রূপা পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

রূপা পর্ব – ৪

স্যার, আপনের শইল খুবই খারাপ করল। একজন ডাক্তার ডাইকা আনলাম। উনি আপনেরে হাসপাতালে ভর্তি করাইছে। আমি স্যার প্রত্যেক দিন আপনেরে দেখতে আসি। কাইলও আসছি। আপনার কি ইয়াদ আছে? এখানের এক ডাক্তার সাব বলেছেন আমি আমার পুলারে নিয়া রাতে থাকতে পারি। স্যার আমি কি থাকব? মুখে কথা বলতে না পারলে মাথা নাড়েন।

রাশেদ কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ল।স্যার, আপনার চিন্তা নাই, আমরা বাপ-বেটা আপনের সাথে আছি। উপরে আল্লাহ আর নিচে আমরা দুই বাপ-বেটা।রাশেদের খুব জানতে ইচ্ছা করছে লোকটা তার ছেলের নাম কিন্তু কেন রেখেছে। নিশ্চয়ই কারণ আছে। মানুষ কারণ ছাড়া কিছুই করে না। মানুষের জগত cause and effect এর জগত। কিন্তু নিয়ে শৈশবের একটা ছড়া মাথায় এসেছে

If যদি is হয়……………….But কিন্তু Not নয়……………..What মানে কি?………লোকটা হড়বড় করে কথাই বলছে।

মানুষ এত কথা বলে কেন।স্যার আপনার একটা চিকিৎসা আমি করব বলে ঠিক করেছি। কচি পান পাতার উপরে কালিজিরা তেল দিয়া সেই পান পাতা গরম কইরা আপনার পায়ের পাতায় ঘষব। সাথে সাথে বল পাইবেন। আধুনিক ডাক্তার এইসব চিকিৎসা জানে না। এইগুলো গেরাইম্যা চিকিৎসা। একটাই সমস্যা পান পাতা গরম করব কেমনে?

ঠাণ্ডা পান পাতা ঘষলে হিতে হবে বিপরীত। দেখি কি করা যায়। একবার যখন পান পাতা ঘষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন ঘষব ইনশাল্লাহ। স্যারের মাথা আস্তে কইরা টিপ্যা দেই? রাশেদ টের পেল তার কপালে হিমশীতল আঙুল। আঙুল কপালের উপর দিয়ে যাচ্ছে আর রাশেদের শরীর কেঁপে উঠছে। তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল, ঐ কেনতু বাপধন! স্যারের পায়ের আঙ্গুল আস্তে কইরা ফুটা।

স্যার আরাম পাই।ছেলেটার নাম তাহলে কেন। কিন্তু না। কেনতু শব্দটার মানে কি? মাথার কাছে সব সময় দুটা ডিকশনারি রাখা দরকার। একটা বাংলা একটা ইংরেজি। ভুল হয়ে গেছে। বিরাট ভুল। Life is a bundle of mistakes. এটা কার কথা? জীবন হচ্ছে এক বান্ডেল ভুলের… 1 Bandle শব্দটার বাংলা কি? ডিকশনারি খুবই প্রয়োজন।

বোমা ফাটার মতো শব্দ হচ্ছে কোথায়? ও আচ্ছা কেনতু নামের ছেলেটা, আঙুল ফুটাচ্ছে। আঙুল ফুটানোর এত শব্দ। আশ্চর্য।রাশেদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। চুরুটের গন্ধ আবার নাকে আসছে। শরীর গুলাচ্ছে।সামছু বলল, কেনতু বাপধন! স্যারের সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকতে পারবি?……….কেনতু বলল, হুঁ।

আমি বুদ্ধি পাইছি। ঘরে খবরের কাগজ জ্বালায় আগুন করব। সেই আগুনে পান গরম করব। আমি যাই, পান আর কালিজিরা তেলের জোগাড় দেখি।রাত এগারোটায় বাপ-ছেলেকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হল। সামছু হাসপাতালের দারোয়ানের চড়-থাপ্পড় খেলো। অপরাধ? বাপ-বেটা রুমে আগুন জ্বালিয়ে পান গরম করছিল।

ঘড়ি-কন্যা মদিনার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে হারুন তার বাল্যবন্ধু সুলতানকে খবর দিয়ে এনেছেন। তারা দুজন বসেছে গেস্টরুমে। রূপা। ঢুকল।ঘড়ি পরীক্ষায় সেও থাকবে। সুলতান পকেটে করে দুটা ঘড়ি এনেছেন। একটার সময় তিন ঘণ্টা বাড়ানো। অন্যটায় ঘণ্টার কাটা নেই, বন্ধ ঘড়ি। রূপা বলল, সুলতান চাচা আপনাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে।

সুলতান বললেন, আমি কি করেছি রে মা? আমি কি করেছি?………..রূপা বলল, আপনি প্রতিটি কথা দুবার করে বলেন। ভয়ংকর অস্বস্তিকর ব্যাপার।আর বলবনা রে মা। আর বলব না।রূপা বলল, অসহ্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনারা করুন। আমি ছাদে যাচ্ছি।হারুন বললেন, তোকে থাকতে হবে। তুই না থাকলে মেয়েটা ফ্রি ফিল করবে না। কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছে।এক শর্তে থাকব। সুলতান চাচা কোনো কথা দুবার বলতে পারবেন না।সুলতান বললেন, দুবার বলব না। বলব না। অবশ্যই বলব না।রূপা হতাশ গলায় বলল, এখন তত তিনবার করে বলছেন।হারুন বললেন, কথা বন্ধ। পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। মদিনা মদিনা।

মদিনা ঘরে ঢুকল। তার মুখ শুকনা। যে কোনো কারণেই হোক সে ভয় পেয়েছে। হারুন বললেন, মদিনা! আমার বন্ধু সুলতান সাহেবের পকেটে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়ির টাইম ঠিক নেই। অর্থাৎ এখন ১১টা বাজে। তার ঘড়িতে ১১টা বাজে না। তুমি বল তার ঘড়িতে কয়টা বাজে।মদিনা বলল, পারব না স্যার।হারুন বললেন, আমার পকেটে দুটা ঘড়ি আছে। একটা কালো বেল্টের আরেকটা মেটালিক বেল্টের কোনটায় কত বাজে।

মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, পারব না স্যার।পারবে না মানে? অবশ্যই পারবে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা কর তারপর বল।মদিনা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় থেকে চোখ মেলে বলল, পারব না স্যার।সুলতান বললেন, তুমি কোত্থেকে কি শুনেছ। মেয়ে ফ্রড। মেয়ে ফ্রউ। এই মেয়ে ফ্রউ।হারুন বললেন, মেয়েকে নিয়ে পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। পেপার কাটিং আমার কাছে আছে। দেখবে?

না। ফালতু নিউজ। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। ঠিক না।হারুনকে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে। তিনি আশাই করেন নি ঘটনা এ রকম ঘটবে। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, থাপড়ায়ে এই মেয়ের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার।রূপা বলল, শুধু শুধু চিৎকার করবে না বাবা। মেয়ে এমন কোনো অপরাধ করেনি যে থাপড়ায়ে তার দাঁত ফেলতে হবে। মদিনা! তুমি আমার ঘরে যাও কিছু হ্যান্ড মেড পেপার বাথটাবে ভেজাও। ছবি আঁকব।মদিনা বের হয়ে গেল। তার চোখভর্তি পানি। রূপা বলল, বাবা তুমি তো তাকে পরীক্ষা করেছ। তোমার ঘড়ির সময় ঠিক ঠিক বলেছে।

তাই না?……………হুঁ।রূপা বলল, আমার ধারণা তুমি কোনো পরীক্ষা নাও নি। পত্রিকায় খবর দেখে মদিনাকে নিয়ে চলে এসেছ। তোমার ঘড়ির টাইম বলে দিয়েছে এই গল্পটা তোমার বানানো।

খামাখা গল্প বানাবো কেন?……………….সেটা আমি কি করে বলব…………..বেশি জ্ঞানী হবার চেষ্টা করিস না। কাগের ঠ্যাং বগের ট্যাং ছবি আঁকছিস ছবি আঁক।

আমি মদিনা মেয়েটাকে কানে ধরে তার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমি সহজ চিজ না।কবে পাঠাবে? আজই পাঠাব। বদ মেয়েটাকে রেডি হতে বল। আমি মাইক্রোবাসে গ্যাস ভরে নিয়ে আসি। সুলতান যাবে নাকি আমার সাথে? সুলতান হাই তুলতে তুলতে বললেন, যেতে পারি। একা মানুষের এই সুবিধা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারি।

এখন তোর দুপা……………যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা…………….যখন হবে চার পা……………….ভাত কাপড় দিয়া যা,…………….যখন হবে ছয় পা………………বাবা! তুমি যাবা না।……………….ছড়া স্টপ কর। সত্যি যাবে?………………..অবশ্যই।

রাগে আমার শরীর চিড়বিড় করছে। এক কাজে দুই কাজ হবে। রথ দেখব, কলাও বেচব। পথে বগুড়ার কাছে একটা কুয়া আবিষ্কার হয়েছে তার কোন তল নেই।শুল নেই মানে? তল নেই মানে?…….হারুন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, মনে কর তুমি পাথরের বড় একটা চ্যাং কুয়াতে ফেললে। পাথরটা কোথাও না কোথাও হিট করবে। শব্দ হবে। সেটাই লজিক, কিন্তু এই কুয়ায় কিছু ফেললে শব্দ হয় না।বল কি? বল কি? দড়ি ফেলেও মাপার চেষ্টা করা হয়েছে।

দড়ি নেমেই যায় নেমেই যায়।সুলতান বললেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় ছাপা হবার মত নিউজ। ঠিকানা জান তো?……….খুঁজে বের করব।দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে দুজন মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মদিনাকে সঙ্গে নেবার কথা তাদের মনে রইল না।রূপা রাশেদের সুটকেস ঘাটছে। তার ঠিকানা যদি কোথাও পাওয়া যায়। বইপত্রের সঙ্গে একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে অনেক কিছু লেখা কিন্তু কোথাও ঠিকানা নেই। অন্যের ডায়েরি পড়ার প্রশ্নই উঠে না।

তারপরেও দুই লাইনের একটা লেখা রূপা পড়ে ফেলল। লেখাটা ইংরেজিতে। শিরোনাম suspicion………..My own suspicion is that the Universe is not only queerer than we suppose, but qucerer then we can suppose.

বাংলায় কি হবে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমরা যত অদ্ভুত মনে করি তার চেয়েও অদ্ভুত। অন্য কেউ এই ব্যাপারটা জানুক বা না জানুক, রূপা জানে। খুব ভাল করেই জানে।আফা একটা কথা বলব? রূপা তাকালো। তার সামনে মদিনা দাঁড়িয়ে, সে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে। মনে হয় পরীক্ষায় ফেল করে ভালই কান্নাকাটি করেছে। তার চোখ লাল।

রূপা বলল, বল কি বলবে?……….আমার উপরে রাগ হইয়েন না আফা।তুমি ঘড়ির সময় বলতে পার নি। এটাই তো স্বাভাবিক। ঘড়ি না দেখে আমরা কেউ সময় বলতে পারি না। খানিকটা অনুমান হয়ত করতে পারি। এর বেশি না।আফা অন্য একটা কথা বলব। আপনের পায়ে ধরি রাগ হইয়েন না।বল কি বলবে। রাগ হব না।মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, উনার অবস্থা ভাল না।রূপা বলল, কার অবস্থা ভাল না? মদিনা আঙ্গুল দিয়ে রূপার হাতের ডায়েরি দেখাল।

রূপা গম্ভীর গলায় বলল, আমি যার লেখা পড়ছি তার অবস্থা ভাল না?….মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, বোস আমার সামনে।মদিনা বসল। রূপা বলল, তোমার কথাবার্তা যথেষ্টই বিরক্তিকর। সুলতান চাচার চেয়েও বিরক্তিকর। তুমি এ বাড়িতে পা দিয়েই ভূত দেখে ফেললে। এখন আবার দেখছ একজনের অবস্থা ভাল না। বেশি বেশি দেখা ভাল না।

এখন থেকে কম কম দেখবে।মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।আমি একজন ভদ্রলোকের একটা খাতা হাতে নিয়েছি তাই দেখে তুমি তার শারীরিক অবস্থা বলে ফেললে? শারীরিক অবস্থা দেখার জন্যে মানুষের শরীর পরীক্ষা করতে হয়। তার জন্যে ডাক্তার আছেন।

তুমি কি ডাক্তার?………….না আফা।তোমাকে কিছু জ্ঞানের কথা বলি, মানুষ তার ক্ষমতার সবটাই অর্জন করে। জন্ম থেকে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নিয়ে কেউ আসে না। তুমি আর কখনো ভূত দেখা, অমুকের শরীর ভাল না, তমুক দুর্ঘটনায় মারা যাবে এইসব বলবে না।জী আচ্ছা বলব না।এখন সামনে থেকে যাও। তোমাকে দেখলেই রাগ লাগছে।মদিনা উঠে গেল।

হারুন অনেক ঝামেলা করে তলহীন কুয়া খুঁজে পেয়েছেন। বগুড়া জেলার ভেতর কাহালু রেল স্টেশন। রেল স্টেশনে মাইক্রোবাস রেখে রিকশায় গেছেন উত্তরে এগারো কিলোমিটার। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সাত কিলোমিটার। সুলতান বললেন, তোমার সঙ্গে বের হওয়া বিরাট বোকামি হয়েছে। তুমি বিপজ্জনক ব্যক্তি। অবশ্যই বিপজ্জনক ব্যক্তি।হারুন বললেন, আমার মেয়ে ঠিকই বলে তুমি বিরক্তিকর মানুষ। প্রতিটা কথা দুবার তিনবার বল।

তোমার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বিরাট ভুল করেছি। বিরাট ভুল করেছি। দেখো আমার পায়ের অবস্থা হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে। পা ফুলে গেছে।চুপ একটা কথা বলবে না। একটাও কথা বলবে না।সুলতান অবাক হয়ে বললেন, এখন তো তুমিও দুবার করে বলছ।হারুন চিৎকার করে উঠলেন, আমার সঙ্গে আসতে চাইলে আস। না আসতে চাইলে স্টেশনে ফিরে যাও।একা একা কীভাবে ফিরব? আমি তো পথ চিনব না। পথ চিনব না।

দুজন যখন তলহীন কুয়ার পাশে উপস্থিত হলেন তখন রাত দশটা। গ্রামের সবাই খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকাডাকির পর তলহীন কুয়ার মালিক বের হয়ে এলেন। মধ্যম বয়সের মানুষ। গালভর্তি শাদা দাড়ি। দাড়িতে মেহেদি দিয়েছেন। এখন মুখভর্তি লাল-শাদার সমারোহ।হারুন বললেন, জনাব আপনার নাম কি? আমি মেরাজ ফকির।তলহীন কুয়া আপনার? জী, এই কুয়ার আরেক নাম জিন্দা কুয়া।

সুলতান বললেন, কুয়া আবার জিন্দা মুর্দা হবে কীভাবে? ……মেরাজ ফকির বললেন, সবাই জিন্দা কুয়া বলে। কেন বলে জানি না।কুয়াটা দেখতে এসেছি।দেখতে এসেছেন দেখেন। একশ টাকা করে হাদিয়া। কুয়ার রক্ষণাবেক্ষণ আছে।হারুন বললেন, আমরা আপনার কুয়ার ছবি তুলব। একটা পাথর ফেলব। পাথর ফেললে শব্দ হয় না এটা যদি নিশ্চিত হই তাহলে আপনাকে দুশ টাকা দিব।

মেরাজ ফকির বললেন, কুয়া হাত দিয়া ছোঁয়া নিষেধ, ছবি ভোলা নিষেধ। কিছু ফেলাও নিষেধ। জিন্দা কুয়া, তারে ইজ্জত করতে হয়।সুলতান বললেন, আমরা দুজন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কিছু খাওয়াতে পারবেন। টাকা দিব।আমি হোটেল খুলি নাই। নিশি রাইতে অনেক ত্যাক্ত করেছেন, এখন ফিরত যান।ফেরার পথে হারুনের সঙ্গে সুলতানের বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে গেল।আমি যে কজন গাধা মানুষকে চিনি তোর সুলতান চাচা তাদের মধ্যে এক নম্বর। গাধা শ্রেষ্ঠ।

সুলতান চাচা মোটেই গাধা মানুষ না। ভাল মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ। কথা রিপিট করলেই মানুষ গাধা হয় না।চুপ করে ভাত খা। তোর জ্ঞানী কথা ভাল লাগছে না।চুপ করেই তো খাচ্ছি। কথা তুমি শুরু করেছ। তুমি একতরফা কথা বলবে আমি চুপ করে থাকব এটা তো ফেয়ার না।তোর সুলতান চাচাকে গাধা মানব প্রমাণ করে দেব। প্রমাণ করাব? কর।থাক। তোর সঙ্গে কোন কথা নেই। আমি নিঃশব্দে খাব।নিঃশব্দে তুমি খাচ্ছ না বাবা। কড়মড় করে শসা কামড়াচ্ছ। আমার উপরের রাগ শসার উপরে ঢালছ।

