্ভব।

তা হলে ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ওই চেষ্টা করাও নিরর্থক। যখন মন চাইবে তখন আপনি ইচ্ছে করবে। তখন মাথা কেন, তোমার অস্তিত্ব জাগ্রত হবে। মন না চাইলে নির্লিপ্ত থাকাই তো ভাল।

আমরা এখানে দিন তিনেক থাকতে চাই। অর্ক বলল।

এ কী? এত অল্প দিন? কথা বলে আমার তো সুখই হবে না। বলেই সন্ন্যাসিনী হাসলেন, অবশ্য অল্পেই সন্তুষ্ট হওয়া ভাল। প্রসাদ কণিকাতেই যথেষ্ট।

আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। আমি খুব অবাক হয়েছি যখন এখানে এসেই একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, আপনি তাকে বলেছেন আমি এখানে আসবই। অর্ক বলল, স্বীকার করছি আপনি ঠিক অনুমান করেছিলেন।

সন্ন্যাসিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সংসার ধর্ম পালন করছ না, না?

আমি বিবাহিত নই।

তোমার মা, বাবা?

আছেন। মা শিক্ষিকা ছিলেন।

বাবা?

একটু চুপ করে শেষ পর্যন্ত বলল অর্ক, বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন। পুলিশের অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তাই কাজকর্ম করতে পারেননি।

কী নাম তোমার বাবার?

অনিমেষ মিত্র।

তুমি কী করো? একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন সন্ন্যাসিনী।

আমি একটা চাকরি করছি।

আর?

আর কিছু না।

আমার মনে হচ্ছে তুমি সত্য বলছ না। যাক গে, তোমাকে এখানকার প্রার্থনায় যোগ দিতে হবে না। ওই নদীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখো। খুব ভাল লাগবে। ভোরের আগের অন্ধকার আর সূর্য ডোবার পরের অন্ধকারের মধ্যে কোথাও মিল আছে কি না খুঁজতে চেষ্টা করো। তবে আশ্রম থেকে বেরিয়ে ওই বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যাওয়াই ভাল। মানুষ অকারণে কৌতূহলী হয়। এসো। সন্ন্যাসিনী উঠে দাঁড়ালেন।

ঘরে ফিরে তক্তপোশে শুয়েও ঘুম আসছিল না অর্কর। পাশের তক্তপোশে রামজি নাক ডাকছে মৃদু। কাল গোটা রাত জেগে থেকে শরীর ঘুম চাইছে কিন্তু পাচ্ছে না। সন্ন্যাসিনী বারংবার চোখের সামনে চলে আসছেন। এরকম মহিলাকে সে কখনও দেখেনি। কথা শুনলে মনে হবে উনি বেশ শিক্ষিত। ওঁর প্রতিটি কথাই অসাধারণ। কিন্তু মহিলা কী করে অনুমান করলেন সে এখানে আসবেই। সাধু সন্ন্যাসিনীদের কী সব শক্তি থাকে বলে সে শুনেছে কিন্তু কোনওদিন বিশ্বাস করেনি। এখন মনে হচ্ছে এটাও কোনও শক্তির ব্যাপার নয়। ওঁর মনে হয়েছে সে এখানে এলে ভাল হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছেন ব্যাপারটা সত্যি হবে আর সেই ভাবনার কথা অন্যদের বলেছেন। কিন্তু সে এখানে এলে উনি কেন খুশি হবেন? ট্রেনে অত অল্পসময়ের আলাপে তো এরকম ভাবনা আসার কথা নয়। ঘুম আসছিল না, তারপরেই মনে পড়ল, অনিমেষ মিত্রের নাম শুনে একটু চুপ করে ছিলেন, সে যে শুধু চাকরি করে এটাও বিশ্বাস করেননি। করেননি বলে সতর্ক করেছেন যেন তারা বাসস্ট্যান্ডের দিকে না যায়। নদীর ধারে ঘুরতে বলেছেন, অন্ধকার দেখতে বলেছেন। এসব তো বলতে হয় তাই বলা। কিন্তু উনি নিশ্চয়ই অনুমান করেছেন ওরা এখানে আড়াল খুঁজতে এসেছে। রামজির ব্যাপারে একটুও উৎসাহ দেখালেন না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষের কৌতূহলী চোখ এড়াতে যিনি সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন জানাজানি হলে তারা বিপদে পড়বে। সেটা জেনেও কেন তাদের আশ্রয় দিলেন? অর্ক ব্যাখ্যা পাচ্ছিল না।

নদীতে জল কোথাও কোমরের ওপরে, কোথাও হাঁটু ছোঁওয়া। তরুণ শিষ্য বলল, আপনারা ইচ্ছে করলে নদীতেই স্নান করতে পারেন। না হলে ওই যে ইঁদারা আছে ওখানেও সেরে নিতে পারবেন। স্নান সেরে আমাদের খাওয়ার ঘরে চলে আসুন। মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়ে গিয়েছে।

নদীর জল খুব ধীরে বয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে বালির চরে কয়েকটা শকুন বসে আছে দেখে ওরা ইঁদারায় স্নান করে নিল। পোশাক বদলে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ তো ঘুমালেন, এখন কেমন লাগছে?

ভাল। ওঃ, ঘুমটার দরকার ছিল। আচ্ছা, এই আশ্রমের প্রধানের সঙ্গে কখন দেখা করতে হবে? আমার খুব নার্ভাস লাগছে। রামজি বলল।

ওঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আপনাকে যেতে হবে না।

যাক! আর পরীক্ষা দিতে হবে না।

খাওয়ার ঘরটিতে কোনও দেওয়াল নেই। টেবিলের পাশে বেঞ্চি পাতা। বাঁশের ওপর টিনের চাল। খেতে বসলে গায়ে বাতাস লাগে। ওরা যেতেই তরুণ শিষ্যটি বসার ব্যবস্থা করে দিল। আরও জনা আষ্টেক শিষ্য তখন দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত।

খাবার এল। কলাপাতায় ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর চাটনি। গুরুমায়ের কাছে যে বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখেছিল অর্ক তিনি এসে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, খুব সামান্য ব্যবস্থা। আজ বৃহস্পতিবার তাই আমিষ গ্রহণ করি না। আপনাদের হয়তো খেতে অসুবিধে হবে।

অর্ক বলল, এ নিয়ে ভাববেন না। খেয়ে তৃপ্তি পেলে নিরামিষই অমৃত।

বাঃ। ভাল বলেছেন। একটা কথা, আমরা সাধারণ মানুষ। গুরুমা যা। পারেন আমরা তা কীভাবে পারব। যাঁর সঙ্গে কথা বলছি তাঁর নাম না জানা থাকলে অস্বস্তি হয়। আমার নাম যুধিষ্ঠির।

ভাত খেতে খেতে অর্ক বলল, আমি অর্ক মিত্র।

এরকম নাম আগে শুনিনি। সূর্য তো আকছার, কিন্তু অর্ক আমার কাছে নতুন। আর ওঁর নাম?

ওর নাম রামজি। অর্ক বলল, ও অবাঙালি।

বাঃ, স্বয়ং রামজি আমাদের এখানে অন্নগ্রহণ করছেন। কী সৌভাগ্য। গুরুমাকে সংবাদটা দিতে হবে। রামজিভাই, আপনার খেতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? খানা কি আচ্ছা হ্যায়?

রামজি হেসে ফেলল, বহুৎ আচ্ছা।

বৃদ্ধ শিষ্য খুশি হয়ে চলে গেলে অর্ক খেয়াল করল অন্যরা খেতে খেতে তাদের লক্ষ করছে। গায়ে পড়ে কথা বললে কথা বাড়বে বলে মুখ নামিয়ে খেয়ে নিল অর্ক। রান্না খুবই সুস্বাদু। তরকারিটা তো অসাধারণ। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ওরা ঘরে চলে এল। এখন পেটে খাবার যেতে শরীর শিথিল লাগছিল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি আবার ঘুমাবেন? না না। আপনি ঘুমিয়ে নিন। আমি একটু চারপাশ ঘুরে দেখে আসি। এদিকে নিশ্চয়ই কাছাকাছি থানা নেই। রামজি বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল, না, একা কোথাও যাবেন না। গুরুমাও চান না আমরা কোনও বিপদে পড়ি। শুয়ে পড়ুন। বিকেলে নদীর ধারে যাব।

.

কাল রাত্রে কথা এগোয়নি। ছোটমার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলেছিল, তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

শোনার পর ছোটমা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সকালে চা খেতে খেতে মাধবীলতা কথাটা তুলল, তুমি বললে উনি বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তোমার আপত্তি নেই। আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।

কেন? অনিমেষ চায়ের কাপ নামাল।

এতদিন একা ছিলেন, আমরা এসে বাড়ি বিক্রি করে ওঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলাম। মানুষ তো বলবে আমরা ঘাড় থেকে বোঝা নামালাম।

মাধবীলতার গলার স্বরে অনেকটাই হতাশা।

কোন মানুষ কী বলছে তা নিয়ে তুমি আজ ভাবছ লতা? এতদিন তো দেখেছি যেটা ভাল বলে মনে করো তা করতে, কারও কথা গ্রাহ্য করো না। তুমি এ কথা কেন ভাবছ না, এতদিন এই বাড়িতে একা থেকে উনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। গতকাল দেবেশের ওখানে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে ওঁর মন থেকে অনেক চাপ সরে গিয়েছে। ওঁর কথাবার্তাও বদলে গিয়েছে অনেকটাই। মাঝে মাঝে ওঁদের কাছে গিয়ে যদি ওঁর মনে হয় ওখানে পাকাপাকি থাকলে উনি ভাল থাকবেন তা হলে সেটাই মেনে নেওয়া উচিত। অনিমেষ বলল। এর বিকল্প কি কিছু আছে?

হ্যাঁ, আছে।

বলো।

বাড়ি বিক্রির টাকায় ওঁর নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে আমরা তিনজনই সেখানে থাকতে পারি। আমি সঙ্গে থাকলে উনি ভাল থাকবেন।

ফ্ল্যাটটা কোথায় নেওয়া হবে?

উনি যেখানে গিয়ে থাকতে চাইবেন।

তারপর? উনি চলে গেলে? ফ্ল্যাটটা তো আমাদের হয়ে যাবে। আমি চাই না তারপরে ওটা অর্কর হাতে যাক।

শুধু অর্কর হাতে যাবে বলে তুমি রাজি হচ্ছ না?

না। আসল কারণটা তুমি জানো। এই বাড়ি বিক্রির টাকায় কেনা ফ্ল্যাটে আমি থাকতে পারি না। কারণ এই বাড়ির কাছে আমার যা ঋণ তা আমি শোধ করিনি। শোধ করার সময়ও চলে গেছে।

তা হলে আমার কিছু বলার নেই। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল।

বাড়ি বিক্রি করার পর সেই টাকার কী হবে?

ভাবতে হবে। বিক্রির পরে ব্যাঙ্কে ছোটমার নামেই তো থাকবে।

দরজা পর্যন্ত চলে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল মাধবীলতা, আর একটা কথা। দেবেশবাবুরও তো বয়স হয়েছে। যদি ওঁর কিছু হয়ে যায় তা হলে অতগুলো মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন?

অনিমেষ তাকাল। এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই।

মাধবীলতা বেরিয়ে গেল, উত্তরের অপেক্ষা না করে।

.

বেলা নটা নাগাদ মিস্টার রায়ের সহকারী ফোন করে জানালেন, আজ ঠিক বারোটা নাগাদ কোর্টে চলে আসুন আপনার মাকে নিয়ে।

আজ? অনিমেষ অবাক।

হ্যাঁ। আজই তো শুক্রবার। কোর্ট কোথায় তা জানেন তো?

আগে তো আমাদের বাড়ি থেকে ডি এমের বাড়ির দিকে গিয়ে নদীর ধারেই ছিল। অনিমেষ বলল।

ছিল। এখন নেই। এখন নবাববাড়িতে। আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে করলা নদী পেরিয়ে সমাজপাড়ায় এসে এল আই সি বিল্ডিং থেকে ডানদিকে এগোলেই বাঁদিকে নবাববাড়ি দেখতে পাবেন। মিস্টার রায়ের নাম বললেই যে কেউ ওঁর চেম্বার দেখিয়ে দেবে। ফোন রেখে দিল ছেলেটি।

ভাগ্যিস নিবারণবাবু সাহায্য করলেন তাই দু-দুটো রিকশা পাওয়া গেল। ছোটমা যে এত সহজে যেতে রাজি হয়ে যাবেন তা মাধবীলতাও ভাবেনি। দরজায় তালা দিয়ে সেজেগুজে ওরা নবাববাড়িতে পৌঁছে গেল। এবার অনিমেষ একা রিকশায়। কোর্ট চত্বরে রিকশা থেকে নামতে একটু অসুবিধা হল তার। রিকশাওয়ালা সাহায্যের হাত বাড়াবার কথা ভাবেনি। অনিমেষের সমস্যা দেখে এক ভদ্রলোক দ্রুত এগিয়ে এলেন, আমার কাঁধে হাত রাখুন।

সোজা হয়ে নেমে অনিমেষ বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আরে না না–। ভদ্রলোক থেমে গেলেন, খুব চেনা লাগছে, কী নাম বলুন তো ভাই?

অনিমেষ মিত্র।

আরে তাই। কতদিন পরে দেখা হল। তোমার এই অবস্থা কেন?

হয়ে গেল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি?

আমি অজিত। একসঙ্গে জেলা স্কুলে পড়তাম। চাকরি করেছি এতকাল। আইন পাশ করা ছিল। এখন রিটায়ার করার পর বাড়িতে না বসে থেকে কোর্টে আসা যাওয়া করি। তুমি এখানে?

অজিতকে মনে পড়ে গেল অনিমেষের। খুব পাকা কথা বলত সে সময়। অজিতের চাপে অনিমেষকে বলতেই হল মিস্টার রায়ের কাছে কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছে। শোনার পর অজিত ওদের নিয়ে গেল মিস্টার রায়ের চেম্বারে। তিনি বা তার সহকারী তখন চেম্বারে নেই। অন্য কেসে সওয়াল করতে গেছেন। ওদের চেম্বারে বসিয়ে অজিত বলল, তোমাদের ব্যাপারটা যেখানে হবে সেখানে গিয়ে সবুজ আলো জ্বেলে আসি।

মানে?

এদের তো বত্রিশ মাসে বছর। কাজটা যাতে আজকেই হয়ে যায় তার জন্যে একটু তৈলমর্দন করতে হবে। তোমার মামলায় তো আমি ওদের পকেটে কিছু দিতে রাজি নই। অজিত চলে গিয়েছিল।

.

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ মিস্টার রায় বললেন, এবার আপনারা যেতে পারেন। বাকি ফর্মালিটিগুলো আমরাই সামলে নেব। সামনের সপ্তাহে কাগজপত্র পেয়ে যাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা দিতে হবে?

ওই তো, আপনাকে আগে যেমন বলেছিলাম তাই দেবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সোমবারের মধ্যে দিলেই হবে। মিস্টার রায় বললেন।

এ কথা ঠিক, অজিতের উদ্যোগে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেরোনোর অনেক আগে থেকেই তার দেখা পাওয়া যায়নি। অজিতকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার ছিল, হল না।

রিকশায় অনিমেষ উঠে বসলে মাধবীলতা পাশে এসে বলল, শোনো, আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। চলো না, কোথাও খেয়ে বাড়ি যাই।

কোথায় খাবে?

বা রে! আমি কী জানি। এটা তো তোমার জায়গা।

কী খাবে?

নোনতা বা মিষ্টি। নিশ্চয়ই চপ কাটলেট নয়।

অনিমেষ ফাঁপরে পড়ল, দীর্ঘ সময়ে নিশ্চয়ই জলপাইগুড়ির খাবারের দোকানগুলো বদলে গিয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ল, নবাববাড়ির সামনেই কাঁঠালতলার মিষ্টির দোকান তাদের বাল্যকালে খুব বিখ্যাত ছিল। আর-একটা দোকান ছিল রূপশ্রী সিনেমার সামনে, গন্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কিন্তু ওইসব দোকান এখনও রয়েছে কি না তা তার জানা নেই। সে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল কাঁঠালতলার দোকান এখনও রয়েছে। সেখানেই যেতে বলল অনিমেষ। রিকশাওয়ালাকে বেশি ভাড়া দেবে বলে আশ্বস্ত করে ওরা কাঁঠালতলায় গিয়ে দেখল দোকান বন্ধ রয়েছে। অনিমেষ রিকশায় বসেই মাধবীলতাকে বলল, তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমি নোতা মিষ্টি কিনে নিয়ে আসছি।

বা রে। মাধবীলতা বলল, আমরা দোকানে বসে খেতে চাই। উনি কোনওদিন ওইভাবে খাননি।

শেষপর্যন্ত দিনবাজারে একটা দোকান পাওয়া গেল। শালপাতায় রাধাবল্লভী এবং ছোলার ডালের পর রসগোল্লা খাওয়া হল। মাধবীলতা বলল, তোমরা বোতলের জল বিক্রি করো?

হ্যাঁ মা। ছেলেটি বোতল নিয়ে এল।

ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী জল?

এই জল খেলে পেট খারাপ হবে না। মাধবীলতা বলল।

ওরা তো কলের জল দিচ্ছে। আমরাও তো বাড়িতে তাই খাই।

মাধবীলতা ফাঁপরে পড়ল। বলল, ওরা জল জমিয়ে রেখেছে, তাই থেকে দিচ্ছে। তাই একটু সাবধান হওয়া ভাল।

তা হলে থাক। বাড়িতে গিয়েই খাব। তা ছাড়া– হাসলেন ছোটমা।

তা ছাড়া মানে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

এই প্রথম রাধাবল্লভী খেলাম তো। জিভে স্বাদটা খানিকক্ষণ থাক না। ছোটমা উঠে দাঁড়ালেন।

.

৩৫.

এখনও বাইরে কড়া রোদ, অর্ক রামজির দিকে তাকাল। রামজি তার তক্তপোশে বসে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। কী ভাবছে তা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হল না।

ছেলেটাকে তার ভাল লেগেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এতদিন একসঙ্গে থেকেও রামজি তার অনেক কথাই বলতে চায়নি, অর্কও যেচে জিজ্ঞাসা করেনি।

অর্ক এখন বলল, না, রোদ কমলে অজয়ের ধারে যাব, এখন থাক। ঠিক তখনই সেই তরুণ শিষ্য দরজায় এসে দাঁড়াল, আপনি কি বিশ্রামে আছেন?

এখানে তো আর কিছু করার নেই। কী ব্যাপার ভাই? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

যদি বিশ্রামে না থাকেন তা হলে গুরুমা একবার যেতে বললেন।

অবশ্যই। উঠে দাঁড়াল অর্ক, চলুন।

যাওয়ার আগে সে রামজির দিকে তাকাল। রামজি মাথা নাড়ল।

মন্দিরের সামনে বসে কয়েকজন শিষ্য ধ্যান করছেন। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এই সময়ে ধ্যান? একটু আগেই তো দুপুরের খাওয়া শেষ হল।

ধ্যানের তো সময় অসময় নেই। তরুণ শিষ্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, গুরুমা বলেন যখনই ইচ্ছে হবে তখনই সময়। কিন্তু যাঁদের দেখছেন তারা মধ্যাহ্নভোজন করেন না। সকালে সামান্য জলযোগ করে সন্ধেবেলায় রাতের আহার সারেন।

অর্ক অবাক হল, মুসলমান বন্ধুরা তো রোজার সময় এই নিয়ম মেনে চলেন, তবে তারা সকালে না, ভোরের আগেই যা খাওয়ার খেয়ে নেন। অর্ক বলল।

গুরুমা বলেন, মাঝে মাঝে ঈশ্বরের আরাধনায় শরীর অভুক্ত রাখলে কোনও ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্যের উপকার হয়। তরুণ শিষ্য বলল।

বাঃ, আপনি দেখছি চমৎকার জ্ঞান লাভ করেছেন।

না না। আমি অতি সামান্য। গুরুমার কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যাব। সেই বৃদ্ধ শিষ্য অপেক্ষা করছিলেন। হেসে বললেন, ওকে বিশ্রাম থেকে টেনে নিয়ে আসেননি তো?

অর্ক বলল, না না। আমি তো বসেই ছিলাম।

আসুন আমার কক্ষে। বৃদ্ধ শিষ্য পেছন ফিরতেই তরুণ শিষ্য যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল। অর্ক বুঝতে পারল এই আশ্রমে ডিসিপ্লিন মেনে চলে সবাই।

ভেতরের বারান্দার কাছে গিয়ে বৃদ্ধ শিষ্য বললেন, গুরুমা ওই বাগানে অপেক্ষা করছেন, যান।

অর্থাৎ এখন তার ওই পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার তা তিনি জানেন।

অর্ক এগিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই শুনতে পেল, এই যে এসে গেছ।

অর্ক দেখল বাড়ির পূর্বদিকের বাগানে এখন ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে আছেন গুরুমা এবং একজন মহিলা। কিন্তু মহিলাকে দেখে শিষ্যা বা সন্ন্যাসিনী বলে মনে হল না। একটু রোগা কিন্তু যথেষ্ট ফরসা এবং টানটান শরীর। অর্ক হেসে বলল, এখানে আসার পর সবসময় হুশে আছি যাতে আপনি ডাকলেই চলে আসতে পারি।

ও মা? তাই। বেশ বলল, মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে?

অর্ক বলল, মার্জনা করবেন যদি ধৃষ্টতা দেখাই। মানুষ তো নিজের ইচ্ছেয় পৃথিবীতে আসে না।

গুরুমা কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর বললেন, বসো।

অর্ক নিঃশব্দে তৃতীয় চেয়ারে বসল।

গুরুমা জিজ্ঞাসা করলেন, একসময় মানুষের জীবন ফুরিয়ে যায়। এই আসা-যাওয়া কী কারণে? অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তফাত কোথায়?

অর্ক বলল, তফাত একটাই, মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে, অন্য প্রাণী পারে না।

জোরে হেসে উঠলেন গুরুমা, বাঃ। খুব ভাল। তুমি দেখছি পড়াশোনা করেছ।

কিছুই পড়িনি। মায়ের কাছে ওঁর লেখা বই ছিল, তাই অর্ক বলল।

এবার গুরুমা মহিলার দিকে তাকালেন, এই মেয়ে, তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে সে এই।

মহিলা তার দিকে তাকাতেই অর্ক হাত জোড় করল, আমি অর্ক মিত্র।

আমি কুন্তী সেন। নমস্কার। হাত জোড় করলেন মহিলা। তারপর একটু থেমে বললেন, আপনার নামটা সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু আমি আগে শুনেছিলাম বাবার মুখে। তাই আপনাকে দেখার কৌতূহল হল। অবশ্য বাবা যে অর্কের কথা বলেছিলেন তিনি অন্য কেউ হওয়াই স্বাভাবিক।

গুরুমা হাসলেন, নাম শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল মেয়ে, বলল দেখতে চাই। কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ। আপনি?

আমি এখন ব্যান্ডেলে থাকি, স্কুলে পড়াই।

আপনার বাবা–।

কলেজে পড়াতেন। অবসর নিয়েছিলেন। ছবছর আগে মারা গিয়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাবার এক সহযোগীর ছেলের নাম অর্ক।

হতেই পারে। আমি একজন আইএএস অফিসারের নাম কাগজে পড়েছি যাঁর নাম অর্কপ্রভ দেব। তিনি অবশ্য আমার বাবার বয়সি ছিলেন।

আপনার বাবা কী করতেন?

অর্ক একটু চুপ করে বলল, কিছু না। কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।

বুঝলাম না।

একাত্তরের আন্দোলনে ধরা পড়ার পর পুলিশ তাঁকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। অনেকদিন জেলে থাকার পর বেরিয়ে এসেও হাঁটতে পারেননি। এখন অবশ্য ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আপনার এখানে সবাই। এত শৃঙ্খলা মেনে চলেন যা বাইরে বেশি দেখা যায় না।

তাই বুঝি। গুরুমা হাসলেন, ওরা সবাই খুব ভাল। কতবার এখানে পুলিশ এসে দেখতে চেয়েছে ওদের মধ্যে কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে। কিনা। না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছে। জেলাশাসক এসে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে গিয়েছেন।

ছদ্মবেশে কারা লুকিয়ে আছে বলে ওরা ভেবেছিল?

ওই যারা মনে করে যেভাবে দেশ চলছে সেভাবে চললে গরিব মানুষরা আরও গরিব হবে। তাই তারা উগ্র পথ ধরেছে। গুরুমা বললেন, আমি বলি শরীরে যদি টিউমার তৈরি হয় তা হলে ছুরি চালিয়ে সেটা বাদ দিলেই তো সেরে যাবে না, আবার একটা জায়গায় সেটা মুখ তুলবে। অসুখটা সারাতে ঠিকঠাক ওষুধ দিতে হবে শরীরে। ভেতর থেকে রোগটাকে নির্মূল না করলে রোগ সারে?

অর্ক মুগ্ধ হল কথাটা শুনে। কিন্তু ভেতর থেকে নির্মূল করার জন্যে যে ওষুধ দরকার তা কি প্রশাসনের কাছে আছে? সে কিছু বলল না।

আপনারা কি বহুদিন কলকাতায় আছেন? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল। কিছু মনে করবেন না, আপনি বললেন আপনার বাবা একাত্তরের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবাও এম এ পরীক্ষা দিয়ে সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। বছর খানেক জেলেও ছিলেন। পরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে উনি সরকারি কলেজে চাকরি পান।

কোন জেলে ছিলেন?

বহরমপুরে।

কী নাম ওঁর?

অবনী সেন। কুন্তী বললেন, সিপিএম থেকে ওঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল দলের হয়ে কাজ করতে কিন্তু উনি রাজি হননি।

অর্ক গুরুমায়ের দিকে তাকাল, আচ্ছা, আপনি তো আমাদের সম্পর্কে কিছুই না জেনে আশ্রয় দিয়েছেন। পুলিশ যদি এখন এসে আমাদের ধরে

আপনার কৈফিয়ত চায় তা হলে কী বলবেন?

পুলিশের মুখোমুখি যদি হতে না চাও তা হলে আমার বিশ্বাস তোমরা আমাকে অপদস্থ করবে না। ওই অজয় নদের ওপারের জঙ্গলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারবে। তবে পুলিশ চলে যাওয়ার পর যদি এখানে তোমরা ফিরে আসো তখন তোমাদের থাকতে দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হবে। সকালে তোমাকে বলেছিলাম অজয়ের ধারে ঘুরে দেখে আসতে। ইচ্ছে হলে দেখে এসো। গুরুমা উঠলেন, এবার আমাকে তৈরি হতে হবে। তোমরা আসতে পারো। কুন্তী, তুমি আজই ফিরে যেতে চাইছ?

হ্যাঁ। বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে রাত্রে থাকব।

দ্যাখো। যদি মনে করো, এখানেও থাকতে পারো। আমার এই এখানে। গুরুমা সামনের ঘরটি আঙুল তুলে দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

রোদ মরে আসছে। অর্ক বলল, আচ্ছা, চলি।

কুন্তী বললেন, একটু দাঁড়ান, আপনার বাবার নাম কি অনিমেষ?

হ্যাঁ। আপনার বাবা তা হলে আমার বাবাকে চিনতেন?

নিশ্চয়ই। বাবার কাছে আপনার মায়ের কথাও শুনেছি। প্রচুর স্যাক্রিফাইস করেছেন মহিলা। কুন্তী বললেন।

অর্ক কিছু বলল না।

আর তা হলে আপনিই সেই অর্ক। কুন্তী হাসলেন।

পৃথিবী খুব ছোট জায়গা।

তাই তো দেখছি। পনেরো-ষোলো বছরে শোনা গল্পটা আজ আপনাকে দেখে নতুন করে মনে পড়ছে। খুব ভাল লাগছে।

অর্ক তাকাল, আপনি কি গুরুমায়ের শিষ্যা?

আমি? বুকে আঙুল রেখে মাথা নাড়লেন কুন্তী, প্রথাগত দীক্ষা নিয়ে শিষ্যা আমি হইনি। কোনও কোনও মানুষ যখন কথা বলেন তখন শুনলে ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এক অর্থে তিনি নিশ্চয়ই গুরু হয়ে যান। এরকম গুরু আমার কয়েকজন আছেন। তাদের আমি চোখেও দেখিনি।

যেমন?

রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কার্ল মার্কস।

সে কী? ওই দুজনের পাশে কার্ল মার্কস?

কেন নয়? আপনি দাস ক্যাপিটাল পড়েছেন?

না।

আলোচনা থাকায় একবার এই আশ্রমে চাই না। কিন্তু

তা হলে এই আলোচনা থাক। কুন্তী বললেন, আমি মাঝে মাঝে বোলপুরে আসি। যখনই আসি তখনই একবার এই আশ্রমে এসে গুরুমায়ের সঙ্গে দেখা করে যাই। ওঁর অতীত আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এলে ভাল লাগে।

অর্ক বলল, আচ্ছা। তা হলে এখন চলি।

আপনি কি প্রার্থনাতে যোগ দিচ্ছেন?

প্রার্থনা?

মন্দিরের সামনে সবাই একত্রিত হন। পুজো শুরুর আগে গুরুমাকে সামনে রেখে কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। তারপর গুরুমা উপদেশ দেওয়ার পর নিজের হাতে মায়ের পুজো করেন। ওই পুরো ব্যাপারটাকেই এখানে প্রার্থনা বলা হয়।

না। আমি এখন অজয় নদের চরে যেতে চাই। গুরুমা আমাকে বেশ কয়েকবার ওখানে যাওয়ার কথা বলেছেন। আচ্ছা, এলাম।

অর্ক ঘর পেরিয়ে বাইরে আসতেই বৃদ্ধ শিষ্যকে দেখতে পেল। ইতিমধ্যে তার পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গিতে তাকে ঈশ্বরভক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। বললেন, প্রার্থনার পর এখানে চা এবং সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়। দূর থেকেই ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পাবেন। অন্য সময় এক-দুবার বাজলেও সে সময় পরপর সাতবার বাজবে।

মাথা নেড়ে এগিয়ে যেতেই অর্ক তরুণ শিষ্যকে দেখতে পেল। বেচারা সম্ভবত তখন থেকে এখানেই অপেক্ষা করছিল। দুবার ঘণ্টাধ্বনি হতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এখনই প্রার্থনা আরম্ভ হবে?

হ্যাঁ, সবাই মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছেন। অতিথিরাও অংশ নিতে পারেন। আপনি কি সেখানে যাবেন না ঘরে ফিরবেন?

ঘরেই ফিরব।

অর্ককে পৌঁছে দিয়ে তরুণ শিষ্য দ্রুত চলে গেল প্রার্থনায় যোগ দিতে। এই যে ছেলেটি তাকে একটা সীমা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল এবং আবার ফিরিয়ে আনল, এটা নিশ্চয়ই স্ব-ইচ্ছায় করেনি। তা হলে কি আশ্রমের মধ্যে বহিরাগতদের চলাফেরা এঁরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান? এখানকার শেষ কথা যখন গুরুমাই বলেন তখন নির্দেশটা তারই। কেন?

রামজিকে ঘুম থেকে তুলল অর্ক। বলল, চলুন নদীর চরে যাব।

এখন রামজি অনেকটা চাঙ্গা। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ঘুমটা দরকার ছিল।

অর্ক রসিকতা করল, যে কাজে এসেছেন তাতে কি এভাবে ঘুমোনোর সুযোগ পাবেন? এখান থেকেই তো ছুটতে হবে সুন্দরবনে।

হাঁটতে হাঁটতে রামজি বলল, যতদূর জানি সেখানে তো খাল আর তারপর সমুদ্র। কুমির আর বাঘ আছে প্রচুর। মুশকিল হল আমি সাঁতার জানি না।

জেনেও কোনও লাভ হত না। সুন্দরবনের নদী বা খালে সাঁতরানো যায় না।

অর্ক নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। যতই অজয়কে নদ বলা হোক অন্যমনস্ক মন নদীই বলে চেনে। এদেশের যাবতীয় নদীর নাম স্ত্রীলিঙ্গের পরিচায়ক, পুরুষ নাম হলেই নদ হয়ে যায়। কোনও মানে হয় না।

ওরা চরে নামল। রুপোলি বালির ওপর দিয়ে বিকেলের বাতাস বইছে, খানিকটা হাঁটার পর জলের ধারা। কোথাও হাঁটুর ওপরে কোথাও গোড়ালি ডোবা। ওরা জায়গা বেছে নিয়ে জল পেরিয়ে আবার বালির চরে আসতেই খানিকটা দূরে দুটো শেয়াল তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক হেসে ফেলল।

হাসছেন কেন? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

জলপাইগুড়িতে আমার ঠাকুমার পোষা শেয়াল আছে।

শেয়াল পোষ মানে?

তাই তো দেখে এলাম। বলতে বলতে অর্ক দেখতে পেল আশ্রমের দিক থেকে কেউ একজন দুহাতে জিনিস নিয়ে দৌড়ে এদিকে আসছে। চিৎকার করছে লোকটা। আর একটু কাছে আসতেই চিনতে পারল অর্ক, সেই তরুণ শিষ্য হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে, দুহাতে ওদের দুজনের ব্যাগ। জল পেরিয়ে এসে সে একটু দম নিয়ে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি ওই জঙ্গলের ভেতর চলে যান।

কেন?

খবর এসেছে পুলিশ আবার সার্চ করতে আসছে। ছেলেটি শ্বাস ফেলছিল দ্রুত, ওই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুই মাইল গেলে বর্ধমানের রাস্তা পেয়ে যাবেন, পুলিশ চলে গেলে কুন্তীদিদি ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি চলি। পুলিশ আসার আগেই আশ্রমে ফিরতে হবে। তরুণ শিষ্য যেভাবে এসেছিল সেইভাবে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল, যদিও এখন গতি অনেক কম।

দ্রুত বালির চর ভেঙে ওরা জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপর ঘুরে দেখল ছেলেটি তখনও ওপারে পৌঁছায়নি। রামজি জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ কী করে আমাদের কথা জানতে পারল? তার মানে ওদের চর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে এখানে এসেছে?

না। তা হতে পারে না। আশ্রমের কেউ নিশ্চয়ই পুলিশকে জানিয়েছে। কিংবা আমরা আশ্রমে ঢোকার আগে লোকাল লোক যারা দেখেছিল তাদের মধ্যে পুলিশের ইনফর্মার ছিল। আবার দেখুন, পুলিশের কেউ আশ্রমে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে বলে ছেলেটা দৌড়ে এল। চলুন, হাঁটা যাক। পুলিশ আমাদের ওখানে না পেলে নিশ্চয়ই নদীর এপাশে আসবে। অর্ক হাঁটতে শুরু করল।

আর একটু পরে তো সব অন্ধকারে ঢেকে যাবে, কোথায় খুঁজবে ওরা? রামজি হাসল, অন্ধকার ঘন হওয়ার আগেই আমরা যতটা পারি এগিয়ে যাই।

এই জঙ্গল ঘন নয়। মাঝে মাঝে কিছু বড় গাছ থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় ঝোঁপ এবং লতানো গাছের জঙ্গল। অবশ্য একটা পায়ে চলা পথ। পেয়ে ওদের হাঁটতে সুবিধে হচ্ছিল।

কিন্তু সেই সমস্ত চরাচর অন্ধকারে ডুবে গেল, শিয়ালগুলো ডেকে উঠল সমস্বরে, সন্ধ্যাতারা লাফিয়ে উঠল আকাশের কোনায় অমনি ওরা দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কাছে কি টর্চ আছে?

না। পায়ে হাঁটি, চলুন।

কিন্তু এই পায়ে হাঁটা পথ যে বর্ধমানের রাস্তার দিকে যাচ্ছে তার নিশ্চয়তা কী?

তা ঠিক। তা হলে এক কাজ করি। এখানেই রাতটা কাটিয়ে ভোরের জন্যে অপেক্ষা করি। রামজি বলল।

সেটা ঠিক হবে না। দিনের আলোয় জঙ্গল থেকে বের হলে যে কেউ সন্দেহ করবে। চলুন। অর্ক এগোল। মাঝে মাঝেই ঝোঁপের পাতায় শরীরে। জ্বলুনি ধরছিল। রাত দশটা নাগাদ ওরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে অজয় নদের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে দূরে গুমগুম আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল একটা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে।

কাছে এলে ওরা পাশাপাশি গাড়ি চলার সেতুটাকে দেখতে পেয়ে রাস্তার ওপর উঠে গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ক বলল, এই দিকটা দিয়ে গেলে বর্ধমানে পৌঁছোনো যাবে।

কতটা দূর? রামজি জিজ্ঞাসা করল।

বোলপুর অনেক কাছে। গেলে ঝুঁকি নিতে হবে।

রামজি তাকাল। বোলপুরের দিক থেকে একটা বড় গাড়ি আসছে। তার হেডলাইটের আলো বেশ তীব্র। রামজি দ্রুত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল ওটাকে থামার জন্যে। গতি কমাচ্ছে না দেখে বাধ্য হয়ে সরে এল সে।

অর্ক বলল, কেউ থামবে না ডাকাতির ভয়ে।

তা হলে?

যা হওয়ার তা হবে। চলুন বোলপুরের দিকেই হাঁটি।

ওরা মিনিট পনেরো হাঁটার পর রাস্তার ধারে একটা গাড়িকে হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সামনের সিটে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসে। অর্করা শুনল, হঠাৎ গাড়িটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক গাড়ির মেকানিজম জানেন না। সঙ্গে সঙ্গে রামজি বনেট তুলে পরীক্ষা শুরু করলে অর্ক বলল, গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমাদের বর্ধমান পর্যন্ত লিট দেবেন?

ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন, নিশ্চয়ই দেব।

৩৬-৪০. রামজির কৃতিত্বে

রামজির কৃতিত্বে গাড়ির ইঞ্জিন প্রাণ ফিরে পেলে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ঠিক কোথায় যেতে চাইছেন?

অর্ক বলল, আমরা কলকাতায় যাব, আপনারা যদি বর্ধমানে নামিয়ে দেন! ভদ্রমহিলা বললেন, উঠে পড়ুন। ওরা পেছনের দরজা খুলে উঠে বসার পর ভদ্রলোক গাড়ি চালু করলেন। অর্ক লক্ষ করছিল, এতক্ষণ ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি, ভদ্রমহিলাই যা বলার বলছেন।

গাড়ি চলছিল অন্ধকার চিরে। রামজি একটা বড় শ্বাস ফেলল। ওটা যে স্বস্তির শ্বাস তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ভদ্রমহিলা অন্ধকার গাড়িতেই মুখ ঘোরালেন, আপনারা ওরকম জায়গায় কী করছিলেন?

পাশেই তো অজয় নদ। ওখানে সুন্দর একটা বাংলো আছে, বেড়াতে এসেছিলাম। একটু আগে ওর বাড়ি থেকে ফোন এল, কারও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কার হয়েছে জানার আগেই লাইন কেটে গেল। তারপর কিছুতেই আর যোগাযোগ করা গেল না। তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছি, যা পাব তাতেই কলকাতায় ফিরতে চাই। চটজলদিতে মিথ্যে বলল অর্ক। এ ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি।

ভদ্রমহিলা বললেন, আশা করি দুর্ঘটনায় খারাপ কিছু ঘটেনি। আপনারা এলে হয়তো সারারাত ওই জায়গায় বসে থাকতাম আমরা। কিন্তু বর্ধমানে যাবেন বলছেন কেন?

কাছাকাছি বলে। ওখান থেকে ট্রেন ধরব।

আপনারা বর্ধমানে যেতে চাইলে নামিয়ে দিতেই পারি। কিন্তু আমরা শহরে ঢুকে বাইপাস ধরতাম, আমরা যাব নরেন্দ্রপুর। ভদ্রমহিলা বললেন।

বাঃ। খুব ভাল। আপনাদের তো কলকাতা দিয়েই যেতে হবে।

হ্যাঁ। বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে ঢুকব। ভদ্রমহিলা এবার সামনে ফিরে সিডি অন করলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় গান বেজে উঠল।

অর্ক ভেবে নিল, কলকাতায় পৌঁছোতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তখন রামজিকে সঙ্গে নিয়ে বেলগাছিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। ঈশ্বরপুকুর লেনের বাসিন্দাদের কেউ না কেউ ফুটপাতে জেগে থাকে। অথচ অত রাতে ওকে শহরের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াও যাবে না। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না কোথায় ওকে রাখা যায়। তার পাশে বসে আছে রামজি একদম নিশ্চিন্ত হয়ে। এরকম ছেলে কী করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে তা বোঝা মুশকিল।

ভদ্রমহিলা বললেন, আজকের খবর শুনেছেন?

না।

সে কী! ভয়ংকর খবর। নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গ্রামবাসীরাও পালটা লড়াই করেছে। গুলি চলেছে দুপক্ষ থেকে। শুনলাম হতাহত প্রচুর। বামফ্রন্ট এত বড় ভুল কী করে করল জানি না। ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন।

গ্রামবাসীরাও গুলি চালিয়েছে? অর্ক অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।

সিপিএম বলছে তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীরা হাত মিলিয়েছে। সেইসব মাওবাদীরাই গুলি চালিয়েছে। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের জমি হাতছাড়া করবে না বলে যে আন্দোলন করেছে তাদের ওপর সরকার কেন গুলি চালাবার অর্ডার দেবে? ছিঃ।

আড়চোখে রামজিকে দেখল। কথাগুলো রামজির কাছে এখন আর অবোধ্য নয়। অর্কর মনে হল নন্দীগ্রাম বামফ্রন্টের একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। যে-কোনও ক্ষমতা তা রাজনৈতিক হোক, ব্যবসায়িক হোক বা শারীরিক, তার একটা চূড়ান্ত সীমা থাকে। সেই সীমায় ওঠার পর পতন শুরু হলে আর আটকানো যায় না।

রাত একটা নাগাদ বিদ্যাসাগর সেতুর টোলট্যাক্স দিয়ে গাড়ি কলকাতায় ঢুকল। ভদ্রলোক কোনও কথা বলেননি এই সময়ের মধ্যে। ভদ্রমহিলাও অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ গান শুনে গেছেন। একবার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় নামবেন আপনারা?

আপনারা কি গড়িয়া হয়ে নরেন্দ্রপুর যাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তা হলে গড়িয়াতেই নামিয়ে দিন।

ওমা! আপনারা ওখানেই থাকেন?

আমি নই। এর বাড়ি।

উনি তো গাড়িতে ওঠার পর কথাই বললেন না।

মন খারাপ, ভয় পেয়ে গেছে।

গড়িয়ার মোড়ে গাড়ি থামলে ওরা নেমে পড়ল। ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে অর্ক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ হল না।

কী দরকার? ওঁর সঙ্গে তো কথা বললেন। ভদ্রলোক গিয়ার টানলেন।

আপনার পরিচয়টা–।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, উনি একজন আইপিএস অফিসার।

গাড়ি বেরিয়ে গেলে রামজির মুখ থেকে ছিটকে এল, বাঁচ গিয়া।

একজন আইপিএস অফিসার আমাদের লিস্ট দিলেন। বাঃ। দারুণ ব্যাপার। অর্ক বলল, এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে জেলে যেতে হবে।

রামজি জিজ্ঞাসা করল, এখানে কোনও রেলওয়ে স্টেশন নেই?

অর্ক চিন্তা করল। গড়িয়াতে একটা রেলের স্টেশন আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা তার জানা নেই। রাস্তায় কোনও লোক নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। সে একটা বন্ধ দোকানের শেডের নীচে রামজিকে নিয়ে চলে এল। বলল, কোনও উপায় নেই। এখানেই বসে পড়ুন। সামনে লরিটা থাকায় রাস্তা থেকে চট করে কেউ দেখতে পাবে না।

ওরা ধুলো ভরতি ফুটপাতে বাবু হয়ে বসে পড়ল। রামজি বলল, রাস্তায় কত ধাবা ভোলা ছিল, ওরা গাড়ি থামাল না।

খিদে পেলে কিছু করার নেই।

এই সময় রামজির মোবাইল বেজে উঠলে সে তাড়াতাড়ি শব্দটাকে থামিয়ে কানে চাপল, হ্যালো। তারপর ওপাশের কথা শোনার পর আচ্ছা বলে মোবাইল অফ করে জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে খঙ্গাপুরে কী করে যাব?

এই তো যাচ্ছিলেন সুন্দরবনে। চেঞ্জ হয়ে গেল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

রামজি বলল, সেখানে যে জন্যে যাওয়ার কথা ছিল সেই কাজটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই খড়গপুরে যেতে বলল।

কোনও ঠিকানা বলেছে?

হ্যাঁ। স্টেশনের বাইরে গিয়ে লালকেবিন চায়ের দোকানে গিয়ে বাসুদেব নামের একজনকে খোঁজ করলেই কোথায় যেতে হবে বলে দেবে। কথাগুলো বলেই রামজি এই রে বলে চুপ করে গেল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

এইসব কথা গুপ্ত রাখতে আমাদের শেখানো হয়েছিল। সরল গলায় বলল রামজি।

বাঃ, চমৎকার! আমি আপনাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে পাড়ার লোকদের মনে সন্দেহ তৈরি করলাম, আপনার বিপদ বুঝে এখানে ওখানে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিলাম অথচ আপনি আমাকেই একথা বললেন? ঝাঁঝিয়ে উঠল অর্ক।

না না। ভুল বুঝবেন না। আমার মাথা কাজ করছে না।

আমি একটা কথা বলব, শুনবেন?

বলুন।

আপনি হাজারিবাগে ফিরে যান।

ফিরে যাব?

হ্যাঁ। গিয়ে আগে যা করতেন তাই করুন। আপনার পক্ষে এই আগুনস্রোতে ভাসা বোধহয় সম্ভব নয়। আপনার মনের গঠন সেরকম নয়।

রামজি কথা বলল না কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে দুপাশে। তাদের মধ্যে পুলিশের গাড়ি থাকা খুবই স্বাভাবিক। রামজি বলল, আপনি সেইসব মানুষদের দেখেছেন যারা কেন বেঁচে আছে। তা নিজেরাই জানে না। জঙ্গল থেকে পাতা কুড়িয়ে এনে যারা বিক্রি করে শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকবে বলে, তাদের দেখেছেন? আরও কিছু মানুষ এই ভারতবর্ষে আছে যারা বহুকাল ভাতের গন্ধ পায়নি, তাদের দেখেছেন?

