রিহাবের নতুন জামা
রিহাব সকাল থেকেই হু হু করে কাঁদছে। দু’চোখের কোণায় এক ফোটাও জল নেই। এভাবে কাঁদলে কি আর মায়ের মন গলানো যায়? চোখে জল নাই-বা এলো, তাতে কী যায় আসে? মুখের জলতো ফুরিয়ে যায়নি। একটু আঙুলে করে লাগিয়ে নিলেই তো হলো। হোক সেটা অভিনয়ের জল। মানুষতো বেশির ভাগ সময় অভিনয়ই করে। বরং মঞ্চের অভিনয় সত্যিকারের অভিনয় নয়। মঞ্চে অভিনয়তো এক ধরনের আর্ট, কলাকৌশল। সেটা লোক দেখানো অভিনয়। মঞ্চ ছাড়াও আমরা বাস্তব জীবনে প্রতিদিন সারাক্ষণ অভিনয় করে থাকি। এক একজন মানুষ এক একটা পাকা অভিনেতা। যে যেখানেই অভিনয় করুক না কেন, রিহাব আজ বুঝিয়ে দিবে, সেও একজন পাকা অভিনেতা।
রিহাব হু হু হু করে কাঁদছে। তার মা সাফিয়া খাতুন রান্নাঘরে ইফতার নিয়ে ব্যস্ত। রমজান মাস। দুপুরের পর চুলো জ্বালানোর কাজে বসে পড়তে হয়। ইফতারের জন্য ছোলা সিদ্ধ করা, পিঁয়াজো ভাজা, রুটি বানানো। ভাত, তরকারি রান্না করা। এ মাসে প্রত্যেক বাড়িতে এগুলো নিত্য কাজ।
রিহাব উঠানে দাঁড়িয়ে গলার হাজার স্বরের মধ্যে হু হু হু স্বরটা আপাতত বেছে নিয়েছে। প্রয়োজন হলে স্বর বদলাবে। এ্যা, এ্যা। আরও কত রকমের স্বর তার জানা আছে। সাফিয়া খাতুন হাতে একটা কাঠের তক্তা নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বললেন, ‘দেখেছিস এটা? সবকটা পিঠে পড়বে। আবারও বলছি হাত-মুখ ধুয়ে নে। গায়ে ময়লা হচ্ছে।’ রিহাব উঠানে বসে দুই পা সামনে ছড়িয়ে বলল, ‘আমি জানি না, আমাকে নতুন জামা কিনে দাও।’ এতক্ষণ চোখের কোণায় জল ছিলো না। মায়ের সাথে কথা বলতেই তার দুচোখ ভিজে এলো। এই জল মায়ের ভয়ে নাকি ঈদের নতুন জামা না পাওয়ার কষ্টে-বলা কঠিন। তবে এবার মনে হয় সত্যি সত্যিই কাঁদছে। অভিনয় আর সত্যিটা এক নয়।
রিহাবের সব বন্ধুর নতুন জামা, প্যান্ট, রোদচশমা কেনা হয়ে গেছে। সবার বাড়ি গিয়ে রিহাব দেখে এসেছে। নিলয়, হাসান, কবির এদের সবার ঈদের জামা কাপড় কেনা হয়ে গেছে। ওরা সবাই রিহাবের বন্ধু। সবাই সবার বাসায় গিয়ে একে অন্যেরটা দেখে এসেছে। শুধু পাপ্পুরটা কাউকে দেখায়নি। ও বলেছে, নতুন জামা দেখালে পুরনো হয়ে যাবে। যাগগে সেকথা। রিহাবের এত কিছুর প্রয়োজন নেই। তার দাবি শুধু একটা রঙিন জামা।
রিহাবের বড় বোন মিমি এসে বলল, ‘মা, ভাইয়া ফোন করেছিল। এবার ঈদে ভাইয়া আসবে। রিহাব, কাঁদিস না, ভাইয়া তোর জন্য নতুন জামা নিয়ে আসবে।’ সাফিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বললো তোকে?’
‘চুমকির ভাই ফোন করেছিল। আমি ছিলাম ওদের বাড়ি। ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে। ভাইয়া চাঁদরাতে বাড়ি আসবে।’
কথাটি শুনে রিহাব বলল, ‘সত্যি বলছো?’
হাসিমুখে মিমি বলল, ‘হ্যাঁ ভাই। সত্যি বলছি।’
রিহাব চট করে উঠে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে পকেটে করে মুড়ি নিয়ে ছুটলো বাইরে। বন্ধুদের খবরটা জানাতে হবে।
সাফিয়া খাতুনের চোখ ভিজে এসেছে। রিহাবের বড় ভাই শিহাব ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিল। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন চোখের কোণায় রয়ে গেল। হঠাৎ রিহাবের বাবা মারা যাওয়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল। সংসারের বোঝা এসে পড়লো শিহাবের কাঁধে। পাড়াতো এক বন্ধুর সাথে চলে গেল ঢাকায়। মাসে মাসে যা টাকা পাঠায় এতে রিহাব, মিমির পড়ালেখা আর সংসারের খরচে চলে যায়।
কয়েক দিন অস্থির সময় পার করতে হয়েছে রিহাবকে। জানে না দেখতে কেমন হবে তার নতুন জামা?
অবশেষে দোয়ারে এসে দাঁড়ালো সেই দিন। আজ চাঁদরাত। আগামি কাল ঈদ-ঊল-ফিতর। চারিদিকে চাঁদ দেখার আনন্দ। হৈ চৈ পড়ে গেল ছেলে-মেয়েদের। রিহাবের একটাই চিন্তা, তার ভাই আসবে তো? কখন আসবে? কখন তার নতুন জামা দেখবে। বার বার রাস্তায় বের হচ্ছে আর বাড়িতে ঢুকছে। সন্ধ্যার পর শিহাব বাড়িতে পৌঁছাল। দীর্ঘ দিন পর বাড়ি ফিরল সে। রাতের খাবার খেয়ে বসে পড়ল ব্যাগ নিয়ে। রিহাব আর মিমি দুজনে বসল ভাইয়ের দু’পাশে। শিহাব ব্যাগ থেকে পোশাক বের করছে। বারান্দায় চৌকিতে বসে আছেন সাফিয়া খাতুন। একটি শাড়ি বের করে বলল, ‘রিহাব এটা মাকে দে।’ রিহাব মুঠ করে ধরে মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো। মা তার পুরোনো ডায়ালগ শুনিয়ে বললেন, ‘আমার জন্য শাড়ি কিনেছিস কেনো? আমার শাড়ি নেই বলেছি? শুধু শুধু টাকা নষ্ট।’
শিহাব তার মায়ের কথায় কান দিলো না। সে জানে এটা তার মায়ের পুরোনো কথা। সব মায়েরাই এরকম বলেন।
এবার একটি ফ্রক বের করে দিলো মিমির হাতে। মিমি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে ফ্রক নিয়ে ছুট দেয় ঘরের মধ্যে। এবার বেরিয়ে এলো রিহাবের জামা। তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কিরে, কেমন হয়েছে বলতো?’ রিহাবের দুই ঠোঁটে হাসির ঝিলিক। জামাটা হাতে নিয়ে গায়ে ঢুকিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে হাত গেল থমকে। মুখটা মলিন করে বলল, ‘মিয়াভাই, এই বোতামটার রং অন্যরকম কেনো?’ শিহাব চাকুরি করে একটা গার্মেন্টসে। অল্প টাকার বেতন। ঢাকা শহরে থাকা খাওয়ায় অর্ধেক টাকা ফুরিয়ে যায়। বাকি টাকাটা পাঠায় বাড়িতে। তারমতো একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের সাধ্য নেই যে বড় বড় দোকান থেকে ঈদের পোশাক কেনে। সাধ আছে সাধ্য নেই। ফুটপাত থেকে বেছে বেছে কেনা। কিন্তু তখন দেখেনি। রাস্তায় হকারদের কাছ থেকে কিনলে এমনটি হওয়া স্বাভাবিক। এখন আর কী করার! ওরকম বোতাম পাবে কোথায়?
শিহাব হাসিমুখে বলল, ‘ঢাকায় এখন এটাই নতুন ডিজাইন। ওখানের সব জামাতে একটি করে বোতাম অন্য রকম থাকে। এটা এক ধরনের ডিজাইন।’ রিহাব বুঝে যায়। মা চুপ থাকেন। প্রিয়জনকে খুশি করতে মাঝে মাঝে মিথ্যাটাও সুন্দর করে বলতে বাধ্য হন শিহাবের মতো ভাইয়ারা।
ঈদের দিন রিহাবকে যে-ই জিজ্ঞাসা করেছে তোর জামার একটি বোতাম অন্যরকম কেন রে? রিহাব তাকেই সটাসট উত্তর দিয়েছে, ‘ঢাকার জামা এটা, নতুন ডিজাইনের বের হয়েছে। মিয়াভাই কিনে দিয়েছেন আমাকে।’