জ্বি আচ্ছা।
আপনার ছবি তুলতে হবে। পাসপাের্টের জন্যেও ছবি লাগবে। ভিসার জন্যে ছবি লাগবে । গাড়ি দিয়ে দেব, ছবি তুলে নিয়ে আসবেন। পাসপাের্ট ফরমে সই করে যাবেন।
জি আচ্ছা ।।
আপনি বরং এক কাজ করুন স্যারের বাড়িতে আপনাকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জিনিসপত্র নিয়ে উঠে আসুন। কখন কোন প্রয়ােজন হয়। এ বাড়িতে থাকতে কোনাে অসুবিধা আছে ?
জ্বি না।
চলুন আসগর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি। কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। উনার মেজাজ আজ অত্যন্ত খারাপ।
চোখ তুলে তাকালেন। মােবারক দ্রলােককে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। উনি সেই মানুষ যিনি প্রথম দিন অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে মােবারককে জিজ্ঞেস করেছেন আনিস সাহেব কি চলে গেছেন।
এই মুহূর্তে ভদ্রলােক যে খুব রেগে আছেন তা মনে হল না। রাগ থাকলেও খবরের কাগজে ধর্ষণ জাতীয় খবর পড়ে মনে হয় রাগ পড়ে গেছে। ম্যানজোর সাহেব তার বিখ্যাত মিনমিনে গলায় বললেন, স্যার ইনিই মােবারক হােসেন ।
মােবারক হােসেনটা কে ? কিডনি ডােনার।
ও আচ্ছা আচ্ছা। আপনি বসুন। ম্যানেজার সাহেব আপনি চলে যান। আপনার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।
জ্বি আচ্ছা।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
আসগর সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ইদানীং লক্ষ করছি আপনি কুঁজো হয়ে হাঁটছেন ? Why? আপনার বাথরুমে আয়না আছে না?
জ্বি আছে । | দয়া করে একটু আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখুন— স্যুট পরা লােক যখন কুঁজো হয়ে থাকে তখন তাকে কেমন দেখায়। Please do that.
জ্বি আচ্ছা।
মােবারক লক্ষ করল ম্যানেজার সাহেব বারান্দা থেকে যাবার সময় সত্যি সত্যি কুঁজো হয়েই যাচ্ছেন। আগে কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন না। আসগর সাহেবের কথা শােনার পর থেকে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন।
আসগর সাহেব হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে বললেন, আপনি হলেন কিডনি ডােনার !
জ্বি স্যার।
ভেরি গুড। হিউমেন বডির দু‘টা কিডনির কোনাে প্রয়ােজন নেই। একটাই মাের দ্যান সাফিসিয়েন্ট। একটা কিডনিতে বাকি জীবন আপনি হেসে খেলে পার করতে পারবেন। আপনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না।
| মােবারক তার মুখ হাসি হাসি করে দেখাবার চেষ্টা করল যে সে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত না । তবে মনে মনে বলল, একটা কিডনিই যদি মানুষের জন্যে যথেষ্ট হয় তাহলে তুই তাের দু’টা থেকে একটা দিয়ে দিচ্ছিস না কেন? তুই
আসগর সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে বসে আছেন । তার সামনের ছােট্ট টি টেবিল ভর্তি রাজ্যের পত্রিকা। মােবারককে দেখে ভদ্রলােক
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
জামাই মানুষ। শ্বশুরের জীবন রক্ষার জন্য তুই কিছু করবি না ? তাের একটা দায়িত্ব আছে ? শশুরের সম্পত্তিতে তােরা জামাইরাই হাতাবি। এক কাজ কর–– তুই একটা কিডনি দে আর সুইজারল্যান্ডের জামাই দিক একটা । শ্বশুর পুরােপুরি ঠিক হয়ে যাক। | আসগর সাহেব বললেন, অপারেশন যেটা হবে সেটাও রুটিন অপারেশন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এত হচ্ছে যে ব্যাপারটা টনসিল তােলার মত সহজ হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগেও কোনাে ফরেন বডি শরীর এক্সসেপ্ট করত না। শরীরের Immune systems allow করত না। নতুন একটা ড্রাগ এই প্রবলেম একশ ভাগ সলভ করেছে । ড্রাগটার নাম,..।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
জ্ঞানগর্ভ আলােচনা হচ্ছে । ইচ্ছা থাকলেও এই জ্ঞানগর্ভ আলােচনায় অংশ গ্রহণ করা মােবারকের পক্ষে সম্ভব না। হাসি হাসি মুখে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।
অপারেশনটা সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে শুনেছেন বােধহয় ? জ্বি।
A very wrong decision. সুইসরা ঘড়ি বানানাে ছাড়া আর কিছু পারে না। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টতাে আর ঘড়ি বানানাে না। জটিল মেডিক্যাল প্রসিডিউর। ঠিক না ?
অবশ্যই ঠিক।
অপারেশন এমন হসপিটালে হওয়া উচিত যেখানে সকাল বিকাল এই অপারেশন হচ্ছে। যেমন ধরেন ব্যাংককের আমেরিকান হসপিটাল। কিংবা ইন্ডিয়ার মাদ্রাজ । আমার ফার্স্ট চয়েস ছিল মাদ্রাজ । অবশ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড কাস্ট্রিতে এ ধরনের অপারেশনের কিছু রিস্ক আছে। পােস্ট অপারেটিভ কেয়ারটা হয় না। যে কারণে আমি ইংল্যান্ডের কুইন’স হসপিটালের কথা বলেছিলাম।
স্যার আপনি খুব ভাল কথা বলেছেন। অতি ভাল সাজেশন।
আসগর সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, এ বাড়ির সমস্যা হচ্ছে— এই বাড়ির লােকজন ভাল কথা, ভাল সাজেশন বলে কিছু বিশ্বাস করে না। কেউ একটা ভাল সাজেশন দিলে এরা ইমিডিয়েটলি সেটা কমােডে ফেলে ফ্লাস করে দেবে। সেই আইডিয়া বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে চলে যাবে সিউয়ারেজে।
মােবারক মুখ হাসি হাসি করে রাখলেও মনে মনে বলল, ব্যাটা শুধু তাের
সাজেশনস না, তােকে শুদ্ধ কমােড়ে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেয়া দরকার। আমি এখানে বসার পর থেকে তুই সমানে কথা বলে যাচ্ছিস। তুইতাে কথা বলেই কুল পাস না। তুই সাজেশনস কখন দিবি ?
আসগর সাহেব মােটামুটি হতাশ গলায় বললেন, আমার একটা সাজেশন ছিল— দুজন ডােনার নিয়ে যাওয়া। যাতে একজন ডােনারের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে কোনাে কমপ্লিকেশন হলে অন্য একজন স্ট্যান্ডবাই থাকে। এমনতাে না যে ডােনার পাওয়া যাচ্ছে না বা টাকার অভাব হয়েছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি ।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
অবশ্যই না। স্যার আপনিও কি যাচ্ছেন?
আমাকেতাে যেতেই হবে । রুমা যেতে পারবে না। কারণ কুমার ছেলে স্কলাসটিকায় পড়ে। স্কুল থেকে ওরা একটা ড্রামা করছে ছেলে সেখানে সুযােগ পেয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের আলিভার টুইস্ট। আঠারাে তারিখে স্টেজ হবে । চিফ গেস্ট হলাে আমেরিকান এ্যাম্বেসেডর। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে বাবা–মা কেউ থাকবে না– তাতাে হয় না।
| মােবারক বলল, অবশ্যই হয় না। এতে শিশুমনের উপর একটা চাপ পড়ে। চাপের কারণে পরবর্তি সময়ে এইসব ছেলেপুলে গাধা টাইপ হয়ে। যায়। স্যার আমি উঠি ? আমার আবার পাসপাের্টের জন্যে ছবি তুলতে হবে।
আসগর সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, এখনাে পাসপাের্ট হয় নি? কুঁজো ম্যানেজারটা করছে কী ? একেতাে কানে ধরে উঠবােস করানাে দরকার।
মােবারক অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছে।
আসগর সাহেব জবাব না দিয়ে হাতে আরেকটা খবরের কাগজ তুলে নিলেন।
মােবারক পাসপাের্টের ফরমে সই করতে করতে বলল, সুইজারল্যান্ড জায়গাটিতে শীত কেমন পড়ে ?
ম্যানজোর সাহেব বললেন, ভাল শীত। বরফ পড়ে। সারা ইউরােপ থেকে লােকজন স্কী করতে সুইজারল্যান্ডে আসে।
শীতের কাপড় চোপড়তাে সঙ্গে নেয়া দরকার। ম্যানেজার সাহেব বললেন, হু।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
মােবারক চিন্তায় পড়ে গেল। হুঁ বলে চুপ কলে গেলেতাে হবে না। শীতের কাপড় কেনার টাকা পয়সা লাগবে না! গরম কাপড় ছাড়াওততা কিছু কাপড় দরকার। বিদেশ যাত্রা বলে কথা। মহাত্মা গান্ধী হলে নেংটি পরে প্লেনে উঠে পড়া যেত। সঙ্গে দড়ি বাঁধা দুর্বল ছাগী থাকলেও কেউ কিছু বলত না। ছাগীটাকে তার পাশের সীটে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করত। প্লেনের মধ্যেই ছাগলের দুধ দোয়ানাের ব্যবস্থা হত। এয়ার হােস্টেসরা হেল্প করতেন। | লজ্জা করে চুপ করে থাকা বিরাট বােকামি হবে। টাকা চেয়ে ফেলা দরকার। কাপড় চোপড়ের জন্যে আলাদা টাকা যদি না দেয় তাহলে বরং এই টাকাটা কিডনির দামের সঙ্গে এডজাস্ট করে দেবে। কিডনির দাম কখন দেবে সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। বড়লােকের কারবার– এরা জিনিস হাতে না পেয়ে দাম দেবে বলে মনে হয় না। খােদা না করুক অপারেশন টেবিলে সে যদি মারা যায় তাহলে কী হবে। টাকাটা পাবে কে? | মােবারক খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিচু গলায় বলল, ম্যানেজার সাহেব, কাপড় চোপড় কেনার জন্যে আমার কিছু টাকা দরকার।
ম্যানেজার মুখ তুলে তাকাল। মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে জীবনে শুনেনি।
মােবারক তেলতেলে মুখ করে বলল, হাতে তাে সময় বেশি নেই। কাপড় চোপড় এখনি কেনা দরকার।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
ম্যানেজার এখনাে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। মােবারক হাই তােলার ভঙ্গি করতে করতে বলল, বন্ধু বান্ধবের কাছে কিছু ধারদেনা আছে। যাওয়ার আগে শােধ করে যেতে চাই। কিছুতাে বলা যায় না, ধরেন উল্টা–পাল্টা কিছু যদি হয় ।
উল্টা–পাল্টা মানে ? আপনার স্যার কিডনি নিয়ে বেঁচে উঠলেন— আমি গেলাম ফুটে।
আপনি ফুটে গেলেন মানে? | ফুটে গেলাম মানে মরে গেলাম। ফুল ফোটা আর মানুষ ফোটা আলাদা ব্যাপার।
এখন আপনার কত টাকা দরকার।
মােবারক বিপদে পড়ে গেল। এটা একটা ঝামেলার প্রশ্ন। কত টাকা এরা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত তা না জেনে টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। এরা কত টাকা দিতে পারে সেটা জানারও তাে কোনাে বুদ্ধি নেই।
মােবারক ক্ষীণ গলায় বলল, সেটা আপনার বিবেচনা । আর গরম কাপড় চোপড়ে কত লাগে তাও জানি না। কাপড় বানানাে হয় না অনেক দিন।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি— নতুন গরম কাপড় কিনতে যাবেন না। বঙ্গবাজার চলে যান, সস্তায় প্রচুর ভাল কাপড় পাবেন। ফিটিং–এ সমস্যা হলে দরজি দিয়ে ফিটিং করিয়ে নেবেন। হাজার খানিক টাকায় সব কাপড় হয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা। আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে কিছু ঋণ ছিল । ঋণ রেখে মরতে চাই না।
রূপার পালঙ্ক-হুমায়ূন আহমেদ
মরবেন কেন ?
মােবারক বলল, দু’দিন থেকে মনের মধ্যে কুডাক শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। এই জন্যে ঠিক করেছি আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখাও করে যাব। আমার নিকট আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। দাদিজান বেঁচে আছেন। থাকেন নেত্রকোনায়। উনাকে দেখতে যেতে হবে। ভাবছি উনার জন্যে একটা শাড়ি, আর গরম চাদর নিয়ে যাব। বুড়ি খুশি হবে । ভাল একটা গরম চাদরের দাম কত হবে ম্যানেজার সাহেব জানেন ?
জানি না।
সস্তায় পুরনাে গরম চাদর অবশ্যই পাওয়া যাবে। পাওয়া গেলেও বুড়িকে নতুন চাদরই দিতে চাই। দাম যতই হােক। বুড়ির দিন শেষ। মরেইতাে যাবে । নতুন গরম চাদর গায়ে দিয়ে মরুক। মৃত্যুর সময় ঠাণ্ডা কম লাগবে। | ম্যানেজার সাহেব বললেন, কিছু ক্যাশ আমি দিচ্ছি। কেনাকাটা যা করার করুন। যে কাজগুলি আপনাকে করতে হবে তা হল— প্রথমেই বার কপি ছবি তুলবেন। পােলারয়েড ক্যামেরায় ছবি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে। আপনার সঙ্গে লােক দিয়ে দিচ্ছি, সে ছবি নিয়ে চলে যাবে। গাড়ি আপনার সঙ্গে থাকুক।
গাড়ি মানে ?
আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছা করলে সারাদিন গাড়ি রাখতে পারেন। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি এবং আপনার কাপড় চোপড় নিয়ে চলে আসবেন। এখানে আপনার জন্যে রুম রেডি করে রাখব। সুইজারল্যান্ড যাবার আগ পর্যন্ত আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।