দরজা দিয়ে ঢুকেই সিড়ি । আত্মীয়স্বজন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলে সিড়ি দিয়ে উঠে ডাইনে ঘুরতেন, আর ছাপার কাজের ব্যাপারে যাঁরা আসতেন তাঁরা ঘুরতেন বাঁয়ে। বাঁয়ে ঘুরে ব্লক–মেকিং ডিপার্টমেন্টের দরজা, আর ডাইনে ঘুরে আমাদের বৈঠকখানার দরজা।
সেরা সত্যজিৎ বাবা মারা যাবার দু’বছর পর অবধি সন্দেশ পত্রিকা বেরিয়েছিল। একতলার ছাপাখানায় সন্দেশ ছাপা হচ্ছে, তার তিন রঙের মলাট ছাপা হচ্ছে, একথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। ছাপাখানায় ঢু মারার সময়টা ছিল দুপুর বেলা । দোতলাতেই যাওয়া হত বেশি। ঢুকলেই দেখা যেত ডাইনে সারি সারি কম্পােজিটারের দল তাদের খােপ কাটা হরফের বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ে হরফ বেছে বেছে পর পর বসিয়ে লেখার সঙ্গে মিলিয়ে লাইন তৈরি করছেন। সকলেরই মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল, ঘরে ঢুকলে সকলেই আমার দিকে চেয়ে হাসতেন।
আমি তাঁদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম ঘরের পিছন দিকে। আজও তারপিন। | তেলের গন্ধ পেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইউ রায় অ্যান্ড সনসের ব্লক। মেকিং ডিপার্টমেন্টের ছবি। ঘরের মাঝখানে রাখা বিরাট প্রােসেস ক্যামেরা । ক্যামেরার কাজ যে শিখে নিয়েছিল বেশ পাকা ভাবে, সেই রামদহিন প্রেসে যােগ দিয়েছিল সামান্য বেয়ারা হিসাবে। বিহারের ছেলে। ঠাকুরদা নিজে হাতে তাকে কাজ শিখিয়েছিলেন। রামদহিন ছিল প্রায় ঘরের লােকের মতাে, আর তার কাছেই ছিল আমার যত আবদার । একটা কাগজে হিজিবিজি কিছু একে নিয়ে গিয়ে তার।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
হাতে দিয়ে বলতাম, রামদহিন, এটা সন্দেশে বেরােবে। রামদহিন তক্ষুনি মাথা। নেড়ে বলে দিত, ‘হাঁ খােখাবাবু, হাঁ’ । শুধু তাই না ; আমার ছবি ক্যামেরার নিচের দিকে মুখ করা লেসের তলায় বিছিয়ে রেখে আমাকে কোলে তুলে ক্যামেরার। পিছনের ঘষা কাঁচে দেখিয়ে দিত সে ছবির উল্টো ছায়া। পড়াশুনা গড়পারে কী করেছি তা ঠিক মনে পড়ে না। একটা আবছা স্মৃতি আছে যে ধনদাদুর মেয়ে বুলুপিসি আমাকে ইংরিজি প্রথম ভাগ পড়াচ্ছেন। বইয়ের নাম ছিল step by Step। সেটার চেহারাও মনে পড়ে। মা-ও পড়াতেন নিশ্চয়ই, তবে যেটা মনে পড়ে সেটা হল তিনি ইংরিজি গল্প পড়ে বাংলা করে শােনাচ্ছেন।
তার মধ্যে দুটো ভয়ের গল্প কোনােদিন ভুলিনি : কোন্যান। ডয়েলের ব্লু জন গ্যাপ আর ব্রেজিলিয়ান ক্যাট। বুলুপিসির পরের বােন ছিল তুতুপিসি । তিনি থাকতেন আমাদের বাড়ি থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথ আপার সার্কুলার রােডে। আমাদের বাড়িতে কারুর কোনাে বড় অসুখ করলে মা লেগে যেতেন সেবার কাজে। তখন আমি চলে যেতাম তুতুপিসির বাড়ি। জানালার শার্সিতে লাল–নীল–হলদে–সবুজ কাঁচ। লাগানাে মােজাইকের মেঝেওয়ালা এই আদ্যিকালের বাড়িটা আমার খুব মজার লাগত। সামনে বারান্দা ছিল একেবারে বড় রাস্তার উপর। তার একধারে রেলের লাইন, সে লাইন দিয়ে যাতায়াত করে ছােট রেলগাড়ি। যতদূর মনে পড়ে সে গাড়িতে মানুষ যাতায়াত করত না। সেটা ছিল মালগাড়ি ; শহরের আবর্জনা নিয়ে যাওয়া হত ধাপার মাঠে ফেলার জন্য। লােকে ঠাট্টা করে বলতে ‘ধাপা মেল’ ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
যখন ছােট ছিলাম। তুতুপিসির বাড়িতে যে ক’দিন থাকতাম সে ক’দিন আমার পড়াশুনার ভার তিনিই নিতেন। আর পিসেমশাই কাজ থেকে ফিরে বিকেলে তার গাড়িতে নিয়ে। যেতেন বেড়াতে । বাড়ির অসুখ সেরে গেলে আবার ফিরে যেতাম গড়পারে । | বাড়িতে থাকতে বিকেলে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম স্যার জগদীশ বােসের বাড়িতে। এ বাড়িও আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ, সেই আপার সার্কুলার রােডেই। জগদীশ বােস তখন বাংলার বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন ; গাছের প্রাণ আছে সেটা তিনি আবিষ্কার করেছেন, আর তার জন্য ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছেন । অবিশ্যি আমরা তাঁর বাড়ি যেতাম তাঁকে দেখতে নয়, তাঁর বাগানের একপাশে যে চিড়িয়াখানা ছিল সেইটে দেখতে।
তবে বেশির ভাগ দিন বিকেলটা কাটত আমাদের বাড়ির ছাতে। আমার নিজের ভাইবােন না থাকলেও, বাড়িতে যে সঙ্গী ছিল না তা নয়। রাঁধুনী বামনীর ছেলে হরেন ছিল আমার বয়সী, আর শ্যামা ঝিয়ের ছেলে ছেদি আমার চেয়ে বছর চার–পাঁচের বড়। শ্যামার বাড়ি ছিল মতিহারি। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলত, তবে কোনাে কারণে অবাক হলে গালে হাত চলে যেত, আর সেই সঙ্গে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ত—“আ–গে—মইনী ! দেখতাে পহিলে ! ছেদি বাংলা শিখেছিল। তার অনেক গুণের মধ্যে একটা ছিল ঘুড়ির প্যাঁচে কেরামতি। মাঞ্জা দেবার কাজটা আমাদের ছাতেই তিনটি লােহার থামের গায়ে সুতাে পেঁচিয়ে হয়ে যেত । লাটাই ধরার ভার ছিল আমার উপর ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
বিশ্বকর্মার পুজোর দিনে যখন উত্তর কলকাতার আকাশ ঘুড়িতে ছেয়ে যেত তখনই দেখা যেত ছেদির কেরামতি। চারিদিকে ছাত থেকে প্যাঁচওয়ালাদের চিৎকারে পাড়া মেতে উঠত—দুয়ােক্কো ! বাড়েনাকো ! ‘দুয়ােক্কো ! প্যাঁচ লড়েনাকো ! আর ঘুড়ি কাটলেই ‘ভােকাট্টা ! | ছেদির হাতের কাজ বেশ ভালাে ছিল। দশ বারাে বছর বয়সেই নিজে রঙিন। পাতলা কাগজ জুড়ে ফানুস তৈরি করত যেটা আমরা কালীপুজোর দিন ছাত থেকে ওড়াতাম । এ ছাড়া আরাে দুটো জিনিস ছেদি তৈরি করত যেটা আমি আর কাউকে করতে দেখিনি। এক হল চাবি পটকা।
একটা হাতখানেক লম্বা বাঁখারি নিয়ে তার মাথার দিকের খানিকটা চিরে তার মধ্যে একটা চাবির হাতলের দিকটা ঢুকিয়ে দিয়ে বেঁধে দিত এমন ভাবে যাতে চাবিটা সমকোণে বেরিয়ে থাকে বাঁখারি থেকে। চাবি সাধারণত দু’রকমের হয়—মাথা বন্ধ আর মাথা ফুটো। এই ব্যাপারে দরকার। দ্বিতীয় ধরনের চাবি কারণ ওই ফুটোর মধ্যে পুরতে হবে বারুদ। ছেদি দেশলাইয়ের মাথা থেকে বারুদ নিয়ে ঢুকিয়ে দিত ফুটোর মধ্যে।এবারে সেই ফুটোয় ঢােকাতে হবে একটা বেশ আঁট–ফিটিং পেরেক, যাতে