আনিকা বলল, ঠাট্টা করব কেন? তুমি তাে জানাে আমি ঠাট্টা করার মেয়ে । তােমার পাল্লায় পড়ে আমি অনেক দিন ঘুরেছি। আমার আর ভালাে লাগছে। হয় তুমি আজকে আমাকে বিয়ে করবে; আর যদি তা না হয়, বিয়ে করতে কখনাে বলব না।
আমার নিজেকে সিন্দাবাদের ভূত বলে মনে হয়। তােমার ঘাড়ে চেপে আছি। তুমি যতই ফেলতে চাচ্ছ, আমি ততই কঁাচকি মেরে বসছি।
শওকত হাসল। আনিকা বলল, এভাবে হাসবে না। আমি হাসির কোনাে কথা বলছি না। দাঁড়িয়ে আছ কেন ? ট্যাক্সি আন। এসি আছে এমন গাড়ি আনবে। আজ কেন জানি আমার খুব গরম লাগছে। হাঁসফাঁস লাগছে।
ট্যাক্সিতে উঠে আনিকা সত্যি সত্যি ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, মগবাজার যাবেন ? মগবাজার কাজি অফিস। চিনেন না ?
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, চিনি।
আনিকা বলল, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা আপনার ট্যাক্সিটা ভাড়া করতে চাই । ঘণ্টায় এত রেট— এ ধরনের ফালতু অ্যারেঞ্জমেন্টে আমি যাব না। সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত থাকবেন। কত নিবেন বলেন। প্যাকেজ ডিল।
এক হাজার টাকা দেন ।
পাঁচশ‘ পাবেন। চিন্তা করে দেখেন। বখশিশ আলাদা দেব। এক্ষুণি জবাব দিতে হবে না। মগবাজার কাজি অফিসে যেতে যেতে চিন্তা করেন।
শওকত বলল, আমরা কি সত্যি সত্যি কাজি অফিসে যাচ্ছি ?
আনিকা ক্লান্ত গলায় বলল, হঁ্যা। তােমার কি অসুবিধা আছে ? বিয়ের কথা তাে অনেক দিন থেকেই বলছ। সামনের বছর বিয়ে। এই শীতে না, পরের শীতে। এই করে করে সাত বছর পার করেছ। আর কত ?
শওকত বলল, একটা সিগারেট ধরাই ?
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
ধরাও। ড্রাইভার সাহেব গাড়ির কাচ নামিয়ে দিন। আর আপনি চিন্তা ভাবনা করছেন তাে? আমি আরাে একশ’ বাড়িয়ে দিলাম । ছয়শ‘।
শওকত সিগারেট টানছে। তারা কাজি অফিসে যাচ্ছে এই নিয়ে সে খুব যে চিন্তিত তা না। এক্ষুণি বিয়ে করতে হবে— এরকম একটা ঝোঁকের ভেতর দিয়ে আনিকা প্রায়ই যায়। ঝোক কেটেও যায়। আজকেও নিশ্চয়ই সে–রকম কিছু হবে। তবে ট্যাক্সি নিয়ে কাজি অফিসের দিকে রওনা দেয়াটা বাড়াবাড়ি। একে ঝোক বলা ঠিক হচ্ছে না।
আনিকা বলল, তুমি কথা বলছ না কেন? চিন্তা করছি।
ও ৷ fil ব্যাপারে তােমার আপত্তি আছে ? আজ শুভদিন । শু–শা। অ :(৩ তারিখ । ১৩ আশ্বিন।
শও–৩ বণ, বিয়ের মতাে বড় ব্যাপারে প্রিপারেশন লাগবে না ?
আনিকা বলল, তুমি তাে সাত বছর ধরেই প্রিপারেশন নিচ্ছ। আরাে প্রিপারেশন লাগবে?
শওকত বলল, বিয়ের পর তুমি কি আমার এখানে উঠবে ?
আনিকা বলল, তােমার বাসায় আমি কীভাবে উঠব ? বাবার এক পয়সা রােজগার নেই। পুরাে সংসার চলছে আমার টাকায়।
শওকত বলল, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে বিয়ের পর তুমি তােমার বাসায় থাকবে। আমি আমার বাসায়।
আনিকা বলল, তুমি আমার বাসায় উঠে আসবে। আমি একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকি তুমি আমার ঘরে থাকবে । কিছুদিন পর মিতুর বিয়ে হয়ে যাবে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
তখন মিতুর ঘরটায় তুমি তােমার ছবি আঁকার জিনিসপত্র রাখবে।
ঘরজামাই হবাে ?
আমরা মেয়েরা যদি ঘরবউ হতে পারি, তােমাদের ঘরজামাই হতে অসুবিধা কী ?
কোনাে অসুবিধা নেই। সিগারেট তত শেষ হয়ে গেছে, হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
শওকত সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, তােমাকে একটা খবর দিতে চাচ্ছি।
কী খবর দেবে ?
আমার ছেলে এসেছে ঢাকায়। সে কয়েক দিন আমার সঙ্গে থাকবে । আমার সঙ্গে জন্মদিন করবে।
ছেলে নিশ্চয়ই একা আসে নি। ছেলের মাও এসেছেন। তিনিও কি ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তােমার সঙ্গে থাকবেন ?
ছেলের মা অন্য একজনের স্ত্রী।
তাতে কী হয়েছে ? পাকা রঙ এত সহজে যায় না। বাবা–মা দু‘জনের মাঝখানে দাড়িয়ে ছেলে জন্মদিনের কেক কাটবে। বাবা–মা একসঙ্গে সুর করে গাইবে— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ । তারপর তারা নিজেদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে হাসবে। সেই হাসির ছবি তােলা হবে।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
ট্যাক্সি মগবাজার কাজি অফিসের সামনে থামল । ড্রাইভার জানাল সে ছয়শ’ টাকাতে রাজি আছে। শুধু বখশিশের পরিমাণ যেন বাড়িয়ে দেয়া হয়।
আনিকা বলল, বখশিশ নির্ভর করবে ভালাে ব্যবহারের উপর। আপনি মাই ডিয়ার ব্যবহার করবেন, আমি আপনার বখশিশ বাড়িয়ে দেব। এখন আপনি যান, এককাপ চা খেয়ে আসুন। গাড়ি চালু রেখে যান। আপনার ঠাণ্ডা গাড়িতে বসে এই ভদ্রলােকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঝগড়া করব। আমাদের ঝগড়া আপনাকে শােনাতে চাই না।
শওকত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, করাে ঝগড়া করাে।
আনিকা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক ঝগড়া করব না। তােমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আজ থেকে আমি একজন সেকেন্ডহ্যান্ড হাজবেন্ডের
ন্ধানে বের হবাে। সেকেন্ডহ্যান্ড ?
আনিকা বলল, অবশ্যই সেকেন্ডহ্যান্ড। আমার কপাল হলাে সেকেন্ডহ্যান্ডের। আমার যখন সতেরাে বছর বয়স, তখন বিয়ের যে প্রপােজল এলাে সেই পাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড । স্ত্রী মারা গেছে। বিরাট বড়লােক। তুমি চিন্তাই করতে পারবে না সেই সেকেন্ডহ্যান্ডওয়ালার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে সবার সে কী চাপাচাপি! তারপর আরেকটা প্রপােজল এলাে। ছেলে ইতালিতে থাকে। বিয়ে যখন প্রায় হয় হয় অবস্থা, তখন জানা গেল ছেলে কাগজপত্রের জন্যে জার্মান এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছর তারা ছিল এক সঙ্গে। সেই পাত্রও বাবার পছন্দ। বাবা বললেন, প্রয়ােজনে সে জার্মান বিয়ে করেছে। শখের বিয়ে তাে না। সমস্যা কী ? শেষমেষ সেকেন্ডহ্যান্ড আধবুড়াে তুমি উদয় হলে ।
যদিও সন্ধ্যা -পর্ব-(৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি বুড়াের প্রেমে হাবুডুবু ও আমার জানরে, ও আমার পাখিরে অবস্থা।
শওকত বলল, আনিকা তােমার কি জ্বর না–কি ?
আনিকা বলল, আমার কথাবার্তা কি জ্বরের ঘােরে প্রলাপ বকার মতাে শােনাচ্ছে ?
চোখ লাল, এই জন্যে বলছি ।
Read more