দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে প্রচুর, তারপর একটু ঘুম দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু তার উপায় নেই।
বাইরে কোথাও বেড়াতে এলে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত পিকনিকের মেজাজ, এর মধ্যে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
স্থান মধ্যপ্রদেশ, চতুর্দিকে জঙ্গল ও ছোট-ছোট পাহাড়, তার মাঝখানে এই সুদৃশ্য অতিথিভবন, অনেকগুলি ঘর। সামনে অনেকখানি ফুলের বাগান আর প্রকৃতির সুষমা দেখলে বোঝাই যায় না যে এর কাছাকাছি রয়েছে মস্ত ইস্পাত কারখানা, কয়লাখনি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। অতিথিভবনটি ওইরকমই কোনও সংস্থার। আরামের উপকরণের কোনও অভাব নেই। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, দুপুর দুটোয় কিংবা রাত এগারোটাতেও চা চাইলে পাওয়া যায়।
সত্যি, এটাতেই বেশি আশ্চর্য হয়েছেন সুকুমার চৌধুরী। তাঁর দারুণ চায়ের নেশা। দিনে দশ বারো কাপ তো লাগেই। তিনি মদ্যপান করেন না। সন্ধের পর অন্যরা যখন মদের বোতল নিয়ে বসে, সুকুমার চৌধুরীর জন্য চা আসে ঘনঘন।
বহু জায়গায়, অনেকরকম ডাকবাংলো ও অতিথিভবনে তিনি থেকেছেন। সব জায়গাতেই নিয়মকানুনের কড়াকড়ি। সকালে চা দিলে বেলা দশটার পর আর পাওয়া যাবে না। দুপুরে প্রশ্নই নেই। রাত নটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে হবে, নইলে বন্ধ হয়ে যাবে রান্নাঘর। ঠান্ডা খাবার চাপা দেওয়া থাকবে টেবিলে, পরিচারকদের ডিউটি অফ হয়ে যাবে!
এখানে কাল রাত্তিরে সবাই আড্ডা থামিয়ে খেতে বসেছিল রাত পৌনে একটায়, তখনও সব গরম-গরম। পরিচারকরা খাতির করে বলেছিল, আর-একটু মাংস নিন, পাঁপড়ভাজা এনে দেব স্যার?
অন্য কোথাও এরকম ব্যবহার অকল্পনীয়। অবশ্য এই অতিথিশালার ম্যানেজার বাঙালি, দুজন পরিচারকও বাংলায় কথা বলে। কিন্তু বাঙালিরা খুব অতিথিপরায়ণ নাকি? খোদ পশ্চিম বাংলার গেস্ট হাউস, ট্যুরিস্ট লজগুলোতে অনেক সময় এক গেলাস জল চাইলেও দু-ঘণ্টা লেগে যায়। মশারির দড়ি থাকে না।
প্রবাসে বাঙালির স্বভাবও বদলে যায়।
এত বড়-বড় সংস্থায় কাজ করে অনেক বাঙালি, সব মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা সাড়ে আটশো। সুতরাং বাঙালিদের নিজস্ব ক্লাব থাকবেই এবং দুর্গাপুজোও হবে। এখনও দলাদলিতে দু-ভাগ হয়নি।
বছরে একবার সাংস্কৃতিক উৎসবও হয়, সবাই আজকাল যাকে বলে কালচারাল ফাংশান। কলকাতা থেকে নাচ-গান-বাজনার শিল্পীদের আনানো হয়, এবং আবৃত্তিকার, দু-একজন সাহিত্যিক।
যাওয়া-আসার জন্য অনেকটা সময় লাগে, ট্রেন ছাড়া গতি নেই। তবু কলকাতার শিল্পীমহলে জানাজানি হয়ে গেছে যে মধ্যপ্রদেশের ওই বাঙালি ক্লাবের আমন্ত্রণে খাতিরত্ন পাওয়া যায় খুব, বেড়াবারও সুযোগ অনেক। তাই প্রায় সকলেই আগ্রহের সঙ্গে রাজি হয়।
সুতরাং এবারে যে এগারোজন এসেছেন, তাঁরা সারাদিন পিকনিকের মেজাজে থাকলেও কেউ কারুর আত্মীয় নন, কলকাতায় সারাবছর হয়তো অনেকের সঙ্গে দেখাই হয় না। কিন্তু এখানে এসে প্রথম দিন থেকেই ভাব জমে যায়।
প্রীতম অনেক ছায়াছবি ও টিভি ধারাবাহিকের ব্যস্ত নায়ক, কিন্তু এখানে ছুটির আনন্দে হইহই করছে সবসময়। কখনও সে নদীতে স্নান করতে যাচ্ছে, কখনও ব্যাডমিন্টন খেলছে বাগানে, কখনও মেতে যাচ্ছে তাস খেলায়। সে যে খালি গলায় এত ভালো লোকসঙ্গীত গাইতে পারে, তা কারুর জানা ছিল না। নীপা নাম্নী গায়িকাটির হাসির গল্পের স্টক অফুরন্ত। সে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মদ্যপানও করতে পারে।
ঔপন্যাসিক সুকুমার চৌধুরী এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, তিনিই দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের মূল সভাপতি। ধীর, স্থির মানুষ, বেশি কথা বলেন না, কিন্তু চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় বসে থাকেন শেষপর্যন্ত। তিনি মদ্যপান না করলেও সেটা পুষিয়ে দিয়েছে কবি অরিন্দম সেনগুপ্ত। সকাল দশটা বাজতে-না-বাজতেই সে বিয়ারের বোতলে চুমুক দেয়। বাঙালি লেখকদের মধ্যে গদ্যকারদের তুলনায় কবিদেরই মদের প্রতি আসক্তি বোধহয় বেশি।
সুকুমার চৌধুরী সিগারেটটা শেষ করে একটুখানি শুতে যাবেন ভেবেছিলেন, অরিন্দম তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল আবৃত্তিকার সুরঞ্জনের ঘরে। সেখানে জমিয়ে তাস খেলা চলছে।
সুরঞ্জন সুকুমারকে বলল, স্যার, আপনি ভালো ব্রিজ খেলেন শুনেছি। বসুন না আমাদের সঙ্গে। সুকুমারের ব্রিজ খেলার দুর্বলতা আছে। তিনি আপত্তি করলেন না।
অরিন্দম নিজে অবশ্য তাস খেলে না। ভাত খাওয়ার পরেও তার হাতে তৃতীয় বিয়ারের বোতল। সে বলল, সুকুমারদা তো তাসখেলা শিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে, তাই না?
সুকুমার বললেন, প্রেমেনদা দারুণ তাস খেলতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তাস খেলা দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। জীবনানন্দ দাশও না। কবিরা তাস খেলে না। খানিকক্ষণ পরেই আর দুটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এ-ঘরে ঢুকে পড়ল নীপা।
রীতিমতন ধমকের সুরে সে বলল, এত চমৎকার দিনটায় আপনারা ঘরে বসে-বসে শুধু তাস খেলছেন। চলুন, বেড়াতে চলুন!
প্রীতম বলল, এই রোদ্দুরের মধ্যে কোথায় বেড়াতে যাব? নী
পা বলল, শীতকালের রোদ্দুর কী মিষ্টি! উঠুন, উঠুন!
অরিন্দম বলল, শীতকালে বেড়াতে হয় সন্ধেবেলা। চাদর মুড়ি দিয়ে তোমার কাঁধে হাত রেখে বেড়াব!
নীপা বলল, সন্ধেবেলা তো ফাংশান!
প্রীতম বলল, ফাংশান আর কতক্ষণ? এই, কেউ বেশি গান গাইবে না, বড়জোর দু-তিনখানা। সুকুমারদা, আপনি প্লিজ লম্বা বক্তৃতা দেবেন না!
সুকুমার বললেন, আমি জীবনে কখনও দশ মিনিটের বেশি বলি না। তোমরা অরিন্দমকে সামলাও। ও এখন দারুণ পপুলার, শ্রোতারা অনুরোধ করবে, ও দশ-বারোটা কবিতা পড়ে যাবে!
অরিন্দম হাসতে-হাসতে বলল, যদি ততক্ষণ আমার জ্ঞান থাকে। তা ছাড়া, আমি আজ পড়বই না। কাল দেখা যাবে। আজ তোমরা তাড়াতাড়ি ফাংশান শেষ করবে। তারপর আমরা জঙ্গলে বেড়াতে যাব!
প্রীতম বলল, তখন, জঙ্গলে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা! নীপা, আমার সঙ্গে হারিয়ে যেতে রাজি আছ?
নীপা বলল, ইস! এই জঙ্গলে ভাল্লুক আছে শুনেছি। তার পরেও অবশ্য বেড়াতে যাওয়া হল না। শুরু হয়ে গেল গল্প।
একটু পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল বিশ্বজিৎ। সে এখানকার বাঙালি ক্লাবের সেক্রেটারি। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, সুন্দর চেহারা, খুবই সপ্রতিভ। সে যেমন সকলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখাশুনো করছে, তেমনই ব্যবস্থা করছে অনুষ্ঠানের, আবার ফাঁকে-ফাঁকে অফিসেও ঘুরে আসছে।
বিশ্বজিৎ হাত জোড় করে বলল, আপনাদের কারুর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? বিশেষ করে অরিন্দমের দিকে চেয়ে বলল, দাদা, যখন যা লাগবে চেয়ে নেবেন!
নীপা বলল, ওকে দিনের বেলা অত বিয়ার খেতে দেবেন না। রাত্তিরে তো আছেই।
অরিন্দম বলল, চোপ! আমি কতটা কী খাব, তাতে তোর কী রে?
নীপা বলল, বিশ্বজিৎ, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে যাব না!
বিশ্বজিৎ বলল, নিশ্চয়ই। কাল ফাংশান হয়ে যাক, পরশু সবাই মিলে—এ সি বাস ব্যবস্থা করে রেখেছি।
প্রীতম বলল, পরশু থাকতে হবে? আমি পারব না।
বিশ্বজিৎ বলল, তার আগে ছাড়ছিই না।
একটু থেমে, মুখটা কাচুমাচু করে বিশ্বজিৎ বলল, সবাইকে একটা অনুরোধ করব? আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমাদের এম ডি আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন। একসঙ্গে চা। খেতে চান। সেই সময়টায় আপনারা সবাই থাকবেন? বেশিক্ষণ না, আধঘণ্টা।
প্রীতম বলল, সাড়ে পাঁচটা তো চা খাবারই সময়। ঠিক আছে, সবাই থাকব।
বিশ্বজিৎ অরিন্দমকে বলল, দাদা, সেই সময়টা যদি বিয়ারের বোতলটা নীচে নামিয়ে রাখেন! বুঝতেই তো পারছেন, এম ডি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! ফিনান্সটাও ওঁর হাতে। উনি ওকে না করলে এই ফাংশান করাই যেত না। উনি খুব ব্যস্ত লোক, তবু বলেছেন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করতে চান!
নীপা বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তখন অরিন্দমের কাছ থেকে বিয়ারের বোতল সরিয়ে রাখব।
বোঝাই গেল, বিশ্বজিৎ চায়, এম ডি-কে যেন সবাই খাতির করে। সৌজন্য দেখায়।
সাড়ে পাঁচটার অনেক আগেই ডাইনিং হলে পাতা হল পরপর পাঁচটা টেবিল। তার ওপরে ধপধপে চাদর। পরিচারকরা সবাই ফিটফাট পোশাক পরেছে। ম্যানেজার মহাদেব নিজের হাতে সাজাচ্ছে চেয়ার।
টেবিলের ওপর রাখা হতে লাগল প্লেট ভরতি-ভরতি কাজুবাদাম, নানারকম কেক পেস্ট্রি, সন্দেশ, চানাচুর।
অতিথিরা সবাই এসে বসেছে চেয়ারে, মেয়েরা এর মধ্যে নতুনভাবে সেজেগুঁজে নিয়েছে। অরিন্দমের চোখ লাল, কিন্তু হাতে বিয়ারের বোতল নেই, আছে জ্বলন্ত সিগারেট। টেবিলে অ্যাশট্রে নেই।
বিশ্বজিৎ নিজে একটা অ্যাশট্রে তার সামনে এনে বলল, এই সিগারেটটা শেষ করে নিন, তারপর খানিকক্ষণ মানে, এম ডি সাহেব ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না।
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল, পৌনে ছটা, এম ডি-র দেখা নেই। সবচেয়ে বেশি ছটফট করছেন সুকুমার চৌধুরী। টেবিলে চায়ের সব সরঞ্জাম প্রস্তুত, অথচ তিনি চা খেতে পারছেন না। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
এক-একটা গাড়ি এসে থামছে বাইরে, অমনি ছুটে যাচ্ছে বিশ্বজিৎ। কোনওটাই সেই মহামান্য ব্যক্তিটির নয়।
এবার সবাই ছটফট করতে শুরু করেছে। এম ডি কখন আসবেন, সেজন্য সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে হবে?
ঠিক ছটায় সময় এম ডি-র সচিব টেলিফোনে জানালেন, তাঁর প্রভু বিশেষ কাজে আটকে গেছেন, আসতে পারছেন না। অতিথিরা যেন চা খেয়ে নেন। অরিন্দম আপন মনে বলে উঠল, ধুর শালা!
আবৃত্তিকার সুরঞ্জন বিশ্বজিৎকে বলল, দেখুন, এখানে অনেকেই রয়েছেন, বিশেষত সুকুমার চৌধুরী অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ তাঁকে এভাবে এতক্ষণ বসিয়ে রাখাটা কি ঠিক?
সুকুমার চৌধুরী অপমানিত বোধ করছেন, মুখে কিছু বললেন না। প্রীতম এমন মুখের ভাব করল, যেন সে-ও কম বিখ্যাত নয়!
বিশ্বজিৎ ওদের কাছে এসে হাত জোড় করে কাতরভাবে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমাকে যত ইচ্ছে গালাগালি দেবেন, মানে, উনি খুবই ব্যস্ত, উনি নিজেই বলেছিলেন—
প্রীতম গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল, এম ডি-র নামটা কী?
বিশ্বজিৎ বলল, এ এন ব্যানার্জি, উনি বাঙালি বলেই বিশেষ করে…
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সাড়ে ছটায়। স্টেজ সাজানো হয়ে গেছে, দর্শকও এসে গেছে অনেক। এরা চা খেয়ে নিল তাড়াতাড়ি।
তবু অনুষ্ঠান শুরু হল না। ওই এম ডি-ই সভাপতি, তিনি এসে প্রদীপ জ্বালবেন, উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন।
আবার অপেক্ষা। তিনি আসছেন না। কোনও খবর নেই। সামনের সারিতে বসে অরিন্দম বলল, এখনও আরম্ভ হচ্ছেনা, কত রাতে শেষ হবে, অ্যাঁ? আমি কিন্তু আবার মাল খাওয়া শুরু করব।
উৎকণ্ঠিতভাবে ছুটোছুটি করছে বিশ্বজিৎ, শ্রোতারাও অনেকে চঞ্চল। মঞ্চে এখনও পরদা ফেলা। তার আড়ালে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস।
সুরঞ্জন সুকুমার চৌধুরীকে বলল, এইসব ধ্যাড়ধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে এম ডি-রাই রাজা। এরা শিল্পীদের সম্মান দিতে জানে না। কিন্তু আসলে তো এই লোকটি একজন চাকরিজীবী, যত বড়ই চাকরি হোক। সমাজে ওদের কে চেনে?
সুকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, আজকাল তো ওদের হাতেই সব ক্ষমতা।
সুরঞ্জন বলল, ক্ষমতা মানে টাকার ক্ষমতা। রিটায়ার করার পর এঁদের কে পুঁছবে? আপনাকে বহুকাল মানুষ মনে রাখবে। এইসব এম ডি ফেম ডি-দের কোনও রাইট নেই আমাদের এইভাবে বসিয়ে রাখার। চলুন, আমরা উঠে যাই।
প্রীতম বলল, আমরা তো বিশ্বজিতের মুখ চেয়েই এসেছি। এত কম টাকায় আমি কোথাও যাই না।
নীপা বলল, আমার রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম ছিল, সেটা ছেড়ে চলে এসেছি–
স্টেজের পাশ থেকে লাফিয়ে নেমে বিশ্বজিৎ সুকুমার চৌধুরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ফিসফিস করে বলল, দাদা, আমাদের এম ডি আসতে পারছেন না, আরও দেরি হবে। আপনিই উদ্বোধনটা করে দেবেন?
সুকুমার কঠিন গলায় বললেন, না। আমি অন্য কারুর প্রক্সি দিই না।
ঠিক বুঝতে না পেরে বিশ্বজিৎ আবার বলল, আপনি প্রদীপটা জ্বেলে দিন, তারপর প্রোগ্রাম শুরু করে দেব।
সুকুমার বলল, অন্য কারুর উদ্বোধন করার কথা ছিল, তার বদলে সুকুমার চৌধুরী কখনও যায় না।
সুকুমারকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। অগত্যা দর্শকদের মধ্য থেকে তুলে নেওয়া হল এক ডিভিশনাল ম্যানেজার আগরওয়ালকে। তিনিই উদ্বোধন করলেন। ভদ্রলোক ভাঙা-ভাঙা বাংলা জানেন, বাংলার সংস্কৃতির প্রভূত প্রশংসা করে শরৎচন্দ্র বিষয়ে বলতে লাগলেন অনেকখানি। তারপর স্থানীয় শিল্পীদের সমবেত গান ও আবৃত্তি দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান।
কলকাতার শিল্পীদের মেজাজ বিগড়ে আছে। সবাই ঠিক করেছিল খুব সংক্ষেপে সেরে দেবে। কিন্তু শ্রোতাদের সামনে ফাঁকি দিতে পারল না।
নীপা গান গাইল সাতখানা। প্রীতম নানারকম অভিনয় করে দেখাল আধঘণ্টা ধরে। এমনকি অরিন্দমও কবিতা পড়ল অনেকগুলো। শুধু সুকুমার চৌধুরী বক্তৃতা দিলেন ঠিক নমিনিট।
পৌনে নটা বেজে গেল। এরপর আছে এখানকার বেঙ্গলি ক্লাবের একটা থিয়েটার। সেটা না দেখলেও চলবে।
কলকাতা শিল্পীরা মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছে অতিথি ভবনের দিকে। এই সময় এক সঙ্গে দুটো গাড়ি এসে থামল, অমনি হুড়োহুড়ি পড়ে গেল স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে।
নিশ্চিত কোনও ভি আই পি এসেছে।
অরিন্দম বলল, এখন যদি ওই শালা এম ডি-টা এসে থাকে, আমি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করতে রাজি নই।
সুরঞ্জন হাসতে-হাসতে বলল, অরিন্দম অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে থেকেছে। এখন ওকে অবশ্যই বোতল দেওয়া উচিত।
সুকুমার বললেন, আমি স্নান করতে যাব। রাত্তিরে আর-একবার স্নান করা আমার অভ্যেস।
প্রীতম তিনটি মেয়ের দিকে তাকাল, দুষ্টুমির স্বরে বলল, এই অন্ধকারে বেড়াতে যাবে নাকি। যদি ভাল্লুক আসে, আমি হিন্দি ফিল্মের হিরোদের মতন ফাইট করব।
পরিচারকরা দৌড়োদৌড়ি করে খাবার ঘরের টেবিলগুলো আবার সাজাচ্ছে। বিশ্বজিৎ বলল, সুকুমারদা, এম ডি এসে গেছেন। তিনি আপনাদের সঙ্গে চা খাবেন বলছেন।
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, এখন চা?
বিশ্বজিৎ অপরাধীর মতন বলল, উনি অ্যালকোহল টাচ করেন না। বেশিক্ষণ লাগবে না। ওঁর সঙ্গে এককাপ চা খাবেন, তারপর আমাদের আড্ডা তো আছেই।
সুকুমার বললেন, আমি এককাপ চা খাব ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘরে বসে।
বিশ্বজিৎ তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, সুকুমারদা, প্লিজ, প্লিজ!
নীপা, শান্তা, বিশাখারা একেবারেই রাজি নয়। সুরঞ্জন বলল, বিশ্বজিৎ এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মানসম্মান নেই?