হারুন মেয়েকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেছেন। খাবার সময় হালকা গল্প-গুজব করতে তিনি পছন্দ করেন। রূপা বেশির ভাগ সময় আলোচনা হালকা পর্যায়ে রাখে না। কঠিন পর্যায়ে নিয়ে যায়। হারুনকে মেজাজ খারাপ করে আলোচনা শেষ করতে হয়।রূপা বলল, বাবা। তোমার ইতিহাস কাব্য কেমন চলছে? হারুন বললেন, তোর কথার মধ্যে ফাজলামী ভাব লক্ষ করছি। এটা আমার পছন্দ না।রূপা বলল, তাহলে ঐ প্রসঙ্গ থাক। অন্য প্রসঙ্গ।

তলাবিহীন কুয়া সম্পর্কে তো কিছুই বললে না। কুয়া পেয়েছিলে? হুঁ।সত্যি তলা নেই?…মস্ত বড় একটা পাথর ছুড়ে মেরেছিলাম। সেই পাথর পানিতে হিট করেছে এমন শব্দ পাই নি।রূপা বলল, মনে হয় কুয়ায় পানি নেই।হারুন বললেন, পানি না থাকলে মাটি তো থাকবে। মাটিতে পড়ার শব্দ হবে না? হয়ত নিচে মাটি নেই। নরম কাদামাটি। পাথর কাদামাটিতে শব্দ না করেই দেবে গেছে।হতে পারে।বাবা! তুমি মেজাজ খারাপ করে খচ্ছি। বদ হজম হবে। মেজাজ ঠিক কর।

আমি একটা থিওরি বের করেছি। শুনবে?……বল শুনি।আমার ধারণা এই পৃথিবীর প্রতিটি মানব সন্তানকে কোনো না কোনো Special gift দিয়ে পাঠানো হয়। বেশির ভাগ মানুষই তাদের এই গিফট সম্পর্কে জানে না। তোমার ঘড়ি বালিকা, ঘড়ি না দেখে সময় বলতে পারে। তার মতো আমিও হয়ত কিছু পারি। তুমিও পার। যদিও এখন কোনো কারণে পারছো না।হারুন কিছু বললেন না।

রূপা বলল, বাবা তুমি কি গিফট নিয়ে এসেছ বলে তোমার ধারণা?……আমি কোন গিফট নিয়ে আসিনি।অবশ্যই এসেছ। চিন্তা করে বল।হারুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কোনো কারণ ছাড়া মানুষকে বৈরী করার ক্ষমতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি। এটাই আমার Special Gift. উদাহরণ হল তোর মা। আমি এমন কি করেছি যে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল? তুই একটা কারণ দেখা সে কেন গেছে।

রূপা বলল, মানুষ হিসেবে তুমি খুবই Predictable. কোন কাজের পর তুমি কোন কাজ করবে তা আগে থেকে বলে দেয়া যায়। প্রেডিকটেবল মানুষ হল যন্ত্রের মতো। মেয়েরা যন্ত্র মানব পছন্দ করে না। মা এই জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং ভাল করেছে।হারুন বললেন, যার কাছে গেছে সে খুব আনপ্রেডিকটেবল? সে তো চশমা চোখে ছাগল ছাড়া কিছু না। ছাগলের সঙ্গে তার একটাই তফাৎছাগল ব্যা ব্যা করে আর সে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। যখন কথা বলে তখন মনে হয় জাবর কাটছে। ছাগলার ছাগলা।

রূপা বলল, বাবা তুমি উনার উপর শুধু শুধু রাগ করছ। উনি মাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যান নি। মা স্বেচ্ছায় গেছেন। রাগ করলে তুমি মার উপর রাগ করতে পার।ঐ ছাগলাটা তোর কাছে রসগোল্লা? রূপা বলল, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা ঠিক না, তবে উনি মানুষ ভাল। যথেষ্টই ভাল।

ছাগলাটার ভাল কি আছে যা আমার নেই?………..আলোচনাটা থাক না বাবা।থাকবে না। আমি শুনতে চাচ্ছি। তোর কাছে ছাগলাটা কীভাবে মহামানব হয়ে গেল।বাবা। তুমি প্রচণ্ড রেগে গেছ। আমি তোমার রাগ আর বাড়াব না। খাওয়া শেষ কর। মটরশুটি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল ক্লাসিক পর্যায়ের ভাল হয়েছে! তোর ক্লাসিক কৈ মাছের আমি গুষ্ঠি কিলাই। হারুন খাওয়া ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।রূপা হতাশ গলায় বলল, বাবা তুমি ছেলেমানুষ না। দুই মাস আগে আমরা তোমার ষাট বছর পূর্তির উৎসব করেছি। এই বয়সে তুমি যদি রাগ করে ভাত না খাও সেটা হবে খুবই হাস্যকর।

 

Read more

রূপা পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *