জহির উৎসাহের সঙ্গে শুরু করল।
হয়েছে কী— রাত তখন দুটা, আমি আর শিবেন ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাকা। যাচ্ছি গড়িয়াহাটার দিকে। গড়িয়াহাটা জায়গাটা কোথায় বলি….
গড়িয়াহাটা জায়গা কোথায় বলতে হবে না। তুই গল্প শেষ কর। আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পাঞ্জাবি। শিখ। মাথায় পাগড়ি…।
মাথায় কী বলার দরকার নাই। শিখরা মাথায় পাগড়ি পরে সবাই জানে। গল্প শেষ কর।
ট্যাক্সি যাচ্ছে। আমার ঝিমুনির মত এসেছে। ঝিমুনির মত আসবে আবার কী ? তােরতাে ঝিমুনি লেগেই আছে।
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হার্ড ব্রেক। আমার ঘুম গেল ভেঙে। শিখ ড্রাইভার বলল, সে আর যাবে না।
মােবারক বলল, যাবে না মানে। মাঝপথে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেবে ? ইয়ারকি ? লাথি মেরে হারামজাদাকে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়া দরকার। তুই
কী করলি ?
আমি ভদ্রভাবে বললাম, ভাই কেন যাবেন না। সমস্যা কী ? বাংলায় বললি?
হিন্দিতেই বলেছি। ভুল হিন্দি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আবার ভুল হিন্দিটাই ভাল বুঝে। সব সময় ভুল হিন্দি শুনেতাে।
৪২
৪৩
পড়তে বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। বিল্পি মে কাট দিয়া।
পুলিশ টর্চ নিভিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ তার আধবুড়াে এক লােককে দেখা গেল। ভীত চেহারা। সে সঙ্গে মেয়ে নিয়ে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে। বজলু বলল, এই যে ওল্ড ব্রাদার, অন্য জায়গায় যান। এই জায়গাটা ভাল না। এই জায়গা বিল্লি মে কাট দিয়া।
হিন্দিটা কী? ভাইয়া! কেউ নাহি জায়েগি। প্রবলেম কিয়া হুয়া ? ড্রাইভার কী বলল । ড্রাইভার বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। কী বলল আবার বল। বলল বিল্লি মে কাট দিয়া।
এর মানে কী?
জহির রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, মানে হচ্ছে তার গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেছে। বিড়ালটা রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে গিয়েছে।
তাতে সমস্যা কী ?
সমস্যা আছে। শিখ ড্রাইভাররা বিশ্বাস করে গাড়ির সামনের রাস্তা যদি ‘বিল্লি মে কাট দেয় তাহলে মহাবিপদ। এ্যাকসিডেন্ট হবেই। তখন তারা কিছুতেই গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে চালাবে না। গাড়ি রাস্তার এক পাশে নিয়ে
অপেক্ষা করবে। অন্য কোনাে গাড়ি যদি পার হয় তাহলেই বিল্লি কাটার দোষ। কাটা যাবে।
বাক্যটা কী ? বিল্লি মে কাট দিয়া।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৮)
তিনজনই একসঙ্গে হাসতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা অতি বিচিত্র । কিছুক্ষণের জন্যে হাসি থামে, তখন একজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত হাসি শুরু হয়। সেই হাসি থামতেই আরেকজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। আবারাে হাসি শুরু হয় । হাসতে হাসতে এদের চোখে পানি এসে গেল। তাতেও হাসি থামে না।
সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে পুলিশ টহলে আসে রাত একটার দিকে। টহল মানে চাঁদা তােলা। নিশিকন্যাদের রােজগারের একটা অংশ পুলিশকে দিতে হয়। এদের সঙ্গে যে সব কাস্টমার থাকে, ধমক ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকেও কিছু আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে নেশারুদের এরা ঘটায় না।
হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে দু’জন টহল পুলিশ এগিয়ে এল। ওদের গায়ে টর্চের আলাে ফেলে বলল, কী হয়েছে ?
তিনজনই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে রাত অনেক হয়েছে। তিন বন্ধুই পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের গায়ে মােবারকের শাল। জহির ঘুমুচ্ছে। শান্তির গাঢ় ঘুম। জেগে আছে মােবারক এবং বজলু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলােয় কুয়াশা চকচক করছে। মােবারকের কাছে কুয়াশাটাকে মনে হচ্ছে হালকা শাদা পশমে বােনা বিশাল এক চাদর। কেউ একজন যেন পৃথিবীতে বিশাল এক চাদর পাঠিয়েছে। যে চাদর দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষকে ঢেকে দেয়া যায়।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৮)
মােবারক একটা হাত রাখল বজলুর গায়ে ।। বজলু বলল, কিছু বলবি?
মােবারক বলল, দোস্ত তােকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলেই চোর। এই শালটা আমি চুরি করে এনেছি।
বাদ দে।
দোস্ত বাদ দিব কেন? আমি চোর । বিরাট চোর। আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।
আহ্ বাদ দে না।
মােবারক কাঁদতে শুরু করল। জহির বলল, দোস্ত কাঁদিস না । কান্না থামা। তাের পায়ে ধরি কান্না থামা ।
মােবারক কাঁদছে। মােবারকের কান্না দেখে বজলুরও কান্না পেয়ে গেছে। সেও কাঁদছে। তাদের গায়ে গাঢ় হয়ে কুয়াশা পড়ছে। কান্না থামানাের জন্যে জহির একবার মােবারকের পায়ে ধরছে আরেকবার ধরছে বজলুর পায়ে।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৮)
আজ মােবারকের বসার জায়গা হয়েছে অন্য একটা ঘরে । প্রমােশন না ডিমােশন বােঝা যাচ্ছে না। এই ঘরটা আগেরটার চেয়ে বড়। তবে মেঝেতে কার্পেট নেই, দেয়ালে পেইনটিং নেই। সােফা আছে । সােফার কভার ময়লা। প্রথমবারের ঘরে মােবারক একা বসে ছিল। এই ঘরে আরাে লােকজন আছে। সবার মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা। মােবারক কিছুক্ষণ বসতেই বড় ট্রে ভর্তি চা নিয়ে একজন ঢুকল। সে সবাইকে চা দিচ্ছে। গণ-চা হয় খুব কুৎসিত হবে, আর নয়তাে খুব ভাল হবে। এই চা-টা ভাল। শুধু চা না, দেখা গেল আরেকজন প্লেট ভর্তি কেক নিয়ে এসেছে। কেকের প্লেট রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে। কেউ কেক নিচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভদ্রতা করছে। মােবারক উঠে গিয়ে দুই পিস নিয়ে নিল । একটা আপাতত জমা থাকুক চায়ের কাপের পিরিচে।
| কিছুক্ষণ পর পর ম্যানেজার সাহেব ঢুকছেন। একজন দু’জন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজার সাহেব আজ স্যুট পরেছেন। ভদ্রলােককে স্যুটে একেবারেই মানাচ্ছে না। টাই-এ ইস্ত্রী নেই বলে টাই এর মাথা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে টাইটা মাথা উচু করে আশে পাশে কি হচ্ছে দেখার চেস্টা করছে। কোনাে কারণে ম্যানেজার সাহেবের মনও মনে হয় খারাপ। তাঁকে মিয়াননা মুড়ির মত লাগছে।
ম্যানেজার সাহেব মােবারকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বােঝাই যাচ্ছে ডাক পড়েছে। এক পিস কেক এখনাে রয়ে গেছে, খাওয়া হয় নি। থাক ফিরে এসে খাওয়া যাবে।
মােবারক সাহেব কেমন আছেন? জ্বি ভাল। আসুন আমার সঙ্গে।
কোথায় যাব? বড় সাহেবের কাছে ? আপাতত আমার ঘরে। আপনি নিজে এলেন কেন ? কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠালেই হত।
ডেকে পাঠানাের লােক নেই। অফিস স্টাফের দুইজন আজ আসেই নি। একজন গেছে ছুটিতে।
| স্যার, আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি আপনার উপর চাপ বেশি পড়েছে। আপনার বিশ্রাম দরকার।
ম্যানেজার সাহেব এই গভীর আন্তরিকতায় অভিভূত হলেন না। বিষাদময় মুখ করে মােবারককে অফিসে নিয়ে গেলেন। মােবারককে তার সামনের চেয়ার বসতে বললেন।
মােবারক বলল, স্যার, ডাক্তারের রিপোের্ট কি এসেছে ? হ্যা এসেছে। রিপাের্ট পজেটিভ। আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায় ? হা যায়।
মােবারক সিগারেট ধরাল। ম্যানেজার সাহেব বললেন, ঝামেলা যখন ঘাড়ে এসে পড়ে একসঙ্গে আসে । আমার হয়েছ মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। কোন হেল্পিং হ্যান্ড নাই— অথচ আজকের মধ্যে আপনার পাসপাের্ট করাতে হবে। ভিসার জন্যে কাল পাসপাের্ট জমা দেব। কোথায় যাওয়া হবে সেটা নিয়ে ফ্যাকড়া বেঁধেছে।
কী ফ্যাকড়া ?
স্যারের বড় মেয়ের জামাই বলছে অপারেশনটা ইংল্যান্ডে করাতে কুইনস হসপিটাল। তার নাকি চেনা জানা আছে। এদিকে মেজো মেয়ের জামাই থাকেন সুইজারল্যান্ডে; তিনি সেখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
কোথায় যাওয়া হবে এখনাে ঠিক হয় নি ?
ঠিক হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে যাওয়া হবে। আসগর সাহেব এটা নিয়ে খুবই আপসেট। স্যারের সঙ্গে উনার যাবার কথা। উনি মনে হয় যাবেন না।
অজগর সাহেব কি উনার বড় মেয়ের জামাই ?
জ্বি । অজগর না-আসগর। চলুন উনার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেই।।
উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে?
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ-(পর্ব-৮)
আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। চলুন যাই।
বসুন এক কাপ চা খেয়ে যাই। সকালে বাসা থেকে যে বের হয়েছি এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে পারি নি। আপনি খাবেন ?
অবশ্যই খাব। আপনি একা একা চা খাবেন এটা হয় না। এক্সকিউজ মি স্যার আপনিও কি বড় সাহেবের সঙ্গে যাবেন ?
এখনও বুঝতে পারছি না। একবার ঠিক হচ্ছে যাব। একবার ঠিক হচ্ছে যাব না। টোটেল ‘কেওস‘।
আপনি গেলে খুব ভাল হয়। কেন?
আমিতাে আর কাউকে চিনি না। শুধু আপনাকেই চিনি। আপনাকে নিয়ে দেশটা ঘুরে ফিরে দেখতাম। শুনেছি সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনােহর।
ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। দ্রুত চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। | চলুন আসগর সাহবের কাছে নিয়ে যাই। দ্রলােক খুবই মুডি। উনি কী কথা বলেন, না বলেন শুধু শুনে যাবেন। কোনাে আগুমেন্টে যাবেন না।