রুদ্রায়ণ-সমরেশ মজুমদার

রুদ্রায়ণ-সমরেশ মজুমদার

দুপুর একটু গড়ালেই এখানে ঠান্ডা হাওয়া বয়। সঙ্গে-সঙ্গে চারপাশে এমন একটা হিমভাব ছড়ায় যে রোদ্দুরটাকে গায়ে লাগে না। তারপর যখন ছায়ারা গাঢ় হয়, নিচের জঙ্গলের অন্ধকার গায়ে মেখে তারা যখন ওপরে উঠে আসে তখন থেকেই কনকনানিটা শুরু হয়। রাত যত বাড়ে তত তার দাঁত ধারালো হয়। সন্ধের পর পথেঘাটে মানুষ আর বের হয় না। আলোগুলো জ্বলতে থাকে ভূতুড়ে চোখের মতন। শুধু বাতাসের একটানা গোঙানি দিয়ে রাতটা থাকে জড়ানো।


দূরের ওই আকাশের গায়ে ছড়িয়ে থাকা মাঠটার বুকে ছোট-বড় যে তাঁবু পড়েছিল রাজকুমারের অভিষেকের সম্মানে সেগুলোকে তুলে নেওয়া হয়েছে। গত তিনদিন প্রচণ্ড খাটুনি গেছে জয়ন্তীর। মহারাজকুমারের অভিষেক উপলক্ষে এই পাহাড়ি শহরে ছুটে আসতে হয়েছে দিল্লির দেইলি সান কাগজের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে। প্রাত্যহিক রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। একটা রঙিন ফিচার লিখতে হবে তাঁকে। রাজপরিবার এবং তাঁকে নানানরকম কাহিনি সাজিয়ে এই পটভূমিকে প্রাণবন্ত করতে হবে কাগজের পাতায়। এ-ব্যাপারে অবশ্য জয়ন্তীর সুনাম আছে। অভিষেক মিটে গেলে জয়ন্তীর ইচ্ছে হল এখানে আরও কয়েকটা দিন রয়ে যেতে। ছবির মতো ছোট্ট শহর বিশ্রামের পক্ষে সত্যি খুব ভালো। পরিশ্রম বেশি হয়ে যাওয়ায় মন আরাম চাইছিল। কাগজ থেকে অনুমতি মিলতেই হাঁফ ছেড়েছিলেন তিনি। যাক, এখন দশটার আগে বিছানা ছাড়বেন না, সন্ধের পরেই লেপের তলায় ঢুকবেন। দিল্লিতে যা করা হয় না তাই করবেন তিনি এখানে।


জয়ন্তীর আস্তানাটা চমৎকার। শহরের ঠিক ওপরে পাহাড়ের গা-ঘেঁষে পরপর যে ছবির মতো বাংলোগুলো তারই একটা ভাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি কপালজোরে। একটি বৃদ্ধ। ভুটানিদম্পতি দেখাশোনা করে এটিকে। মালিক থাকেন আরও ওপরের রাজধানীতে। বৃদ্ধ বাগান করে সামনের চিলতে জমিতে, বৃদ্ধা সুন্দর রান্না করে দেয় জয়ন্তীকে। প্রথম কদিনের পরিশ্রমে যা চোখে পড়েনি এখন এই বিশ্রামের সময়ে তাই চেখে-চেখে দেখছেন তিনি। এই পাহাড়ি মাটিতে শীতের ফুলেরাও বুদ্ধের হাতে কি সুন্দর হয়ে ফোটে। এই দম্পতির যেন কোনও ব্যাপারেই কৌতূহল নেই। জয়ন্তী এখানে রয়েছেন এবং কদিন থাকবেন একাকী তাও যেন ওদের কাছে স্বাভাবিক।

চল্লিশটা বছর কখন নিশব্দে খরচ হয়ে গেল। অথচ শরীরটার দিকে তাকালে চল্লিশ শব্দটাকে মনেই পড়ে না। এখন তাঁর চামড়া তেমনি টানটান, মুখের কোথাও আঁচড় পড়েনি, স্বাস্থ্য সেই তিরিশেই ঠেকে রয়েছে। শুধু একটা মোলায়েম রুক্ষতা জয়ন্তীর সর্বাঙ্গে ছড়ানো যা কিনা তাঁকে বর্মের মতো আড়াল দেয়।


এখনও ঠান্ডা বাতাস নেমে আসেনি, মিষ্টি ওম রোদ্দুরে মাখানো। জয়ন্তী কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূরে কালো চাপ জঙ্গলমাখা পাহাড়ের শরীর ঘেঁষে বেশ চওড়া নদীর সাদা খাদটা চোখে পড়ল। কী নাম যেন, তোর্সা? যে সব ভেঙে ফেলে? এখন কি বিষাদ নিয়ে শুয়ে আছে নিশ্ৰুপ হয়ে! জল বইছে সরু ধারায়, বাকিটা সাদা হাড়ের মতো পাথরে ছড়ানো। অদ্ভুত নির্জনতা এখানে। জয়ন্তী ঝুঁকে নিচের রাস্তাটা দেখলেন। ওঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। ওরা আসছে। পায়ে-পায়ে, খুব সন্তপর্ণে। গতকালই আলাপ হয়েছে। দুটো বাড়ির ওপাশে বাঁকের মাথায় যে। বাংলো সেখানে থাকে ওরা। মহিলাটি মাঝবয়সি, ট্রেইনড নার্স ছেলেটি বছর পনেরর হবে কিনা। সন্দেহ। অত রোগা এবং সাদা চামড়ার কিশোরকে জয়ন্তী আগে কখনও দেখেননি। প্রথম দেখায় বুঝতে পেরেছিলেন বেশ অসুস্থ ছেলেটি। এইটুকুনি পথ হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। প্রতিটি পা। ফেলছে আর বড়-বড় নিশ্বাস নিচ্ছে।

দ্রুত নিচে নেমে এলেন জয়ন্তী। ছোট্ট বাগান পেরিয়ে কাঠের গেটের সামনে দাঁড়ালেন। এখন ওঁর শরীরে একটা হালকা শাল অথচ ছেলেটির আপাদমস্তক গরম উলে মোড়া। মাথায় মাঙ্কিক্যাপ। যে চামড়াটাকে প্রথমে সাদা মনে হয়েছিল তা যে রক্তহীন সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কথা বলার চৌহদ্দিতে আসা মাত্র জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো আজকে?




ছেলেটির চোখে লজ্জা ফুটল কি! ঘাড় নাড়ল সে, ভালো।

গতকাল ওকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নার্স। যেই ওই পাহাড়টার মাথায় কুয়াশারা এসে জমা হয়েছিল সঙ্গে-সঙ্গে সে তাড়া দিয়েছিল, চলো, রোদ মরে আসছে। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।

ছেলেটির কাতর চোখের চাহনিতে তার মন গলেনি। জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কী করব বলুন! ডাক্তার পইপই করে নিষেধ করেছে ঠান্ডা না লাগাতে, অথচ রোদ্দুরে একটু পায়চারিও করাতে হবে। এদিকে পদ্মপাতায় জল কখন যে টুপ করে ঝরে পড়বে আর দোষ হবে আমার। আর দাঁড়াতে হবে না, ফিরে চলো।

ছেলেটির ফিরে যাওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু প্রতিবাদ করার ক্ষমতাটুকু বোধহয় অর্জন করতে শেখেনি সে। আজ জয়ন্তী গেট খুলে রাস্তায় চলে এলেন। দু-একটা ভেড়া ছাড়া পিচের পথটায় কোনও প্রাণী নেই। জয়ন্তী বললেন, কাল তোমার নাম জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি!

ছেলেটির ঠোঁট নড়ল। শুধু চোখ নাক আর গালের পাশ দিয়ে ঠোঁট নজরে আসছে। নার্স বলল, নাম বলো!

তাপস সেনগুপ্ত।

বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তোমার। চলো আমি তোমার সঙ্গে একটু বেড়াই। তোমার আপত্তি নেই। তো? তাপসের পাশে এসে দাঁড়ালেন জয়ন্তী।

দ্রুত মাথা নাড়ল সে, না কোনও আপত্তি নেই।

কয়েক পা হাঁটতেই নার্স চাপা গলায় বলল, আঃ অতজোরে হাঁটতে মানা করেছিনা? এমনভাবে হাঁটবে যাতে কষ্ট না হয়।

আমার কষ্ট হচ্ছে না। জয়ন্তী লক্ষ করলেন তাপসের কণ্ঠস্বর বয়সের তুলনায় বেশ সরু কিন্তু খুব মিষ্টি।


কিসে কষ্ট হবে তা যদি বুঝতে পারতে। এখানে একটু বসো। জিরিয়ে নাও। আর যেতে হবে না ওদিকে। এক্ষুনি রোদ পড়ে আসবে। তোমার বাবা শুনলে আমায় আস্ত রাখবে না। নার্স। তাপসকে হাত ধরে রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসিয়ে দিল। জয়ন্তী লক্ষ করছিলেন নার্সের শাসন। এর মধ্যে তাঁর কথা বলা শোভন নয়। তবে নার্স ঠিকই বলেছে বলে মনে হল। তাঁর। এটুকু আসতেই ছেলেটি হাঁপাচ্ছে। মুখে ঘাম জমছে, বুকের ওঠানামা পুলওভার আড়াল করতে পারেনি।

ওর অসুখটা কী তা জয়ন্তী জানেন না। গতকাল নার্সটি বলেছিল, ও খুব অসুস্থ। বিশ্বাস করতে চাননি কিন্তু এখন মনে হল সেটা খুব বেশি রকমের কিছু। জয়ন্তী ছেলেটির দিকে তাকাতেই স্থির হয়ে গেলেন। এক একটা স্পর্শ কিংবা গন্ধ অথবা চাহনি আছে যা মুহূর্তেই সমস্ত পলেস্তারা খসিয়ে হাঁ করে দেয় গাঁথুনিকে। এক মুহূর্তে ঠেলে নিয়ে যায় সেখানে যেখানে স্মৃতি থাকে মুখ বুজিয়ে। ছেলেটি যেভাবে তাঁর দিকে বিশাল চোখে তাকিয়ে আছে, সেই চাহনি জয়ন্তীকে এবার কাঁপিয়ে দিল। পঁচিশ বছর আগের আর একজোড়া চোখ কী করে এই চোখে দৃষ্টিটাকে এঁকে দিল হুবহু?




মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে শাড়ি থেকে চোরকাঁটা সরাচ্ছিল নার্সটি। জয়ন্তী ওর কাছে এগিয়ে গেলেন যেন চাহনিটার সীমা ছাড়াতেই। জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা কী হয়েছে ওর?

কথা শোনার দূরত্বে নেই ছেলেটি, তবু নার্স আড়চোখে একবার দেখে নিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, বাঁচবে না।

সেকি!

নীরবে মাথা নাড়ল নার্স তারপর বলল, শরীর রক্ত হয় না। কলকাতা বোম্বাই দিল্লি ঘুরে অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কোনও লাভ হয়নি। গরম জায়গায় থাকলে অ্যাদ্দিন চলে যেত। ঠান্ডা পাহাড়ি অঞ্চল অথচ ঠান্ডা লাগবে না বলেই এই জায়গাটা বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিসপ্তাহের শনিবারে রক্ত দিতে হয়। বাড়িতেই সব ব্যবস্থা করা আছে।

ওর বাবা-মা? জয়ন্তী ছেলেটির দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছিলেন না।


মা তো মরে গেছে জন্ম দিয়ে। বাপের খুব আদুরে ছেলে। খরচা করছে খুব। কিন্তু বেশিদিন ভুগলে কজনের আর ধৈর্য থাকে। চাকরি বাকরি ছেড়ে তো আর এখানে পড়ে থাকতে পারে না। শনিবার আসে সোমবার ভোরে চলে যায়। এটাই বোধহয় শেষ মাস।

কেন? চমকে উঠলেন জয়ন্তী।

জানি না। ডাক্তার ওর বাবাকে তৈরি থাকতে বলেছেন। আর দেরি করব না দিদি। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। চলি। নার্স তরতর করে এগিয়ে গেল তাপসের দিকে। জয়ন্তী লক্ষ্য করলেন এতক্ষণে তাপসের বুক কিছুটা স্থির। নার্স বলল, ওঠো, সন্ধে হয়ে আসছে।

এখনও তে রোদ আছে। কাতর হল তাপসের গলা।

থাক। আর বসে কাজ নেই।

আর একটু থাকো না।

না।

আর একটুখানি। আমার খুব ভালো লাগছে। আবদার না প্রার্থনা তা বোধহয় ও নিজেই জানে না বলে মনে হল জয়ন্তীর। নার্সের পাশে পৌঁছে জয়ন্তী বললেন, এক কাজ করলে হয় না, আপনি এগিয়ে যান আমি ওকে নিয়ে আসছি।


নার্সটি বুঝতে পারছিল না এ কথায় বিরক্ত হওয়া উচিত কিনা। সে বলল, আপনি জানেন না দিদি, ওর সঙ্গে হাঁটা কি কষ্টকর।

জয়ন্তী হাসলেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ভালোভাবে নিয়ে যাব ওকে।

একটু কি স্বস্তি নার্সটির? মুখে আরামের ভাঁজ? বলল, তাহলে বেশি দেরি করবেন না। ওর বাবা শুনলে আমাকে খেয়ে ফেলবে। ভীষণ রাগী মানুষ। শোনো, তুমি আবার অন্য কিছুর বায়না করবে না, বুঝলে? তাহলে আমি আসি!

হ্যাঁ। জয়ন্তীর মুখ থেকে শব্দটি বের হওয়া মাত্র নার্স বাড়ির পথ ধরল। সেদিকে একবার তাকিয়ে জয়ন্তী তাপসের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তুমি কিন্তু খুব ঘামছ।

তাপস ওঁর দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। জয়ন্তী চারপাশেনজর বোলালেন। এখনও আকাশ রোদ্দুরে রাঙাননা, কুয়াশারা গতকালের মতো জমতে শুরু করেনি। ঠান্ডা হাওয়াটা এখনো নামেনি পাহাড় থেকে। ওঁর মনে হল অতিরিক্ত গরম জামা কাপড় তাপসকে অস্বস্তি দিচ্ছে। তিনি বললেন, মাঙ্কি ক্যাপটা খুলে ফেললে হয়তো আরাম লাগবে তোমার, খুলবে?

একটু শঙ্কিত হল তাপস। সরু গলায় বলল, আন্টি বকবেন।


এখন খুলে বসো, যাওয়ার সময় আবার পরে নিও।

ছেলেটি নিজে খুলতে পারল না, জয়ন্তীকে হাত দিতে হল। ভীষণ দুর্বল ও, কাগজের মতো সাদা দেহে কোথাও শক্তি অবশিষ্ট নেই। অথচ চোখ দুটো কি দারুণ উজ্জ্বল। মাথার চুল চেপে বসে। গিয়েছিল। জয়ন্তীর খুব ইচ্ছে করছিল কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে। কয়েকদিনের মধ্যে যে মরে যাবে তার সম্পর্কে সঙ্কোচ হওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু ছেলেটি যে আরাম বোধ করছে এটা বোঝা গেল। মুখের চেহারার পরিবর্তন হচ্ছিল ঘামে বাতাস লাগায়। মাঙ্কিক্যাপটা হাতে। নিয়ে জয়ন্তী পাশের পাথরটা ওপর একটু আরাম করে বসলেন, এসো আমরা এবার গল্প করি। তুমি এখানে কতদিন এসেছ?

প্রশ্নটা শুনে মনে-মনে হিসেব করতে চাইল তাপস। তারপর বলল, ঠিক বিরানব্বই দিন। অবাক হলেন জয়ন্তী। এইভাবে দিন গুনতে কাউকে কখনও দেখেননি তিনি। স্বচ্ছন্দে তিনমাস বলতে পারত ও।

আমি এসেছি এক সপ্তাহ হয়নি।

জানি।

কী করে জানলে? দারুণ অবাক হলেন জয়ন্তী।

দেখেছি।

ও। তোমার কেমন লাগছে এই জায়গাটা?

ঠোঁট বেঁকাল তাপস, ভালো না।

সেকি! কেন!

আমি তো বাড়ি থেকে শুধু এই পর্যন্ত আসি।


তুমি আর কোথাও যাওনি? নিচে কত বিরাট মেলা হল, ওদিকে নদীর বুকটা কি চমৎকার! একটা গুম্ভা আছে ওপাশে যার ঘণ্টা বাজে মাঝে-মাঝে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে সব দেখিয়ে নিয়ে আসব। দেখবে, তোমার তখন এই জায়গাটাকে খুব ভালো লাগবে।

সত্যি আমাকে নিয়ে যাবে? উৎসাহে উজ্জ্বল হল তাপসের মুখ।

ঘাড় কাত করলেন জয়ন্তী। এবং হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তাঁর কথা বলার ধরন যেন বদলে গেছে। দিল্লির ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক জয়ন্তী রায় নয়, পঁচিশবছর আগের সেই বালিকার গলা যেন আচমকা শুনতে পেলেন তিনি। শুনে মজা লাগল। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন এই নিরক্ত কিশোরটির সঙ্গে এইভাবে কথা বলাই স্বাভাবিক।

এবার কুয়াশারা জমতে শুরু করেছে পাহাড়ের মাথায়। খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে রোদ্দুরের চেহারা। জয়ন্তী মাঙ্কিক্যাপ এগিয়ে ধরলেন, এবার এটা পরে নাও।

তাপস মাথা নাড়ল, না, এই ভালো লাগছে।

উঁহু, তোমার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।

লাগবে না। তুমি আন্টির মতো কথা বলো না।

হেসে বললেন জয়ন্তী, বেশ। শুধু আজকের দিনটায় পরো।

অনিচ্ছায় আবার সেটাকে মাথায় চাপাল তাপস। জয়ন্তী তাকে সাহায্য করলেন।

এবারে চলো, আমরা আস্তে-আস্তে ফিরে যাই।

না, আর একটু থাকব।

বাঃ, বিকেল হয়ে আসছে না?

সবাই তো বিকেলেই বেড়ায়। আমার বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। একা-একা শুধু কান্না পায়।

জয়ন্তী তাপসের কাঁধে হাত রাখলেন, চলো আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব কিছুক্ষণ। দোনামনা করে রাজি হল তাপস। ওর সঙ্গে জোরে হাঁটা যাবে না। ধীরে-ধীরে ওঁরা তাপসদের বাংলোয় চলে এলেন। জয়ন্তী দেখলেন, একই প্যাটার্নের বাংলোগুলো সাজানো। কাঠের সিঁড়ি, সামনে চিলতে বাগান, কাঠের গেট। এটুকু হেঁটে আসতেই তাপস বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। গেট ধরে জিরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি ভেতরে আসবে না?


এবার অস্বস্তিতে পড়লেন জয়ন্তী। ছেলেটির সঙ্গে সামান্য আলাপে বাড়ির ভেতরে যাওয়া শোভন হবে না। যদিও শুনেছেন আর কেউ এখানে নেই, তবু। জয়ন্তী হেসে বললেন, আজ থাক। কালকে আসব।

তাহলে আমি কার সঙ্গে গল্প করব?

তাই তো! কিন্তু তোমার বাবা যদি রাগ করেন! কথা ঘোরাতে চাইলেন জয়ন্তী।

বাবা! শব্দটি উচ্চারণ করেই থমকে গেল তাপস। ওর চোখ এখন দূরে লেপ্টে আছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন জয়ন্তী। একটা গাড়ি আসছে উঠে। তাপস বলল, বাবাকে আমি ভয় পাই না।

বেশ তাহলে কাল থেকে–।

আমি তোমার নামই জানতে পারিনি, কী বলে ডাকব তোমাকে?

ঠিক সেই সময় গাড়িটা এসে থামল বাড়ির সামনে। এক প্রায়-বৃদ্ধ দরজা খুলেই চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যালো তাপসবাবু, বেড়ানো হয়ে গেল?

তাপসের ঠোঁটে সামান্য হাসি, মাথা কাত করল সে।

গুড। চলো আমরা ভেতরে গিয়ে গল্প করি। ভদ্রলোকের গলার স্বর শুনেই নার্স প্রায় দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে তাপসের কাঁধে স্পর্শ করতেই সে বিরক্তির সঙ্গে হাতটাকে সরিয়ে দিল। জয়ন্তী এতক্ষণে বুঝে গেছেন ইনি ডাক্তার। ততক্ষণে ভদ্রলোক ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জয়ন্তীকে লক্ষ্য করছেন উনি, আপনি। ও হ্যাঁ, আপনি তো এদিকের একটা বাংলোয় উঠেছেন। জার্নালিস্ট?

সেকি, আপনি জানলেন কী করে?

কী আশ্চর্য, এরকম একটা ছোট জায়গায় কোনও খবর চাপা থাকে?

আপনি তো ডাক্তার?

গুড গড! সেটাও কি আমার মুখে লেখা আছে? কৃত্রিম চমকে উঠলেন ভদ্রলোক।

না। আপনার পকেট থেকে উঁকি মারছে।

চকিতে নিজের কোটের পকেটের দিকে তাকিয়ে হো-হো করে হেসে উঠে স্টেথোটাকে একবার ছুঁলেন ডাক্তার, যাক, আমাদের তাপসবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার! খুব ভালো ছেলে তবে একটু অভিমানী।

এরকম বিকেলে একা বসে থাকতেই ইচ্ছে করে না। ছায়ারা যত ঘন হয় তত বিষণ্ণ লাগে চারধার। জয়ন্তী নিজের বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে ফিরে এসে বসতেই আকাশ থেকে আলো নিবে গেল। এখানে সন্ধে হয় আচমকা। সূর্য ডুবে গেলেও এক ধরনের মায়াবী আলোয়। মাখামাখি হয়ে কিছুক্ষণ পৃথিবী চুপচাপ অপেক্ষা করে। জয়ন্তী অনেকদিনের একটা পুরোনো চাপ বুকের মধ্যে নতুন করে অনুভব করলেন। সেটা কি তাপসের ওই রকম তাকানোর জন্যে, নাকি মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি তাকে দেখছে বলে? বুড়ি এসে দাঁড়াল পেছনের দরজায়, মেমসাব, চা আনব?


ঘাড় কাত করলেন জয়ন্তী। তারপর চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। পঁচিশ বছর আগের সেই কিশোর চোখ দুটো এখন নিশ্চয়ই অনেক পোক্ত হয়েছে। সেই চোখের মালিক এখন কোথায় আছে কে জানে। ধীরে-ধীরে সময় পুরু হতে-হতে যে আস্তরণ ছড়িয়েছিল তা ভেদ করার কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। সে থাকল কি থাকল না এখন আর কিছুই এসে যায় না। পনেরো বছর বয়সটা একসময় হাবুডুবু খেয়ে স্থির শক্ত হয়ে গেছে। চল্লিশে এসে তাকে নেহাতই শৈশবস্মৃতি বলে মনে হত। মাঝে-মাঝে সেই সময়ের চাপল্য অথবা দুঃখবোধের কথা ভেবে নিজেরই অবাক লাগত। তাহলে আজ কেন এমন লাগছে? একটি নিরক্ত কিশোরের চোখ এবং কথা এমন শিকড় ধরে টানছে কেন?

তারপর বেশ ভাব হয়ে গেল তাপসের সঙ্গে। আজও নার্স এসেছে ওকে নিয়ে। জয়ন্তী গেটে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের দেখে বেরিয়ে এলেন। নার্স বলল, আপনি ওকে জাদু করেছেন দিদি। সারাদিন আপনার কথা বকবক করছে।

জয়ন্তী হাসলেন, কেমন আছো?

তাপস সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল, ভালো। নার্স বলল, দিদি, আপনি ওকে পৌঁছে দেবেন? আমার অনেক কাজ পড়ে আছে–।

জয়ন্তী বললেন, বেশ তো। তুমি যেতে পারো।

নার্স তাপসকে বলল, দিদির অবাধ্য হবে না। একদম ঠান্ডা লাগাবে না। রোদ পড়ে যাওয়ার

আগেই চলে আসবে, বুঝলে?

তাপস স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নার্স চলে গেলে বলল, আমার একটুও ভালো লাগে না। সবসময় শাসন করে।

না, উনি তোমায় ভালোবাসেন তাই এসব বলেন। জয়ন্তী বললেন, তোমার হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?

মোটই না। আমার আজকে খুব ভালো লাগছে।

তাহলে চলো আমরা ওই কালভার্টটায় গিয়ে বসি। ওর তলায় একটা ছোট্ট ঝরনা বয়ে যায়।

তাপস তাকাল। দূরত্বটা ওর পক্ষে বেশ দূরের। একটু নার্ভাস দেখাল ওকে, আমি ওখানে যেতে পারব?

কেন পারবে না? তুমি আমার হাত ধরো। খুব সন্তপর্ণে ওর সঙ্গে পায়ে-পায়ে হাঁটতে থাকলেন। জয়ন্তী। ছেলেটির শরীর পাখির মতো হালকা। জয়ন্তীর একবার মনে হল ওকে কালভার্টের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত হচ্ছে কিনা! কিন্তু তাপসের মুখ বেশ খুশি-খুশি। কয়েক পা হেঁটে সে বলল, আমি তোমাকে কী বলে ডাকব?


জয়ন্তী বললেন, তোমার যা খুশি।

আমি তোমাকে নতুনদি বলব।

বাঃ, তোমার তো বেশ বুদ্ধি। আর কোনও দিদি আছে বুঝি?

নীরবে ঘাড় নাড়ল তাপস, তারপর উদাস গলায় বলল, আমার কেউ নেই।

ওকথা বলো না। তোমার বাবা আছেন না? আমার তো তেমন কেউ নেই।

তাপস ওর মুখের দিকে তাকাল, তারপর নীচু গলায় বলল, তোমার খুব কষ্ট, না?

জয়ন্তী বিব্রত হলেন। এ প্রশ্নের তিনি কী জবাব দেবেন?

কালভার্টে পৌঁছে ভীষণ খুশি হল তাপস। নীচে কুলুকুলু শব্দে শীর্ণ জলের ধারা দ্রুত নেমে যাচ্ছে। ছোট নুড়ি পাথরগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে। মুখ তুললে গুম্ভাটা চোখে পড়ে। কতগুলো। ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে গুস্তাটার শরীরে ঝোলানো ছোট ঘণ্টাগুলোর শব্দ বাতাস বয়ে আনছে। তাপসের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল জয়ন্তীর। নানান কথা যার হয়তো কোনও মানে নেই, সারাক্ষণ বকবক করে গেল দুজনে। জয়ন্তীর মনে হল তাপস যেন এতদিন পাথরচাপা ছিল, আজ হঠাৎ মুখ খোলা পেয়ে ফিনকি দিয়ে উঠেছে।


রোদ্দুরের রং পালটাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে জয়ন্তী আনমনে এক কলি গেয়ে ফেললেন। শুনেই তাপস বলল, বাঃ, তুমি তো বেশ সুন্দর গান করো!

জয়ন্তী বললেন, এই ছেলে, ঠাট্টা হচ্ছে, না?

না, সত্যি বলছি।

তুমি গাইতে পারো না?

আমি? আমাকে কেউ কোনদিনও গান গাইতে বলেনি।

সেকি! গান তো নিজে থেকেই আসে। বেশ, আমি বলছি, তুমি গাও আমার সঙ্গে। তাপসের। পিঠে হাত রেখে জয়ন্তী একটা লাইন গাইলেন, আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা। বললেন, গাও আমার সঙ্গে, আমার মতন করে। তাপসের ঠোঁট কাঁপল। ক্রমশ ওর মুখচোখ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল। জয়ন্তী লাইনটি বারংবার গাইতে লাগলেন ওকে সাহস দেওয়ার জন্যে। তাপসের সাদা মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম, নিচু গলায় সে গলা মেলাতে চেষ্টা করছিল। একটা নতুন ধরনের আনন্দে সে জয়ন্তীর হাত চেপে ধরতেই তিনি হঠাৎ শিহরণ অনুভব করলেন। সেই হাত এবং স্পর্শ যা কিনা পঁচিশ বছরেও মরে যায়নি। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন জয়ন্তী। তাঁর মুখ। লাল শরীর অস্থির। তাপস ওঁর মুখ এবং আচরণে অবাক হয়ে গেল, কী হল নতুনদি?




কোনওরকমে শক্তি ফিরিয়ে আনলেন, জয়ন্তী, কিছু না। চলো, ওঠা যাক। ঠান্ডা পড়তে শুরু করছে।

না, আর একটু বসো। আমার এখানে বসতে খুব ভালো লাগছে।

উঁহু, ওঠো।

আর একটু বসো না, তোমার পাশে আর একটু বসব।

এই সময় দূরে গাড়ির শব্দ উঠল। জয়ন্তী মুখ ফিরিয়ে দেখলেন ডাক্তারবাবু আসছেন। কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা, আরে তাপসবাবু, তুমি আজ এতদূর এসে পড়েছ? ফাইন!

জয়ন্তী একটু বিব্রত গলায় বললেন, আমারই দোষ, এতদূরে আনা–।

না-না, দোষ বলছেন কেন? এইটে ওর প্রয়োজন ছিল। দেখুন তো, ওর মুখের চেহারা পালটে যাচ্ছে। আমরা ওষুধে যা পারি না তা মনের পরিবর্তনে অনেক সময় সম্ভব হয়। তবে আর দেরি নয়, এখনই টুপ করে অন্ধকার হয়ে যাবে। আপনারা বরং আমার গাড়িতে উঠে আসুন। এসো তাপসবাবু।

জয়ন্তী বললেন, এইটুকু পথ, আমি না হয় হেঁটেই ফিরছি।

আরে আসুন তো! দরজা খুলে দিলেন ডাক্তার।

প্রথমে খুব সন্তর্পণে তাপসকে বসিয়ে নিজে উঠলেন জয়ন্তী। গাড়ি চলতে শুরু করলে ডাক্তার বললেন, খুবই অবিশ্বাস্য। তিনদিন আগেও ভাবতে পারিনি ও এতটা হাঁটতে পারবে।

কথাটা ইংরেজিতে বললেন তিনি। তাপস ইংরেজি জানে কিনা বুঝতে পারলেন না জয়ন্তী। তাই অনেক জিজ্ঞাসা থাকা সত্বেও চুপ করে বসে রইলেন। ওঁর বাংলোর সামনে গাড়ি থামলে নেমে দাঁড়ালেন, ধন্যবাদ।

ডাক্তার হেসে আবার ইঞ্জিন চালু করলেন। জয়ন্তী দেখলেন, তাপসের চোখে কাতরতা। আর দাঁড়াতে পারলেন না জয়ন্তী। এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন বালিশে মুখ গুঁজে। এই মুহূর্তে তিনি স্পষ্ট জানেন না কেন এমন শরীর কাঁপিয়ে কান্না আসছে। পঁচিশ বছরে এমনভাবে কখনও কাঁদেননি তিনি!


পরদিন মেঘলা ছিল। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জয়ন্তী। হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙল। চমকে উঠে বসতে-বসতে হেসে ফেললেন, ওমা, তুমি কখন এসেছ?

দরজায় নার্সটি দাঁড়িয়ে, কিছুতেই ছাড়বে না, আপনার কাছে আসবেই। দুদিনে বাবু যেন সেরে উঠেছেন। তারপর আজ সকালে ডাক্তারবাবু বলে গেছেন যে আপনার কথা শুনতে। ব্যাস, একদম সাপের পাঁচ পা দেখেছে।

জয়ন্তী হাসলেন। প্রশ্রয় বোধহয় একেই বলে। বললেন, এই ছেলে, বসো, দাঁড়িয়ে কেন? অগোছালো চুল দু-হাতে জড়িয়ে খোঁপা করে নিলেন তিনি। নার্সটি বলল, আমি তাহলে যাই দিদি?

ঘাড় কাত করলেন জয়ন্তী।

নিশব্দে ফিরে গেল নার্সটি। সেদিকে তাকিয়ে তাপস বলল, আমার সঙ্গে বেড়াতে হয় না বলে আন্টি খুব খুশি হয়েছে।

বিছানা ছেড়ে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন জয়ন্তী। নার্সটি দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাই? কেন?

সুনীতদার সঙ্গে গল্প করতে পারে না বেরোতে হলে।

সুনীতা কে?

কম্পাউন্ডার। আমাকে ইঞ্জেকশন দিতে আসে।

তুমি রোজ ইঞ্জেকশন নাও?

না। তবু আসে। যখন ইঞ্জেকশন দিতে হয় না তখন এলে কারও সামনে বের হয় না, এমনকি ডাক্তারবাবু এলেও না।

ও।

জয়ন্তী বুঝতে পারছিলেন না ব্যাপারটাকে কীভাবে এড়ানো যায়।

জানো নতুনদি, ওরা নিজেরা থাকলে অনেক কথা বলে, আমি থাকলে চুপ করে যায়। কী কথা বলে ওরা?

জয়ন্তী বললেন, তা আমি কী করে জানব? ওরা হয়তো খুব বন্ধু।

যাঃ, ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয়?

এই অপাপবিদ্ধ ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল জয়ন্তীর, আর পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিকতা এর মধ্যে আসেনি। আলনা থেকে কাপড় টেনে নিয়ে জয়ন্তী বললেন, বাঃ কেন হবে না?

তোমার ছেলে বন্ধু আছে?

আমার? জয়ন্তী শক্ত হতে গিয়ে সামলে নিলেন, উঁহু।

তবে?

বাঃ, আমার নেই বলে আর কারও হবে না?

জানো নতুনদি, আন্টি না সুনীতদাকে চুমু খায়। আমি দেখেছিলাম বলে খুব রেগে গিয়েছিল

সুনীতদার ওপরে। ছেলে বন্ধুকে চুমু খেলে কি অন্যায়? কী বলবেন জয়ন্তী। মজা করতে ইচ্ছে হল, না, অন্যায় হবে কেন?

আমি তোমার বন্ধু হলে আমাকে চুমু খাবে তুমি?

জয়ন্তী মুখ তুলে তাকালেন। সমস্ত শরীরে সেই কাঁপুনিটা ফিরে এল। মুখ নামিয়ে বললেন, আগে সত্যিকারের বন্ধু হও–।

আমি তোমার সত্যিকারের বন্ধু হব নতুনদি, তুমি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না তো?

হাত বাড়িয়ে ওর চুলে আঙুল রাখলেন জয়ন্তী, তুমি বড় ভালো ছেলে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। তারপর কাপড়টাকে আবার আলনায় রেখে দিয়ে বললেন, নাঃ, আজ আর বেরোব না। এসো আমরা বারান্দার বেতের চেয়ারে গিয়ে বসি।

সেই কালভার্টের কাছে যাবে না?

উঁহু, তার চেয়ে এস আমরা বারান্দায় বসি।

তুমি গান গাইবে?

আমি? গাইতে পারি যদি তুমি আমার সঙ্গে গাও।

খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল তাপস। জয়ন্তীর মনে হল ওকে আজ আর অসুস্থ বলে মোটেই মনে হচ্ছে না।

গতকাল বিকেলে বেড়ানো হয়নি। জয়ন্তী আজ সাততাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। বারান্দার রেলিং-এ ভর রেখে সামনের পাহাড় দেখতে-দেখতে তাঁর জায়গাটাকে আরও বেশি ভালো লাগল। এখানে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। ভাবতে গিয়েই হাসি এল। বহু ব্যবহারে সব কিছুই ঘষা আধুলির মতো হয়ে যায়। জয়ন্তী ডান দিকে মুখ ঘোরাতেই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তাপস আসছে। কিন্তু নার্স নয়, আজ ওর সঙ্গে যে ভদ্রলোক তাঁর হাঁটার ভঙ্গিটি। সদর্পের। এই কি সেই সুনীতদা? মন বলল, না। আজ কী বার? নিশ্চয়ই ইনি তাপসের বাবা। কোনও কারণ নেই এটা বুঝতে পারছেন তবু জয়ন্তীর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। একবার ভাবলেন ভেতরে চলে যান। কিন্তু ওরা যে তাঁকে দেখে ফেলেছে, কারণ ভদ্রলোকের মুখ এদিকেই।


পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। কিন্তু তাপসের মুখ নামানো। ভদ্রলোক কথা বলছেন খুব কম। লম্বা, মেদহীন একটু পোড়খাওয়া চেহারা। জয়ন্তীর মনে হল, ইনি সেই রকম মানুষ যিনি নিজের। অনেক অভিজ্ঞতা সযত্নে চেপে রাখতে জানেন। তাপস বাংলোর কাছাকাছি এসে মুখ তুলল। তুলেই নামিয়ে নিল। ঠিক নীচে এসে ভদ্রলোক দাঁড়ালেন। তারপর সহাস্যে দু-হাত জড়ো করে বললেন, নমস্কার। আমি সুভাষ সেনগুপ্ত। এবার এসে আপনার নাম সবার মুখে শুনছি।

দুহাত যুক্ত করে নমস্কার ফিরিয়ে দিলেন জয়ন্তী। ওঁরা এখনও দাঁড়িয়ে অতএব অনিচ্ছে সত্বেও নীচে নেমে এলেন তিনি। গেট খুলে বাইরে এসে তাপসকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো?

নীরবে ঘাড় নাড়ল তাপস, ভালো। ছেলেটি বারংবার তাঁর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে কিন্তু। হাবভাবে কেমন একটা সন্ত্রস্ত ভাব। সুভাষ বললেন, ডাক্তার বললেন, আপনার সঙ্গে মেশার পর ওর স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিক উন্নতি হয়েছে। এজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

ছি-ছি, একি কথা বলছেন! সত্যি লজ্জিত হলেন জয়ন্তী।

কিন্তু কথাটা তো সত্যি। গত সপ্তাহে আমি ওকে নিয়ে এতটা আসব ভাবতেই পারিনি। কিন্তু শুনলাম আপনার সঙ্গে খোকা কালভার্ট অবধি গিয়েছিল। অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি ঘটনা। প্রতি সপ্তাহে ওকে ব্লাড দিতে হয়। আজ সকালে ডাক্তার অবাক হয়েছেন। ওঁর মনে হচ্ছে আরও কদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। এর একমাত্র কারণ ও আপনার সঙ্গে মেলামেশা করে একধরনের মানসিক আনন্দ পেয়েছে। আপনি জানেন নামি…।

জয়ন্তী রায়।

আপনি জানেন না জয়ন্তী দেবী, এতে আমি কী রকম স্বস্তি পেয়েছি।

আপনি বাড়িয়ে বলছেন।

সুভাষ হাসলেন, চলুন, একটু হাঁটা যাক।

জয়ন্তী আপত্তি করলেন না। দুপা হেঁটে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাপসকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার, তুমি আজ চুপচাপ কেন? তাপস মুখ ঘুরিয়ে নিল। জয়ন্তীর এটা ভালো লাগল না। খুব ধীরে হাঁটছে ওরা। সুভাষ বললেন, ও চিরকালই এরকম। ওর মা তো জন্ম দিয়েই মুক্তি নিলেন। ঝি-চাকরের হাতে মানুষ হওয়ায়। কারও সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়নি। তারপর গত কয়েকবছর ধরে তো এই বিপদ। কথাই বলতে চায় না। আর পাঁচটা ওই বয়সের ছেলের তুলনায় তাই মানসিক ডেভলপমেন্ট হয়নি।


না, একথা ঠিক নয়। তাপস আমার সঙ্গে অনেক কথা বলে। জয়ন্তী সস্নেহে তাপসের দিকে। তাকালেন। তাপস দৃষ্টি ফেরাল না।

কথা বলে? স্ট্রেঞ্জ। সত্যি ওর অনেক কিছু বদলে দিয়েছেন আপনি। আমি একা মানুষ হয়তো ঠিক ওর যত্ন নিতে পারি না। চাকরি বাঁচিয়ে ছুটে আসি প্রত্যেকবার ভয় নিয়ে, কী জানি কী দেখব। এবার এসে অবাক হলাম।

আপনি একটু বাড়িয়ে বলছেন! জয়ন্তীর চোখ ছিল তাপসের দিকে। ওর কপালে এই ঠান্ডায় গুঁড়ি-গুঁড়ি ঘাম। হঠাৎ মনে হল তাপসের যেন কষ্ট হচ্ছে। দ্রুত ওর হাত ধরলেন তিনি, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

কথা না বলে মুখ নামাল তাপস। জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে একটু বসে জিরিয়ে নেবে?

সবেগে মাথা নাড়ল তাপস, মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বের হল। ঘাড় শক্ত, জেদি ভঙ্গি। জয়ন্তী সুভাষকে বললেন, মনে হচ্ছে ওর শরীরটা ঠিক নেই।

সুভাষ কাছে এগিয়ে এলেন, কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?

আমি বাড়িতে যাব। তাপস যেন কোনওরকমে বলতে পারল।

ওরা কেউ আর কথা বলল না। ধীরে-ধীরে ফিরে চলল। নিজের বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে জয়ন্তী বললেন, আমি চলি।

সঙ্গে-সঙ্গে তাপস চোখ তুলে তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। সুভাষ বললেন, সেকি, এখনও তো বিকেল যায়নি। শুনেছি আমার ওখানে একবারও যাননি, আজ আসুন।

অনুরোধ এড়ানো সম্ভব হল না। তাছাড়া তাপসের জন্যও দুশ্চিন্তা ছিল। ছেলেটার আজ হঠাৎ এমন পরিবর্তন হল কেন?

বারান্দায় উঠেই জয়ন্তীর মনে হল অযত্ন শব্দটাকে কেউ চারপাশে সাজিয়ে রেখেছে এখানে। নার্স বেরিয়ে এসেছিল, সুভাষ বললেন, ওর শরীরটা ঠিক নেই। জামাকাপড় চেঞ্জ করিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও। ডাক্তার তো এখনি আসবেন। আর আমাদের কফি দিতে বলো।

জয়ন্তীর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাপসের কাছে কিছুক্ষণ বসেন। কিন্তু সুভাষের কথা বলার ধরনে সঙ্কোচ হল। বন্ধ জানলার সামনে বারান্দার চেয়ারে এসে বসলেন ওঁরা। সামনে পাতলা লাল হলুদ-গোলা রোদ। সুভাষ বললেন, আপনি দিল্লিতেই থাকেন? কোথায়?

পুসা রোডে।

ও। দিল্লিতে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছড়িয়ে। এখন তো আর যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি কোন কাগজে আছেন?

ডেইলি সান।

বেশ ভালো চাকরি আপনাদের।

ওই আর কি!

আমি এখন ওই ছেলের কাছে দায়বদ্ধ। ওর মা চলে গেছেন কতদিন হল, আর এ তো যাওয়ার মুখেই।

সুভাষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এই প্রথম এসে আমি স্বস্তি পেলাম। ওর মুখে এই প্রথম রক্ত দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। সত্যি, আপনি ওকে জীবন দিয়েছেন। আপনি না এলে খোকা বাঁচত না।

জয়ন্তী এইরকম কথায় খুব স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ভদ্রলোক যেন বারবার তাঁকে জড়াতে চাইছেন। যেটা ছিল তাঁর এবং তাপসের সহজ ব্যাপার সেটার ওপর একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যেন। হঠাৎ ডানদিকে চোখ ফেরাতেই আঁতকে উঠতে গিয়ে সামলে নিলেন জয়ন্তী। পেছনের জানলার কাছে একটা সাদা মুখ লেপ্টে ছিল এতক্ষণ। চোখ দুটো পাথরের মতো তার দিকে স্থির। তিনি তাকাতেই ছবিটা ভেঙে গেল। চট করে মুছে গেল জানলা থেকে। সুভাষ ওর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন। বললেন, কী হল?


জয়ন্তীর তখন বুকের মধ্যে দম আটকানো অনুভূতি। সেই চোখ দুটো যেন বসে যাচ্ছে গভীরে। কোনওক্রমে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমি যাই।

সে কি! কী হল আপনার? সুভাষ বিস্মিত।

কিছু না। আমি–। শরীরটা–। জয়ন্তী অনেক দিন পরে এমনভাবে কথা বললেন।

কিন্তু কফি হচ্ছে, কফি খেয়ে যান।

মাপ করবেন। আর একদিন হবে।

বুঝতে পারছেন এটা অভদ্রতা এবং এতদিনের শিক্ষা ও অভ্যাসে যা তিনি কখনও করেননি তাই আজ করলেন। সুভাষকে গেটে দাঁড় করিয়ে রেখেই দ্রুত ফিরে চললেন নিজের বাংলোয়। প্রতিবার তিনি পা ফেলছেন আর যেন মনে হচ্ছে আরও যদি দূরত্ব বাড়ানো যেত!

নিজের বিছানায় বেশ কিছুক্ষণ শোওয়ার পর বুক শান্ত হল। না, সত্যি আজ অন্যায় ব্যবহার হয়ে গেল। সুভাষবাবু যথেষ্ট ভদ্রতা করেছেন। অসুস্থ ছেলের বাবা হিসেবে ওঁর কথাবার্তা সঙ্গত। কিন্তু তাপসের চোখদুটো অমন জ্বলছিল কেন? কেন ও বেড়াতে বেড়িয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখছিল? কেন অমন চোরের মতো তাঁকে দেখছিল সে কাঁচের আড়াল থেকে। পঁচিশ বছর আগের সেই জেদি অভিমানী দৃষ্টিটাকে আজ নতুন করে দেখতে পেয়ে সব বেসামাল হয়ে গেল তাঁর। জয়ন্তী উঠে বসলেন। বাইরে এখন সন্ধের আঁধার। তির তির করে ঠান্ডার মেজাজ বাড়ছে। হঠাৎ জয়ন্তী সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল সকালের বাসেই তিনি ফিরে যাবেন, এখানে আর একদিনও নয়।


বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বলে দিয়েছেন খাওয়ার সময়। টাকাপয়সা মিটিয়ে দেবেন সকালে। সাতটায় নীচের বাজার থেকে প্রথম বাস ছাড়ে। আলো জ্বেলে বই পড়ার চেষ্টা করছেন, এমন সময় মেয়েলি গলা পাওয়া গেল। কেউ তাঁকে ডাকছে।

দরজা খুলেই নার্সটিকে দেখতে পেলেন, দিদি, ডাক্তারবাবু আপনাকে খবর দিতে বললেন। আপনি এক্ষুনি চলুন।

কেন, কী হয়েছে? হৃৎপিণ্ড বুঝি গলায় আটকে গেল।

খোকা খুব অসুস্থ।

আর দাঁড়ালেন না জয়ন্তী। আলনা থেকে একটা শাল টেনে নিয়ে ছুটলেন তিনি। প্রায় এক দৌড়েই তাপসের ঘরে পৌঁছে গিয়ে থমকে গেলেন জয়ন্তী। খাটের ওপর দুতিনটে কম্বল গায়ে। চাপিয়ে তাপস শুয়ে আছে। ডাক্তারের হাতের মুঠোয় ওর কজি। তাপসের চোখ বন্ধ। মুখ যেটুকু বেরিয়ে আছে তাতে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। মৃত্যু এবং জীবন এই মুহূর্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। সুভাষ ওর পায়ের কাছে বসে কাতর চোখে তাকালেন। ডাক্তার হাতটি নামিয়ে ওঁকে দেখলেন, যাক, আপনি এসে গেছেন! যতক্ষণ জ্ঞান ছিল ততক্ষণ আপনার নাম শুনতে হয়েছে আমাদের।

ধীরে-ধীরে ওর মাথায় পাশে এসে বসলেন জয়ন্তী। কাঁপা হাত ওর কপালে রাখতেই মনে হল বরফের স্পর্শ পেলেন, কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। সকালে দেখলাম খুব ইম্প্রভড। ইম্প্রভড সন্ধে থেকে এমন খারাপ হল কি। করে কে জানে! ব্লাড চেঞ্জ করতে হবে ইমিডিয়েটলি। আজকের রাত যদি কোনওমতে কেটে যায় তবেই ভালো। কাল সকালের আগে ওটা করা যাবে না। আমি আর একটা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি।


সুভাষ বললেন, হাঁটাচলায় কি–।

নো নো। মনে হচ্ছে মেন্টালি আপসেট। আপনারা কেউ কি ওকে কিছু বলেছেন?

না। দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ করলেন সুভাষ, এ কি কথা বলছেন? তারপরেই যেন কিছু মনে পড়ায় জয়ন্তীর দিকে তাকলেন।

এগারোটা বেজে গেল। এখন নিশিরাত। তাপসের দু-চোখ বন্ধ। অনিয়মিত নিশ্বাস পড়ছে। ডাক্তার উঠলেন, মনে হচ্ছে রাতটা শান্তিতেই কাটবে। আমি ভোরেই চলে আসছি। আপনি আর বসে কী করবেন? এখন ও ঘুমুক।

ধীরে-ধীরে চুল থেকে হাত সরিয়ে নিল। এতক্ষণ কি জয়ন্তী তাঁর মধ্যে ছিলেন? দ্রুত সামাল দিলেন নিজেকে। তারপর ডাক্তারের সঙ্গে ঘরের বাইরে আসার আগে আর একবার ঘুরে দাঁড়ালেন। তাপস নিস্পন্দ।

সুভাষ বেরিয়ে এলেন সঙ্গে। ডাক্তারের গাড়ি বেরিয়ে গেলে বললেন, চলুন, আমি আপনাকে এগিয়ে দিই।

জয়ন্তী ঘাড় নাড়লেন, না। আপনি বরং ওর কাছে থাকুন।

সুভাষ ইতস্তত করলেন, আমি বুঝতে পারছি না কেন এমন হল।

জয়ন্তী বললেন, কিছু হবে না। ও ঠিক ভালো হয়ে যাবে।

সুভাষ মুখ তুললেন, আপনাকে আমি আজই দেখলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি থাকলে আমার মন জোর পাবে।

চকিতে শক্ত হয়ে গেলেন জয়ন্তী। তারপর সুভাষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অন্ধকারে হেঁটে গেলেন। এখন এই শীতের কোনও অনুভূতি তাঁর আসছে না।

ঘুম আসছে না। জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেছে। জয়ন্তী চোখের পাতা বন্ধ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। বন্ধ করলেই সেই মুখ, যা কিনা পঁচিশ বছর আগে মিলিয়ে গিয়েছিল তা বেঁচে উঠে সেই চাহনি নিয়ে ফিরে আসছে। এখনও হাতের আঙুলে তাপসের কপালের হিমস্পর্শ, ছটফট করতে লাগলেন জয়ন্তী। ও কি মরে যাচ্ছে? ডুকরে একটা কান্না উঠে এল। কেন হয় এমন? কেন তিনি নিজেকে কপট করতে পারলেন না?

বন্ধ জানলার বাইরে অন্ধকার স্থির হয়ে আছে। আকাশের এক কোণে নবমীর চাঁদ মেঘে জড়ানো। একটু সরে আসতেই লাইটহাউসের মতো আলোটা চোখে পড়ল। ওটা যে সুভাষবাবুদের বাংলো এখন বুঝতে অসুবিধে নেই। আশেপাশের কোনও বাড়িতে আলো জ্বলছে না। সুভাষবাবুদের অন্য ঘরগুলোতেও আলো নেই। শুধু আলো জ্বলছে যেখানে সেখানে একটি শরীর কম্বলের তলায় স্থির হয়ে রয়েছে। শরীরের সব রক্ত দ্রুত মরে যাচ্ছে তার। এই দূরে একা। বসে জয়ন্তীর সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চোখ সরাচ্ছিলেন না জয়ন্তী, একটা চেয়ার টেনে বসে সেই আলোটিকে আঁকড়ে ধরলেন যেন।


এখন কত রাত জানা নেই। বসে থাকতে-থাকতে কখন ঘুম জুড়ে বসেছিল চোখে টের পাননি। শব্দটা কানে আসতেই চেতনা এল। ভারি কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। একবার হয়েই থেমে গেলেও জয়ন্তীর কানে লেগে রয়েছে। দূরের সেই আলোটা এখন অস্পষ্ট কুয়াশায় মাখামাখি। শব্দটা কোথায় হল? জয়ন্তীর মনে ভয় এল। তিনি চাপা গলায় বৃদ্ধাকে ডাকলেন। কোনও সাড়া এল না। চেয়ার ছেড়ে দরজার পাশের জানলার পরদা সরালেন। কুয়াশা বা হিমবাতাস জল জমিয়ে দিয়েছে জানলার কাঁচে। খানিকটা মুছে নিতেই বারান্দাটা নজরে এল। নবমীর চাঁদ বুঝি এখন মাথার ওপরে। তার ফিকে আলোয় ভীষণ মায়াবী মনে হচ্ছে চারধার। আর তারপরেই তাঁর চোখে পড়ল একটা সাদা নগ্ন হাত কাঠের সিঁড়ির মুখে বারান্দায় নেতিয়ে আছে। চিৎকার করে উঠলেন জয়ন্তী। অন্য কোনও ভাবনা এল না, পাগলের মতো ছুটে এলেন দরজা খুলে।

সিঁড়িতে অর্ধেক দেহ, অর্ধেকটা বারান্দায়, একটা হাত প্রসারিত, তাপস চেতনা হারিয়ে পড়ে আছে। গায়ে গরমজামা নেই। কম্বলের তলায় যে অবস্থায় শুয়েছিল সেই অবস্থায় পড়ে আছে এখানে। চাপা আর্তনাদ করে হাঁটু মুড়ে বসে জয়ন্তী ওকে জড়িয়ে ধরলেন। দু-হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আর একটা আর্ত চিৎকার তাঁর বুক নিংড়ে ছিটকে এল। সেই শব্দে চোখ খুলল তাপস। ঠোঁট নড়ল। কিছুকী বলছে ও? জয়ন্তী নিজের উত্তপ্ত মুখ ওর গলার কাছে নিয়ে কান পাতলেন ঠোঁটে। জড়ানো গলায় ঘড়ঘড়ে শব্দ কিন্তু স্পষ্ট যেন শুনতে পেলেন জয়ন্তী, তুমি আমার বন্ধু। শেষটা হয়ত কানে আসেনি, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন সবটা। নিজের উষ্ণ ঠোঁটে শীতল স্পর্শ লাগতেই উন্মাদিনী হয়ে গেলেন জয়ন্তী। হয়তো বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা কান্নাটা কিংবা তাপসের শরীরের শীতলতাকে দূর করতে চুম্বন করতে লাগলেন ওর গালে ঠোঁটে গলায়।


দুহাতের বাঁধনে তাপসের নিথর শরীর। একে টেনে নিয়ে ঘরে যাওয়া এখন সম্ভব নয়। জয়ন্তীর মাথায় কিছু এল না। পাগলের মতো চুম্বন করে যেতে লাগলেন ওই নিথর শরীরে। মুখ তুলতে তাঁর এখন ভীষণ ভয় করছিল। তাপসকে উত্তাপে ভরিয়ে দিতে নিজের শরীরকে নিংড়ে দিতে চাইছিলেন জয়ন্তী। ওই হিম নতুন করে সইবেন কী করে, এই চল্লিশ বছর বয়সে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *