তখন মধ্যাহ্ন।
আকাশে গনগনে সূর্য। পায়ের নিচের বালি তেতে আছে। ঘাসের তৈরি ভারী স্যান্ডেল ভেদ করে উত্তাপ পায়ে লাগছে। তাঁবুর ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্যে সময়টা ভালাে না। আউজ তাঁবু থেকে বের হয়েছে। তাকে অস্থির লাগছে। তার ডান হাতে চারটা খেজুর। সে খেজুর হাতবদল করছে। কখনাে ডান হাতে কখনাে বাম হাতে।
আউজ মনের অস্থিরতা কমানাের জন্যে দেবতা হাবলকে স্মরণ করল। হাবল কাবা শরিফে রাখা এক দেবতা—যার চেহারা মানুষের মতাে। একটা হাত ভেঙে গিয়েছিল বলে কাবা ঘরের রক্ষক কোরো সেই হাত সােনা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। দেবতা হাবলের কথা মনে হলেই সােনার তৈরি হাত চোখে চকমক করে।
দেবতা হাবলকে স্মরণ করায় তার লাভ হলাে। মনের অস্থিরতা কিছুটা কমল। সে ডাকল, শামা শামা। তাঁবুর ভেতর থেকে শামা বের হয়ে এল। শামা আউজের একমাত্র কন্যা। বয়স ছয়। তার মুখ গােলাকার। চুল তামাটে। মেয়েটি তার বাবাকে অসম্ভব পছন্দ করে। বাবা একবার তার নাম ধরে ডাকলেই সে ঝাঁপ দিয়ে এসে তার বাবার গায়ে পড়বে। শামার মা অনেক বকাঝকা করেও মেয়ের
এই অভ্যাস দূর করতে পারেন নি।
আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হলাে না। শামা এসে ঝাঁপ দিয়ে বাবার গায়ে পড়ল। সে হাঁটতে পারছে না। তার বাঁ পায়ে খেজুরের কাঁটা ফুটেছে। পা ফুলে আছে। রাতে সামান্য জ্বরও এসেছে।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ
শামা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাবার কাছে আসতেই তার বাবা এক হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল। এক হাতে বিচিত্র ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। শামা খিলখিল করে হাসছে। তার বাবা যেভাবে তাকে কোলে তােলেন অন্য কোনাে বাবা তা পারেন না।
আউজ বলল, মা; খেজুর খাও।
শামা একটা খেজুর মুখে নিল। সাধারণ খেজুর এটা না। যেমন মিষ্টি স্বাদ তেমনই গন্ধ। এই খেজুরের নাম মরিয়ম।
আউজ মেয়েকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। রওনা হয়েছে উত্তর দিকে। শামার খুব মজা লাগছে। কাজকর্ম না থাকলে বাবা তাকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বের হন। তবে এমন কড়া রােদে কখনাে না। আউজ বলল, রােদে কষ্ট হচ্ছেরে মা ?
শামা বলল, না। তার কষ্ট হচ্ছিল। সে না বলল শুধু বাবাকে খুশি করার জন্যে। বাবা!
আমরা কোথায় যাচ্ছি ? তােমাকে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখাব। সেটা কী ? আগে বললে তাে মজা থাকবে না। তাও ঠিক। বাবা, অদ্ভুত জিনিসটা শুধু আমি একা দেখব? আমার মা দেখবে ?
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ
বড়রা এই জিনিস দেখে মজা পায় না। আউজ মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাল। সে সামান্য ক্লান্ত। তার কাছে আজ
শামাকে অন্যদিনের চেয়েও ভারী লাগছে। পিতা এবং কন্যা একটা গর্তের পাশে এসে দাঁড়াল। কুয়ার মতাে গর্ত, তবে তত গভীর না।
আউজ বলল, অদ্ভুত জিনিসটা এই গর্তের ভেতরে আছে। দেখাে ভালাে করে। শামা আগ্রহ এবং উত্তেজিত হয়ে দেখছে। আউজ মেয়ের পিঠে হাত রাখল। তার ইচ্ছা করছে না মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলতে। কিন্তু তাকে ফেলতে হবে। তাদের গােত্র বনি হাকসা আরবের অতি উচ্চ গােত্রের একটি । এই গােত্র মেয়েশিশু রাখে না। তাদের গােত্রের মেয়েদের অন্য গােত্রের পুরুষ বিবাহ করবে ? এত অসম্মান ?
ছােট্ট শামা বলল, বাবা, কিছু তাে দেখি না।
আউজ চোখ বন্ধ করে দেবতা হাবলের কাছে মানসিক শক্তির প্রার্থনা করে শামার পিঠে ধাক্কা দিল।
মেয়েটা বাবা’ ‘বাবা’ করে চিৎকার করছে। তার চিৎকারের শব্দ মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আউজকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। গর্তে বালি ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না।
শামা ছােট্ট হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে, বাবা, ভয় পাচ্ছি। আমি ভয় পাচ্ছি।
আউজ পা দিয়ে বালির একটা স্থূপ ফেলল। শামা আতঙ্কিত গলায় ডাকল, মা! মা গাে!
তখন আউজ মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, উঠে আসাে।
আউজ মাথা নিচু করে তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে। তার মাথায় পা ঝুলিয়ে আতঙ্কিত মুখ করে ছােট্ট শামা বসে আছে। আউজ জানে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। গােত্রের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তাকে অবশ্যই গােত্র থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এই অকরুণ মরুভূমিতে সে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে হলে তাকে গােত্রের সাহায্য নিতেই হবে। গােত্র টিকে থাকলে সে টিকবে ।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ
বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্যে গােত্রকে সাহায্য করতেই হবে। গােত্র বড় করতে হবে। পুরুষশিশুরা গােত্রকে বড় করবে। একসময় যুদ্ধ করবে। মেয়েশিশুরা কিছুই করবে না। গােত্রের জন্যে অসম্মান নিয়ে আসবে। তাদের নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাওয়াও কষ্টকর।
আউজ আবার গর্তের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ছােট্ট শামা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। মরুভূমিতে দিকচিহ্ন বলে কিছু নেই। সবই এক।
আজ থেকে সতেরাে শ’ বছর আগে আরব পেনিসুয়েলার এটি অতি সাধারণ একটি চিত্র। রুক্ষ কঠিন মরুভূমির অতি সাধারণ নাটকীয়তাবিহীন ঘটনা। যেখানে বেঁচে থাকাই অসম্ভব ব্যাপার সেখানে মৃত্যু অতি তুচ্ছ বিষয়।
আরব পেনিসুয়েলা। বিশাল মরুভূমি। যেন আফ্রিকার সাহারা। পশ্চিমে লােহিত সাগর, উত্তরে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পার্শিয়ান গালফ। দক্ষিণে প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ার নগ্ন পর্বতমালা । সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। এখানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বলে কিছু নেই, সারা বত্সরই মরুর আবহাওয়া। দিনে প্রখর সূর্যের উত্তাপ সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। সারা দিন ধরে বইছে মরুর শুষ্ক হাওয়া। হাওয়ার সঙ্গে উড়ে আসছে তীক্ষ্ণ বালুকণা। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই।
লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ
পানি নেই। তারপরেও দক্ষিণের পর্বতমালায় বৃষ্টির কিছু পানি কীভাবে কীভাবে চলে আসে মরুভূমিতে । হঠাৎ খানিকটা অঞ্চল সবুজ হয়ে ওঠে। বালি খুঁড়লে কাদা মেশানাে পানি পাওয়া যায়। তৃষ্ণার্ত বেদুইনের দল ছুটে যায় সেখানে। তাদের উটগুলির চোখ চকচক করে ওঠে। তারা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কাঁটাভর্তি গুল্ম চিবায়। তাদের ঠোট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। তারা নির্বিকার। মরুর জীবন তাদের কাছেও কঠিন। অতি দ্রুত পানি শেষ হয়। কাটাভর্তি গুল্ম
শেষ হয়। বেদুইনের দলকে আবারও পানির সন্ধানে বের হতে হয়। তাদের থেমে থাকার উপায় নেই। সব সময় ছুটতে হবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। কোথায় আছে পানি ? কোথায় আছে সামান্য সবুজের রেখা? ক্লান্ত উটের শ্রেণী তাদেরকে মরুভূমির একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে চলে।
মাঝেই যুদ্ধ। এক গােত্রের সঙ্গে আরেক গােত্রের হামলা। পরিচিত গােত্রের পুরুষদের হত্যা করা । রূপবতী মেয়েদের দখল নিয়ে নেওয়া । রূপবতীরা সম্পদের মতে, তাদের বেচাকেনা করা যায়।
প্রতিটি গােত্র নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা মালামাল নিয়ে সিরিয়া বা ইয়ামেন থেকে যখন আসা-যাওয়া করে তখন তাদের ওপরও ঝাপিয়ে পড়তে হয়। মালামাল লুট করতে হয়। বেঁচে থাকতে হবে। সারভাইবেল ফর দ্য ফিটেস্ট। ভয়ঙ্কর এই মরুভূমিতে যে ফিট সে-ই টিকে থাকবে। তাদের কাছে জীবন মানে বেঁচে থাকার ক্লান্তিহীন যুদ্ধ।