সাড়েপাঁচ ঘণ্টার গল্প-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

সাড়েপাঁচ ঘণ্টার গল্প-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

সাড়েপাঁচ ঘণ্টার গল্প

 

রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

১০/০৮/২৪

 

স্কুলজীবনের শেষ সাড়েতিনবছর আমার কেটেছিল পুরুলিয়ার এক হোষ্টেলে। আর পাঁচটা স্কুলের মতো সেখানেও ছুটি হতো বছরে তিনবার; গরমের ছুটি, পূজোর ছুটি আর শীতের ছুটি। প্রত্যেক ছুটির শেষে বাড়ি থেকে হোষ্টেল ফিরে যাবার ব্যাপারটা ছিল মোটামুটি এক মহোৎসব। কাকভোরের ট্রেণে রওনা হয়ে সন্ধ্যের মুখে ধানবাদ পৌঁছে সেখানে রাত্রিবাস। পরদিন সকালে সেখান থেকে বাস ধরে শেষদুপুরে হোষ্টেল পৌঁছতাম। অন্যভাবে গেলে সেই একই ট্রেণ ধরে বোলপুরে পৌঁছে ওখান থেকে বাস ধরে দুর্গাপুর পৌঁছনো। সেখানে রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার বাস ধরে সেই শেষদুপুরে হোষ্টেল পৌঁছনো। অর্থাৎ যেদিক দিয়েই যেতাম না কেন পুরো দুদিনের জার্নি। সেই তুলনায় হোষ্টেল থেকে বাড়ি পৌঁছতে বাস আর ট্রেণ মিলিয়ে লাগত মাত্র ঘণ্টাবারো। বাসে করে বর্দ্ধমান, সেখান থেকে ট্রেণ ধরে বাড়ি। এই জার্নিটা বেশ ভালো লাগতো তার বৈচিত্রতার কারণে।

 

আমাদের স্কুল ছিল পুরুলিয়া শহরের মাইল তিনেক বাইরে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তার ওপর। কাছেই ছিল বোঙ্গাবাড়ি গ্রাম। এদেশের গ্রামগুলোর নাম বেশ মজার; এখনও কানে বাজে –  বোঙ্গাবাড়ি, ছররা, দলদলি, হুড়া, বাঘমুণ্ডি, হেঁটলা, হেটগুগুই ইত্যাদি, ইত্যাদি। পুরুলিয়া বাসষ্ট্যাণ্ড থেকে ছেড়ে ঘড়ি ধরে ঠিক সকাল সোয়াছ’টায় আমাদের গেটের সামনে লাল রঙের বাসটা এসে দাঁড়াত। লম্বা রুটের এক্সপ্রেস বাস, ভাড়া বেশি, তাই সিট খুবএকটা খালি না থাকলেও ভীড়ে ঠাসাঠাসি নয়। রঙের জন্য সবার কাছে বাসটার পরিচিতি ছিল লালবাস নামে। বাসের গন্তব্য হুরা, কাশীপুর মোড়, ঝাঁটিপাহাড়ি, বাঁকুড়া, দুর্গাপুর, বর্দ্ধমান হয়ে কলকাতা। আমার গন্তব্য বর্দ্ধমান। পৌনে বারোটা নাগাদ সেখানকার ষ্টেশনের সামনে নামিয়ে দিত। সেখান থেকে বাড়ি যাবার ট্রেণ ধরে আরেকটা ঘণ্টা চারেকের যাত্রা। বাস আর ট্রেণের সময়ের মাঝে বর্দ্ধমান ষ্টেশনে আড়াই ঘণ্টার একটা সাময়িক যাত্রাবিরতি, যাকে এখনকার বিমানযাত্রার ভাষায় বলে লে-ওভার।

 

হোষ্টেলের একমাত্র আমিই স্কুলের সামনের ষ্টপেজ থেকে ঐ বাসে উঠতাম। কখনোসখনো বোঙ্গাবাড়ি গ্রামের দুএকটা পরিবার উঠত তাদের কাচ্চাবাচ্চা সমেত। তবে যেটা আমার নজর কাড়ত সেটা হচ্ছে ওরা যখনই উঠতো, পরিবারপিছু অন্তত দুটো করে ছাগল এদের সঙ্গে থাকতই থাকত। অবশ্য ছাগলগুলো বাসের ভেতর কারুর কোন অসুবিধা করতোনা, সীটের তলায় চুপচাপ বসে থাকতো। মাঝেসাঝে জুতোতে হাল্কা করে ঠেলা দিত। এরা সাধারণত পরের ষ্টপেজ ঝাঁটিপাহাড়িতে নেমে যেত। আমার ধারণা ওরা সেখানে ছাগলগুলো বিক্রীর জন্য নিয়ে যেত। আমার সঙ্গে লটবহর হিসেবে থাকত স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী কুচকুচে কালো রঙের মিলিটারি ট্রাঙ্ক যার সামনের ডানদিকে ধবধবে সাদা রঙ দিয়ে ইংরেজীতে বড়বড় অক্ষরে লেখা আমার নাম, ক্লাস আর স্কুলের নাম। স্কুলের দ্বিতীয় নিয়ম অনুসারে আমার পরনে থাকত স্কুল ইউনিফর্ম। ছুটিতে যাবার সময় ইউনিফর্ম পরে যাওয়ার নিয়ম ছিল। অর্থাৎ মাঝরাস্তা থেকে পালিয়ে যাবার কোন সুযোগই ছিলনা! অবশ্য ছুটিশেষে ফেরার সময় এই নিয়ম লাগু থকতোনা। বাস মোটামুটি ভর্তি থাকলেও বসার একটা জায়গা পেয়ে যেতাম, না পেলে কণ্ডাক্টার কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিত। দুর্গাপুর পর্যন্ত পুরোটাই ছিল সিঙ্গল রাস্তা। বাঁকুড়া পর্যন্ত ধুলোয় ভরা কাঁচা রাস্তা আর কালো পিচের রাস্তার মধ্যে চিরকালের গা ঠেলাঠেলি  মানে, অধিকার দখলের লড়াই!  ঝাঁটিপাহাড়ি আসতে আসতে কালো পিচ প্রায় নিশ্চিহ্ন; বাসের ভেতর, বাইরে মিলিয়ে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধুলোর কুয়াশায় মোড়া। সেই ধুলোর আবরণ একেবারে পাহাড়ি মেঘের মতো, যতই অস্বস্তি হোকনা কেন তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকতেই হবে। ঝাঁটিপাহাড়িতে বাস দাঁড়াতো মিনিটখানেকের জন্য। কণ্ডাকটার ‘বাঁকুড়া বাঁকুড়া’ বলে হাজার চেঁচালেও কাউকে সেরকম কোনদিন বাসে উঠতে দেখিনি। কারণ নিশ্চয় বাসের কৌলিন্য –  একে এক্সপ্রেস্ বাস, তায় আবার ভাড়া বেশি। পরের ষ্টপেজ বাঁকুড়া। আটটা সোয়াআটটা নাগাদ পৌঁছত। সঠিক সময়টা অবশ্য এখন মনে পড়েনা। শহরের একেবারে মধ্যেখানে বাসষ্ট্যাণ্ড। ধুলোর আলিঙ্গন সেরকম শক্তিশালী না হলেও জামার হাতায় ফুঁ দিলে কিন্তু ধুলো উড়তে দেখা যেত। বাসষ্ট্যাণ্ডে অনেকরকম খাবারের দোকান। তাছাড়া অনেকে আবার ঝাঁকা মাথায় বাসের জানলাগুলোর পাশেপাশে ঘুরেঘুরে চপ্, সিঙ্গারা, বেসনের লাড্ডু, চিনেবাদাম, ভাবরা ভাজা (বেসন আর সোডা দিয়ে তৈরী জিলিপি আকৃতির ভাজা নোনতা) পেয়ারা, কলা, আঙ্গুর এসব বিক্রী করতো। একবার এক ঝাঁকাঅলাকে ঐ অঞ্চলের কোনো বন্ধুর কাছে শোনা কস্তার লাড্ডু আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে সে কিরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল। আমার প্রশ্ন শুনে পাশে বসা বৃদ্ধ এক সহযাত্রী শুনিয়েছিলেন মানভুমের একদা বিখ্যাত, অধুনালুপ্ত কস্তার লাড্ডুর গল্প।  আটা অথবা ময়দার সাথে খোয়া অথবা ক্ষীর বা ছানা, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, কিসমিস, কাজুবাদাম, জায়ফল, জয়িত্রী, খুব অল্প পরিমাণ চিনি আর খাঁটি ঘি একসাথে মেখে তৈরি উত্তরপ্রদেশ ঘরানার মিষ্টি ছিল কস্তার। মানভুমের রাজার ছিল রোজকার দুবেলার শেষপাতে মিষ্টির শখ। আর ছিল শিকারের শখ। মুস্কিল হতো শিকারের জন্য লম্বা সফরে বেরিয়ে। ঠিকমতো পছন্দের মিষ্টিসব অতদিন ঠিক থাকতোনা, খারাপ হয়ে যেত। সমস্তরকম চেষ্টা বিফল হলে অবশেষে সমস্যার সমাধানে রাজার মোদকরা এখনকার উত্তরপ্রদেশের তাদের পরিচিত সেখানকার মোদকদের কাছ থেকে কস্তার লাড্ডুর রেসিপি আনিয়েছিল এবং সেই লাড্ডু রাজার খুব পছন্দ হয়েছিল। যাইহোক, মানভুমের রাজমোদকদের সঙ্গেসঙ্গে সেখানকার কস্তার লাড্ডুও বহুবছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

বাঁকুড়া পৌছতে পৌঁছতে খিদে পেয়ে গেলেও অত ধুলোমাখা খাবার খেতে ঠিক ইচ্ছে করতোনা। ধুলো যদি অল্পস্বল্প থাকতো তাহলে একটা চেষ্টা হয়তো করলেও করতাম! প্রায় পনের-কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে আমাদের লালবাস রওনা হতো পরের ষ্টপেজ দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে। মিনিট পঁয়তাল্লিশের যাত্রা। আমার সেই সাড়েপাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথে দুর্গাপুর ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে নির্দিষ্টদিনে বাসটা পৌঁছনোর অপেক্ষায় আমি ছুটি শুরুর বহু আগে থেকে অপেক্ষা করে থাকতাম। বোধহয় সেই তাগিদটা ছিল বাড়ি পৌঁছনোর তাগিদের চেয়েও বেশি। আসলে দুর্গাপুরের ধুলোবালির সঙ্গে মিশে থাকা তখনকার কাছাকাছি সময়ের একটা ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ক আর খিদের মুখে বাসষ্ট্যাণ্ডে অপেক্ষারত অশোকের মায়ের হাতে তৈরী লুচি, তরকারি, জিলিপি – দুটোই আমাকে টানতো। কোনটা বেশি কোনটা কম বলা মুস্কিল।

 

অশোক আর আমি ছিলাম দুর্গাপুরের স্কুলের বন্ধু, যাকে বলে একেবারে হরিহর আত্মা! ছুটি শুরুর দিনক্ষণ অশোককে মাসখানেক আগে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতাম। ও ঠিক দিনে ঠিক সময়ে বাসষ্ট্যাণ্ডে লুচি তরকারি সমেত আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। কাঁচের বোতলে করে জল আনত, সঙ্গে কাঁসার গেলাসও। খেতেখেতে জানলার এপারওপার থেকে দুই বন্ধু পনেরো-কুড়ি মিনিট গল্প করতাম, কয়েকমাসের জমে থাকা সব গল্প। বাস থেকে নেমে গল্প করা সম্ভব হতোনা ততক্ষণে অত্যধিক ভীড় হয়ে যাওয়ার কারণে।

 

দুর্গাপুরে মিনিট কুড়িপঁচিশ দাঁড়িয়ে ভীড়ে ঠাসা হয়ে লালবাস জি টি রোড ধরে রওনা দিত আমার গন্তব্য বর্দ্ধমানের জন্য। মাঝে বুড়িছোঁয়ার মতো করে দাঁড়াতো পানাগড়, মানকর আর গলসীতে। দুপুর পৌনেবারোটা নাগাদ বাসটা এসে দাঁড়াত বর্দ্ধমানে ষ্টেশনের ঠিক বাইরে। সীতাভোগ, মিহিদানা ছাড়াও সেইসময়ের বর্দ্ধমানের খ্যাতি ছিল আরেকটি কারণে; সেটা ছিল অগুন্তি রিক্সা। বাসগুলো এসে দাঁড়াতেই রিক্সাগুলো মশামাছির মতো ঘিরে ধরতো। ষ্টেশন বিল্ডিং ছিল একেবারে নাকের ডগায় মাত্র শ’দুয়েক ফিট দুরে, তবু রিক্সা আমাকে নিতেই হতো আমার মিলিটারি ট্রাঙ্কের জন্য।

 

সাড়েপাঁচ ঘণ্টা হয়েছে। একটি কাকতালীয় ঘটনা দিয়ে গল্পটা শেষ করবো। এই যাত্রাটি আমাকে নিতে হয়েছে একটানা তিনবছর ধরে, সাকুল্যে নয় থেকে দশবার। প্রথমবার থেকে শেষবার পর্যন্ত প্রত্যেকবার তপন বলে ঐ একই রিক্সাঅলা ট্রাঙ্কসমেত আমাকে ঐ শ’দুয়েক ফিট্ পার করে ষ্টেশনবিল্ডিঙের সিঁড়িতে নামিয়ে দিত। কি করে এটা সম্ভব হতো আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনা। ভাড়া নিত চারআনা।

 

বয়সকালের জীবনযাত্রায় ট্রেণ, প্লেন, গাড়ী এসবে করে ঘোরাঘুরি করার সময় মাঝেসাঝে লালবাস আর মানভুমের ধুলো মনে পড়ে। যতই ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করিনা কেন, আলিঙ্গনের রেশ কিছুটা তো থেকেই যায়!

******

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *