প্রপার গাইডেন্স দরকার।
ক্লাস এইট পর্যন্ত আসিফ প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হল। তারপর একদিন খুবই স্বাভাবিক গলায় বাবাকে এসে বলল, আমি আর পড়াশােনা করব না বাবা। সিরাজুদ্দিন সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘সে কী!
আসিফ সহজ স্বরে বলল, ‘আমার ভালাে লাগে না বাবা। সিরাজুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, ‘আজ আর কাল এই দুদিন পড়তে হবে । বিশ্রাম কর। মাঝে–মাঝে বিশ্রামের প্রয়ােজন আছে।
বিশ্রাম না বাবা। আমি আর পড়াশােনাই করব না।” ‘টান দিয়ে কান ছিড়ে ফেলব হারামজাদা। ‘কান ছিড়ে ফেললেও পড়ব না। সিরাজুদ্দিন সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
তখন তাঁর তৃতীয় মেয়ের বিয়ের আয়ােজন চলছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। কিছু বলা বা শাসন করার মতাে মানসিক অবস্থা তার নেই। তিনি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। আসিফের মা চিররুগ্না মহিলা। সংসারের কোনাে ব্যাপারেই তাঁর কোনাে ভূমিকা নেই। তবু তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাদ দাও। কয়েকটা দিন যাক৷ ছেলে মানুষ। বয়সটা দেখবে না?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
সিরাজুদ্দিন অবাক হয়ে লক্ষ করলেন আসিফ পড়াশােনা ছেড়ে দিয়েছে। সকালবেলা বের হয়। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘােরে। স্টার ড্রামাটিক ক্লাবে নাটকেও নাকি নাম দিয়েছে। রাত আটটা নটা পর্যন্ত রিহার্সেল হয়। রিহার্সেল শেষ করে সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরে। সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে
থাকেন আর হতভম্ব হয়ে ভাবেন এসব কী হচ্ছে? হচ্ছেটা কী?
স্টার ড্রামাটিক ক্লাবের এ্যানুয়েল নাটক হল জেলা স্কুলের মাঠে। বিরাট হৈ–চৈ। সিরাজুদ্দিন সাহেব নাটক দেখতে গেলেন। ত্রিপুরা রাজপরিবার নিয়ে জমকালাে নাটক। তিন রাজকুমারের গল্প। বড় রাজকুমার, মধ্যম রাজকুমার এবং ছােট রাজকুমার। বড় এবং ছােট রাজকুমারের অত্যাচারে মধ্যম রাজকুমার জর্জরিত।
একদিন তার দু‘চোখ নষ্ট করে দিয়ে দুই ভাই তাকে গভীর বনে ফেলে দিয়ে এল। ক্লান্ত শ্রান্ত মধ্যম রাজকুমার যে দিকে যেতে চায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। কোনােমতে উঠে দাঁড়ায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় এবং কাঁদতে কাঁদতে বলে, কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও—কাছে ‘এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
মধ্যম রাজকুমারের অভিনয় দেখে সিরাজুদ্দিন সাহেব অভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়তে লাগল। বুকের মধ্যে হু–হু করতে লাগল। চারদিকে প্রচণ্ড হাততালি পড়ছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে তাঁর কানে বাজছে মধ্যম কুমারের হাহাকারকে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।‘
গলায় একটা রূপার মেডেল ঝুলিয়ে আসিফ বাড়ি ফিরল। সিরাজুদ্দিন সাহেব আগেই পৌছেছেন। একা একা অন্ধকার বারান্দায় জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁকে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় তিনি মগ্ন। আসিফ ঘরে ঢুকতেই তাঁর আচ্ছন্ন ভাব দূর হল। শান্ত গলায় বললেন, ‘আয় আমার সাথে।
ছেলেকে তিনি বাসার পেছনের কুয়ােতলায় নিয়ে গেলেন। সহজ গলায় বললেন, ‘গলার মেডেলটা খুলে কুয়ার মধ্যে ফেল।
তাঁর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আসিফ কোনাে কথা না বলে মেডেল ফেলে দিল। গহীন কুয়া। মনে হল যেন দীর্ঘ সময় পর পানিতে ঝপ করে শব্দ হল।
সিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, এখন বল, আর কোনােদিন অভিনয় করব না। বল, বল হারামজাদা।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ কিছু বলল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, ‘বল, আর কোনােদিন অভিনয় করব না। নয়ত তােকে আজ খুন করে ফেলব। বল, হারামজাদা। বল।‘
আসিফ ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কেন বাবা? বল তুই। বল। নয়ত খুন করে ফেলব।
সিরাজুদ্দিন সাহেবের চোখে–মুখে উন্মাদ ভঙ্গি। তিনি ছেলের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। দু’হাতে চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘বল আর অভিনয় করব না। বল।‘
আসিফ যন্ত্রের মতাে বলল, আর অভিনয় করব না।‘ | সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের মাথা কুয়ার মুখের কাছে ধরলেন। হিস হিস করে ললেন, ‘বল, আবার বল। তিন বার বল।
আসিফ বলল। গহীন কুয়া সেই শব্দ ফেরত পাঠাল। কুয়ার তল থেকে গমগমে থচ শীতল একটি স্বর ফিরে এল। আমি অভিনয় করব না... অভিনয় করব না...
করব না।‘
আসিফ তার কথা রেখেছিল। বাবা জীবিত থাকাকালীন সময়ে সে অভিনয় করে নি। তার জীবনের দ্বিতীয় অভিনয় সে করে বাবার মৃত্যুর এক বছর পর। গ্রাম্য কবিয়ালের একটা ভূমিকা। যে কথায় কথায় পদ বাঁধে। সেই পদ লােকজনদের বলে বলে শােনায় এবং গভীর আগ্রহে বলে, ‘পদটা কেমন হইছে ভাইজান এটু কন দেহি। বুকের মইধ্যে গিয়া ধরে, ঠিক না? আহারে কী পদ বানছি
হলুদ পাখি সােমার বরণ কালা তাহার চউখ, ছােট্ট একটা পাখির ভিতরে কত্ত বড় দুখ ও আমার সােনা পাখিরে। ও আমার ময়না পাখিরে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
গ্রাম্য গীতিকারের অভিনয় করে সে ময়মনসিংহ শহরে একটা হৈ–চৈ ফেলে দিল। অভিনয়ের শেষে স্টেজের পেছনে গ্লাসে করে চা খাচ্ছে, জেলা স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকে বললেন, ‘আসিফ একটু বাইরে আস তাে, ডিসট্রিক জাজ ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তােমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
‘চা–টা শেষ করে আসি স্যার। ‘চা পরে খাবে—আস তাে তুমি।
আসিফ বাইরে এসে দেখে ওয়াদুদুর রহমান সাহেব হাতে চুরুট নিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে টানছেন। তাঁর গা ঘেঁষে লম্বা রােগামতন একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির মুখে দীঘির শীতল জলের মতাে ঠাণ্ডা একটা ভাব। মেয়েটি কিছু বলল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, ‘ইয়াং ম্যান, তােমার অভিনয় দেখে আমার মেয়ে খুব ইমপ্রেসড। ওয়েল ডান।
আসিফ কী বলবে বুঝতে পারল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, ‘আমার মেয়ের খুব ইচ্ছা তুমি একদিন আমাদের বাসায় এসে লাঞ্চ বা ডিনার কর। আমি নিজেও খুশি হব।
‘জ্বি আচ্ছা, আমি যাব।
ভেরি গুড। ইয়াং ম্যান, পরে একদিন দেখা হবে, কেমন?
আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা বলল, ‘আপনি আজই চলুন না। আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে।
আপনাকে বাসায় পৌছে দেবে। প্লিজ।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব শীতল গলায় বললেন, ‘বেচারা অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে আছে। আজ থাক। কোনাে একটা ছুটির দিনে বরং....।‘
‘না বাবা আজ। ভালাে লাগাটা থাকতে থাকতে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। আপনার কি খুব অসুবিধা হবে? প্লিজ আসুন না, প্লিজ।
আসিফ গেল। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ভাত খেল।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের স্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন বাবা কী করেন? ভাই বােন কজন? বােনদের কোথায় বিয়ে হয়েছে? সে
পড়ছে? ম্যাট্রিক রেজাল্ট কী? আই. এ তে কী রেজাল্ট?
লীনা এক সময় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘চুপ কর তাে মা। কি শুধু উকিলের মতাে প্রশ্ন রছ। ওকে ভাত খেতে দাও। | মা চুপ করলেন না। প্রশ্ন করা ছাড়াও তাঁর পরিবারের সমস্ত তথ্য দিয়ে দিলেন। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়ছে নিউ জার্সি স্টেট কলেজে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই ডাক্তার। সম্প্রতি এফ আর সি এস করেছে। এখন আছে পিজিতে। লীনা দ্বিতীয় মেয়ে। ম্যাট্রিকে চারটা লেটার এবং স্টার মার্ক নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে।
আই, এ–তে খুব ভালাে করতে পারে নি। সায়েন্স থেকে আর্টস–এ আসায় একটু অসুবিধা হয়েছে। তবু ফার্স্ট ডিভিশন ছিল। এখন পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। হলে থাকে। গরমের ছুটি কাটাতে এসেছে। ছােট মেয়েকে শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলেন। কলাভবনের ছাত্রী। তবে ওর সেখানে থাকতে ভালাে লাগছে না। গরমের সময় খুব গরম পড়ে। মেয়ের আবার গরম সহ্য হয় না।
ফেরার পথে লীনা তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এল। নরম গলায় বলল, ‘মা নিজেদের কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। আপনি আবার কিছু মনে করলেন নাতাে?”
আসিফ বলল, ‘না। কিছু মনে করি নি।
‘আমি আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি। সবার সামনে দিতে লজ্জা লাগল। আপনি যদি এটা নেন আমি খুব খুশি হব। আপনার অভিনয় আমার কী যে ভালাে লেগেছে! অনেকদিন ধরেই আমার মনটা অন্ধকার স্যাতস্যাতে হয়ে ছিল। হঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলাে পড়ল। খুব কাব্য করে কথা বলে ফেলেছি! কিছু মনে করবেন না, এই নিন। (চলবে)