শীতের আমেজ – রজত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

সাড়েপাঁচ ঘণ্টার গল্প-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের নিজেদের জীবনকালে দুটো জিনিসের যথার্থ অর্থে সঞ্চয় হয়ে থাকে – বয়স আর অভিজ্ঞতা। দুটোরই ব‍্যবহার আছে কিন্তু খরচ নেই। প্রথমটি যেমন যেমন বাড়ে দ্বিতীয়টিও সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। প্রথমটি যখন থেমে যায় অন‍্যটিকেও থেমে যেতে হয়। এই যে এত বিশাল সংখ্যক জমা অভিজ্ঞতা জমে যায়, তার  মধ‍্যে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা থাকে যেগুলো নানারকম কারণে আমরা নিজেরাই চেষ্টা করে ভুলে যেতে চাই। আবার বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা মনের আনাচে কানাচে থেকেই যায়, অনেকটা ঐ চিলেকোঠায় রাখা ঠাকুর্দার পুরনো ভাঙ্গা বাক্সের মত, কোন কাজেও লাগে না, আবার ফেলাও হয়ে ওঠে না। তবে হাতে গোনা কয়েকটি অভিজ্ঞতা থাকে যেগুলো আমাদের প্রায় সন্তানসম স্নেহে ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখি, আঁকড়ে ধরে থাকি। শুধুমাত্র একান্ত ঘনিষ্ঠদের মধ‍্যে এইসব অত‍্যন্ত মূল‍্যবান অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি। আজ সেইরকমই এক অভিজ্ঞতার গল্প সবার কাছে রাখছি।

 

আজ থেকে প্রায় বছর পঁয়তাল্লিশ আগের শান্তিনিকেতন। দিন দশবারো হলো পৌষমাস শেষ হয়েছে। সারাদিন ধরে একটানা ঘ‍্যানঘ‍্যানানি টিপটিপ বৃষ্টি হয়েছে, সঙ্গে শরীর-চেরা ভিজে হাওয়া।

 

ঘটনার সূত্রপাত পরেরদিন ভোররাতে, বলা যেতে পারে রাত তখনো ঠিকভাবে শেষ হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ঐ সময়টায় ছাত্ররা সবাই লেপের ভেতর সেঁধিয়ে আছে অতল ঘুমে। ঠিক সেইসময় আমার ঘুম ভেঙেছিল দরজায় জোরেজোরে ধাক্কার দুমদাম আওয়াজে। অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল ঘুমের ঘোর কিছুটা হলেও কাটাতে। তারপর সামান্য ধাতস্থ হয়ে, হোষ্টেলের সমস্ত আবাসিকের চোদ্দপুরুষদের কলেজিয় গালাগালে ভূষিত করতে করতে, কোনোরকমে দরজা খুললাম। দেখি কিশোর   দাঁড়িয়ে। কোথাও একটা বেরনোর জন‍্য তৈরী। কানে এল ‘রেডি হয়ে নীচে আয়। কিছু পয়সা নিয়ে নিস। আমি নীচে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি’। কি, কেন, কোথায় এসব জিজ্ঞেস করার কথা মাথাতে আসেনি ঐ ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচাঘুমে। আর যদি আসতও বা, তাহলেও সেসব জিজ্ঞেস করার প্রশ্ন ছিল না। কারণ হোষ্টেলের সেই জীবনকালে কিশোর আর আমি ছিলাম হরিহর-আত্মা, হিন্দিতে যাকে বলে জিগড়ি দোস্ত।

 

শীতের ভোরের নৈসর্গিক আরামের সেই ঘুম ছেড়ে আমরা দুজন রওনা দিয়েছিলাম গাছ-টাটকা খেজুররস খেতে, খোয়াইয়ে। আমাদের হোষ্টেল থেকে শ‍্যামবাটি হয়ে বড়জোর পাঁচশ মিটারের মধ‍্যে খোয়াই শুরু। শুরুর দিকে রাস্তার দুধারে বেশিরভাগই তালগাছ, তারপর থেকে তালগাছেরা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে খেজুরগাছেদের। সেই মধ‍্য মাঘের হাল্কা কুয়াশা মাখানো এক ভোরে আমরা দুই বন্ধু খোয়াইয়ের বুক চিরে লাল কাঁকড়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছিলাম কোপাই নদীর দিকে। রাস্তার ডানদিকে বেশ কিছু দূরে প্রান্তিক, বাঁদিকে সোনাঝুরি আর সোজা মাইল দুয়েক গেলে কোপাই নদী। আমাদের ইচ্ছে সেই কোপাই নদী পযর্ন্ত গিয়ে তারপর একই রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। এখানে একটু বলে নি এই নদীর মজা। শুধুমাত্র বর্ষাকালে তার মনে পড়ে যে সে একটি নদী। তাই ঐসময়টাতে হঠাৎ ঠিকঠাকভাবে নিজের পরিচয় মনে পড়াতে সে অতি মাত্রায় চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং আশপাশের গ্রামগুলোকে জলে চুবিয়ে সেখানকার জনমানুষের জীবন ব‍্যতিব‍্যস্ত এবং অতিষ্ঠ করে তোলে। মনে আছে ভোরের খোয়াইয়ের সেই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে হাঁটতে একটা লোককে দেখেলাম একটা গাছে থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে। তক্ষুনি নামিয়ে আনা খেজুররস সেই গাছেতেই হেলান দিয়ে বসে শালপাতার ঠোঙায় নিয়ে খেয়েছিলাম। দুএক চুমুকে একবার করে আমরা শেষ করি আর সাথে সাথে সে আমাদের ঠোঙায় মশারির টুকরো দিয়ে  মুখ বাঁধা হাঁড়ি থেকে আবার একটু একটু করে ঢেলে দেয়। এক জায়গায় খাওয়া শেষে কিছুটা হাঁটার পর আরেকটি গাছের নীচে বসে আবার রস খাওয়া সেই একই ভাবে। এইভাবে বার চারেক বোধহয় খেয়েছিলাম। সেই বরফঠাণ্ডা রসে মুখের ভেতর জমে শক্ত হয়ে গেছিল, চোয়াল হয়ে গেছিল পাথর।

 

খেজুররসে আকণ্ঠ পরিপূর্ণ হয়ে আমরা কোপাই নদীর দিকে এগোতে থাকলাম। মাঠঘাটের ওপর দিয়ে ঐ নদীতে কয়েকবার গিয়েছি, তবে অন‍্য দিক দিয়ে। এই রাস্তা দিয়ে সেবারই প্রথম যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাাঁটতে দিন পরিষ্কার হয়ে উঠল। ছুটছাট্ জনা কয়েক সাইকেলযাত্রি, কয়েকটি গরুর গাড়ি ইতিমধ্যে যাওয়া আসা শুরু করেছে। খোয়াইয়ের রাস্তা রাতের শিশির শুকিয়ে ধুলো ওড়ানো শুরু করেছে। লাল ধূলো। আমাদের চটি, প‍্যাণ্টের নীচের দিক সবকিছু লাল। স্বপন ওর প‍্যাণ্ট থেকে কয়েকবার ধূলো ঝাড়ার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে স্বগোতক্তি করেছিল ‘কিছু কিছু চেষ্টা, খুব ইচ্ছে করলেও, কক্ষনো করা উচিৎ নয়, বুঝলি’। কিশোরের এই একটা অদ্ভূত অভ‍্যেস ছিল। কোনো কিছু পছন্দ না হলে অথবা মনের মতো না হলে একটা করে দার্শনিক বাক‍্য বাজারে ছেড়ে দিত।

 

কোপাই নদী এদিক দিয়ে পৌঁছতে রাস্তাটা একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে যায়। গ্রামের নামও কোপাই। অনেক বাড়ির মেয়েদের দেখলাম নিজের নিজের বাড়ির সামনের দালান ঝাঁট দিতে ব‍্যস্ত। রাস্তার দুপাশে পাকা বাড়ি নজরে পরেছিল বলে আজ আর মনে পড়ে না। সবগুলোই বোধহয় মাটির তৈরী দেখেছিলাম। কয়েকটি দোতলা বাড়িও নজরে পরেছিল। কয়েকজন বুড়োকে দেখেছিলাম রোদে ন‍্যাতানো দালানে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে অ‍্যালুমিনিয়ামের গেলাসে ধোঁয়া ওঠা চা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেতে। বড় লোভ হয়েছিল সেই ধোঁয়াওঠা চা দেখে সেদিন ঠিক সেইসময়। অতটা হেঁটে খিদেও পেয়ে গিয়েছিল অল্পস্বল্প।

 

আমাদের রাস্তাটি গ্রামে ঢুকেই দুভাগে ভাগ হয়ে যায়, হুবহু ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের মতো। অক্ষরের ঠিক মুখটাতে দোতলা একটা মাটির বাড়ি। অন‍্যান‍্য বেশিরভাগ বাড়ির মতো এটির সামনেও বেশ বড় দালান। দালান জুড়ে চপ মুড়ির দোকান, চা চাইলে গুড় দিয়ে বানিয়ে দেয়। দোকানটি সম্ভবত কোপাইয়ে একমাত্র দোকান ছিল; তবে এতবছর পরে এখন আর অতটা নিশ্চিত নই। এটা অবশ‍্য মনে আছে সেদিন সেইমুহূর্তে দুজনে মিলে যুদ্ধকালিন তৎপরতায় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোপাই নদীকে ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে আমরা চায়ের জন্য সটান ঐ দোকানে ঢুকে গিয়েছিলাম।

 

দোকানের একপাশে লম্বা দুটো কাঠের বেঞ্চি। অন‍্য পাশে একটা বড় উনুনের গনগনে আগুনে  বসানো মস্ত এক কড়াই। কড়াইভর্তি ছাঁকা তেলে ভাজা হচ্ছে আলুর চপ্ আর বেগুনি। চায়ের ডিশের সাইজের আলুর চপ্ আর ইঞ্চি আটেক মাপের লম্বা লম্বা করে কাটা বেগুনের বেগুনি। অতবড় সাইজের আলুর চপ্ আমরা আগে কোনদিন দেখিনি। কাঁচাপাকা চুলওয়ালা মাঝবয়সী একজন লোক কাঠের পিঁড়িতে উবু হয়ে বসে একটা ঢাউস ছাঁকনা দিয়ে সেগুলোর গায়ে পিঠে হাল্কা করে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ভাজছিল। আমি মন দিয়ে লোকটির ভাজার কায়দা দেখছিলাম। কনুইয়ের আলতো খোঁচায় কিশোর ইশারায় লোকটির ঠোঁট দেখতে বলল। লক্ষ্য করে দেখলাম তার ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখা বিড়িটা ধোঁয়া টেনে টেনে সে শেষ করল কিন্তু একবারও আঙ্গুল দিয়ে না ধরে। আর ধোঁয়া টানছিল অনেকটা স্ট্র দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস টেনে খাওয়ার কায়দায়। শেষ হলে ওটাকে বাঁ হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে ধরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপরে পাশে রাখা ছোট একটা পেতলের ঘটির জলে আলগোছে ঠিক ঐ আঙ্গুলদুটো ধুয়ে নিয়েছিল। ওর সামনে রাখা দুটো বড়ো মাপের কাঠের পরাতে রাখা ছিল ভাজা চপ্ আর বেগুনি। আর ঠিক পেছনে পেল্লাই সাইজের তিনটে ধামায় চুড় করে রাখা ছিল মুড়ি। সামান্য দূরে বসে হাতখানেক ঘোমটা দেওয়া একটি অল্পবয়সী মেয়ে একমনে আলুর চপ গড়ছিল আর লম্বা লম্বা ফালি করে বেগুন কেটে সামনে এগিয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে ছোট একটা উনুনে স‍্যসপ‍্যান বসিয়ে গুড় দিয়ে চা করে খদ্দেরদের দিচ্ছিল। চিনির চা হবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আমাদের পাশে বসা একজন তার চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে আমাদের বুঝিয়েছিল ‘চিনি বড় মাঙনা গো দাদারা’। এসবের মধ‍্যে ঐ মেয়েটি আমাদের মধ‍্যে এক নিঃশব্দ কৌতুহল জাগিয়েছিল। সে মধ‍্যবয়স্ক দোকানির মেয়ে ছিল, না ছেলের বউ ছিল, নাকি কেউই ছিল না সেটা আমরা কোনভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।

 

আমরা বেঞ্চিতে বসেছিলাম চা’ভর্তি গেলাস নিয়ে। মনে পড়ে চা’টা খেয়েছিলাম নবাবি ঢংয়ে, বেশ অনেকক্ষণ ধরে, তাড়িয়ে তাড়িয়ে। ঘণ্টা দেড়েক বাদে আরেকবার করে চা নিয়েছিলাম। মধ‍্যিখানের সময়টুকু কেটেছিল  শালপাতার ঠোঙায় এক ঠোঙা করে তেল মাখানো মুড়ি, দুটো করে আলুর চপ্ আর বেগুনি আর মুখমিষ্টি হিসেবে এক টুকরো করে খেজুর গুড়ের পাটালি খেতে খেতে।

 

বছর পঁয়তাল্লিশের পুরনো, সেই কোন্ এক মাঘের সকালে ঐ পরিবেশে নিজের জিগড়ি দোস্তের সঙ্গে বসে কোপাই গাঁয়ের জলখাবারের সেই সবমেশানো, মন কেমন করা গন্ধটা আজও নাকের সামনে দিয়ে কচ্চিৎ-কখনও হাল্কা হয়ে ভেসে যায়। কবেকার সেই সকালের সমস্তকিছু ছিল আলাদা; ঠাণ্ডার কনকনানি, মানুষজন, প্রকৃতি, পরিবেশ, স্বাদ, গন্ধ সবকিছুই। পরিপূরক হিসেবে আলাদা ছিল আমাদের বয়স, আমাদের মন, আমাদের মেজাজ। সেই গন্ধের বর্ণনা কাগজে কলমে তুলে ধরার চেষ্টা করা বৃথা। সান্ত্বনা খুঁজি কিশোরের কথায় ‘কিছু কিছু চেষ্টা, খুব ইচ্ছে  করলেও, কক্ষনো করা উচিৎ নয়, বুঝলি’।

 

*******

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *