আজ শুক্রবার। ডাঃ জামান শুক্রবারে রুগী দেখেন না, তবু দু’তিন জন রুগী বাইরের বারান্দায় বসে আছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে তারা কিছুতেই যাবে না। লীনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তাকেই ধরল, আপা ডাক্তার সাহেবকে একটু বলে দেন। খুব বিপদে পড়েছি।
লীনা মার শােবার ঘরে ঢুকতেই একসঙ্গে সবাই হৈ–চৈ করে উঠল। লীনার বড়
বােন দীনা বলল, ‘ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রিকশা নিয়ে চলে এলি? তােকে আনতে গাড়ি গেছে। সবচে ছােট বােন নীনা বলল, ‘একটা লেটেস্ট মডেল গাড়িতে চড়া মিস করলে আপা। দুলাভাই নতুন গাড়ি কিনেছে। বড় আপাদের এখন দুটো গাড়ি। সুলতানা বললেন, ‘জামাইকে আনলি না কেন? আমরা নাটক করি না বলে বুঝি আমাদের বাড়িতে আসা যাবে না।‘ | নাটকের একটা খোঁচা না দিয়ে সুলতানা মেজো জামাই সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না। আজও পারলেন না। লীনার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সহজ স্বরে বলল, ‘ওর কাজ আছে মা, রাত দশটার আগে ছাড়া পাবে না।
সুলতানা তিক্ত গলায় বললেন, ‘আমার তিন জামাইয়ের মধ্যে মেজোটাই সবচে কাজের হয়েছে। রাত দশটা–এগারটার আগে কোনােদিন ছাড়া পায় না।
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, ‘জামাই প্রসঙ্গ থাক মা। সবাই তাে আর একরকম হয় না। কেউ কাজের হয়, কেউ হয় অকাজের—কি আর করা। কী জন্যে ডেকেছু বল? কারাে জনাদিন–টিন নাকি? আমি তাে কিছু মনে করতে পারলাম না। ফুল নিয়ে এসেছি। যার জন্মদিন সে নিয়ে নিক। | মীনা ছুটে এসে ফুল নিয়ে নিল। নীনার কাছ থেকে ফুল নেবার জন্যে বড় জামাই ঝাপিয়ে পড়ল। নীনা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ আমার ফুলগুলাে সেভ কর।‘ বলেই সে ফুলের তােড়া ক্রিকেট বলের মতাে ছুঁড়ে মারল স্বামীর দিকে। সুলতানা কপট বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন, ‘এরা সব সময় কি যে যন্ত্রণা করে। এই তােরা চা খাবি না কফি খাবি? যেটাই খাবি একটা। দু‘তিন পদের জিনিস বানাতে পারব না।‘
দীনা ও দীনার স্বামী জামান সাহেব বললেন, ‘কফি। নীনা বলল, ‘চা। নীনার স্বামী লুণ্ডুল হক চেচিয়ে বলল, ‘সরবত।‘
চারদিকে তুমুল হাসি শুরু হল। লীনা মনে–মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই সব চমৎকার হাসিখুশির মুহূর্তগুলােতে আসিফ কখনাে অংশ নিতে পারে না! মাঝে–মাঝে সে যে উপস্থিত থাকে না তা নয়। থাকে, কিন্তু বড়ই বিব্রত বােধ করে। দেখে মনে হয় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
সবাইকে একত্র করার উদ্দেশ্য ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। জামান সাহেব বললেন, রাতে খাওয়া–দাওয়ার পর অফিসিয়ালী সেটা বলা হবে। টপ সিক্রেট। এখন আমি আমার নতুন গাড়িতে সবাইকে নিয়ে একটা চক্কর দেব। এখান থেকে সাভার যাবসাভার থেকে ফিরে আসব। টাটকা হাওয়ায় খিদেটা চাগবে। আমাকে বিশ মিনিটের জন্যে ক্ষমা করতে হবে। আমার কয়েকটা রুগী বসে আছে। বিদেয় করে আসি।‘
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
লুৎফুল বলল, ছুটির দিনেও রুগী দেখেন। এত টাকা দিয়ে করবেন কী দুলাভাই? লােজন ব্লাড প্রেসারে মারা যায়—আপনি দেখি টাকার প্রেসারে মারা যাবেন।
| জামান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। সুখী মানুষের হাসি। সুখী মানুষ অতি তুচ্ছ রসিকতায় হেসে ভেঙে পড়তে পারে।
| নিমন্ত্রণের রহস্য জানা গেল রাতের খাবারের পর। জামান সাহেব ছােটখাট একটা বক্তৃতা দিলেন। তিনি সবাইকে নিয়ে কাশ্মীর যেতে চান। শুধু কাশ্মীর না—আগ্রা, জয়পুর এবং কাশীর। থাকা খাওয়ার যাবতীয় খরচ তাঁর। দুই শ্যালিকা এবং শাশুড়ির টিকিটও উনি কাটবেন। অন্য কেউ যেতে চাইলে তাদের টিকিট তাদের কাটতে হবে।
এই ভ্রমণে বাচ্চারা কেউ যাবে না।
লুৎফুল বলল, ‘আমার টিকিট কাটবেন না, এর মানেটা কি দুলাভাই? ‘আমার কর্তব্য হচ্ছে শ্যালিকা পর্যন্ত, এর বাইরে না।‘ নীনা বলল, আপনি কি সত্যি মিন করছেন দুলাভাই? তােমার সন্দেহ আছে নাকি?
‘হ্যা আছে। আপনার মধ্যে যে এক জন হাতেম তাই লুকিয়ে আছে সেটা জানা ছিল না।
এখন জানলে?‘ ‘তা জানলাম। যাচ্ছি কবে আমরা?
‘সামনের মাসের এগার তারিখে, ফিরব বাইশ তারিখ। দীনা, তুমি ওদের টিকিট ওদের দিয়ে দাও।
সাজঘর (পর্ব-১২): হুমায়ূন আহমেদ
নীনা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘টিকিটও কেটে ফেলেছেন? ‘অফকোর্স। আমি কাঁচা কাজ করি না। ঢাকা–দিল্লী–ঢাকা রিটার্ন টিকিট।
লীনা কিছুই বলল না। চুপচাপ বসে রইল। জামান সাহেব বললেন, ‘আমার মেজো শালীকে দেখে মনে হচ্ছে তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে। লীনা তুমি এমন মুখ কালাে করে বসে আছ কেন?
‘আমার শরীরটা ভালাে না দুলাভাই।‘
তুমি যাচ্ছ তাে। “না দুলাভাই।‘
না কেন? তােমার বরকে ছেড়ে এই দশটা দিন তুমি থাকতে পারবে না?‘ “তা না। ‘তাহলে অসুবিধাটা কোথায়। ‘অসুবিধা কিছু নেই।‘
জামান সাহেব নিজেই লীনাকে গাড়ি করে পৌছে দিলেন। কোমল গলায় বললেন, ‘তােমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেতে চাচ্ছ না!