যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১৭)

রমণীবাৰ  আঁচ করে নিয়ে তার দিকে ছাড়লেন বাক্যবাণএই যে মাকাল ফল, মাকাল ঠাকরতােমাকান দুটো আরেকটু লাল করে দেব নাকি, অ্যাাঁ ? এসতােকা বাপু! | রমণীবাবুর এই ছ্যাঁকা দেওয়া কথা সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারুরই চিলযখন ছোট ছিলাম কিন্তু এমন মাস্টারমশাইও ছিলেন যাঁদের রাগ যাতে বেশিদূর এগােতে না পারে তার ব্যবস্থা করা ছাত্রদের অসাধ্য ছিল নাব্ৰজেনবাবু ছিলেন আমাদের প্রিয় মাস্টারমশাইদের মধ্যে একজনকড়া কথা তার মুখ দিয়ে খুব বেশি শােনাযায়নিছাত্রেরা বেশি গােলমাল করলে তিনি ভারী ব্যস্ত হয়ে বলতেন cease talking! Cease talking!তাতে সব সময় যে খুব কাজ হত তা নয় একবার এই অবস্থায় আর থাকতে না পেরে ব্রজেনবাবু একজন ছাত্রের দিকে চেয়ে হাঁকলেন, অ্যাই, তুই উঠে আয় এখানে

শাস্তিটা কী হবে জানা নেই ; হয়ত ক্লাসরুমের কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হবে ছাত্রটি উঠে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ অলােক তার জায়গা ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্ৰজেনবাবুকে জড়িয়ে ধরল। স্যার, আজকের দিনটা ওকে মাপ করে দিন স্যারব্ৰজেনবাবুর রাগ তখনাে পড়েনি, তবে তিনি এই অপ্রত্যাশিত বাধাতে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে বললেন, কেন, আজকের দিনটা কেন ? আজ মার্চেন্ট সেঞ্চুরি করেছে স্যার

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

এই ব্ৰজেনবাবুরই একদিন সরকারী ডাক পড়ল এক বিখ্যাত খুনের মামলায় জুরি হবার জন্যডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই ; ব্ৰজেনবাবুকে তাই মাঝে মাঝে ইস্কুল কামাই করে আদালতে হাজিরা দিতে হয়পাকুড় হত্যার মামলায় তখন কলকাতা সরগরমজমিদারী খুনে মামলা, সেই নিয়ে কত বই বেরােচ্ছেহপ্তায় হপ্তায়রাস্তার মােড়ে মােড়ে বিক্রী হয় সেগুলাে আর লােক হুমড়ি দিয়ে কিনে নিয়ে গােগ্রাসে গেলেব্ৰজেনবাবু কোর্টে হাজিরা দিয়ে পরদিনইস্কুলে এলেই 

যখন ছােট ছিলাম আমরা তাঁকে ঘেঁকে ধরিস্যার, মামলায় কী হল বলুন স্যার ! পড়াশুনা শিকেয় ওঠে, কারণ ব্ৰজেনবাবুও যেন গল্প শােনাতে উৎসুক টানা এক ঘণ্টা ধরে হাওড়া স্টেশনের ভীড়ের মধ্যে ইনজেকশন দিয়ে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার লােমহর্ষক হত্যার গল্প শুনি আমরা। 

বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তখনকার দিনে ছাত্রদের কোনাে ইউনিফর্ম ছিল নাআমরা কেউ কেউ হাফপ্যান্ট পরতাম, কেউ কেউ ধুতিমুসলমান ছেলেদের পায়জামা পরেও আসতে দেখেছি মনে পড়েধুতির সঙ্গে সার্ট পরাই ছিলরেওয়াজ, আর একটু লায়েক ছেলে হলেই সার্টের পিছনের কলারটা দিত তুলে স্পাের্টসম্যান হলেতােকথাই নেইউঁচু ক্লাসের কেষ্টদা, যতীশদা, হিমাংশুদা, এরা সকলেই খেলােয়াড় ছিলেন, আর সকলেই কলার তুলতেনএর মধ্যে কেষ্টদার রীতিমতাে দাড়ি গোঁফ গজিয়ে গিয়েছিল ম্যাট্রিক ক্লাসেই ; দেখে মনে হত বয়স অন্তত উনিশ কুড়ি তােহবেই

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

আমরা মাত্র চার ক্লাস নিচে পড়েও অনেক বেশিছেলেমানুষ, দাড়ি গোঁফের কোনাে লক্ষণ তাে নেইঅদূর ভবিষ্যতে হবে বলেও মনে হয় নাকলার তােলার যিনি রাজা, তিনি কিন্তু ছাত্র নন, তিনি শিক্ষকড্রিল স্যার সনৎবাবইনি যখন এলেন তখন ইস্কলে তিন বছর হয়ে গেছে আমারচোখ ঢুলু ঢুলু বায়স্কোপের হিরাে হিরাে চেহারা, আর সার্টের কলার এত বড় আর ছড়ানাে যে কাঁধ অবধি পৌছে যায় তার উপর সেটা তুলতে মনে হল ড্রিল স্যার বুঝি ওড়ার জন্য তৈরি হচ্ছেনএখন যেটাকে পি. টি. বলা হয়, তখন সেটাই ছিল ড্রিলসপ্তাহে দুটো কি তিনটে দিন একটা ঘণ্টা ইস্কুলের মাঠে কাটাতে হত

ড্রিল স্যারের তখন মিলিটারি মেজাজনানারকম কুচকাওয়াজের মধ্যে হাই জাম্পেরও ব্যবস্থা আছে মাটি থেকে হাত দুয়েক উঁচুতে শুইয়ে রাখা বাঁশ টপকে পেরােতে হবেযে ইতস্তত করবে তারই প্রতি হুঙ্কার ছাড়বেন ড্রিল স্যারআইসে জাঁ! ভদ্রলােক Jump কথাটা জাম্প আর ঝাঁপের মাঝামাঝি করে নিয়েছেন হুকুমটা আরাে জোরদার হবে বলে এই জাঁপের হুকুম আমাকেও শুনতে হয়েছে, কারণ ছেলেবেলায় ডেঙ্গু নামে এক বিটকেল অসুখে আমার ডান পাটা কমজোর হয়ে যাবার ফলে আমি লম্ফঝম্পে কোনােদিনই বিশেষ পারদর্শীহতে পারিনি

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালােই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা সেই কারণে ইস্কুলে ঢােকার অল্পদিনের মধ্যেই আমি ড্রইং মাস্টার আশুবাবুর প্রিয়পাত্র হয়ে পড়েছিলামসইত্যZিত নামেও সইত্যZিত কাZেও সইত্যZিতকথাটা অনেকবার বলতে শুনেছি আশুবাবুকে যদিও কাজেও সত্যজিৎ বলতে উনি কী বােঝাতে চান সেটা বুঝতে পারিনি রােগা পটকা মানুষ, চোখা নাক, সরু গোঁফ, হাতের আঙুলগুলাে সরু লম্বা, টাক মাথার পিছন দিকে তেলতেলে লম্বাচুলগভর্নমেন্ট আর্ট ইস্কুল থেকে আঁকা শিখেছেন, তবে ইংরিজিটা আদৌ শেখা হয়নিছাত্ররা সবাই সেটা জানে, আর জানে বলেই ক্লাসে নােটিস এলেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেস্যার, নােটিস ! আশুবাবু দারােয়ানকে ঢুকতে দেখলেই একটা যে কোনাে কাজ বেছে নিয়ে তাতে গভীর ভাবে মনােনিবেশ করে বলেন, দিলীপ, নােটিসটা একটু পড়ে দাও তাে বাবা ! দিলীপ ক্লাসের মনিটরসে নােটিস পড়ে আশুবাবুর সমস্যা মিটিয়ে দেয়একদিন আমার একটা ছবিতে

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

আশুবাবু নম্বর দিলেন 10+Fসবাই ঝুঁকে পড়ে খাতা দেখে বলল, প্লাস এফ কেন স্যার ? আশুবাবু গম্ভীর ভাবে বললেন, এফ হল ফাস্ট| বাৎসরিক প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের কিছুদিন আগে থেকে আশুবাবুর ব্যস্ততাবেড়ে যেতহল সাজানাের ভার তাঁর উপরছেলেদের আঁকা ছবির প্রদর্শনীহবে সেটার দায়িত্বও তাঁর প্রাইজের আগে বিবিধ অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা মাকামারা আইটেম আছে সেটাতেও আশুবাবুর অবদান আছে আইটেমটাকে বলা হয়মিউজিক উইং

এটা বােধ হয় ইঙ্কলের শুরু থেকেই চালু ছিলস্টেজের উপর ব্ল্যাকবোের্ড আর রঙীন চকখড়ি রাখা থাকবেএকজন ছাত্র একটি গান গাইবে, আর সেই সঙ্গে আরেকজন ছাত্র গানের সঙ্গে কথা মিলিয়ে ব্ল্যাকবাের্ডে ছবি আঁকবেআমি থাকাকালীন প্রতিবারই একই গান হয়েছেরবীন্দ্রনাথের অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়াশেষের দুবছর বাদে প্রতিবারই একই আর্টিস্ট ছবি এঁকেছেআমাদের চেয়ে তিন ক্লাস উপরের পড়ুয়া হরিপদদাএটা বলতেই হবে যে হাত আর নার্ভ, এই দুটো জিনিসের উপরই আশ্চর্য দখল ছিল হরিপদদারহলভর্তি 

যখন ছােট ছিলাম লােকের সামনে নাভাস না হয়ে সটান ব্ল্যাকবাের্ডে ছবি আঁকাটা চাট্টিখানি কথা নয়, কিন্তু হরিপদদা প্রতিবারই সে পরীক্ষায় চমৎকার ভাবে উৎরােতেন। ১৯৩৩-এ ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি ইস্কুল থেকে বেরিয়ে গেলেন । এবার কে নেবে তাঁর জায়গা ? আশুবাবুর ইচ্ছে আমি নিই, কিন্তু আদৌ রাজী নই।

 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়-(পর্ব-১৬)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *