কথাবার্তার পর দরজি এসে মাপ নিয়ে গেল। জুদোর জামার জন্য। খদ্দর টাইপের পুরু সাদা কাপড়ের তৈরি জ্যাকেট, বেল্ট আর খাটো পায়জামা । জ্যাকেটের বুকের উপর কালাে সুতােয় সেলাই করে বড় বড় অক্ষরে লেখা JUD0। | জামা তৈরি হলে পর দশ ইঞ্চি পুরাে গদি বিছানাে ঘরে জুদো শেখা আরম্ভ হল ।
পঁয়তাল্লিশ বছর পরে জুদোর মাত্র দুটো প্যাচই এখনাে মনে আছে—শেওই–নাগে আর নিপ্পন–শিও। শেখার শুরুতে খালি আছাড় খাও আর আছাড় মারাে। চোট না পেয়ে কী করে আছাড় খেতে হয় এটা জুদোর একেবারে গােড়ার শিক্ষা। তাকাগাকি বলে দিয়েছিলেন—যখন পড়বে তখন শরীরটাকে একেবারে আলগা দিয়ে দেবে, তাহলে ব্যথা কম পাবে, আর হাড় ভাঙার সম্ভাবনাও কমে যাবে। আছাড় মানে একেবারে মাথার উপর তুলে আছাড় ।
জুদোর কায়দায় একা বারাে–তেরাে বছরের ছেলেও যে একটা ধুমসাে মানুষকে কত সহজে আছাড় মারতে পারে, সে এক অবাক করা ব্যাপার।
আমরা যেদিন শিখতাম সেদিন আরাে দুটি ভদ্রলােক আসতেন—একজন বাঙালী, একজন সাহেব। বাঙালীটি আমাদের মতাে শিক্ষানবিশ, আর সাহেবটি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়মের অধিবাসী আর্মির লােক Captain Hughes । ইনি বক্সিং–এ কলকাতার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বেশ সুপুরুষ চেহারা, চোখাচোখা নাকমুখ, ছােট করে ছাঁটা ঢেউখেলানাে সােনালি চুল। জুদোয় এর শেখবার কিছু ছিল না। ইনি নিজেই ছিলেন একজন এক্সপার্ট।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
কলকাতায় প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে ইনি তাকাগাকির সঙ্গে কিছুক্ষণ লড়ে নিজের বিদ্যেটা একটু ঝালিয়ে নিতেন।সে লড়াই দেখার জিনিস, আর আমরা দেখতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতাে। প্যাঁচের পর প্যাঁচ, আছাড়ের পর আছাড়, আর যে–কোনাে একজন। বেকাদায় পড়লেই ডান হাত দিয়ে গদির উপর পর পর দুটো চাপড় মেরে জানিয়ে দেওয়া, আর অন্য জন তার প্যাঁচে আলগা দিয়ে তাকে রেহাই দেওয়া । |
সবশেষে তাকাগাকি আমাদের খাওয়াতেন ওভালটিন, আর সন্ধ্যার অন্ধকারে জংলা মাঠ পেরিয়ে ভবানীপুরের ট্রাম ধরে আমরা আবার ফিরে যেতাম যে যার বাড়িnউত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণে চলে আসার ফলে বাপের দিকের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যােগ কমে গেলেও, ধনদাদু আর ছােটকাকা প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি। দাদু তখন কনান ডয়েলের গল্প উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করছেন। পােশাকে, সাহেবী ভাব, বরকত আলির দোকান থেকে স্যুট করান, বিকেলে বাড়ি থেকে বেরােলে টাই পরে বেরােন। ট্রামের মান্থলি টিকিট আছে, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন আসেন আমাদের বাড়ি।
সেরা সত্যজিৎ ভবানীপুরে থাকতেই দাদুর মুখে শুনেছিলাম পুরাে মহাভারতের গল্প । এক–একদিন এক–এক পরিচ্ছেদ। একটা বিশেষ ঘটনা দাদুকে দিয়ে অন্তত বার। চারেক বলিয়েছি । তখন আমার মনে হত মহাভারতের সেটা সবচেয়ে গায়ে–কাঁটা দেওয়া ঘটনা। সেটা হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে জয়দ্রথ বধ । জয়দ্রথ কৌরবদের দিকের বড় যােদ্ধা। অর্জুন অনেক চেষ্টা করেও তাকে মারতে পারেনি। আজ সে প্রতিজ্ঞা করেছে জয়দ্রথকে না মারতে পারলে সে নিজে আগুনে পুড়ে মরবে । এই প্রতিজ্ঞার কথা কৌরবরাও শুনেছে। যুদ্ধ হয় সূর্যাস্ত পর্যন্ত, সূর্য ডুবুড়বু, তখনও পর্যন্ত অর্জুন কিছু করতে পারেনি। এমন সময় অর্জুনের সারথি কৃষ্ণ মন্ত্রবলে। চারিদিক অন্ধকার করে সূর্যকে ঢেকে দিলেন। কৌরবরা দিনের শেষ ভেবে ঢিলে দিল আর সেই সুযােগে অর্জুন জয়দ্রথের মাথা উড়িয়ে দিল এক বাণে। কিন্তু এখানেও মুশকিল।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
জয়দ্রথের বাবা রাজা বৃদ্ধক্ষত্র ছেলের জন্মের সময়। দৈববাণী শুনেছিলেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর ছেলের মাথা কাটা যাবে। শুনে তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন কাটা মুণ্ড মাটিতে পড়লেই, যে ফেলেছে তার নিজের মাথা। চৌচির হয়ে যাবে।এটা জানা ছিল বলে কৃষ্ণ অর্জুনকে সাবধান করে । দিয়েছিলেন—দেখাে, জয়দ্রথের কাটা মাথা যেন মাটিতে না পড়ে ; তাহলে। তােমার মাথাও ফেটে যাবে। অর্জুন তাই এক বাণে জয়দ্রথের মাথা কেটে সেটা।
মাটিতে পড়ার আগেই পর পর আরাে ছ‘টি বাণ মেরে সেটা শূন্যে উড়িয়ে বহুদূর। নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল জয়দ্রথের তপস্যারত বুড়াে বাপ বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে । বৃদ্ধক্ষত্র নিজের ছেলের মাথা কোলে দেখেই চমকে উঠে দাঁড়ানােমাত্র কাটা মাথা। মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। | দাদুর কাছে যেমন মহাভারতের গল্প শুনতাম, তেমনি ছােটকাকার কাছে। শুনতাম ভূতের গল্প
এই ছােটকাকার বিষয় অল্প কথায় বলা মুশকিল, কারণ ঠিক ছােটকাকার মতাে আরেকটি মানুষ আর আছে কিনা সন্দেহ। | ছােটকাকা মাস্টারি করতেন সিটি স্কুলে। খাটো ধুতি, ঢােলা–হাতা পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর, হাতে ছাতা আর পায়ে ব্রাউন ক্যাম্বিসের জুতাে দেখলে পেশাটা আন্দাজ করা যেত। ছছাটকাকা বিয়ে করেননি। একা মানুষ বলেই বােধহয়। ছােটকাকার কাজ ছিল হেঁটে বা বাসে পালা করে চতুর্দিকের আত্মীয়–স্বজনের বাড়ি গিয়ে তাদের খবর নেওয়া। আমার বিশ্বাস আমাদের বিরাট ছড়ানাে রায়।
পরিবারের সব্বাইকে একমাত্র ছােটকাকাই চিনতেন। | মজার মানুষের স্বপ্নগুলােও মজার হয় কিনা জানি না। ছােটকাকার স্বপ্নের কথা শুনে তাই মনে হত । একবার স্বপ্ন দেখলেন এক জায়গায় খুব জাঁকিয়ে কীর্তন হচ্ছে। কিছুক্ষণ শুনে বুঝলেন গানের কথা শুধু একটিমাত্র লাইন—“সত্য বেগুন জ্বলে। কী ভাবে এই লাইনটা গাওয়া হচ্ছিল সেটাও ছােটকাকা নিজে যখন ছােট ছিলাম গেয়ে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। আরেকটা স্বপ্নে দেখলেন কলকাতার রাস্তায় প্রােসেশান বেরিয়েছে। মানুষের নয়, বাঁদরের ।
যখন ছোট ছিলাম-সত্যজিৎ রায়
তাদের হাতে ঝাণ্ডা, আর তারা স্লোগান দিতে দিতে চলেছে—“তেজ চাই ! তেজ চাই ! আফিঙে আরাে তেজ চাই ! ” আত্মীয়দের অনেককেই ছােটকাকা তাঁর নিজের দেওয়া নামে ডাকতেন। তাই শুধু না, তাদের বিষয় কিছু বলতে গেলেও সেই নামেই বলতেন। বার বার। ছােটকাকার মুখে শুনে শুনে সে সব নাম আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছিল আমরা জানতাম ‘ডিডাক্স’ হচ্ছেন ধনদাদু ; Voroid’ হচ্ছেন মেজোপিসেমশাই, ‘ওয়্যাং’ হচ্ছে ধনদাদুর মেয়ে তুতুপিসি, ‘গােগ্রিল’ হচ্ছে ধনদাদুর ছেলে পানকুকাকা, ছােট ‘কুসুমপুয়া’ আর বড় ‘কুসুমপুয়া’ হল আমার পিসতুতাে বােন নিনিদি আর রুবিদি, ‘বজ্র বৌঠান’ হচ্ছেন মা, নুলমুলি’ হচ্ছি আমি। কখন কেন কীভাবে এই নামকরণ হয়েছে তা কেউ জানে না। একবার জিগ্যেস করছিলাম পিসেমশাইয়ের নাম Voroid হল কেন। তাতে ছােটকাকা গম্ভীর ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, উনি খুব ভােরে ওঠেন তাই।