রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে পর্ব : ২
রাজা ভাবলেন, বোধ হয় সে তার নিজের পরিচয় ভুলে গেছে। তাই পরীক্ষা করার জন্য ল্যাটিন ভাষায় প্রশ্ন করলেন। টম ঠিক ঠিক উত্তরই দিল। তখন রাজা মনে মনে ভাবলেন যে বেশি পড়াশুনা করার ধরুন তার এই অবস্থা হয়েছে। তাকে খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। সে হলো আমার একমাত্র উত্তরাধিকারী। আর কালই তার অভিষেক করতে হবে। রাজা যাকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি বলে উঠলেন যে হুজুর আপনি কি ভুলে গেছেন নরফোকের ডিউক এখনো আপনার রাজনৈতিক বন্দি, তাকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। রাজা বললেন, সে আদেশ ঠিক থাকবে। ঠিক আছে হুজুর, বলে লোকটা বিদায় নিল।
সেদিন রাজকুমারের ঘরে বসে টম একা একা বিরক্ত হয়ে ওঠল নিজের ওপর। সে বলল, উহ্! এটা অসহ্য, রাজার আদেশে এই লোকটাকে হত্যা করা হবে। আহা! এই সময় যদি সত্যিকারের রাজকুমার ফিরে আসত।সেদিন বিকালে লর্ড হাটফোর্ড রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করে বলল, তুমি যেই হও, তুমি যে রাজকুমার নও এ-কথা অস্বীকার করবে না। টমও ভাবল, ঠিক আছে তারা যেভাবে বলে সেভাবে চলে দেখি। এরপর থেকে টম রাজকুমারের যাবতীয় কাজ করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সে পদে পদে ভুল করতে লাগল।
যেমন ভালো তোয়ালে নষ্ট হবে মনে করে হাত মুছতে ভয় পেতে লাগল। গোলাপজল দেয়া হাত ধোয়ার পানি সে পান করে ফেলল। ফলমূল বাদাম সব পকেটে পুরে ফেলতে লাগল। সেদিন বিকেলে অসুস্থ রাজার অবস্থা আরও অবনতি হলো।রাজার সঙ্গে রাজার পরামর্শদাতা লর্ড চ্যান্সেলর দেখা করলেন। রাজা বললেন, আমি শীঘ্রই মারা যাব। ডিউক অব নরফোকের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করতে হবে। তাই একটা মৃত্যুর পরোয়ানা লিখে নিয়ে এসো, আমি তাতে আমার সিল দিয়ে দিই।
রাজা বিছানায় উঠে বসতে চাইলেন কিন্তু দুর্বলতার জন্য পারলেন না। কিন্তু বড় সিলটা অনেক খোঁজার পরও পাওয়া গেল না। রাজা মনে মনে বললেন, আমি রাজকুমারের কাছে সিলটা রেখেছিলাম। কিন্তু রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সে বলল যে সে সীলটা কোথায় রেখেছে তা মনে করতে পারছে না। আপাতত ছোট সীল দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। রাজকুমারকে আনন্দিত রাখার জন্য তাকে নৌবিহারে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু এতসব আনন্দের মধ্যে থেকেও সে সুখী হতে পারছিল না।এদিকে সত্যিকারের রাজকুমার রাস্তায় রাস্তায় লাঞ্ছিত হচ্ছিল। রাজকুমারকে এই লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একজন জোয়ান এগিয়ে এসে সবাইকে বাধা দিল।
ফলে সৈনিকের সঙ্গে বিদ্রুপকারীদের তর্ক শুরু হলো। আর ঠিক এই সময় রাজার ঘোড়সওয়ারেরা সেই রাস্তায় তাদের মাঝখানে এসে পড়ল এবং সৈনিক ও রাজকুমার সবার থেকে আলাদা হয়ে পালিয়ে গেল।এর কিছুক্ষণ পর রাস্তায় রাস্তায় এক ফরমান পাঠ করা হলো। এতে সবাইকে বলা হলো যে, রাজা মারা গিয়েছেন এবং রাজকুমার এডওয়ার্ড নতুন রাজা হয়েছেন। টম তার উপদেষ্টা লর্ড হাটফোর্ডকে জিজ্ঞাসা করল, আমি যদি এখন থেকে রাজা হয়ে থাকি তাহলে আমার আদেশ বহাল থাকবে। লর্ড হাটফোর্ড বললেন, নিশ্চয়ই আপনার হুকুমই আইন। টম ক্যান্টি তখন বলল : আমার রাজত্ব হবে দয়ার, ক্ষমার। কোনো রক্তপাত হবে না আমার রাজত্বে এবং নোরফোকের মৃত্যুদন্ড আমি তুলে নিয়ে তাকে মুক্ত করলাম।
এদিকে রাজকুমার যখন তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল তখন রাজার মৃত্যুসংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমার বাবা মারা গিয়েছেন। নতুন সৈনিকটি বলল, ওহো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি রাজকুমার এডওয়ার্ড, এ দেশের নতুন রাজা। সৈনিক মনে মনে ভাবছিল : আহা বেচারা, তার মাথাটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি সব অবস্থাতে এই ছেলেটিতে আপদে-বিপদে রক্ষা করে যাব।এরপর সৈনিকটি রাজকুমারকে একটা সরাইখানাতে নিয়ে গেল। কিন্তু যেইমাত্র তারা সেখানে ঢুকতে যাবে তখনই টমের বাবার সঙ্গে দেখা।
সে এগিয়ে এসে বলল, এবার তুমি পালিয়ে যেতে পারবে না বাছাধন, তোমাকে আচ্ছা করে পিটুনি দেব। সৈনিকটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটি তোমার কী হয়? লোকটি উত্তর দিল, এই বজ্জাত ছেলেটি আমার ছেলে। রাজকুমার বলে উঠল, মিথ্যা কথা, আমাকে যেন এই লোকটার জিম্মায় ছেড়ে দিও না। সৈনিক বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তুমি আমার সাথেই থাকবে। জন ক্যান্টি তখন গজরাতে গজরাতে বলল, আচ্ছা দেখা যাবে। সৈনিক তখন তার খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বলল, সাবধান একে ছুঁয়েছ কি তোমার একদিন কি আমার একদিন। এই ছেলে আমার তত্ত্বাবধানে থাকবে। তুমি কি মনে করো তোমার মতো একজন জঘন্য ব্যক্তির হাতে একে ছেড়ে দেব? যাও এখান থেকে সরে পড়ো, আর এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতেই চেষ্টা করো।
সৈনিক রাজকুমারকে বলল, আমি থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না বা কেউ জ্বালাতনও করতে পারবে না। রাজকুমার বলল, সৈনিক তোমাকে ধন্যবাদ, আমি যখন আমার সিংহাসনে আরোহণ করব তখন তোমার কথা আমার মনে থাকবে। তারপরে সরাইখানাতে যেয়ে রাজকুমার ঘুমাল আর সৈনিক তার জন্য একটা পোশাকের ব্যবস্থা করার জন্য চলে গেল।ভোরে সৈনিক নিজ হাতে একটা পোশাক মেরামত করে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে রাজকুমার বিছানায় নেই। তখন সে দৌড়ে সরাইখানাওয়ালার কাছে গিয়ে হুমকি দিল।
তখন সরাইখানাওয়ালা বলল, ও তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। আপনার সংবাদবাহক এসে খবর দিয়েছে যে আপনি তাকে লন্ডন ব্রিজের ওখানে দেখা করতে বলেছেন।সংবাদবাহক কি একা ছিল? হ্যাঁ, কিন্তু সে যখন ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল তখন আরও একজন বদমাইশ প্রকৃতির লোক তাকে অনুসরণ করছিল।একথা শুনে সৈনিক ছুটল রাজকুমারের খোঁজে।এদিকে নকল রাজকুমার টম বিচার ও অন্যান্য রাজকার্য সমাধা করে যাচ্ছে। আর সত্যিকার রাজকুমার লন্ডন ব্রিজের দিকে তার রাজপ্রাসাদের কারো সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় সেদিকে চলেছে।
হঠাৎ রাজকুমারের কানে আসল, তোমার রক্ষক বন্ধু তোমাকে আর আজ রক্ষা করার জন্য আসছে না। রাজকুমার বলল, এটা কোন ধরনের ধূর্ততা! তখন জন ক্যান্টি চাবুক হাতে এগিয়ে এসে বলল, নিশ্চয়ই তুমি তোমার বাবাকে চিনতে ভুল করোনি। এখন এই গুদামঘরের ভিতর ঢোকো এবং যতদিন পর্যন্ত আমার জন্য ভিক্ষা করতে রাজি না হবে এখানেই তোমাকে কাটাতে হবে। এদিকে সেই সৈনিক পইপই করে রাজকুমারকে খুঁজছে। পরে সে অনুমান করল যে সেই বদমাইশ লোকটা যে তাকে ছেলেটির বাবা বলে পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছিল নিশ্চয়ই সে তাকে কোথাও আটকে রেখেছে। ভীত ও সন্ত্রস্ত রাজকুমার পুরাতন গুদামের মধ্যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ রাতে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সে দেখল কয়েকজন চোরের এক সভা বসেছে। তারা সবাই চুরির জন্য নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনে ব্যস্ত। রাজকুমারের দিকে চোখ পড়তেই তাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তার মাথায় এক ছেঁড়া টুপি পরিয়ে দলের মাতবর বলল, আমি তোমাকে ফুফু দি ফাস্ট নামে নামকরণ করলাম। পরের দিন ভোরে রাজকুমার ও তার সঙ্গী ছেলেটি ভিক্ষা করতে বের হলো। রাজকুমারকে ছেলেটি বলল, তুমি আমাকে হিউগস বলে ডাকতে পারো। রাজকুমার বলল, কিন্তু আমি তোমার মতো ভিক্ষা করতে পারব না। হিউগস বলল, তুমি এত সাধু হলে কবে থেকে? তোমার বাবা যে বলল, তুমি গত জীবনে লন্ডনে ভিক্ষা করে কাটিয়েছ?
রাজকুমার বলল, ঐ বদমাইশটা আমার বাবা নয়। এমন সময় হিউগস বলল, শীঘ্র এদিকে আসো একজন ধনীলোক এদিকে আসছে। তোমাকে ভিক্ষা করতে হবে না। তুমি শুধু ভান করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমি মাটির উপর শুয়ে অজ্ঞান হবার ভান করব। যখন ধনী লোকটি তোমার সামনের দিকে আসবে তখন হৈ-চৈ করে চিৎকার করে বলবে যে আমি তোমার ভাই এবং আমরা কয়েকদিন কিছুই খাইনি। তারপর ছেলেটি রাজকুমারকে শাসিয়ে বলল, ঠিকমতো যদি কথা না শোনো তাহলে তোমার শরীরের হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করব।ধনী ভদ্রলোকটি হিউগ্সের কাছে এসে তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে?
তখন সে বলল, আমি এক গরিব ছেলে, অনাহারে ভুগছি, আমাকে দয়া করে একটা পয়সা দিয়ে সাহায্য কর লোকটি বলল, আহা গরিব বেচারা, তোমায় একটা কেন তিনটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করব। ছেলেটি বলল, জনাব দয়া করে যদি আমাকে একটু ধরে ধরে আমার বাড়ি পৌঁছে দেন। এমনি সময় রাজকুমার চিৎকার করে উঠল, ও আমার ভাই নয়, সে একজন ভিক্ষুক ও চোর, আপনি লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে, সে আপনার পকেট কেটেছে। আপনার লাঠির এক বাড়িতে ওর সব ভান পালাবে। একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে হিউগ্স দৌড়ে পালাল।
রাজকুমার সুযোগ খুঁজছিল। সে ভাবল এখন যদি আমি না পালিয়ে যাই তাহলে হিউগ্স ভিক্ষুকদের নিয়ে এসে আমায় তাড়া করবে। সে সমস্তটা দিন কৃষকদের জমির চারিদিক দিয়ে ঘুরে বেড়াল। সন্ধ্যার দিকে এক বনের ধারে এসে হাজির হলো। এখানে দূরে একটা কুটিরে আলো জ্বলতে দেখে সে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। এই কুটিরটা ছিল একজন ঋষিতুল্য সন্ন্যাসী। রাজকুমার ভিতরে গিয়ে পরিচয় দিল যে সে ইংল্যান্ডের রাজা। কুটিরের ভিতরের সন্ন্যাসী বলল, আসো ভিতরে আসো। আমার এখানে কাউকে জায়গা দিই না, তবে রাজার জন্য নিশ্চয়ই আমার জায়গা আছে। রাজকুমারকে সম্বোধন করে সন্ন্যাসী বলল, আমার তোমাকে বিচার করার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
এখন আমি তোমাকে একটি গোপন তথ্য বলব, আমি সন্ন্যাসী নই। আমি হলাম একজন ফেরেস্তা। তুমি তাহলে হেনরির ছেলে, সে কী বেঁচে আছে? রাজকুমার বলল, না কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছে।সন্ন্যাসী তাকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানায় ঘুমোতে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে সন্ন্যাসী এসে তাকে বলতে লাগল, তুমি তো জানো না তোমার বাবা আমার ওপর অত্যাচার করেছে। আমাকে ধর্ম থেকে বিতাড়িত করেছে। আমাকে ও আমার অনুসারীদের দেশ থেকে তাড়িয়েছে। এই জঙ্গলে আমি পালিয়ে আছি। যখন বুঝতে পারল যে রাজকুমার ঘুমিয়ে তখন সে বলল, যতক্ষণ বেঁচে আছ সুখস্বপ্ন দেখে নাও।
এই বলে সে বড় পাথরে ছুরি শান দিতে লাগল আর বলতে লাগল, তোমার বাবা আমার হাত থেকে বেঁচে গেছে, তুমি বাঁচবে না। তারপর সে তার হাত পা ও মুখ দড়ি ও কাপড় দিয়ে বাঁধল। তারপর সন্ন্যাসী যেইমাত্র ছুরি উঁচিয়ে রাজকুমারকে হত্যা করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কে যেন কড়া নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, বাসায় কে আছে? রাজকুমার সেই স্বর শুনে ভাবল, এ তো সেই সৈনিক বন্ধুর গলা। সন্ন্যাসী দরজা খুলে দিতেই সৈনিক জিজ্ঞাসা করল, ছেলেটি কোথায়? সন্ন্যাসী বলল, কোন ছেলে? তখন সৈনিক রেগে গিয়ে বলল, যে ছেলেটা চুরি করেছিল তাকে আমি শাস্তি দিয়েছি। এখন তোমার এখানে যে এসেছে সে ছেলেটি কোথায়?
Read more