যেন আপনি ছায়াদায়িনী বিশাল বটবৃক্ষ । আমার ছােট্ট ইমন তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।
আমার দুর্ভাগ্য আমি আমার পুত্রকে কোনাে ছায়া দিতে পারি নি। আমি একজন পরাজিত পেইন্টার। পরাজিত মানুষ ছায়া দিতে পারে না, কারণ তারা নিজেরাই ছায়া খুঁজে বেড়ায়।
আপনি আমার এই চিঠি পড়ে ভাববেন না যে আমি ছেলেকে কাছে না পেয়ে খুব মনঃকষ্টে থাকি। মানুষ অতি দ্রুত সমস্ত পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইমন কেমন আছে, কী করছে– এইসব সেন্টিমেন্টাল বিষয় নিয়ে ভাবি না। শুধু তার জন্মদিনে ৯ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি ইজেলে মনের সুখে লেমন ইয়েলাে রঙ মাখাই। তার জন্মের পর–পর আমি তার নাম রেখেছিলাম
লেমন ইয়েলাে। শওকত হঠাৎ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে লম্বা চিঠি ফেঁদে বসেছে। কোনাে মানে হয় ? কাকে দিয়ে অনুবাদ করাবে ? তারচে’ নিজেই একটা কাগজে লিখবে— With complements. from Imon‘s dad. কিংবা শুধু লেখা থাকবে With complements নিচে সে তার নাম সই করবে ।
ইমন জেগে উঠেছে। বাবার সন্ধানে সে চলে এসেছে বারান্দায় । শওকত বলল, Hello!
ইমন বলল, Hello! Good morning. আজ তােমার জন্মদিন। Happy birthday baby. থ্যাংক ব্যু। জন্মদিনে কী করতে চাও? জানি না । আমেরিকায় কীভাবে জন্মদিন করতে ? স্কুলের সব বন্ধুরা আসত। কেক কাটা হতাে। গিফট খােলা হতাে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
এর বাইরে বিশেষ কিছু হতাে না? আমার ধারণা মিস্টার অ্যান্ডারসন তােমার জন্মদিনে মজার কিছু করেন। ধারণা ঠিক না ?
হ্যা ঠিক। উনি ক্লাউনের পােশাক পরে ম্যাজিক শাে করেন। উনি ম্যাজিক জানেন না–কি ? খুব ভালাে ম্যাজিক জানেন । আর তােমার মা ? সে বিশেষ কিছু করে না ?
কিছুই করে না?
মা শুধু কেক কাটার সময় তােমার হয়ে আমার কপালে চুমু দেয়। আমার হয়ে চুমু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা কর।
মা বলে, লেমন ইয়েলাে । হ্যাপি বার্থডে। তুমি তাে আমাকে লেমন ইয়েলাে নাম দিয়েছিলে, আমার জন্মদিনে মা একবার এই নামে আমাকে ডাকে।
শওকত শান্ত গলায় বলল, এতটা সম্মান তােমার মা আমাকে দেয়— এটা আমি চিন্তাও করি নি । যাও হাত–মুখ ধুয়ে আস। জন্মদিনে আমরা কী করব ঠিক করে ফেলি । তােমার মাকে দাওয়াত করে নিয়ে আসি।
মা আসবে না।। অবশ্যই আসবে ।
আসবে না। মা আগেই বলে দিয়েছে এই জন্মদিনটা আমি যেন শুধু তােমার জন্যে করি।
শুধু তুমি আর আমি জন্মদিন করব ? তুমি তােমার বন্ধুদের বলাে। তােমার বন্ধু নেই ?
শওকত বলল, না। এক সময় অনেক বন্ধু ছিল, এখন আর তাদের সঙ্গে যােগাযােগ নেই।
কারাে সঙ্গেই যােগাযােগ নেই ?
অনেকের সঙ্গে হঠাৎ পথে দেখা হয়। তাদের বাসার ঠিকানা জানি না। শুধু একজনের ঠিকানা জানি— তৌফিক। ধানমণ্ডিতে থাকে। বড় পেইন্টার হিসেবে নাম করেছে।
উনাকে আসতে বলাে । তুমি কি আমার জন্যে কোনাে গিফট কিনেছ বাবা?
গিফট কিনতে হবে । মিস্টার অ্যান্ডারসন তুমি আমাকে কী গিফট দেবে সেটা আমাকে গােপনে বলেছেন। আমি দেখতে চাই তার কথা ঠিক হয় কি ইমন মিটিমিটি হাসছে। বাবাকে বড় ধরনের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিতে পারায় সে খুব মজা পাচ্ছে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
আজকের নাশতা বাইরে থেকে এসেছে। কিং বিরানি হাউসের তেহারি । বাংলাদেশের এই খাবারটা ইমনের পছন্দ হয়েছে। ইমনের ধারণা এই খাবারটা ম্যাকডােনাল্ডের বার্গারের কাছাকাছি। সে অবশ্যি তেহারি বলতে পারে না। বলে তােহারি ।
নাশতার মাঝখানে আনিকা এসে উপস্থিত । সে ঢুকল ব্ৰিত ভঙ্গিতে। ইমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম বাবার বাসায় সে বাইরের কাউকে আসতে দেখল ।
আনিকা ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ইমন, আমি তােমাকে দেখতে এসেছি। শুভ জন্মদিন।
ইমন বলল, থ্যাংক ব্যু।
আমি তােমার জন্যে জন্মদিনের গিফট এনেছি। জানি না তােমার পছন্দ হবে কি–না।
কী গিফট এনেছ ? কচ্ছপের বাচ্চা। কিসের বাচ্চা ? কচ্ছপের বাচ্চা। কচ্ছপ চেন না! Turtle. তােমাদের এখানে Pet shop আছে ? আছে।
আনিকা হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে পানি ভর্তি হরলিক্সের বােতল বের করল। বােতলের ভেতর ছােট ছােট দু’টা কচ্ছপের বাচ্চা উঠা–নামা করছে। ইমন মুগ্ধ গলায় বলল, Oh my God. What a surprise! ইমন হাতের চামচ ছুড়ে ফেলে ছুটে এসে হরলিক্সের বােতল হাতে নিল।
আনিকা বলল, উপহার পছন্দ হয়েছে ? ইমন বলল, খুব পছন্দ হয়েছে।am so happy. আমাকে ধন্যবাদ দিলে না তাে?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(২৩)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি এত খুশি হয়েছি যে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেছি। মিস, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন ।
আমাকে মিস কেন বলছ ? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমার এখনাে বিয়ে হয় নি ?
হ্যা।
আনিকা শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তাে তােমার ছেলের জন্মদিনে আমাকে আসতে বলবে না, আমি নিজ থেকে চলে এসেছি। ভয় নেই, বেশিক্ষণ থাকব না। আমার অফিস আছে, আমি অফিসে চলে যাব ।
শওকত বলল, চা খেয়ে যাও। চা এক কাপ খেতে পারি ।
আনিকা ইমনের চেয়ারটায় বসল । বাসায় দু‘টাই চেয়ার। ইমন তার চেয়ার খালি করে দাড়িয়ে আছে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি সে একবারও কচ্ছপ দু‘টা থেকে সরাচ্ছে না ।
আনিকা বলল, আমি তােমার এখানে আসতে আসতে ভাবছিলাম, খুব সুন্দর একটা ছেলে দেখব। কিন্তু এত সুন্দর কাউকে দেখব ভাবি নি। তােমার ছেলের চেহারায় কোথায় যেন দেবদূত দেবদূত ভাব আছে। ঠিক না ?
| শওকত জবাব না দিয়ে চা বানাতে গেল। ইমন আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি এদের হাত দিয়ে ধরতে পারি ? এরা কি কামড়ায় ?
আনিকা বলল, এখন কামড়াবে না। তুমি ইচ্ছা করলে এদের হাতে নিতে পার। তবে এরা বড় হলে কিন্তু কামড়ায়। খুব শক্ত কামড়। এরা যখন কাউকে কামড়ে ধরে, তখন আর ছাড়ে না।
কামড়ে ধরেই থাকে ?