রাবেয়া হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। রুনু এসে ঢুকল খুব ব্যস্তভাবে, হাতে একটা লুডুবাের্ড। কিরে রুন? ‘কিটকি আপার কী হয়েছে? ‘কেন?’ ‘চুপচাপ বসে আছে। আগে বলেছিল লুডু খেলবে, এখন বলছে খেলবে না।’
রাবেয়া উচু গলায় হাসল আবার। রুনুকে বললাম, রুনু, মন্টু কোথায়? মন্টুকে দেখছি না তাে।
মন্টু হাসপাতালে গেছে। হাসপাতালে কার সঙ্গে গেল, খালার সঙ্গে? ‘না, একাই গেছে। তার নাকি খুব খারাপ লাগছিল। তাই একা একাই গেছে। ‘কোন হাসপাতালে, চিনবে কী করে?
চিনবে। তার স্কুলের কাছেই। চা-টা খেয়ে গিয়েছে? না, যায় নি।
মানে ? শুয়ে পা দোলাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে উঠে বসল, ‘খােকা তুই শা িfাখতে চাস আমার সঙ্গে?’
কী নিয়ে শুনি ? ‘মা ছেলে হলে কি মেয়ে হবে, এই নিয়ে।’
‘আহ, খা না শট। শা6ি। তার কি মনে হয় ছেলে হবে? ‘আমার ঠুি মনে হয় না। ‘আহ, বল না একটা কিছু। ‘ছেলে।’
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আমার মনে হয় মেয়ে। যদি ছেলে হয়, তবে আমি তােকে একটা সিনেমা দেখার পয়সা দেব। আর মেয়ে হলে তুই কী দিবি আমাকে?
“কি বাজে বকিস। ভাল্লাগে না। ‘আহা, বল না কী দিবি? প্লীজ বল।
ক্লাস শেষ হল দেড়টায়।
আতিক ছাড়ল না, টেনে নিয়ে গেল তার বাসায়। একটি মেয়ে নাকি প্রেমপত্র লিখেছে তার কাছে। সত্যি মেয়েটিই লিখেছে, না কোনাে ছেলে ফাজলামি করেছে, তাই ভেবে পাচ্ছে না। তার আসল সন্দেহটা আমাকে নিয়ে, আমিই কাউকে দিয়ে লেখাই নি তাে। যত বার বলছি, আজ ছেড়ে দাও, আরেক দিন কথা হবে। আমার একটু কাজ আছে।’ ততই সে চেপে ধরে।
উঠতে গেলেই বলে, ‘কী এমন কাজ বল? কী যে কাজ, তা আর বলতে পারি না লজ্জায়। অস্বস্তিতে ছটফট করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল। আমাকে দেখেই ওভারশীয়ার কাকু দৌড়ে এলেন, ‘খােকা, তােমার মার অবস্থা বেশি ভালাে নয়। সবাই হাসপাতালে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে? যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও। রিক্সাভাড়া আছে ?
আমার পা কাঁপতে লাগল। আচ্ছন্নের মতাে রিক্সায় উঠলাম। সমস্ত শরীর টলমল করছে।
কালােমলত একটি মেয়ে কাঁদছে। কী হয়েছে তার কে জানে। রাবেয়া বাবার হাত ধরে রেখেছে। রুনু-ঝুনুকে দেখছিনা। বাচ্চা বােনটা কাঁদছে ট্যাট্যা করে। খালা কোলে করে আছেন তাকে। খালা বললেন, ‘দেখ থােকা, কি সুন্দর ফুলের মতাে বােন হয়েছে।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
হ্যাঁ, খুব সুন্দর ফুলের মতাে বােন হযেছে একটি। আর আমাদের আশ্চর্য ফর্সা, ভীষণ রােগা মা হাইফোরসেপ ডেলিভারিতে অপারেশন টেবিলে চুপচাপ মারা গেছেন।
তেইশ বছর আগে মা এসেছিলেন আমাদের ঘরে। তেইশ বছরে একটি বারের জন্যও নিজের বাবার প্রকাণ্ড বাড়িতে যান নি। কতই-বা দূর, বাসে চার আনার বেশি লাগে
এত কাছাকাছি থেকেও যেন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরের গৃহে তেইশ বছর কাটিয়ে দিলেন।
হাসপাতালে মার চারপাশে তাঁর পরিচিত আত্মীয়স্বজনেরা ভিড় করলেন। নানাজানকে প্রথম দেখলাম আমরা। সােনালি ফ্রেমের হাল্কা চশমা, ধবধবে গায়ের রং। শাজাহান নাটকে বাদশা শাজাহানের চেহারা যেমন থাকে, ঠিক সে-রকম চেহারা।
নানাজান বাবাকে বললেন, ‘মেয়েকে আমি আমার বাড়ি নিয়ে যাই, তােমার আপত্তি আছে? বাবা চুপ করে রইলেন। নানাজান কথা বলছিলেন এমন সুরে যেন তাঁর বাড়ির কোনাে কর্মচারীর সঙ্গে বৈষয়িক কথা বলছেন। তিনি আবার বললেন, ‘সেখানে। মেয়ের মার কবর আছে, তার পাশেই সেও থাকবে।’
তেইশ বছর পর মা আবার তাঁর নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। একদিন যেমন সব ছেড়েছুড়ে এসেছিলেন, কোনাে পিছুটান ছিল না, ফিরেও গেলেন তেমনি।
শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
সুর কাটল না কোথাও। ঘর সংসার চলতে লাগল আগের মতােই। বয়স বাড়তে লাগল আমাদের। রুনু ঝুনু আর মন্টু ব্যস্ত থাকতে লাগল তাদের পুতুলের মতো ছােট্ট বােনটিকে নিয়ে, যার একটিমাত্র দাঁত উঠেছে। মুখের নাগালের কাছে যা-ই পাচ্ছে তা-ই কামড়ে বেড়াচ্ছে সেই দাঁতে। সে সময়ে-অসময়ে থ থ থ থ বলে আপন মনে গান গায়। আর রাবেয়া ? অপূর্ব মমতা আর ভালােবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে আমাদের। সমুদ্রের মতাে এত স্নেহ কী করে সে ধারণ করেছে কে জানে?
বাবা রিটায়ার করেছেন কিছুদিন হল। দশটা-পাঁচটা অফিসের বাঁধা জীবন শেষ হয়েছে। ফেয়ারওয়েলের দিন রুনু-ঝুনু বাবার সঙ্গে গিয়েছিল। অফিসের কর্মচারীরা বাবাকে একটি কোরাণ শরীফ, একটি ছাতা আর এক জোড়া ফুলদানি উপহার দিয়েছে। এতেই বাবা মহা খুশি।
মার অবর্তমানে যতটা শূন্যতা আসবে মনে করেছিলাম, তা আসে নি–সমস্তই আগের মতাে চলছে। সব মৃত্য সম্বন্ধেই এ কথা হয়তাে খাটে। অতি প্রিয়জন যদি। পাশে না থাকে, তবে কি করে বেঁচে থাকা যাবে’ ভাবনাটা অর্থহীন মনে হয়। মৃতার জন্যে মানুষ শােক করে ঠিকই, কিন্তু সে-শােক স্মৃতির শােক, এর বেশি কিছু নয়।
কোনাে কোনাে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মার কথা মনে পড়ে। তখন অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না।