দুটোর মধ্যে একটা। হিট করল। কারাের হাসি আর থামতেই চাচ্ছে না। এই দলটিকে দেখলে কে বলবে এদের জীবনে কোনাে দুঃখ–কষ্ট আছে? এদের দেখে মনে হচ্ছে গভীর আনন্দে এদের হৃদয় পরিপূর্ণ।
রিহার্সেলের ঘরে এরা যখন ঢােকে জীবনের সমস্ত হতাশা ও বঞ্চনা পেছনে ফেলে ঢােকে। নাটক তাদের দ্বিতীয় জীবন। এই জীবনটাকেই তারা আঁকড়ে ধরে। দ্বিতীয় জীবনই এক এক সময় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয় দৃশ্য শুরু হল। এটিও রাতের দৃশ্য। লেখক শােবার ঘরে। বিছানায় বসে। আছেন। পাশেই তাঁর স্ত্রী—কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। লেখক লিখে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটা শব্দ হল। লেখক চমকে তাকালেন—ঘরের মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়ে। যে দাঁড়িয়ে, তার চেহারা ভালাে না। সে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ। তার নাম ছলিমুদ্দিন। ছলিমুদ্দিনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন প্রণব বাবু।
লেখক অবাক হয়ে ছলিমুদ্দিনকে দেখছেন। চিনতে পারছেন না। এই গভীর রাতে শােবার ঘরে লােকটা কোথেকে এল বুঝতে পারছেন না। তিনি খানিকটা ভীত।
লেখক : কে কে কে? ছলিমুদ্দিন : আস্তে। চেঁচাবেন না। আপনার স্ত্রী জেগে উঠতে পারেন। লেখক : কে কে? আপনি কে?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
ছলিমুদ্দিন : চিনতে পারছেন না? কি অদ্ভুত কথা। নিজের সৃষ্টি করা চরিত্র নিজেই চিনতে পারছেন না। ভালাে করে তাকিয়ে দেখুন, জীবন যুদ্ধে পরাজিত, ক্লান্ত শ্রান্ত একজন মানুষ, আজ সারাদিন যার খাওয়া হয় নি। যার প্রেমিকা অন্য এক পুরুষের হাত ধরে....
লেখক : ও আচ্ছা, আপনি ছলিমুদ্দিন।
ছলিমুদ্দিন : হ্যা ছলিমুদ্দিন। আপনি আমার জন্যে একটা ভালাে নাম পর্যন্ত খুঁজে পান নি। নাম দিয়েছেন ছলিমুদ্দিন। সুন্দর, শােভন, আনন্দদায়ক কিছুই আপনি আমার জন্যে রাখেন নি। একটি ভালাে নাম কি আমার হতে পারত না?
লেখক : না, পারত না। আপনার জন্ম হয়েছে কৃষক পরিবারে। আপনার বাবা একজন বর্গাদার। সে তার পুত্রদের এ রকম নামই রাখবে। একজন কৃষক তার পুত্রের নাম নিশ্চয়ই আবরার চৌধুরী রাখবে না।
ছলিমুদ্দিন : আপনি ইচ্ছা করলে সবই সম্ভব। কলম আপনার হাতে। আপনি
ইচ্ছা করলেই কোর্টে এফিডেভিট করে আমার নাম পাল্টে আবরার চৌধুরী করতে পারেন। আপনি ইচ্ছা করলেই বিদেশি কোনাে কোম্পানিতে আমার চমৎকার একটা চাকরি হতে পারে। ছলিমুদ্দিন নামটা যদি আপনার এতই প্রিয় হয়, বেশ ভাে আপনার ড্রাইভারের ঐ নাম দিয়ে দিন।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লেখক : তা সম্ভব নয়। | ছলিমুদ্দিন ; কেন সম্ভব নয়? একের পর এক আপনার কারণে আমি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছি। কেন আপনি এ রকম করছেন? লেখক : এ রকম করছি কারণ, তােমার মাধ্যমে আমি সমাজকে তুলে আনছি। তুমি আলাদা কেউ নও। তুমি এই সমাজেরই একজন প্রতিনিধি। তােমাকে দেখে পাঠক চমকে উঠবে। ঘা খাবে।
ছলিমুদ্দিন : আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? নিজের লেখা পড়ে দেখুন, বয়সে আমি আপনার চেয়ে বড়। এ জীবনে তাে আপনি আমাকে কিছুই দেন নি। সামান্য সম্মানটুকু অন্তত দিন।
লেখক : আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করবেন। এখন থেকে আপনি করে বলব।
ছলিমুদ্দিন : ধন্যবাদ, আপনাকে যতটা হৃদয়হীন মনে করেছিলাম তত হৃদয়হীন আপনি নন। এটাই যখন করলেন তখন আরেকটু করুন। আমার প্রেমিকাকে আপনি ফিরিয়ে দিন। অর্থ বিত্ত, কিছুই চাই না। আমি পথে–পথে না খেয়ে ঘুরতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমার প্রেমিকাকে ফেরত দিন।
লেখক : তা হয় না।
ছলিমুদ্দিন : অবশ্যই হয়। আপনি নিজে তাে আপনার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আরাম করে বসে আছেন। আমি কেন বসব না? সমাজ দোষ করতে পারে, রাষ্ট্র দোষ করতে পারে—আমি তাে কোনাে দোষ করি নি। আমি কেন শাস্তি পাব?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লেখক : এই পচা সমাজে নির্দোষ যারা, তারাই শাস্তি পায়।
ছলিমুদ্দিন : সমাজ করুক। আপনি কেন করবেন? আপনি মানবপ্রেমিক এক জন লেখক। আপনি আমার প্রতি করুণা করুন। আপনি শেষের কুড়িটা পাতা ছিড়ে ফেলুন। আবার নতুন করে লিখুন। এর মধ্যে আমি আপনার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।
লেখক : আপনাকে হাত জোড় করে অনুরােধ করছি, আপনি এ ঘর থেকে যান। ছলিমুদ্দিন : না, আমি যাব না। লেখক : যাবেন না মানে? ছলিমুদ্দিন : মানে হচ্ছে, যাব না। প্রয়ােজন হলে আপনাকে খুন করব। লেখক; খুন করবেন।
ছলিমুদ্দিন : হা। অস্ত্র নিয়ে এসেছি—এই দেখুন। এগার ইঞ্চি ছােরা। এটা সােজা আপনার পেটে বসিয়ে দেব। আমি কেন আত্মহত্যা করব? আমার কি দায় পড়েছে?
লেখক : {ভয় পেয়ে) জরী, জরী, একটু ওঠ তাে। এই জরী।
নাটক এক পর্যায়ে থেমে গেল। বজলু সাহেব ফিরে এসেছেন। পুষ্প তার সঙ্গে আছে। পুষ্পের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। বজলু সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, এই মজনু, চা দে। আসিফ স্টেজ থেকে নেমে এল। বজলু
তাকে নিয়ে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। তিক্ত গলায় বললেন, ‘অপমানের চুড়ান্ত হয়েছি। শালার নাটক–ফাটক ছেড়ে দেব।‘
আসিফ বলল, মেয়েকে তাে নিয়েই এসেছেন দেখতে পাচ্ছি।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘ভেতরের ঘটনা জানলে এটা বলতে না। আমি নাটকের কথাটা বলতেই বাড়িতে আগুন ধরে গেল। সবাই এমন ভাব করতে লাগল, যেন আমি একজন মেয়ের দালাল। বুড়ােমতাে এক লােক, সম্ভবত মেয়ের চাচা–টাচা কিছু হবে, সরু গলায় বলছে, ‘এটা ভদ্রলােকের বাড়ি। এটা ভদ্রলােকের বাড়ি। রাগে আমার গা জ্বলে গেল। বাটা বলে কী? আমি কি অভদ্রলােক নাকি?
‘রাজি করালেন কী ভাবে?
‘আমাকে কিছু করতে হয় নি, মেয়ে নিজেই উল্টে গেল। সে নাটক করবেই। কান্নাকাটি করে বিশ্রী এক কাণ্ড, এমন অবস্থা যে চলেও আসতে পারি না। বসেও থাকতে পারি না। ব্যাঙের সাপ গেলার মতাে অবস্থা। এরকম সুপার ইমােশনাল মেয়ে নিয়ে কাজ করা যাবে না। শুধু শুধু পরিশ্রম।
আসিফ বলল, ‘আমি মেয়েটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলি। তারপর ছ’ নম্বর দৃশ্যটা হােক। বাড়তি লােক চলে যেতে বলুন। মেয়েটা পারবে কী পারবে না আজই বােঝা যাবে।
তােমার মনে হয় পারবে? ‘হা পারবে। ভালােই পারবে।‘
আসিফ পুষ্পকে বলল, ‘এস আমরা ঐ কোণার দিকে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। গল্পগুজব করলে টেনশান কমবে। অভিনয় করা সহজ হবে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘আমার মধ্যে কোনাে টেনশান নেই।
‘আছে। যথেষ্ট আছে। টেনশানের সময় মানুষ খুব উঁচু পর্দায় কথা বলে; তুমিও তাই বলছ। এস আমার সঙ্গে।
পুষ্প এগিয়ে গেল। আসিফ বলল, ‘চা খাবে? পুষ্প বলল, ‘না।‘
একটু খাও। চা খাবার সময় মানুষ একটা কাজের মধ্যে থাকে। কাজের মধ্যে থাকলে আপনাআপনি মানুষ খানিকটা ফ্রি হয়ে যায়। তখন কথাবার্তা সহজ হয়।
এত কিছু আপনি জানেন কী ভাবে? ‘রাত–দিন তাে এটা নিয়েই ভাবি। কাজেই কিছু কিছু জানি। পুষ্প চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার কি মনে হয় আমি পারব?
“অবশ্যই পারবে। যারা অভিনয় করে না, তারা মনে করে অভিনয় ব্যাপারটা বুঝি খুবই কঠিন। আসলে তা না। অভিনয় খুবই সহজ।
‘আপনি আমাকে সাহস দেয়ার জন্যে এটা বলছেন।’
‘মােটেই না। তােমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। মনে কর তুমি এক জনের চরিত্রে অভিনয় করছ। অভিনয়ের অংশটা হচ্ছে প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তােমার রিএ্যাকশান। এখন দেখ এই অভিনয়ের কোনাে সেট প্যাটার্ন নেই। পৃথিবীতে অসংখ্য ধরনের মানুষ। একেক জন মানুষ মৃত্যুর খবর একেকভাবে নেবে। এর যে কোনাে একটা করলেই হল। তুমি গড়াগড়ি করে কাঁদলেও ঠিক আছে, আবার স্তব্ধ হয়ে
গেলেও ঠিক আছে।
‘এত সােজা?
‘হ্যা, এই অংশটা সােজা। তবে সবচে কঠিন কাজ হচ্ছে,
একবার একটা প্যাটার্ন নিয়ে নিলে গােটা নাটকে তা বজায় রাখতে হবে। বুঝতে পারছ?
‘পারছি।
এই নাটকে তুমি বালিকা বধূর চরিত্রে অভিনয় করছ। ঐ চরিত্রের একটা প্যাটার্ন তােমাকে তৈরি করতে হবে। কোনটা তুমি নেবে? সবচে সহজটা নাও, যেটা তুমি জান।‘
কোনটা আমি জানি?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
তােমার নিজের চরিত্র ভূমি জান। ঐ চরিত্রটাই তুমি স্টেজে নিয়ে আসবে। মঞ্চে তুমি দেখবে তােমার স্বামীকে। এই স্বামী কিন্তু মিথ্যা স্বামী না। মঞ্চে সে তােমার সত্যিকার স্বামী। এটা যখন তােমার মনে হবে তখনই তুমি পাশ করে গেলে।
‘আমার ভয় ভয় লাগছে।
‘কোনাে ভয় নেই। তুমি সংলাপগুলাে একটু দেখে নিয়ে মঞ্চে যাও, আমি তােমার ভয় কাটিয়ে দিচ্ছি।
জি আচ্ছা।
‘পুষ্প, আরেকটা কথা তােমাকে বলি শােন, এটাও খুব জরুরি।
(চলবে)