বিশ্বজিৎ বারবার বলতে লাগল, প্লিজ, প্লিজ, দশ মিনিটের জন্য।
প্রীতমই বিশ্বজিতের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এগিয়ে এল।
সে দু-হাত তুলে বলল, আর মাত্র দশ-পনেরো মিনিট আমরা অপেক্ষা করতে পারব না? বিশ্বজিৎ বেচারা ফলস পজিশানে পড়ে যাবে।
সুরঞ্জন বলল, দশ-পনেরো মিনিটের প্রশ্ননয়। একজন বুরোক্রাটের এরকম অপমানজনক ব্যবহার শিল্পীরা কেন সহ্য করবে? লোকটা আবার বাঙালি? ছিঃ!
প্রীতম বলল, বিশ্বজিৎও তো বুরোক্রাট। ও যে কত ভালো ব্যবহার করছে। আমার বিশেষ অনুরোধ, আসুন আমরা একটুখানি বসে যাই।
প্রীতমের এতখানি আগ্রহ দেখে অন্যরা আর আপত্তি করতে পারল না।
অরিন্দম বলল, আমি বসব, কিন্তু চা খাব না।
সবাই গিয়ে বসল, আগেকার যে-যার চেয়ারে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন এম ডি। তাঁকে দেখে বাঙালি বলে মনেই হয় না। দীর্ঘকায়, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, রং খুব ফরসা, নিখুঁত সুট পরা। ভুরু তোলা অহঙ্কারী ভাব। স্ত্রীটিও খুব রূপসী, সম্ভবত পাঞ্জাবি, স্কার্ট পরা।
নমস্কার করতে-করতে ঢুকলেন দুজনে। এম ডি ইংরিজিতে বলতে লাগলেন, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, ঠিক সময় আসতে পারিনি, দিল্লি থেকে হঠাৎ একজন মিনিস্টার এসে পড়েছিলেন—
অন্য কেউ কোনও সাড়া শব্দ করল না। বিশ্বজিৎ একে-একে পরিচয় করিয়ে দিল সকলের সঙ্গে।
এম ডি নমস্কার করতে-করতে ইংরেজিতে দু-একটা ভদ্রতার কথা বলতে লাগলেন। পেছনে পেছনে তাঁর স্ত্রী। তাঁর ঠোঁটে স্থায়ী হাসি আঁকা।
পরিচারকরা কাপে চা ঢালছে। সুরঞ্জন ফিসফিস করে নীপাকে বলল, নামেই বাঙালি, বাংলা ফাংলা বোধহয় ভুলে গেছে।
নীপা বলল, বড় অফিসার হলেই ইংরিজি বলতে হয়। নিজের মায়ের সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলে?
সুরঞ্জন বলল, বউ নিশ্চয়ই বাংলা জানে না।
অরিন্দম বেশ জোরে-জোরেই বলল, না, না, আমি চা খাব না।
তারপর সে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়িতে গিয়ে বসল, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।
বিশ্বজিৎ চোখ দিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে, অরিন্দম তা গ্রাহ্য করল না। কেউ কোনও কথা বলছে না। এম ডি-র স্ত্রী নীপাদের সঙ্গে ভাব করতে এল, কিন্তু তাঁর কথা শুনলেই বোঝা যায়, তিনি এইসব বাঙালি শিল্পীদের কারুরই নাম জানেন না।
হঠাৎ অরিন্দম বলে উঠল, আপনার নাম এ এন ব্যানার্জি-মানে পুরো নামটা কী বলুন তো?
এম ডি উত্তর দেওয়ার আগেই বিশ্বজিৎ জানাল, অমরনাথ, অমরনাথ ব্যানার্জি।
অরিন্দম বলল, অমরনাথ? আপনাকে চেনা-চেনা লাগছে। আগে কলকাতা ছিলেন?
এম ডি সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন।
এবার সুদর্শন বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। হ্যাঁ, আমারও চেনা লাগছে। আমি আপনাকে দেখেছি। আপনার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ছিল না তখন, অনেক দিন আগে। আমার যদি ভুল না হয়, আপনি কি গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতেন?
এবারেও অমরনাথ কিছু বলার আগেই বিশ্বজিৎ বলল, না, না, স্যার অনেকদিন ইংল্যান্ডে ছিলেন। তারপর হাঙ্গেরিতে।
তাকে থামিয়ে দিয়ে অমরনাথ এই প্রথম পরিষ্কার বাংলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি কিছুদিন বহুরূপীতে অভিনয় করেছি।
অরিন্দম বলল, অফ কোর্স, বিসর্জন নাটকে। আমি দেখেছি। আমার মনে আছে।
সুরঞ্জন বলল, আমি বহুরূপীর বিসর্জন দেখেছি বহরমপুরে। তাতেও আপনি অভিনয় করেছিলেন না?
এবার অমরনাথের মুখে একটা ফ্যাকাসে হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, সেসব কবেকার কথা। আপনারা মনে রেখেছেন?
সুরঞ্জন বলল, বেশ ভালোই মনে আছে। নতুন অভিনেতা হিসেব অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব নাম হয়েছিল। তারপর হঠাৎ অন্য একজন জয় সিংহ করতে লাগল। আপনি কোথায় চলে গেলেন!
সুকুমার চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অমরনাথের মুখের দিকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কী দারুণ বদলে গেছে ওই মুখখানি।
একটু আগে ছিল একজন অতি সার্থক, খুব ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষের অহঙ্কারী মুখ। এখন যেন তার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে এক গ্রুপ থিয়েটারের তরুণ অভিনেতা। বহরমপুরে নিশ্চয়ই ট্রেনের ভিড়ে ঠাসা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় গিয়েছিল। সাধারণ হোটেলে থাকত অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে এক ঘরে।
সুরঞ্জন জিগ্যেস করল, তার মানে একসময় আপনি আমাদের মতনই একজন স্ট্রাগলিং শিল্পী ছিলেন। অভিনয় ছেড়ে দিলেন কেন হঠাৎ?
অমরনাথ বললেন, হয়তো নিয়তি।
সুরঞ্জন আবার বলল, সেই যে জীবন ছিল, আর এখনকার এই যে ব্যস্ত জীবন, এর মধ্যে কোনটা ভালো বলুন তো!
অমরনাথ মুখ নীচু করে বললেন, কী জানি!
সিঁড়ির দিক থেকে অরিন্দম চেঁচিয়ে বলল, তুমি তো আমাদেরই বয়েসি হবে। ওহে অমরনাথ, সেই বিসর্জন নাটকের কিছু এখনও মনে আছে তোমার? এরপর কী বলো তো—
অরিন্দম আবৃত্তি করতে লাগল।
নহি কি রে আমি তোর পিতার অধিক
পিতৃবিহীনের পিতা বলে? এই দুঃখ,
এত করে স্মরণ করাতে হল! কৃপা–
ভিক্ষা সহ্য হয়, ভালোবাসা ভিক্ষা করে
যে অভাগ্য, ভিক্ষুকের অধম ভিক্ষুক
সে যে! বৎস, তবু নিরুত্তর? …
উঠে দাঁড়ালেন অমরনাথ। রুমাল দিয়ে মুছলেন কপাল, তারপর বলতে লাগলেন উদাত্ত স্বরে :
পিতা, এ বিদীর্ণ বুকে
আর হানিয়ো না বজ্র। রাজরক্ত চাহে
দেবী, তাই তারে এনে দিব! যাহা চাহে
সব দিব! সব ঋণ শোধ করে দিয়ে
যাব। তাই হবে। তাই হবে!
বিশ্বজিৎ, মহাদেব ও অন্যান্য স্থানীয় কর্মীরা হতবাক।
এখানকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গম্ভীর এম ডি নাটরেক সংলাপ বলছেন? বাংলায়? তাঁর স্ত্রীরও চোখ বড়-বড় হয়ে গেছে।
অমরনাথ চেয়ার ছেড়ে সোজা চলে গেলেন অরিন্দমের কাছে। সিঁড়িতে অরিন্দমের পাশে বসে পড়ে লাজুক গলায় বললেন, আপনার একটা সিগারেট দিন। একসময় খুব খেতাম, অনেকদিন পর আবার ইচ্ছে করছে—
তারপর বিশ্বজিতের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, বিশ্বজিৎ, এঁদের জন্য ড্রিংকসের ব্যবস্থা করোনি? আনতে বলো!