রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে শেষ পর্ব
সন্ন্যাসী প্রথমে নানা কথা বলে তাকে ফাঁকি দিতে চাইল। কিন্তু সৈনিকের চাপের মুখে সন্ন্যাসী রাজকুমারকে সৈনিকের হাতে তুলে দিল। সৈনিক তখন সেই কেনা পোশাক রাজকুমারকে পরিয়ে গ্রাম থেকে দুটি গাধা কিনে এনে তাতে চড়ে শহরের দিকে রওনা হলো।শহরে হেনডেন হলে এসে তারা পৌঁছল। এই হেনডেন হলটা ছিল সৈনিকের বাড়ি। সৈনিক বাড়ির কড়া নাড়তেই তার ভাই বেরিয়ে আসল। সৈনিক তখন বলল, আরে আমার ভাই। উহ্! প্রায় সাত বছর পরে তোমার সঙ্গে দেখা। কিন্তু তার ভাই তাকে না চেনার ভান করে বলল, আপনি কে? সৈনিক বলল, আমি তোমার ভাই মিল। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?
তখন তার ভাই বলল, আমার ভাই! সে তো কবে প্রায় তিন বছর হলো যুদ্ধে মারা গেছে। তুমি একজন জালিয়াত।সৈনিক বলল, তুমি মিথ্যা বলছ। ঠিক আছে তোমার বাবাকে ডাকো। বাবা মারা গেছেন। উহ্! বড় দুঃখের সংবাদ, তাহলে লেডি এডিথকে ডাকো। কিছুক্ষণ পরে সৈনিকের ভাই এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো ও জিজ্ঞাসা করল, বলো তো এই লোকটাকে তুমি চেনো কী না? লেডি এডিথ বলল, এ লোকটাকে জীবনে আমি কখনো দেখিনি। সৈনিক রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল, বদমাইশ, মিথ্যুক, তুমি নিজে চিঠি লিখে জানিয়েছ যে আমি মরে গেছি এবং তারপর আমার বাগদত্তাকে বিয়ে করেছ। আমার সামনে থেকে দূর হও, নচেৎ তোমায় আমি হত্যা করব। এই বলে তার ভাইকে আক্রমণ করল।
আক্রান্ত ভাইয়ের চিৎকারে সব চাকর এসে হাজির। তখন সৈনিকের ভাই হিউগ বলল, সব দরজা বন্ধ করে দাও যেন এই জালিয়াত পালাতে না পারে। সৈনিক বলল, আমি পালাচ্ছি না, যে পর্যন্ত আমি ন্যায়মতো হেনডন হলের উত্তরাধিকারী হচ্ছি। রাজকুমার বলল, সত্যি বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। সৈনিক বলল, হিউগ ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ আর জোচ্চোর স্বভাবের ছিল। রাজকুমার বলল, আমি ভাবছি যে আমাকে খোঁজার জন্য এখনো কোনো সৈন্য পাঠানো হলো না কেন? সৈনিক মনে মনে বলল, আহা! বেচারার রাজকীয় দুঃস্বপ্ন এখনও যায়নি। রাজকুমার বলল, আমি আমার সমস্ত ঘটনা এ কারণে লিখে রেখেছি।
এটা তুমি আগামীকাল আমার চাচা লর্ড হাটফোর্ডের কাছে পৌঁছে দেবে। সৈনিক বলল, ঠিক আছে।ঠিক এমনই সময় একটা নারীকন্ঠ ভেসে আসল: দয়া করে একটু থামুন স্যার। সৈনিক বলল,বাগদত্তা বধূ এডিথ, তুমি এখনো আমাকে না চেনার ভান করছ। এডিথ বলল, আমি দুঃখিত স্যার, না, আমি না-চেনার ভান করছি না। আমি আপনার জন্য সমবেদনা অনুভব করছি। কারণ আপনি মিলসের মতো দেখতে। আপনি আমার স্বামীকে বিরক্ত করলে সে আপনাকে হত্যা করবে। সৈনিক বলল, না একথা সত্যি নয়। তুমি সমবেদনা জানাতে আসনি, তুমি আমায় ভালোবাস তাই এসেছ।
ঠিক এমনি সময় পুলিশ এসে দরজা খুলে সৈনিক ও রাজকুমারকে জেলখানায় নিয়ে গেল। জেলখানায় তাদের কয়েকদিন কাটল। তারপর একদিন একজন পুরোনো চাকর এসে সৈনিকের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করল। সে বলল, হুজুর আমি মনে করেছি আপনি মারা গেছেন। আপনাকে আবার জীবিত দেখলাম এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সৈনিক বলল, এন্ড্রু আমি জানতাম তুমি আমার বিরুদ্ধে যাবে না।প্রতিদিনই এন্ড্রু সৈনিকের সঙ্গে দেখা করে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে যেতে লাগল।
এন্ড্রু বলল, এডিথ হিউগকে বিয়ে করেছে কিন্তু সে মোটেও সুখী নয়। সে এখনো আপনাকে ভালোবাসে। আপনার ভাই হিউগ আমাদের শাসিয়েছে আমরা কেউ যদি আপনাকে চিনি বলে পরিচয় দিই তাহলে সে আমাদের হত্যা করবে। এখন রাজার অভিষেক হবার পরে নতুন রাজার অনুগ্রহে সে অনেক কিছু করবে বলে আশা করছে।রাজকুমার জিজ্ঞাসা করলেন অভিষেক উৎসব কবে? সৈনিক মিলসকে বলল, তারা আর কাউকে সিংহাসনে বসাচ্ছে। আমাদের ওয়েস্টমিনিস্টার গির্জায় যেতে হবে এবং যে করেই হোক এই অভিষেক উৎসব বন্ধ করতে হবে।
সৈনিক বলল, কালই আমার বিচার হবে, ঠিক সময়মতোই সেখানে পৌঁছাতে পারব।পরের দিন বিচারে মিলের দুদিনের জেল হবার আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমার বললেন, হে জজ, আপনি কেমন করে এর প্রতি অবিচার করতে পারেন? আমি আপনাকে হুকুম দিচ্ছি একে মুক্তি দিন। বিচারক সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে এই বোকা ছেলেটাকে কয়েক ঘা বেত লাগাও। তাহলে তার জিহবা সংযত হবে। সৈনিক নিজে বিচারকের কাছে মিনতি করল যে বালকটি বড় দুর্বল। বালকের ভাগের চাবুক আমাকে মারার অনুমতি দিন।উত্তম প্রস্তাব, এই বেওকুফকে এক ডজন চাবুক কষে লাগাও।
চাবুক খাওয়া শেষে জেলখানার ভিতরে রাজকুমার সৈনিককে বলল, তুমি সব লোক থেকে মহান এবং তোমাকে আজ থেকে আরল খেতাবে ভূষিত করলাম।দুইদিন পরে তারা দুজনেই কারামুক্ত হয়ে লন্ডনের পথে রাজার অভিষেক দেখার জন্য রওনা হলো। সৈনিক ভাবছিল এ যাত্রায় দুটা কাজ হবে। এক : রাজকুমারের ইচ্ছা পূরণ হবে, আর দুই : আমার বাবার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে রাজপ্রাসাদে আমার দেখা হয়ে যাবে। তারা লন্ডনে ঢোকার পরে দেখল সবাই উৎসব মেতে আছে। হঠাৎ একজন বলে উঠল, তুমি ধাক্কা দিয়ে আমার হাতের পেয়ালা ফেলে দিলে কেন? অন্যজন উত্তর দিল যে সে ইচ্ছা করে ধাক্কা দেয়নি। এখন তুমি কী করতে চাও?
এমনিভাবে কথা কাটাকাটি করতে করতে শেষে হাতাহাতি শুরু হলো এবং সব লোক এই গন্ডগোল দেখে এদিকে-সেদিকে ছুটে পালাতে লাগল। এর মধ্যে সৈনিক ও রাজকুমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। যাক, গন্ডগোল শেষে খুঁজে পাওয়া যাবে এই মনে করে রাজকুমার একাই নিজে অভিষেক দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলো। পথ চলতে চলতে রাজ্যের সব অনাচার তার চোখের উপর ভেসে উঠল। আর সে মনে মনে ভাবছিল যে আমি সিংহাসনে আরোহণ করার পরে এইসব অন্যায় ও অনাচার দূর করতে চেষ্টা করব।
এদিকে রাজপ্রাসাদে টম ক্যান্টির জন্য আজ দিনটা বড় আনন্দের। তাকে ভালো ভালো কাপড় পরানো হলো। বিভিন্ন খাবারও এল। সে মনে মনে ভাবল রাজা হওয়ায় ভারি মজা এবং অভিষেকে যাবার পথে সে আরও আনন্দিত হলো। তার হাতে কয়েক থলি মুদ্রা গরিবের মধ্যে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করার জন্য দেয়া হলো। সে গাড়িতে বসে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করছিল। এমনি সময় ভিড়ের মধ্যে সে তার মাকে দেখতে পেল এবং তার অজান্তেই তার হাত মাথায় চলে গেল।
এদিকে তার মাও তাকে চিনতে পারল, ‘টম আমার টম’ বলে গাড়ির দিকে ছুটে আসছিল কিন্তু গাড়ির প্রহরীরা তাকে আটকে ফেলল। তখন টম তার মন্ত্রণাদাতাকে বলল, এই প্রৌঢ় মহিলাটি আমার মা। এই কথা শুনে হাটফোর্ড তাড়াতাড়ি আর্চ-বিশপের সঙ্গে পরামর্শ করে বলল যে, রাজকুমারের পাগলামিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই অভিষেকের কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করলেই ভালো হয়।
এই কথা অনুযায়ী অনুষ্ঠানটি খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগল। তারা সবাই যখন দরবার কক্ষে এসে পোঁছাল ঠিক সেই সময় হঠাৎ এক বালককণ্ঠে উচ্চারিত হলো: থামো, আমিই হলাম আসল রাজকুমার। দরবারের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে উঠল, এই ভিক্ষুক ছেলেটাকে বের করে দাও। কিন্তু সিংহাসন থেকে টম বলে উঠল, না না, সেই সত্যিকারের রাজকুমার। টম ক্যান্টি তখন সব ঘটনা হাটফোর্ডকে খুলে বলল। তখন হাটফোর্ড বললেন, এ যে অবিশ্বাস্য ঘটনা। তবে এই ব্যাপারে একটা মাত্র পরীক্ষা হবে-যার দ্বারা এই ঘটনার ফয়সালা হবে যে কে সত্যিকারের রাজকুমার। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বলোতো বড় রাজকীয় সিলটা কোথায় আছে?
ভিখারি রাজকুমার বলল, এ তো অতি সাধারণ প্রশ্ন। আমার কামরায় গিয়ে টেবিলের বামদিকে একটা লোহার পেরেক আছে, সেটা চাপ দিলে একটা গুপ্ত আলমারির দরজা খুলে যাবে, সেখানেই সিলটা পাবেন। হাটফোর্ড তড়িৎ সিল আনার জন্য চলে গেল কিন্তু কিছুক্ষণ পর খালি হাতে ফিরে এসে বলল, সিলটা পাওয়া গেল না। তখন হাটফোর্ড বললেন, এতে শুধু একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়। ভিখারি রাজকুমার হাটফোর্ডকে প্রশ্ন করল, আপনি ঠিকমতো খুঁজে দেখেছেন তো?
হাটফোর্ড বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু কোথাও সেই বড় সোনালি গোল সীলটা পাওয়া গেল না। টম বলল, একটা বড় সোনালি গোল সিলের কথা বলছেন, আরে তোমার টেবিলের উপরই ছিল এবং পরে তুমি সেটাকে লুকালে। ভিখারি রাজকুমার বলল, আর বলতে হবে না মনে পড়ছে। হাটফোর্ড আমার ঘরে যে লোহার বর্ম আছে তার বাহুর তলে বড় সোনালি সিলটা আছে। আবার হাটফোর্ড দৌড়ে সীলটা খুঁজতে গেল এবং তাড়াতাড়িই ফেরত এসে বলল, আপনাকে সন্দেহ করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন হুজুর।
এর মধ্যে সৈনিক মিলস হেনডেন একদিন পরে এসে প্রাসাদে পৌঁছোল। দ্বারী তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে কী করছ? সৈনিক বলল, আমি আমার স্বর্গীয় পিতার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দ্বারী বলল, লোকটাকে সন্দেহ হচ্ছে, তোমরা একে তল্লাশি করো। তারা তার দেহ তল্লাশি চালিয়ে একটা পত্র পেল। তাতে লেখা : ‘লর্ড হাটফোর্ড সমীপেষু, এই পত্রবাহক আমার বন্ধু স্যার মিলস হেনডেন। সৈনিক মিলসকে রাজকুমারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সৈনিক তখন ভাবছে : আমি কি স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি? তখন রাজকুমার বলল, হ্যাঁ মিলস, তুমি আমার পাশে বসো, এই অধিকার তোমাকে আগে দেওয়া হয়েছে। তারপর হিউজ হেনডেনকে রাজ্য হতে বিতাড়িত করা হলো।
তার মৃত্যুর পরে মিলসের সঙ্গে এডিথের বিয়ে হলো। সে তার মা ও বোনদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে বসবাস করতে লাগল। রাজকুমারকে যারা সাহায্য করেছিল। সবাইকে পুরস্কৃত করা হলো। আর যারা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো।রাজা এডওয়ার্ডের রাজত্ব খুব ন্যায় ও শান্তির রাজত্ব ছিল। একদিন রাজকুমার টমকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমার বড় গোল সীলটার কথা কীভাবে মনে রাখলে? টম বলল, মনে থাকবে না? ওটা দিয়ে তো আমি প্রতিদিন বাদামের খোসা ছাড়াতাম ও বাদাম ভাঙতাম। এটাকে আমি হাতুড়ির মতোই ব্যবহার করেছি।
Read more