দেখিনি, তবে জেনেছি। অর্ক বলল।

কিছুই জানা যায় না যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছেন। মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে শুরু করে বিহারের কিছুটা আর ঝাড়খণ্ডের অনেকটা অঞ্চল জুড়ে এদের বাস। কোনও সরকার এদের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। এদের জন্যে টাকা বরাদ্দ হলে সেটা রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে বছরের পর বছর। গ্রামে জল নেই। এক কলসি জল আনতে তিন ক্রোশ হাঁটতে হয়। এতদিন ওরা জানত এটাই জীবন। এইভাবেই বেঁচে থেকে মরে যেতে হবে। কিন্তু এখন ওরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে যে অন্যভাবে বেঁচে থাকা যায়। তার জন্যে মাথা নিচু করে মেনে না নিয়ে অধিকার কেড়ে নিতে হবে। রামজি মাথা নাড়ল, একটাই তো জীবন। অলসভাবে নিজের জন্যে এই জীবনটা কাটিয়ে দিতে আমি চাই না। ওই মানুষগুলোর জন্যে কাজ করতে চাই। আমার মনের ইচ্ছা আপনার কাছে যাই মনে হোক আমি ঠিক এই কাজটা করে যেতে পারব। আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি। কোন বাসে উঠলে আমি এখান থেকে খড়গপুরে যেতে পারব সেটা বলে দিন।

অর্ক শ্বাস ফেলল, এখান থেকে খঙ্গপুরে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে হাওড়া স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে খড়গপুর। ট্রেনে ঘণ্টা আড়াই বোধহয় লাগে। কিন্তু হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার ঝুঁকি কি আপনি নেবেন?

আর কোনও উপায় আছে?

ময়দান থেকে খঙ্গপুরের বাস পেতে পারেন।

রামজি একটু ভাবল। তারপর বলল, ভোর-ভোর স্টেশন পৌঁছেলে মনে হয় ঝুঁকি তেমন থাকবে না। আমাকে তো খড়গপুর স্টেশনের বাইরেই যেতে হবে।

আলো ফোঁটার আগেই বাস চলাচল শুরু হয়ে গেল। গড়িয়া-হাওড়া মিনিবাসে উঠল ওরা। রামজি টিকিট কাটল হাওড়ার, অর্ক ধর্মতলার। নামবার

আগে অর্ক বলল, সাবধানে থাকবেন।

আপনিও। হাতে হাত রাখল রামজি, ভুলে যাবেন না।

.

তালা খুলে উঠোনে ঢুকে আঁতকে উঠল অর্ক। উঠোন, বারান্দা এত নোংরা হয়ে আছে যে এই সময় মা যদি আসত তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। জামা প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সব পরিষ্কার করল অর্ক। করতে করতে মনে পড়ল গলি দিয়ে আসার সময় বুড়িটাকে দেখতে পায়নি আজ। এরকম তো সাধারণত হয় না। এই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হতে সে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলল, বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলেন দাদা?

এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কেন? অর্ক অবাক।

আপনার বাড়িতে যিনি ছিলেন তিনি কি মাওবাদী?

তার মানে?

মনে হচ্ছে সুরেনদা থানায় কথাটা জানিয়েছে। রোজ দুবার পুলিশ এসেছে আপনার খোঁজ করতে। আপনি তো কোনও রাজনীতি করতেন না। আপনাকে ফাঁসিয়ে সুরেনদার কী লাভ হবে জানি না। আমরা শিগগিরই ক্ষমতায় আসব। তখন সুরেনদাদের কী হাল করব দেখবেন। বিশ্বজিৎ বলল।

বামফ্রন্টকে হারিয়ে আপনারা ক্ষমতায় আসবেন?

ওদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে। বাংলার প্রতিটি নির্যাতিত মানুষ দিদিকে সমর্থন করছে। বিশ্বজিৎ বলল, আমার মনে হয় আপনার থানায় যাওয়া দরকার। পুলিশ কেন খোঁজ করছে

তা প্রশ্ন করুন। আপনি যদি চান তা হলে আমি সঙ্গে যেতে পারি।

আপনি?

বিশ্বজিৎ হাসল, কদিন আগে সুরেনদা আর তার লালপার্টি ছাড়া পুলিশ কাউকে পাত্তা দিত না। আমাদের সঙ্গে তো চাকরবাকরের চেয়ে খারাপ ব্যবহার করত। এখন হেসে কথা বলছে, অনেকটা পিঁপড়ের মতো।

বুঝলাম না।

আকাশে মেঘ জমার আগে দেখবেন পিঁপড়েরা মাঝে মাঝে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে লাইন বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। ওরা ঠিক টের পায় বৃষ্টি আসছে। গ্রামের মানুষ ওদের দেখে আকাশের দিকে তাকায়। এই পুলিশগুলো ঠিক পিঁপড়েদের মতো। ক্ষমতা বদলের গন্ধ আগাম টের পায়।

বেশ। কখন যাবেন বলুন?

ঘড়ি দেখল বিশ্বজিৎ। হাসল, এখন তো বড়বাবুর ঘুম ভাঙেনি। বেলা এগারোটা নাগাদ চলুন। কিন্তু আপনি নিশ্চিত তো লোকটা মাওবাদী নয়?

আমি এখনও ঠিক জানি না কে মাওবাদী, কে নয়। অর্ক বলল।

একদম ঠিক। দিদির কথা শোনেননি? বিশ্বজিৎ জিজ্ঞাসা করল।

কোন কথাটা?

পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কেউ নেই। সিপিএমই মাওবাদী সেজে ভয় দেখাচ্ছে। তবু শিয়োর হওয়ার জন্যে জিজ্ঞাসা করলাম।

বিশ্বজিৎ, আপনাকে আমি কতটুকু চিনি? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

একই এলাকায় থাকি। আগে কংগ্রেস করতাম। দেখলাম কংগ্রেসের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তার চেয়ে দিদি তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে মানুষের পাশে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের জন্যে কাজ করতে হলে দিদির নেতৃত্ব চাই। তাই আমি তৃণমূলে এসেছি। এটা তো আপনার অজানা থাকা উচিত নয়। বিশ্বজিৎ বলল।

নিশ্চয়ই। তবে এসব তো শোনা কথা। গোপনে গোপনে আপনি তো মাওবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। আমি জানব কী করে?

এটা কী বললেন আপনি? বিশ্বজিৎ উত্তেজিত, আপনি আমার সততা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন?

মোটেই না। আমি বলতে চাইছি, যিনি আমার কাছে ছিলেন তিনি যদি মাওবাদী হন তা হলে সেটা আমাকে জানাননি। আমি জানব কী করে? তা ছাড়া, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? পশ্চিমবাংলায় যখন কোনও মাওবাদী নেই তখন আপনার পক্ষে তো সেটা হওয়া সম্ভব নয়। অর্ক হাসল।

ও, তাই বলুন। এটা রসিকতা। সিপিএম এখন যাকে ফাঁসাতে চায় তার ওপর মাওবাদী তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। কী রাজত্বে আছি, বলুন? বিশ্বজিৎ আবার ঘড়ি দেখল, ঠিক আছে সাড়ে এগারোটার সময় আমি থানায় পৌঁছে যাব। লেট করবেন না প্লিজ, চলি।

সারারাত টেনশনে না ঘুমিয়ে শরীরে আর জুত ছিল না। কোনওমতে চা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। তখনই তার মনে হল অনেকদিন বাবা-মায়ের খবর নেওয়া হয়নি। সে মোবাইল তুলে নাম্বার টিপল, আউট অব রিচ। পরপর দুবার একই কথা কানে এল। ওটা রেখে বালিশে মাথা রাখল অর্ক।

.

ছোটমায়ের নামে মহীতোষ মিত্রের সম্পত্তি আইনসম্মতভাবে করে দিলেন মিস্টার রায়। বললেন, অনিমেষবাবু, আপনার বাবার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। কাগজপত্র কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন আপনার মা।

এতদিন জানা ছিল খারাপ খবর বাতাসের আগে ওড়ে কিন্তু আজ দেখা গেল ভাল খবরও খোঁড়া নয়। স্বপ্নেন্দু দত্ত চলে এলেন এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে। সেটা মাধবীলতার হাতে দিয়ে বললেন, খবরটা পেয়ে যে কী আনন্দ হল বোঝাতে পারব না। শেষ ভাল যার সব ভাল…।

এখনও কি শেষ ভাল বলার সময় এসেছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

আর বাকি রইল কী? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।

পার্টিকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন?

ম্যানেজ তো হয়েই গেছে। আপনি কোনও খবর রাখেন না?

কী ব্যাপারে?

পুলিশের হাতে ধোলাই খেয়ে এই পাড়ার ক্লাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেগুলোকে তাদের বাপ-মা অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কানাঘুষোয় শুনলাম ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, আপনার বাড়ির ব্যাপারে কেউ যেন নাক না গলায়। শুনলাম মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার সহপাঠী ছিলেন? স্বপ্নেন্দু গদগদ গলায় বললেন।

সমসাময়িক ছিলেন।

ইস। আপনি ওঁকে ব্যাপারটা জানালে এত ঝামেলাই হত না।

আপনি কী করে ভাবলেন যে উনি আমাকে দেখা করার অনুমতি দিতেন? তা ছাড়া ওঁর কাছে গিয়ে কিছু চাইতে হলে অনেক আগেই চাইতে পারতাম।

মাধবীলতা বলল, তাই যদি বলো, তুমি তো জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলে?

দুটো এক কথা হল না। জেলার লোক হিসেবে জেলা কমিটির সম্পাদকের কাছে যাওয়ার অধিকার আমার আছে। সমসাময়িক একজন সিপিএম নেতার কাছে নিজের প্রয়োজনে যাব ভাবতেই পারি না। অনিমেষ বলল।

তা হলে এবার আমরা কাজটা সেরে ফেলি? স্বপ্নেন্দু বললেন।

হ্যাঁ, মাধবীলতা বলল, আপনি কাগজপত্র তৈরি করুন।

স্বপ্নেন্দু চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ছোটমায়ের সঙ্গে আর একবার কথা বলা দরকার। গতকাল ওখান থেকে ফিরে খুব খুশিখুশি দেখেছিলাম। ওঁর কী ইচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করো।

তুমিই করো। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা ছোটমায়ের ঘরে গিয়ে অবাক হল। আলমারি থেকে একটার পর একটা রঙিন শাড়ি বের করছেন ছোটমা। মাধবীলতাকে দেখে তিনি বললেন, অনেক শাড়ি, কখনও পরিনি। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ঠিক করলাম আশ্রমে দিয়ে দেব। ওখানকার অনেকেই তো রঙিন শাড়ি পরেন।

আশ্রমটাকে আপনার মনে হচ্ছে ভাল লেগেছে।

খুউব। ছোটমা মাথা নাড়লেন।

আমরা চলে গেলে ওখানে গিয়ে থাকতে চান?

আমাকে কি দেবেশবাবু থাকতে দেবেন?

কথা বলব।

দ্যাখো।

মাধবীলতার মুখে কথাগুলো শুনে দেবেশকে ফোন করল অনিমেষ। বলল, খুব তাড়াতাড়ি যেন দেবেশ এই বাড়িতে আসে। খুব দরকার।

.

৩৭.

এখন না দুপুর না বিকেল। রোদের তাপ বেশ কম। একটা কাক তখন থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বাগানের ডুমুর গাছের উঁচু ডালে বসে। মাঝে মাঝেই এই ডাল থেকে ওই ডালে ব্যস্ত পায়ে নামছে সে, স্থির থাকছে না যেমন, তেমনই তার চিৎকার বন্ধ হচ্ছে না। কেবলই মাথা ঘুরিয়ে নীচের দিকে কিছু খুঁজে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে কাকটাকে দেখতে দেখতে অনিমেষ বলল, সাপটা বেরিয়েছে।

এতক্ষণ চুপচাপ ছিল দেবেশ, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, সাপটা মানে?

এই বাগানে দীর্ঘদিন ধরে সাপ বাস করে। ছোটমা দাবি করেন ওটা তার পোষা সাপ। রোজ কিছু না কিছু খেতে দেন ওটাকে। আজ বোধহয় সাপ খাবার খুঁজতে ওপাশে গেছে তাই দেখে কাকের এই ডাকাডাকি। অনিমেষ বলল।

অদ্ভুত। দেবেশ বলল, তোর বড় পিসিমা তো শেয়াল পুষতেন বলে শুনেছিলাম। যাকগে–।

মাধবীলতা খানিকটা তফাতে বসে ছিল, প্রসঙ্গে ফিরে আসতে চেয়ে বলল, এই হল ব্যাপার। আপনার কথা কিছু বললেন না। দেবেশ মাথা নাড়ল, উনি আমাদের ওখানে থাকবেন এটা তো আনন্দের কথা। আবাসিকরা সবাই খুব পছন্দ করেছেন ওঁকে। এই যে তোমাদের ছাড়াই একা গেলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। কিন্তু–।

কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল মাধবীলতা।

দেবেশ বলল, দেখুন, আমার ইচ্ছে ছিল কারও কাছ থেকে একটা টাকাও না নিয়ে বয়স্ক নিরাশ্রয় মানুষগুলোকে আগলে রাখব। কিন্তু সাধ সাধ্যের কাছে হার মানল। এখন যারা আছেন তারা যে যেমন পারেন তা থাকা খাওয়ার জন্যে দেন। বাকিটা চাষবাস, গোরুর দুধ আর পুকুরের মাছ থেকে যখন কুলিয়ে উঠতে পারি না তখন শহরের অর্থবানদের কাছে হাত পাততে হয়। কিন্তু একজনের কাছ থেকে ঠিক ততটুকুই নেওয়া হয়, যতটুকুতে তার খরচ মেটানো যায়। কারও কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে সেই টাকায় অন্যদের অভাব মেটানোর কথা আমি কল্পনাও করি না। কারণ যারা উপকৃত হবে তারা এক ধরনের হীনমন্যতায় আক্রান্ত হবে। ভাববে ওই একজন বেশি টাকা দিচ্ছে বলে তার দয়ায় আমি বেঁচে আছি। আমাদের আবাসিকদের মধ্যে কোনও বিভাজন চাই না। তাই আপনাদের প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনিমেষ বলল, খুব যুক্তিসংগত কথা।

মাধবীলতা বলল, তা হলে কী হবে?

এই সময় ছোটমার গলা কানে এল। তারস্বরে ধমকাচ্ছেন, অ্যাই মুখপোড়া, কানের পরদা ছিঁড়ে যাবে তোর জন্যে? ওখানে ঘাসে ঘাসে ঘুরছে তাতে তোর কী? তুই ডালে ডালে উড়ে বেড়া না। শয়তান কাক।

দেবেশ হাসল, উনি বাড়ি বিক্রি বাবদ যে টাকা পেয়েছেন তা ব্যাঙ্কেই থাক। ওই টাকা থেকে যে মাসিক ইন্টারেস্ট পাবেন তার কিছুটা নিজের খরচের জন্যে আশ্রমকে দিলেই ওঁর কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে।

অনিমেষ বলল, কিন্তু দেবেশ, ওঁর বয়স হয়েছে, শরীরও সুস্থ নয়। উনি যখন থাকবেন না তখন টাকাটার কী হবে?

দেবেশ শব্দ করে হেসে উঠল, আচ্ছা, এ ব্যাপারে আমি কী বলব? ওঁর টাকা কীভাবে খরচ করবে তা তোমাদের ব্যাপার।

মাধবীলতা বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। শোনো, আমি বলি কী, এক-এক করে এগোনো যাক। ছোটমা আশ্রমে যান। আপাতত ছয় মাসের জন্যে যে টাকা আশ্রমকে দিতে হবে তা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দেওয়া যাক। ওখানে থাকতে থাকতে ওঁর মনে যদি কোনও ইচ্ছে জন্মায় তখন সেইভাবে তা পূর্ণ করা যাবে।

অনিমেষ মাথা নাড়ল সম্মতিতে, তারপর দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলল, দেবেশ, পৃথিবীর অনেক কিছু পালটাল। ইউরোপ থেকে কমিউনিস্টরা মুছে গেল, চিনের সেই বিখ্যাত কমিউনিজম চেহারা বদলে ফেলল। এদেশের মেয়েদের পোশাক এবং চালচলনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। আমরা মানুষ হয়েছিলাম যেসব তথ্য জেনে তা আজ একটানে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তুই একই থেকে গেলি।

কীরকম? দেবেশ হাসল।

তোকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে বি সি ঘোষ টোকলাইতে টি-ম্যানেজার ট্রেনিং কোর্সে পাঠাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তোর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল। ওই কোর্স করলেই চায়ের বাগানে লোভনীয় চাকরি পেতিস। প্রথমে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার, পরে ম্যানেজার। অথচ তুই যেতে চাইলি না। অনিমেষ বলল।

তুই এসব কথা জানলি কী করে?

অজিতের কাছে সেসময় শুনেছিলাম। অনিমেষ বলল।

চাইনি, কারণ সে সময়েও চাকরিটা ক্রীতদাসের ছিল। ব্রিটিশরা ওই চাকরিতে সেইসব ভারতীয়দের চাইত যারা আত্মীয়স্বজন যদি কম রোজগার করে তা হলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। মা যদি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হন তা হলে তাঁর সঙ্গে ম্যানেজার ছেলে দেখা করতে পারবে না। তার সমাজ হবে অন্যান্য ম্যানেজারদের নিয়ে। স্বাধীনতার দেড় দশকেও এই ব্যবস্থাটা বদলায়নি বলে আমার পক্ষে চাকরিটা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, একবার ছোটমায়ের সঙ্গে কথা বলব। দেবেশ বলল।

মাধবীলতা উঠে বাইরে চলে গেল।

অনিমেষ হাসল, সেটা বুঝলাম। আজ তুই ছোটমায়ের বাড়ি বিক্রির টাকা নিতে রাজি হলি না। কেন? লোভ বেড়ে যেতে পারে, এই ভয়ে?

দেবেশ মাথা নাড়ল, হয়তো তাই। বেশ আছি ভাই। বেশ আছি, খাই দাই, ডুগডুগি বাজাই। ঢাক ঢোল নিয়ে কী করব? চল, আমারই উচিত ওঁর কাছে যাওয়া। দেবেশ উঠে দাঁড়াল।

কিন্তু তখনই মাধবীলতার সঙ্গে এসে দাঁড়ালেন ছোটমা, ওমা। আপনি?

আমি যে এসেছি তা আপনি জানতেন না দেখছি।

বা রে, জানলে আগে এসে দেখা করে যেতাম না? বসুন।

এই মরেছে। আপনাকে আগেও বলেছি, অনিমেষ আর আমি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। আমাকে আপনি বললে খুব অস্বস্তি হয়। প্লিজ আপনি বলবেন না। দেবেশ হাসল, আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। এই বাড়ি আপনাকে এতকাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। এখন সেই বন্ধন থেকে। আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন। আশ্রমের সবাই চাইছে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমার মনে হয় আপনারও আপত্তি নেই, তাই না?

না নেই। খুব খুশি হব থাকতে পারলে। দ্যাখো তো, এরা আমার জন্যে নিজের সংসার ফেলে কতকাল এখানে আটকে আছে। আমার একদম ভাল লাগে না। ছোটমা কথাগুলো বলতে বলতে মাধবীলতার কনুই ধরলেন।

অনিমেষ বলল, যিনি কিনলেন, স্বপ্নেন্দু দত্ত, তিনি অবশ্য বলেছেন মাস তিনেকের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে না। তারপরে বাড়ি না পেলে উনি একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার মনে হয় তার দরকার হবে না।

এখনও তো মাস দুয়েক হাতে আছে? দেবেশ তাকাল।

হ্যাঁ।

ভাড়াটের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। নিবারণবাবুকে ছোটমা চেক কেটে দিয়েছেন। উনি শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ি ভাড়া পেয়ে গেছেন। আজই বোধহয় সেখানে চলে যাবেন। মাধবীলতা বলল।

বাঃ। তা হলে তো আর সমস্যা নেই।

ছোটমা বললেন, একটা কথা বলব? না, একটা নয়, দুটো কথা।

দেবেশ অবাক হল, বেশ তো।

ছোটমা বললেন, নিবারণবাবুকে দেওয়ার পরেও ব্যাঙ্কে যে টাকা আমার নামে আছে তা আমি এখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ওই টাকার কথা ভাবলেই আমার কেমন ভয়ভয় করে।

বুঝলাম। হাসল দেবেশ।

ওই টাকা যদি আশ্রমের ফান্ডে নিয়ে নাও তা হলে আমি বেঁচে যাই। যার পেটে ভাত জুটত না তার সামনে পোলাও বিরিয়ানি ধরে রাখলে কী হয় তা তোমরা বুঝতে পারবে না। ছোটমা বললেন।

এ ব্যাপারে অনিমেষের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। দেবেশ বলল, টাকাটা কি ব্যাঙ্কে শুধু আপনার নামেই আছে?

মাধবীলতা বলল, না, মিস্টার রায়, মানে এই বাড়ির যিনি উকিল, তিনি ইনসিস্ট করলেন টাকাটা জয়েন্ট নামে রাখতে। ফলে ওঁর সঙ্গে আমার নাম রাখতে হল। আমি যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলাম।

এ কী কথা? ছোটমা প্রতিবাদ করলেন, তুমি এই বাড়ির বউ না? আর তা যদি বলল, জুড়ে বসেছি তো আমি। যাঁর সম্পত্তি তার ছেলে নাতি থাকা সত্ত্বেও আমাকে ওজন বইতে হচ্ছে। আমি তো বাইরের মানুষ।

দেবেশ বলল, প্রথমটা শুনলাম, দ্বিতীয়টা?

ছোটমা মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে যদি আর একজন যায় তা হলে কি তোমাদের খুব অসুবিধা হবে?

আর একজন? দেবেশ অবাক হল।

খুব ভাল মেয়ে। আশ্রমের সব কাজ করবে। ওর থাকা খাওয়ার জন্যে যে খরচ হবে তার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ছোটমা বললেন।

কার কথা বলছেন? দেবেশ অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ ঠাওর করতে পারছিল না। ঠিক তখনই বাইরের বাগান থেকে নিবারণবাবুর গলা ভেসে এল, অনিমেষবাবু, ও অনিমেষবাবু।

মাধবীলতা বলল, নিবারণবাবু, বোধহয় চলে যাচ্ছেন।

ক্রাচ টেনে নিয়ে মেঝেতে নামল অনিমেষ। ওর পেছনে ঘরের সবাই বাইরে বেরিয়ে এল। নিবারণবাবু বারান্দায় উঠে এসে হাতজোড় করলেন, বহু বছর আপনাদের আশ্রয়ে ছিলাম। কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। আর আপনি সাহায্য না করলে তো আমি শিল্পসমিতি পাড়ার সুন্দর বাড়িটায় যাওয়ার সুযোগই পেতাম না।

এসব কী বলছেন। আপনাদের জিনিসপত্র?

সকালে একদফা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাকিটা এখন লরিতে তুলে দিয়েছি। আপনারা যদি একবার ওই বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন তা হলে খুব খুশি হব। সোনাউল্লা স্কুল ছাড়িয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় ঢুকে বাঁ দিকের গলি। ওখানে গিয়ে কল্যাণ শিকদারের নাম বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। ওঁর পাশের বাড়ি।

নিবারণবাবু এবার ছোটমায়ের দিকে তাকালেন, সুখে দুঃখে বহু বছর একসঙ্গে কাটিয়ে গিয়েছি। আমার ব্যবহার যদি আপনাকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকে তা হলে তার জন্যে ক্ষমা চাইছি।

ছোটমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মাধবীলতা বলল, আপনার বাড়ির সবাই কি চলে গিয়েছেন?

হ্যাঁ। একজন ছাড়া। নিবারণবাবু হাসলেন।

মানে?

আপনি তো ওকে দেখেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমার বাড়ির মানুষ। হয়েই এতদিন ছিল। এখানে জায়গা প্রচুর ছিল, কোনও অসুবিধে হয়নি। নতুন বাড়িতে ওর থাকা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। আপনার শাশুড়ি ওকে খুব স্নেহ করেন। উনি ওকে আশ্বাস দিয়েছেন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার। কেউ যদি ভাল থাকে তা হলে আমি আপত্তি করব কেন? আচ্ছা, চলি। জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছি, দরজা খোলা আছে। একবার যদি দেখে নেন। নিবারণবাবু বললেন।

ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন। অনিমেষ বলল।

নিবারণবাবু বেরিয়ে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কার কথা বললেন?

ওঁর এক ভাইয়ের স্ত্রী। মাধবীলতা বলল।

আশ্চর্য? যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তার জায়গা হল না?

জায়গা আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা মেয়েটির নেই, তাই হল না। মাধবীলতা বলল, আমি যাই, একবার জেনে আসি।

মাধবীলতা চলে গেলে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কবে থেকে আশ্রমে গিয়ে থাকার ইচ্ছে?

যে দিন বলবে। ছোটমা জবাব দিলেন।

তা হলে আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে।

কীরকম?

আশ্রমের গোরু, হাঁস, মুরগি দেখার জন্যে তোক আছে। কিন্তু সে সামলে উঠতে পারছে না। আপনি যদি ওর মাথার ওপরে থেকে দেখাশোনা করেন তা হলে আমাকে আর ওদের জন্যে চিন্তা করতে হয় না। আপনি তো পশুপাখিদের ভালবাসেন।

অনিমেষ হেসে ফেলল। তাই দেখে ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন, হাসির কী হল?

সাপকে পশুর পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা বুঝতে পারছি না।

ছোটমা ঈষৎ রেগে গেলেন, মানুষও তো মাঝে মাঝে পশুর মতো আচরণ করে তা হলে সাপকে পশু বলতে দোষ কী? এই যে নিবারণবাবু, ইনি কি মানুষ না পশু?

দেবেশ বলল, একদম ঠিক কথা। তা হলে পরশু চলে আসুন। আপনার জিনিসপত্র যদি বেশি থাকে তা হলে আমি দোমহনী থেকে একটা ম্যাটাডোর পাঠিয়ে দেব। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওখানেই লুচি তরকারি খাবেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, প্রতি মাসে কত দিতে হবে বললি না তো।

কেউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আগে উনি আশ্রমে আসুন, সড়গড় হন, তারপর ও নিয়ে ভাবা যাবে। হ্যাঁ তোরা কি এই বাড়িতে কিছুদিন থাকছিস?

না। এখন তো রিজার্ভেশন পাওয়াটাই সমস্যা। পেলেই কলকাতায় ফিরে যাব। অনিমেষ বলল, তার আগে স্বপ্নেন্দুবাবুকে জানাতে হবে।

আমি বলি কী, আমাদের ওখানে দুদিন থেকে তারপর কলকাতায় যাস। দেবেশ বলল, খারাপ লাগবে না। আমাদের অতিথিগৃহ খুব আরামদায়ক হয়তো নয় কিন্তু বাসযোগ্য। মাসিমার সঙ্গেই চলে আয় তোরা। যাচ্ছি রে।

এক মিনিট দাঁড়া। মাধবীলতাকে ডাকছি।

কিন্তু ডাকতে হল না। মাধবীলতা শীর্ণা বউটির হাত ধরে ভাড়াটেদের দিক থেকে বারান্দায় উঠে এসে বলল, এদেশের মেয়েদের নাকি পরিবর্তন হয়েছে। ছাই হয়েছে। গিয়ে দেখি খালি ঘরের মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ রেখে ইনি কাঁদছেন।

ছোটমা বললেন, এখন তো তুমি স্বাধীন। স্বাধীনতা পেলে কি কেউ কাঁদে?

প্রশ্নটা শোনামাত্র বউটি ছুটে গেল ছোটমার দিকে। দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। ছোটমা বললেন, আরে আরে কী হল? তুমি এতদিন জলে পড়ে ছিলে এখন ডাঙায় উঠছ। ইনি অনির বন্ধু দেবেশবাবু। ওঁকে তোমার কথা বলেছি। তুমি আমার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে থাকবে। আমাকে যে ঘর দেবে সেখানেই তুমি শোবে। গিয়ে দেখবে তোমার মন একদম ভাল হয়ে গেছে? আর কাঁদতে হবে না।

দেবেশ বলল, হ্যাঁ। আমাদের ওখানে সব কিছু আছে শুধু কান্না বাদ।

দেবেশ চলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমি ওকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।

মাধবীলতা বলল, যারা বিপ্লবের কথা বলে, মানুষ খুন করে, যারা সমাজ ব্যবস্থা বদলাতে চায় তারা তাদের রক্তাক্ত হাত ধুয়ে ফেললেও তাতে রক্তের গন্ধ থেকেই যায়। অথচ দেবেশবাবুর মতো কিছু মানুষ নীরবে যে কাজ করে চলেছেন তা কোনও অংশে বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। আমার তো ইচ্ছে করছে ওদের ওখানে কয়েকদিন থাকতে।

অনিমেষ হাসল, এই প্রস্তাবটাই দিয়ে গেল দেবেশ। দেখি, কলকাতার ট্রেনের টিকিট কবে পাওয়া যায়!

স্বপ্নেন্দু দত্ত দায়িত্ব নিলেন। আগের দিন জানতে পারলে তিনি রেলের বড় কর্তাকে বলে দার্জিলিং মেলের ভি আই পি কোটার টিকিট করে দিতে পারবেন। এ নিয়ে যেন অনিমেষ কোনও দুশ্চিন্তা না করে। শুনে মাধবীলতা হেসেছিল, এই দেশে দুধরনের মানুষ ভাগ্যবান। এক, যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে সরকারে যে দল আছে তাদের কর্তাদের যোগাযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডায়রি নেবে না, নিলেও চোখ বন্ধ করে থাকবে। তারাই কোটায় ফ্ল্যাট-জমি পাবে। পাড়ার মানুষ ভয় পাবে তাদের। বেশ আছে এরা।

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, দ্বিতীয়টা?

যাদের প্রচুর টাকা আছে তাদের সঙ্গে প্রশাসনের খুব সুসম্পর্ক। তুমি আমি যদি রেলের কারও কাছে টিকিট চাইতে যাই তা হলে তিনি দেখাই করবেন না। কিন্তু স্বপ্নেন্দু দত্ত সুপারিশ করলে স্বচ্ছন্দে অনেক লোকের মাথা ডিঙিয়ে কলকাতায় যেতে পারব। আগে সমস্ত জনসাধারণের মাত্র এক ভাগ সুবিধে ভোগ করত, দশটা পরিবার দেশ চালাত। এখন রাজনীতি এবং কালো টাকার কল্যাণে শতকরা পাঁচভাগ মানুষ ক্ষমতা উপভোগ করে, বাকি পঁচানব্বই ভাগ মানুষ অসহায়; আশায় আশায় শুধু ভোট দিয়ে যায়। মাধবীলতা বলল, এসব নিয়ে আমি ভাবতে চাই না, তবু ভাবনাটা চলে আসে।

সকালে ম্যাটাডোর চলে এসেছিল। স্বপ্নেন্দু দত্তের লোক এসে শুধু বাড়ির মালিকানা বুঝে নেয়নি, ছোটমার যাবতীয় সম্পত্তি ম্যাটাডোরে তুলে দিয়েছিল। অবশ্য ওদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছিল লছমন এবং তার ছেলে। বাবা।

মালপত্র ম্যাটাডোরে ভোলা হয়ে গেলে সেই ট্যাক্সিটা চলে এল। দেবেশ ড্রাইভারকে খবর দিয়েছিল। মালপত্র রাখার পর ম্যাটাডোরে জায়গা যদি না হয় সেইজন্যে। ছোটমা তার ঠাকুরদের সযত্নে পুটুলিতে বেঁধে নিয়ে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পাশে সেই বউটি। ছোটমা যত মুখ ঘোরাচ্ছেন তত তার চোখ উপচে জল নামছিল। ছোটমা বললেন, এই বাগান কেটে পরিষ্কার করে ফেলবে ওরা। শেয়াল সাপগুলোকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে। সেই কতকাল আগে আমি চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছিলাম। তখন ওরা, ওই গাছগুলো যেমন ছিল, তেমনই রাখতে পেরেছিলাম। শুধু আমার শরীরটা বুড়ি হয়ে গেল।

অনিমেষকে দেখা গেল, একটু এগিয়ে এসে ডাকল, চলুন, আপনারা। চোখে বারংবার আঁচল চাপতে চাপতে বারান্দা থেকে নেমে গলির মুখে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন ছোটমা। পাশে বউটি। মাধবীলতা ওপাশের দরজা খুলে বসতেই লছমনের ছেলে বাবা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ছোটমা দুহাতে নিজের কান চেপে ধরলেন। মাধবীলতা ড্রাইভার ছেলেটিকে বলল, একটু হর্ন দাও তো। কোথায় গেল।

অনিমেষ অপলক বাড়িটাকে দেখছিল। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বাড়ি ছেড়ে সে ঠাকুরদা-বড়পিসিমার সঙ্গে চলে এসেছিল এখানে। চোখের ওপর এই বাড়ি তৈরি হতে দেখেছিল। আজ সেই বাড়িটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে চিরকালের জন্যে। আজ থেকে তার আর কোনও বাড়ি নেই। এই সময় ট্যাক্সির হর্ন সজোরে কানে ধাক্কা মারল অনিমেষের।

.

৩৮.

বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে ছিল, সঙ্গে একজন দাড়িওয়ালা যুবক। অর্ককে দেখে হাত তুলল। কাছে এলে সে বলল, ইনি আমাদের পার্টির একজন যুবনেতা। ওঁকে আপনার কথা বলেছি।

খানিকটা দূরেই থানা। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে যুবক বলল, আঃ, বিশু কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে নাম বলতে হয়। নমস্কার দাদা, আমি প্রতুল রায়। একটা কথা বলুন, যে মানুষটিকে নিয়ে পুলিশকে চিন্তিত করা হয়েছে তাকে আপনি কি দীর্ঘদিন চেনেন?

না। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক ঝাড়খণ্ড থেকে ওকে পাঠিয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। ও কলকাতার কিছুই চেনে না।

নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন আপনি। পুলিশ মনে করে ঝাড়খণ্ডি মানেই মাওবাদী।

প্রতুলের কথা শুনে হেসে ফেলল অর্ক।

আপনি হাসছেন? প্রতুল বিরক্ত।

বাবার কাছে শুনেছি, নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবাংলার বাইরের মানুষ ভাবত বাঙালি মানেই নকশাল। অর্ক বলল।

হুম। দেখুন, আমরা মা-মাটি-মানুষের জন্যে সংগ্রাম করছি। বামফ্রন্ট মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নন্দীগ্রাম ওদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। গরিব মানুষদের জমি সামান্য টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে বুর্জোয়া টাটাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করবই। মুশকিল হল ওদের এবারে মানুষ এখনও ভুল বুঝছেন। জঙ্গলমহলে ওদের হার্মাদ বাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করছে তারাই নাকি মাওবাদী। অথচ মানুষ জানে না মাওবাদীদের সাপ্লাই দেওয়া হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে। প্রতুল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সযত্নে ধরাল, শুনলাম আপনার বাবা নকশাল ছিলেন। তার মানে তিনি চূড়ান্তভাবে সিপিএম বিরোধী। জেল খেটে বেরিয়ে অনেক নকশাল রাতারাতি সিপিএম হয়ে গিয়েছিলেন, আপনার বাবা হননি। আপনার অল্পবয়সে আপনি মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিপিএমের চাপে সরে আসতে বাধ্য হন। আপনাদের ওপর ওদের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তাই আপনার বাড়িতে একজন মাওবাদী আশ্রয় নিয়েছে বললে ওরা এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে পারবে। এক, আপনাকে জেলে ঢোকাতে পারবে, দুই, পাবলিককে আরও ভয় পাইয়ে দিতে পারবে। তাই এই কারণে ওদের মুখোশ খুলতে আমরা আপনাকে সাহায্য করব। আপনি বিশুর সঙ্গে থানায় যান। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে যা বললেন তা ওখানে বলবেন না।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। অর্কর কপালে ভাঁজ পড়ল।

আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি যে ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছেন এবং তাকে আপনি চেনেন না, আর একজনের সুপারিশে রাজি হয়েছেন, এ কথা পুলিশকে জানানোর কোনও দরকার নেই। শুনলেই এখন যদি ধোয়া হয়ে থাকে তা হলে তা দাউদাউ আগুন হয়ে যাবে। বুঝতে পারলেন? প্রতুল রায় বলল।

তা হলে কী বলব?

বলবেন আপনার পূর্ব পরিচিত। নর্থ বেঙ্গলে থাকেন। প্রতুল বলল। বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, নর্থ বেঙ্গল বলাই ভাল। আপনাদের বাড়ি তো ওখানেই।

প্রতুল বলল, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আশা করব সুরেন মাইতিদের সঙ্গে লড়াইয়ে আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। বিশু, তোমরা যাও। কী হল তা বেরিয়ে এসে আমাকে জানিয়ো।

.

অর্ক আর বিশ্বজিৎ থানায় ঢুকল। যে সাব-ইন্সপেক্টার দরজার ওপাশে টেবিলে ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন, মুখ তুলে বললেন, আরে! বিশুবাবু যে। কী ব্যাপার?

বড়বাবু কোথায়?

সাব-ইন্সপেক্টার দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে শরীর একটু মুচড়ে বললেন, বিশ্রাম করছেন। এই সরকার যদি চলে যায় তা হলে তো বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না।

বিশ্বজিৎ বলল, তার মানে, তখন আপনাদের কাজ করতে হবে? নিঃশব্দে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসলেন সাব-ইন্সপেক্টার, এখনই তো আপনারা বলছেন আমাদের নাকে দড়ি লাগিয়ে হামাগুড়ি দেওয়াবেন। যাক গে, একটা সত্যি কথা বলি, তিরিশ বছর চাকরি হয়ে গেল, এমন জাঁদরেল মহিলা কখনও দেখিনি। একদম একা দেশটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। তা কী ব্যাপার, বলুন।

বড়বাবু এঁকে দেখা করতে বলেছেন। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্কর দিকে তাকিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, চিনলাম না।

অর্ক হাসল, চেনার মতো কোনও পরিচয় নেই। আমি অর্ক মিত্র।

কপালে ভাঁজ পড়ল সাব-ইন্সপেক্টারের, ঈশ্বরপুকুর লেন?

হ্যাঁ। অর্ক মাথা নাড়ল।

হয়ে গেল। কোথায় পালিয়ে গিয়ে গা-ঢাকা দেবেন, না নিজেই চলে এসেছেন খাঁচায় ঢুকতে! সুরেন মাইতি তো বলে গেল আপনি ডেঞ্জারাস লোক। সাব ইন্সপেক্টার একজন সেপাইকে ডাকল, দেখো তো, বড়বাবু কী করছেন।

চা খাচ্ছেন।

অ উঠে দাঁড়ালেন সাব-ইন্সপেক্টার, আসুন।

বন্ধ দরজা ঠেলে সাব-ইন্সপেক্টার ভেতরে ঢুকে গেলে বিশু নিচু গলায় বলল, শুনলেন তো, সুরেন মাইতি কী চিজ। বলুন।

ঘরের ভেতরে ঢুকে ওরা দেখল ঘরোয়া পোশাকে বড়বাবু বসে চা খাচ্ছেন। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সাব-ইন্সপেক্টার কিছু বললেন। সেটা শুনে মুখ তুললেন বড়বাবু। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আসতে পারি?

ঘরে ঢোকার পরে এ কথা জিজ্ঞাসা করার কোনও মানে নেই। আসুন। বসুন।

সাব-ইন্সপেক্টার বললেন, উনি বিশ্বজিৎবাবু। তৃণমূল নেতা। ইনি অর্ক মিত্র।

বড়বাবু বিশ্বজিতের দিকে তাকালেন, বলুন, আপনার কী সমস্যা?

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, আমি অর্কদার সঙ্গে এসেছি।

অ্যা? চমৎকার। কিন্তু আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ও। আমি তা হলে বাইরে অপেক্ষা করছি।

আপনার ইচ্ছে।

এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে নয়। অর্কদা, আপনি কথা বলুন। বিশ্বজিৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সাব-ইন্সপেক্টার ওকে অনুসরণ করছিলেন কিন্তু বড়বাবু তাকে থামালেন, এঁকে আমার কাছে নিয়ে আসার আগে সার্চ করেছেন?

না স্যার!

কী আশ্চর্য! আপনার যে কেন প্রমোশন হচ্ছে না তার কারণ জানতে চেয়েছিলেন না?

বড়বাবুর ধমক খেয়ে সাব-ইন্সপেক্টার এগিয়ে এসে অর্কর শরীর, পকেট খুঁজে দেখে হাসলেন, না স্যার, কিছুই নেই। সিগারেটের প্যাকেটও নেই।

যান। বড়বাবু বলমাত্র সাব-ইন্সপেক্টার বেরিয়ে গেলেন।

বড়বাবু বললেন, আপনি বসুন।

অর্ক টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড়বাবু বললেন, আপনি মাওবাদীদের ঘনিষ্ঠ, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে আপনার এলাকার বামপন্থী নেতা আমাদের জানিয়েছেন। কাজটা কতদিন ধরে করছেন?

আমি জ্ঞানত এরকম কাজ কখনও করিনি।

কলকাতায় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মাওবাদী সমর্থকের সংখ্যা প্রচুর। এরকম কার কার সঙ্গে আপনার সরাসরি যোগাযোগ আছে?

আমি তাদের কাউকেই চিনি না।

যে লোকটিকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন তার নাম কী?

রাম, রামচন্দ্র। ইচ্ছে করে রামজি বলল না অর্ক।

রামচন্দ্র। টাইটেল কী?

রামচন্দ্র রায়।

কতদিন চেনেন ওকে?

অনেকদিন।

ওর বাড়ি কোথায়? কোত্থেকে এসেছিল?

শিলিগুড়ি। এখানে ওর পরিচিত কেউ নেই বলে থাকতে চেয়েছিল।

আপনি কী করেন?

চাকরি।

তৃণমূলে ঢোকার আগে কী করতেন?

আমি তৃণমূলে ঢুকিনি। কোনও দলেরই সমর্থক ছিলাম না।

তা হলে ওই তৃণমূল নেতা আপনার সঙ্গে কেন এলেন?

আমরা একই পাড়ায় থাকি।

বড়বাবু সোজা হয়ে বসলেন, আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

মা এবং বাবা।

তাঁরা রামচন্দ্রকে দেখেছেন?

না। তারা এখন জলপাইগুড়ির বাড়িতে আছেন।

বড়বাবু হাসলেন, চমৎকার। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। কলকাতায় রামচন্দ্র কী কাজে এসেছিলেন?

আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করিনি।

একজন লোক আপনার বাড়িতে এসে থাকছে, কেন এসেছে, কী কাজ করতে এসেছে তা জানার আগ্রহ আপনার নেই? মিথ্যে বলছেন। বড়বাবু ঠোঁট মোচড়ালেন।

অর্ক একটু ভাবল, আপনাকে সুরেন মাইতি বলেছে যে ও মাওবাদী?

আরও বেশি বলেছে। আচ্ছা, এই রামচন্দ্র এখন কোথায়?

ও চলে গেছে। এর বেশি কিছু জানি না।

কিন্তু জানি না বললে তো চলবে না। জানতেই হবে।

মানে? অর্ক অবাক হল।

আপনাকে আমি চারদিন সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে ওই সো কলড রামচন্দ্রকে খুঁজে বের করে আমাকে জানাতে হবে।

আশ্চর্য! আমি কোথায় খুঁজব?

সেটা আপনার সমস্যা। মাথা দোলালেন বড়বাবু।

আপনি অযথা আমার ওপর চাপ তৈরি করছেন। একটু গলা তুলল অর্ক।

এখনও করিনি। আমার কথা না শুনলে সেটা করব।

মানে?

আমি আপনার সঙ্গে এতক্ষণ ভদ্রভাবে কথা বলেছি কারণ এটা আমার স্বভাব। কিন্তু আপনি যদি সমানে মিথ্যে বলে যান, আমাদের কোনও সাহায্য না করেন তা হলে যেটা স্বাভাবিক তাই করা হবে। অর্কবাবু, আপনি আপনার বাড়িতে যাকে আশ্রয় দিয়েছেন তার সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না বললেন, কোনও বাচ্চা ছেলেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি চারদিনের মধ্যে তার খবর আমাকে না দেন, তা হলে আমি ধরে নেব আপনিও একজন মাওবাদী। আপনি দেশের শত্রু। আপনি জঙ্গলমহলে গিয়ে অস্ত্র ধরেননি বটে কিন্তু শহরে থেকে তাদের মদত দিচ্ছেন। আপনাকে নিয়ে এসে ওষুধ প্রয়োগ করলেই মিথ্যের বদলে সত্যি কথাগুলো বলতে শুরু করবেন। আপনার দল বলছে পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী বলে কিছু নেই। তা হলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সিপিএমের কর্মীদের খুন করছে কারা? এখন আপনার ওপর নির্ভর করছে আপনি কী চান। বড়বাবু টেবিলে রাখা বেল বাজালেন।

একজন সেপাই ঘরে ঢুকলে বড়বাবু বললেন, ওই তৃণমূলি নেতা কি আছেন?

হ্যাঁ স্যার।

ডাকো তাকে।

সেপাই গিয়ে খবর দিলে বিশ্বজিৎ ঘরে ঢুকল। বড়বাবু বললেন, আপনার পাড়ার লোক মনে করছে ইনি মাওবাদীদের আশ্রয় দিয়েছেন। আমি এঁকে অনুরোধ করেছি লোকটার হদিশ আমাকে দিতে। ঠিক আছে, যেতে পারেন।

বিশ্বজিৎ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বড়বাবু হাত নাড়লেন, না, কিছু বলতে হবে না। আপনি সঙ্গে এসেছেন বলে ওকে আজই অ্যারেস্ট না করে একটা সুযোগ দিলাম। আসুন আপনারা।

কোনও কথা না বলে বিশ্বজিৎ অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে সে জিজ্ঞাসা করল, লোকটা এখন কোথায় বলুন তো?

অর্ক মাথা নাড়ল, যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেছে। বিশ্বজিৎ সন্দেহের চোখে অর্ককে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে আমরা সাহায্য করতে চাইছি কেন জানেন? আপনি তৃণমূল দূরের কথা, কখনও কংগ্রেসই করেননি। কিন্তু আমাদের শত্রু যখন আপনার সঙ্গে শত্রুতা করছে তখন আপনাকে মিত্র ভাবাই যেতে পারে। যাক গে, চারদিনের মধ্যে লোকটার খবর বড়বাবুকে দিয়ে যাবেন।

আমি খুব বিপদে পড়লাম বিশ্বজিৎ।

বিশ্বজিৎ তাকাল। এবার দৃষ্টি নরম। বলল, আপনি আমাদের পার্টি অফিসে আসুন।

কেন?

আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে হয়তো আপনার বিপদ কেটে যেতে পারে। বিশ্বজিৎ বলল, আচ্ছা অর্কদা, আমি এখন যাচ্ছি। বিকেলে পার্টির অফিসে থাকব।

বিশ্বজিৎ চলে গেলে অর্ক চুপচাপ হাঁটতে লাগল। রাস্তায় নোকজন বেড়ে গেছে। সে পেছন দিকে তাকাতেই একজোড়া বুটজুতো দাঁড়িয়ে গেল। এখনও পাঞ্জাবি এবং ধুতির নীচে বুটজুতো পরার অভ্যেস যারা ছাড়তে পারেনি তাদের চিনতে অসুবিধে হয় না। লোকটা কি তাকে অনুসরণ করছে?

অর্ক খানিকটা হেঁটে ফুটপাথ বদল করলে দেখা গেল লোকটাও রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির জন্যে দাঁড়িয়ে গেছে। সন্দেহ সত্যি হতেই অর্ক উলটোদিক থেকে আসা একটা বাসে উঠে পড়ল। বাসটা লাল আলোয় দাঁড়িয়েছিল। ওঠামাত্র আলো বদলাতে বাস যখন চলতে শুরু করল তখনও লোকটা পৌঁছোতে পারেনি। বড়বাবু তাকে চোখের আড়ালে রাখতে চাইছেন না। এটা আর একটা চাপ তৈরি করল।

শ্যামবাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে কিছু একটা করার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আর দেশলাই কিনল অর্ক। সিগারেট সে খায় না, কখনও শখ হলে একটা যদি খায় তা হলে তাকে খাওয়া বলে না। আজ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টানার পর আচমকা বেশ ভাল লাগল। পাঁচ মাথার মোড়ের ফুটপাত ঘেঁষা রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবার চেষ্টা করল, কী করা উচিত।

এ কথা সত্যি, ঠিক কোন জায়গায় এখন রামজি আছে তা সে জানে না। রামজি যে সূত্র তাকে দিয়ে গিয়েছিল সেটা পুলিশকে জানালে ওরা নিশ্চয়ই একটা হদিশ পেয়ে যাবে। কিন্তু–।

মাথা নাড়ল অর্ক। রামজি তাকে বলেনি, অন্তত খোলাখুলি বলেনি ও কেন পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। ও মাওবাদী স্কোয়াডের সদস্য কি না তাও জানায়নি। অর্ক অনুমান করেছে। যারা সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে রামজি তাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু সেই অনুমানের ওপর নির্ভর করে ছেলেটার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা কি উচিত কাজ হবে? আবার এমনও তো হতে পারে রামজির দেওয়া সূত্রগুলিকে জানিয়ে দিলে যদি পুলিশ ওকে খুঁজে না পায় তা হলে নির্ঘাত ধরে নেবে সে ওদের ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। তখন যা হবে তা কল্পনাও করতে পারছে না সে।

মোবাইল বেজে উঠতেই সেটা পকেট থেকে বের করে সামনে ধরতেই মা শব্দটা দেখতে পেল অর্ক। বোতাম টিপে সে বলল, বলো।

তুই কোথায়? মাধবীলতার গলা।

শ্যামবাজার।

অফিসে যাসনি?

যাওয়া হয়নি। কেন?

বাড়ি পরিষ্কার আছে তো?

তোমরা কি আসছ?

হ্যাঁ। আজ টিকিটের জন্যে চেষ্টা করা হবে। ভি আই পি কোটায় বোধহয় পাওয়া যাবে।

ভি আই পি কোটায়? অর্কর গলায় বিস্ময়।

যাওয়ার আগে ফোন করব। খোলা রাখিস।

বাড়ির কী ব্যবস্থা হল?

যা হয়েছে তার চেয়ে ভাল এই মুহূর্তে হতে পারত না। রাখি।

ফোনটা কেটে দিল মাধবীলতা। মন খারাপ হয়ে গেল অর্কর। মাধবীলতা তার সঙ্গে যে গলায় কথা বলল তাতে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই। তাকে মা এখন দূরের মানুষ বলে ভেবে নিয়েছে। বাবার এই ব্যাপারে ভূমিকা থাকলেও মা তাতে প্রভাবিত হওয়ার মহিলা নয়। ওরা কাল বা পরশু এখানে ফিরে এলে নিশ্চয়ই সুরেন মাইতির লোকজন সাতকাহন করে সব শোনাবে। রামজিকে নিয়ে মায়ের প্রচুর ঔৎসুক্য ছিল, খানিকটা সন্দেহও। এখানকার কথা শোনার পর সেটা মায়ের কাছে নির্ভুল বলে মনে হবে। স্বামীর জন্যে যে মহিলা সারা জীবন স্যাক্রিফাইস করে এলেন, ছেলের জন্যে সেটাই তিনি মেনে নেবেন না।

তা হলে তার কী করা উচিত?

এই যে মশাই, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?

অর্ক মুখ ঘুরিয়ে দেখল অলকা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

ও, আপনি?

আপনাকে খবরটা দেওয়া হয়নি। মেয়ে আবার স্কুলে যাচ্ছে।

বাঃ। ভাল খবর।

কিন্তু আপনার সম্পর্কে যেটা শোনা যাচ্ছে তা কি সত্যি?

কী শুনছেন তাই তো জানি না।

আপনি নাকি ভয়ংকর মাওবাদীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার কাছে এ কে ফর্টি সেভেন রাইফেল ছিল। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।

হেসে ফেলল অর্ক। মুখে কিছু বলল না।

অলকা হাসার চেষ্টা করল, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করলাম। চলি।

ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে অর্কর মনে হল, যেতে পেরে ও যেন বেঁচে গেল। সেই গায়ে-পড়া আত্নাদি ভাবটা একদম উধাও হয়ে গিয়েছে।

দেখতে দেখতে প্রবল চাপ অনুভব করল অর্ক। সে কোনও অন্যায় করেনি, কোনও দেশবিরোধী কাজ করেনি। তা হলে তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না কেন?

.

৩৯.

দেবেশ গিয়েছে নিউ জলপাইগুড়িতে, ফিরবে দুপুরের পরে। অনিমেষ আশ্রমের বাগানে চেয়ার পেতে বসে ছিল। মাথার ওপর বেশ বড়সড় কাঁঠাল গাছ থাকায় রোদ নামছিল না নীচে। এখন আকাশ জুড়ে শুধু নীল আর নীল। কালচে দুরের কথা সাদা মেঘের টুকরোগুলোও সেখানে ভাসছে না। এই আকাশ কলকাতায় দেখা যায় না। এখানে সে অনেক কিছু পাচ্ছে যা কলকাতায় পাওয়া যায় না। জোরে শ্বাস নিলে বুক ভরে শান্তি নামে। এই মাটি গাছগুলোকে বন্ধু বলে মনে হয়। কান খাড়া করলেও শুধু পাখির গলা। আর হাওয়ার শব্দ দুই কানে মোলায়েম আরাম ছড়িয়ে দেয় যা কলকাতায় মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না। সেখানে শুধু মানুষের তৈরি উৎকট শব্দ সারাক্ষণ কানের পরদাকে বিব্রত করে রাখে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বেকার ছোঁড়াগুলো অকারণেই শব্দ তৈরি করে উল্লসিত হয়।

একেবারে দুহাত দূরে কাঠবিড়ালিটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। কাঁঠাল গাছ থেকে নেমে এসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনের দুটো পায়ের ওপর ভর করে সোজা দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। বেশ মজা লাগল অনিমেষের। ঠিক তখনই পেছন থেকে আর একটা কাঠবিড়ালি তীব্র স্বরে ডেকে উঠল। পঁড়িয়ে থাকা কাঠবিড়ালি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল একবার কিন্তু নড়ল না, এবার পেছনের কাঠবেড়ালি দৌড়ে এসে যেভাবে সঙ্গীকে ধাক্কা দিয়েই ফিরে গেল তাতে না হেসে পারল না অনিমেষ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনওমতে নিজেকে সামলে সঙ্গীকে অনুসরণ করল সে, ওরা কি স্বামী স্ত্রী? অথবা প্রেমিক প্রেমিকা? এবার অনিমেষ লক্ষ করল শুধু ওরা দুজন নয়, এই বাগানে প্রচুর কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অনি।

নিজের নামটা কানে যেতেই অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে ছোটমাকে দেখতে পেল। পরনে সাদা শাড়ি কিন্তু তাতে নীলের আলপনা রয়েছে। অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল কিন্তু ছোটমা হাত নাড়লেন, না না, উঠতে হবে না। তোমরা কি আজই চলে যাচ্ছ?

দেবেশ গিয়েছে এনজেপিতে। যদি টিকিট পায় তা হলে–। কথা শেষ করল না অনিমেষ।

তুমি তো শ্ৰাদ্ধশান্তিতে বিশ্বাস করো না, তাই না? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অনিমেষ হাসল, মুখে কোনও কথা বলল না।

আসলে তোমার বাবা, বড়পিসিমা, ঠাকুরদা চলে গেছেন অনেককাল আগে। আমার আয়ু আর কতদিন তা জানি না। তুমি মানো না জেনেও বউমার সঙ্গে কথা বলেছি। বউমা রাজি হয়েছে। তুমি তাকে বাধা দিয়ে না।

কী ব্যাপারে রাজি হয়েছে মাধবীলতা?

গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধের কাজ করতে।

অ্যাঁ? মাধবীলতা আপনাকে বলেছে এ কথা?

হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি একেবারে চারজনের কাজ যেন করে সে।

হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, চারজন? ওঁরা তো তিনজন। চতুর্থজন কে?

ছোটমা হাসলেন, আমি।

কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অনিমেষ বলল, এই কাজটা করতে মাধবীলতা রাজি হয়েছে?

ছোটমা বললেন, প্রথমে হয়নি। আমি অনেক বলার পরে নিমরাজি হয়েছে। তোমাকে নিশ্চয়ই বলবে। তুমি নিজে ইচ্ছুক না হলেও ওকে বাধা দিয়ো না।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না এসব কী হচ্ছে!

পৃথিবীতে অনেক কিছুই হয় যা মানুষ বুঝতে পারে না। ছোটমা বললেন।

আচ্ছা সেই কবে দাদু-বড়পিসিমা চলে গিয়েছেন। বাবা গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। আত্মা আছে কি না তার কোনও প্রমাণ মানুষ পায়নি। শুধু কল্পনা করে তার অস্তিত্ব প্রচার করেছে। তর্কের খাতিরে যদি ওই কল্পনা করি তা হলে এত বছরে তাদের একটা গতি হয়ে গিয়েছে। গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়নি বলে তারা পৃথিবীতে বন্দি হয়ে নিশ্চয়ই নেই।

তুমি কী করে বুঝছ যে তাদের আত্মা মুক্তি পেয়েছে?

আমি কোথাও পড়িনি, কারও মুখে শুনিনি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মার মুক্তির জন্যে গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করা হয়েছে। তা যদি না করা হয়ে থাকে তা হলে হেসে ফেলল অনিমেষ, কী উদ্ভট কথা।

ছোটমা গম্ভীর হলেন, অনি, তোমার কাছে এসব উদ্ভট বলে মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। তা ছাড়া এতদিন তো এসব আমার মাথায় আসেনি। আজ এল। যে বাড়িতে তোমার দাদুর মনপ্রাণ পড়ে ছিল, যেখানে তোমার বড় পিসিমা, বাবা অনেককাল থেকেছেন সেই বাড়ি চিরকালের জন্যে ছেড়ে চলে এলাম। আজ বাদে কাল প্রোমোটার বাড়িটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো চার-পাঁচতলা বাড়ি তুলবে। তখন সেই বাড়িতে তোমার পূর্বপুরুষের কোনও স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না। তুমি ভাবো তো, তোমার দাদু বেঁচে থাকলে, যত অভাব হোক, নিজের হাতে তৈরি বাড়িটাকে বিক্রি করতেন? মানুষ যদি কাউকে বা কিছুকে খুব ভালবাসে তা হলে তার চলে যাওয়ার পরে সেই ভালবাসাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু আমি করি। ওই জমিতে নতুন বাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই ওঁদের আত্মার শান্তি হওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, গয়ায় শ্রাদ্ধ করলেই সেটা সম্ভব হয়। আমি পথঘাট চিনি না, শরীরও ভাল না, তা না হলে নিজেই যেতাম। মাধবীলতা বিচক্ষণ মেয়ে। আমার কথা ওর পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছে কারণ ও আমাকে হতাশ করতে চায়নি।

তা হলে তো হয়েই গেল। কিন্তু তোমার নাম জুড়লে কেন?

এবার হাসলেন ছোটমা, শখ হল।

শখ?

এই যে তোমরা এসে আমার কত উপকার করে যাচ্ছ, আবার কবে আসবে তা তো জানি না। ভেবে দেখো, কত বছর পরে এলে। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই খবর পাবে কিন্তু তখন তো আমি থাকব না। তাই জানতেও পারব না আমার শ্রাদ্ধ কেউ করল কি না? মাধবীলতা করে দিলে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারব। মরার পর আর এই পৃথিবীর মুখ দেখতে হবে না। ছোট মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার ভেসে এল, নতুন দিদা, নতুন দিদা!

ছোটমা ব্যস্ত হয়ে বাগানের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী?

এই সময় ছেলেটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছেলেটি দুদিকে দুটো হাত ছড়িয়ে বলল, ইয়া বড়া সাপ। মুরগির বাচ্চাদের খেতে ছুটে আসছিল। দেখতে পেয়ে আমি মাটিতে লাঠির বাড়ি মারতে ভয় পেয়ে পুকুরের জলে নেমে গেছে। কিন্তু ব্যাটা আবার আসবে। কী হবে?

চল, দেখি গিয়ে। মুরগির বাচ্চারা এখন কোথায়?

পুকুরের পাশেই মায়ের সঙ্গে ঘুরছে।

ওদের ওখান থেকে সরাতে হবে। চল, চল!

ছোটমা যে গতিতে ছেলেটির সঙ্গে অদৃশ্য হলেন তাতে অনিমেষের মনেই হল না ওঁর শরীর ভাল নয়। ক্রাচ টেনে নিয়ে অনিমেষ উঠল। ওরা যেদিকে গিয়েছে সেই দিকে কিছুটা হাঁটতেই পুকুর চোখে পড়ল। ছোটমা খানিকটা ঝুঁকে তু তু করে ডাকছেন যাদের সেই মুরগি-মা এবং তার ছানারা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে। ছোটমা ছেলেটাকে কিছু বলতেই সে ছুটে আশ্রমের পেছন দিকে চলে গেল।

অনিমেষ কাছে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করল, এরকম মুরগিছানা কত আছে?

আছে, তবে তারা একটু বড় হয়ে গেছে। বিপদ বুঝলে পালাতে পারে। এরা একেবারেই শিশু। জ্ঞানগম্যি হয়নি এখনও। বলেই ছোটমা চেঁচালেন, না, ওদিকে নয়। খুব বকব ওদিকে গেলে।

মুরগিছানাগুলো জলের দিকে যাচ্ছিল, ধমক শুনে থমকাল। সঙ্গে সঙ্গে মুরগি-মা ডেকে উঠতেই ওরা ফিরে গেল তার কাছে।

অনিমেষ পুকুরের দিকে তাকাল। ওখানে নাকি প্রচুর মাছ বড় হচ্ছে। কিন্তু সাপ থাকলে তারা কি আর বড় হতে পারবে? হঠাৎ চোখে পড়ল পাড় থেকে খানিকটা দূরে জলের ওপর একটা মাথা যেন উঁচু হয়ে আছে। অনিমেষ উত্তেজিত হল, সাপ।

ছোটমা তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই।

তার মানে?

ওটা জলঢোঁড়া। বিষ নেই কিন্তু খুব বদমাশ। ছোটমা একটা নুড়ি তুলে ছুঁড়ে মারতেই মাথাটা জলের তলায় চলে গেল। এই সময় ছেলেটা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে ছোটমায়ের হাতে দিল। তিনি একটু একটু করে চাল ছড়িয়ে মা-মুরগি এবং তার ছানাদের আশ্রমের পেছনে নিয়ে গেলেন।

দৃশ্যটি দেখতে খুব ভাল লাগল অনিমেষের। এবারে জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসে অনেকদিন থেকে ছোটমাকে যেরকম দেখেছিল তার সঙ্গে এই ছোটমার কোনও মিল নেই, যেন নতুন জন্ম হয়ে গেছে ওঁর। অনিমেষের খেয়াল হল, নিবারণবাবুর বাড়ির বউটি সেই যে এখানে এসেছে তারপর থেকে তাকে আর দেখতে পায়নি সে। নিশ্চয়ই সে মনের মতো কাজ পেয়ে গেছে। ছোটমা তাকে নিয়ে অবশ্যই ভাল থাকবেন। এই সময় সাপটাকে দেখতে পেল অনিমেষ। একটু ওপাশের পুকুরের জল থেকে ওপরে উঠে আসছে ধীরে ধীরে। তার লক্ষ্য যে আশ্রমের পেছন দিক সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ছোটমা বললেন ওই সাপ নির্বিষ। কিন্তু বেশ মোটা এবং অনেকটাই লম্বা। ও যে মুরগির বাচ্চাদের লোভ এখনও ছাড়েনি তা আশ্রমের পেছন দিকে যাওয়ার চেষ্টাতেই বোঝা যাচ্ছে, অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গেল। সে যতটা সম্ভব দ্রুত ক্রাচ নিয়ে চলে গেল সাপের কাছে। সাপটা নির্বিকার। হয়ে এগোচ্ছিল। অনিমেষকে আসতে দেখে মুখ ফিরিয়ে হাঁ করল। কিছু না ভেবেই অনিমেষ মাথার কিছুটা নীচে ক্রাচের লোহা বাঁধানো নীচের অংশটি যতটা জোরে সম্ভব চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা শরীর দুমড়ে লেজটাকে ওপরে এনে ক্রাচটাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। অনিমেষ কিছুতেই ক্ৰাচটাকে সাপের শরীর থেকে সরাচ্ছিল না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এভাবে বেশিক্ষণ চেপে ধরে থাকতে সে পারবে না। সাপের লেজের টানে ওটা যে-কোনও মুহূর্তেই উঠে আসতে পারে। অনিমেষ চিৎকার করল। দুবার চিৎকার করতেই ওপাশের বাগানে কাজ করা কয়েকজন বৃদ্ধ দ্রুত চলে এসে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। তারপর তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় সাপটাকে বেঁধে ফেললেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কিছু হয়নি তো?

না। তবে আপনারা না এলে হয়তো হত।

আপনি খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এটা ঠিক করেননি।

হঠাৎ মনে হল মুরগির বাচ্চাগুলো সাপটা খেয়ে নেবে। মনে হওয়ামাত্র এগিয়ে এসেছিলাম। অনিমেষ হাসল।

হাসছেন যে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

আমাদের চারপাশে এরকম কত সাপ প্রতিদিন হাঁ করে বসে আছে দুর্বল মানুষদের গিলে ফেলতে, দেখেও মুখ ঘুরিয়ে থাকি। এগিয়ে গিয়ে আটকাবার চেষ্টা করি না। অনিমেষ বলল।

.

অনিমেষ তার ক্রাচের সাহায্যে একটা মোটা লম্বা সাপ ধরেছে এই খবরটা আশ্রমের সবাই জেনে গেল। তাদের সবাই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা আহত সাপটাকে দেখে গেল। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা এদের সঙ্গে সাপ দেখতে আসেনি।

সে ফিরে গেল আশ্রমের ভেতরে। সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল কীভাবে সে সাপটাকে আটকাল? উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে গেল সে। শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পেতেই আশ্রমের পেছনে চলে এল। সেখানে বড় বড় তারের খাঁচায় হাঁস এবং মুরগিদের সংসার। ছোটমা ছেলেটির সঙ্গে তাদের পরিচর‍্যা করছেন। তাকে দেখে বললেন, সাপটাকে মেরে ফেললে?

মরেনি। বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু আহত হয়েছে।

কোনও দরকার ছিল? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

অবাক হল অনিমেষ। কী বলছ? ওটা তো এদিকে আসছিল মুরগির বাচ্চাদের খাওয়ার জন্যে।

খেতে আসছিল মানেই খাওয়া নয়। আমরা যদি এদের ঠিকঠাক আগলে রাখি তা হলে সাপ খাবে কী করে? ওটাও তো একটা প্রাণী। ওকেও তো বাঁচতে হবে। এই, চল। ছোটমা ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেলেন। অনিমেষের খেয়াল হল দেবেশ এখনও ফোন করেনি। যে সময়ে সে আশ্রম থেকে বের হয়েছে তাতে অনেক আগেই এনজেপি স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া উচিত। ফোন করেনি মানে ধরে নেওয়া যেতে পারে আজকের কোনও ট্রেনে টিকিট পায়নি। টিকিট না পাওয়া মানে এখানেই থাকতে হবে।

থাকতে তার খারাপ লাগছে না। বহুদূরের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া বাসের ঈষৎ আওয়াজ ছাড়া কোনও যান্ত্রিক শব্দ এখানে শোনা যায় না। পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ আর মাঝে মাঝে আশ্রমে পালিত গোরু ছাগলের ডাক এখানকার নির্জনতাকে সমৃদ্ধ করে। এই গাছগাছালি, পুকুরে জলের শিশু ঢেউ দেখতে দেখতে দিন চমৎকার কেটে যায়। এইরকম পরিবেশে সে। স্বর্গভেঁড়াতেও থাকেনি।

স্বৰ্গছেঁড়া এখান থেকে বড়জোর পঁচিশ মাইল দূরে। বাসে প্রায় এক ঘণ্টা লাগত সে সময়ে। শৈশব-বাল্যকালের সেই জায়গাটার এত কাছে এসেও যাওয়া হল না। অনিমেষ হাসল, মানুষের জীবনে না শব্দটি বারংবার ফিরে ফিরে আসে। একটু তৃপ্তির সঙ্গে অনেকটা অতৃপ্তি চাকার মতো ঘোরে।

গতকাল এখানে আসার পরে মাধবীলতার সঙ্গে দেখা হয়নি। এই আশ্রমে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা আলাদা। অনিমেষ শুয়েছিল দেবেশের ঘরে। কাল দুবেলা খাওয়ার সময় বয়স্করা পরিবেশন করেছিলেন, মাধবীলতা ছিল রান্নাঘরে। অর্থাৎ অনিমেষকে না দেখেই একটা দিন বেশ কাটিয়ে দিল মাধবীলতা।

তুমি এখানে? শুনলাম একটা সাপকে ধরতে সাহায্য করেছ? বলতে বলতে মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল।

তুমি তো দেখতে গেলে না।

জখম হওয়া প্রাণীকে দেখতে আমার খারাপ লাগবে। স্নানঘরে জল তুলে দিয়েছি, চান সেরে নাও। মাধবীলতা বলল।

অনেক ধন্যবাদ।

আরে। এভাবে কথা বলছ কেন?

কারণ তুমি এখন আমার সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত নিতে পারো। আমার মতের বিরুদ্ধে যেতে তোমার এখন কোনও আপত্তি নেই।

বুঝতে পারলাম। মাধবীলতা হাসল, সারা জীবন তুমি যা বলেছ, যাতে তোমার খারাপ না লাগে সেইমতো কাজ করে এসেছি। অনেক সময় পছন্দ না হলেও সেটা তোমাকে জানাইনি। কিন্তু একটা সময় তো মনে হয়, আমিও একজন মানুষ, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু কাজ করি। তোমার পরিবারের পাশে তুমি কখনও দাঁড়াওনি, অবশ্য সেই ক্ষমতা শরীরের জন্যে তোমার ছিল না। আমিও তোমাকে অনুসরণ করে গেছি। ওই বাড়িটাকে এতকাল বুক দিয়ে যিনি আগলে রেখেছিলেন, তিনি যদি আমাকে একটা অনুরোধ করেন তা হলে তা আমি পছন্দ না করলেও শুধু তার শান্তির জন্যে করতে চাই। কাউকে তৃপ্তি দিয়ে নিজেকে সংকুচিত করতে আমার আপত্তি নেই। তুমি স্বামীর ভূমিকা নিয়ে আমাকে নিষেধ করবে বলেই আমি তোমাকে জানাইনি।

বাঃ। চমৎকার। এখন থেকে আমরা যে যার মতো ভাবব?

আমি সে কথা একবারও বলিনি। ভাবতে পারো কিন্তু দোহাই খেয়োখেয়ি কোরো না। কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি দুরাতের জন্যে গয়া থেকে ঘুরে আসব।

তিনজন মৃত মানুষ আর একজন জীবিত মানুষের আত্মার শান্তির জন্যে।

ওহো। তাই তো। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। মাধবীলতা বলল।

তুমি তো কিছুই ভোলো না।

হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার মুখ থেকে শুনেছিলাম। তুমি যখন কলেজ হস্টেলে ছিলে তখন একদিন তোমার দাদু সরিৎশেখর মজুমদার আচমকা উপস্থিত হয়েছিলেন। তার মাথা কামানো ছিল এবং বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তোমার কি এখনও সে কথা মনে আছে? মাধবীলতা তাকাল।

হ্যাঁ, মনে আছে।

তা হলে তিনজন মৃত মানুষের শ্রাদ্ধের কথা বলছ কেন? তোমার দাদু। তো বেঁচে থাকতেই নিজের শ্রাদ্ধ গয়ায় গিয়ে করে এসেছিলেন, তাই না? তা হলে তার পুত্রবধূ হয়ে ছোটমার একই ইচ্ছে হলে তোমার কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। দুজন মৃত এবং একজন জীবিত মানুষ, যারা তোমার পরিবারের তাদের জন্যে আমি যেতেই পারি। মাধবীলতা হেসে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অনিমেষ বলল, হিসেবে ভুল হল। আমার মাকে বাদ দিচ্ছ কেন?

তোমার মায়ের কথা ছোটমা আমাকে বলেননি। আমি তো নিজে কাজটা করতে যাচ্ছি না। উনি যাঁদের কথা বলেছেন, শুধু তাদের কাজ করব। মাধবীলতা বলল, যাও, স্নান করে নাও।

শোনো, আমি কদিন এখানে থেকে যেতে চাই।

হঠাৎ?

এই আশ্রমে এসে আমার ভাল লাগছে, তাই।

ভাল তো আমারও লাগছে। রিটায়ার করার পর যে হাঁপিয়ে পড়া জীবনযাপন করছিলাম এখানে এসে মনে হচ্ছে মুক্তি পাচ্ছি। তুমি দেবেশবাবুর সঙ্গে কথা বলো না, ছোটমায়ের মতো আমরাও যদি এখানে থেকে যাই।

আমি কদিন থাকতে চেয়েছি। সারা জীবন নয়। তুমি যদি সারা জীবন থাকতে চাও তা হলে দেবেশ এলে কথা বলল।

তুমি কলকাতায় আর আমি এখানে। পারবে? মাধবীলতা তাকাল।

মানুষ পারে না এমন কোনও কাজ নেই। অনিমেষ বলল।

অনিমেষ। অনিমেষ। ডাকতে ডাকতে দেবেশ চলে এল সামনে, বলল, তোরা দুজন এখানে? তৈরি হয়ে নে। তিস্তাতোর্সায় তোদের টিকিট পেয়েছি। এই কাছেই জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেব। কিন্তু বেশি সময় নেই। আমি মোবাইলে তোদের কিছুতেই ধরতে পারিনি। এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে নে। দেবেশ যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল।

মাধবীলতা হাসল, দেবেশকে বললে না তো আরও কদিন এখানে থাকতে চাও। অনিমেষ কথা না বলে দ্রুত সামনে থেকে সরে গেলে মাধবীলতা মোবাইল বের করে অর্কর নাম্বার টিপল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুনতে পেল, আউট অফ রিচ।

.

৪০.

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কয়েকজন অল্পবয়সি ছেলেকে উত্তেজিত হয়ে কিছু বোঝাচ্ছে। শ্রোতাদের একজন ইশারায় অর্কর কথা বলতেই সুরেন মাইতি ঘুরে দাঁড়াল। একেবারে মুখোমুখি বলে অর্ক ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে গলির ভেতর ঢুকতে যাচ্ছিল কিন্তু সুরেন মাইতি শূন্যে হাত তুলেছে দেখে তাকে থামতে হল। সে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?

শ্রোতাদের কিছু বলে সুরেন মাইতি এগিয়ে এল, বাড়িতে ফিরছেন নিশ্চয়ই, চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।

অর্ক বুঝতে পারল তার সঙ্গে আলাদা কথা বলার জন্যেই সুরেন মাইতি দল ছেড়ে চলে এল। কয়েক পা হেঁটে সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবুকে কেমন লাগল?

বড়বাবু? অবাক হল অক।

দূর মশাই। থানার ওসিকে যে বড়বাবু বলা হয় তা জানেন না?

ও। আপনি তা হলে জেনে গেছেন ব্যাপারটা!

জেনে গেছি মানে? এই যে আপনি লকআপে না ঢুকে বাড়ি ফিরছেন তার জন্যে এই লোকটার সামান্য অবদান আছে। একজন মাওবাদীকে সাহায্য করার অপরাধে দশ বছর ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে পারত। যেহেতু আপনার বাবা মুখ্যমন্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, নকশাল হয়ে জেল খেটেও বন্দি মুক্তির সুযোগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কোনও রাজনীতি দলে যোগ দেননি, আপনাকে সেসব করতে দেখিনি বলে আমি বড়বাবুকে অনুরোধ করেছিলাম একটা সুযোগ আপনাকে দিতে। হাসিমুখে মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

অর্ক কোনও কথা বলল না। খানিকটা হাঁটার পর সুরেন মাইতি আবার কথা বলল, আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সে নন্দীগ্রামে গিয়ে আমাদের কজন কমরেডকে গুলি করে মেরেছে তার হিসেব রাখেন?

অর্ক হেসে ফেলল, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?

লোকটা যেদিন ঈশ্বরপুকুর থেকে উধাও হয়েছিল তার পরের দিন থেকেই। নন্দীগ্রামে মাওবাদীরা ঢুকেছিল সুন্দরবন দিয়ে। দেখুন, আপনারা কি ভাবেন আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করি? যারা জমি নিয়ে আন্দোলন করছিল তারা আধুনিক বন্দুক চালানো শিখে গেল? কোথায় পেল ওইসব অস্ত্র? যারা এই কাজ করেছে তাদের আড়াল করতে তৃণমূলের নেত্রী ঘোষণা করে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। উত্তেজিত হল সুরেন মাইতি।

যারা কৃষকদের হয়ে লড়াই করেছিল তারা কি ধরা পড়েছে?

কী করে ধরা পড়বে? তার আগেই তাদের সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। যাক গে, আপনি আমাকে বলুন, লোকটা এখন কোথায়?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না।

হু! শেষ প্রশ্ন, আপনি কি তৃণমূলে জয়েন করেছেন?

সুরেন মাইতির প্রশ্ন শুনে অর্ক একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি বলুন তো, তৃণমূলের রাজনীতি কোন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?

কাঁধ নাচাল সুরেন মাইতি, কেন? ওই মা-মাটি-মানুষকে টুপি পরানো।

অর্কর গলার স্বর শক্ত হল, সুরেনবাবু, আপনি কোনও মতবাদকে শ্রদ্ধা নাও করতে পারেন কিন্তু তাকে ব্যঙ্গ করার কোনও অধিকার আপনার নেই।

দূর মশাই। ব্যঙ্গ করার মতো কেউ কিছু করলে তাকে পুজো করব? কোনও মতবাদ নেই, আদর্শ নেই, শুধু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে পাবলিককে খেপিয়ে তুলছেন মহিলা, স্বপ্ন দেখছেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলে সবাইকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন? পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কখনও হয়েছে? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

পৃথিবীর ইতিহাসে কি এমন উদাহরণ আর একটা খুঁজে পাবেন যেখানে একজন সাধারণ মহিলা একা যে আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাতে ভয়ংকর শক্তিশালী বামফ্রন্ট সরকারের মতো আদর্শবাদী সরকার ভয়ে কাঁপছেন? একজন একদম একা, তাঁর পাশে যারা গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অধিকাংশের কোনও পরিচিতি নেই, নেত্রী যা বলছেন তাই তাদের কাছে বেদমন্ত্র, সেই একা মহিলাকে আপনারা যখন ভয় পাচ্ছেন তখন বুঝতেই হবে আপনারা টের পাচ্ছেন জনসমর্থন কার সঙ্গে আছে। অর্ক বেশ স্পষ্ট কথাগুলো বলল।

অর্থাৎ আপনি স্বীকার করলেন যে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।

আমি সেটা একবারও বলিনি।

আর কী বাকি রাখলেন বলতে? বিশ্বজিৎকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন যাতে বড়বাবুকে একটু চমকানো যায়। শুনে রাখুন বামফ্রন্ট তিন দশকের ওপর যেমন ক্ষমতায় আছে তেমনি আগামী তিন দশকও থাকবে। প্রায় হুংকার দিল সুরেন মাইতি, শুনুন অর্কবাবু, আপনার সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করতে চাইছি। ওই মাওবাদী লোকটি কোথায় আছে তা আমাদের জানিয়ে দিন। ওকে ধরে যদি জেরা করা যায় তা হলে নন্দীগ্রামের নেপথ্য কাহিনি আমরা মানুষকে জানাতে পারব। আমি সন্ধেবেলায় আবার আপনার কাছে আসব। চলি।

.

বাড়িতে ফিরে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল অর্ক। তার মনে হচ্ছিল সাঁড়াশির দুটো শক্ত হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। একটা পুলিশ অন্যটা সুরেন মাইতির দল। এরা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেই।

এতদিন যে জীবন সে যাপন করেছে তা যেন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। চাকরিতে জয়েন করার তারিখ চলে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। চাকরিটা চলে গেলে নতুন সমস্যা যোগ হবে। অর্ক অফিসে ফোন করল। তাদের ইনচার্জ ভদ্রলোক ফোন পেয়েই খেপে গেলেন, কী ভাবছেন আপনি? এটা কি আপনার মামার বাড়ি? যখন ইচ্ছে ছুটি নেবেন, যেদিন জয়েন করার কথা সেদিন হাওয়া হয়ে থাকবেন, আবার মর্জিমতো ফোন করবেন, এটা কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে বলে ভাবলেন কী করে?

আমি বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আচমকা এমন সমস্যায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে যোগাযোগ করতে পারিনি। অর্ক বলল।

কী সমস্যা? চুরিচামারি না খুন করেছেন? মানে?

না হলে পুলিশ এসে আপনার সম্পর্কে খোঁজ খবর করবে কেন?

অবাক হয়ে গেল অর্ক, পুলিশ এসেছিল আমার খোঁজে?

হ্যাঁ। আপনার চরিত্র কীরকম, মন দিয়ে কাজ করেন কিনা, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তা জিজ্ঞাসা করছিল। আমরা যতটুকু জানি তা বলেছি, যা জানি না তা বলিনি। খোঁজ করার কারণ হিসেবে বলেছে রুটিন চেক আপ।

এসব কেন হল বুঝতে পারছি না। অর্ক বলল।

আমরাও বুঝতে পারছি না। দেখুন, আপনি আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আছেন, কাজের ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে কোনও কমপ্লেন নেই, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু আপনার প্রচুর ছুটি পাওনা আছে তাই টানা এক মাস ছুটিতে আপনি থাকুন, কালকের মধ্যেই এই ছুটির জন্যে আবেদন করবেন, সেই ছুটির শেষে যদি জয়েন না করেন তখন, বুঝতেই পারছেন, ব্যবস্থা না নিয়ে কোনও উপায় থাকবে না। ফোন রেখে দিলেন ভদ্রলোক।

তৎক্ষণাৎ ছুটির জন্যে আবেদনপত্র লিখে ফেলল অর্ক। দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখের পোস্ট অফিস থেকে একটা খাম কিনে তাতে ঠিকানা লিখে সেটা পোস্ট বক্সে ফেলে দিল।

খুব খিদে পাচ্ছে এখন। অর্ক চারপাশে তাকাল। এই এলাকার রেস্টুরেন্টে সব খাবার পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো বড় একঘেয়ে। অর্কর ইচ্ছে হল ধর্মতলায় গিয়ে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটি খাওয়ার। বহুকাল এসব খাওয়া হয়নি। সে দেখল ডিপো থেকে একটা ট্রাম বেরুবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ট্রামগুলো ওখান থেকে মুখ বের করে এক মিনিট থমকে থাকে। এসপ্ল্যানেড লেখা দেখে সে দৌড়ে ট্রামে উঠতেই কন্ডাক্টার বললেন, ভাড়া ফেরত দিতে পারব না কিন্তু।

এরকম সংলাপ কখনও শোনেনি অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী বললেন?

কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল বেরুবার কথা আছে। সেখানে গাড়ি পৌঁছাবার আগেই যদি মিছিল বের হয় তা হলে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে জানি না। সে সময় অনেকে ভাড়ার টাকা ফেরত চায় বলে আগাম জানিয়ে দিলাম।

কীসের মিছিল? সিটে বসে থাকা একটি যুবক বলল, আপনি আজকের কাগজ নিশ্চয়ই দেখেননি। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল যাবে ধর্মতলা পর্যন্ত।

তৃণমূলের মিছিল? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

তা বলতে পারব না। বিদ্বজ্জনেরা ডাক দিয়েছেন। ওই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাধারণ মানুষকে মিছিলে যোগ দিতে বলেছেন। লাক ভাল থাকলে মিছিল বের হওয়ার আগেই কলেজ স্কোয়ার পেরিয়ে যেতে পারব। যুবকটি বলল।

ট্রাম চলছে। যেই কোনও স্টপে থামছে অমনি উঠে আসা যাত্রীদের একই কথা শোনাচ্ছেন কন্ডাক্টার। অর্ক লক্ষ করল এর ফলে কেউ আর টিকিট কাটছে না, যার গন্তব্য কলেজ স্ট্রিটের আগে সে-ও টিকিট না কেটে নেমে যাচ্ছে।

মহাত্মা গাঁধী রোডের মোড়ে ট্রাম দাঁড়িয়ে গেল। সামনের রাস্তায় অচল গাড়ির জটলা। ওপাশ থেকেও গাড়ি আসছে না। সেই যুবকটি হঠাৎ বলে উঠল, মার গাড়িয়েছে, বলে নেমে গেল টিকিট না কেটেই। শব্দ দুটোর অর্থ বোধগম্য হল না অর্কর। ঈশ্বরপুকুর লেনের রকবাজরা যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করত তা এখন বস্তির মেয়েরাও রপ্ত করে ফেলেছে। বাবার কাছে শুনেছে সে একসময় শালা শব্দটা বড়দের সামনে বললে প্রচণ্ড মার খেতে হত। কথাটা শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে, কিন্তু ওই যুবকটি যা বলে গেল তা সে কখনও শোনেনি।

ফুটপাত ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই প্রচুর মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে মাইকে একজন জানাচ্ছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রতিবাদ মিছিল পথে নামবে। আমরা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে চাই, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না, আমরা যারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ এই মিছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শ্রেণির যত শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এই মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন, যিনি এর আগে কখনও মিছিলে যোগ দেননি তিনিও বামফ্রন্ট সরকারের ঘৃণ্য আচরণের প্রতি ধিক্কার জানাতে রাস্তায় পা রাখছেন। আমি আপনাদের কাছে আবেদন করছি, অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণভাবে এই মিছিলে অংশগ্রহণ করুন।

ভিড় ঠেলে খানিকটা এগোতেই বিখ্যাত মানুষগুলোকে দেখতে পেল অর্ক। এঁরা দীর্ঘদিন ধরে ছবি আঁকছেন, অভিনয় করছেন, লেখালেখি করে মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। এঁদের কেউই কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচারে নামেননি। এই মানুষগুলো আজ নেমে এসেছেন প্রতিবাদে সামিল হতে। অর্ক লক্ষ করল এখানে কোনও দলের পতাকা নেই। এমনকী তৃণমূলেরও নেই। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এমন প্রতিবাদ মিছিল এর আগে কখনও হয়েছে কিনা তা প্রাচীনরা বলতে পারবেন কিন্তু অর্ক মনে করতে পারল না।

মিছিল শুরু হল। একটা লম্বা ফেস্টুনের পেছনে বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার, লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা, তারপরে সাধারণ মানুষ। অর্ক অবাক হয়ে সেই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে দেখল রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় যেসব মানুষ উৎসুক হয়ে মিছিল দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের অনেকেই নেমে এসে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন। ফলে মিছিলের আয়তন ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

কোনও স্লোগান নেই, কলেজ স্ট্রিট বোধহয় এতবড় নীরব ধিক্কার মিছিল আগে দেখেনি। হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মনে পড়ল রামজিকে। রামজির যাওয়ার কথা ছিল সুন্দরবনে। সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে তা ওকে বলা হয়নি। সুন্দরবন থেকে নৌকো করে নন্দীগ্রামের কাছাকাছি কোনও জায়গায় পৌঁছানো যায়?যদি যায় তাহলে রামজিকি পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হত? পুলিশের ধারণা সে ওই কাজটা করেছে, কিন্তু অর্ক নিশ্চিত জানে নন্দীগ্রামের যুদ্ধের সময় রামজি তার সঙ্গে ছিল। গুরুমায়ের আশ্রম থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে এসে তারা প্রথম শুনতে পেয়েছিল নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। খারাপ হওয়া গাড়িতে বসে আই পি এস ভদ্রলোকের স্ত্রী কথাটা বলেছিলেন। অতএব রামজি নন্দীগ্রামের সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নয়।

মিছিল বউবাজারের মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন গলাটা কানে এল, আরে! আপনি? কেমন আছেন?

মুখ ফিরিয়ে অবাক হল অর্ক। কুন্তী সেন। গুরুমায়ের আশ্রমে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে বলল, ভাল। আপনি–?

সকালে কাগজে খবরটা দেখে চলে এলাম। গাড়ি আনিনি। হাওড়ায় এসে সোজা এখানে। নন্দীগ্রামে কী কাণ্ড হল বলুন তো? হাঁটতে হাঁটতে পাশে চলে এলেন কুন্তী সেন, আমি ভাবতেই পারি না, কোনও কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকতে থাকতে এরকম বুর্জোয়াদের মতো কাজ করতে পারে।

অর্ক কিছু বলল না। গত কয়েকদিনের খবরের কাগজ, টিভির সঙ্গে তার কোনও সংশ্রব ছিল না। এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন তাও তার জানা নেই। কিন্তু যাই বলুন না কেন এই বিষয়ে তিনি তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।

কিছুটা হাঁটার পর অর্ক জিজ্ঞাসা করল, মিছিলের খবর জেনে আপনি সেই ব্যান্ডেল থেকে চলে এলেন?

সেই ব্যান্ডেল মানে? এখান থেকে গড়িয়াতে যেতে যে সময় লাগে তার থেকে কম সময় ব্যান্ডেলে যেতে লাগবে। এলাম কেননা, মনে হয়েছিল এই প্রতিবাদের মিছিলে আমারও অংশ নেওয়া উচিত। কুন্তী সেন বললেন।

কয়েকদিন আমি খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পাইনি। তাই–।

বাইরে বাইরে ঘুরছিলেন?

হ্যাঁ।

সেদিন গুরুমায়ের আশ্রমে পুলিশ এসেছিল, জানেন?

অনুমান করছি।

তাদের কাছে খবর ছিল বাইরে থেকে দুজন মানুষ নাকি ওখানে আশ্রয় নিয়েছে। গুরুমা তাদের অনুমতি দিলে তারা তল্লাশি চালায় কিন্তু কোনও বাইরের লোককে না পেয়ে চলে যায়।

ওরা কী করে খবর পেল?

তা বলতে পারব না। কিন্তু আপনাদের কেন চলে যেতে হল?

অর্ক একটু ভাবল, তারপর বলল, আমার সঙ্গে যে ছিল তার কাজকর্ম সম্পর্কে আমি স্পষ্ট কিছু জানি না। ছেলেটিকে ভাল লেগেছিল, বুঝেছিলাম সে পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চায়। আমার অনুমান গুরুমাও তাই বুঝেছিলেন। আশ্রমে যাওয়ার পরই বলেছিলেন নদীর ধারটা ঘুরে দেখে আসতে। সত্যি কথা হল, আমার সঙ্গীর জন্যেই পুলিশ আসার আগে তড়িঘড়ি চলে আসি।

আপনার সঙ্গী কি মাওবাদী?

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। তবে পুলিশ থেকে শুরু করে সিপিএম এবং তৃণমূলের পাড়ার নেতাদের তাই ধারণা। আমাকে প্রচণ্ড চাপে রেখেছে ওরা।

কুন্তী কিছুক্ষণ কথা না বলে হাঁটলেন। মিছিলে আরও মানুষ যোগ দিয়েছেন এর মধ্যে। কুন্তী বললেন, আমাকে বলা হয়েছিল আপনারা হাইওয়েতে অপেক্ষা করবেন। আমার কথা ছিল বোলপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে ওই রাতে থেকে যাওয়ার, কিন্তু তা না করে গাড়ি নিয়ে বর্ধমানের দিকে অনেকটা গিয়েও না দেখা পেয়ে বোলপুরে ফিরে গিয়েছিলাম।

ও। আমরা বোধহয় তার আগেই লিফ্ট পেয়ে গিয়েছিলাম।

সেই দুপুরের পর অর্কর মনে হল পশ্চিমবাংলার মানুষ আর বামফ্রন্টের সঙ্গে নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে। তাতে তার স্থির বিশ্বাস হল নন্দীগ্রামেই বামফ্রন্টের তেত্রিশ বছরের শরীর কবরে যাওয়ার জন্যে কফিন তৈরি করে ফেলল। কথাটা কুন্তীকে বলতেই কুন্তী হাসলেন, যত দিন এগোবে তত বামফ্রন্টের নেতারা উদ্ধত হবেন, তত মাথা গরম করে অসংলগ্ন কথা বলবেন। আমরা-ওরার বিভাজন তৈরি করবেন। বিরোধী মানুষের শরীর উধাও হয়ে যাবে পথের কাঁটা সরাবার কারণে। অথচ, বিশ্বাস করুন, সেই ছাত্রাবস্থা থেকে আমি কল্পনা করে এসেছি, কমিউনিজমই মানুষকে সুস্থ জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে, কমিউনিজমই সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর। বাবার কাছে শুনেছিলাম তারা যখন নকশাল আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন এদেশের কেউ ভাবতেই পারত না কমিউনিস্ট সরকার আসবে। পরে যখন এল তখন মানুষ স্বপ্ন দেখতে চাইল, কিন্তু কোথায় গেল সব? ক্ষমতা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, এখন সেই আমিই চাইছি, পরিবর্তন হোক।

মিছিলের শেষে নিউ মার্কেটের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে মাটন চাপ আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে ওরা কথা বলছিল। অর্ক হাসল, পরিবর্তন তো চাই, কিন্তু পরিবর্তিত সরকার কোন দলের হবে?

দেখবেন, সেটা মানুষই ঠিক করে দেবে।

ভোটবাক্সে?

তা ছাড়া তো মানুষের আর কোনও অস্ত্র নেই।

কিন্তু সেটার জন্যে উপযুক্ত দল চাই। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে

মানুষ উপযুক্ত দল বলে এই মুহূর্তে ভাবতে পারে না। তার চেয়ে এই অল্প সময়ে তৃণমূল নেত্রী মানুষের সপক্ষে কথা বলে অনেকটা এগিয়ে আছে।

আমি কোনও মন্তব্য করব না। কুন্তী বললেন, মানুষই ঠিক করবে।

ধরুন, আপনি ঠিক বলছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ তৃণমূল নেত্রীর ওপর আস্থা রেখে বামফ্রন্টকে সরিয়ে দিল। একটি মানুষ তার বিশ্বাস ভাবনা নিয়ে যে দল তৈরি করেছেন সেই দল ক্ষমতায় এলে কি আপনি নিশ্চিত যে পরিবর্তন চাইছেন তা সম্ভব হবে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ভবিষ্যৎ এর উত্তর দেবে। কুন্তী বলামাত্র খাবার এসে গেল।

অর্ক হাসল, কিছু বলল না। কুন্তী খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে বললেন, এত মশলা দেওয়া খাবার, হজম করতে পারব তো?

অর্ক বলল, আগামীকাল উত্তরটা দেবে।

৪১-৪৫. কুন্তীকে হাওড়া স্টেশনে

কুন্তীকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিল অর্ক। ধর্মতলা থেকে ট্যাক্সি নিয়েছিল কুন্তী, আসার পরে ভাড়া দিয়েছিল নিজেই। তারপর বলেছিল, আজ সকালে ভাবতেই পারিনি যে আপনি আমাকে এতটা সময় দেবেন। অর্ক হেসে ফেলল, বিখ্যাত লেখকরা বোধহয় এভাবেই উপন্যাসে লিখে থাকেন যা পাঠক আগে আন্দাজ করতে পারে না।

আমার কথা বলতে পারি, যে ভয়ংকর চাপে আমি স্যান্ডউইচ হয়ে ছিলাম তা থেকে এই সময়টুকু পেরিয়ে এসেছিলাম আপনার দেখা পেয়ে। আপনি চলে গেলে আবার–! কথা শেষ করল না সে।

কুন্তী বলল, একদিন আসব আপনার মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে।

অর্ক মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। কুন্তী চলে গেল ব্যান্ডেলে।

এতক্ষণ একসঙ্গে কাটানোয় কুন্তী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। অর্ক। কুন্তী ব্যান্ডেলে থাকে স্কুলের চাকরির কারণে। শনিবার বিকেলে কলকাতার বাড়িতে এসে রবিবার বিকেলে ফিরে যায়। কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে এখনও ওঁর মা বাস করেন। ব্যান্ডেলে দুজন শিক্ষিকার সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে কুন্তী থাকেন। রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার সময় এইসব তথ্য জানার আগে অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, এই যে সকালের কাগজে প্রতিবাদের মিছিল হবে খবর পেয়ে চলে এলেন, তার জন্য কোনও সমস্যা হল না?

কীরকম সমস্যা?

সংসারে যা হয়ে থাকে।

ও। আমার হয়নি কারণ আমি সেই অর্থে সংসারী মানুষ নই।

অর্ক ব্যাপারটা অনুমান করার চেষ্টা করছে দেখে কুন্তী হেসে বলল, বুঝতে পারছেন না? আমি সিঙ্গল উয়োম্যান। এক মহিলা। কোনও সন্তান নেই। ফলে পিছুটান নেই। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া করে ব্যান্ডেলে থাকি আর সেই বাড়ির যাবতীয় হ্যাঁপা ওরাই সামলে নেয়। আমি ঝাড়া হাত-পা। আপনি এই ব্যাপারটাকে সুবিধেবাদ বলতে পারেন।

আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায়নি অর্ক। একজন সুশ্রী শিক্ষিত মহিলা মধ্য তিরিশ পেরিয়ে এই জীবনযাপন করলে তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছুটা কৌতূহল তৈরি হয় যা কোনও পুরুষের ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু কোনও মানুষ অতীতে কী কাজ করেছিল বা করেনি তার নিরিখে বর্তমানকে বিচার করা কি অত্যন্ত জরুরি? এক জীবনে মানুষকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান যতবার বদলাতে হয় অন্য কোনও প্রাণীকে তা করতে হয় না। গিরগিটিরও রং বদলাবার ক্ষমতা বেশ সীমিত।

ট্রামে উঠল অর্ক। সামনের আসনে বসা দুজন যাত্রী আজকের মিছিল নিয়ে কথা বলছে। একজন টিভিতে মিছিল দেখেছে, তার মুখ থেকে অন্যজন শুনছে।

শ্রোতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলছ? অ্যান্টি বামফ্রন্ট মিছিল? খুব বড়?

যে টিভিতে দেখেছে সে বলল, ভুল হল। বলতে পারো সিপিএম-এর সরকারের আচরণের প্রতিবাদে ওই মিছিল হয়েছে, টিভি দেখলাম প্রায় সব স্তরের মানুষ রাস্তায় হাঁটছেন।

তৃণমূল, কংগ্রেসের নেতারা সামনে ছিলেন?

না। কোনও রাজনৈতিক নেতাকে মিছিলে দেখিনি।

মানে? এরকম হয় নাকি?

আগে হতে দেখিনি, আজ দেখলাম। চিত্রশিল্পী, লেখক, অভিনেতা অভিনেত্রী, অধ্যাপক থেকে সাধারণ মানুষ, যাঁদের নাম কখনওই কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখিনি, তারা মিছিলে হেঁটেছেন।

ভাবতেই পারছি না। কে কে ছিলেন?

আমি টিভিতে অপর্ণা সেন, বিভাস চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখার্জি, শুভাপ্রসন্নকে দেখেছি। ধরে নাও, আমরা যাঁদের চিনি তাদের অধিকাংশই ছিলেন।

শ্রোতা হাসল, বাপস, এ তো বৈপ্লবিক ব্যাপার। বামফ্রন্ট এই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাবে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্কর মনে হল, আজকের দিনটা বামফ্রন্টের কাছে কালাদিবস হয়ে যাবে। নন্দীগ্রামের কৃষকরা যা শুরু করেছিলেন তা হয়তো গতি হারাত, কিন্তু আজকের মিছিলের পর তা বেগবান হবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলবেন, ভূমিহীন মানুষ, দরিদ্র কৃষক, শ্রমজীবীরা যখন রুখে দাঁড়ান তখন পরিবর্তনের সূচনা হয়। কিন্তু এত তত্ত্ব যখন তৈরি হয়েছিল তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যারা সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত এবং সুবিধেবাদী, তাদের ঘুম ভেঙে গেলে যদি একত্রিত হতে পারেন তা হলে সেই শক্তিই শেষ কথা বলবে। আজ তারই সূচনা হয়ে গেল।

.

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠল। মোড়ের মুখেই আট-নয়জনের একটা জটলায় যে যার মতো কথা বলছিল, অর্ককে দেখে সবাই চুপ করে গেল। ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আর একটু এগোতেই গলির রকে বসা কয়েকজন তার দিকে তাকিয়েই অন্য পাশে মুখ ঘোরাল। এবার দাঁড়াল অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার ভাই? কিছু হয়েছে নাকি?

একজন বলল, বাড়িতে যান, দেখতেই পাবেন। কিন্তু বাড়ি অবধি যেতে হল না। বিশ্বজিৎ চারজন সঙ্গী নিয়ে উলটো দিক থেকে বেশ ব্যস্ত হয়ে আসছিল, অর্ককে দেখে দাঁড়িয়ে গেল, আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

কেন? আমার তো ব্যক্তিগত কাজ থাকতেও পারে।

তা থাকুক। চলুন। বিশ্বজিৎ ঘুরে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার বলো তো? অবাক হচ্ছিল অর্ক।

ঘণ্টা দুয়েক আগে এই বস্তিতে একটা হামলা হয়েছিল।

সে কী? কার ওপর কারা হামলা করল?

যারা করেছিল তারা পালিয়ে যেতে পেরেছে। ওরা ভাঙচুর করেছে, নষ্ট করেছে জিনিসপত্র। কিন্তু আগুন ধরাতে পারেনি, কারণ বস্তির মানুষের চিৎকারে ওরা ভয় পেয়েছিল, আমরাও ছুটে এসেছিলাম। বিশ্বজিৎ বলল।

পথটুকু হেঁটে বাড়ির সামনে এসে অর্ক দাঁড়িয়ে গেল। তাদের উঠোনে ঢোকার দরজার সামনে মানুষ জড়ো হয়ে কথা বলছে, তাদের দেখে সবাই চুপ করে যেতে অর্ক পা বাড়াল। দরজা খোলা, সেখানে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক। দুটো ঘর, রান্নাঘরের দরজা ভাঙচুর করা হয়েছে। খাট টেবিল থেকে যাবতীয় জিনিসপত্র উঠোনে এনে আছড়ানো হয়েছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল যেন, বুকে চাপ অনুভব করল অর্ক।

বিশ্বজিৎ বলল, হয়তো কেরাসিন সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছিল তাই পালাবার আগে আগুন ধরাতে পারেনি, ধরালে কী হত ভাবতেই পারছি না। আপনাদের বাড়ি তো বটেই পুরো বস্তি ছাই হয়ে যেত।

কারা করল এসব? কোনওমতে প্রশ্নটা করল অর্ক।

কেউ তো নিজের পরিচয় দিয়ে এসব করে না। কিন্তু আমরা এতটা মূর্খ নই যে বুঝতে পারব না। দেখুন, খবর দেওয়া হয়েছিল ঘটনার পরপরই। অথচ তাদের দেখা এখনও পাওয়া গেল না। বোঝাই যাচ্ছে যারা কাজটা করেছে তাদের আড়াল করতেই পুলিশ টালবাহানা করছে।

ভেতরে ঢুকল অর্ক। সঙ্গে বিশ্বজিৎ। তার সঙ্গীরা দরজায় দাঁড়িয়ে বস্তির লোকদের ভেতরে ঢোকা আটকাচ্ছিল। এতক্ষণ তারা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল,

অর্ককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ভেতরটা দেখার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল।

বিশ্বজিৎ বলল, আমরা দেখছি। যেসব ফার্নিচার ভাঙেনি সেগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ছেলেরা। যেগুলো ভেঙে গেছে সেগুলো ফেলে দিতেই হবে। এমনিতেই ওগুলো পুরোনো হয়ে গেছে।

অর্ক নিজের মনে বলল, মা-বাবার কালই এখানে আসার কথা। এসে এসব দেখলে ওঁরা যে কী করবেন!

ওঁরা কালই আসছেন?

সেইরকম কথা আছে।

মাথা নাড়ল বিশ্বজিৎ, দেখুন, ওঁদের কাছ থেকে তো আপনি এসব লুকোতে পারবেন না। আমরা এখনই কিছুটা ভদ্রস্থ করে দিতে পারি কিন্তু

পুলিশ এসে দেখার আগে তো এসবে হাত দিতে পারি না।

অর্ক এগিয়ে গিয়ে একটা ছবির ফ্রেম টেনে তুলল। কাঁচ ভেঙে গেছে। ছবিটা রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বজিৎ বলল, অর্কা, হাত দেবেন না। যেমন আছে তেমন থাকুক। পুলিশ আগে আসুক–।

এই সময় বাইরের জনতা চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ, পুলিশ এসেছে।

বড়বাবু দেখা দিলেন, সঙ্গে একজন সেপাই। ভেতরে পা দিয়ে চারদিক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। ভুলটা আপনারই। মাওবাদীদের মধ্যে অনেক দল আছে। এক দল অন্য দলকে সহ্য করতে পারে না। যাকে আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তার অ্যান্টি দল বোধহয় জানত না লোকটা এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। তাকে না পেয়ে ভাঙচুর করে গিয়েছে।

অর্ক শান্ত গলায় বলল, আপনার কাছে এত তথ্য যখন আছে তখন যারা ভাঙচুর করেছে সেই দলটাকে ধরুন।

নিশ্চয়ই ধরব। আগে আপনি কানটাকে দিন, আমি মাথাটাকে টেনে নিয়ে আসি। হাসলেন বড়বাবু, আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করবেন না অর্কবাবু।

আমি সেটা কখন করলাম? অর্ক বিরক্ত হচ্ছিল।

এইরকম জমজমাট এলাকায় বাইরে থেকে কয়েকজন ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র ভাঙল আর সেটা কেউ টের পেল না, যে শিশু মায়ের পেটে রয়েছে সেও বিশ্বাস করবে না। যেহেতু আমি আপনাকে চারদিন সময় দিয়েছি ওই মাওবাদীটার হদিশ জানাতে তাই নিজেকে ধোওয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করতে এই ঘটনা সাজালেন। ঠিক আছে। আমি রেকর্ড করে রাখছি আপনার বাড়িতে কে বা কারা হামলা করেছে, বাকিটা আপনার হাতে। বড়বাবু রবীন্দ্রনাথের ছবিটাকে দেখলেন। বললেন, ইস।

আমার হাতে মানে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আজকের দিনটা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আরও তিনটে দিন আপনি সময় পাচ্ছেন। ওই লোকটা কোথায় আছে আমাকে জানিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বড়বাবু ঘুরে দাঁড়াতেই বিশ্বজিৎ কথা বলল। এতক্ষণ সে চুপচাপ শুনছিল। এবার এক পা এগোল, আচ্ছা, এখানে আসতে আপনার এত দেরি হল কেন?

কৈফিয়ত চাইছেন? অমায়িক হাসলেন বড়বাবু।

আমি তো পুলিশ কমিশনার নই যে কৈফিয়ত চাইতে পারি। অবশ্য তিনিও আজকাল ওইসব চাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ জানে কোথায় কাদের কাছে আপনাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। বিশ্বজিৎ বলল।

একজন পুলিশ অফিসারকে অপমান করার জন্যে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে পারি। আপনি কথাটা উইথড্র করুন। মুখের চেহারা পালটে গেল অফিসারের। চোখ ছোট হয়ে গেল তার।

আমাকে অ্যারেস্ট করতে হলে আর একজনকেও করতে হবে।

অ্যাঁ? মানে?

আচমকা আবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলেন বড়বাবু, বাঃ, আপনি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। ওহো, অর্কবাবু, আপনার এখানে যখন এসব নাটক হচ্ছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি মিছিলে গিয়েছিলাম।

মিছিলে? আজ মাওবাদীদের কোনও মিছিল হয়েছে বলে শুনিনি তো!

আজ সাধারণ মানুষ এবং শিল্পী সাহিত্যিকরা নন্দীগ্রামের ইস্যুতে বিশাল মিছিল করেছেন। অর্ক বলল।

ওরে বাব্বা। আপনি সেখানেও ছিলেন! চমৎকার। বড়বাবু তার সঙ্গে আসা সেপাইকে বললেন, এখানে যেসব ভাঙা জিনিস পড়ে আছে তার একটা লিস্ট তৈরি করে নাও। আমি যাচ্ছি।

বিশ্বজিৎ বলল, এক মিনিট স্যার। আপনি কি এই ঘটনা নিয়ে সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলেছেন?

আবার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন?

একদমই নয়। আপনি আমাদের থানার দায়িত্বে আছেন। আর সুরেন মাইতি সরকারি দলের আঞ্চলিক নেতা যাঁর কর্তব্য এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকা খুব জরুরি। বিশ্বজিৎ হাসল।

সেটা আমি বুঝে নেব, হ্যাঁ? বড়বাবু এগোলেন। ঠিক তখন একেবারে মুখ বন্ধ করে জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি গলা চেঁচিয়ে উঠল, সুরেনদা থানায় গিয়েছে দুঘণ্টা হল। এখনও ফেরেনি।

বিশ্বজিৎ বলল, এটা বললেই পারতেন। এই হামলার ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যে সুরেন মাইতিকে থানায় ডেকেছেন।

বড়বাবু আর দাঁড়ালেন না। ভিড় দুভাগ হয়ে তাকে যাওয়ার পথ করে দিল। সেই সময় ভিড়ে মিশে থাকা কেউ চেঁচিয়ে উঠল, বাপি বাড়ি যা।

খানিকটা দূরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন বড়বাবু, তার হাত কোমরের অস্ত্রের কাছে পৌঁছে গেল, কে? কে বলল কথাটা? আয়, এগিয়ে আয় শালা। আমাকে পাক দেওয়া হচ্ছে? এতটা সাহস? কে বলল?

ভিড় এবার নিশ্ৰুপ হয়ে গেল।

বড়বাবু চিৎকার করলেন, বিশ্বজিৎ, এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে থানায় এসে ক্ষমা চাইতে বলুন। নইলে ওকে বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। সুরেনবাবুকে বললেই ওকে পেয়ে যাব। তখন কিন্তু–! শেষ করলেন না কথা, বড়বাবু গলি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু গোলমালটা শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ শোনা গেল অনেকগুলো গলা একসঙ্গে চিৎকার করছে, বাপি বাড়ি যা। তারপর কথাটা বদলে গেল। ধ্বনি উঠল, সুরেন তুই বাড়ি যা।

বিশ্বজিৎ তখন তার ছেলেদের নির্দেশ দিচ্ছিল ভাঙা জিনিসগুলো সরিয়ে ভালগুলো ভেতরে সাজিয়ে রাখতে। নতুন আওয়াজ শুনে সে অর্ককে বলল, আমি এদের কাউকে এই স্লোগানটা বলতে শেখাইনি।

অর্ক কিছু বলল না। সে দেখল জনতা তাদের বাড়ির সামনে থেকে সরে বাইরের চায়ের দোকানের কাছে চলে গেল। এই সময় একজন ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে উত্তেজিত গলায় বলল, বিশুদা, তাড়াতাড়ি এসো, প্রতুলদারা চলে এসেছেন। তোমার খোঁজ করছেন।

বিশ্বজিৎ তৎক্ষণাৎ অর্ককে চলে যাওয়ার ইশারা করে দৌড়াল। ছেলেরা উঠোন মোটামুটি পরিষ্কার করে দিতেই মাইকের আওয়াজ ভেসে এল। সেটা শুনে দাদা আসছি বলে বিশ্বজিতের ছেলেরা বেরিয়ে গেল। কোনওমতে দরজাগুলো বন্ধ করে অর্ক দেখল গলি কঁকা হয়ে গিয়েছে। বস্তির প্রায় সবাই গিয়ে ভিড় করেছে চায়ের দোকানের সামনে যেখানে গলিটা বেশ চওড়া, সেখানে পৌঁছে অর্ক অবাক হয়ে দেখল মানুষের জমায়েত অনেক। বড় হয়ে গেছে এই সন্ধে পার হওয়া সময়ে। এরই মধ্যে রকের ওপর বেঞ্চি তুলে বক্তৃতা শুরু হয়ে গেল। মাইকে সকালে আলাপ হওয়া প্রতুল রায়ের গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছিল। তিনি বারংবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, আপনারা একটুও উত্তেজিত হবেন না। ওরা চাইছে ওদের ফাঁদে পা দিয়ে এমন কাজ করুন যা থেকে ওরা ফায়দা তুলতে পারে। প্রিয় বন্ধুগণ, আজ আপনাদের এলাকায় ওরা যে কাণ্ড করেছে তার নিন্দা যে ভাষায় করতে হয় তা আমি উচ্চারণ করতে পারব না। তেত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকে ওরা এতটাই উদ্ধত হয়ে গিয়েছে যে এখন দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছে না। ক্ষমতার নেশা ওদের অন্ধ করে রেখেছে। পুলিশকে করে রেখেছে ক্রীতদাস। যে পুলিশ অবাধ্য হবে তাকে সুন্দরবন অথবা পুরুলিয়ায় বদলি করে দিতে ওদের দুদিন সময় লাগে না। পুলিশ সেটা জানে বলে ওদের পদলেহন করে যাচ্ছে। কিন্তু বন্ধুগণ, আমি আপনাদের বলছি, সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন মা-মাটি মানুষের সরকার এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সভ্য ভদ্র মানুষ। সরকারে এলে আমরা দলতন্ত্রে না গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করব। কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না। কিন্তু জনতার টাকায় মাইনে নিয়ে যেসব পুলিশ অফিসার জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন তাদের তালিকা আমরা তৈরি করে রাখছি। আপনাদের আর একবার বলছি, প্ররোচনায় উত্তেজিত হবেন না। বন্দেমাতরম।

সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার করল, সুরেন মাইতি বাড়ি যা।

ক্রমশ ভিড়টা এগিয়ে গেল সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে। বাড়ির সব জানলা দরজা বন্ধ। সেই বাড়ির সামনে তেত্রিশ বছরে এই প্রথম জনতার সমস্ত ক্রোধ চিৎকার হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসতেই জনতা সেদিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ করে তাকাল।

তারপরেই মুখগুলো থেকে শব্দ ছিটকে উঠল, পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি। তারপরেই যোগ হল, সুরেন মাইতি পুলিশের গাড়িতে।

কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। জনতা সেদিকে এগোতেই গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।

অট্টহাসি হাসল জনতা।

দাদা, আপনার মোবাইল বাজছে। পাশের লোকটা অর্ককে সচেতন করতেই সে পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করল। মায়ের ফোন।

কানে চেপে গলা তুলে জনতার চিৎকারকে উপেক্ষা করে অর্ক বলল, হ্যাঁ, মা, বলল।

অস্পষ্ট হলেও অর্ক শুনতে পেল, আজ ট্রেনে উঠছি।

যন্ত্রটাকে বন্ধ করে ঠোঁট কামড়াল অর্ক। ঠিক তখনই বিশ্বজিৎ পাশে এসে বলল, দাদা, আজ রাত্রে বাড়িতে থাকবেন না।

.

৪২.

ঈশ্বরপুকুর লেনের ছবিটা আচমকা পালটে গেল। অনেকেই মনে করতে পারছিল না শেষ কবে সুরেন মাইতিদের পার্টি অফিস বন্ধ থেকেছে। সুরেনের শিষ্যরা তখন উধাও, গলির ভেতর যারা আমোদ করছে তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, তৃণমূল বা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক নয়।

অর্ক ঘরে ফিরে এল। তাদের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। প্রৌঢ়া। মুখে বেশ উদ্বেগের ছাপ। একজন জিজ্ঞাসা করল, সব ভেঙে দিয়ে গেছে, না?

প্রায় সব। অর্ক দরজার তালা খুলছিল, ভাঙা তালাটাকেই ঝুলিয়ে বেরিয়েছিল সে।

এ পাড়ার ছেলে নয় ওরা। দ্বিতীয়জন বলল।

আপনারা ওদের দেখেছেন? দরজা খুলে ঘুরে দাঁড়াল অর্ক।

যখন পালাল, ওই উলটো দিক দিয়ে, তখন দেখেছিলাম। ঢোকার সময় দেখিনি। নিঃশব্দে ঢুকেছিল। একজনকে মাঝে মাঝে সুরেন মাইতির কাছে আসতে দেখেছি। কিন্তু এসব বলে ফেললাম বলে পরে সাক্ষী মেনো না। এই ভাড়ায় ঘর তো আর কোথাও পাব না। সুরেন মাইতি শেষ করে দেবে আমাদের।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল অর্ক। বাইরের তালাটাই খারাপ করেছে। ওরা, কড়া ভাঙেনি। ওখানে একটা নতুন তালা ঝোলাতে হবে। উঠোনের এক কোণে ভাঙা আসবাবগুলোর তূপ দেখল সে। এই রাত্রে বাইরে ফেলতে ইচ্ছে করল না। দুটো ঘরে ঢুকে যেটুকু পারল সাজাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু উঠোনে পা দিয়েই মা সব বুঝতে পারবে। কেমন এমন হল তার উত্তর বানিয়ে দেওয়া চলবে না। আশেপাশের মানুষ যেচে সত্যি কথা শোনাবে। আর তখনই রামজির প্রসঙ্গ চলে আসবে। রামজিকে এখানে থাকতে দেওয়া নিয়ে মা প্রশ্ন তুলেছিল। আগামীকাল মায়ের সঙ্গে সে ঝগড়া করবে, না তার সব অভিযোগ মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে?

অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা এখন ট্রেনে। কাল সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে ওরা। মাথা নাড়ল অর্ক। না, ঝগড়া করে কোনও লাভ নেই। মা যত কটু কথা বলুক মেনে নেওয়াই উচিত। একটা কথা তো ঠিক, সে যদি এখানে রামজিকে আশ্রয় না দিত তা হলে আজকের ঘটনাটা ঘটত না।

কিন্তু হঠাৎ আজকেই কেন ঘটনা ঘটল? যদি ধরে নেওয়া যায়, সুরেন মাইতির লোক ভাঙচুর করেছে তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করল? সে তো বামফ্রন্ট বা সুরেন বিরোধী কোনও কথা আজ দুপুর পর্যন্ত কাউকে বলেনি। থানাতেও সে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় তাকে ওরা বামফ্রন্ট বিরোধী বলে ভেবেছে তা হলে বাড়িতে এসব না করে তাকেই নির্যাতন করল না কেন? আর করার জন্যে এই বিকেলটাকেই বেছে নিল। কেন?

মাথা কাজ করছিল না। সন্ধে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু অর্কর ইচ্ছে হল এক কাপ চা খেতে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মায়ের প্রিয় রান্নাঘরেও তাণ্ডব চলেছে। চা-চিনির প্লাস্টিকের কৌটোগুলো মুখ খুলে মাটিতে পড়ে আছে। অর্ক মাথা নাড়ল। এই ঘরটাকে অন্তত ঠিকঠাক করতে হবে মা আসার আগে।

দরজায় নতুন তালা ঝুলিয়ে গলির চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়াল সে। বস্তির বাইরে বেরিয়ে দেখল দোকানটা এখন বন্ধ। অনেক রাত পর্যন্ত যে দোকান খোলা থাকে তা কী কারণে বন্ধ রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

হঠাৎ অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে ভেসে এল, বোঝা গেল স্লোগান দিতে দিতে ট্রামডিপোর দিক থেকে মানুষগুলো এগিয়ে আসছে। মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের, বেশ বড়সড় একটা মিছিল বামফ্রন্টের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেল। মিছিলের পুরোভাগে হাতজোড় করে হেঁটে আসছেন সুরেন মাইতি। বিশ্বজিত্রা এখন ধারে কাছে নেই। যারা এতক্ষণ হইচই করছিল তারা একেবারে চুপ। স্লোগান উঠল, সর্বহারার বন্ধু কে? সিপিএম, আবার কে? স্বার্থলোভী উঠাইগিরির দল, দূর হঠো, দূর হঠো। মিছিল এগিয়ে গিয়ে থামল সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে।

মিছিলের সঙ্গে হেঁটে আসা মানুষদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অর্কর কাছে। এঁকে মাঝেমধ্যেই অনিমেষের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছে অর্ক। এককালে সরকারি বাসের ডিপোয় কাজ করতেন। অবসর নেওয়ার পর খবরের কাগজ পড়ে আর এর ওর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেন। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কবে আসবেন?

আগামীকাল।

শুনলাম তোমাদের বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এসে কী দেখবেন ওরা? কারা করেছে তা জানো?

না।

যত কম জানা যায় তত ভাল। তুমি সে সময় কোথায় ছিলে?

সত্যি কথা বলল অর্ক, মিছিলে।

অ্যাঁ? তুমি রাজনীতি করো নাকি?

না, ওটা অরাজনৈতিক মিছিল ছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে অরাজনৈতিক মানুষেরা ধিক্কার মিছিল করেছেন আজ। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন, সোনার পাথরবাটি হয় নাকি?

মানে?

মিছিল হবে, তার ওপর ধিক্কার মিছিল বলে কথা, অথচ তাতে রাজনীতি থাকবে না, শিশুভোলানো কথা বলছ বাবা। তা তোমাকে ওই মিছিলে

এখানকার কেউ নিশ্চয়ই দেখেছিল। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

এ কথা কেন বলছেন?

দেখো, রাগ প্রকাশ করার জন্যে একটা উপলক্ষ তো চাই। ফিসফিসানি শুনছিলাম, তোমার বাড়িতে একটা মাওবাদী লুকিয়ে আছে। তোমাকে মিছিলে দেখে ওদের মনে হতেই পারে বাড়ির ভেতরটা খুঁজে দেখা দরকার। মানুষ না পেয়ে অন্যভাবে মনের ঝাল মিটিয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

অর্ক বলল, আপনি যাদের কথা বলছেন তারা তো আপনার সঙ্গে এইমাত্র হেঁটে আসতে পারে।

হয়তো পারে।

আপনিও তাদের সঙ্গে হাঁটলেন!

কোনও অন্যায় করিনি বাবা। একটু হাঁটাহাঁটি হল আবার সময়ও কাটল। আজ ওদের সঙ্গে আমি ঝোলে আছি, কাল অন্য কেউ অম্বল নিয়ে এলে তাতেও থাকব। বাঁচতে হলে জলের মতো হতে হবে। যে পাত্রে যেমন। সাবধানে থেকো বাবা। এই যে এসব কথা যখন তোমার বাবাকে বলি তখন তিনি চুপচাপ শুনে যান। হ্যাঁ না কিছুই বলেন না। ওটাও বাঁচার একটা ভাল পদ্ধতি। বৃদ্ধ চলে গেলেন সুরেন মাইতির বক্তৃতা শুনতে।

অর্কর মনে হল বৃদ্ধের কথাটাই ঠিক। নিশ্চয়ই তাকে মিছিলে দেখে কেউ মোবাইলে সুরেন মাইতিকে জানিয়েছিল। সুরেন যা নির্দেশ দেওয়ার দিয়ে সোজা থানায় গিয়ে বড়বাবুর কাছে বসে ছিল।

এটুকু ভাবতেই অর্কর মনে হল বিশ্বজিৎ তাকে ভুল সতর্ক করেনি। আজ রাত্রে তার ওপর আবার আক্রমণ হতে পারে। যেভাবে বিশ্বজিৎত্রা এলাকা দখল করে সুরেন মাইতিকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল তাতে মনে হয়েছিল এখান থেকে ওরা একেবারেই উৎখাত হয়ে গেল। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যেই সুরেন মাইতি বেশ বড় দল নিয়ে ফিরে এসে আবার জাঁকিয়ে বসল। বিপক্ষের কোনও সংগঠন নেই জানা থাকায় সুরেন মাইতি একটুও দেরি করেনি। এই অবস্থায় জেনেশুনে রাত্রে বাড়িতে একা থাকা খুবই বোকামি হবে।

দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে একটা কাপড়ের কাধ ঝোলানো ব্যাগে দু-তিনটে জামা একটা প্যান্ট আর প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে এটিএম কার্ডটা নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে উলটোদিকের পথটা ধরল। এই পথটা বস্তির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেলগাছিয়া ব্রিজের কাছে গিয়েছে, কপাল খুব খারাপ না হলে কেউ চট করে তাকে দেখতে পাবে না।

ডিপো থেকে বেরিয়ে আসা ট্রামে উঠে বসল অর্ক। খালি ট্রাম। বসামাত্র খেয়াল হল, কোথায় যাবে ঠিক করা হয়নি, কোথায় গিয়ে রাতটা থাকা যায়? এই মুহূর্তে পরিচিত কোনও মুখ মনে পড়ল না। কোথায় যাওয়া যায়? শিয়ালদায় বেশ কিছু অল্প দামের হোটেল আছে, তার একটা নিয়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাম থেকে নামল অর্ক। এখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। শিয়ালদার হোটেলের পাড়ায় হেঁটে এল সে। প্রথম যে হোটেল চোখে পড়ল তাতেই ঢুকে পড়ল। ঘর পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই টেবিলের উলটোদিকে বসা লোকটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে হাত বাড়াল।

কী চাইছেন?

আপনার পরিচয়পত্র। ভোটার কার্ড আছে?

না।

তা হলে যা দিয়ে বোঝা যাবে আপনি কে তাই দিন।

আমি তো সঙ্গে কিছু আনিনি।

তা হলে ঘর দেওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু কেন? আমি শুধু আজকের রাতটা থাকব।

আর সঙ্গে মালপত্র নেই। তাই তো? দেখুন, থানা থেকে কড়া অর্ডার এসেছে। উইদাউট আইডেন্টিটি কাউকে ঘর দেওয়া যাবে না। যান। ঝামেলায় পড়তে চাই না। লোকটা বিরক্ত গলায় বলল।

মহাত্মা গাঁধী রোডে দাঁড়িয়ে কী করবে যখন মাথায় আসছিল না, ঠিক তখন ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক, হাওড়া স্টেশন যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিটা মাথায় এল। সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে যে-কোনও একটা বেঞ্চিতে বসে সে দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে।

হাওড়া স্টেশন পৌঁছে ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই সে দেখল একটা যাত্রীকে খুব শাসাচ্ছেন স্টেশনের টিকিট চেকার। লোকটি ভেতরে ঢোকার জন্যে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনেছিল কিন্তু চেকার বলছেন প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে রাত পর্যন্ত সেই অধিকারে ভেতরে থাকা যায় না। তা ছাড়া চেকারের ধারণা ওই প্ল্যাটফর্ম টিকিট সকালে কাটার পর অনেকবার হাতবদল হয়েছে। লোকটি স্বীকার করল সে ঘণ্টাখানেক আগে কম দামে টিকিটটি কিনেছে।

অর্ক সরে এসে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। এখন টিকিট কিনে ভোর পর্যন্ত স্টেশনে থাকা যাবে কি না তা ওর জানা নেই। ঝামেলায় না পড়ার জন্যে সে খড়গপুর পর্যন্ত একটা সাধারণ টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে চমকে গেল অর্ক। গিজগিজ করছে মানুষ। কোনও বেঞ্চি খালি নেই, মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে বসে আছে প্রচুর মানুষ। অর্ক অনুমান করল এরা হয় মধ্যরাতের নয় ভোরের ট্রেন ধরবে। কিন্তু এখানে রাত কাটাতে হলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

খিদে পাচ্ছিল এবার। পাশের স্টল থেকে চিকেন রোল এবং চা খেয়ে সে দেখল এখন রাত পৌনে এগারোটা। কী করা যায় ভাবতেই সে দেখল সামনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে গেল। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ক্রমাগত কোন ট্রেন ছাড়বে এবং আসবে তার ঘোষণা চলছে। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ভাবনাটা। তার পকেটে খগপুরের টিকিট আছে। কোনও লোকাল ট্রেনে সে স্বচ্ছন্দে আরাম করে খঙ্গপুরে চলে যেতে পারে। তারপর সেখানে নেমে হাওড়ার টিকিট কিনে ফিরে আসতে আসতে রাত শেষ হয়ে যাবে। ভাগ্য ভাল থাকলে বসার বদলে সে শুয়েও যেতে পারে। ট্রেনটা যদি খড়গপুরেই যাত্রা শেষ করে তা হলে ঘুমিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই।

রাত সাড়ে এগারোটার লোকাল ট্রেনে উঠে খুব খুশি হল অর্ক। দু তিনজন যাত্রী ছাড়া কামরা বিলকুল ফাঁকা। ট্রেন চলতে শুরু করলে বেঞ্চিতে শরীর মেলে দিল সে। আঃ, কী আরাম! সেই সকালের পর এরকম বিশ্রামের সুযোগই পাওয়া যায়নি। সারাদিন শুধু টেনশন আর টেনশনে কেটে গেছে। কাল সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা সে শিয়ালদায় চলে যাবে। মা বাবা যে ট্রেনেই আসুক সকাল নটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। স্টেশনে ওকে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবে ওরা।

ব্যাপারটা ভেবে আরাম বোধ করল অর্ক। সে কঁধব্যাগ মাথার নীচে রেখে আরাম করে পাশ ফিরে শুল। ট্রেনটা চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যে স্টেশনগুলোতে থামছে কিন্তু যাত্রী উঠছে খুব কম। ফলে অর্কর ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল না। হঠাৎ মাথাটা ওপরে উঠেই বেঞ্চিতে আছাড় খেলে সে উঃ বলে উঠে বসতেই একটা লোক দৌড়ে নেমে গেল প্ল্যাটফর্মে। থেমে থাকা ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অর্ক দৌড়ে দরজার সামনে পৌঁছোতে না পৌঁছোতে প্ল্যাটফর্ম পেছনে চলে গেল।

এইরকম মড়ার মতো ঘুম কেউ কি রেলগাড়িতে ঘুমায়?

প্রশ্নটা শুনে মুখ ফেরাল অর্ক। পাকা দাড়ি, মাথায় সাদা টুপি পরা প্রৌঢ় মানুষটি বললেন, আসুন শান্ত হয়ে বসুন, যা গেল তার জন্যে শোক করবেন না।

লোকটাকে আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে দেখেও চিৎকার করলেন না কেন? অর্ক রেগে গেল।

প্রাণের ভয়ে। ওর কাছে নিশ্চয়ই ছুরি আছে, সেটা যদি আমার বুকে বসিয়ে দিত তা হলে কি আমার ভাল লাগত? আপনি খুশি হতেন। দামি কিছু ছিল?

জামাকাপড়।

ইনসাল্লা। আল্লা যা ভাল মনে করেন তাই করেছেন।

আমার আর কোনও জামাকাপড় সঙ্গে থাকল না এটা ভাল হল?

মনে করুন, আরও খারাপ কিছু হতে পারত। এটা মনে করলে বোঝাটা কমে যাবে। প্রৌঢ় হাসলেন, বসুন। রাতের এইসময় লোকাল ট্রেনে কেউ ঘুমায়?

অভিজ্ঞতা ছিল না বলে! এইরকম ছিনতাই হয় কে জানত?

ও অতি নিম্নশ্রেণির ছিনতাইবাজ। অতি উচ্চশ্রেণির হলে আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলত। ব্যাগের দিকে হাত না বাড়িয়ে বলত, পকেটে যা আছে সব বের করে দিতে। আপনি কোনও প্রতিবাদই করতে পারতেন না কারণ আগ্নেয়াস্ত্র দেখাত। তারপর দিব্যি সিগারেট খেত আপনার সামনে বসে। যে স্টেশনে দরকার নেমে যেত। এই কারণেই মাঝরাত্রের ট্রেনে উঠলে আমি সঙ্গে কিছু রাখি না। প্রৌঢ় তাঁর সাদা দাড়িতে আঙুল বোলালেন।

অর্ক বসল, তার পকেটে ট্রেনের টিকিট, কিছু টাকা আর এটিএম কার্ড, মোবাইল রয়েছে। এখন ফিরে আসার ট্রেন থাকলেও সেটা না ধরে ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। যাতে ওগুলো ছিনতাই না হয়ে যায়।

কোথায় যাচ্ছেন?

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন।

কোথাও না।

লাখ টাকার উত্তর। সত্যি তো আমরা কে কোথায় যাচ্ছি জানি না।

আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

খড়্গপুরে, আমার ভাইয়ের বাসায়। ও কাল সকালে হজ করতে যাবে। বাসা খালি পড়ে থাকবে। তাই কদিন পাহারা দিতে হবে। প্রৌঢ় হাসলেন, সেখান থেকে যাব ইসলামপুরে। বাপ-মাকে নিয়ে এক বন্ধু আজমিরে যাবে, তারও বাসা পাহারা দেবার জন্য আমাকে দরকার।

অর্ক অবাক হল, আপনি বিয়ে থা করেননি?

করেছিলাম। আমাকে তার পছন্দ হয়নি বলে আর একজনের সঙ্গে চলে গেছে। ওই যে বললাম, যা গেছে তার জন্যে শোক না করতে। আমিও করিনি। প্রৌঢ় বললেন, খড়্গপুর অবধি ঠিক আছে, তারপরেই আসল। বিপদ।

কীরকম?

কখন ট্রেনলাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে তা কামরায় বসে জানতেও পারবেন না। দেখছেন না, খোদ সরকারও মাওবাদীদের ভয় পাচ্ছে। প্রৌঢ় গলা নামালেন শেষ কথাগুলো বলতে।

অর্ক সতর্ক হল। এই বৃদ্ধ আসলে কী তা যখন সে জানে না তখন মুখ খোলা অত্যন্ত বোকামি হবে। লোকটা তো পুলিশের চর হতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল, খঙ্গপুর আর কতদূর?

প্রৌঢ় শব্দ করে হাসলেন, কতবছর পরে আপনি মনে করিয়ে দিলেন। তা একসময় খুব গল্প পড়তাম। উপন্যাস পড়ার ধৈর্য ছিল না। বউ চলে যাওয়ার পর ওই পড়াটড়া ছেড়ে দিয়েছি। সেই সময় একটা গল্প পড়েছিলাম, ডানকুনি আর কতদূর? লেখকের নাম শ্রীশচীন ভৌমিক। এখনও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি খঙ্গপুর আর কতদূর জিজ্ঞাসা করতে মনে পড়ে গেল। এই যে কথা থেকে কথা মনে পড়ে যাওয়া, গন্ধ থেকে স্মৃতি ফিরে পাওয়া, ভারী চমৎকার ব্যাপার। খড়গপুর থেকে কতদূরে যাবেন?

কোথাও না। হাওড়ায় ফিরে যাব। অর্ক উঠে চলন্ত ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে একটু-আধটু টিমটিমে আলো, বাতাসও বেশ শীতল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুন্তীর মুখ মনে পড়ল। অদ্ভুত ছিমছাম মেয়ে যার সঙ্গে কথা বললে দূরের মানুষ বলে মনে হয় না। যদি আরও আগে ওর সঙ্গে আলাপ হত? হেসে ফেলল সে। তবে কী হত? কুন্তী নিশ্চয়ই এম এ পাশ করে শিক্ষকতা করছে। ওর ধারেকাছে বিদ্যে তার নেই। যেসব কারণে সংসারী হওয়ার কথা ভাবা যায় তা কোনওদিন মাথায় আসেনি এবং তার জন্য কোনও আক্ষেপ কখনও হয়নি। আজ হঠাৎ এসব ভাবছে কেন সে? মোবাইল বের করে সময় দেখল অর্ক। এখন গভীর রাত। ট্রেন কোনও নদী পার হচ্ছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে বলে অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ বাবার মুখ মনে এল। ছেলেবেলায় বাবাকে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনত স্কুল থেকে ফিরে। একটা কবিতা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তার। আজ এই রাতের এমত সময়ে আচমকা লাইনগুলো বুকে পাক খেয়ে গেল, আধেক লীন হৃদয়ে দূরগামী/ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি/সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া/অবনী বাড়ি আছ?

খড়গপুরে এর আগে গিয়েছেন?

না। অর্ক ফিরে দাঁড়াল।

স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটা বিশাল অজগর সাপের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। কয়েকজন যাত্রী চোখের পলকেই চলে গেলেন যে যার গন্তব্যে।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন ফেরার ট্রেনটা কখন পাবেন বোর্ড দেখে বলে দিই। দেখা গেল তাকে আরও একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। প্রৌঢ় চিন্তিত হলেন। এরকম নির্জন স্টেশনে একা বসে থাকা ঠিক হবে না।

কেন?

পুলিশ এসে খামোকা হয়রানি করবে। তার চেয়ে বাইরে চলুন। স্টেশনের বাইরে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে বসে চা খেয়ে সময় কাটাতে পারবেন। আমিও ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। প্রৌঢ় বললেন।

চায়ের দোকান এত রাত্রে ভোলা থাকবে?

আগের বার দেখেছি খোলা ছিল। প্রৌঢ় এগোলেন।

এত রাতেও দোকানে আলো জ্বলছে। দুজন খদ্দের। অর্ক প্রৌঢ়ের সঙ্গে ভেতরের বেঞ্চিতে গিয়ে বসার আগে সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল। সুন্দর করে লেখা, লাল কেবিন।

এই নাম সে কার মুখে শুনেছে? চোখ বন্ধ করল অর্ক।

.

৪৩.

প্রৌঢ় বললেন, দুকাপ চা নতুন করে বানিয়ে দিন লালবাবু। খুব রোগা, লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা বৃদ্ধ, যিনি ক্যাশবাক্সের পাশে বসে ছিলেন তিনি বললেন, রাত বারোটার পর এই দোকানে পুরনো চা বিক্রি হয় না। বসুন।

বেঞ্চিতে বসতে বসতে মনে পড়ে গেল অর্কর। রামজির মুখে এই দোকানের কথা সে শুনেছিল। হাওড়া থেকে এই দোকানে এসে কোথায় যাবে তার খবর নিতে বলা হয়েছিল তাকে। বৃদ্ধের দিকে তাকাল অর্ক। তা হলে কি নিরীহ দেখতে এই মানুষটির সঙ্গে রামজির দলের লোকদের যোগাযোগ রয়েছে? একেবারে স্টেশনের বাইরে এই দোকান ঘেঁষে যদি বৃদ্ধ পোস্ট অফিসের কাজ করেন তা হলে তা পুলিশ জানতে পারল না? অর্কর ইচ্ছে হচ্ছিল বৃদ্ধকে রামজির ব্যাপারে প্রশ্ন করে। রামজি এখন কোথায় তা ইনি নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু নিজেকে সামলাল অর্ক। যদি সন্দেহ সত্যি হয় তা হলে অচেনা লোকের কাছে ইনি মুখ খুলবেন না।

চা দিয়ে গেল একজন। প্রৌঢ় সেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পেট খালি নাকি?

মাথা নাড়ল অর্ক, তারপর চুমুক দিল। চায়ের স্বাদ ভাল।

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে এইসময় রাস্তায় হাঁটা কি নিরাপদ?

বৃদ্ধ বললেন, ভবিষ্যৎ বলতে পারব না। তবে এখন চোর ছিনতাইবাজের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত গত কয়েকমাসে সেরকম খবর কানে আসেনি।

প্রৌঢ় হাসলেন, তা হলে তারা সবাই লোকাল ট্রেনগুলোতে আস্তানা গেড়েছে। এই যে, আমার এই ভাইয়ের ব্যাগ ট্রেন থেকে ছিনতাই হয়ে গেল।

খবরটা খুব দুঃখের। আপনারা কোথায় যাবেন? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বি-ই কলেজের কাছে যাব। ভোর হোক, তখন রওনা হব। প্রৌঢ় চায়ের কাপ রাখলেন, ইনি ফাস্ট ট্রেন ধরে ফিরে যাবেন।

সে কী? এসেই ফিরে যাবেন কেন?

হোটেলে থাকলে যা খরচ হত ট্রেনে যাতায়াত করলে তার চেয়ে অনেক কমে হয়ে গেল। অর্ক জবাব দিল।

তা ভাই কি হোটেলেই বসবাস করেন? স্থায়ী বাসা নেই? বৃদ্ধ হাসলেন।

তা থাকবে না কেন? কিন্তু আজকের রাতটা বাইরে কাটাতে হচ্ছে।

তাই বলুন। অনেকে শুনেছি পুলিশের ভয়ে বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসে। বোধহয় তেমন ঘরে গেলে হোটেলের চেয়ে সস্তা হয়। আপনি তা না করে নতুন পথ দেখালেন। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। বেঁচে থাকলে আরও কত নতুন দেখব।

প্রৌঢ় বললেন, দেখবেন তো নিশ্চয়ই। এখন থেকেই তো পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে। পরিবর্তন হয়ে গেলে নতুন দেখার সুযোগ পাবেন।

হাওয়া বলছেন কী ভাই, ঝড় উঠল বলে। এই দোকানে আমি দিনের বেলায় বসি না। রাত দশটায় আসি, আলো ফুটলে চলে যাই তখন দুই ছেলে পালা করে বসে। কী করব বলুন? রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। যত ঘুম দুপুরে। তাই রাত জেগে চেয়ে চেয়ে দেখি। পরিবর্তনের ঝড় আসছে। বলতে বলতে বৃদ্ধ মুখ ফেরালেন। একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ড্রাইভারের পাশে বসে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও খবর আছে। লালবাবু?

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, না স্যার। রাতের বেলায় কোনও খবর পাইনি।

ছেলেদের বলবেন দিনের বেলায় কান খাড়া রাখতে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলে অফিসার চেঁচিয়ে বললেন, এবার নিজের আর দোকানের নাম পালটাতে হবে যে, নতুন নাম ভাবুন। জিপ বেরিয়ে গেল।

বৃদ্ধ অর্কদের দিকে তাকালেন, শুনলেন? ঠাকুরদার দেওয়া নামটা এবার বদলাতে হবে। আর সবুর সহ্য হচ্ছে না ।

এই সময় একটি ছেলে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে দোকানের সামনে চলে এল, দাদু, এখনই এলাকা ঘিরে সার্চ করবে পুলিশ? বড়বাবু কিছু বলল?

না ভাই। খবর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করল। বৃদ্ধ জবাব দিতেই ছেলেটা উধাও হয়ে গেল।

প্রৌঢ় উঠে দাঁড়ালেন, চায়ের দাম নিন। এখন এখানে বসে থাকলে ঝামেলায় পড়তে হবে। কী বলেন দাদা?

বৃদ্ধ বললেন, ওরে বাবুর কাছ থেকে টাকাগুলো নে।

যে চা দিয়েছিল সে দাম নিয়ে গেল। অর্ক বুঝতে পারল লালবাবু প্রৌঢ়ের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। সে উঠে দাঁড়াল, আমি তা হলে প্ল্যাটফর্মেই চলে যাই। ওয়েটিং রুম নিশ্চয়ই খোলা পাব।

বৃদ্ধ বললেন, কুমিরের মুখে মাথা গলিয়ে দেবেন? অবশ্য আপনার যা ইচ্ছে।

প্রৌঢ় বললেন, ভাই, চলুন, পায়ে হেঁটে এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাই। আঁধার কাটলে না হয় রিকশায় ফিরে এসে ট্রেন ধরবেন।

বৃদ্ধ বললেন, সেই ভাল, সেই ভাল।

প্রৌঢ়র পেছন পেছন বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল অর্ক, আমি আগে কখনও খঙ্গপুরে আসিনি, কিন্তু আপনার দোকানের নাম শুনেছি।

প্রশংসা না নিন্দে? বৃদ্ধ নিরুত্তাপ।

কোনওটাই নয়। আমার পরিচিত একজন বলেছিল সে আপনার দোকানে আসবে।

কী নাম?

রামজি।

মনে নেই। রাম লক্ষ্মণ থেকে নকুল সহদেব, কতজনই তো আসছে। যান, আর দেরি করবেন না। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। খঙ্গপুরের রাস্তায় যথেষ্ট আলো। কিন্তু এই সময়ে চারধার খাঁ খাঁ করছে। প্রৌঢ় হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা ছেড়ে গলির ভেতর ঢুকলেন, একটু শর্টকাট করি। তা ছাড়া বড় রাস্তায় হাঁটলে মহাজনদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ভাইয়ের নামটা বোধহয় এখনও জানা হয়নি।

অর্ক।

বা রে, বা। চমৎকার নাম। আমি আবুল কালাম আজাদ। অবাক হওয়ার। কোনও কারণ নেই। আমার এই নাম অন্তত দশ হাজার মুসলমানের আছে। তবে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত তার দশ হাজারের এক ভাগ গুণ আমার নেই। কথাগুলো বলে খানিকটা পথ চুপচাপ হাঁটলেন আজাদভাই। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু ভাই, আপনি তখন বললেন রামজির কাছে লালবাবুর দোকানের নাম শুনেছেন। রামজি তো বাঙালির নাম হতে পারে না।

রামজি বাঙালি নয়। ঝাড়খণ্ডের মানুষ।

তাই বলুন।

কিন্তু গলি থেকে বড় রাস্তায় আসতেই হল ওদের। এঁকেবেঁকে সেটা আবার বেরিয়ে এসেছে। খানিকটা হাঁটতেই পেছন থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। প্রৌঢ় বললেন, তাড়াতাড়ি পা চালান, স্টেশনে গুলি চলছে।

পুলিশ? প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অর্কর।

জবাব দিলেন না প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ। দুটো সাইকেলে চারটে ছেলে পাঁইপাঁই করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গা এখান থেকে কত দূরে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

প্রৌঢ় বললেন, আমার সব হিসেব গুলিয়ে গেছে।

তার চেয়ে রাস্তার পাশে কোনও শেড-এর নীচে ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বোধহয় ঠিক হবে। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ চারপাশে তাকালেন। এই রাস্তায় দোকানপাটও তেমন নেই। যা আছে। তাদের সামনে কোনও শেড নেই।

এইসময় তৃতীয় সাইকেলটি পেছন থেকে চলে এল। অর্ক দেখল সাইকেল নড়বড় করছে। রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যেতে যেতে মাটিতে পড়ে গেল। যে চালাচ্ছিল তার গলা থেকে গোঙানি ছিটকে বের হল।

প্রৌঢ় দৌড়ে গেলেন ছেলেটার কাছে। রাস্তার আলোয় বোঝা গেল ওর পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে ভাই?

ছেলেটা ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল, মা! মাগো!

প্রৌঢ় ওকে টেনে সোজা করার চেষ্টা করলেন। রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারায়নি ছেলেটা। জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি পুলিশ?

প্রৌঢ় বললেন, না

তা হলে আমাকে বাঁচান। আমাকে সামনের গলির ভেতরে স্কুলের পেছনে নিয়ে চলুন। প্লিজ। ছেলেটি কাতরাতে লাগল।

প্রৌঢ় অর্কর দিকে তাকাল, ওকে কি সাহায্য করবেন?

অর্ক বলল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই জরুরি।

ছেলেটি দ্রুত মাথা নাড়ল, হাসপাতালে গেলেই পুলিশ অ্যারেস্ট করবে। স্কুলের পেছনে গেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার হাঁটুর ওপরে একপাশে গুলি লেগেছে। উঃ, মাগো!

অর্ক বলল, তা হলে ওকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।

সাইকেল দাঁড় করিয়ে ছেলেটিকে সিটে বসিয়ে ওরা যখন গলির ভেতর ঢুকছে তখন দেখতে পেল স্টেশনের দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি আসছে। ওটা যে পুলিশের গাড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

গলির ভেতরে খানিকটা যাওয়ার পর প্রৌঢ় ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাসা কোথায় ভাই?

এখানে আমার বাসা নেই। আমাকে ওই বারান্দায় নামিয়ে দিলেই হবে।

ওই বারান্দায় নামালে কে তোমাকে দেখবে? এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার, কী করি বলুন তো? অর্ককে প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ়।

আমরা ওকে কোথায় নিয়ে যাব? ও যা বলছে তাই করাই ভাল। বলতে বলতে অর্ক দেখল দুটো গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা গলির দিকে মুখ করে দাঁড়ালেই তাদের দেখতে পেত।

অগত্যা প্রৌঢ়র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছেলেটিকে বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হল। এখন আশেপাশের সব বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। গলির ভেতরের দিকটা অন্ধকার। শোওয়ার পর ছেলেটি পকেট থেকে সেলফোন বের করে চোখের সামনে যন্ত্রটা এনে বোতাম টিপতে গিয়ে থমকাল, আপনারা চলে যান, প্লিজ।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন। কয়েক পা হেঁটে অর্ক পেছন ফিরে দেখল ছেলেটা সেলফোনে কথা বলছে। আশ্চর্য! অত রক্তপাতের পরেও ছেলেটার হুশ ঠিকঠাক রয়েছে। গলির মুখে এসে অর্ক বলল, বড়রাস্তায় হাঁটলেই পুলিশ আটক করবে।

করলে করবে। আমি রাতের শেষ ট্রেনে এসেছি! কোন ঠিকানায় যাব তা ওদের বলব। খোঁজ নিলেই বুঝবে মিথ্যে বলছি না।

প্রৌঢ়র গলায় বেপরোয়া সুর। অর্ক অবাক হয়ে বলল, আমি তো কিছুই বলতে পারব না।

প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ। আপনি সমস্যায় পড়বেন।

তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সমস্যা বলছি কেন? আপনি একজন ভদ্রলোক। খুন জখম বা ছিনতাই কখনও করেছেন? যাকে বলে উগ্রপন্থী রাজনীতি, সেই দলে কি আপনি?

না।

তা হলে আপনি সমস্যায় পড়বেন না।

মানে? পুলিশ ধরলে সত্যি কথা বলবেন। নিজের পরিচয় দেবেন।

কিন্তু পুলিশ নিশ্চয়ই জানতে চাইবে এত রাত্রে খড়গপুরের রাস্তায় আমি কী করছি? কী জবাব দেব?

একটা কিছু ভেবে নিন ভাই।

মাথায় কোনও জবাব প্রথমে আসছিল না। প্রৌঢ় হাঁটতে শুরু করলে অর্কর আচমকা মনে হল, সে পুলিশকে বলবে ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে থানার বড়বাবুর চাপে বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। বড়বাবু বলেছেন, যেমন করেই হোক রামজির সন্ধান তাকে দিতে হবে। সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু রামজির ঠিকানা সে জানে না। আজ বিকেলে মনে পড়ে গেল রামজি তার কাছে খঙ্গপুর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। ওর গ্রামের এক বন্ধু খঙ্গপুরের থানায় পোস্টেড। জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই লোকটাকে বের করলে হয়তো তার কাছ থেকে রামজির ঠিকানা জানা যাবে এই আশায় মরিয়া হয়ে সে চলে এসেছে।

প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ হনহনিয়ে হেঁটে যাওয়ায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল লোকটার সঙ্গে গিয়ে তার কী লাভ হবে? রাত ফুরোতে তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। তার চেয়ে ফিরে গিয়ে লালবাবুর দোকানে বসাই ভাল। চট করে ট্রেনে ওঠা যাবে। তার মধ্যে পুলিশ ধরলে তো জবাব তৈরি হয়ে গেছে।

প্রৌঢ় মানুষটাকে এখন আবছা দেখাচ্ছে। এই সময় ওপাশ থেকে একটা জিপ হেডলাইট জ্বালিয়ে আসতেই মানুষটাকে সিলুট হয়ে যেতে দেখল সে। জিপটা থেমে গেল। চিৎকার কানে আসতে অর্ক দ্রুত গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। সে দেখল প্রৌঢ় মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন এবং দুটো পুলিশের অবয়ব তার সামনে। তখনই প্রচণ্ড শব্দ হল। পরপর চারটে বোম পুলিশের গাড়ির ওপর আছড়ে পড়তেই প্রৌঢ় দৌড়ে পালাতে চাইলেন। যে দুটো পুলিশ তার সামনে ছিল তাদের একজন রিভলভারের ট্রিগার টিপতেই প্রৌঢ় রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন। পুলিশের গাড়ি তখন ধোঁয়ার আড়ালে। এখনই জায়গাটায় অনেক পুলিশ এসে যাবে। অর্ক আর ভাবতে পারল না। রাস্তার ধার ঘেঁষে সে দ্রুত হাঁটতে লাগল স্টেশনের দিকে। ভূতে তাড়া করলে মানুষ যেভাবে ছোটে দিকবিদিকে জ্ঞান হারিয়ে সেইভাবে হাঁটতে গিয়েও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল অর্ক। স্টেশনের দিক থেকে একের পর এক পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ঘটনাস্থলে। সেই আলো দেখেই তাকে লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হচ্ছিল। এই করতে করতে সে যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখনও লালবাবুর দোকান খোলা কিন্তু সেখানে না গিয়ে সে সোজা টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে দেখল ভিতরে লোক বসে আছে। হাওড়ার টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ভুতুড়ে চেহারার ট্রেনটাকে দেখতে পেয়ে চুপচাপ উঠে বসল। একটাও মানুষ নেই কামরায়। এই ট্রেন আদৌ কোথাও যাবে কি না সে জানে না। রাত শেষ হয়ে আসছে। কামরার ভেতরে অন্ধকার। সে জানলা দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল দুজন রাইফেলধারী রেলের পুলিশ হেঁটে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো পরে হঠাৎ ট্রেনে আলো জ্বলে উঠল। তারপর যেতে হয় তাই যাওয়ার ভঙ্গিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে হাওড়ার দিকে এগোতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। ঘুমিয়ে পড়লেও তার পকেট থেকে জোর করে বের না করলে কেউ লাভবান হবে না। সে চোখ বন্ধ করল। করতেই প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদের শরীরটাকে রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে দেখল। নিশ্চয়ই পিঠে বা মাথায় গুলিটা লেগেছিল। যে পুলিশ ছুঁড়েছিল সে কী ভেবেছিল? মাওবাদীরা প্রৌঢ়কে টোপ দিয়ে পুলিশের গাড়ি থামিয়েছে? থামার পর তারা বোম চার্জ করেছে? এই ঘটনার আর কেউ সাক্ষী আছে কি না কে জানে, কিন্তু কাল কাগজে ছাপা হবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন মাওবাদী প্রৌঢ় নিহত। ওই মানুষটা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিল। তাকে চা খাইয়েছিল। মানুষটার জীবিকা কী তা অর্ক জানে না, কিন্তু আত্মীয় বন্ধুদের উপকারের জন্যে এর বাড়ি ওর বাড়ি পাহারা দিতে ভালবাসত। প্রৌঢ় জানত না, প্রশ্নের বদলে পুলিশ বুলেট ব্যবহার করতে অনেক বেশি পছন্দ করে। যারা লুকিয়ে থেকে পুলিশের গাড়িতে বোমা ছুঁড়েছিল তারা সন্ত্রাসবাদী অথবা মাওবাদী হলে যে পুলিশ প্রশ্ন না করে প্রৌঢ়কে গুলি করে মেরেছে সে উগ্রপন্থী নয় কেন?

প্রথম রোদে কলকাতাকে এখনও মোলায়েম দেখায়। এখনও চিৎকার, শব্দের কোরাস শুরু হয়নি। গঙ্গার জল এই সময় সত্যি পবিত্র বলে মনে হয়। হাওড়া থেকে অর্ক ট্রাম ধরে চলে এল শিয়ালদায়। একটু একটু করে শহর জাগছে। স্টেশনও।

সত্তরের নকশাল আন্দোলন হয়েছিল ভারতের সংবিধান পালটাতে, সমাজব্যবস্থা বদলাতে। তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট তারপর আবার কংগ্রেস। সে সময় রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্যে। সরকার পুলিশকে ব্যবহার করতেন। মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে পুলিশ দিয়ে মানুষ খুন করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। বুর্জোয়া শাসকদের সমালোচনা করে গিয়েছে সমানে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তাদের ঔদ্ধত্য যত বেড়েছে, যত তারা আগের আদর্শচ্যুত হয়েছে, তত পুলিশকে ব্যবহার করে আনন্দিত হয়েছে।

দূর থেকে বাবা এবং মাকে দেখতে পেল অর্ক। কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে মা তাকে সামলে হেঁটে আসছে, একটু পেছনে ক্রাচ হাতে বাবা। অর্কর মনে হল দুজনকেই বেশ ভাল দেখাচ্ছে। চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।

এই যে, দাঁড়াও। কুলিকে দাঁড়াতে বলে মাধবীলতা সামনে এল, তুই?

তোমাদের নিতে এলাম, চলো। অর্ক হাসল।

অনিমেষ ততক্ষণে চলে এসেছিল কাছে। অর্ককে দেখে মাধবীলতাকে বলল, ওর চেহারাটা দেখেছ? রাত জেগে চুরিচামারি করে বেড়াচ্ছে নাকি?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, রাতে ঘুমোসনি?

অর্ক বলল, চলো, তোমাদের সব বলছি। এই কুলি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড চলো।

লাইন দিয়ে ট্যাক্সি পেতে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল। ট্যাক্সি যখন চলতে শুরু করেছে তখন মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলবি বলছিলি?

আমাদের বাড়িতে সুরেন মাইতির লোকজন হামলা করেছিল কাল।

সে কী? কেন? মাধবীলতা অবাক।

আমার কাছে যে ছেলেটি ছিল তাকে ওরা মাওবাদী বলে সন্দেহ করেছিল। বিশ্বাস করো আমার সঙ্গে ছেলেটি কখনওই রাজনীতি নিয়ে কথা বলেনি। ও চলে যাওয়ার পরে পুলিশ আমায় ডেকে ওর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিল। অর্ক বলল।

এইজন্যে হামলা করেছে! মাধবীলতার গলায় বিস্ময়।

হ্যাঁ, তার সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে রেগে যাওয়াটাও ছিল। আমি গতকাল বামফ্রন্ট বিরোধী বিশাল অরাজনৈতিক মিছিলে হেঁটেছিলাম এই খবরটা ওরা পেয়েছিল। সেই রাগে বাড়ি ভেঙে তছনছ করেছে। অর্ক বলল।

সর্বনাশ। তা হলে আমরা থাকব কোথায়? মাধবীলতা যেন পরে পড়ল। এতক্ষণে অনিমেষ কথা বলল, মনে হচ্ছে এতদিনে তুমি রাজনীতিতে নামবে। নামো, আরও নামমা, কিন্তু আমাদের জড়িয়ে নয়।

.

৪৪.

বিস্তারিত শোনার পরে মাধবীলতা একটি কথাও বলেনি, বাড়িতে ঢুকে হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকাল। জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে গিয়েছিল অর্ক। অনিমেষ হতাশ গলায় বলল, এখানে না ফিরে এলেই ভাল হত।

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। তারপর শ্বাসজড়ানো শব্দগুলো উচ্চারণ করল, আর কতদিন কতবার আমি সহ্য করব! কথাগুলো একেবারেই নিজেকে বলা। সেটা বুঝেই অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল। বহু বছর, সেই জেল থেকে বের হয়ে মাধবীলতার সঙ্গে চলে আসার পর থেকে যে হীনমন্যতাবোধ তার মনে আঁচড় কাটত, যা ক্রমশ নেতিয়ে ধুলোচাপা হয়ে গিয়েছিল তা মাধবীলতার কথায় আবার জেগে উঠল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উঠোনে পা রেখে বারান্দায় বসে পড়ল। নিজেকে অর্থহীন বলে মনে হচ্ছিল তার।

অর্ক বেরিয়ে এল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ তোর ডায়েরি নেয়নি?

ডায়েরি করার সুযোগ পাইনি। থানার ওসি নিজেই দেখতে এসে আমাকেই যা ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। অর্ক জানাল।

কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমিই নাকি এসবের জন্যে দায়ী।

সত্যি কথা বল, তুই জেনেশুনে একটা মাওবাদী ছেলেকে বাড়িতে রেখেছিলি?।

সত্যি কথাই বলছি মা, আমি কিছুই জানতাম না। ও ঝাড়খণ্ডের ছেলে। আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। আমার তো ওকে ভদ্র সরল মানুষ বলে মনে হয়েছে। পরে বুঝেছি ও কোনও দলের সঙ্গে যোগ দিতে এসেছে। সেই দল প্রকাশ্যে কাজ করে না। কিন্তু এটা যখন বুঝেছি তখন ওর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাকে ফিরতে দেখে ইতিমধ্যেই বস্তিতে ছোটখাটো জটলা তৈরি হচ্ছিল, এখন তারাই কৌতূহলী হয়ে সঙ্গ নিল। মাধবীলতা বস্তি থেকে বেরিয়ে সোজা সুরেন মাইতির পার্টি অফিসে পৌঁছে গেল। অত সকালে অফিসের দরজা খোলেনি কিন্তু সুরেন মাইতির দুজন ছায়াসঙ্গী বারান্দায় বসে ছিল। মাধবীলতা তাদের বলল, সুরেনবাবুকে একটু ডেকে দাও তো ভাই।

মাধবীলতা এবং তার পেছনে জনা পনেরো মানুষ, যাদের বেশিরভাগই মহিলা, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলে দুটো। দ্রুত মাথা নেড়ে চলে গেল সুরেন মাইতিকে ডাকতে। তাদের সঙ্গে সুরেন মাইতি আসার আগেই ভিড়ের আয়তন বেড়ে গেল। লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে সুরেন মাইতি মাধবীলতার সামনে এসে নমস্কার জানাল হাতজোড় করে। তারপর বলল, যাক আপনি এসে গেছেন। কী ঝামেলা বলুন তো! আপনার ছেলে না জেনেশুনে উটকো লোককে বাড়িতে ঢুকিয়ে বিপদ ডেকে আনল। মাওবাদী এক্সট্রিমিস্ট। যে ছিল তার অ্যান্টি গ্রুপ এসে ওই হামলা করে গেছে। আমি তখন এলাকায় থাকলে ওদের হাতেনাতে ধরে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতাম। আপনি বাড়ি যান, বিশ্রাম নিন। আমি চেষ্টা করছি যে ক্ষতি আপনাদের হয়েছে তার অন্তত কিছুটা পূর্ণ করে দিতে।

মাধবীলতা শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার কথা শেষ হয়েছে?

সুরেন মাইতি একটু বোকা হাসি হাসল, হ্যাঁ, এই আর কী!

মাধবীলতা বলল, দেখুন, আমি রাজনীতির মানুষ নই, সাদা চোখে যা দেখছি তাই বলছি, আপনারা নিজেদের পায়ে কুড়োল মারছেন, আপনাদের যে শক্তি ছিল তা অপব্যবহারে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন মানুষ আপনাদের একফোঁটা ভালবাসে না। ভয় করতে করতে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে ভাবছে কবে আপনারা চলে যাবেন। মিথ্যে দিয়ে যে অন্যায়গুলো ঢাকতে চাইছেন তা সবাই বুঝতে পারছে শুধু আপনারা তা পারছেন না। খুব খারাপ লাগে, বুঝলেন?

কথাগুলো শেষ করে মাধবীলতা হনহন করে ফিরে গেল। সুরেন মাইতি তার যাওয়াটা দেখে হাত ঘোরাল, কী বলে গেল তা মাথায় ঢুকল না।

যারা এতক্ষণ সবিস্ময়ে দেখছিল তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সারা সকাল ধরে আলোচনা করার সুযোগ পেয়ে বর্তে গেল।

তৃতীয় দিনের শেষে থানায় গেল অর্ক। বড়বাবুর জন্যে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই সময় একজন এস আই, যিনি ডিউটিতে ছিলেন, বসতে বললেন। চা খাওয়ালেন। তারপর বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝছেন?

কী ব্যাপারে?

চারধারে যা হচ্ছে তা দেখছেন, শুনছেন তো?

অর্ক বলল, ও, কিন্তু আমি তো রাজনীতি করি না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি রাজনীতি করি? এস আই হাসলেন। আমরা পিঁপড়ের মতো। কেন বললাম?

বুঝতে পারলাম না।

ঝড়বৃষ্টি আসার কিছু আগে, দেখবেন, পিঁপড়েরা লাইন বেঁধে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেন করে? কারণ ওরা ঠিক টের পেয়ে যায় বৃষ্টি আসছে। আমরাও টের পেতে শুরু করেছি। আপনাদের বস্তির লোকজন কিছু বলছে না?

আমি শুনিনি। কারণ আমি সকালে বেরিয়ে যাই, রাত্রে ফিরি। কারও সঙ্গে আড্ডা মারার সময় পাই না। অর্ক বলল।

বুঝলাম, আপনি কেন বড়বাবুর দেখা চাইছেন?

উনি আমাকে বলেছিলেন যাকে আমি আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম তার হদিশ জানাতে। না হলে আমার বিপদ হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে যে এখন কোথায় তা আমি জানি না। এটাই ওঁকে বলতে চাই। অর্ক সরল গলায় বলল।

ঠিক আছে, ওঁর জন্যে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি বলে দেব আপনি এসেছিলেন। নিশ্চিন্তে চলে যান।

আমি সত্যি জানি না। অর্কর অবিশ্বাস হচ্ছিল এস আই-এর কথায়।

কী করে জানবেন? পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী না থাকলে তার ঠিকানা আপনি কী করে জানবেন? এস আই হাসলেন।

মানে? হকচকিয়ে গেল অর্ক।

খবরের কাগজ পড়েন না? বিরোধী নেত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। বড়বাবু কাল থেকে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তা হলে আপনাকেও কোনও মাওবাদীর ঠিকানা জানাবার জন্যে চাপ দেওয়া হবে না।

কথাটা বিশ্বজিৎকে বলতেই সে খুব হাসতে লাগল।

হাসছ কেন?

হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে, বুঝলেন না? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, একটার পর একটা ব্রহ্মাস্ত্র বামফ্রন্টের হাত পা কাটছে। সামনের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়বেই। দাদা আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আপনাদের ওপর সুরেন মাইতিরা যে অত্যাচার করল তার কি কোনও কারণ ছিল? আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। আপনাকে দেখলে মানুষ ভরসা পাবে। এত বড় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে এখনই পরিবর্তন আসা দরকার। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কী করতে বলছ?

আপনি টিএমসির সক্রিয় সদস্য হন। আপনার মতো একজনকে পেলে দল শক্তিশালী হবেই। দিদি যে স্বপ্ন দেখছেন তা সার্থক করতে এগিয়ে আসুন অকা। আমাদের পার্টি অফিসে আপনাকে নিয়ে কথাও হয়েছে। বিশ্বজিৎ বলল।

কিন্তু বিশ্বজিৎ, আমি আজ অবধি রাজনীতি করিনি। করতে চাইও না।

ছোটমুখে বড় কথা বলছি, অনেকেই জীবনে যা করেননি তা চাপে পড়লে করতে বাধ্য হন। আপনি কি আগে কখনও কলকাতার রাস্তায় মিছিলে হেঁটেছেন? অপর্ণা সেন, শুভাপ্রসন্ন কি রাজনীতি করেছেন? কিন্তু ওঁদের সঙ্গে আপনিও পথে মিছিল করেছেন। কারণ আপনারা কৃষকদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলি চালানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বামফ্রন্টকে ধিক্কার দিয়েছেন। দাদা, এটাও তো রাজনীতির অঙ্গ। বিশ্বজিৎ অর্কর হাত ধরল।

অর্ক হাত ছাড়িয়ে নিল, এ কী বলছ? ওই প্রতিবাদ মানুষ হিসেবে করা উচিত বলেই সবাই করেছেন, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

তা হলে তো দিদি কোনও রাজনীতি করছেন না। বিশ্বজিৎ বলল।

মানে?

দিদি সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মা-মাটি-মানুষের সম্মান বজায় রাখতে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের কাছে আবেদন করেছেন। আজ চৌত্রিশ বছর ধরে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে সুরেন মাইতির মতো অত্যাচারী শোষকরা যে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে তা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাইছেন উনি। এই মহৎ কাজে আমরা যদি তার পাশে না দাঁড়াই তা হলে দেশটা শেষ হয়ে যাবে। অর্কা, এই জনসেবাকে কি আপনি রাজনীতি করা বলে ভাববেন? বিশ্বজিৎ বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।

একমুহূর্ত ভাবল অর্ক। তারপর বলল, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তা নিয়ে একটু ভাবি। ভেবে বলব।

বাড়িতে ফিরে এলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী কথা হল? আমি তো ভাবলাম তোমাকে লকআপে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টারের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা বলল অর্ক। মাধবীলতা চুপচাপ শুনছিল। বলল, অদ্ভুত ব্যাপার। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

অর্ক বলল, আমারও প্রথম বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, পাগল!

মাধবীলতা বলল, কে?

অনিমেষ বলল, একজন মহিলা যাঁর দেশপ্রেম ছাড়া কোনও আদর্শ নেই, যাঁর পাশে কোনও সুশৃঙ্খল দল নেই, কোনও রাজনৈতিক চিন্তাধারা নেই, যাঁদের একমাত্র স্লোগান বামফ্রন্ট হঠাও তারা দেশের মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে না। বামফ্রন্ট যতই অত্যাচার করুক তাদের সাংগঠনিক শক্তি এতটাই যে বন্দুকের সঙ্গে তিরধনুক নিয়ে লড়ে জিততে হবে বিরোধীদের। সেটা কি সম্ভব? এটা হল একজন বনাম এক লক্ষ লোকের লড়াই। ইম্পসিবল।

মাধবীলতা বলল, মিরা তো হয়েই থাকে।

অনিমেষ শব্দ করে হাসল। বলল, বেশ, তোমার কথাই সত্যি হল। ভদ্রমহিলা তার দলবল নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন। হওয়ার পর তাকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে হবে। কংগ্রেস তার ভোটসঙ্গী হলে তাদের কিছু দপ্তর দিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে সেটা ভেবেছ?

কী হবে মানে?

উনি যে দল করেছেন সেই দলের প্রথম সারির নেতাদের একটাই পরিচয়, তারা দিদির আলোয় আলোকিত। বটগাছ থেকে নেমে আসা ঝুরির মতো। তাই মুখ্যমন্ত্রী হলে দিদি কাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করবেন? মুখ্যমন্ত্রী দিদি, অর্থমন্ত্রী দিদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিদি, শিল্পমন্ত্রী দিদি। এইসব মন্ত্রকে রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ওইসব নেতাদের নিয়োগ করা ছাড়া তার অন্য কোনও উপায় থাকবে না। অবশ্য আর একটা উপায় আছে। দলের বাইরে থেকে যোগ্য মানুষদের এনে নির্বাচন জিতিয়ে পূর্ণমন্ত্রী করতে পারেন।

অনিমেষ বেশ মজা পাচ্ছিল কথাগুলো বলার সময়ে। মাধবীলতা বলল, তুমি বেশি বেশি ভাবছ। বাংলার মানুষ যদি তার ওপর আস্থা রাখে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই তার সম্মান দেবেন। আচ্ছা বলো তো, পশ্চিমবঙ্গে এবং আগের অবিভক্ত বাংলায় অনেক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাদের জনপ্রিয়তা কম ছিল না। কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তা কি তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়নি?

অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক বলল, মা, তুমি কী বলছ?

ঠিকই বলছি। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু হয়তো অনেক মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেননি। মাধবীলতা বলল, আমার তো মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বসু জনপ্রিয় হয়েছেন তার নিখোঁজ হওয়ার পরে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, এই কলকাতায় ছিলেন ততদিন কি তিনি এই মহিলার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন? আমার ধন্দ আছে।

অনিমেষ বলল, যা তা বলে যাচ্ছ! একজন মহিলা জপ করার মতো করে পশ্চিমবাংলার মানুষের কানে বামফ্রন্ট বিরোধী মন্ত্র বলে সুড়সুড়ি দিয়ে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তা যে-কোনও মুহূর্তে উধাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সুভাষ বোসের প্রতি শ্রদ্ধা বাঙালির মনে বহুকাল থাকবে। ভালবাসায় শ্রদ্ধা মিশে না থাকলে আর আয়ু বেশিদিন থাকে না। যাক গে, এসব দেখি আর মনে মনে গুমরোই। আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অনিমেষ ক্রাচ টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল। মাধবীলতা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, তোর বাবার মুখে এরকম কথা বহু বছর পর শুনলাম!

বুঝলাম না! অর্ক বলল।

তুই তখন নার্সারিতে পড়িস। তোর বাবাকে জেলখানা থেকে ট্যাক্সিতে নিয়ে আসছিলাম। জেলে থাকার সময় আমি ওকে জানাইনি তোর কথা। তাই জেল থেকে বেরিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। তখন বলেছিল, আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারপর তোকে পেয়ে ধীরে ধীরে মনে জোর পেল। আজ আবার সেই কথাটা শুনলাম। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, তুই চল, আমার সঙ্গে হাত লাগা। বাড়িটাকে একটু বসবাসযোগ্য করে নেওয়া দরকার। কেউ ভেঙে দিয়ে চলে গেলে আমি তার মধ্যে পড়ে থাকব কেন? আয়।

হাওয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। বামফ্রন্টকে হঠিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকারকে ক্ষমতায় আনলে বাংলার চেহারা বদলে যাবে। শহরের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা জঙ্গলমহল বা দার্জিলিং পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। সেখানে যা হচ্ছে তা সেখানকার মানুষের সমস্যা। শহরের বেকার যুবকদের চাকরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, কলকাতা শহরটা ধীরে ধীরে লন্ডন হয়ে উঠবে। মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারবে। এগুলোর কোনওটাই বামফ্রন্টের আমলে হয়নি। তারা পেশিশক্তি দেখিয়েছে। যেখানে বাধা পেয়েছে সেখানেই রক্তবন্যা বইয়েছে। যারা নিখোঁজ বলে পুলিশের খাতায় ঘঘাষিত তাদের মাটির নীচে শুইয়ে দিয়েছে শক্ত হাতে। মা-মাটি-মানুষের সরকার এলে বদলার রাজনীতি বাতিল হবে। দলতন্ত্রের বদলে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। দিদি মুখ্যমন্ত্রী হলে যে সমস্ত বাঙালি নেতা, কবি, লেখক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁদের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, তাদের নতুন করে সরকারি সম্মান দেওয়া হবে। এই স্বপ্নের ঢেউ কোচবিহার থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বিশাল বটগাছের গোড়া ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেখানে পৌঁছেছে, একটা মৃদু ধাক্কা লাগলেই গাছটা হুড়মুড়িয়ে লুটিয়ে পড়বে। প্রায় সমস্ত মিডিয়া ওই ঢেউটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে হাত লাগালেও অনিমেষের মতো কিছু মানুষ যারা শিক্ষিত রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তারা একমত হতে পারছিলেন না। কিন্তু পরিবর্তন চাই স্লোগান আকাশ ছুঁয়ে গেল।

বিশ্বজিতের চাপে অর্ক এই ঢেউটাকে উপেক্ষা করতে পারল না। সে নিজের চোখে মাওবাদীদের কার্যকলাপ খঙ্গপুরের রাস্তায় দেখে এসেছে। জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে সুরেন মাইতিদের পেশিশক্তিতে ক্ষুব্ধ হয়েও চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ এই কদিন পর্যন্ত ছিল সরকারের ক্রীতদাস, নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। তাই যখনই সময় পাচ্ছিল তখনই সে বিশ্বজিৎদের প্রচারসভায় পৌঁছে যাচ্ছিল। বিশ্বজিৎ অনুরোধ করলেও অর্ক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তার উপস্থিতি শ্রোতারা ভাল চোখে দেখছে বুঝে বিশ্বজিত্রা চাইছিল প্রায় প্রতিটি সভায় তাকে হাজির করতে। বক্তৃতা না দিলেও, এই কারণে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল অর্কর।

অফিস থেকে ফিরছিল অর্ক। সাধারণত সন্ধেবেলায় এবং ছুটির দিনে সে নির্বাচনী প্রচারে বের হয়। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখল একটা মিছিল ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকছে বামবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মিছিলে যারা হাঁটছে, স্লোগান দিচ্ছে, তাদের বেশ কয়েকজনকে এ যাবৎকাল সিপিএমের কর্মী বলে সে জানত। দুজনকে তো সুরেন মাইতির হয়ে চোখ গরম করতে দেখেছে। ওরা কখন কেমন করে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিল? এত সাহস পেল কী করে? অর্কর মনে পড়ল সেই সাব-ইন্সপেক্টরের কথা। বর্ষার আগে পিঁপড়েরা ঠিক টের পেয়ে যায় জল পড়বে। সাব-ইন্সপেক্টররা যখন টের পেয়ে গেছে তেমনি মস্তানবাহিনীও। কিন্তু কয়লা তার চরিত্র পালটায় না। দলে এদের দেখলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবেই, ভয়ও পাবে। কী করে বিশ্বজিত্রা এদের দলে ঢুকতে দিল?

বিশ্বজিৎকে খুঁজে বের করল সে। তৃণমূলের সদ্য তৈরি পার্টি অফিসে বসে সে অন্যদের কাজ বোঝাচ্ছিল। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলল অর্ক।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, অর্কদা, যখন জলোচ্ছাস হয় তখন কি জল পরিষ্কার থাকে? যাবতীয় আবর্জনা স্রোতের মধ্যে ঢুকে যায়। কী করব বলুন! এমন কোনও ছাঁকনি নেই যে তাদের আটকাব।

অর্ক বলল, আটকাতে হবেই। নইলে এরাই কিছুদিন পরে সিপিএমে থেকে যা যা করছিল তাই করবে।

না। তা করতে পারবে না। যদি নির্বাচনে আমরা জিতি তা হলে ঝাড়াই বাছাই করে এদের বাদ দেওয়া হবে। এখন কিছু করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া আমাদের দল নতুন। লড়াই করার মতো সক্রিয় কর্মীর সংখ্যাও বেশি নয়। সিপিএমের হার্মাদবাহিনীর সঙ্গে টক্কর দিতে এরাই পারবে। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। বিশ্বজিৎ তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

অস্বস্তির কাটাটা তবু দূর হচ্ছিল না। বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই অর্কর মোবাইল বেজে উঠল। অন করতেই শুনতে পেল, আপনি কোথায়?

হঠাৎ মন শান্ত হয়ে গেল। অর্ক বলল, বেলগাছিয়া। আপনি?

আর জি কর হাসপাতালে। একজন সহকর্মীকে দেখতে এসেছিলাম। এখন কি হাতে সময় আছে? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

.

৪৫.

শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের নির্বাচনী জনসভায় তৃণমূলের বক্তৃতা চলছে। বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে তৃণমূলের মিছিল নিপাত যাক নিপাত যাক ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এসেও মুখ ঘুরিয়ে খালের দিকে চলে গেল।

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিস্টের একটি চায়ের দোকানে মুখোমুখি বসে কুন্তী হাসল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন হয়েছিল তখন কীরকম চিৎকার দুপক্ষ করেছিল বলে আপনার মনে হয়?

এই দোকানে ভরসন্ধ্যাতেও চায়ের সঙ্গে টোস্ট পাওয়া যায়। কারণটা জানা নেই, উত্তর কলকাতার বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানে যেমন বিকেল বেলায় জিলিপি তৈরি করে বিক্রি করা হয় না তেমনি চায়ের দোকানদাররা ওই সময় টোস্ট বিক্রি না করে চপ কাটলেট বিক্রি করতে পছন্দ করেন। চা-টোস্টের অর্ডার দিয়ে প্রশ্নটা শুনতেই হেসে ফেলল অর্ক, যুদ্ধের সময় নিশ্চই দুপক্ষই হুংকার দিত কিন্তু বিকেলে যখন যুদ্ধ স্থগিত রাখা হত ভোর অবধি, তখন একসঙ্গে গল্প করত সবাই।

কুন্তী মাথা নাড়ল, ঠিক। আমরা অনেক পালটে গিয়েছি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এদিকে এসেছিলেন বলে আমার কথা মনে এল?

না। এদিকে এসেছিলাম বলে আপনাকে ফোন করলাম। মনে আসলেই যদি ফোন করি তা হলে কেন করলাম তার কৈফিয়ত দিতে হয়। তাই করিনি। কুন্তী বলল, আমার ফোন পেয়ে অবাক হয়েছেন?

একটু। কারণ অনেক আগেই ফোনটা আশা করেছিলাম। বলুন, খবর কী? অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল।

কুন্তী কপালে চলে আসা চুল পেছনে সরিয়ে বলল, ব্যান্ডেলের বাস চুকিয়ে দিলাম।

তার মানে? ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন?

না। চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম। কুন্তীর মুখ গম্ভীর।

কিছু হয়েছিল?

হ্যাঁ। আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশিরকম নাক গলাচ্ছিলেন। সহ্য করে ছিলাম। নতুন সেক্রেটারি এসে তার সীমা পেরিয়ে গেলে ছেড়ে এসে স্বস্তিতে থাকতে পারলাম। কুন্তী বলল, এখন কলকাতার বাড়িতে?

হ্যাঁ। বাড়িতেই ছেলেমেয়েদের পড়াব। তাতে দিব্যি চলে যাবে। মায়ের মনে একটা ক্ষোভ ছিল আমি বাইরে থাকি বলে, সেটাও চলে গেল। কুন্তী বলল, আপনার খবর বলুন।

চা আর টোস্ট এসে গেল। টোস্টের প্লেট কুন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে অর্ক বলল, চাকরিটা যেতে যেতে যায়নি বলে এখনও করে যাচ্ছি। যে ব্যাপারটা থেকে চিরদিন দূরে থাকতাম তা আর না থেকে সামনের নির্বাচনে একটি দলকে সমর্থন করছি। ভোট হয়ে গেলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাব।

অর্থাৎ আবার শামুকের মতো খোলের আড়ালে গুটিয়ে থাকবেন?

যা ইচ্ছে বলতে পারেন।

সমর্থন করছেন, তা মনে মনে নাকি সক্রিয় হয়ে?

কিছুটা সক্রিয় হয়েছি। না হলে নির্বাচনী সভাগুলোতে যাব কেন?

বেশ। যাঁদের সমর্থন করছেন তারা যদি ক্ষমতায় আসেন তা হলে তাদের পাশে থেকে দেখবেন না, যে কারণে সমর্থন করেছিলেন তা বাস্তবে হচ্ছে কিনা! কুন্তী তাকাল।

অর্ক হাসল, আমি কোন দলের সমর্থক তা আপনি বুঝে গেলেন?

স্বাভাবিক। বামফ্রন্টের প্রয়োজন নেই আপনাকে। এই নির্বাচনে কী হবে তা ওরা ভালভাবেই জানে। আপনি তৃণমূল নেত্রীকে সমর্থন করছেন। নির্বাচনে ওঁর জয়ের সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ। আমি জ্যোতিষী নই। সাধারণ মানুষের কথা শুনেই বলছি। তবে আপনি সমর্থন করেছেন বলে একটা সুবিধে পাবেন। আগামী পাঁচ বছর নিরাপদে বাস করতে পারবেন। কুন্তী বলল।

নইলে বিপদে পড়তাম? বাঁকা গলায় প্রশ্ন করল অর্ক।

দেখুন আমি রাজনীতি বুঝি না। বাবা একমাত্র রাজনীতি করতেন। পরে যখন রিয়েলাইজ করলেন তখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেন। এমনিতেই বাঙালি মেয়েরা রাজনীতি করতে চাইলে পরিবার থেকে তুমুল আপত্তি ওঠে। বাবার ব্যাপারটা আমাকেও রাজনীতি বিমুখ করেছিল। কিন্তু চোখ ভোলা থাকলে যা দেখা যায় তা কল্পনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একজন ভদ্রমহিলার ওপর যদি নির্ভর করে তা হলে তা বহন করতে হবে তাকেই। সেই হিমালয়ের চেয়ে ভারী বোঝার সঙ্গে তাকে সামলাতে হবে নির্বাচিত বিধায়ক থেকে পাড়ার নেতাদের যারা প্যারাসাইটের মতো তারই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ভেবে নেবে আমরাই রাজা। খুব কঠিন কাজ। বাবার মুখে শুনেছিলাম, সাতষট্টির নির্বাচনের আগে প্রবীণ কংগ্রেসি নেতারা বলতেন, আমরা তো খেয়ে দেয়ে ফুলে ফেঁপে গেছি, আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু কমিউনিস্টরা তো উপোসি ছারপোকার মতো শুকিয়ে আছে, ক্ষমতায় এসে খাওয়া ছাড়া অন্য চিন্তা করবে না। ভয় হয় নেত্রী যা চাইছেন তা তাঁর অনুগামীরা না শুনে ওই খাওয়ার পথে না চলে যান। সেরকম হলে বিপদ তো অনিবার্য। কুন্তী খুব সিরিয়াস গলায় কথাগুলো বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল। আপনি ভুল করছেন। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সময় অনেক নোংরা ভেসে আসে। পুরনো যা তা ভেঙে চুরমার করে জল যখন থিতিয়ে যায় তখন ওই নোংরাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আপনি খুব আশাবাদী। সেরকম হলে আমিও খুশি হব। কুন্তী বলল। চা শেষ করেই সে মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা তখন থেকে শুধু রাজনীতির কথা বলে যাচ্ছি কেন? আমরা কি অন্য বিষয়ে কথা বলতে পারি না?

সামান্য দূর থেকে ভেসে আসা গরম বক্তৃতা, স্লোগান আচমকা থামতেই কুন্তী নিজেই জবাব দিল, ওঃ, শান্তি! ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো ওটা বেজে চলছিল বলে আমরাও প্রভাবিত হয়েছি। ঘড়ি দেখল সে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বললে আসবেন?

নিশ্চয়ই। অর্ক বলল।

নির্বাচনের পরে?

না না। যে-কোনও দিন। অর্ক পকেটে হাত ঢোকাল। কুন্তী মাথা নাড়ল।

না। আমি দেব। কারণ আমার ফোন পেয়ে আপনি এসেছেন।

অর্ক ওয়েটারের রেখে যাওয়া প্লেটে টাকা দিয়ে বলল, আপনি-আমি করবেন না তো!

আচমকা শব্দ করে হেসে উঠল কুন্তী। অর্ক অবাক হয়ে তাকাল। হাসি শেষ হলে কুন্তী বলল, গোটা পশ্চিমবঙ্গ যেখানে আমরা-ওরা-তে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন আপনার গলায় অন্য কথা কেন?

অর্ক উত্তর দিল না। কুন্তী বলল, এবার বলুন। ওরা দোকানের বাইরে পা রাখামাত্র আবার স্লোগান শুরু হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কী মনে হচ্ছে এসব শুনে?

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। কুন্তী বলল।

কুরুক্ষেত্রে? অর্ক চোখ বড় করল।

হ্যাঁ। পাণ্ডব বনাম কৌরবদের। কুন্তী বলল, সে সময় ভারতবর্ষ দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুভাগ হয়ে দুপক্ষকে সমর্থন করেছিল।

তারপর?

অত্যাচারীর পতন হয়েছিল। শুভ ইচ্ছার জয় হয়েছিল।

এখন?

আমি তো জ্যোতিষী নই। তবে পড়েছি, ইতিহাস কথা বলে। ঘুরে ফিরে আসে। সেটা এবারও হতে পারে।

তার অর্থ হল বামফ্রন্টের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী?

হতেই পারে। কিন্তু তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলে সীমাবদ্ধ। কুন্তী হঠাৎ ব্যস্ত হল, এখন এদিকে বাস চলছে না বলে মনে হচ্ছে। আমি পাতাল রেলে ফিরে যাই। স্টেশনটা কোথায়?

এই তো, ওপাশের রাস্তায়। চলুন। অর্ক এগোল। ভিড়ের ফুটপাত দিয়ে ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পৌঁছে পাতাল রেল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা উচ্ছ্বসিত চিৎকার কানে এল, এই কুন্তী।

কুন্তী দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাতেই মহিলা প্রায় দৌড়ে এলেন, সঙ্গে বছর পাঁচেকের বালক। বললেন, কী রে! তুই এখানে? উঃ, কতকাল পরে তোকে দেখলাম। একদম আগের মতো সুন্দর আছিস তুই। আর দ্যাখ, আমি কীরকম বুড়ি হয়ে গিয়েছি। প্রায় ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে গেলেন মহিলা।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাসল কুন্তী, শিপ্রা!

এই দ্যাখ, তোর চিনতে সময় লাগল! লাগবেই বা না কেন? সিজার হয়েছিল, তারপর থেকেই শরীরটা ভেঙে গেল। গলা নীচে নেমে গেল মহিলার, তলপেটের চর্বি কিছুতেই কমছে না। তোর বর?

না গম্ভীরমুখে বলল কুন্তী।

উড বি? বলেই মহিলা বলল, যাক গে, এখনও বিয়ে করিসনি, খুব ভাল করেছিস। তুই তো সাউথে থাকতিস?

হ্যাঁ। এখনও সেখানে আছি।

তুই একবার আমাদের বাড়িতে আয়। এই তো কাছেই! আচ্ছা এখন না। ইলেকশনের রেজাল্ট বের হওয়ার পর আসবি। তোর মোবাইলের নাম্বার দে।

তোর বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে ইলেকশনের রেজাল্টের কী সম্পর্ক? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

এই যাঃ। তোকে বলা হয়নি। আমার শ্বশুরবাড়ি তো মেদিনীপুর। ওর বাবা সেখানকার একটা আসনে তৃণমূলের ক্যান্ডিডেট হয়েছে। এই প্রথম দাঁড়াল। হারার কোনও চান্স নেই। সব পাবলিক তো তৃণমূলকেই ভোট দেবে। তার পরে আয়।

তখন এম এল এর বউ হয়ে স্পেশ্যাল খাতির করবি?

অর্ক দেখল মহিলার চোখেমুখে খুশি ছড়িয়ে গেল।

কুন্তী বলল, চলি।

নাম্বারটা দে?

কুন্তী নাম্বারটা বললে মহিলা তার মোবাইলে সেটা সেভ করে নিল, খুব ভাল লাগল রে। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে মশাই,

আপনিও আসবেন।

কুন্তী হটতে আরম্ভ করেছিল, জবাব না দিয়ে অর্ক তার সঙ্গী হল। পাতালরেলের দরজায় পৌঁছে কুন্তী জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলেন?

কোন ব্যাপারে?

শিপ্রাকে দেখে? আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। বহু বছর পরে দেখা। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে ও ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো আমাকে জানিয়ে দিল।

মহিলা সম্ভবত খুব সরল।

না। সরল নয়, তরল হয়েছে। এম এল এর বউ হবেই এই আনন্দে। আপনাকে দেখে আমার সঙ্গে যে সম্পর্কটা বানিয়ে নিল তা বাঙালি বউদের মাথায় প্রথমে আসে।

আপনি তো সেটা ভেঙে দিলেন।

তাতে দমে যায়নি। বর্তমানে যখন নয় তখন ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বলে ভাবল!

আপনি খুব বিরক্ত হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মেয়েরা এসবের বাইরে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ভাববে না কেন? এই একুশ শতকে? তা হলে ঠাকুমা দিদিমাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? যাক গে, কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে?

যাব।

নিশ্চয়ই বলবেন না ইলেকশনের রেজাল্ট বের হলে যাব?

হেসে ফেলল অর্ক, না। অবশ্যই না।

তা হলে এলাম। কুন্তী নেমে গেল পাতালের সিঁড়ি বেয়ে। অর্ক সেদিকে তাকিয়ে ভাবল একবার হয়তো মুখ ফিরিয়ে তাকাবে, কিন্তু তাকাল না।

ফুটপাতে না নেমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অর্ক। এখন কলকাতায় রাত নেমে গেছে। সন্ধের মুখে যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে তখন চারধার যেরকম ঝকমকিয়ে ওঠে, রাত বাড়লে তা ক্রমশ নেতিয়ে যায়। একটা হলদেটে ভাব ফুটে ওঠে।

এতক্ষণ বেশ কেটে গেল। কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগছিল। এই যে কুন্তী উত্তর কলকাতায় এসে তাকে মনে করে ডেকে নিল, গল্প করল, তার কারণ কী? এই অঞ্চলে কি ওর অন্য কোনও পরিচিত মানুষ নেই? না থাকলেও তাকে কেন ডাকবে? কাজ শেষ করে ফিরে যেতেই পারত!

তাড়াহুড়োয় কাজে যাওয়ার সময় যে মোবাইলটা নিয়ে আসা হয়নি তা অর্ক টের পেল বেলা বারোটা নাগাদ। প্রথমে মনে হয়েছিল বাসে পকেটমার হয়ে যায়নি তো! তার মোবাইল প্রিপেইড। ব্যালেন্স বেশি ছিল না। হারিয়ে গেলে থানায় গিয়ে ডায়েরি করাই নিয়ম। অর্কর মনে হল সেটাও একটা ঝামেলা। তারপরেই খেয়াল হল, বাড়িতে ফেলে আসেনি তো? সে ল্যান্ডলাইন থেকে মাধবীলতার মোবাইলে ফোন করল।

মাধবীলতার সাড়া পেলে জিজ্ঞাসা করল, মা, দ্যাখো তো আমি সেলফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি কিনা!

হ্যাঁ। দুটো ফোন এসেছিল। তাতেই জানতে পারলাম। মাধবীলতা বলল।

কারা ফোন করেছিল?

প্রথমটা একটা মেয়ের ফোন ছিল। নাম বলল কুন্তী। বলল তোর সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল। বেশ ভালভাবে কথা বলল মেয়েটি। কবে আলাপ হল?

বেশিদিন নয়। ওর বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন, মারা গিয়েছেন। বাবাকে চিনতেন। কুন্তী স্কুলে পড়াত। এখন সেটা ছেড়ে বাড়িতে ছেলে মেয়েদের পড়াবে। বলেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্বিতীয় ফোনটা কার?

আমি জানি না।

তুমি ধরোনি?

না। ধরলে তো বলতেই পারতাম। তোর বাবা ধরেছিল। কথা বলেছিল।

কার সঙ্গে কথা বলেছিল?

আমাকে বলেনি।

ঠিক আছে, বাবাকে দাও ফোনটা।

তোর বাবা বাড়িতে নেই।

কোথায় গেছে?

মোবাইলে কথা বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, আমি আসছি, দেরি দেখলে তুমি খেয়ে নিয়ো। মাধবীলতা বলল, প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে।

মোবাইলটা কোথায়?

সঙ্গে নিয়ে গেছে।

প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল অর্কর। কুন্তীর ফোন নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। গতকাল ফিরে যাওয়ার পর ভদ্রতা করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ফোনটা কে করেছিল? নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নইলে কথা বলার কিছুক্ষণ পরে বাবা বাড়ির বাইরে যাবে কেন? ইদানীং বাবা বড়জোর গলির ভেতরের কাকার দোকান অবধি যায়, ঈশ্বরপুকুর লেনের বাইরে কখনওই নয়। শরীরের জন্যে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি মন চায় না বলেই যেতে পারে না। তা হলে?

অর্ক ল্যান্ডলাইনে নিজের নম্বর ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল ওটা সুইচ অফ করে রাখা হয়েছে।

কাজে মন দিতে পারছিল না অর্ক। তার মনে হচ্ছিল যে ফোন করেছিল সে নিশ্চয়ই বাবাকে ডেকে নিয়ে গেছে। বাবার কোনও পরিচিত মানুষ তার মোবাইলে বাবাকে চাইবে না। তা হলে যে ফোন করেছিল সে তারই পরিচিত। লোকটা কি সুরেন মাইতি? তার নাম্বার পেতে লোকটার একটুও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাকে না পেয়ে সুরেন মাইতি বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী বলতে পারে? কেন অর্ককে তৃণমূলের নির্বাচনী সভায় দেখা যাচ্ছে তার কৈফিয়ত চাইবে? অর্ক নিশ্চিত এর উত্তর বাবা ঠিকঠাক দিতে পারে।

কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে অর্ক দেখল মাধবীলতা বস্তির কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে, অর্ক তাদের এড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে মহিলারা বেরিয়ে গেলে মাধবীলতা দরজা বন্ধ করলে অর্ক বারান্দায় এল, বাবা এখনও ফিরে আসেনি?

না। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

আশ্চর্য! কোথায় গেছে?

দুপুরে ফোন করেছিল। বলল ফিরতে দেরি হবে।

আমি ফোন করেছিলাম তখন মোবাইল বন্ধ ছিল। অর্ক বলল।

ও।

তুমি এমন নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলছ? বাবা কি কখনও এভাবে এতক্ষণ কোথাও গিয়েছে? অর্ক উষ্ণ হল।

তোর বাবা ছেলেমানুষ নয়। সে বাইরে গিয়েছে, ফোনে খবর দিয়েছে আসতে দেরি হবে। তারপরে আমি খবরদারি করতে যাব কেন? মাধবীলতা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুই হঠাৎ এত চিন্তিত হয়ে পড়লি কেন?

অর্ক জবাব দিল না। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। এতদিন পরে মা এরকম নির্লিপ্ত হয়ে গেল কী করে?

৪৬-৫১. অনিমেষ বাড়িতে ফিরে এল

অনিমেষ বাড়িতে ফিরে এল রাত আটটায়। হাতমুখ ধোওয়ার পরে মাধবীলতা খাবার দিল।

খাওয়া শুরু করে অনিমেষ মাধবীলতাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নিশ্চয়ই খুব কৌতূহল হচ্ছে, আমি কোথায় গিয়েছিলাম তা জানতে?

এই খবরটা তোমাকে কে দিল? মাধবীলতা তাকাল।

মানে? আমি একটি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলার পাঁচ মিনিট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। বলেছি ফিরতে দেরি হবে। মাঝে ফোনে তোমাকে খবর দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে এত টায়ার্ড ছিলাম যে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে পারিনি। অনিমেষ বলল।

তুমি এভাবে কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল। অনিমেষ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অর্কই মুখ খুলল, তুমি তো শরীরের কারণে বাইরে যাও না। আমাকে যারা ফোন করে তাদের বেশির ভাগকেই তুমি চেনো না, অথচ শুনলাম ফোনে কথা বলার পরেই বেরিয়ে গেছ। কে ফোন করেছিল তা বলবে?

মোবাইলে তার নাম্বার দেখিসনি?

ওটা তো তোমার সঙ্গে ছিল। এখনও ফেরত দাওনি। অর্ক বলল।

অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, টেবিলের ওপর মোবাইলটা রাখা আছে, এনে দেবে?

মাধবীলতা খাওয়া ছেড়ে ঘরে গিয়ে সেটা এনে অর্ককে দিল। ওটা এখনও সুইচ অফ করেই রাখা আছে। সেট অন করে বাঁ হাতের আঙুলের চাপে রিসিভড কলগুলো দেখতে গিয়ে চমকে উঠল।

অনিমেষ খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পেরেছিস?

রামজি ফোন করেছিল! হঠাৎ? অর্ক মাথামুন্ডু বুঝতে পারছিল না।

সে তোর বন্ধু। এই বাড়িতে আমাদের অনুপস্থিতিতে তাকে তুই আশ্রয় দিয়েছিলি। তুই তো ভাল বলবি সে কেন ফোন করেছে? হঠাৎ হবে কেন? অনিমেষ বলল।

আমার সঙ্গে ইদানীং কথা হয়নি। ও কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল? আর চাইলেই তুমি বেরিয়ে গিয়ে দেখা করবে কেন? অর্ক গম্ভীর হল।

তুই যদি ওকে নিয়ে বোলপুরে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে পারিস আমি সামান্য দূরত্বে গিয়ে কথা বলতে পারব না কেন? অনিমেষ তাকাল।

রামজি কি এখন কলকাতায়?

ও যদি খগপুরে থাকত তা হলে কি আমি সেখানে যেতে পারতাম?

বাবা, তুমি স্পষ্ট কথা বলছ না কেন?

দ্যাখো অর্ক, তুমি স্পষ্ট কথা বলতে যা বোঝাতে চাইছ তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই, ভাবছ কেন? অনিমেষ বিরক্ত হল।

বেশ। রামজি কি কলকাতায় এসেছে? সরাসরি জিজ্ঞাসা করল অর্ক।

হ্যাঁ। সে এই শহরে না এলে আমি কথা বলতে যেতাম না।

কিন্তু তুমি খুব ঝুঁকি নিয়েছ। রামজিকে পুলিশ খুঁজছে। অর্ক বলল।

তুমি যখন তাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলে, যখন তাকে নিয়ে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছিলে তখনও তো পুলিশ খুঁজছিল।

কোথায় আছে রামজি?

কেন?

কিছুই না। কৌতূহল হচ্ছে তাই জিজ্ঞাসা করছি।

তোমাকে তো থানার বড়বাবু বলেছিলেন রামজির খবর পাওয়ামাত্র তাকে জানিয়ে দিতে। কারণ পুলিশের মতে সে মাওবাদী। কিন্তু তোমাদের নেত্রী তো বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। তা হলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? অনিমেষ নিজের ঘরের দিকে এগোল।

ছেলেটা যখন এখানে ছিল তখন তুই জানতিস না ও কোন রাজনীতি করে? এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাধবীলতা প্রশ্নটা করল।

রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা আমাদের মধ্যে হয়নি।

তা হলে তুই কীভাবে বুঝলি ও মাওবাদী?

একসঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝে গিয়েছি। ওর বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। কিন্তু সুন্দরবন দিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে কোথাও যেতে চাইছিল। সেটা বাতিল হওয়ার পর দিঘার কাছে তালসারিতে চলে গেল। সেখানে সমস্যা হওয়ায় আবার কলকাতায় ফিরে এসে আমার কাছে আশ্রয় চাইল। আমি বুঝেছিলাম ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এলে বিপদে পড়ব। আবার ও এত ভদ্র ব্যবহার করেছে যে এড়িয়েও যেতে পারছিলাম না। ওকে নিয়ে গেলাম বোলপুরের কাছে একটা আশ্রমে। কোথাও ওকে রাজনীতির কথা বলতে শুনিনি। এমনকী মোবাইলে খবর পেয়ে ও যখন খড়গপুরে চলে গেল তখন বেশ স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়েছিল। তৃণমূলের নেত্রীকে রাজনীতি করতে হয়। তার সব কথার চুলচেরা বিচার করা ভুল হবে। অর্ক একটানা বলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমার এখনও বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে যে আদর্শহীন কিছু লোককে জুটিয়ে নিয়ে একজন ব্যক্তি শুধু তার আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস দেখা গেলে মিলিটারির মদতে বলীয়ান হয়ে ডিক্টেটাররা সেটা করতে পেরেছেন। এমনকী মাও সে তুং, হো চি মিনের মতো ব্যক্তিত্বও ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি। যদি তাও সম্ভব হয় তা হলে তোমার কি ধারণা ক্ষমতায় এলে মাওবাদী বলতে যাদের বোঝা হচ্ছে তারা অস্ত্র ফেলে রেখে নেত্রীর অনুগামী হবে? আর একটিও খুন জঙ্গলমহলে হবে না? যাক গে, অর্ক, যদি রামজি নিজে থেকে যোগাযোগ করে তা হলে তুমি জানতে পারবে কিন্তু আমি তোমাকে তার ঠিকানা জানাতে পারব না।

কেন?

আমরা যখন জলপাইগুড়িতে ছিলাম তখন তুমি রামজির ব্যাপারটা আমাদের জানাওনি। এখন তুমি যে দলের সমর্থক, তোমার যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে আমার কাছ থেকে খবরটা তুমি পেলে রামজি যদি বিপদে পড়ে তা হলে নিজেকে কী বলব? আমার শরীর ভাল নেই, শুয়ে পড়ছি। অনিমেষ ঘরে ঢুকে গেল।

অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখল মাধবীলতা এরই মধ্যে রান্নাঘরে চলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে একা। এই সময় উঠোনের ওপাশের দরজায় শব্দ হল। কেউ মৃদু আঘাত করছে। একটু এগিয়ে গিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কে?

অর্কদা আমি সলিল। দরজা খুলুন, খুব জরুরি। চাপা গলা ভেসে এল।

একটা দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলল অর্ক। যে অল্পবয়সি ছেলেকে সামনে সে দেখতে পেল তাকে আগেও বিশ্বজিৎদের সঙ্গে দেখেছে। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

বিশ্বজিৎদা বলে পাঠাল আপনি যেন আজ রাত্রে ঘরে না থাকেন।

কেন?

সুরেন মাইতিরা আবার হামলা করতে পারে। আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।

দরকার নেই। বিশ্বজিৎকে বলো চিন্তা না করতে।

ওরা বাইরে থেকে ছেলে এনেছে অর্কা! ছেলেটি বেশ উত্তেজিত।

ঠিক আছে। দাঁড়াও।

অর্ক ভেতরে ফিরে গিয়ে মাধবীলতাকে বলল, মা, দলের ছেলেরা এসে ডাকছে। একটা জরুরি মিটিং আছে। তুমি শুয়ে পড়ো।

মাঝরাতে এসে ঘুম ভাঙালে বাকি রাত জেগে বসে থাকতে হবে। মাধবীলতা গম্ভীর মুখে বলল।

মাঝরাত হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাব।

যা ভাল বোঝো তাই করো!

বোঝো শব্দটা কানে লাগল। দূরত্ব বাড়াতে মা তুই থেকে তুমিতে উঠে যায়। ছেলেটির সঙ্গে চায়ের দোকানের কাছে পৌঁছে দেখল সেখানে বিশ্বজিত্রা জটলা করছে। বারো-চোদ্দোজন মানুষ বেশ উত্তেজিত। অর্ককে দেখে বিশ্বজিৎ এগিয়ে এল, দাদা, ওরা আজ রাত্রে আমাদের ওপর হামলা করতে চাইছে। বাইরে থেকে প্রচুর ছেলে আনবে, কিছু এসে গিয়েছে। আমরা ঠিক করেছি প্রতিরোধ করব। আজকের রাত্রে কেউ ঘুমাব না।

কিন্তু ওরা হামলা করবে কেন?

বুঝতে পেরেছে পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে তাই। নির্বাচনের আগে আমাদের কর্মীদের যদি হাসপাতালে পাঠাতে পারে তা হলে ওদের সুবিধে হবে। আপনি আজ আমাদের সঙ্গে থাকুন। বিশ্বজিৎ বলল।

পুলিশকে জানিয়েছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বড়বাবু নাকি অসুস্থ। সেজবাবু ছোটবাবুরা গৌরাঙ্গ হয়ে গেছেন।

তার মানে?

মাথার ওপর হাত তুলে দিয়েছেন। বলছেন গিয়ে সামাল দিতে গেলে সুন্দরবনে বদলি করবে বর্তমান সরকার আর সামাল না দিলে দার্জিলিং-এ পাঠিয়ে দেবে আগামী সরকার। তার চেয়ে না যাওয়াই ভাল। বুঝুন! বিশ্বজিৎ বলল।

ওরা যদি অস্ত্র নিয়ে মারপিট করে? অর্ক চিন্তিত।

আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে আবেদন জানিয়েছি ঠিক এগারোটা বাজলেই সবাই যেন ঘরে ঘরে জেগে থাকেন। প্রয়োজন হলে তারা বাইরে বেরিয়ে আসবেন। এত লোক দেখলে যত অস্ত্র হাতে থাক কেউ সাহস পাবে না এগোতে। কথাগুলো বলে বিশ্বজিৎ চলে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে থামাল অর্ক। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সুরেন মাইতি কোথায়?

জানি না।

বাড়িতে নেই?

বোধহয় না। হয়তো থানায় গিয়ে বসে আছে।

আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মানে?

ওঁর সঙ্গে কথা বলে যদি এই ঝামেলাটা বন্ধ করা যায়, আমার মনে হয় সেই চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত। অর্ক বলল।

বিশ্বজিৎ কাধ নাচাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। আজ রাতে এখানে একটা নাটক হবে জেনে সবাই দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। এরা সেইসব মানুষ যারা যে চোখে বিসর্জনের মিছিল দেখে সেই চোখে মাস্তান বাহিনীর ঝগড়া, মারপিট দেখে তৃপ্ত হয়।

অর্ক ভিড় ছাড়িয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির কাছে এসে দেখল বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই সময় বিছানায় চলে যায় কিন্তু সুরেন মাইতি সাধারণ নয়। ইতস্তত ভাব কাটিয়ে অর্ক বারান্দায় উঠে দরজায় কড়া নাড়ল। দ্বিতীয়বারে ভেতর থেকে সাড়া এল। একটি মহিলা জানতে চাইলেন কে কড়া নাড়ছে। অর্ক নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলতে চায়।

মহিলা বললে, ও তো বাড়িতে নেই।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছেন?

হাসপাতালে।

কোন হাসপাতালে?

পিজি হাসপাতালে।

কারও কিছু হয়েছে?

ওর মায়ের খুব অসুখ, তাই।

অর্ক সরে এল। এই মহিলা কে এবং তিনি সত্যি কথা বলছেন কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। সুরেন মাইতি বাড়িতে থেকে মহিলাকে মিথ্যে কথা শিখিয়ে দিতেই পারে।

মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে মানুষের ঔৎসুক্য উবে গেল। কোনও নাটক হল না, হারে রে আওয়াজ করে অস্ত্র নিয়ে কোনও দল ধেয়ে এল না যখন, তখন দর্শকরা যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেল। বিশ্বজিৎ এবং তার সঙ্গীরা তখনও অনড়। এই সুযোগটা নিশ্চয়ই নেবে সুরেন মাইতির বাহিনী। শেষরাত্রে হানা দিলে কোনও বাধা পাবে না বলে অপেক্ষা করছে তারা।

কিন্তু রাতটাও ফুরিয়ে গেল। খুব হতাশ দেখাচ্ছিল বিশ্বজিৎদের। অর্ক বেরিয়ে এল ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে। সামনেই বাসস্টপ। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই বাস পেয়ে গেল। ওটা যাবে প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের দিকে, পিজি হাসপাতাল হয়ে।

ভোরের পিজি হাসপাতাল প্রায় মর্গের মতো চুপচাপ। কোনও জীবন্ত মানুষ বাড়িগুলোর বাইরে নেই। শুধু ইমারজেন্সি লেখা ঘরটার সামনে কয়েকটি শরীর তখনও নিদ্রামগ্ন। আধঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে সুরেন মাইতির হদিশ পেল না অর্ক। গেটের বাইরে এসে ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় চা কিনে খেতে খেতে ভাবল, মহিলাকে দিয়ে কাল রাত্রে মিথ্যে বলিয়েছে সুরেন। মাইতি।

চায়ের দাম দিতেই ওপাশ থেকে একজন বলল, আপনি এখানে?

সে মুখ ফিরিয়ে ছেলেটিকে চিনতে পারল, সুরেন মাইতির একটি ছায়া।

ছেলেটি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কেউ কি অসুস্থ?

না। শুনলাম সুরেনবাবুর মা নাকি এখানে ভরতি হয়েছেন, তাই অর্ক থামল।

হ্যাঁ। হয়েছিলেন। ছেলেটি মাথা নাড়ল।

সুরেনবাবু কাল রাত্রে এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ। তিনটের সময় মাসিমা চলে গেছেন। দাদা খুব ভেঙে পড়েছেন। আরও একটু বেলা হলে সবাই এসে পড়বে। তখন এখান থেকে নিমতলায় নিয়ে যাব।

অর্ক ঢোক গিলল।

আপনি দাদার কাছে যাবেন?

চলো।

পার্কের পেছন দিকে পাঁচজন মানুষের মধ্যে বসে ছিল সুরেন মাইতি। অর্ককে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। অর্ক কাছে এসে বলল, শুনলাম!

কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই না। বলতে বলতে চোখ মুছল সুরেন।

অর্ক বলল, শক্ত হন, ভেঙে পড়বেন না।

আপনি, আপনি যে আসবেন তা আমি ভাবতেই পারছি না। অর্কর হাত ধরল সুরেন মাইতি, কী বলে ধন্যবাদ জানাব।

কথা না বাড়িয়ে অর্ক বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। ঠিক তখনই পকেটে রাখা যন্ত্রটা বেজে উঠল। ওটা বের করে অবাক হল সে। বোতাম টিপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞাসা করল, বলুন রামজি!বলামাত্র লাইন কেটে গেল। তৎক্ষণাৎ ডায়াল করল অর্ক। অন্তত চারবার। প্রতিবারেই রেকর্ড বাজল, আউট অফ রিচ।

অর্ক অপেক্ষা করতে লাগল, নিশ্চয়ই আবার ফোনটা বেজে উঠবে।

.

৪৭.

টেলিফোনটা বাজল কিন্তু অর্ক দেখল নাম্বারটা অচেনা। ল্যান্ডলাইন থেকে কেউ কল করেছে। সে সাড়া দিতেই কুন্তীর গলা কানে এল। কী করছেন? এখন তো আপনাদের ভাল থাকার কথা।

অর্ক হাসল, আমাদের মানে?

ছাড়ুন। শুনুন, আমি একটা অফার পেয়েছি। ভাবছি, অ্যাকসেপ্ট করব। কুন্তী বলল, আপনি কী বলেন?

আমি তো কিছুই জানি না, কী উত্তর দেব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ওহো! আজ কীরকম ব্যস্ত আছেন? আসুন না কথা বলি।

বেশ তো। কোথায়?

আমাদের বাড়িতেই আসুন। মা তো আপনাদের কথা জানে। একটু দূর হবে, আসতে আপত্তি নেই তো?

উত্তর থেকে দক্ষিণ, এমন কী দূর! নিশ্চয়ই যাব।

কুন্তী তাকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে যেতে হবে। ঠিক হল কাজের পরে অর্ক সোজা পাতাল রেল ধরে চলে যাবে।

সারাদিন ধরে অন্য অস্বস্তি। মোবাইলে সেই কলটা এল না। অস্বস্তি বাড়িতেও। অর্ক বুঝতে পারছিল তারা তিনজন এখন প্রায় তিনটে দ্বীপের মতো। অনিমেষ অতিরিক্ত চুপচাপ, বাড়ির বাইরে এখন একদম বের হয় না। মা মুখ বুজে সংসারের কাজ করে যাচ্ছে। অর্কর সঙ্গে কথা বলে দুবেলা খাবার দেওয়ার সময়ে। বাকি সময় বই নিয়ে বসে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কুন্তীর ফোন শীতল বাতাসের আরাম দিল অর্ককে।

এখন নির্বাচনী প্রচার বন্ধ। পশ্চিমবঙ্গ যেন সুচের ওপর দাঁড়িয়ে। সমস্ত মিডিয়া বুঝতে পারছে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাবনাটা ভুল হয়ে যেতেও তো পারে। বিরোধী নেত্রী তাঁর শেষ নির্বাচনী সভার পরে বলেছেন, আর পশ্চিমবাংলায় দলতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে রাজ্য চলবে। মানুষের জীবন যাতে একটু সুস্থভাবে চলে তার জন্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তার প্রথম কাজ হবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। চৌত্রিশ বছরের বাম কুশাসনের অবসান হলে তিনি কোনওরকম বদলার রাজনীতি করবেন না।

অর্ক এই প্রতিশ্রুতিতে খুব খুশি হল। কলকাতাকে লন্ডন বা দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড করা সম্ভব নয় তা যে-কোনও শিশুও জানে। কিন্তু কথাটাকে সাধারণ অর্থে নিলে ভুল হবে। নেত্রী বলতে চেয়েছেন ওই দুই জায়গার মতো উন্নত এবং সুন্দর চেহারা তিনি দিতে চাইবেন। বিরোধীরা সেটা বুঝেও অপব্যাখ্যা করছে। যদিও অর্কর কাজের দফতরের প্রধান ঠাট্টা করেছিলেন, আমি তো দুবার লন্ডনে গিয়েছি। কলকাতাকে যদি লন্ডন করে দেওয়া হয় তা হলে সেটা হবে খুব দুর্ভাগ্যের। কারণ লন্ডনের রাস্তায় নোংরা পড়ে থাকতে দেখেছি, ছেঁড়া কাগজ উড়ছে ফুটপাতে। চারপাশে ঘিঞ্জি এলাকা। ট্রাফালগার স্কোয়ারের চারপাশে প্রায় সবসময় ট্র্যাফিক জ্যাম হয়ে থাকে। একশো বছর আগের লন্ডন আর এখনকার লন্ডনের মধ্যে কোনও মিল নেই। হয়তো ভদ্রলোক ঠিক বলেছেন। কিন্তু অর্কর মনে হচ্ছিল, শহরটা নয়, লন্ডন নামটার যে মাহাত্ম আছে তার কথাই ভেবে বলেছেন নেত্রী। বিশ্বজিত্রাও তাই বলেছিল। এখন ওরা খুব টেনশনে রয়েছে। কথা বলতে এসেছিল বিশ্বজিৎ, অর্কা, যা ভাবছি তা হবে তো? না হলে সুরেন মাইতির দল আমাদের পাড়া ছাড়া করবে।

আমি নিশ্চিত, এবার পরিবর্তন হবেই। অর্ক বলল।

কেন? কেন আপনি এত নিশ্চিত? বিশ্বজিৎ তাকাল।

এই প্রথম এত বড় একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যিনি তিনি মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত বা ধনী পরিবার থেকে রাজনীতি করতে আসেননি। তাঁর সাজ পোশাক এমনকী পায়ের চটিও বাংলার সাধারণ গরিব মানুষের অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই প্রথম সান অব দ্য সয়েল হাল ধরেছেন আন্দোলনের। কথাটা পালটে ডটার অফ দ্য সয়েল বলাই ঠিক। মানুষ তো চোখ খুলে এটা দেখছে। তাই ঘরের মানুষের সঙ্গেই এবার রাজ্যের মানুষ থাকবে। দেখে নিয়ে। অর্ক বলল।

আপনার কথা যেন ঠিক হয় দাদা। বিশ্বজিৎ খুশি হল।

কুন্তীর বাড়িতে পৌঁছাতে অসুবিধে হল না। দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা অর্কর খুব সড়গড় নয় তবু কুন্তীর বর্ণনা শুনে একটুও ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। দোতলা বাড়ি, গলির মুখে। দরজার সামনে লোহার খাঁচায় তালা ঝুলছে। হাত গলিয়ে বেলের বোতামে চাপ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওপরের ব্যালকনি থেকে বৃদ্ধার গলা ভেসে এল, কে?

দুপা পিছিয়ে অর্ক মুখ তুলে দেখল খাটো চেহারার বেশ ফরসা এবং অতি বয়স্কা মহিলা নীচের দিকে দেখার চেষ্টা করছেন।

সে সামান্য গলা তুলে বলল আমার নাম অর্ক। কুন্তী আছেন?

না। সে বাইরে গেছে। কিছু বলতে হবে? বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন।

আমাকে এই সময় আসতে বলেছিলেন। অর্ক বলল।

দাঁড়াও। ওর মা কলে গিয়েছে, জিজ্ঞাসা করে দেখি। বৃদ্ধা ভেতরে চলে গেলেন। উত্তর কলকাতায়, বিশেষ করে রাজাবাজার-শোভাবাজার অঞ্চলে এই শব্দগুলো এককালে খুব চালু ছিল। বাথরুম মানে কলঘর, লুচি মানে ময়দা, স্নান করতে যাওয়া মানে নাইতে যাওয়া, মাথা না ভিজিয়ে শরীরে জল ঢালা মানে গা ধোওয়া। বাঙালরা, মানে যাদের দেশ পূর্ববঙ্গে ছিল, এই ভাষাভাষীদের ঘটি বলে হাসাহাসি করত। ঘটিরাও বাঙালদের প্রচুর খুঁত ধরত। মায়ের কাছে শুনেছিল অর্ক। গত তিরিশ বছরে এই বিভাজন উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধা অবশ্যই ওই ঘটি সম্প্রদায়ের একজন। কিন্তু কুন্তী বাড়িতে নেই আর বৃদ্ধার মেয়ে বাথরুমে, এর অর্থ কী? বৃদ্ধা কি কুন্তীর ঠাকুমা আর যিনি এখন বাথরুমে তিনি মা? কুন্তী কিন্তু ঠাকুমার কথা তাকে বলেনি। বলেছে মা একা থাকেন এই বাড়িতে।

মিনিট তিনেক বাদে মাধবীলতার বয়সি এক মহিলা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেই বোঝা যায় বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা। বললেন, আপনি অর্ক? কুন্তী বলেছিল যে আপনি আসতে পারেন। জরুরি দরকারে ও একটু বেরিয়েছে এখনই এসে পড়বে।

তা হলে আমি কি পরে আসব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বুঝতেই পারছেন আপনাকে আগে দেখিনি তো! বাড়িতে আমরা দুজন মহিলা আছি। আমার মনে হয় মিনিট কুড়ির মধ্যে এসে যাবে। মহিলা বললেন।

অর্ক মাথা নেড়ে বাড়ির সামনে থেকে সরে বড় রাস্তায় চলে এল। না। এতে ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোনও কারণ নেই। আগে মানুষ ভদ্রতা সৌজন্যবোধ ইত্যাদিকে এত গুরুত্ব দিত যে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করত না। কিন্তু প্রতারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সতর্ক না হয়ে উপায় থাকল না। যে-কোনও লোক নিজেকে অর্ক বলে ওই বাড়ির বেল টিপতে পারত। ওঁরা দরজা খুলে দিলে সর্বনাশ করতে কতটা সময় লাগত? মাধবীলতা মাঝে মাঝে অনিমেষকে যা বলত তা মনে পড়ে গেল অর্করা বলত, নকশাল আন্দোলন করে কার কী লাভ হল জানি না তবে মানুষের মন থেকে অনেকগুলো বোধ খুন করে গিয়েছিল। ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যবোধ, পরস্পরকে সম্মান জানানোর মানসিকতা। মানুষ এখন তাই আত্মসর্বস্ব হয়ে গিয়েছে। কথাগুলো কতটা সঠিক অর্ক জানে না। তবে মা যে-কোনও ভাঙনের জন্যে নকশাল আন্দোলনকেই প্রথম দায়ী করে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই কুন্তীকে দেখতে পেল অর্ক। একটু দ্রুত হাঁটছে। সে সামনে দাঁড়াল, আস্তে, আস্তে।

ওঃ এসে গেছেন, সরি, খুব দুঃখিত। কতক্ষণ এসেছেন? কুন্তী বিব্রত।

এই তো! অর্ক হাসল।

একটা ওষুধের জন্যে সাতটা দোকান ঘুরতে হল।

কীসের ওষুধ?

প্রেশারের। রোজ যা খেতে হয় তা শেষ হওয়ার পর কেনার কথা কেন যে এঁদের মনে পড়ে! দিদি নাকি প্রায়ই সেটা ভুলে যান। চলুন।

কুন্তীর ব্যাগে চাবি ছিল, তাই দিয়ে প্রথমে খাঁচা পরে দরজার তালা খুলে বলল, চলুন, ওপরে গিয়ে বসি।

অর্ক দেখল নীচেও বসার ঘর রয়েছে। কিন্তু সে কুন্তীকে অনুসরণ করে ওপরে উঠে এল। পরপর তিনটি ঘর, সামনে সুন্দর বারান্দা ব্যালকনি। বারান্দার এক পাশে বসার ব্যবস্থা। কুন্তী বলল, বসুন!

ঠিক তখনই কুন্তীর মা এবং দিদিমা বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে, কুন্তী বলল, এই নাও তোমার ওষুধ। কুড়ি দিন চলে যাবে। পনেরো দিনের মাথায় কেনার কথা বলবে। খুব হাঁটিয়েছ আজ।

বৃদ্ধা ছেলেমানুষের হাসি হাসলেন। এই বয়স তো হাঁটার। দে–।

ওষুধের প্যাকেট দিয়ে কুন্তী পরিচয় করাল।

কুন্তীর মা বললেন, বসো। তোমার বাবার কথা ওঁর মুখে শুনেছি। উনি এখন কেমন আছেন?

একটা পা তো সেই থেকেই জখম। তবে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে পারেন। আপনারাও বসুন। অর্ক বসল।

বসার পরে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে কে কে আছেন?

বাবা মা আর আমি। অর্ক শেষ কবে এই প্রশ্ন শুনেছে মনে পড়ল না। কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন, কী করো তুমি?

আমি একটা ল্যাবরেটরিতে চাকরি করি। অর্ক জবাব দিল।

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ে থা করেছ নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়ে কী?

অর্ক হেসে ফেলল, বিয়ে করা হয়নি।

ওমা! কেন? বৃদ্ধা অবাক।

কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করেনি। অর্ক মজা করে বলল।

ও তাই তো। দিদিমা হাসলেন, আজকাল শুনি ছেলেরা বিয়ে করে না, মেয়েরাই বিয়ে করে। তা মা-বাবা চাপ দেননি?

কুন্তী কথা বলল, আচ্ছা দিদা, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন? কত মানুষ তো বিয়ে করে না। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, এঁরা কি বিয়ে করেছেন?

দেশের জন্যে কাজ করতে ওঁদের নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, বিয়ে করবেন কখন? তবে শুনেছি, বিধানবাবু নাকি কাউকে ভালবাসতেন, তাঁকে না পেয়ে সারাজীবন আইবুড়ো থেকে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধা বললেন।

নাও শুরু হল গল্প! কুন্তী মন্তব্য করল।

তুমি কি রাজনীতি করো? কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্ক মুখ খোলার আগেই কুন্তী বলল, আগে রাজনীতির ধারে কাছে থাকত না। কিছুদিন আগে একটু সমস্যায় পড়েছিল। এখন সেটাকে কাটিয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।

অর্ক অবাক হল। কিছুদিন আগে, রামজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে যেদিকে যাচ্ছিল তার ইঙ্গিত কুন্তী পেল কী করে! সে বলল, পুরোটা ঠিক নয়। আমি এখনও সক্রিয় রাজনীতি করি না। তবে তিন দশকের ওপর বামপন্থীরা যা করতে পারেনি তা যদি তৃণমূল করতে পারে তা হলে তাদের সমর্থন না করার কোনও কারণ দেখি না। পরিবর্তন যদি সামান্য ভাল এনে দেয় তা মানুষেরই লাভ।

দিদিমা বললেন, ঠিক বলেছ বাবা। আমি তো মেয়েটাকে সবসময় দুহাত তুলে আশীর্বাদ করি। ওইটুকু মেয়ে কিন্তু তার কী তেজ!

কুন্তীর মা বললেন, সব ভাল কিন্তু কথায় কথায় অত ইংরেজি বলার কী দরকার? ওই ইংরেজি শিখলে বাচ্চারা তো পরীক্ষায় ফেল করবে! আচ্ছা জাপানি বা চিনেরা শুনেছি মাতৃভাষায় কথা বলে, আমাদের দেশের তামিল তেলেগুভাষী নেতারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ইংরেজি ব্যবহার করে । তা হলে বাঙালির সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা বললে দোষ কী! গরমেন্ট না বলে সরকার বললেই তো হয়।

দিদিমা রেগে গেলেন, তোর স্বভাব হল সবসময় অন্যের খুঁত ধরা। না হয় একটু আধটু ভুল ইংরেজি বলছে কিন্তু কাজটা কী করছে তা দ্যাখ। কার এই কাজ করার হিম্মত আছে?

কুন্তীর মা হেসে ফেললেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি কাজ সারি। মা, তুমি ওষুধ খেয়ে নাও।

ও হ্যাঁ। বসো বাবা। দিদিমা মেয়েকে অনুসরণ করলেন।

অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল, কীসের অফার পেয়েছেন?

বলছি। কুন্তী মাথা নাড়ল, মাস্টারি ছেড়ে বাড়িতেই ছেলেমেয়ে পড়াব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার এক বান্ধবী, ও জামশেদপুরে থাকে, খবরটা দিল। আপনি কমল চক্রবর্তীর নাম শুনেছেন?

না। কে তিনি?

গল্প লেখেন। জামশেদপুর থেকে কৌরব নামে একটি পত্রিকা দীর্ঘকাল ধরে বের করে চলেছেন।

না। আমি নাম শুনিনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম কমলবাবু পুরুলিয়ার খুব নির্জন প্রান্তরে একটি স্কুল চালান আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। চাকরি ছেড়ে সমমনস্ক কয়েকজনকে নিয়ে প্রচুর স্ট্রাগল করে স্কুলটাকে দাঁড় করিয়েছেন। কুন্তী বলল, ওইরকম নির্জন জায়গা, যার চারপাশে জঙ্গল আর পাহাড়, সেখানে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়েছেন ওঁরা।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরকম জায়গায় ছাত্র পাচ্ছেন কী করে?

আমিও তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। শুনলাম দশ-বারো মাইল দূরের গ্রাম থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় প্রতিটি ভোরে। স্টেট ব্যাঙ্ক ওঁদের সাহায্য করেছে একটা বাস দিয়ে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর পর পড়ানো হয়। কুন্তী বলল, জানেন, ওইসব গ্রামগুলোর বেশির ভাগকেই মাওবাদী গ্রাম বলে। চিহ্নিত করা হয়েছিল।

তা হলে তো বাচ্চারা ওইসব পরিবারের থেকেই আসে?

হয়তো!

ভদ্রলোকের তো খুব সাহস।

হয়তো সেটাই ওঁর ভরসা। কেউ নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে চায় না বলেই স্কুলের গায়ে হাত পড়বে না। কুন্তী বলল, আমি বান্ধবীর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কমলবাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, আপনি স্বাগত। যদি আসেন তা হলে আমাদের শক্তি বাড়বে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার দেখে যান। আমরা আপনাকে শহরের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারব না। জীবনযাপনের জন্যে যা প্রয়োজন তার কিছুটা অবশ্যই পারব। আর হ্যাঁ, আমাদের কোনও ধর্মাধর্ম নেই। আমরা একমাত্র বৃক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা তাই সম্বোধন করি জয় বৃক্ষনাথ বলে।

অদ্ভুত তো? অর্ক বলল।

হ্যাঁ সে কারণেই ভাবছি, দেখে আসি। কলকাতা থেকে চার ঘণ্টার পথ। ওখান থেকে দিনে দিনেই জামশেদপুরে বান্ধবীর বাড়িতে চলে যাব।

কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন?

আমি তো বাইরেই ছিলাম। ব্যান্ডেল কি কলকাতা?

তবু তো পা বাড়ালেই চলে আসা যায়।

মাথা নাড়ল কুন্তী, বিশ্বাস করুন, ভাল লাগছে না। মায়ের কথা ভেবে চুপচাপ বসে থাকব এখানে? মা বাধা দিচ্ছে না। বলল, যাতে শান্তি পাবি তাই করবি।

শান্তি খুঁজতে যাচ্ছেন?

ঠাট্টা করবেন না। আপনাকে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করল, তাই কথাগুলো বললাম। কুন্তী মুখ ফেরাল।

এই সময় ওর মা এসে গেলেন, হাতে ট্রে-তে বসানো চা এবং কেক। কুন্তী উঠে দাঁড়াল মাকে সাহায্য করতে।

.

কুচবিহার থেকে ডায়মন্ডহারবারে নিঃশব্দে ব্যালট বক্সে বিপ্লব হয়ে গেল। তিন দশকের বেশি প্রাসাদটা ভেঙেচুরে পড়ল মাটিতে। আবেগে মানুষ উচ্ছ্বসিত।

পরিবর্তিত জীবনের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি নারীর মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে এখন।

.

৪৮.

হাওয়া বইছিল, সেটা ঝড় হয়ে গেল। সেই ঝড়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কখনওই যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ী সৈনিকরা কী আচরণ করে থাকে তা তারা বই-এ অথবা সিনেমা দেখে জেনেছে।

চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন যা অনেক আশা জাগিয়ে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সকালটাকে রাতের চেয়ে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল তা ধসে পড়ায় মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হল। বিজয়ী সৈন্যরা জয়ের পরমুহূর্তে কিছুটা অসংযমী হয়। এতদিনের নির্যাতন সহ্য করার পর জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে জয়ের স্বাদ পাওয়া মানুষেরা মনের সাধ মেটাতে চাইল। কিন্তু দলনেত্রী, যিনি এখন। মুখ্যমন্ত্রী, ঘোষণা করলেন, বদলার রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। দলতন্ত্র নয়, চাই গণতন্ত্র। দলের কর্মীদের সংযত থাকতে আবেদন করলেন তিনি।

অনিমেষ খবরের কাগজ পড়ছিল। ইদানীং কাগজ পড়ার সময় তার অনেক বেড়ে গেছে। মাধবীলতা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুমি কি বিজ্ঞাপনগুলোও মুখস্থ করো?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি বিজ্ঞাপনগুলো পড়ো না?

আমার অত সময় নেই। মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়েছিল, দশজন কাগজ পড়লে তার নয়জন বিজ্ঞাপনে চোখ রাখে না।

তা হলে যারা বিজ্ঞাপন দেয় তারা পয়সা খরচ করে কেন?

আশায়। ভাবে যারা কাগজটা কিনছে তারা পড়ে মুগ্ধ হবে। উঃ, আজকাল তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। যা বলব অমনি তুমি জেরা করতে শুরু করবে। সত্যি তুমি বুড়ো হয়ে গিয়েছ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

অনিমেষ হাসল, বিজ্ঞাপনগুলো মন দিয়ে পড়লে দেশের সামাজিক, আর্থিক পরিস্থিতি কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা জানতে পারতে। আচ্ছা বলো, আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে কেউ কি ভাবতে পারত এই কলকাতার কোনও টেলিফোন নাম্বার ঘোরালে একটা সংস্থার সদস্য হওয়া যাবে যারা পছন্দমতো মহিলার সঙ্গে এক দিনের বন্ধু হওয়ায় সুযোগ করে দেবে অর্থের বিনিময়ে?

কী যা তা বলছ! মাধবীলতা চাপা গলায় বলল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। এই যে কাগজের দ্বিতীয় পাতায় যে পত্ৰ-মিতালি শিরোনামে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় তা কখনও পড়েছ? আজ এরকম বিজ্ঞাপনের সংখ্যা সাতটা।

না পড়িনি। কারণ ওগুলো তো চিঠি লিখে বন্ধুত্ব তৈরি করা। ভেবেছি যাদের কোনও বন্ধু নেই, একা থাকে, তারাই পত্রমিতালি করে। মাধবীলতা বলল।

চল্লিশ বছর আগে হয়তো তাই হত। এখন, এই দেখো, ভরসা দেওয়া হয়েছে, কোনও ঝুঁকি নেই। প্রতারিত হবেন না। বুঝতেই পারছ।

অনিমেষ বলল, এই বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হচ্ছে তার কারণ যেসব মানুষ রেডলাইট এরিয়ায় যেতে সংকোচ বোধ করে তাদের সাহায্য করতে। খবরের কাগজে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে এবং মানুষ যে তা মেনে নিচ্ছে তার কারণ আমাদের সামাজিক জীবন অনেক উদার হয়ে গিয়েছে। রেডলাইট এলাকায়। যে খরচ করতে হয়, এদের ডাকে সাড়া দিলে তার অনেক বেশি টাকা দিতে হবে জেনেও লোকে যাচ্ছে তার কারণ এখন এই ধরনের মানুষের আর্থিক সংগতি অনেক বেড়ে গেছে।

পুলিশ কিছু বলছে না?

পুলিশ? অনিমেষ হেসে ফেলল, আমাকে বরং এক কাপ চা খাওয়াও।

মাধবীলতা একটা বড় শ্বাস ফেলল, শোনো, আমার আর এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। তুমি সারাদিন চুপচাপ বসে শুয়ে থাকো, নয়তো কাগজ পড়ো। ছেলে সেই সকালে কাজে বেরিয়ে রাত করে ফেরে। বাধ্য হয়ে সারাদিন আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হয়। এইভাবে থাকতে থাকতে একদিন আমরা মরে যাব, ভাল্লাগে না।

অনিমেষ হাসল, আমার কিন্তু ভাল লাগল।

তার মানে? মাধবীলতা ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল।

এতগুলো বছর পরেও আমরা দুজনে একই রকমভাবে ভাবি, এটা জেনে আনন্দ হবে না? কিন্তু কোথায় যাব? এত সস্তায় থাকার জায়গা কোথায় পাব? বলো?

ঠিক। তবু–। মাধবীলতা বলল, এখন মনে হয় জলপাইগুড়ির বাড়িটা বিক্রি না করলে ভাল হত। ওখানে গিয়েও তো আমরা থাকতে পারতাম। এখন

তো বামফ্রন্টের আমল নয় যে পার্টির নোক এসে লাল চোখ দেখাবে।

কে যে পার্টির লোক ছিল তাই এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বোকা বোকা কথা বোলো না। সুরেন মাইতিদের খুঁজে পাবে না?

সুরেন মাইতিদের কোনও উপায় নেই হারিয়ে যাওয়ার। তা ছাড়া ওরা যত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ততটা চক্ষুলজ্জাহীন হতে পারেনি। কিন্তু আজ গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখলাম তৃণমূলের যে মিছিল যাচ্ছে তাতে সুরেন মাইতির পেছনে ঘোরা বেশ কয়েকজন স্বচ্ছন্দে পতাকা বইছে। হয়তো ওদের কেউ কেউ এই বাড়ি সুরেনের নির্দেশে ভাঙচুর করে গেছে। যে নৌকো ভাসে তাতে উঠে পড়তে ওরা দেরি করে না। অনিমেষ বলামাত্র মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে যন্ত্রটা তুলে কানে চাপল, হ্যালো। কে বলছেন?

আমি দেবেশ বলছি, জলপাইগুড়ি থেকে। কানে গলা ভেসে এল। মাধবীলতা চাপা গলায় অনিমেষকে জানাল, দেবেশ। তারপর গলা তুলে বলল, বলুন।

ওপাশের কথা শুনতে শুনতে চোখ বড় হয়ে গেল মাধবীলতার। তারপর বলল, আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন? আচ্ছা, আমি ওকে বলছি।

মোবাইল রেখে দিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল মাধবীলতা, ছোটমাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে।

সে কী? সোজা হয়ে বসল অনিমেষ।

দেবেশবাবু বললেন, আচমকা পড়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলছে হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা কী করব জানতে চাইছিলেন। মাধবীলতা বলল, শোনো, দেরি না করে আজই রওনা হই।

হ্যাঁ। কিন্তু যাব কী করে? ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে কি?

ট্রেনে যেতে না পারলে বাসে যাব। আমি অর্ককে ফোন করে বলছি টিকিটের ব্যবস্থা করতে। আমার খুব খারাপ লাগছে। মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে লাইন ঠিক থাকে। নিশ্চয়ই অর্ককে ফোন করছে মাধবীলতা। ছোটমা এখন হাসপাতালে। হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। দেবেশকে ফোন করলে জানা যেত হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে কি না। ঠাকুরদা-বড়পিসিমা বাবার চলে যাওয়ার সময় সে পাশে থাকতে পারেনি। মা মারা যাওয়ার পরে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ছোটমাকে মেনে নিতে প্রথম দিকে খুব অসুবিধে হয়েছিল। ক্রমশ সম্পর্কটা আপাত স্বাভাবিক হলেও দুরত্ব থেকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলা সারা জীবন স্বামীর সংসার, শ্বশুরের বাড়ি আগলে গিয়েছেন, বিনিময়ে কিছুই পাননি। শেষপর্যন্ত বাড়ি বিক্রির টাকাগুলো ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হলেও তা ভোগ করার কথা ছোটমা ভাবেননি, চলে গেলে সেই সুযোগও থাকবে না। কিন্তু এটা সত্যি, ছোটমাই তার একমাত্র গুরুজন যিনি এখনও জীবিত। অনিমেষ এও ভাবল, হয়তো দেবেশ বলতে পারেনি, ছোটমা সম্ভবত আর বেঁচে নেই।

মাধবীলতা ফিরে এল, অর্ক বলছে ও সঙ্গে টাকা নিয়ে যায়নি। এটিএম কার্ড বাড়িতে রেখে গেছে। বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর স্টেশনে গিয়ে টিকিটের চেষ্টা করতে পারে। তা হলে তো ওর সঙ্গেই স্টেশনে যেতে হবে আমাদের।

গিয়ে যদি টিকিট না পাওয়া যায়? অনিমেষ তাকাল, না, লতা, আমি আজই যেতে চাই। তুমি আমাকে টাকা দাও, আমি বাসের টিকিট কিনে আনছি।

বাসের টিকিট পাওয়া যাবে?

আগে তো যেত। অনিমেষ বলল।

না, থাক। বাসে চেপে সারারাত বসে বসে শিলিগুড়ি, তারপর আবার বাস পালটে জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ধকল অনেক। আমরা কেউ আর একুশ বছরের নেই। তার চেয়ে স্টেশনে চলো। রিজার্ভেশন পাওয়া না গেলেও দুটো বসার জায়গা পেলে ট্রেনে অনেক স্বস্তিতে যাওয়া যাবে। মাধবীলতা বলল।

যদি না পাই?

আঃ। এখন কি নর্থ বেঙ্গলে যাওয়ার একটাই ট্রেন? একটা না একটাতে ঠিক পাওয়া যাবে। আমি গুছিয়ে নিচ্ছি। মাধবীলতা পা বাড়ান।

কিছু টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নাও। অনিমেষ বলল।

সত্যি। হেসে ফেলল মাধবীলতা, তুমি যে এখনও কোথায় পড়ে আছ! সঙ্গে এটিএম কার্ড থাকলে টাকা বয়ে নিয়ে যেতে হয় না তা ভুলে গেলে? মাধবীলতা বেরিয়ে গেল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। আজকাল অনেক কিছু ঠিকঠাক সময়ে মনে আসে না। প্রায়ই কোনও নাম মনে করতে গিয়ে দেখতে পায়, মনে আসছে না। তখন মাথায় যে অস্বস্তি শুরু হয় তার থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে নিজেই জানে না কোথায় পড়ে আছে। সে কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে না, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি তার কাছে হিব্রু। সে আজ পর্যন্ত কোনও বড় শপিং মলে যায়নি।

সময় এগিয়ে চলেছে দ্রুত কিন্তু তার সওয়ারি হওয়ার, ইচ্ছে হোক বা ক্ষমতা হোক, তার নেই। ফলে তাকে একা একা থাকতে হচ্ছে। মাধবীলতা তার সর্বসময়ের সঙ্গী কিন্তু তার পরেও তো নিজের একাকিত্ব থেকেই যাচ্ছে। অর্ক তার ছেলে কিন্তু মনে হয় তারা দুজন এমন দুটো দ্বীপ যাদের মধ্যে অনেক যোজন সমুদ্রের ফারাক। এখন মনে হয় সেই ছাত্রকাল থেকে যা সে শিখেছিল, জেনেছিল সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ভাবতেই মন মুষড়ে পড়ে। এই যে পশ্চিমবাংলায় যে নির্বাচন হল, মার্কসবাদী কমিউনিস্টদল তার বিপুল সংগঠন থাকা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ল তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না যদি বিজয়ী দল একটি রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হত। একজন মহিলার বিপুল আবেগ আর আন্তরিকতার জোয়ারে বেশির ভাগ ভোটার ভেসে গেল, কোনও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের পক্ষে তা বিশ্বাস করা মুশকিল। সব কিছুর একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। শুধু আবেগ বুকে নিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন চালানো যায় না। যদি কেউ সেটা সচল করে ফেলে তা হলে তা অত্যন্ত সাময়িক ব্যাপার হবে, দুর্ঘটনা হতে বাধ্য। ভালবাসার আবেগ বুকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একা কতদিন রাজ্যে সুশাসন করা সম্ভব যখন তার চারপাশে অসংখ্য স্বার্থলোভী চাটুকারের ভিড়? এ কথা ঠিক, ভদ্রমহিলা প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে বিপ্লব এনেছেন। থেমে থাকা ট্রেনে গতি এনেছেন। কিন্তু তারপর? এইসব কথা অর্ক জানে না তা হতেই পারে না। অনিমেষের কানে এসেছে, অর্ক সক্রিয়ভাবে না হোক, এই বিজয়ের উল্লাসে শরিক হয়েছে। এটাও অনিমেষের কাছে বিস্ময়। এইসব ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দেবেশের ওখানে থাকলে হয়তো শান্তি পাওয়া যাবে। অনিমেষ মাথা নাড়ল। কে জানে? শান্তি কোথায় আছে তা মানুষ কি জানে?

একটু আগে ছুটি চেয়ে নিয়ে অর্ক বাড়ির পথে বাস ধরল। সেই বাসের ভেতর মোবাইল বেজে উঠল। কুন্তী।

কেমন আছেন?

চমৎকার। অর্ক, আপনি ভাবতে পারবেন না আমি এমন জায়গায় এসেছি যা কল্পনার বাইরে ছিল। আশপাশে মানুষের বসতি নেই। লক্ষ লক্ষ গাছের মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল। এখানে মাস্টারমশাইরা সকাল বিকেলে রান্না করেন, সবাই সব কাজ করেন, বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় দূর দূর গ্রাম থেকে। ওরা বাস থেকে নেমেই কচি গলায় বলে ওঠে, গুডমর্নিং। কমলবাবু ওদের ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ পেট ভরে খাইয়ে স্কুলের পড়া শুরু করান। বেচারারা এত গরিব যে ওই খাওয়ার লোভেই বোধহয় কামাই করে না। অর্ক, আমি কাল কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি দীর্ঘদিন এখানে থাকব বলে। কুন্তীর গলায় উচ্ছ্বাস।

জায়গাটার নাম কী?

কী নাম ছিল জানি না। এখন সবাই বলে ভাল পাহাড়। নামটা কমলবাবু রেখেছেন। দারুণ নাম, তাই না?

কীভাবে যেতে হয়?

গালুডি স্টেশনে নেমে কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে। অটো, ট্যাক্সি ছাড়া মাঝে মাঝে বাস পাওয়া যায়। ঘাটশিলা থেকেও যাওয়া যায়। যাক গে, আপনি কেমন আছেন? কুন্তী প্রশ্নটা করামাত্র মোবাইল শব্দহীন হল। লাইন কেটে গেছে। অর্ক চেষ্টা করে শুনল, আউট অফ রেঞ্জ।

দিনটা যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। ওই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাধবীলতা যেন দশ হাতে এক মাটি থেকে শেকড় উপড়ে আর এক মাটিতে স্থিতু হওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি করে নিচ্ছিল। বিকেলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে গলির মোড়ে এসেছিল অনিমেষ। অর্ক এখনও ফেরেনি। দোকানদার পরিচিত। জিনিসগুলোর নাম শুনে জিজ্ঞাসা করল, কোথাও যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। জলপাইগুড়িতে।

ও। ওখানেও নিশ্চয়ই পরিবর্তনের ঢেউ পৌঁছে গেছে। দোকানদার হাসল।

সেটা স্বাভাবিক। জায়গাটা তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নয়। জিনিসগুলোর দাম মিটিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুনল একজন খেকুরে চেহারার বৃদ্ধ বলছেন, এটা ঠিক নয়। এত লড়াই করে দিদি পরিবর্তন আনলেন, আর ওরা এসব করছে কী!

দোকানদার বলল, পাবলিকলি ওসব কথা বলব না দাদু।

তা ঠিক। এখন তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। বৃদ্ধ বললেন।

কী হয়েছে? অনিমেষ দোকানদারের দিকে তাকাল।

কিছু সমাজবিরোধী দুপুরবেলায় সিপিএমের পার্টি অফিসে আগুন দিয়েছিল। পুরোটা পোড়েনি। তৃণমূলের ছেলেরা ধাওয়া করতেই ওরা পালিয়ে গেছে। দোকানদার বলল, এই রকমটাই তো শুনলাম।

সমাজবিরোধীরা পার্টি অফিস পোড়াতে যাবে কেন?

বৃদ্ধ বলল, বন্যা বয়ে যাচ্ছে এখনও। এই পুকুরের মাছ ভেসে ঢুকছে ওই পুকুরে। জল থিতিয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। তখন কোন মাছ কোন পুকুরে ছিল তা আর বোঝা যাবে না।

অনিমেষ আর কথা বাড়াল না।

.

অর্কর উদ্যোগে ব্যবস্থা হল। টিটি অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে দুটো শোওয়ার জায়গার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে লোকাল ট্রেন ধরে জলপাইগুড়ি শহরে যেতে হবে। মাধবীলতা বলল, এসি-র দরকার নেই। বাসে যাওয়ার চেয়ে এটা ঢের ভাল হল।

রাতের খাবার বাড়িতেই খেয়ে এসেছিল ওরা। অর্ক বিছানা পেতে দিয়ে বলল, যাচ্ছি।

অনিমেষ বলল, শোনো, ছোটমার কী অবস্থা তা জানি না। দেবেশকে কয়েকবার ফোন করেও লাইন পাইনি। ওখানে যাওয়ার পরে জানতে পারব। কিন্তু কবে ফিরতে পারব তা বলতে পারছি না। তুমি তোমার মতো থেকো।

অর্ক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ট্রেন হুইসল দিচ্ছে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার। মাধবীলতা বলল, তোকে তো কিছু বলার নেই, যথেষ্ট বুঝতে পারিস। শুধু একটা কথা, আর যাই করিস যে-কোনও রকম রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াস না। রাজনীতি মানুষকে হয়তো ক্ষমতা দেয় কিন্তু কখনওই শান্তি দেয় না।

কথাগুলো শুনে অনিমেষ অন্য দিকে তাকাল। সে যখন নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, পেছন ফিরে তাকায়নি। তখন মাধবীলতা কোনও বাধা দেয়নি, বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। উলটে লালবাজারে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও তাকে নিষেধ করেছিল মুখ খুলতে। আজ, এতকাল পরে ছেলেকে কি মনের কথাটা জানাল?

.

৪৯.

পশ্চিমবাংলার মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন শিক্ষিত গুণীজনেরা আছেন যারা কখনওই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। যেহেতু এইসব মানুষেরা সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র তাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাল সবাই। কিছু সংবাদপত্র স্বীকার করল যে দলীয় রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে উপযুক্ত মানুষদের হাতে দফতরগুলো দিয়ে ঠিকঠাক কাজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সামনে রয়েছে পাঁচ বছর। চৌত্রিশ বছরের কুশাসন সরিয়ে প্রচুর কাজ তারা করবেন, জীবনযাপনে পরিবর্তন আসবে। মানুষ সেই আশায় স্থির। কিন্তু তারা শুনছিল প্রতিদিন মন্ত্রীরা, বিশেষ করে যারা রাজনীতি করে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তাঁরা মুখ খুললেই বামফ্রন্টকে গালাগাল করছেন। কাজ করার চেয়ে এই গালাগাল দিয়ে যেন অনেক বেশি সুখ পাচ্ছেন। মানুষ দেখছে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় অফিসে রাতারাতি তৃণমূলের সংগঠন তৈরি হয়ে যাচ্ছে এবং যাদের দলে বিতাড়িত কংগ্রেসি এবং ছেড়ে আসা বামফ্রন্টের সমর্থক ভিড় করছেন।

এবং তার পরেই পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল। কোনও খবর না নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ওটা স্রেফ সাজানো ঘটনা। তাঁর সরকারকে হেয় করার জন্য সাজানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন তার ওপর রং চড়িয়ে পুলিশ কমিশনার অপপ্রচারের জন্যে সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী করলেন। কিন্তু তারই অধস্তন একজন মহিলা পুলিশ অফিসার যখন অভিযুক্তদের বেশির ভাগকে গ্রেফতার করে বললেন, সত্যি ধর্ষণ হয়েছিল, তখন মানুষের মন থমকে দাঁড়াল। তারা দেখল সেই মহিলাকে সত্যি বলার অপরাধে সরিয়ে দেওয়া হল এমন দফতরে যেখানে তার কোনও জনসংযোগ থাকবে না।

ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। মুখ্যমন্ত্রীর অসম্ভব জনপ্রিয়তায় সামান্য ছাপ লাগলেও তার প্রতি রাজ্যের মানুষের আস্থা এখনও প্রবল। যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে রাজনীতি করেন না, দেশের মানুষের জন্যে যাঁর জীবন উৎসর্গিত তার পাশে জনসাধারণ থাকবেই।

কিন্তু মহাভারতের মুষল পর্ব শুরু হয়ে গেলে একা শ্রীকৃষ্ণ যা পারেননি তা কি মুখ্যমন্ত্রী পারবেন? স্টেশন থেকে বাইরে বের হওয়ামাত্র অর্কর মোবাইল জানান দিল। সুইচ অন করে হ্যালো বলতেই কানে এল, দাদা, আমি রামজি বলছি।

অর্ক কথা বলল, হ্যাঁ, বলুন রামজি!

রামজির গলা কানে এল, আপনি কি এখন কলকাতায়?

হ্যাঁ।

দাদা, আমি এখন জলপাইগুড়িতে।

সে কী! ওখানে কী করছেন আপনি?

আমার অবস্থা খুব খারাপ। কলকাতায় থাকতে পারলাম না। আপনার বাবা যদি জলপাইগুড়িতে থাকার ব্যবস্থা না করে দিতেন তা হলে– কথা শেষ করল না রামজি।

আমার বাবা আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু দাদা, আমার হাত একদম খালি। এই মোবাইলে পঞ্চাশ টাকা ভরেছিলাম, সেটাও শেষ হয়ে আসছে। আমাকে এক হাজার টাকা পাঠাতে পারবেন? আমি কথা দিচ্ছি, মাস তিনেকের মধ্যে শোধ করে দিতে পারব। করুণ গলায় বলল রামজি।

না শব্দটা মুখে চলে এসেছিল কিন্তু সামলে নিল অর্ক। বলল, আপনি জলপাইগুড়ির কোথায় আছেন, কীভাবে টাকা পাঠাব তা জানি না। পাঠালে কতদিনে পাবেন তারও ঠিক নেই। আপনার সঙ্গে তো বাবার পরিচয় হয়েছে, তিনি আপনাকে সাহায্যও করেছেন। এক কাজ করুন, উনি এখন জলপাইগুড়িতে। ওঁর সঙ্গে দেখা করে টাকাটা চান। যদি উনি বলেন তা হলে টাকাটা আমি ওঁকে পাঠিয়ে দেব পরে। অর্ক কথাগুলো বলে খুশি হল।

আপনার বাবা এখন জলপাইগুড়িতে? এখানে যে আসবেন তা আমায় বলেননি তো। কোথায় উঠেছেন? রামজি বেশ অবাক হয়ে গেল।

অর্ক ওকে দেবেশবাবুর আশ্রমের ঠিকানা বুঝিয়ে বলল, হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করুন। ওখানে আমার ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে ভরতি আছেন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা। রামজি যেন স্বস্তি পেল।

একটা কথা রামজি, আপনাকে আমি কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, কেন আপনাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? আপনি কি একজন মাওবাদী?

দাদা, আপনি তো জানবেন। তবু জিজ্ঞাসা করছেন?

অনুমান করেছিলাম। আপনার ব্যবহার ভাল লেগেছিল বলে কিছুটা সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু রামজি, এসব করে কী লাভ? এতবড় ভারতবর্ষকে কয়েক হাজার মাওবাদী কোনও অস্ত্র দিয়ে বদলে দিতে পারে? মানুষ খুন করে কি অসম থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিপ্লব আনা সম্ভব? আপনারা যেটা করছেন সেটা স্রেফ আত্মহত্যা। এখনও সময় আছে, পথটা ছেড়ে দিন। অর্ক বলল।

কীভাবে?

পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে মূল স্রোতে ফিরে আসুন।

আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী নেই। তা হলে আবেদন করলে কান দেবেন কেন? পুলিশ আমাকে বিনা বিচারে জেলে ফেলে রাখবে। আপনি– লাইন কেটে গেল। অর্কর মনে হল রামজির মোবাইলে যে পঞ্চাশ টাকা ভরা হয়েছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছে।

নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার সময় তৃণমূল নেত্রীর সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিল সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকরাও। যাঁরা কখনও রাজনীতি করেননি, নিজের নিজের ক্ষেত্রে যাঁরা অত্যন্ত কৃতী, তেমন কয়েকজনকে তিনি বিধায়কপদে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ বুঝতে পেরেছিল পশ্চিমবাংলায় সবগুলো বিধায়কের আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জোট বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াই করছে না, লড়াইটা হচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে বিরোধীদের। অবশ্যম্ভাবী ফল হল, মানুষ তৃণমূল নেত্রীকে ভোট দিয়ে তার প্রার্থীদের জিতিয়ে দিলেন। যাঁরা চার মাস আগেও কোনও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তারা রাজভবনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। এই ঘটনা মানুষকে খুশি করল। অর্থনীতিবিদ, একজন জাঁদরেল আই এ এস অফিসার, একজন নাট্যব্যক্তিত্ব পশ্চিমবাংলার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন।

অর্ক ভাবছিল, এই ব্যাপারটা বাবা কীভাবে নেবে? পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে এইরকম ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না তার জানা নেই। প্রচলিত রাজনৈতিক শিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত তারা ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারবেন না। অনিমেষ নিশ্চয় বলত, এইসব মানুষ নিজের কাজের জায়গায় কৃতী হতে পারেন কিন্তু তাদের তো কোনও রাজনৈতিক ভিত নেই। শুধু মন্ত্রিত্ব রক্ষার জন্য দলের প্রতি অনুগত হয়ে কতদিন থাকতে পারবেন তাতে সন্দেহ রয়েছে। অর্ক মনে মনে মাথা নাড়ে, ভবিষ্যৎই শেষ কথা বলবে।

ছোটমা এখনও আইসিইউ-তে। সারাদিনের পরে বিকেলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেল ওরা। ডাক্তার বললেন, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ঠিক সময়ে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে আমরা চেষ্টা করতে পারছি। কিন্তু পরিষ্কার বলছি, ওষুধে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

দূর থেকে দেখল ওরা ছোটমাকে। বিছানায় শরীর যেন মিশে গেছে। নাকে নল হাতে নল লাগিয়ে চিত হয়ে রয়েছেন।

এই সময় দেবেশ এল। ওদের দেখে খুশি হল সে, যাক, তোরা এসে গেছিস। কখন এলি? আমাকে ফোন করিসনি কেন?

ফোন করেছিলাম। তোর ফোন বন্ধ ছিল। বেলা বারোটায় পৌঁছেছি, ট্রেন লেট ছিল। অনিমেষ বলল, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, ভরসা পেলাম না।

হ্যাঁ। সকালে এসে শুনেছিলাম বাহাত্তর ঘণ্টা কাটবে না। খুব খারাপ লাগছে রে। দেবেশ বলল, এদিকে আমি খুব সমস্যায় পড়েছি।

কী?

চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে দেবেশ বলল, বলছি। তোরা কি কোনও হোটেলে উঠেছিস?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, রুবি বোর্ডিং-এ।

বিরক্ত হল দেবেশ, ওঃ আশ্রমে না উঠে হোটেলে গেলি কেন? মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করার কী দরকার ছিল?

মাধবীলতা হাসল, আপনার মোবাইল বন্ধ দেখে বুঝতে পারছিলাম না আপনি আশ্রমে আছেন কি না। তা ছাড়া সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্নান খাওয়ার দরকার ছিল। আর এটাও তো ঠিক, আশ্রম থেকে হাসপাতালে আসা যাওয়াটা তো একেবারে সহজ ব্যাপার হবে না। আপনি বাইকে আসছেন বলে বোধহয় টের পান না।

কয়েকটা ওষুধ কিনে দিতে বললেন নার্স। দেবেশই সেটা কিনে দেওয়ার পর ওদের সঙ্গে হোটেলে চলে এল। এখন জলপাইগুড়িতে সন্ধে নামছে, হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে যেন রিকশার মিছিল চলছে। তাদের হর্নের আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগাড়। অনিমেষ বলল, একসময় এই রাস্তাটা শুনশান ছিল।

দেবেশ হেসে বলল, তখন কটা মানুষ রিকশায় চড়ত? চা খাব।

মাধবীলতাই চায়ের অর্ডার দিল বেল বাজিয়ে, হোটেলের কর্মচারীকে ডেকে। অনিমেষ বিছানায় আরাম করে বসে বলল, কী সমস্যার কথা বলছিলি?

দেবেশ ম্লান হাসল, রাজা বদলে গেলেও রাজপুরুষরা বদলাল না।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, রাজপুরুষ মানে?

পার্টির নেতা, উপনেতারাই তো রাজপুরুষ। এখানকার একজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে এতদিন যারা কংগ্রেস করত অথবা সিপিএমের কর্মী বলে যারা পরিচিত ছিল এমন সব লোক। দ্যাখ, শহর থেকে দূরে অনেক কষ্টে আশ্রম বানিয়েছিলাম যাতে বয়স্ক মানুষেরা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারেন। বামফ্রন্টের আমলে চাপ আসত একে জায়গা দিন ওকে জায়গা দিন। সেই চাপ কেটে যেত যখন ওপরতলার নেতাদের জানাতাম। সব সময় যে নেতারা সহযোগিতা করতেন এমন নয়, তবু চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার ছিল। এখন সেইটেও গেছে। দেবেশ বলল।

ঠিক কী হয়েছে বল তো? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

কয়েকদিন আগে তৃণমূলের তিনজন এসে বলল তারা চারজন বৃদ্ধকে আমার আশ্রমে ভরতি করতে চায় কিন্তু তার জন্যে কোনও টাকাপয়সা দিতে পারবে না। আমি বললাম, তা হলে আমি খরচ চালাব কী করে? কী বলল জানিস? বলল, এতদিন অনেক মুনাফা করেছেন, বামফ্রন্টের চামচে ছিলেন, এখন সেই টাকায় এদের উপকার করুন। আমি রাজি না হওয়ায় গালমন্দ করে চলে গেল। তার দুদিন পরেই একজন আঞ্চলিক নেতা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে চেপে এলেন। বললেন, এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাবসা নয়। এখানে যারা আছে তারা জনগণের অংশ। আপনি মা-মাটি-মানুষকে নিয়ে ব্যাবসা করতে পারেন না।

আমি অনেক বোঝাতে চাইলাম। নেতা কোনও কথা না শুনে বললেন, আপনাকে পনেরো দিন সময় দিচ্ছি। আপনার এখানে যারা থাকেন তারা প্রথমে যত টাকা দিয়েছেন, প্রতি মাসে কত টাকা দেন তার হিসেব রেডি করুন। তার সঙ্গে তরি-তরকারি, মাছ, মুরগি বিক্রি করে কী আয় হয় সেটা তৈরি করে আমাদের দেবেন। ওটা অডিট করা হবে।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এসব চাইবার অধিকার কি আপনাদের আছে? উত্তর হল, পনেরো দিনের মধ্যে যদি হিসেব না দেন তা হলে আপনার প্রশ্নের জবাব পাবেন।

কথাগুলো বলে দেবেশ চোখ বন্ধ করল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, পনেরো দিন শেষ হতে আর কত দিন বাকি আছে?

দিন এগারো।

ব্যাপারটা ওপরতলার নেতাদের জানিয়েছেন? মাধবীলতা শ্বাস ফেলল।

কাকে জানাব? রাতারাতি কংগ্রেসিরা তৃণমূল হয়ে গিয়েছে, একসঙ্গে নির্বাচন লড়াই করে মন্ত্রীসভায় অংশ নিয়েও কংগ্রেস দল দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। আর তাদের দল থেকে কিছু স্বার্থান্বেষী ঢুকে পড়েছে তৃণমূলে। এদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াও বিপদ। স্বার্থ ছাড়া কেউ হাত বাড়াবে না। দেবেশের কথার মধ্যেই চা এল।

পুলিশকে বলেছিস?

পাগল!

পুলিশ তোর কথা শুনবে না?

কানেই নেবে না। সিপিএম চৌত্রিশ বছরে যা যা করেছে, পুলিশকে যেভাবে মেরুদণ্ডহীন করে রেখেছিল এরা এই কয়দিনেই সেটা রপ্ত করে ফেলেছে। দেবেশ বলল।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না দেবেশবাবু। জলপাইগুড়ির বাড়ি নিয়ে সিপিএমের কর্মীরা যখন আমাদের ওপর হুমকি দিচ্ছিল তখন একজন আইপিএস অফিসার তাদের শায়েস্তা করেছিলেন। সব পুলিশই মেরুদণ্ডহীন নয়। ব্যতিক্রমী পুলিশও আছেন। আচ্ছা, আশ্রমের মানুষজন নিশ্চয়ই এসব কথা শুনেছেন। তারা কী বলছেন?

তারা আশঙ্কিত। আশ্রম বন্ধ হয়ে গেলে সবাই বিপদে পড়বেন। ওঁরা আমার পাশে আছেন বলে এখনও মনে জোর পাচ্ছি। চা শেষ করে দেবেশ বলল, এবার অন্য কথা বলি। মাসিমার অবস্থা তো আর আশাজনক নয়। উনি চলে গেলে যে সমস্যা হবে তার কী সমাধান হবে ভেবে দ্যাখ অনিমেষ।

কী সমস্যা?

ব্যাঙ্কের টাকা না হয় জয়েন্ট নামে রয়েছে। কিন্তু আশ্রমের জন্য গতমাসে উনি কুড়ি হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিয়েছিলেন। কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্যে শিলিগুড়ির হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। একজনের গলব্লাডার থেকে পাথর বের করতে হয়েছিল। যাঁদের জন্যে ওই খরচ করতে হয়েছিল তাদের মাসিক টাকা দেওয়ার পর আর কিছু দেওয়ার মতো সংগতি নেই। মাসিমা যেচে ওই টাকা দিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম একটু একটু করে টাকাটা ওঁকে ফিরিয়ে দেব। আজ ওঁর যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে তোরা আমাকে সময় দিবি? চোখ তুলে তাকাল দেবেশ।

অনিমেষ আচমকা হেসে উঠল, আমরা সময় দেওয়ার কে? যিনি দিয়েছেন তাকেই ফিরিয়ে দিবি, যদি পারিস।

ঠিক তখনই দেবেশের ফোন বেজে উঠল। সেটা অন করে কানে চেপে সে জানান দিল। ওপারের কথা শোনার পর সে বলল, আমি আসছি।

ফোন বন্ধ করে মাথা নিচু করে সে বসে থাকল কয়েক সেকেন্ড।

মাধবীলতার গলা কেঁপে গেল, কোনও খারাপ খবর?

মাথা নাড়ল দেবেশ, মাসিমা চলে গিয়েছেন।

মিনিটখানেক কথা বলল না কেউ।

দেবেশ উঠে দাঁড়াল, এই রাতে কিছু করার নেই। যা হবে তা কাল সকালেই করতে হবে। আমার একটাই সান্ত্বনা, তোরা এসে গেছিস।

আচমকা শরীর কেঁপে উঠল অনিমেষের। সমস্ত শরীর যেন কোনও প্রতিরোধ মানছিল না। গলা দিয়ে আহত শব্দ বেরিয়ে এল, দুচোখ বেয়ে জল। মাধবীলতা তার কাঁধে হাত রাখল।

দেবেশ নিচু গলায় বলল, আমি হাসপাতাল হয়ে আশ্রমে যাচ্ছি। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। খবর পেয়ে ভেঙে পড়বে। কিছু তো করার নেই। তোরা সকাল আটটার মধ্যে হাসপাতালে চলে যাস। দেবেশ বেরিয়ে গেল।

মাধবীলতা বেশ অবাক হল। ছোটমা সম্পর্কে অনিমেষের কোনও আবেগ, কোনও দুর্বলতা ছিল বলে সে জানত না। অনিমেষ তার ছেলেবেলার গল্প করার সময় বলেছে যে সে তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এই না পারাটা তার পরবর্তীকালের আচরণেও দেখতে পেয়েছে মাধবীলতা। বাবা, বড় পিসিমা গত হওয়ার পরেও বোধহয় সেই কারণে অনিমেষ জলপাইগুড়িতে এসে ছোটমার কাছে কিছুদিন থাকতে চায়নি। তাই আজ তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অনিমেষের এভাবে ভেঙে পড়া মাধবীলতাকে অবাক করেছিল। সে বলল, শান্ত হও। এরকম করছ কেন?

জানি না। হঠাৎ মনে হল সব কিছু শেষ হয়ে গেল। কান্না চাপল অনিমেষ।

সব কিছু শেষ হয়ে গেল? মাধবীলতা অনিমেষের হাত ধরল।

মা, দাদু, বড় পিসিমা, বাবা চলে গিয়েছেন অনেক আগে। আজ মনে হচ্ছে এতদিন তো ছোটমা ছিলেন যিনি বাবা, দাদু, বড় পিসিমাকে চিনতেন, তাদের সঙ্গে সংসার করেছেন। সেই তার চলে যাওয়া মানে অতীতের সঙ্গে আমার সমস্ত যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যাওয়া। বড় শ্বাস ফেলল অনিমেষ, যাঁকে কখনওই মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি তার চলে যাওয়ার সময় এলাম। সেই ছোটবেলায় আমার নিজের মায়ের মুখাগ্নি করেছিলাম। তারপর তিন তিনজন যখন চলে গেলেন আমি তখন কলকাতায়। শেষযাত্রায় পৌঁছোতে পারিনি। সেই দায় মেটাতেই বোধহয় এবার এলাম আমার দ্বিতীয় মায়ের মুখাগ্নি করতে।

মাধবীলতা বলল, এসব ভেবো না। জীবন যা করতে বলে মানুষকে তাই করতে হয়। মানুষ জীবনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিন্তু শাসন করতে পারে না। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। রাত্রে খেতে ইচ্ছে না করলে খেয়ো না।

রুবি বোর্ডিং থেকে সকাল পৌনে আটটায় বেরিয়ে ওরা যখন রিকশায় উঠল তখন মাধবীলতার ফোন বেজে উঠল। মাধবীলতা সাড়া দিতেই অর্ক বলল, কী ব্যাপার? ওখানে গিয়ে তোমরা কোনও খবর দাওনি। আমি যতবার ডায়াল করেছি ততবার শুনেছি আউট অব রেঞ্জ। শোনো, বাবা কোথায়? ফোনটা দাও, বাবাকে একটা জরুরি কথা বলার আছে।

কী কথা?

তুমি শুনলে রেগে যাবে। বাবাকেই বলব।

শোনো আমাদের মন খুব খারাপ। হাসপাতালে যাচ্ছি। তোমার ছোটঠাকুমা। কাল সন্ধেবেলায় চলে গেছেন। মাধবীলতা গম্ভীর গলায় বলল।

সে কী!

এখন রাখছি।

শোনো অশৌচ-টশৌচ কি মানতে হবে?

মাধবীলতা জবাব না দিয়ে লাইন কেটে দিল। অনিমেষ পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? কী বলছে সে?

কিছু না। মাধবীলতা কথা বাড়াল ।

ওরা হাসপাতালে পৌঁছে দেখল দেবেশ এসে গেছে। সে একা নয়, সঙ্গে আরও দুজন বৃদ্ধ আশ্রমবাসী রয়েছেন। তারা এগিয়ে এসে অনিমেষকে বললেন, আমরা ভাবতে পারছি না। কাল রাত্রে কেউ ঘুমাতে পারিনি। উঃ। দ্বিতীয়জন বললেন, আমাদের সবাইকে মায়ায় জড়িয়ে ছিলেন।

সমস্ত ব্যবস্থা হওয়ার পরে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, দাহ করার জায়গার ব্যাপারে তোর কি কোনও বিশেষ সেন্টিমেন্ট আছে?

মানে? অনিমেষ তাকাল।

তোর দাদু, বাবা, বড় পিসিমাকে কি মাসকলাইবাড়ির শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?

সম্ভবত। আমি তখন ছিলাম না। জলপাইগুড়িতে কি তখন আর কোনও শ্মশান ছিল?

না। দেবেশ মাথা নাড়ল।

তা হলে ওখানেই–। তুই জিজ্ঞাসা করছিস কেন? অনিমেষ প্রশ্ন করল।

এখন পর্যন্ত আমাদের আশ্রম থেকে কেউ চলে যাননি, আমরা ভেবেছি যদি কেউ আপত্তি না করে তা হলে চলে যাওয়া মানুষের সৎকার আশ্রমের পাশেই করব। যেখানে তিনি ছিলেন সেখানকার মাটিতেই যেন তিনি মিশে থাকেন। দেবেশ কথাগুলো বলতেই দুই বৃদ্ধ মাথা নেড়ে সমর্থন করল।

অনিমেষ বলল, এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?

দেবেশ অনিমেষের হাত ধরল, আশ্রমের সমস্ত বয়স্ক-বয়স্কারা অপেক্ষায় রয়েছেন। মাসকলাইবাড়িতে গেলে ওঁদের পক্ষে আসা সম্ভব হত না। অনেক ধন্যবাদ তোকে।

.

একটা ম্যাটাডোরে খাঁটিয়ায় শুইয়ে ছোটমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জলপাইগুড়ি শহরের বাইরে, আশ্রমে। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে অনিমেষ আর একজন বৃদ্ধের সঙ্গে ড্রাইভারের পাশে বসল। মাধবীলতা ছোটমার মাথার কাছে ম্যাটাডোরের ওপরেই বসে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। দেবেশ এবং আর এক বৃদ্ধ দুপাশে দাঁড়িয়ে। ম্যাটাডোর ছুটে যাচ্ছিল রাজবাড়ি ছাড়িয়ে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল এইসব রাস্তা, রাজবাড়ির গেট, ডানদিকের দিঘি যা সে আবাল্য দেখে এসেছে, যার ছবি আমৃত্যু মনে থাকবে তা আজ চিরদিনের জন্যে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর কখনও জলপাইগুড়িতে ফেরার জন্যে কোনও পিছুটান রইল না। বুকে ভার জমছিল তার।

.

মহিলাদের কান্নাকাটির পর্ব শেষ হলে ছোটমাকে নিয়ে যাওয়া হল পুকুরের প্রান্তে, সেখানে ইতিমধ্যে আবাসিকরা চিতা সাজিয়ে রেখেছিলেন। দেবেশ বলল, তুই যদি এখানে নিয়ে আসার অনুমতি না দিতিস তা হলে সবাই খুব কষ্ট পেত।

মাধবীলতা দেখল সমস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছেন। সবচেয়ে যিনি বৃদ্ধা তিনি হাত জোড় করে কিছু স্তোত্ৰজাতীয় লাইন সুরে গাইছেন। সে কাছে গিয়ে কান পেতে চমকে উঠল। বৃদ্ধা যে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন। কোনও হরিধ্বনি ভয়ংকর শব্দে আকাশ চৌচির করছে না।

দেবেশ সাহায্য করল। মুখাগ্নি করল অনিমেষ। জীবনের প্রান্তে এসে এই প্রথম সে তার অতীতকে অগ্নিশুদ্ধ করল। দাউদাউ আগুন যখন আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে তখন অনিমেষের চোখে পড়ল কেউ একজন এগিয়ে আসছে। সেই লাল আগুনের দেওয়াল ভেদ করে উসকো খুসকো চেহারার মানুষটাকে দেখতে পেল সে। রামজি এসে হাত জোড় করে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত চিতার দিকে। রামজি এখানে কী করে এল?

.

৫০.

ছোটমায়ের শরীর চিতার পোড়া কাঠের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর যা করণীয় তা বয়স্কদের নির্দেশ মেনে পালন করল অনিমেষ। মহিলাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাধবীলতা আজ অন্য অনিমেষকে দেখল। অস্থি বিসর্জনের পরে অনিমেষ দেবেশকে বলল, আমাকে একটা সাদা থান এনে দে।

দেবেশ অবাক হল। সে কী! তুই কাছা নিবি?

না। গলায় কাছা নেব না। কিন্তু এই পাজামা পাঞ্জাবি ছেড়ে থাকব কয়েকটা দিন। আশ্রমে না থাকলে বাজার থেকে আনিয়ে দে, মাধবীলতাকে বলছি টাকা দিতে। আমি ততক্ষণ এখানেই অপেক্ষা করছি। অনিমেষ চিতার দিকে তাকিয়ে বলল।

দেবেশ বলল, আমি ভেবেছিলাম এসব রিচ্যুয়াল মানবি না, শ্রাদ্ধ করবি না।

অনিমেষ বলল, তুই ঠিকই ভেবেছিস দেবেশ। ব্যক্তিগতভাবে আমি এগুলো কখনও মানিনি, মূল্যহীন একটা সংস্কার বলে মনে করি। যিনি চলে গেলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা না রেখে যারা এইসব ধড়াচুড়ো পরে শ্রাদ্ধ করে, লোক খাওয়ায় তারা আত্মপ্রচার করে। তুই ঠিকই ভেবেছিস।

মাধবীলতা এবং কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। মাধবীলতা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, তা হলে তুমি থান পরতে চাইছ কেন?

অনিমেষ বলল এই মহিলা সারাজীবন ঠাকুরঘরে থেকে গেছেন নিজের কষ্ট ভোলার জন্যে। দেবদেবীর পুজো করে নিজের কষ্ট ভুলতে চেয়েছিলেন। আমরা যখন ওঁর কাছে এসে কিছুদিন ছিলাম তখন তো দেখেছ সারাদিনের বেশিরভাগ সময় ওঁর ঠাকুরঘরেই কেটে যেত। জীবনভর তিনি তাঁর মতো করে বেঁচেছিলেন। আমি একমত না হলেও যখন মুখাগ্নি করেছি তখন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এই কয়েকদিন তার শান্তির জন্যে নিজের মতামত সরিয়ে রাখছি।

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, আমি আজও ঠিক বুঝতে পারলাম না।

অনিমেষকে একটা মোড়া এনে দেওয়া হল পুকুরের ধারে বসার জন্যে। ভিড়টা সরে গেল আশ্রমের দিকে। অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, ওই যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ডেকে দাও।

মাধবীলতা দেখতে পেল, জিজ্ঞাসা করল, ও কে?

ওর নাম রামজি। তোমার ছেলে কলকাতার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল।

আশ্চর্য! ও এখানে কী করে এল? মাধবীলতা বিরক্ত হল।

ওর সঙ্গে কথা না বললে জানা যাবে না। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা রামজির কাছে গিয়ে কথা বলে আর পঁড়াল না। দূরে বৃদ্ধারা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সেখানে চলে গেল।

কাছে এসে রামজি হাতজোড় করল, আমাকে মাপ করুন।

আমি এখানে এসেছি তা কি অর্কর কাছে জেনেছ? অনিমেষ তাকাল।

হ্যাঁ চাচা। বিপদে পড়ে ওঁকে ফোন করেছিলাম। ওর কাছে শুনলাম। আমার মোবাইলের টাকা শেষ হয়ে গেছে। তাই ওর কাছ থেকে আপনার নাম্বার নিয়ে ফোন করতে পারিনি।

তুমি এখানে কোথায় উঠেছ?

আপনি যে চা-বাগানে যেতে বলেছিলেন সেখানে গিয়ে শুনলাম যাঁর কাছে আপনি পাঠিয়েছিলেন তিনি দুবছর আগে মারা গিয়েছেন। ওঁর বউ ছেলে আমাকে দুদিন থাকতে দিয়েছিল। কিন্তু ওরা খুব গরিব মানুষ। ওখানে কাজ পেতে গেলে অন্তত এক মাস থাকতে হত যা ওদের ওপর অত্যাচার হয়ে যেত। সঙ্গে যা টাকা ছিল তা ওদের দেওয়ার পরে আমার হাতে আর কিছু নেই। রামজি বলল।

ওরা কি টাকা চেয়েছিল?

না চাচা। অবস্থা দেখে না দিয়ে পারিনি।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, বহু বছর যোগাযোগ নেই। সব পালটে গেল। এখানে কীভাবে এলে?

হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওখানেই খবর পেলাম, আশ্রমের কথা শুনলাম। ওখান থেকে হেঁটেই চলে এসেছি। রামজি বলল।

এখন কী করবে?

চাচা, আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা দেন তা হলে দেশে চলে যেত পারি। আমি আর পারছি না। রামজি শ্বাস ফেলল।

কিন্তু তুমি বলেছিল সেখানে পুলিশ তোমাকে খুঁজছে।

হ্যাঁ। ফাঁসি তো দেবে না, দু-তিন বছরের জেল হতে পারে। জেলেই যদি থাকতে হয় দেশের জেলেই থাকব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি টাকাটা গিয়েই শোধ করে দেব।

অনিমেষ হাসল, তা হলে তোমার বিপ্লব শেষ হয়ে গেল!

রামজি বলল, চাচা, এই বাংলায় কখনও বিপ্লব হবে না।

বড় দেরি হয়নি কথাটা বুঝতে। আমরা অনেক হারিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

আপনাদের সময়ে কী ছিল জানি না। এখন মানুষের মন থেকে জোর চলে যাচ্ছে। এই সরকার আসার পর থেকে আমাদের অনেকেই লোভী হয়ে উঠেছে। আপনাকে আমি এই সময় নিশ্চয়ই বিরক্ত করছি কিন্তু থেমে গেল রামজি।

অনিমেষ মুখ তুলে দেখতে চাইল মাধবীলতা কোথায়! না দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াতেই একজন প্রৌঢ় তাড়াতাড়ি চলে এলেন, কোনও দরকার আছে?

এই ছেলেটি আমার পরিচিত। মনে হচ্ছে ও অভুক্ত। যদি কিছু খাবার ওকে দেওয়া সম্ভব হয়– অনিমেষ নিচু গলায় বলল।

নিশ্চয়ই, বড়মাকে বললে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আসুন ভাই। রামজিকে ডাকলেন প্রৌঢ়। রামজি হেসে ফেলল অনিমেষের দিকে তাকিয়ে, আপনি কী করে বুঝলেন?

ওঁর সঙ্গে যাও। অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

.

কিন্তু মাধবীলতা আপত্তি জানাল। বলল, চিনি না, জানি না, একটা উটকো ছেলেকে তোমার ছেলে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল বলে আমরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম আর তুমি সেই ছেলেকে অতগুলো টাকা দিতে বলছ?

অনিমেষ স্নান সেরে শরীরে থান জড়িয়ে বসে ছিল। দেবেশের অনুরোধে আজ সে হবিষ্যি না করে নিরামিষ খেয়েছে। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে সে বলল, বেচারা খুব বিপদে পড়েছে। ওকে সাহায্য না করলে–।

পৃথিবীর প্রচুর মানুষ এই মুহূর্তে বিপদে রয়েছে।

ঠিকই। কিন্তু ওই ছেলেটা তো দিব্যি নিজের বাড়িতে থেকে কাজকর্ম করতে পারত। তা না করে এতদূরে এসে বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখল। নিজের ভবিষ্যৎ বা বর্তমানের কথা একটুও ভাবল না। অনিমেষ বলল, যে কেউ বলবে এটা হঠকারিতা। ইচ্ছে করে নিজের বিপদ ডেকে আনা। যা একসময় আমরা করতে চেয়েছিলাম তা এরা করছে। ইতিহাস থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি। এই ছেলে যদি আবার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে চায় তা হলে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করাই যেতে পারে।

আমাদের কাছে কেন? মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাক। মাধবীলতা বিরক্ত হচ্ছিল।

মানে? অনিমেষ অবাক হল।

কাগজে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদীদের কাছে মূলস্রোতে ফিরে আসতে আবেদন করেছেন। ওরা আত্মসমর্পণ করলে তিনি তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেবেন। এই রামজিকে বলো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে। মাধবীলতা বলল।

সে কী! মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে উনি তো বলেছিলেন এই রাজ্যে কোনও মাওবাদী নেই, যা গোলমাল, খুনখারাপি হচ্ছে তা সিপিএমের হার্মাদবাহিনী করে মাওবাদীদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। সেই তিনি কাদের পুনর্বাসন দিচ্ছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

তোমরা কারও ভাল কাজকেও স্বাভাবিক মনে নিতে পারো না? সবসময় ছিদ্র খোঁজো। বিরোধী নেতা হিসেবে যা বলা যায় ক্ষমতায় থাকলে তা বলা যুক্তিসংগত নয়। তুমি ওই রামজিকে বলো থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে। মাধবীলতা চলে গেল।

অনিমেষ ফাঁপরে পড়ল। তার নিজের কাছে শচারেক টাকা আছে। যা কিছু খরচ তা মাধবীলতাই করে বলে তার টাকা সঙ্গে রাখার দরকার হয় না। এখন মনে হল, জলপাইগুড়ি থেকে হাজারিবাগ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট চারশো টাকার মধ্যে হয়তো হয়ে যাবে। সাধারণ ক্লাসে এর বেশি বোধহয় লাগবে না। ঘরে গিয়ে টাকাটা বের করে সে রামজির খোঁজে বের হল।

ক্র্যাচ নিয়ে কিছুটা হাঁটতেই দেবেশকে দেখতে পেল। দেবেশের পাশে রামজি। কাছে এসে দেবেশ বলল, এই ছেলেটি তত বেশ কাজের। আমাদের একটা পাম্প মাস দুয়েক হল খারাপ হয়ে পড়ে ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে মেকানিক আনিয়ে সারাতে প্রায় সাত-আটশো খরচ হত। তারপর সে যদি বলত পার্টস কিনতে হবে তা হলে তো হয়েই যেত। তোমার রামজি আধঘণ্টার চেষ্টায় পাম্পটাকে চালু করে দিয়েছে। অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলাম।

অনিমেষ রামজির দিকে তাকাল। বাঃ, খুব ভাল কথা।

দেবেশ বলল, তার ওপর ও বলছে গাড়ি চালাতে জানে।

গাড়ি? আশ্রমে গাড়ি আছে নাকি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

গাড়ি নেই। তবে জলপাইগুড়ির এক ব্যবসায়ী তার একটা পুরনো ম্যাটাডর আশ্রমকে দিতে চেয়েছিলেন, আমি নিইনি। পুরনো গাড়ি, রোজ বিগড়াবে, সারাইয়ের খরচ, ড্রাইভারের মাইনে দেব কোত্থেকে? তা রামজি বলছে ছোটখাটো খারাপ হলে ও সারাতে পারবে। আর থাকা খাওয়া ছাড়া মাসে এক হাজার টাকা পেলে ও আশ্রমেই থেকে যেতে পারে। লোভনীয় প্রস্তাব। তুই কী বলিস?

অনিমেষ রামজির দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি দেশে ফিরে যাবে না?

রামজি হাতজোড় করল, আশ্রমের জন্যে কাজ করার সুযোগ পেলে থেকে যেতে রাজি আছি।

অনিমেষের মনে হল দেবেশের প্রস্তাব পেয়ে ছেলেটা আর আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এটা ভুল হচ্ছে। হাজারিবাগে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলে দু-তিন বছর ওকে জেলে কাটাতে হতে পারে, কিন্তু তারপর তো সারাজীবনের জন্যে মুক্ত। কিন্তু এখানে থাকলে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে। উত্তরবাংলার এই নির্জন জায়গায় একটি অবাঙালি ছেলে আশ্রমের গাড়ি চালালে কারও না কারও মনে সন্দেহ আসতেই পারে। সেটা পুলিশের কানে গেলে ও বিপদে পড়বে। অনিমেষ বলল, কিন্তু রামজি, আমাকে তুমি বলেছিলে দেশে ফিরে যেতে চাও, আমার মনে হয় তাই যাওয়া ভাল।

দেবেশ বুঝতে না পেরে বলল, আরে ভাই কেন ওকে দেশে যেতে বলছিস! ওখানে তো কাজকর্ম কিছু করে না। ও নিজে থেকেই এখানে থাকতে চাইছে যখন তখন থাক না। তোর পরিচিত লোক, তুই না বললে আমি জোর করতে পারি না।

অনিমেষ হাসল, বেশ। তোর যখন ইচ্ছে হচ্ছে তখন আমি বাধা দেব না।

.

আনন্দের উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙল। ক্ষমতা দখল করেছিলেন কোটি মানুষের ভালবাসা পেয়ে একজন মহিলা। নির্বাচনের আগে তাঁর সংগঠন ছিল সীমিত। কিন্তু নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেল প্রতিটি কেন্দ্রে মানুষ ভোট দিয়েছেন তার মুখের দিকে তাকিয়ে। পরিহাস করে বলা হল, তার আশীর্বাদ পেলে একজন বাবা এবং কালা মানুষও নির্বাচনে জিতে যেত এবার। কুরুক্ষেত্রের আগে শ্রীকৃষ্ণ যে দলে যোগ দিয়েছিলেন সেই দলই জিতে যাবে বলে ব্যাসদেব ইঙ্গিতে জানিয়েছিলেন। দুর্যোধনের ঔদ্ধত্য, যুধিষ্ঠিরের নম্র আচরণই ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। মানুষ এই নির্বাচনে নেত্রীকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিল এবং দেখেছিল। নির্বাচনের পরে ওই সীমিত সংগঠিত দল আচমকা ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়ে গেল। যারা কখনওই তৃণমূলের ছায়া মাড়ায়নি তারা ক্ষমতার স্বাদ পেতে বেনোজলের মতো ঢুকে গেল সংগঠনের নিচুতলায়।

নেত্রীর স্লোগান ছিল, ভয়ংকর অত্যাচারী সিপিএমকে সরিয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন এনেও নেত্রী সেই বক্তব্যে অটল থাকলেন। তার মুখে ক্রমাগত সিপিএম বিরোধী কথা শুনে উদ্দীপ্ত হলেন দলের প্রথম সারির নেতারা। তারা সর্বত্র সিপিএমের ভূত দেখতে লাগলেন। সেই উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ল নিচুতলায়। সদ্য দলে যোগ দেওয়া তৃণমূল কর্মীরা গ্রামে গ্রামে মফস্সলে সিপিএমের কার্যালয় ভাঙতে লাগল। মানুষ ভয় পেল। নেত্রী বলেছিলেন গণতন্ত্রে তিনি বিশ্বাস করেন, অথচ দলতন্ত্র প্রবল হচ্ছে। নেত্রী তা বন্ধ করতে মুখ খুলছেন না। উলটে যা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা সিপিএমের তৈরি বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী না বিরোধী নেত্রী সেটা সাধারণ মানুষের কাছে মাঝে মাঝেই বিভ্রম তৈরি করছিল। কেউ সামান্য সমালোচনা করলে মুখ্যমন্ত্রী যদি বিরক্ত হয়ে পড়েন, তার পারিষদরা উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে মানুষ দেখছে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী যে আচরণ করত ঠিক তার অনুকরণ করছে তৃণমূলের নিচু তলার কর্মীরা। রাতারাতি স্কুলপরিচালন সমিতি পালটে যাচ্ছে। তার সভাপতি হয়ে যিনি আসছেন তার বিদ্যে স্কুলের চৌহদ্দিতেই শেষ হয়েছে। কিন্তু মানুষ কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।

কারণ কেউ প্রতিবাদ করলে সে কারও সমর্থন পাবে না। পুলিশ তাদের আচরণে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে কোনও তৃণমূল নেতা-নেত্রী কর্মীর বিরুদ্ধে তারা অ্যাকশন নেবে না, বামফ্রন্টের আমলে তারা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল তাতে যদি মাস্টার্স ডিগ্রি পেয়ে থাকে এখন তারা নামের আগে ডক্টর লিখতে চাইছে। উলটে তৃণমূল কর্মীরা ভাঙচুর করলে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে অপরাধীদের কেউ তৃণমূলের সমর্থক ছিল না। তবু পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা মানুষ ভাবছিল, বন্যার পর অনেক আগাছা ভেসে আসে। জল যখন যায় তখন পলি পড়ে। তারপর সেই মাটিতেই নতুন করে শস্য তৈরি হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই সবকিছু সামলে পরিবর্তিত শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করবেন।

কুন্তীর ফোন এল, চলে আসুন।

অর্ক অবাক হল, কোথায়?

সকাল ছটা পঞ্চান্নর ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরবেন হাওড়া স্টেশন থেকে। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে নামবেন গালুডি স্টেশনে। ওখান থেকে শেয়ার অটোতে উঠে বলবেন ভাল পাহাড়ে যাবেন। বান্দোয়ানের আগেই ভাল পাহাড়। কুন্তী বলল।

আপনি এখন ওখানে?

হ্যাঁ। দারুণ জায়গা। কমলবাবুর এই স্কুলের বাইরে কোনও মানুষ নেই। শুধু গাছ আর গাছ। দূরে দূরে পাহাড়ের বেড়া। বাতাসে এত অক্সিজেন আমি আগে কখনও পাইনি। আমার মন খুব ভাল হয়ে গেছে। কুন্তী বলল।

আপনি কি এখন ওখানেই থেকে যাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

না। কমলবাবু চাইছেন এইসব জেনে কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি একটু ভেবে দেখি। আর আমার সঙ্গ কেমন লাগল তাও এঁরা ভাববেন। দুই ভাবনা মিলে গেলে সামনের মাস থেকে আমি পাকাপাকি চলে আসব। এখানে কমলবাবুর সঙ্গে যারা আছেন, সব ছেড়ে মহা আনন্দে বাচ্চাদের মানুষ করছেন সেই জয়তী, দিলীপবাবু আর প্রদীপবাবুরা কিন্তু আমাকে পছন্দ করেছেন। আমি তো আরও দিন তিনেক এখানে আছি, চলে আসুন না। কুন্তী অনুরোধ করল।

দেখি, গেলে আপনাকে জানাব। অর্ক কথাগুলো বলতেই লাইন কেটে গেল। যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, কাল রবিবার। সঙ্গে আরও দুদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে ঘুরে আসা সম্ভব। কিন্তু কমল চক্রবর্তীরা তাকে কীভাবে নেবে? কুন্তী কি তাকে বন্ধু বলে পরিচয় করাবে। তা ছাড়া সেখানে থাকার ব্যবস্থা কীরকম তা জানা নেই। অর্কর মনে হল এখন গিয়ে জটিলতা তৈরি করলে হয়তো কুন্তী সম্পর্কে ওরা সুবিচার করতে পারবে না। তার চেয়ে সামনের মাস থেকে কুন্তী যদি ওখানে গিয়ে থাকে তা হলে তখন যাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু অর্কর খুব ভাল লাগল। তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। এই বয়সে পৌঁছে কুন্তীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে যে তার মনের বয়স কমতে শুরু করেছে তা টের পাচ্ছিল। আজ কুন্তীর ফোন পাওয়ার পর মনে হল তার সামনে ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে অনেক সময় পড়ে আছে।

মাধবীলতাকে ফোন করল অর্ক, ফোন বন্ধ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করে যাওয়ার পরে কৃষ্ণ দ্বারকার রাজা হিসেবে তাঁর যাদব প্রজাদের নিয়ে শান্তিতে থাকবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রজাদের চরিত্র ও স্বভাব যে বদলে যাচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারেননি। এই সময় নারদ মুনি, বিশ্বামিত্র এবং কন্বমুনি দ্বারকায় এলে যাদবদের কয়েকজন কৃষ্ণের ছেলে শাম্বকে মহিলা সাজিয়ে মুনিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, এই মহিলার যে সন্তান হবে সে ছেলে না মেয়ে তা বলুন। লোকগুলোর এই ইতর রসিকতা বুঝতে পেরে তারা অভিশাপ দেন শাম্ব একটি লোহার মুষল প্রসব করবে যা যদুবংশকে ধ্বংস করবে। ভয় পেয়ে ওই যাদবরা লোহার মুষলকে ভেঙে চুরমার করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেন। মুনিদের শাপে পুরুষ শাম্ব পরের দিনই মুষলটাকে প্রসব করে।

কৃষ্ণ দ্বারকায় মদ্যপান নিষেধ করেছিলেন। এতে অসন্তুষ্ট হয় কিছু যাদব। চারদিকে অনেক অমঙ্গলের চিহ্ন দেখে কৃষ্ণ সমুদ্রের তীরে প্রভাসতীর্থে সবাইকে পুজোর জন্যে যেতে বলেন, যাদবদের অনুরোধে মাত্র একদিনের জন্যে সুরাপানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নেন, সেইদিন প্রচুর সুরাপান করে যাদবরা মত্ত হয়ে কৃষ্ণের রথের সারথি সাত্যকি ও পুত্র প্রদ্যুম্নকে পানপাত্রের আঘাতে হত্যা করে। কৃষ্ণ সেই হত্যাদৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ হন। তিনি একমুঠো তৃণ তুলে নিতেই সেই তৃণ লোহার মুষলে রূপান্তরিত হয়। সেই লোহার মুষলে কৃষ্ণ সুরামত্ত যাদবদের হত্যা করলেন। কিন্তু ক্রমশ সব তৃণ লোহার মুষলের চেহারা নিতেই যাদবরা তাই দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল। ক্রমশ যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল। কৃষ্ণ বনবাসী হওয়ার সংকল্প নিলেন। তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল। এই সময় গাছের নীচে বসে থাকা কৃষ্ণকে হরিণ ভেবে একজন ব্যাধ তির ছুড়লে তা কৃষ্ণের পায়ে বিদ্ধ হয়। যাঁর হাতে সুদর্শন চক্র থাকত, যিনি ঈশ্বরের বিকল্প হিসেবে মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন, সেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী কৃষ্ণ এমন শক্তিহীন হয়ে গেলেন যে, তিরের আঘাতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা সারাতে পারলেন না। তার মৃত্যু হল। খবর পেয়ে অর্জুন দ্বারকায় এসে কৃষ্ণের সৎকার করে মহিলাদের হস্তিনাপুরে নিয়ে যান। দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হল।

অতি জনপ্রিয় কৃষ্ণ ওই মৌষলপর্বে দ্বারকাকে রক্ষা করতে পারেননি। এই মৌষলকাল পশ্চিমবঙ্গে আসুক তা সাধারণ মানুষ চাইছেন না।

.

৫১.

দুপুরে কুন্তী ফোন করেছিল। সে কলকাতায় ফিরে এসেছে। সন্ধেবেলায় অর্ক কুন্তীর বাড়িতে গেল। ওপর থেকে নীচে নেমে দরজা খুলল কুন্তী। হেসে বলল, আসুন। ওপরে উঠে আগের জায়গায় বসল ওরা। অর্ক চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, মা-দিদাদের দেখছি না?

মা দিদাকে তার আর এক মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে গিয়েছেন। দিদার ভাগ্য খুব ভাল। মেয়েরা পালা করে মাকে নিজেদের কাছে রাখে। ফলে দিদার ফ্ল্যাট তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়ে। কুন্তী আবার হাসল, চা খাবেন?

ওটা করে দেওয়ার মতো কেউ আছে?

না। আমাকেই করতে হবে। কুন্তী উঠতে যাচ্ছিল।

বসুন। এখনই চায়ের দরকার নেই। অর্ক বলল, আমরা বাইরে মিট করতে পারতাম।

তা হলে এই বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে যেতে হত আমাকে। মা জানে যে আপনি আসবেন। খালি বাড়িতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার কি সমস্যা হচ্ছে?

আমি বলতে চাইছি, চা বানাতে গেলে তো আপনি কিছুটা সময় এখানে থাকবেন না। সেই সময়টুকু কোনও রেস্টুরেন্টে বসলে নষ্ট হত না। অর্ক বলল।

ও। তাই বলুন! কুন্তী হাসল।

এবার বলুন, কী ঠিক করেছেন?

জায়গাটাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তবে ঠান্ডার সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা। আবার গরমের সময় অসহ্য গরম। কিন্তু কমলবাবুরা এত গাছ ওখানে আনিয়েছেন যে আবহাওয়াটা ম্যানেজ করা যাবে। তা ছাড়া আমার খুব ভাল লেগেছে ওখানকার মানুষদের। এই কদিনে আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আর বাচ্চাগুলো এত মিষ্টি, ওই স্কুল না তৈরি হলে ওরা কোথায় ভেসে যেত! কুন্তী মাথা নাড়ল।

কেন?

জায়গাটা বান্দোয়ান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। কাছাকাছি গ্রামগুলো জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের গায়ে। সেখানে প্রচুর ধরপাকড় হয়েছিল কারণ মাওবাদীদের মুক্ত অঞ্চল ছিল এলাকাটা। অনেক খুন হয়েছে। মাওবাদীরা করেছে, পুলিশও। ওদের শিশুরা স্কুলের মুখ দেখত না। বাবা ঠাকুরদাদের মতো অক্ষর না চিনে বড় হয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করত। কমলবাবু স্কুল করার পর সেই তিন-চার বছরের শিশুরা অক্ষর চিনল, ভাল করে কথা বলতে শিখল, পড়াশোনা আরম্ভ করল। এর জন্যে ওদের পেট ভরে ভাত খেতে দিতে হয়েছে যা গ্রামে প্রায় দুর্লভ ছিল। ভাবতে পারেন, শুধু ভাতের জন্যে বাচ্চাগুলো পড়তে পড়তে একের পর এক ক্লাসে উঠছে? কুন্তী তৃপ্ত গলায় কথাগুলো বলল।

এদের কারও বাবা-কাকা মাওবাদী?

এককালে থাকলেও এখন ওই এলাকায় মাওবাদী কার্যকলাপ নেই।

তবু তো একটা আতঙ্ক থাকেই।

না। নিজের বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই স্কুলটাকে স্পর্শ করেনি ওরা। আর বোধহয় এই কারণে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় এই স্কুল ছিল। কুন্তী বলল।

এখন কী?

এখন তো ওই অঞ্চলে মাওবাদীদের অস্তিত্ব আগের মতো শোনা যায় না। তার ফলে পুলিশও তেমন আক্রমণাত্মক নয়। কুন্তী বলল।

তা হলে আপনাকে ওদের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অর্ক বলল।

না। ওঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। চলে আসার সময় কমলবাবু বলেছেন, আমি ওঁদের সঙ্গে বাচ্চাদের জন্যে কাজ করলে সবাই খুশি হবেন। কুন্তীর ঠোঁটে হাসি।

ও আচ্ছা! তা হলে কবে যাচ্ছেন?

মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সামনের এক তারিখে যাব। কুন্তী হঠাৎ গলার স্বর বদলাল, আচ্ছা, আপনি ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারেন না?

অর্ক হাসল, আমাকে ওরা থাকতে দেবে কেন? আপনি শিক্ষকতা করেছেন তাই আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। আমার তো– ।

আচ্ছা, শিক্ষকতা ছাড়াও তো ওখানে প্রচুর কাজ আছে। সংগঠনের কাজ। আমি কমলবাবুকে আপনার কথা বলব? সোজা হয়ে বসল কুন্তী।

কী পরিচয় দেবেন?

যেটা ঠিক। বন্ধু। জবাব দিল কুন্তী।

এখনও এ দেশের মানুষ দুই অনাত্মীয় পূর্ণ বয়সের নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে বলে মনে করে না। তারা অন্য ব্যাখ্যা করে। অর্ক বলল।

দুহাজার তেরোতে এসে সেটা অনেক কেটে গেছে। আজ দুপুরে বেরিয়েছিলাম। মেট্রো স্টেশনের ঢোকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি উনিশ কুড়ির ছেলেমেয়ে। হঠাৎ মেয়েটা শব্দ করে কেঁদে উঠতেই ছেলেটা তাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম যেমন, তেমন যারা আশপাশে ছিল তারা দৃশ্যটা দেখেও দেখল না। কয়েক বছর আগে ওরকম করলে ওদের কী অবস্থা হত ভাবুন তো? যত রেপ হোক, ইভটিজিং হোক, তলে তলে মানুষের মানসিকতার বদল হয়েছে এটা তো মানেন? কুন্তী সরাসরি তাকাল।

না মানি না। আগে মানুষ প্রতিবাদ করত। এখন করে না। এখন নিজের স্বার্থ দেখে। ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি তৃণমুলের সমর্থক না হয় তা হলে প্রতিবাদ করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধেই একটা সাজানো মামলা রুজু করতে পারে। তার চেয়ে চারপাশে যা হচ্ছে হোক, আমি যেন আমার মতো বাঁচতে পারি, এটাই এখন সত্যি। অর্ক বলল।

চোখ কপালে তুলল কুন্তী, এ কী? আপনার মুখে কী শুনছি?

তার মানে?

নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের পতন চেয়ে আপনি তৃণমুলকে সমর্থন করেছিলেন। হঠাৎ পালটে গেলেন যে! বেশ অবাক হয়ে বলল কুন্তী।

আমি এখনও মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করি। কিন্তু ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি বামফ্রন্টের সমর্থক হত তা হলে ইচ্ছে থাকলেও ওসব করতে সাহস পেত না। সাহসী হলে পুলিশ মেরে হাত ভেঙে দিত। ওরা শাসক পার্টির সমর্থক বলে সাহস পাচ্ছে, পুলিশ কিছু বলছে না। অর্ক পরিষ্কার বলল।

আপনি বলতে চাইছেন এর মধ্যেই বিজয়ী সমর্থকরা নেত্রীর নির্দেশ মানছে না?

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ্যে নয়। আমাদের পাড়ায় বিশ্বজিৎ চিরকাল সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং যিনি ওর পাশাপাশি নেতা হয়েছেন তিনি বছর দেড়েক আগে সিপিএম থেকে তোলা আত্মসাৎ করার জন্যে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এই খবর নেত্রী জানেন না। যেসব নেতারা ওই লোকটিকে বিশ্বজিতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তারা ওঁকে জানাবেন না। রাজা তো কান দিয়েই দেখেন! অর্ক বলল।

এইসব ঝামেলা ভাল পাহাড়ে নেই। ওখানে শান্তিতে কাজ করতে পারবেন। কুন্তী বলল, আপনি এলে আমার ভাল লাগবে।

অর্ক বলল, যদি যাই তা হলে আপনার জন্যেই যাব।

হাত বাড়িয়ে দিল কুন্তী। অর্ক সেই হাত ধরে বলল, খুশি হলাম।

.

তুমি মাথা কামাবে আমি কখনও ভাবিনি। মাধবীলতা বলল।

চুল ছাঁটিয়ে এসেছি তো দেখেছ, এখন পুরোটাই হেঁটে ফেলেছি। বেশি আর কী? অনিমেষ বলল, জীবনে দ্বিতীয়বার ন্যাড়া হলাম। চিনতেই পারছিলাম না।

হ্যাঁ। তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা গম্ভীর হল।

মানে?

তুমি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে আহত হলে, জেলে গেলে। নিজের স্বার্থের কথা, আমার কথা না ভেবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বাকি জীবন ধরে করে যাচ্ছ। সেই তোমার একটা বিশেষ চরিত্র ছিল। তোমার নিজের মায়ের মৃত্যুর সময় তুমি বালক ছিলে, কিন্তু ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার মৃত্যুর পর তুমি অশৌচ পালন কররানি যা তোমার চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল। সেই তুমি ছোটমায়ের শ্রাদ্ধ করলে মাথা ন্যাড়া করে। শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়লে পুরোহিতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যা অন্ধ সংস্কারে বলা হয়ে থাকে। এই তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অনিমেষ ডাকল, শোনো।

মাধবীলতা দাঁড়াল।

অনিমেষ বলল, পাথরও তো কোনও না কোনও সময় টুকরো হয়ে যায়। আমি যা এতদিন ভেবেছি তা কি সত্যি ছিল? পৃথিবীর কোনও দেশে একটি মানুষ কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ছাড়া শুধু প্রতিবাদী হয়ে একক চেষ্টায় সরকার গঠন করতে পারেন না বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সেই বিশ্বাসটাও তো অসত্য প্রমাণিত হল। কমিউনিজমে বিশ্বাসী মানুষ অশ্লীল আচরণ করতে পারে না বলে দৃঢ় ধারণা ছিল। আমি সিপিএমের মতবাদের বিরোধী হলেও ওদের কমিউনিস্ট বলেই ভাবতাম। কিন্তু অনিল বসু আর তার সঙ্গীরা জনসভায় যে অশ্লীল কথার ফোয়ারা ছোটাল তা কি আমার ভাবনার সঙ্গে মেলে? আজ আমি যা করেছি তা আমার বিপক্ষে গিয়েছে। কিন্তু আমার নিজের পক্ষ কী তাই তো বুঝতে পারছি না। ছোটমা যে জীবনযাপন করতেন তাকে সম্মান দিয়ে নিজের যাবতীয় মানসিকতাকে অসাড় করে যে তার শেষ কাজ করলাম তাতে যদি তিনি এবং আমার ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার আত্মা তৃপ্তি পান তার জন্যে নিজেকে বদলাতে আর আপত্তি নেই। এইসময় বাইরে থেকে রামজির গলা ভেসে এল, চাচা, দেবেশচাচা ডাকছেন।

অনিমেষ গলা তুলল, আসছি, গিয়ে বলো। তারপর মাধবীলতার দিকে। তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রামজি যে এখানে আছে তা অর্ককে বলেছ?

না। ওর সঙ্গে একবারই কথা বলেছিলাম, বলার সুযোগ পাইনি।

কেমন আছে সে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। ওদের পার্টি সরকারে এসেছে। খারাপ থাকবে কেন?

.

দেবেশের অফিসঘরের দরজায় পৌঁছে অনিমেষ দেখতে পেল দুজন লোক ওর সামনে বসে আছে। একজন মোটাসোটা পাঞ্জাবি পাজামায়, অন্যজন ছিপছিপে, পরনে জিনস্ শার্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ডেকেছিলি?

গম্ভীর মুখে দেবেশ বলল, হ্যাঁ। বোস। অনিমেষ চেয়ারে বসার পর দেবেশ বলল, ও অনিমেষ, আমার বাল্যবন্ধু। ইনি স্থানীয় তৃণমূল নেতা, সম্পন্ন মানুষ, আর উনি ওঁর সহকারী।

তৃণমূল নেতা বললেন, আমার নাম অনুকুল রায়। আমি মশাই কাউকে ঝামেলায় পড়তে দেখলে স্থির থাকতে পারি না। কিছু মাথা গরম ছেলে, আমাদের দলের, দেবেশবাবুর সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছে। আরে, একজন মানুষ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সেবা করছে, তাকে সেটা করতে দে।

দেবেশ বলল, অনুকূলবাবু বলছেন, ওরা যেসব শর্ত দিয়েছে তা উনি বাতিল করে দিচ্ছেন। হিসেব দেখাতে হবে না, ওঁর পরিচিত এক বৃদ্ধাকে যদি থাকতে দিই তা হলে উনি খুশি হবেন। ছেলেদের সঙ্গে যা বলার তা উনি বলে নিয়েছেন।

অনিমেষ বলল, বাঃ, এ তো ভালই হল। একজনের থাকা খাওয়ার যা খরচ তা যদি সবাই যা দেয় তা থেকে ম্যানেজ করে নিতে পারিস

সেটা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে অনুকূলবাবু মাসে কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক চাইছেন। সেটা দেব কোত্থেকে? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।

অনুকুলবাবু বললেন, আমি যে ছেলেদের শান্ত করলাম, আপনাদের গায়ে যাতে কোনও আঁচ না লাগে তার ব্যবস্থা করব তার জন্যে এটা কি খুব বেশি চাওয়া হচ্ছে?

কিন্তু আমার সামর্থ্য কোথায়! দেবেশ বলল।

হে হে। আপনি একদম ভুলে গেছেন। হাসলেন অনুকূলবাবু, কয়েকদিন আগে যে ভদ্রমহিলা গত হয়েছেন তিনি নাকি বাড়ি বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা রেখে গেছেন। সেই টাকা তো আশ্রমই পাবে। তিনি নেই, খরচও নেই। সেই টাকার সুদ থেকেই তো এটা দিতে পারেন। আচ্ছা, একটা বন্দোবস্ত হোক, ওই টাকার যা সুদ পাবেন তার অর্ধেক আমায় দিলেই চলবে। মাসিক কিস্তি দিতে হবে না।

অনিমেষ মুখ খুলল, যিনি মারা গেছেন তিনি আমার মা। তার রেখে যাওয়া টাকা আশ্রম পাবে না। তার সুদ দেবেশ তো পাবে না।

বাঃ। এটা তো আরও সহজ হয়ে গেল। উনি তো জলপাইগুড়িতে একাই থাকতেন। আপনি তো ভুলেও দেখাশোনা করেননি। আজ মারা যেতেই উদয় হলেন। এ নিয়ে হইচই করতে পারি। কিন্তু করব না। আপনি অর্ধেক দিয়ে দেবেন।

অনিমেষ উত্তেজিত হল, আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার দলের কলকাতার নেতাদের জানাব। এসব কী করছেন এখানে?

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন অনুকূলবাবু, নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনলেন দেবেশবাবু! এই ভদ্রলোক গোখরোর মুখে হাত ঢুকিয়েছেন। আরে, কলকাতার নেতারা কী করবে? আমরা বিশ ত্রিশ কি এক লাখ খাচ্ছি। যারা আমাদের বাঁচাবে তারা কোটির নীচে মুঠো খোলে না। নেত্রীর কানে তারা কখনওই কথা তুলবে না, আর বাইরের লোক নেত্রীকে বললে আমরা তাঁকে জানিয়ে দেব ইনি সিপিএম। নেত্রী সেটাই বিশ্বাস করবেন। কিন্তু এর ফল ভোগ করবেন আপনারা। চল নাটা। অনুকুলবাবু বেরিয়ে গেলেন সঙ্গীকে নিয়ে। দেবেশ বলল, এখন কী করা যায়!

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কি কিছু করার আছে?

দেবেশ চিন্তিত গলায় বলল, ওরা যখন এতটা জেনেছে তখন এটাও জানবে যে, তোকে তোর ছোটমা নমিনি করে যাননি। ওঁর অবর্তমানে টাকাগুলো আশ্রমের কাজে খরচ করা হবে। আর সেই খরচের ব্যাপারটা তদারকি করবে মাধবীলতা। এই খবর জানামাত্র ওরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

অনিমেষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ওদের সবচেয়ে বড় নেতার সঙ্গে পরিচয় আছে?

না। নেই। নির্বাচনের আগে তো দলটাই ছিল নড়বড়ে। সাধারণ মানুষ ওদের শক্তি জোগাল। যারা নেতা হয়ে বসল তাদের মুখ অচেনা। দেবেশ বলল।

তারা দলটাকে চালাচ্ছে কী করে?

দলনেত্রীর নাম ব্যবহার করে।

তা হলে তার কাছেই যাওয়া উচিত। যিনি এত বড় পরিবর্তন দেশে আনলেন, তিনি নিশ্চয়ই অমানবিক হবেন না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।

অনিমেষের কথায় অবাক হল দেবেশ, তা হলে তো কলকাতায় যেতে হবে। আর গেলেই মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কী করে পাব? যিনি দেশের এত বড় বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি আমাকে সময় দেবেন কেন?

এ ছাড়া কোনও পথ নেই। চেষ্টা করতে হবে তার সাক্ষাৎ পাওয়ার। ঠিক তখনই গাড়ির শব্দ কানে এল। দেবেশ এবং অনিমেষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে দুটো গাড়ি থেকে থানার দারোগা নামছেন।

ওদের দেখতে পেয়ে দারোগা সামনে চলে এলেন, দেবেশবাবু, ইনি কে?

আমার বাল্যবন্ধু, অনিমেষ।

কোথায় থাকেন?

এখন কলকাতায়, কিন্তু এই শহরেই বড় হয়েছে।

দারোগা অনিমেষকে আপাদমস্তক দেখলেন, এটা কী করে হল?

অনিমেষ বলল, দুর্ঘটনাই বলা যায়।

আপনি নকশাল ছিলেন, জেল খেটেছেন? চোখ ছোট হল দারোগার।

হ্যাঁ।

বাঃ। আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

কেন? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। দারোগা বললেন।

কী অভিযোগ?

সেটা থানায় গিয়ে শুনবেন।

আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন? তা হলে ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে।

কী আশ্চর্য! আমি তো একবারও বলিনি অ্যারেস্ট করছি। হাসলেন দারোগা। তারপর বললেন, একটু আগে আমরা এই এলাকায় একজন মাওবাদীকে ধরতে পেরেছি। দেবেশবাবু জানেন, ডুয়ার্সে মাওবাদীদের অস্তিত্ব ছিল না। সেই লোকটি বলছে যে আপনার সৌজন্যে এখানে এসেছে। আপনাকে সামনে বসিয়ে ওর সঙ্গে একটু কথা বলব। আপনি নকশাল ছিলেন, ও মাওবাদী। যতই বলুন কোনও সম্পর্ক নেই, তবু–। চলুন।

দেবেশ বলল, যদি কোনও মাওবাদী ধরা পড়ে তা হলে তার জন্যে ওকে নিয়ে যেতে হবে কেন? যা জিজ্ঞাসা করার তা এখানেই করতে পারেন।

বললাম না, লোকটা ওঁর কথা বলছে। দারোগা বিরক্ত হলেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি রামজিকে অ্যারেস্ট করেছেন?

আরে! এই তো, আপনি ওকে চেনেন তা প্রমাণ হয়ে গেল। দারোগা খুশি।

দেবেশ অবাক, কিন্তু কখন অ্যারেস্ট করলেন ওকে? রামজি একটু আগেও আশ্রমে ছিল। আপনাদের তো এখানে আসতে দেখিনি।

তাকে হাইওয়ে থেকে পেয়েছি আমরা। লোকটা মাওবাদী, এখানে অনিমেষবাবুর মদতে লুকিয়ে ছিল। হাসলেন দারোগা, এই ইনফরমেশন পাওয়া গিয়েছে অনিমেষবাবুর ছেলের কাছ থেকে। জেরার চাপে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন।

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, জেরার চাপে মানে? ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে নাকি? কেন? ওর অপরাধ কী?

মাওবাদীদের সঙ্গে ওঁর পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। তা আড়াল করতে উনি তৃণমূলের সমর্থক হয়েছিলেন। চলুন অনিমেষবাবু। অনেক সময় নষ্ট হল! দারোগা বললেন।

অনিমেষ আপত্তি জানাল, তাকে আইনসম্মতভাবে গ্রেফতার করলে সে নিশ্চয়ই যাবে। এই আশ্রম থেকে নিয়ে যাওয়ার পথে তার কিছু হয়ে গেলে পুলিশ তো দায় অস্বীকার করতে পারে। দেবেশ এবং অনিমেষের সঙ্গে দারোগার যখন উঁচু গলায় কথা চলছিল তা পৌঁছে গেল অন্য আবাসিকদের কাছে। ভিড় জমল ওদের ঘিরে। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা অন্য মহিলাদের একেবারে পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, মাওবাদীদের সাহায্য করার জন্যে অর্ককে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। জেরার চাপে সে রামজির কথা স্বীকার করেছে। এটা আমি ভাবতে পারছি না।

মাধবীলতা পাথরের মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু প্রতিবাদে নামলেন অন্য আবাসিকরা। তারা কিছুতেই অনিমেষকে আশ্রম থেকে নিয়ে যেতে দেবেন না। দেবেশ দারোগার কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতেই তিনি বললেন, দুর মশাই, কয়লা খেলে আংরাই তো পটি হবে। ওঁরা যখন আপনাদের এত করে অনুরোধ করলেন তখন যদি রাজি হয়ে যেতেন তা হলে আমাকে এখানে আসতেই হত না।

হকচকিয়ে গেল দেবেশ। তারপর বলল, আমি ওদের প্রস্তাবে রাজি।

গুড। এইজন্যেই তো ওকে ওয়ারেন্ট এনে অ্যারেস্ট করছি না। আমি থানায় নিয়ে গিয়ে এখন বসিয়ে রাখব। আপনি দুঘণ্টার মধ্যে ওঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিন। ওঁরা আমায় ফোন করে দিলে অনিমেষবাবুকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব। দারোগা সেপাইদের সাহায্যে অনিমেষকে গাড়িতে তুলে চলে গেলেন।

দেবেশ যাওয়ার জন্যে তৈরি হতেই মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছেন?

নিশ্চয়ই সব শুনেছেন?

শুনেছি। কিন্তু আপনি কোথাও যাবেন না। মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।

মানে? দেবেশ অবাক।

আপনার বন্ধুর পাশে আমি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আছি। যখন নকশাল রাজনীতি করত আমি কখনও বাধা দিইনি। জেল থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে বেরিয়ে আসার পরে সাধ্যমতো ওর পাশে থেকেছি। এতদিন পরে ও মাওবাদী জেনেও রামজিকে সাহায্য করেছে কারণ ওর মনের সেই আগুন নিভে যায়নি, যা আমি বুঝতে পারিনি। ছেলে বাবার কিছুটা পেয়েছে, অনেকটা পায়নি। ওর বাবা লালবাজারের পুলিশের হাতে প্রচণ্ড অত্যাচারিত হয়েও মুখ খোলেনি, ও সামান্য জেরার চাপে মুখ খুলেছে। মাধবীলতা হাঁফাচ্ছিল।

কিন্তু একটু সমঝোতা করলে যদি অনিমেষ ছাড়া পায়–! দেবেশ বলল।

কার সঙ্গে সমঝোতা করবেন? আশ্রমের এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত করে হঠাৎ ক্ষমতা পাওয়া লোভী নেতাকেই ঘুষ দিয়ে অনিমেষকে মুক্ত করবেন? অনিমেষ যদি দোষ করে থাকে তা হলে শাস্তি পাবে। যদি বিনা দোষে ওরা শাস্তি দেয় তা হলে যেদিন এরা ক্ষমতায় থাকবে না, সেদিন সে মুক্তি পাবে। দেবেশবাবু, আপনি যদি মাথা নিচু করেন তা হলে এই আমাদের সবার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না। মাধবীলতা মুখ তুলল।

ধীরে ধীরে দেবেশের দুটো হাত ওপরে উঠল। মাধবীলতার সামনে হাতজোড় করে সে মাথা নিচু করল।

.

মহাভারতের কৃষ্ণ মুষলপর্বে অসহায় চোখে যদুবংশ ধ্বংস হতে দেখেছিলেন। এটা ইতিহাস নয়, কাব্যকথায় যদিও বলা হয়ে থাকে, যা নেই মহাভারতে তা ভারতে নেই। তাই ইতিহাসে না থাকলেও ইতিহাস হয়ে গেছে মহাভারতের অনেক ঘটনা। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না তা আগামীকাল বলতে পারবে। জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে কুন্তী। সে কি মাধবীলতা হতে পারবে? আর যিনি কোটি কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাকে কি ধৃতরাষ্ট্র ক্রমশ গ্রাস করে ফেলবে? হায়!

 

 

(সমাপ্ত)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *