আপনার প্রমােশন হয়েছে। আমাদের চাকরিতে প্রমােশন তাে রেয়ার ঘটনা। দশ বছর বার বছর একই পােস্টে ঘটঘটর করেও কিছু হয় না। আপনার ভাগ্য খুবই ভালাে। কনগ্রাচুলেশনস। ….আনিকা হতভম্ব হয়ে গেল। তার প্রমােশন হয়েছে। তার মানে সে এখন সিদ্দিক সাহেবের র্যাংকের একজন। অফিসের গাড়ি তাকে নিয়ে আসবে, দিয়ে আসবে ।
অফিসের কোয়ার্টারের জন্যে অ্যাপ্লাই করতে পারবে। সম্পূর্ণ তার নিজের আলাদা একটা ঘর হবে। ঘরের সামনে টুলের উপর পিওন বসে থাকবে। …….মিস আনিকা! জি স্যার। আপনি কি খুশি হয়েছেন ? ….অবশ্যই খুশি হয়েছি। খুশি হবাে না কেন? এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
কল্পনার বাইরে থাকবে কেন ? আপনি দু’টা সেকশনাল পরীক্ষাতেই খুব ভালাে করেছেন। আপনি কাজ–কর্মেও স্মার্ট। আপনার রেকর্ডস তাে খুবই ভালাে। আমাদের মিষ্টি কবে খাওয়াবেন ?
আজই খাওয়াব। আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে বাসায় যান। আত্মীয়স্বজনদের সুসংবাদটা দিন।
আনিকা চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলাে। এই আনন্দের খবরটা প্রথমেই শওকতকে দিতে ইচ্ছা করছে। সে কি মিষ্টি নিয়ে শওকতের বাসায় যাবে ? শওকত যখন বলবে, মিষ্টি কিসের ? সে বলবে, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে
তার মিষ্টি। আমার চাচাশ্বশুর আমাকে দেখতে এসেছিলেন, তার মিষ্টি।
শওকতের বাসায় যাওয়া যাবে না। মিতুর শ্বশুরবাড়িতে অবশ্যি যাওয়া যায়। মিতুর বরের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, এক প্যাকেট মিষ্টি।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আনিকা নিজের ঘরে ঢুকল। জাহানারা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কী লজ্জার ব্যাপার! দীর্ঘদিনের সহকর্মী আজ তাকে দেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আনিকার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালাে লাগছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আজ ছুটি নেয়াই ভালাে। প্রমােশন পেয়ে একজন একটু পর পর আনন্দে কাদছে এই দৃশ্য দেখে সবাই আড়ালে হাসাহাসি করবে। সে এখন একজন ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার। তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করার সুযােগ সে দেবে।
প্রমােশনের খবর মনে হয় সবাই জেনে গেছে। অফিস থেকে বের হতেই কারপুলের এক ড্রাইভার ছুটে এসে বলল, আপা, কোথায় যাবেন ?
আনিকা বলল, শরীরটা ভালাে লাগছে না, বাসায় চলে যাব। ড্রাইভার বলল, একটু দাঁড়ান আপা, গাড়ি নিয়ে আসি। | আনিকা বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। না না গাড়ি লাগবে না এই বলে সে কি হাঁটতে শুরু করবে ? না–কি বলবে, আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিন। তাতেই হবে।
আনিকা তার অফিসের গাড়িতে বসে আছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার! কোনাে বিস্ময়ই মানুষ একা নিতে পারে না। আনিকার এমনই কপাল, তার জীবনের সমস্ত বিস্ময়কর ঘটনা সে আর কারাে সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে নি।
কত নাটকীয় ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে! এমন কি হতে পারে না হঠাৎ তার চোখে পড়বে রাস্তার এক মাথায় শওকত দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, এই জায়গায় এসে তাদের গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ল। গাড়ির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আনিকা ডাকল। শওকত অবাক হয়ে কাছে এসে বলবে, সরকারি গাড়ি দেখছি! তুমি গাড়ি পাও জানতাম না তাে! আনিকা তখন অবহেলার ভঙ্গিতে বলবে, আগে পেতাম না, এখন প্রমােশন হয়েছে। এখন পাচ্ছি।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
প্রমােশন আবার কবে হলাে ? বাদ দাও তাে, প্রমােশন কবে হলাে সেই আলাপ এখন করতে ইচ্ছা করছে। । তুমি সিগারেট ফেলে গাড়িতে উঠে আস।
আনিকা ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়িতে উঠে আসতে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। সরকারি গাড়িতে বাইরের লােক তােলার নিয়ম নিশ্চয়ই নাই।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনার বাসা কোন দিকে?
আনিকা বলল, বাসায় যাব না। আপনি একটা কাজ করুন, আমাকে নিউমার্কেটের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আমি কয়েকটা ওষুধ কিনব।
আমি অপেক্ষা করি ?
আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাবেন। আমার দেরি হবে ।
প্রথমেই আনিকা কয়েকটা গানের ক্যাসেট কিনল। তার মধ্যে নজরুলগীতির একটা ক্যাসেট আছে। সেখানে মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম
গানটা আছে। ক্যাসেটগুলি কেনার পর পরই মনে হলাে— শুধু শুধু টাকাগুলি নষ্ট করেছে। তাদের বাসায় ক্যাসেট শােনার কোনাে যন্ত্র নেই। আনিকার সামান্য মন খারাপ হলাে। অকারণে টাকা নষ্ট করতে তার মায়া লাগে। সে বেশ কৃপণ মেয়ে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
আজকের শুভদিনটা মনে রাখার জন্যে শওকতের জন্যে কিছু কেনা দরকার। দামি কিছু না। দুই আড়াইশ’ টাকার মধ্যে কিছু। একটা শার্ট কেনা যেতে পারে। আজকাল কাপড়–চোপড় সস্তা হয়েছে। দুই আড়াইশ‘ টাকায় ভালাে শার্ট পাওয়া যায়।
অনেক ঘােরাঘুরির পর একটা শার্ট আনিকার পছন্দ হলাে। দাম তিনশ’ পঞ্চাশ টাকা। ফিক্সড প্রাইসের দোকান। এক টাকাও কমাবে না। তিনশ’ টাকায় শার্টটা কেনার সে অনেক চেষ্টা করল। দোকানদার রাজি হলাে না।
আনিকা ঠিক করল শওকতকে কিছু না দিয়ে তার ছেলের জন্যে উপহার কিনবে। শওকতের জন্যে শার্টের বাজেট ছিল আড়াইশ‘ টাকা। তার সঙ্গে আরাে আড়াইশ’ যােগ করে পাঁচশ’ টাকা হবে। পাঁচশ‘ টাকার মধ্যে কিছু। যে ছেলে আমেরিকার মতাে জায়গায় বড় হয়েছে, তাকে নিশ্চয়ই এক–দেড়শ’ টাকার খেলনা দেয়া যায় না।
আনিকা অনেকগুলাে দোকানে ঘুরল। কোনাে কিছুই মনে ধরছে না। একটা কচ্ছপ শুধু পছন্দ হয়েছে। কচ্ছপটা সারাক্ষণ শুধু মাথা দোলায় । রঙ–বেরঙের কচ্ছপ কোনাে কারণ ছাড়াই মাথা দোলাচ্ছে। দেখতে মজা লাগে। কচ্ছপটার দাম মাত্র একশ‘ পঁচিশ টাকা । এত কম দামি জিনিস বিদেশী ছেলেকে উপহার দেয়া ঠিক না। আরাে ভালাে কিছু দেখতে হবে। জিনিসটা দেখতে সুন্দর হবে। দাম পাঁচশ টাকার মধ্যে থাকবে।
দুপুর দু’টা পঁচিশ মিনিটে আনিকা নিউমার্কেট থেকে বের হলাে। তার হাতে কচ্ছপ। একশ‘ পঁচিশ টাকা দামের কচ্ছপ তাকে দোকানি দিয়েছে নব্বই টাকায়।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(১৬)-হুমায়ূন আহমেদ
নিউমার্কেটের গেট থেকে বের হবার পরপরই একটা ইয়েলাে ক্যাব এসে তার গা ঘেঁসে দাঁড়াল। ড্রাইভার মুখ বের করে বলল, আপা আমাকে চিনেছেন ?
আনিকা বলল, হঁ্যা চিনেছি। কেমন আছেন আপা ? ভালাে।
কোথায় যাবেন? উঠেন গাড়িতে উঠেন। কোনাে কথা না বলে আনিকা গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার বলল, বাসায় যাবেন, না ঐ দিনের মতাে কিছুক্ষণ ঘুরবেন ? আনিকা বলল, আপনার গাড়িতে কি এসি আছে ?