সাজঘর (পর্ব-৭): হুমায়ূন আহমেদ

প্রপার গাইডেন্স দরকার। 

ক্লাস এইট পর্যন্ত আসিফ প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলতারপর একদিন খুবই স্বাভাবিক গলায় বাবাকে এসে বলল, আমি আর পড়াশােনা করব না বাবাসিরাজুদ্দিন সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘সে কী

সাজঘরআসিফ সহজ স্বরে বলল, আমার ভালাে লাগে না বাবাসিরাজুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, আজ আর কাল এই দুদিন পড়তে হবে বিশ্রাম করমাঝেমাঝে বিশ্রামের প্রয়ােজন আছে। 

বিশ্রাম না বাবাআমি আর পড়াশােনাই করব নাটান দিয়ে কান ছিড়ে ফেলব হারামজাদাকান ছিড়ে ফেললেও পড়ব নাসিরাজুদ্দিন সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। 

তখন তাঁর তৃতীয় মেয়ের বিয়ের আয়ােজন চলছে। বাড়ি ভর্তি মেহমানকিছু বলা বা শাসন করার মতাে মানসিক অবস্থা তার নেইতিনি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেনআসিফের মা চিররুগ্না মহিলাসংসারের কোনাে ব্যাপারেই তাঁর কোনাে ভূমিকা নেইতবু তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাদ দাওকয়েকটা দিন যাক৷ ছেলে মানুষ। বয়সটা দেখবে না

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

সিরাজুদ্দিন অবাক হয়ে লক্ষ করলেন আসিফ পড়াশােনা ছেড়ে দিয়েছেসকালবেলা বের হয়সারাদিন কোথায় কোথায় ঘােরেস্টার ড্রামাটিক ক্লাবে নাটকেও নাকি নাম দিয়েছেরাত আটটা নটা পর্যন্ত রিহার্সেল হয়রিহার্সেল শেষ করে সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরেসিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে 

থাকেন আর হতভম্ব হয়ে ভাবেন এসব কী হচ্ছে? হচ্ছেটা কী

স্টার ড্রামাটিক ক্লাবের এ্যানুয়েল নাটক হল জেলা স্কুলের মাঠেবিরাট হৈচৈসিরাজুদ্দিন সাহেব নাটক দেখতে গেলেনত্রিপুরা রাজপরিবার নিয়ে জমকালাে নাটকতিন রাজকুমারের গল্পবড় রাজকুমার, মধ্যম রাজকুমার এবং ছােট রাজকুমারবড় এবং ছােট রাজকুমারের অত্যাচারে মধ্যম রাজকুমার জর্জরিত

একদিন তার দুচোখ নষ্ট করে দিয়ে দুই ভাই তাকে গভীর বনে ফেলে দিয়ে এলক্লান্ত শ্রান্ত মধ্যম রাজকুমার যে দিকে যেতে চায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়কোনােমতে উঠে দাঁড়ায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় এবং কাঁদতে কাঁদতে বলে, কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হওকাছে এস ভাইদৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

মধ্যম রাজকুমারের অভিনয় দেখে সিরাজুদ্দিন সাহেব অভিভূত হয়ে পড়লেনতাঁর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়তে লাগলবুকের মধ্যে হুহু করতে লাগলচারদিকে প্রচণ্ড হাততালি পড়ছেসেই শব্দ ছাপিয়ে তাঁর কানে বাজছে মধ্যম কুমারের হাহাকারকে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাইদৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়‘ 

গলায় একটা রূপার মেডেল ঝুলিয়ে আসিফ বাড়ি ফিরলসিরাজুদ্দিন সাহেব আগেই পৌছেছেনএকা একা অন্ধকার বারান্দায় জায়নামাজে বসে আছেনতাঁকেদেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় তিনি মগ্নআসিফ ঘরে ঢুকতেই তাঁর আচ্ছন্ন ভাব দূর হলশান্ত গলায় বললেন, আয় আমার সাথে। 

ছেলেকে তিনি বাসার পেছনের কুয়ােতলায় নিয়ে গেলেনসহজ গলায় বললেন, গলার মেডেলটা খুলে কুয়ার মধ্যে ফেল। 

তাঁর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আসিফ কোনাে কথা না বলে মেডেল ফেলে দিলগহীন কুয়ামনে হল যেন দীর্ঘ সময় পর পানিতে ঝপ করে শব্দ হল। 

সিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, এখন বল, আর কোনােদিন অভিনয় করব নাবল, বল হারামজাদা। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ কিছু বলল নাশক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলসিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, বল, আর কোনােদিন অভিনয় করব নানয়ত তােকে আজ খুন করে ফেলববল, হারামজাদাবল‘ 

আসিফ ক্ষীণ গলায় বলল, কেন বাবা? বল তুইবলনয়ত খুন করে ফেলব। 

সিরাজুদ্দিন সাহেবের চোখেমুখে উন্মাদ ভঙ্গিতিনি ছেলের উপর ঝাপিয়ে পড়লেনদুহাতে চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, বল আর অভিনয় করব নাবল‘ 

আসিফ যন্ত্রের মতাে বলল, আর অভিনয় করব না| সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের মাথা কুয়ার মুখের কাছে ধরলেনহিস হিস করে ললেন, বল, আবার বলতিন বার বল। 

আসিফ বললগহীন কুয়া সেই শব্দ ফেরত পাঠালকুয়ার তল থেকে গমগমে থচ শীতল একটি স্বর ফিরে এলআমি অভিনয় করব না... অভিনয় করব না... 

করব না‘ 

আসিফ তার কথা রেখেছিলবাবা জীবিত থাকাকালীন সময়ে সে অভিনয় করে নিতার জীবনের দ্বিতীয় অভিনয় সে করে বাবার মৃত্যুর এক বছর পরগ্রাম্য কবিয়ালের একটা ভূমিকাযে কথায় কথায় পদ বাঁধেসেই পদ লােকজনদের বলে বলে শােনায় এবং গভীর আগ্রহে বলে, পদটা কেমন হইছে ভাইজান এটু কন দেহিবুকের মইধ্যে গিয়া ধরে, ঠিক না? আহারে কী পদ বানছি 

হলুদ পাখি সােমার বরণ কালা তাহার চউখ, ছােট্ট একটা পাখির ভিতরে কত্ত বড় দুখ ও আমার সােনা পাখিরেআমার ময়না পাখিরে

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

 গ্রাম্য গীতিকারের অভিনয় করে সে ময়মনসিংহ শহরে একটা হৈচৈ ফেলে দিলঅভিনয়ের শেষে স্টেজের পেছনে গ্লাসে করে চা খাচ্ছে, জেলা স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকে বললেন, আসিফ একটু বাইরে আস তাে, ডিসট্রিক জাজ ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তােমার সঙ্গে কথা বলতে চান। 

চাটা শেষ করে আসি স্যাচা পরে খাবেআস তাে তুমি। 

আসিফ বাইরে এসে দেখে ওয়াদুদুর রহমান সাহেব হাতে চুরুট নিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে টানছেনতাঁর গা ঘেঁষে লম্বা রােগামতন একটি মেয়ে দাঁড়িয়েমেয়েটির মুখে দীঘির শীতল জলের মতাে ঠাণ্ডা একটা ভাবমেয়েটি কিছু বলল নাওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, ইয়াং ম্যান, তােমার অভিনয় দেখে আমার মেয়ে খুব ইমপ্রেসডওয়েল ডান। 

আসিফ কী বলবে বুঝতে পারল নাওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, আমার মেয়ের খুব ইচ্ছা তুমি একদিন আমাদের বাসায় এসে লাঞ্চ বা ডিনার করআমি নিজেও খুশি হব। 

জ্বি আচ্ছা, আমি যাব। 

ভেরি গুডইয়াং ম্যান, পরে একদিন দেখা হবে, কেমন

আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা বলল, আপনি আজই চলুন নাআমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে

 আপনাকে বাসায় পৌছে দেবেপ্লিজ। 

ওয়াদুদুর রহমান সাহেব শীতল গলায় বললেন, বেচারা অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে আছেআজ থাককোনাে একটা ছুটির দিনে বরং....‘ 

না বাবা আজভালাে লাগাটা থাকতে থাকতে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছেআপনার কি খুব অসুবিধা হবে? প্লিজ আসুন না, প্লিজ। 

আসিফ গেলওয়াদুদুর রহমান সাহেবের পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ভাত খেল। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

ওয়াদুদুরহমান সাহেবের স্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন বাবা কী করেন? ভাই বােন কজন? বােনদের কোথায় বিয়ে হয়েছে? সে 

পড়ছে? ম্যাট্রিক রেজাল্ট কী? আই. তে কী রেজাল্ট? 

লীনা এক সময় বিরক্ত হয়ে বলল, চুপ কর তাে মাকি শুধু উকিলের মতাে প্রশ্ন রছওকে ভাত খেতে দাও| মা চুপ করলেন নাপ্রশ্ন করা ছাড়াও তাঁর পরিবারের সমস্ত তথ্য দিয়ে দিলেনতার তিন মেয়ে এক ছেলেছেলে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়ছে নিউ জার্সি স্টেট কলেজেবড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই ডাক্তারসম্প্রতি এফ আর সি এস করেছেএখন আছে পিজিতেলীনা দ্বিতীয় মেয়েম্যাট্রিকে চারটা লেটার এবং স্টার মার্ক নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে

আই, তে খুব ভালাে করতে পারে নিসায়েন্স থেকে আর্টসআসায় একটু অসুবিধা হয়েছেতবু ফার্স্ট ডিভিশন ছিলএখন পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেহলে থাকেগরমের ছুটি কাটাতে এসেছে। ছােট মেয়েকে শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলেনকলাভবনের ছাত্রীতবে ওর সেখানে থাকতে ভালাে লাগছে নাগরমের সময় খুব গরম পড়েমেয়ের আবার গরম সহ্য হয় না। 

ফেরার পথে লীনা তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এলনরম গলায় বলল, মা নিজেদের কথা বলতে খুব পছন্দ করেনআপনি আবার কিছু মনে করলেন নাতাে?” 

আসিফ বলল, নাকিছু মনে করি নি। 

আমি আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছিসবার সামনে দিতে লজ্জা লাগলআপনি যদি এটা নেন আমি খুব খুশি হবআপনার অভিনয় আমার কী যে ভালাে লেগেছে! অনেকদিন ধরেই আমার মনটা অন্ধকার স্যাতস্যাতে হয়ে ছিলহঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলাে পড়লখুব কাব্য করে কথা বলে ফেলেছি! কিছু মনে করবেন না, এই নিন। (চলবে)

সাজঘর (পর্ব-৬): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *