লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা ব্যক্তিগত পত্রটি সংযুক্ত হলাে। 

৫ আগস্ট, ২০০৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা 

শ্রদ্ধাভাজনেষু, 

আমার বিনীত সালাম গ্রহণ করুন। 

আপনি প্রচুর বইপত্র পড়েন—এই তথ্য আমার জানা আছে। নাটক-সিনেমা দেখার সুযােগ পান কি না জানি না। সুযােগ পেলে চ্যালেঞ্জার নামের একজন শক্তিমান অভিনেতার অভিনয় আপনার দেখার কথা ।লীলাবতীর মৃত্যুঅতি অল্প সময়ে সে অভিনয় দিয়ে দেশবাসীর হৃদয় হরণ করেছে। 

বর্তমানে সে মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার তার পরিবার আর নিতে পারছে না । 

আমি তার হয়ে আপনার কোমল মানবিক সত্তার কাছে আবেদন করছি। আপনার মঙ্গলময় হাত কি এই শক্তিমান অসহায় অভিনেতার দিকে প্রসারিত করা যায় ? 

বিনীত হুমায়ূন আহমেদ 

পাদটীকা 

How many loved your moments of glad grace And loved your beauty with love false or true, But one man loved the pilgrim soul in you, And loved the sorrows of your changing face. 

W.B. Yeats 

মানব এবং দানব 

বাঘের গর্ভে সব সময় বাঘ জন্মায়, সাপ জন্ম দেয় সাপের। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে মানুষের জন্ম দেয়, আবার দানবের জন্মও দেয়। দানবদের কর্মকাণ্ড দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি, কারণ এই দানবেরা বৃহৎ মানবগােষ্ঠীর অংশ, এরা ভিনগ্রহ থেকে আসে নি। 

পিলখানার খুব কাছাকাছি আমি থাকি। বুধবার সকাল থেকেই গুলির শব্দ শুনছিলাম। গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কিছু ছিল না। বিডিআর সপ্তাহ’ চলছে, তাদের কর্মকাণ্ড থাকতে পারে। অথচ তখন একে একে প্রাণ দিচ্ছিলেন নিরস্ত্র একদল অসহায় মানুষ। অস্ত্রধারী দানবদের ঠেকানাের কোনাে উপায় তাঁদের ছিল 

 মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের চিন্তা-চেতনায় ছিল তাদের শিশুসন্তান এবং পরিবার। আমরা চলে যাচ্ছি, দানবদের থাবা থেকে তারা রক্ষা পাবে তাে?’ 

পরম করুণাময়ের অসীম করুণায় জিম্মিদের প্রায় সবাইকে আমরা রক্ষা করতে পেরেছি। 

 এই উদ্ধার-প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব জাতি মনে রাখবে কি না আমি জানি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমৃত্যু মনে রাখব। তিনি যখন বজ্রকঠিন গলায় বললেন, কঠোর ব্যবস্থা নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না।’—তখনই তার কাঠিন্য দানবদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল। 

 টক শাের জমানায় চ্যানেলে নানান টক শাে চলছে। এদের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি অনেক আগেই মিলিটারি অ্যাকশনে যাওয়া উচিত ছিল। মিলিটারি দেখামাত্র ‘বিডিআর ছােকরারা অস্ত্র ফেলে দৌড় দেবে। 

যদি বিদ্রোহীরা তা না করত তখন কী হতাে? যে অস্ত্রধারী জানে, তার সামনে নিশ্চিত মৃত্যু, সে কী পরিমাণ ভয়ংকর হতে পারে—এই বিষয়ে কি টক শাে’র জেনারেল সাহেব জানেন? কতগুলাে নারী এবং শিশু তখন তাদের হাতে জিম্মি। 

যে-কোনাে মূল্যে এদের আমাদের রক্ষা করতে হবে এবং তা-ই করা হয়েছে। 

নানান দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে আমরা এগােচ্ছি বলে আমাদের হৃদয়ে কাঠিন্য চলে এসেছে। সহজে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হয় না। বিডিআরের এই ঘটনা পুরাে জাতিকে কাদিয়েছে। দানবেরা কি এই অশ্রুর মূল্য জানে ? 

সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি যখন বিডিআর গেট দিয়ে প্রথম ঢুকছে, তখন সাঁজোয়া গাড়ির চালক কাঁদছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমিও কাঁদছিলাম। 

পুলিশের আইজি নূর মােহাম্মদ সাহেবকে দেখেও আমার চোখ ভিজে উঠল । তিনি তাঁর মেয়েজামাইকে হারিয়েছেন। হৃদয়ে কপাট লাগিয়ে পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে শান্তমুখে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আহা রে! 

স্বজনহারারা যে-রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন তার নাম বীর উত্তম এম এ রব সড়ক। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীর উত্তম। দানবেরা তাদের ঐতিহ্য ভুলে গেছে ? বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ এবং বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ তাে তাদেরই পূর্বসূরি, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। 

স্বামীহারা কিছু মহিলার হতাশ ছবি টিভিতে দেখলাম। তারা বলছেন, এখন আমাদের সন্তানদের কীভাবে মানুষ করব? ঠিক তাঁদের মতােই একদিন আমার মা-ও কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমি আমার ছয়টা ছেলেমেয়েকে কীভাবে মানুষ করব ? তখন তাঁর পাশে কেউ ছিল না। পরম করুণাময় আমার মা এবং তার সন্তানদের ওপর করুণাধারা বর্ষণ করেছেন। 

 যেসব স্বামীহারা মা আজ সন্তানদের চিন্তায় অস্থির হচ্ছেন তাদের বলছি, আপনাদের পেছনে পুরাে জাতি আছে। পরম করুণাময়ের করুণাধারার বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। 

আমার খুব ইচ্ছা করছে পিতাহারা সন্তানদের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করি । তাদের পিঠে হাত রেখে বলি—এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। এই দিনেরে নিবে তােমরা সেই দিনের কাছে। 

উন্মাদ-কথা 

সন্তানদের নাম সাধারণত বাবা-মা কিংবা অন্য গুরুজনরা রাখেন। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই আহসান হাবীবের নাম আমার রাখা। বাবা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের জন্যে নাম খুঁজছিলেন। আমার এক বন্ধুর নাম আহসান হাবীব। দুর্দান্ত ভালাে ছেলে (এখন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্সের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট তবলাবাদক। বাঙালিদের গানের অনুষ্ঠান তার তবলাবাদন না হলে জমে না।) আমি বাবাকে বললাম, আহসান হাবীব নামটা কি রাখবেন ? আমার বন্ধু এবং খুব ভালাে ছেলে। 

 বাবা তাঁর নিউমরােলজির বইপত্র খুললেন। হিসাবনিকাশ করে বললেন, নিউমরােলজিতে ভালাে আসছে। আহসান হাবীব নামের জাতকের জীবন শুভ হবে। এই নামই রাখা হলাে। খাসি জবেহ করে আকিকা করা হলাে না। বাবার সেই সামর্থ্য ছিল না। অনেক বছর পর যখন আমার সামান্য টাকাপয়সা হলাে তখন আমি যেসব ভাইবােনের আকিকা করা হয় নি তাদের নামে আকিকার ব্যবস্থা করলাম। এই ঘটনায় আমার মা পরম সন্তোষ লাভ করলেন। 

ছােট ভাইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সে ছিল অতি রূপবান এক বালক। গায়ের রঙ দুধে-আলতা টাইপ। শৈশবে তার হজকিনস ডিজিজ’ হয়েছিল। তাকে কঠিন চিকিৎসার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল বলেই হয়তাে রঙের এমন পরিবর্তন। 

 প্রিয় পাক, শৈশবে আমার গায়ের রঙও নাকি দুধে-আলতা টাইপ ছিল। (আমার মায়ের ভাষ্য।) একবার কঠিন রক্ত-আমাশা হলাে। আমার গায়ের রঙ হয়ে গেল শ্রীলংকানদের মতাে। ছােটবেলায় আমার গায়ের রঙ কী ছিল আমার মনে নেই, তবে আমার মা যে কালাে ছিলেন সেটা মনে আছে। মা’র কাছে শুনেছি, বাবা একটা কালাে মেয়ে বিয়ে করে এনেছেন, এই নিয়ে দাদার বাড়িতে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে। মা’কে আড়ালে চোখের পানি ফেলতে হয়েছে। সেই কালাে মহিলাকে এখন দেখলে চমকাতে হয়। ধবধবে সাদা রঙ। এই মহিলা নিজের দুই পুত্রকে কালাে বানিয়ে নিতে কীভাবে গৌরবর্ণ ধারণ করলেন কে জানে! জগৎ রহস্যময়। 

 রঙ-প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। আহসান হাবীব প্রসঙ্গে আসি। সে ছিল বাবার অতি প্রিয়পুত্র। দুটি কারণে প্রিয়। 

১. মজার মজার গল্প বলত। তার গল্প শুনে বাবা হাে হাে করে হাসতেন। 

বেচারাকে একই গল্প প্রতিদিন তিন-চারবার করে শােনাতে হতাে। ২.তার গলায় সুর ছিল। যে-কোনাে গান একবার শুনলেই নির্ভুল সুরে 

গাইতে পারত। আহসান হাবীব প্রথম গুণটি নিয়ে এখন জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। উন্মাদ পত্রিকা, রম্য লেখা, জোকসের বই। প্রতি বইমেলাতে তার জোকসের বই বের করা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেছে। 

তার দ্বিতীয় গুণটি বিকশিত হয় নি। সে কাউকে গান গেয়ে শুনিয়েছে এমন শােনা যায় নি। গান গাওয়ার প্রতিভা বিকশিত হলে এখন হয়তাে তার কয়েকটি গানের ক্যাসেট থাকত। উন্মাদের বিশেষ সংখ্যার সঙ্গে একটা শ্যাম্পুর মিনি প্যাক, কফির মিনি প্যাক এবং আহসান হাবীবের গানের CD ফ্রি দেওয়া হতাে। 

সে মােটামুটি রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিগ্রাফিতে M.Sc. করল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামীণ ব্যাংকে ভালাে চাকরি পেল। চাকরি ঢাকার বাইরে। সাত দিনের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় উপস্থিত। মাকে বলল, সকালবেলায় নাশতার সমস্যা, এইজন্যে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে চলে এসেছি। 

মার কাছে মনে হলাে চাকরি ছাড়ার কারণ ঠিকই আছে। যেখানে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, সেই চাকরি করার দরকার কী ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *