সম্রাট শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

সম্রাট শেষ – পর্ব

প্যারাট্রুপার দলের অধিনায়ক কর্নেল ফাতা ফোর্টনকের সর্বদক্ষিণের বাংকারে বসে অনুসন্ধানী দল কীভাবে পাঠানো হবে তা ঠিকঠাক করছিল। তার মুখে চুরুট। বিস্ফোরণের পরপর সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, খুব বড় রকমের বোকামি হয়েছে। খুবই বড় ধরনের বোকামি।কী বোকামি হয়েছে তা বলার মতো অবসর হল না। তিন ইঞ্চি মর্টারের একটি গোলা এসে পড়ল।

নিখুঁত নিশানা, যার থেকে অনুমান করা যায়, বাংকারগুলির পজিশনমতে মটারের গোলা ছোঁড়া হচ্ছে। প্রতিটি বাংকার আক্রান্ত হবে।পরবর্তী কুড়ি মিনিটে যা ঘটল তার নাম হতবুদ্ধি সৈন্যবাহিনীর রিফ্লেক্স অ্যাকশানজনিত বিশৃঙ্খলা।ওরা ভেতর থেকে আক্রান্ত হয়েছে, এটা বুঝতে বেশ কিছু সময় নষ্ট হল। বাংকারের নিরাপদ আশ্রয়ে যারা ছিল, তারা ভেতরের দিকে গুলি করবে কি করবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তারা ক্রল করে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে যাবে। কিন্তু আক্রমণের কোনো কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল দূরপাল্লার জন্যে উপযুক্ত। প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি তাদের ছিল না। বিপক্ষ দলের জনবল সম্পর্কেও একটি ভুল ধারণা তৈরি হল, যা মানসিকভাবে তাদের কাবু করে ফেলল।শুধু হেলিকপ্টার দুটির পাশে দাঁড়ানো দশজনের একটি ইউনিট মাথা ঠাণ্ডা রাখল।

মুহূর্তের মধ্যে তারা দুটি লাইট মেশিনগান বসিয়ে ফেলল। যে-ভুলটা সবাই করেছে—পাগলের মত নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, তা তারা করল না। কভার নেবার চেষ্টা করতে লাগল।রবিনসন তার দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশকে রেখেছিল হেলিকপ্টার দখলের জন্যে। তারা তা করতে পারল না। হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনী রবিনসনের দলকে কাছ-ঘেঁষতে দিল না। রবিনসনের দল যা করতে পারল তা হচ্ছে, রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে দুটি হেলিকপ্টারের একটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া।

ফোর্টনকের সর্বত্রই আগুন জ্বলছে। রবিনসন হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনীর নজর ঢাকবার জন্যে একটি স্মোক বোম ব্যবহার করেছে। সেই ঘন কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। বাইরের বাংকারগুলি থেকে এইচএমজির গুলিবর্ষণের কান-ফাটানো আওয়াজ। তারা গুলি চালাচ্ছে বাইরে। যে-কোনো মুহূর্তে বাইরে থেকে আক্রমণ হবে, এটাই তাদের গুলিবর্ষণের কারণ।হতভম্ব জেলারেল র্যাবি চরর মধ্যে ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করল। ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, বড় রকমের ফাঁদে পড়ে গেছি স্যার।ডোফা শুকনো গলায় বললেন, কি ব্যাপার?

ফকনারের দল ভেতর থেকে আমাদের আক্রমণ করেছ। আশঙ্কা করছি, বাইরে থেকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকেও আক্রমণ হবে।এখন কি আক্রমণ বন্ধ? জ্বি। কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়েছে।ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কি? এখনো পুরো রিপোর্ট পাই নি। তবে অবস্থা বেশি ভালো না। বলা যেতে পারে খুবই খারাপ অবস্থা।তুমি জেনারেল না-হয়ে একটা ছাগল হলে ভালো হত।আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।পরিস্থিতি তোমার পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রবেশ করানো হবে।

জেনারেল ডোফা ওয়্যারলেস রিসিভার নামিয়ে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন।র্যাবির কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির পুরো বিবরণ পাওয়ার পরপরই জেনারেল ডোফা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠালেন। তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল প্রায় এক ঘন্টা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাঁদের বিরাট বিপর্যয়ের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। হাসিমুখে কথা বলেন।

জেনারেল ডোফাও তাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখে যে-কথাটি শেষ মুহূর্তে বললেন, তার সরল অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর দুটি শয়তান তৈরি করেছেন। দুটির একটি হচ্ছে, যে আদমকে গন্ধম ফল খাইয়েছে—আর অন্যটি হচ্ছে, মার্কিন সরকার।রাষ্ট্রদূত সেই কথায় প্রাণখুলে হাসল। মধুর স্বরে বলল, আপনি খুবই রসিক। তবে ভয় নেই, আমরা আপনার পেছনে আছি।

ডোফা হাসিমুখে বললেন, শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে সমস্যা কি, জানেন? সমস্যা হচ্ছে, আপনারা একই সঙ্গে দু-তিন জনের পেছনে থাকেন। এই মুহূর্তে হয়তো-বা অন্য একজন জেনারেলের পেছনেও আছেন, আবার কে জানে। হয়তো ফকনারের পেছনেও আছেন।আপনি খুবই রসিক ব্যক্তি।ঠিক ধরেছেন, খুবই রসিক।দুপুরে ডোফা তাঁর স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম করে নদীতে সাঁতার কাটতে গেলেন। তার জন্যে একটি ক্যাবিনেট মিটিং করতে হল। এখন আর কোনো কিছুতেই মন বসছে না।

নদীর পাড়ে টিভি ক্যামেরাম্যান, সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যচিত্রের গাড়ি এবং বেশ কজন পত্রিকার ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে। আগামীদিনের পত্রিকায় ডোফার সাঁতারের ছবি ছাপা হবে। খবরের ধরন কী হবে, তথ্য মন্ত্রণালয় তাও জানিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে তা লেখা হয়ে গেছে। ফটোকপি করা হচ্ছে। ডোফার অনুমতি পেলেই সাংবাদিকদের হাতে-হাতে দিয়ে দেওয়া হবে।

উসসি নদীতে ডোফা মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজ হঠাৎ উসসি নদীতে সাঁতার কাটার জন্যে উপস্থিত হন। জনগণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে তাঁদের মাঝখানে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন। তাঁরা তুমুল হর্ষধ্বনি দিতে থাকেন। মহামান্য প্রেসিডেন্ট নদীর পারে দণ্ডায়মান জনগণকে তাঁর সঙ্গে সাঁতারের আমন্ত্রণ জানান।

এই আহ্বানে তাঁদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাঁতার কাটতে-কাটতেই তাঁদের ব্যক্তিগত কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং তাঁদের আশ্বাস দেন যে, অদূর ভবিষ্যতে উসসি নদীতে বাঁধ দেবার ব্যবস্থা সরকার করবে, যাতে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় উসসি নদীর দুপাশের মানুষকে আর কষ্ট না-করতে হয়।

তথ্যচিত্রের কর্মীরা বড়-বড় রিফ্লেক্টর ফিট করছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সূর্য বারবার মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ভালো ছবি তোলা খুব সহজ হবে না। টিভি ক্ররা ক্যামেরা নিয়ে নৌকায় উঠে গেছে। অপেক্ষা করছে–কখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি নদীতে নামবেন।ডোফা শেষ মুহূর্তে নদীতে নামার পরিকল্পনা বাতিল করলেন। তবু সবাই নদীর পারে অপেক্ষা করতে লাগল, যদি আবার ফিরে আসেন। কিছুই বলা যায় না, আসতেও ত পারেন।

নিশো ক্ষীণস্বরে বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কি জানতে পারি? ফকনার হাসিমুখে বলল, নিশ্চয়ই জানতে পারেন। এটা কোনো গোপন সংবাদ নয়।তা হলে বল, কোথায় যাচ্ছি।জানলে বলতাম। আমি নিজেও জানি না কোথায় যাচ্ছি। উত্তর দিকে যাচ্ছি, এইটুকু বলতে পারি।তোমার পরিকল্পনা কি? এই মুহূর্তে কোন পরিকল্পনা নেই। আপনাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা নষ্ট হয়েছে।

ফোর্টনকে তোমার যে-দল ছিল, সবাই কি মারা গেছে? তাই তো মনে হচ্ছে। ফিরে তো কেউ আসে নি। কেউ-কেউ বেঁচে থাকতেও পারে। বেঁচে থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।তুমি ওদের কোনো খোঁজ করবারও চেষ্টা কর নি? না, করি নি। কারণ এমন কোনো কথা ছিল না। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, তারপর রওনা হয়েছি। ডোফার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ইচ্ছা নেই।তোমরা এখন আছ মাত্র সাত জন।

না, আট জন। আপনিও আমাদের সঙ্গে আছেন। দয়া করে চুপ করে থাকলে আমার সুবিধা হয়। কথা বলতে ভালো লাগছে না।নিশো চুপ করে গেলেন। দলটি অতিদ্রুত চলছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা লকিয়ে ছিল। অন্ধকার হবার পরপর যাত্রা শুরু করেছে। বিরতিহীন যাত্ৰা। এখন প্রায় মধ্যরাত। এর মধ্যে এরা এক মুহুর্তের জন্যেও বিশ্রাম করে নি। নিশোকে এক জন পিঠে তুলে নিয়েছে। সে আছে মাঝখানে। সেও অন্যদের মতোই সমান তালে পা ফেলছে। নিশো এক বার শুধু বললেন, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

লোকটি কর্কশ গলায় বলল, তুমি যখন কথা বল, তখনই শুধু কষ্ট হয়। নয়তো হয় না।নিশো চুপ করে গেলেন। তাঁর প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পাওয়ার ধরনটা অন্য রকম। মনে হয় সমস্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। তিনি মাঝেমাঝে ঝিমুচ্ছেন। চোখ মেলে রাখতে পারছেন না। আবার ঘুমিয়ে পড়তেও লজ্জা লাগছে।রাত দেড়টায় ফকনার থামবার হুকুম দিল। এক ঘন্টা বিশ্রামের পর আবার যাত্রা শুরু হবে। জায়গাটা খোলামেলা।

চারদিকে গভীর বন। বনের ভেতর পায়ে-চলার রাস্তা আছে। তবে গভীর রাতে কেউ চলাচল করে না। ফকনারের দলের সঙ্গে এখনো কারোর দেখা হয় নি। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে ঘাসপচা গন্ধ। নিশাচর পাখির ডাক এবং গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। অবশ্য ঝিঝির ডাক সারাক্ষণই আছে। কান সেই শব্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে শব্দটা এখন আর কানে আসছে না।

ওয়্যারলেস চালু করা হয়েছে। মাইক্রোওয়েভ কম্যুনিকেশন ফ্রিকোয়েন্সি বদলানো হচ্ছে। কোনো রকম সিগন্যাল ধরা পড়ছে না। ফকনারের ধারণা ছিল, সিগন্যাল আসবে। ডোফা যোগাযোগ করতে চাইবে। এবং তখন হয়তোবা ফকনারের প্রস্তাবে সে রাজি হবে। ডোফা বুদ্ধিমান লোক, রাজি হওয়া ছাড়া তার পথ নেই।

কফি তৈরি হয়েছে। সবাই একসঙ্গে খেতে পারছে না। দুটিমাত্র মগ। দুজন ভাগ্যবান গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে। অন্যরা অপেক্ষা করছে তাদের সুযোগের জন্যে। হাত-পা ছড়িয়ে তারা এমনভাবে শুয়ে আছে যে মনে হচ্ছে আবার উঠে চলার শক্তি নেই। কেউ কেউ মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফকনার কফির মগ হাতে নিশোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।ঘুমুচ্ছেন নাকি?

নিশোর তন্দ্রা ভেঙে গেল। তিনি অবশ্যি কিছু বললেন না।নিন, আপনার জন্যে কফি এনেছি।খেতে ইচ্ছা করছে না।আমরা এক্ষুনি রওনা হব। কফি খেলে আপনার চলতে সুবিধা হবে।আমি তো আর চলি না, পিঠে শুয়ে থাকি।পিঠে শুয়ে থাকতেও কষ্ট কম হবে। নিন, কফি নিন।নিশো কফি নিয়ে এক চুমুক দিয়েই হড়হড় করে বমি করে ফেললেন।আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?

বুঝতে পারছি না। বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। কেমন একটা ঘরের মধ্যে আছি।ফকনার এগিয়ে এসে নিশোর কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। গা পুড়ে যাচ্ছে।আপনার শরীর তো মনে হচ্ছে বেশ খারাপ।নিশো জবাব দিলেন না। ফকনার বলল, এত প্রচণ্ড জ্বর কি আপনার আগে ছিল? জানি না, মনে হচ্ছে মরতে বসেছি। তোমরা কি এখনি রওনা হতে চাও?

হ্যাঁ।আমাকে কি আর আধ ঘন্টা সময় তুমি দিতে পারবে। আমার মনে হচ্ছে আধ ঘন্টার মধ্যে আমার কিছু-একটা হয়ে যাবে। তখন নিশ্চিন্ত মনে তোমরা রওনা হতে পারবে।ফকনার গম্ভীর গলায় বলল, আপনি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হন, তা হলে আধ ঘন্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে মুশকিল কি জানেন, মৃত্যুর আগে যে-শ্বাসকষ্ট, সেটা শুরু হবার পর সাধারণত দু-তিন ঘন্টা সময় পর লোকজন মারা যায়।

আপনার শ্বাসকষ্ট এখনো শুরু হয় নি।নিশো হেসে ফেললেন। ফকনার বলল, দয়া করে আটচল্লিশ ঘন্টা বেঁচে থাকুন। তা হলেই হবে।কি হবে? এর মধ্যেই লোকজন জানতে শুরু করবে-নিশো এখনো বেঁচে আছে। বিরাট একটা চাপ ডোফার ওপর পড়বে। শুরু হবে গৃহযুদ্ধ। জেনারেলদের কেউ-কেউ যেদিকে বাতাস, সেদিকে পাল খাটাবার চেষ্টা করবে।

আমরা যখন গ্রামে লুকিয়ে ছিলাম, তখনই গ্রামের বেশিরভাগ লোক জেনে গেছে আপনি বেঁচে আছেন। এইসব খবর দ্রুত ছড়ায়। কে জানে ইতোমধ্যেই হয়তো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।নিশো কাতর গলায় বললেন, আমার কারণে হাজার-হাজার লোক মারা যাবে, এই দৃশ্য আমি দেখতে রাজি নই। তুমি হয়তো জান না, তোমরা যখন আমাকে বের করে আনলে, তখন থেকেই ঈশ্বরের কাছে আমার মৃত্যু কামনা করছি।

আপনি কিন্তু এক বার বলেছেন ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না।তুমি কর? আমি ঈশ্বর বা মানুষকোনোটাই বিশ্বাস করি না।বন্ধুকে বিশ্বাস কর, তাই না? তা করি।ফকনার নিজের জন্যে আরেক পেয়ালা কফি এনে নিশোর পাশে বসতে-বসতে বলল, পাখিকে নিয়ে যে-কবিতাটা লিখেছিলেন, ওটা পড়ন। শুনি, কি লিখেছেন।

নিশো জবাব দিলেন না।ফকনার বলল, পাখি, নারী, ফুল ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কি আপনি কবিতা লিখেছেন? যেমন ধরুন বন্দুক-বন্দুক নিয়ে কখনো লিখেছেন? হ্যাঁ, লিখেছি। শুনতে চাও? না, পাখির কবিতাটাই পড়ন। প্রথমে আপনার নিজের ভাষায় পড়বেন, তারপর অনুবাদ করবেন। নিশো নিজের ভাষায় পড়লেন না। সরাসরি অনুবাদ করলেন। ফকনার আগ্রহ নিয়ে শুনল

সোনালি ডানার একটি চমৎকার পাখি আমার পাশেই বসেছিল।……. আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে তাকে ছুঁতে গেলাম।….. ওম্নি সে উড়ে গেল।….. গভীর বিষাদে আমার হৃদয় যখন আপ্লুত হল…… ঠিক তখন আমি দেখি পাখির একটি ডানা…… পড়ে আছে।…. সোনালি এই পাখি যেখানেই যায় সেখানেই তার….. কিছু অংশ রেখে যায়।

ফকনার বলল, আপনার কবিতাটি চমৎকার। এখন রওনা হওয়া যাক। আধ ঘন্টা পার হয়েছে। আপনি বেঁচে আছেন। মারা যান নি।নিশো আবারো হেসে ফেললেন।আবার যাত্রা শুরু হল। অসম্ভব খারাপ লাগছে তাঁর। বারবারই মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাচ্ছেন। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, আবার কিছুক্ষণ পর চাঁদের আলো চোখে পড়ছে। গভীর বনে চাঁদের আলো—কী অদ্ভুত দৃশ্য।

তার মতো আসছে। এই তার মধ্যেও তাঁর মনে হল তিনি অসীম ভাগ্যবান মৃত্যুর আগে তাঁর প্রিয় জন্মভূমির কিছু মায়াময় দৃশ্য দেখতে পেলেন। জেলখানার অন্ধকূপে শুয়ে থেকে মরতে হল না। যাদের জন্যে এটা সম্ভব হল তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বড়ই ক্লান্তি লাগছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তাঁর কেবলি মনে হচ্ছে, এক বার ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর ঘুম আর ভাঙবে না।সম্রাট নিশো।

নিশো চোখ মেললেন। ফফকা দিনের আলো চারদিকে। সূর্য অনেক দূর উঠে গেছে। তিনি বিশাল এক পিপুল গাছের নিচে শুয়ে আছেন। তাঁর সামনে ফকনার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।এখনো মনে হচ্ছে বেঁচে আছেন।তাই তো দেখছি।আমরা এখানে পৌঁছেছি অনেক আগেই। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন, তাই জাগাই নি। এখন দয়া করে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খাবার খান। আপনার জন্যে সুসংবাদ আছে।

কী সুসংবাদ!জেনারেল ডোফা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। অন্য একজন ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। নতুন জেনারেল ঘোষণা করেছেন যে নিশো বেঁচে আছেন, তাঁকে রাজধানীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।কোথায় পেলে খবর? প্রাথমিক খবর ওয়্যারলেসে পেয়েছি। তবে নতুন জেনারেল বেতার ভাষণ দেবেন। আপনাকে ডেকে তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেতার ভাষণটি শোনানো।

নতুন জেনারেলের নাম অ্যামিও। তিনি আবেগপূর্ণ একটি ভাষণ দিলেন, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে, মহান নেতা নিশোকে যেসব চক্রান্তকারী জেলখানায় আটকে রেখে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করেছে বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে। জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মহান নেতা আজ দুপুরের মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

ফকনার বলল, আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে হেলিকপ্টার আসবে। আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছি। হেলিকপ্টারে ডাক্তারও আসছেন। আপনি এখন কেমন বোধ করছেন, সেটা বলুন।ভালো।মার্কিন সরকারেরও টনক নড়েছে। তারাও যোগাযোগ করেছে। আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে একটা সি প্লেন পাঠাচ্ছে।

ফকনার চুরুট ধরাল। আর ঠিক তখনই হেলিকপ্টারের পাখার আওয়াজ পাওয়া গেল। হেলিকপ্টার থেকে ডাক্তার এবং নার্স ছাড়াও দশ জন কমান্ডোর একটি দল নামল। ফকনার চুরুট ফেলে এগিয়ে গেল। কমান্ডো দলের প্রধান উষ্ণ গলায় বলল, আশা করছি আপনি কর্নেল ফকনার।

হ্যাঁ।ফকনারের আরো কিছু হয়তো বলার ইচ্ছা ছিল। সেই সুযোগ সে পেল না। কমান্ডো দলের সবার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একসঙ্গে গর্জে উঠল।সম্রাট নিশো এবং ফকনারের দলের সাত জন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মারা গেল। ডাক্তার এবং নার্সকে হত্যা করা হল তার পরপরই।

জেনারেল অ্যামিও নিশোকে রাজধানীতে আনতে চান নি। সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো কোনো পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। তা ছাড়া আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেনারেল অ্যামিওকে জানিয়েছেন, মার্কিন সরকার মনে করে যে, এই দেশের জন্যে সামরিক শাসনই উত্তম। নিশোকে এই সময় হাজির করা মানেই রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা। উন্নয়নশীল দেশের জন্যে যা অশুভ।

সন্ধ্যাবেলা সমগ্র বিশ্ববাসী জানল, শেষ মুহূর্তে কুচক্রী ডোফার অনুসারীরা নিশোকে ফোর্টনকে হত্যা করেছে। জেনারেল অ্যামিও বেতার ও টিভি মারফত এই খবর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। দশ দিনের রাষ্ট্ৰীয় শোক ঘোষণা করা হল। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গভীর সমবেদনা জানিয়ে বার্তা পাঠালেন।

নিশোর নিজের রচনার কিছু অংশই তাঁর কবরের শোকগাঁথায় ব্যবহার করা হয়েছে— মানুষকে ঘৃণা করার অপরাধে কখনো কাউকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় নি, অথচ মানুষকে ভালবাসার অপরাধে অতীতে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।

 

Read more

রতনবাবু আর সেই লোকটা – সত্যজিৎ রায়

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *