যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায় (পর্ব-২)

 দরজা দিয়ে ঢুকেই সিড়ি । আত্মীয়স্বজন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলে সিড়ি দিয়ে উঠে ডাইনে ঘুরতেন, আর ছাপার কাজের ব্যাপারে যাঁরা আসতেন তাঁরা ঘুরতেন বাঁয়েবাঁয়ে ঘুরে ব্লকমেকিং ডিপার্টমেন্টের দরজা, আর ডাইনে ঘুরে আমাদের বৈঠকখানার দরজা

যখন ছোট ছিলামসেরা সত্যজিৎ বাবা মারা যাবার দুবছর পর অবধি সন্দেশ পত্রিকা বেরিয়েছিলএকতলার ছাপাখানায় সন্দেশ ছাপা হচ্ছে, তার তিন রঙের মলাট ছাপা হচ্ছে, একথা আমার পরিষ্কার মনে আছেছাপাখানায় ঢু মারার সময়টা ছিল দুপুর বেলা দোতলাতেই যাওয়া হত বেশিঢুকলেই দেখা যেত ডাইনে সারি সারি কম্পােজিটারের দল তাদের খােপ কাটা হরফের বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ে হরফ বেছে বেছে পর পর বসিয়ে লেখার সঙ্গে মিলিয়ে লাইন তৈরি করছেনসকলেরই মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল, ঘরে ঢুকলে সকলেই আমার দিকে চেয়ে হাসতেন

আমি তাঁদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম ঘরের পিছন দিকেআজও তারপিন| তেলের গন্ধ পেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইউ রায় অ্যান্ড সনসের ব্লকমেকিং ডিপার্টমেন্টের ছবিঘরের মাঝখানে রাখা বিরাট প্রােসেস ক্যামেরা ক্যামেরার কাজ যে শিখে নিয়েছিল বেশ পাকা ভাবে, সেই রামদহিন প্রেসে যােগ দিয়েছিল সামান্য বেয়ারা হিসাবেবিহারের ছেলেঠাকুরদা নিজে হাতে তাকে কাজ শিখিয়েছিলেনরামদহিন ছিল প্রায় ঘরের লােকের মতাে, আর তার কাছেই ছিল আমার যত আবদার একটা কাগজে হিজিবিজি কিছু একে নিয়ে গিয়ে তার

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

হাতে দিয়ে বলতাম, রামদহিন, এটা সন্দেশে বেরােবেরামদহিন তক্ষুনি মাথানেড়ে বলে দিত, হাঁ খােখাবাবু, হাঁশুধু তাই না ; আমার ছবি ক্যামেরার নিচের দিকে মুখ করা লেসের তলায় বিছিয়ে রেখে আমাকে কোলে তুলে ক্যামেরারপিছনের ঘষা কাঁচে দেখিয়ে দিত সে ছবির উল্টো ছায়া। পড়াশুনা গড়পারে কী করেছি তা ঠিক মনে পড়ে নাএকটা আবছা স্মৃতি আছে যে ধনদাদুর মেয়ে বুলুপিসি আমাকে ইংরিজি প্রথম ভাগ পড়াচ্ছেনবইয়ের নাম ছিল step by Stepসেটার চেহারাও মনে পড়েমা-ও পড়াতেন নিশ্চয়ই, তবে যেটা মনে পড়ে সেটা হল তিনি ইংরিজি গল্প পড়ে বাংলা করে শােনাচ্ছেন

তার মধ্যে দুটো ভয়ের গল্প কোনােদিন ভুলিনি : কোন্যানডয়েলের ব্লু জন গ্যাপ আর ব্রেজিলিয়ান ক্যাট। বুলুপিসির পরের বােন ছিল তুতুপিসি । তিনি থাকতেন আমাদের বাড়ি থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথ আপার সার্কুলার রােডেআমাদের বাড়িতে কারুর কোনাে বড় অসুখ করলে মা লেগে যেতেন সেবার কাজেতখন আমি চলে যেতাম তুতুপিসির বাড়িজানালার শার্সিতে লালনীলহলদেসবুজ কাঁচলাগানাে মােজাইকের মেঝেওয়ালা এই আদ্যিকালের বাড়িটা আমার খুব মজার লাগতসামনে বারান্দা ছিল একেবারে বড় রাস্তার উপরতার একধারে রেলের লাইন, সে লাইন দিয়ে যাতায়াত করে ছােট রেলগাড়িযতদূর মনে পড়ে সে গাড়িতে মানুষ যাতায়াত করত নাসেটা ছিল মালগাড়ি ; শহরের আবর্জনা নিয়ে যাওয়া হত ধাপার মাঠে ফেলার জন্যলােকে ঠাট্টা করে বলতে ধাপা মেল। 

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

যখন ছােট ছিলামতুতুপিসির বাড়িতে যে দিন থাকতাম সে দিন আমার পড়াশুনার ভার তিনিই নিতেনআর পিসেমশাই কাজ থেকে ফিরে বিকেলে তার গাড়িতে নিয়েযেতেন বেড়াতে বাড়ির অসুখ সেরে গেলে আবার ফিরে যেতাম গড়পারে | বাড়িতে থাকতে বিকেলে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম স্যার জগদীশ বােসের বাড়িতেবাড়িও আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ, সেই আপার সার্কুলার রােডেইজগদীশ বােস তখন বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন ; গাছের প্রাণ আছে সেটা তিনি আবিষ্কার করেছেন, আর তার জন্য স্যারউপাধি পেয়েছেন অবিশ্যি আমরা তাঁর বাড়ি যেতাম তাঁকে দেখতে নয়, তাঁর বাগানের একপাশে যে চিড়িয়াখানা ছিল সেইটে দেখতে। 

তবে বেশির ভাগ দিন বিকেলটা কাটত আমাদের বাড়ির ছাতে। আমার নিজের ভাইবােন না থাকলেও, বাড়িতে যে সঙ্গী ছিল না তা নয়রাঁধুনী বামনীর ছেলে হরেন ছিল আমার বয়সী, আর শ্যামা ঝিয়ের ছেলে ছেদি আমার চেয়ে বছর চারপাঁচের বড়শ্যামার বাড়ি ছিল মতিহারিভাঙা ভাঙা বাংলা বলত, তবে কোনাে কারণে অবাক হলে গালে হাত চলে যেত, আর সেই সঙ্গে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়তগেমইনী ! দেখতাে পহিলে ! ছেদি বাংলা শিখেছিলতার অনেক গুণের মধ্যে একটা ছিল ঘুড়ির প্যাঁচে কেরামতিমাঞ্জা দেবার কাজটা আমাদের ছাতেই তিনটি লােহার থামের গায়ে সুতাে পেঁচিয়ে হয়ে যেত লাটাই ধরার ভার ছিল আমার উপর

যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়

বিশ্বকর্মার পুজোর দিনে যখন উত্তর কলকাতার আকাশ ঘুড়িতে ছেয়ে যেত তখনই দেখা যেত ছেদির কেরামতিচারিদিকে ছাত থেকে প্যাঁচওয়ালাদের চিৎকারে পাড়া মেতে উঠতদুয়ােক্কো ! বাড়েনাকো ! দুয়ােক্কো ! প্যাঁচ লড়েনাকো ! আর ঘুড়ি কাটলেই ভােকাট্টা ! | ছেদির হাতের কাজ বেশ ভালাে ছিলদশ বারাে বছর বয়সেই নিজে রঙিনপাতলা কাগজ জুড়ে ফানুস তৈরি করত যেটা আমরা কালীপুজোর দিন ছাত থেকে ওড়াতাম । ছাড়া আরাে দুটো জিনিস ছেদি তৈরি করত যেটা আমি আর কাউকে করতে দেখিনি এক হল চাবি পটকা

একটা হাতখানেক লম্বা বাঁখারি নিয়ে তার মাথার দিকের খানিকটা চিরে তার মধ্যে একটা চাবির হাতলের দিকটা ঢুকিয়ে দিয়ে বেঁধে দিত এমন ভাবে যাতে চাবিটা সমকোণে বেরিয়ে থাকে বাঁখারি থেকেচাবি সাধারণত দুরকমের হয়মাথা বন্ধ আর মাথা ফুটোএই ব্যাপারে দরকারদ্বিতীয় ধরনের চাবি কারণ ওই ফুটোর মধ্যে পুরতে হবে বারুদছেদি দেশলাইয়ের মাথা থেকে বারুদ নিয়ে ঢুকিয়ে দিত ফুটোর মধ্যেএবারে সেই ফুটোয় ঢােকাতে হবে একটা বেশ আঁটফিটিং পেরেক, যাতে 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *