লীলাবতীর মৃত্যু -পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ

ভাের ন’টায় এনজিওগ্রাম শুরু হলাে। ডাক্তার একজন অল্পবয়েসী তরুণী। আমেরিকান না, ভারতীয় তরুণী। সে কিছু-একটা গণ্ডগােল করল । ধমনী ফেটে রক্ত ছিটকে বের হয়ে আমার সামনের মনিটরে পড়ল। ডাক্তারের চোখেমুখেও পড়ল।লীলাবতীর মৃত্যু

আমি ইংরেজিতে জানতে চাইলাম, কোনাে সমস্যা কি হয়েছে ? 

তরুণী বলল, Stay calm, অর্থাৎ শান্ত থাকো । 

আমাকে শান্ত থাকতে বলে সে যথেষ্টই অশান্ত হয়ে পড়ল। একটা পর্যায়ে তাকে সাহায্য করার জন্যে অন্য ডাক্তার চেয়ে পাঠাল। আমি মনে মনে বললাম, ডিসকাউন্টের প্রার্থনা নেওয়াই মনে হয় উচিত ছিল। 

গল্প-৩ স্থান : মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল। সিঙ্গাপুর। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চতুর্থবারের মতাে আমার এনজিওগ্রাম করা হয়েছে। রাতটা হাসপাতালের কেবিনে কাটাতে হবে। পরদিন ছুটি। খরচ কমানাের জন্যে সিঙ্গেল কেবিন না নিয়ে ডাবল কেবিন নিয়েছি। আমার পাশে আরেকজন অতি বৃদ্ধ চায়নিজ রােগী। দু’জনের মাঝখানে পর্দা আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি বৃদ্ধ রােগীকে দেখতে পাচ্ছি। 

রােগীর অবস্থা শােচনীয়। তার মুখে বেলুনের মতাে কী যেন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বেলুন ফুলছে এবং সংকুচিত হচ্ছে। অনেকটা ব্যাঙের গলার ফুলকার মতাে। রােগী ঘড়ঘড় শব্দ করছে। ভয়ঙ্কর রকম আহত জন্তু হয়তােবা এরকম শব্দ করে ।। 

রােগীকে দেখার জন্যে একের পর এক তার আত্মীয়স্বজন আসছে। কিছুক্ষণ কেঁদে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অনেককে দেখলাম রােগীর বালিশের নিচে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে আসছে। বাবা-মা বাচ্চাদের উঁচু করে রােগীকে দেখাচ্ছে। অনেকটা শেষ দেখার মতাে। 

কুমিরের বাচ্চার মতাে দেখানাে শেষ হওয়ামাত্র বাচ্চাগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার দিকে। এরা শুরু করে কিচিরমিচির। কেউ কেউ চেষ্টা করে আমার বিছানায় উঠতে । 

একসময় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা এসে বিনয়ে নিচু হয়ে আমাকে জানাল, তার দাদা মারা যাচ্ছেন বলে সবাই দেখতে আসছে। আমাকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে তাদের লজ্জার সীমা নেই। আমি যেন ক্ষমা করে দেই। 

রাত দশটায় নার্স আমার জন্যে ওষুধ নিয়ে এল । আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই বৃদ্ধের কী হয়েছে ? 

নার্স বলল, বার্ধক্য ব্যাধি। 

অবস্থা কি খারাপ? যথেষ্টই খারাপ। ঘটনা রাতেই ঘটবে। 

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেউ রাতে মারা গেলে তার ডেডবডি কি তােমরা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাও, না পরে নাও ? 

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হয়। 

আমি বললাম, আমি মৃত মানুষ পাশে নিয়ে কখনাে শুয়ে থাকি নি। আমাকে কি অন্য একটা কেবিনে দেওয়া যাবে? 

নার্স বলল, অবশ্যই যাবে। তুমি ওষুধ খাও, আমি ব্যবস্থা করছি। 

আমি ওষুধ খেলাম। নিশ্চয়ই কড়া কোনাে ঘুমের ওষুধ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল ভােরবেলা। আমি আমার নিজের কেবিনেই আছি। পর্দার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোনাে শব্দও নেই। সুনসান নীরবতা। ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটে গেছে। 

আমি অতি কষ্টে বিছানা থেকে নামলাম। উঁকি দিলাম পাশের বিছানায়। বৃদ্ধ হেলান দিয়ে আধশােয়া হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধের মুখ হাসিহাসি। সে চামচ দিয়ে স্যুপ খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, গুড মর্নিং । 

আমি বললাম, গুড মর্নিং। 

বৃদ্ধ হাত ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকল। বিড়বিড় করে চায়নিজ ভাষায় কী যেন বলল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বালিশের নিচে হাত দিয়ে এক শ’ সিঙ্গাপুর ডলারের একটা নােট আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, টেক টেক টেক। মনে হয় জীবন ফিরে পেয়ে সে মহা আনন্দিত। এই আনন্দের খানিকটা ভাগ আমাকে দিতে চায়। (পাঠকদের কী ধারণা—আমি কি বৃদ্ধের উপহার নিয়েছি, নাকি নেই নি ? কুইজ ।) 

পাদটীকা-১ এইবার ইউরােপের অতি উন্নত একটি দেশের অদ্ভুত চিকিৎসার গল্প। দেশটির নাম সুইডেন। সেই দেশে বাঙালি এক মহিলা দাঁতের সমস্যা নিয়ে গেছেন। দাঁতের ডাক্তার পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, দাঁতের গােড়ায় ভয়ঙ্কর এক জীবাণু পাওয়া গেছে। এই জীবাণু হার্টে চলে যাওয়া মানে হার্ট ফেইলিউর। তিনি ব্যবস্থা দিলেন রােগীর সব দাঁত জরুরি ব্যবস্থায় তুলে ফেলতে হবে। মহিলা শুরু করলেন কান্না। মহিলার মেয়ে একজন ডাক্তার। সে মাকে বলল, মা, তােমার চিকিৎসা হচ্ছে সুইডেনে, এত ভালাে চিকিৎসা কোথাও হবে 

 দাঁত ফেলতে বলছে, ফেলে দাও। | বেচারির সব সুস্থ দাঁত টেনে তুলে ফেলে দেওয়া হলাে। তাকে ভর্তি করা হলাে ভয়ঙ্কর জীবাণুর চিকিৎসা যে হাসপাতালে হয় সেখানে। ডাক্তাররা ভয়ঙ্কর জীবাণুর সন্ধানে লেগে গেলেন। একসময় ঘােষণা করলেন, এই জীবাণুর কোনাে অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। ভুল হয়েছে। ভুলের কারণেই সব দাঁত ফেলা হয়েছে। তারা দুঃখিত। 

ভদ্রমহিলা হচ্ছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মা। তসলিমা নাসরিন মা’কে চিকিৎসা করাতে সুইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। 

পাদটীকা-২ আমি কখনােই মনে করি না মানুষ এমন কোনাে অপরাধ করতে পারে যার শাস্তি তার কাছ থেকে দেশ কেড়ে নেওয়া। 

মানুষ মানুষকে ত্যাগ করে। দেশ কখনাে তার সন্তানকে ত্যাগ করে না। যারা তসলিমা নাসরিনের রচনা পছন্দ করেন না তারা পড়বেন না। তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তার বিভ্রান্তি নিয়ে, আমরা কেন তাকে দেশছাড়া করব ? কেন বাংলাদেশের একটা মেয়ে ভবঘুরের মতাে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরবে ? ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধাপরাধী তাে ঠিকই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তাে তাদের দেশান্তরী করি নি। 

চ্যালেঞ্জার 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *