২৩/১২/২০২৩
আশির দশকের প্রথমদিকে চাকরিতে জয়েন করার পর আমার প্রথম পোষ্টিং হয় একটি সুন্দর শহরে, যার নাম জামশেদপুর। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, অরণ্য এসবকিছুর অনুপস্থিতিতে কোনো শহর যে শুধু গুচ্ছেরগণ্ডা কারখানা দিয়ে এত সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, সেটা টাটারা জামশেদপুরের পত্তনি থেকেই করে দেখিয়ে দিয়েছে। সবমিলিয়ে বছর ছয়েক ছিলাম। আমার একান্ত পছন্দের জায়গা হিসেবে জামশেদপুর সম্বন্ধে আমি অনর্গল কথা বলে যেতে পারি। কিন্তু আজকের লেখা শহরটা নিয়ে নয়, তাকে ছেড়ে সেখান থেকে শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরের কোন এক জায়গা নিয়ে।
জামশেদপুর শহর থেকে বেরোনর তিনটে রাস্তার মধ্যে একটা রাস্তা টাটানগর ষ্টেশনের পাশ দিয়ে ষাট কিলোমিটার দূরে চাইবাসা চলে গেছে। চাইবাসা সিংভুম জেলার জেলাসদর, অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার। আমাদের এই রাস্তা আবার চাইবাসা শহরটাকে আধাআধি ভাগ করে, তার মাঝখান দিয়ে গিয়ে, ঝিঁকপানির এসিসিদের সিমেন্ট কারখানার গা ঘেঁষে, জগন্নাথপুর, হাতগামারিয়া, নোয়ামুণ্ডি হয়ে আরও প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে বড়াজামদা পৌঁছে গেছে। বড়াজামদাকে ঐ অঞ্চলের লোকেরা আদর করে ‘জামদা’ বলে ডাকে। যেতে যেতে রাস্তাটি আবার টাটানগর – বড়াজামদা রুটের রেললাইনের সঙ্গে মোট সাতবার কাটাকুটি খেলতে খেলতে যায়। এই কাটাকুটি খেলাটা ছিল ট্রেণের ড্রাইভার আর আমাদের মধ্যে একটা মজার খেলা। প্রথম লেভেলক্রশিং যদি ট্রেণ পাস করানের জন্য বন্ধ পাওয়া যায় তাহলে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়েও পরপর বাকী ছ’টাতেও দাঁড়িয়ে পড়তে হবে ঐ একই ট্রেণ পাস করানোর জন্য। আবার উল্টোটাও হতো। প্রথমটা খোলা পেয়ে গেলে বাকা ছ’টাও খোলা পাওয়া যেত। মাঝেমধ্যে উভয়ের মধ্যে মুচকি হাসির বিনিময় অথবা হাত নাড়ানাড়িও হতো। তা, আমাদের আজকের কাহিনী সেই জামদা থেকেই শুরু।
শাল গাছের ঘনজঙ্গল, আয়রন ওরের লাল ধূলো, ভীষণরকম হাতি অধ্যুষিত আর বিভিন্ন প্রজাতির চরম থেকে চরমতম হতদরিদ্র আদিবাসীদের নিয়ে লাল মাটির দেশ, সারাণ্ডা ফরেস্ট। সারাণ্ডা – সাতশ পাহাড়ের দেশ। এই নামের উৎস জানিনা; হতে পারে পাহাড়ের সংখ্যা মোটামুটি সাতশ বলে। আবার হো প্রজাতির আদিবাসীদের ভাষায় হাতির নাম হচ্ছে সারাণ্ডা। আদিবাসীদের মধ্যে এখানে সাঁওতাল, হো আর মুণ্ডা প্রজাতির প্রাধান্য বেশি। বাকি প্রজাতিদের নাম আমার জানা নেই। তবে সেইসময় শুনতাম সারাণ্ডার একেবারে গহীন গভীরে নাকি আরও কয়েকটি আদিমতর প্রজাতির মানুষের বাস, যারা বাইরের দিকে আসে না। আমাকে যেদিকটায় ঘোরাফেরা করতে হতো সেদিকের প্রায় পুরোটাই মুণ্ডা প্রজাতি অধ্যুসিত ছিল।
একে অন্যটার গায়ে লেপ্টে থাকা পাহাড়গুলো বারশ থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিট উচ্চতার মধ্যে। দু’শ আড়াইশ ফিট করে হাইট এবং বয়স্ক থেকে অতিবয়স্ক ঘন শালজঙ্গলের কারণে সারাবছরই রোদের আলোকে এখানে লুকিয়েচুরিয়ে, শালগাছের ডাল, পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটিতে পড়তে হয়। প্রাকৃতিক বিচারে সারাণ্ডা শাল, পাহাড় আর হাতির এক সীমাহীন সমষ্টি। বইপত্র ঘাঁটলে জানা যায় এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম শাল জঙ্গল এই সারাণ্ডা ফরেস্ট যার সিংহভাগ তখনকার বিহার, এখনকার ঝাড়খণ্ডের সিংভূম, রাঁচি আর সিমডেগা জেলা জুড়ে, অল্প বাকি অংশটা প্রতিবেশি রাজ্য উড়িষ্যায়। হাতিদের আয়ুষ্কাল পঞ্চাশ ষাট বছর, পাহাড় চিরঞ্জিবী আর, উত্তরাখণ্ডের লোককথায় – ‘Sal, sau saal khada, sau saal padaa, sau saal sadaa’ (শাল গাছ বড় হয় একশ বছর ধরে, মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে একশ বছর ধরে, তারপর পড়ে গিয়ে মাটিতে মিলিয়ে যায় আরও একশ বছর ধরে)।
কাজের প্রয়োজনে বিহারী সারাণ্ডার আনাচে কানাচে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হতো। সেখানেই হয় প্রকৃতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, এবং কিছুটা প্রেম। এই বিশাল অঞ্চলের ব্যস্ততা, অর্থনীতি এবং জীবনযাপন সবকিছুই আয়রন ওর্ মাইনিং ঘিরে। স্টীল অথরিটি, ইণ্ডিয়ান আয়রন এণ্ড স্টীল, টাটা আয়রন এণ্ড স্টীল এরা প্রত্যেকে এই অঞ্চলে মাইনিং করে নিজেদের স্টীল প্ল্যাণ্টগুলোর চাহিদা মেটায়।
জামদা পযর্ন্ত রাস্তার দুপাশ মোটামুটি ধূধূ রূক্ষ প্রান্তর, ছড়ানো ছেটানো অল্পস্বল্প গাছপালা যার মধ্যে বেশিটাই বুনো ঝোপ, বহুদূরে কম উঁচু, সামান্য বেশি উঁচু ঢেউখেলানো সব পাহাড়। এখানে পৌঁছে আমাদের রাস্তা দুভাগ হয়ে যায়। একটা বাঁদিকে ঢুকে পড়ে উড়িষ্যার বরবিল। তারপর সেখান থেকে কেওনঝাড়, জাজপুর, পানিকৈলি হয়ে কটক, ভুবনেশ্বরের দিকে চলে যায়। অন্য রাস্তাটি সোজা একটুখানি গিয়ে সারাণ্ডার ভেতরদিকে সব মাইনিং এরিয়াগুলোর দিকে চলে যায়। আজকের গল্পে আমরা নেব লাল কাঁকড় আর মিহি লাল ধূলোয় ভরা এই রাস্তা। একটু এগিয়ে আমাদের সোজা রাস্তাটি আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। বাঁদিকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার ঘাট রাস্তা উঠে গেছে সাড়ে তিনহাজার ফিট মতো উঁচুতে কিরিবুরু, সারাণ্ডার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। ‘কিরি’ মানে হাতি, ‘বুরু’ অর্থাৎ পাহাড় – ‘হিলস্ অফ এলিফ্যাণ্টস’। ওখান থেকে একই রাস্তায় একটু নীচে নেমে মেঘাহাতাবুরু, ‘হিলস্ অফ ক্লাউডস্’। দুজায়গাতেই ষ্টীল অথরিটির অফ ইন্ডিয়ার মাইন্স। এদিকটায় আজ আমরা যাচ্ছি না; অন্য একদিন যাওয়া যাবে।
আজকে আমরা এগোব ডানদিকের রাস্তা ধরে। প্রথমে আসবে গুয়া। সেখান থেকে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আরও চল্লিশ কিলোমিটার মতো আরও দুর্গম, আরও গভীর এহং ভয়ানকভাবে হাতি অধ্যুসিত জঙ্গলের ভেতরে চিড়িয়া। চিড়িয়া আমি অনেক পরে গেছি। তার গল্প পরে কোনদিন কিরিবুরুর সঙ্গে শোনানোর ইচ্ছে রাখছি। গুয়া, চিড়িয়াতে ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড ষ্টীল কোম্পানি মাইনিং করে।
বাইরের লোকের কাছে নিজেকে মেলে ধরার জন্য সারাণ্ডার শালজঙ্গলে জড়ানো পাহাড় কাউকে মানসিক প্রস্ততির সময় দেয় না। রাজকীয় ভঙ্গিতে, স্বমহিমায় আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথমবার সে আমাকেও সময় দেয়নি। যতটা মনে আছে দুপাশ থেকে ঘন গাছগাছড়ায় চেপে ধরা সরু রাস্তা দিয়ে পনেরো কিলোমিটার মতো দূরত্বে গুয়া। সময় ভরদুপুরবেলা। লাল কাঁকড়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলা গাড়ির চাকার মড়মড় আওয়াজ, ঘন লাল রঙের পাউডার-ধূলো, আকাশঢাকা উঁচু উঁচু শালের ঘন জঙ্গল, মাটিতে লুটিয়ে আলোছায়া রোদ, খেলায় মত্ত কয়েকটা শেয়ালের বাচ্চা, অসংখ্য কাঠবিড়ালি, চাপা নিশ্তব্ধতার প্রলেপে জড়ানো চারপাশ, আর, একা আমি। আগের দিন অফিসের গুহদা সাবধান করে দিয়েছিলেন “প্রথমবার একা একা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ, চারদিক ভালো করে নজরে রেখে ড্রাইভ করবে। গুয়ার রাস্তায় প্রায়ই হাতি চলে আসে”। সবমিলিয়ে একটা গা ছমছমে ব্যাপার তো বটেই। আদ্দেকের বেশি পেরোনর পর কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম যখন কয়েকজন আদিবাসী মেয়েকে দেখতে পেলাম শুকনো শালপাতা, ভাঙ্গা ডালপালা এসব কুড়োতে। কয়েকটি আঠেরো কুড়ি বছর বয়সি ছেলেকেও দেখলাম কাঁধে তিরধনুক নিয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে। পরে জেনেছিলাম ছেলেরা সব পাখি, কাঠবিড়ালি, বাচ্চা জন্তু জানোয়ার যেমন শূয়োর এবং কখনো সখনো হরিণ এসব খুঁজে বেড়ায় শিকারের জন্য।
গুয়া পৌঁছে রামালিঙ্গমের সঙ্গে চা-পকোড়ার সাথে গল্পগুজব মেশানো কাজকম্মো সারতে সারতে চারটে বেজে গিয়েছিল। রামা ছিল পারচেজ ম্যানেজার; আমাদের সমবয়সী এবং বন্ধু। আমাদের কেউ গেলে ও খুশি হতো, বাইরের লোকের সাথে আড্ডা মারা যাবে বলে। বিকেল চারটে ওদের অফিস ছুটির সময়। আমার থাকার ব্যবস্থা ওখানকার গেস্টহাউসে। বহু পুরনো কিন্তু ভীষন ভালো মেনটেইণ্ড দোতলা বিল্ডিং। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সারি সারি চোদ্দটা রুম ওপরে। রুম বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না, ওগুলো আসলে স্যুইট। নীচে আটটা স্যুইট। বাকি ছ’টার জায়গা নিয়ে এক বিশাল ডাইনিং রুম কাম ফটো গ্যালারি। চার দেওয়ালে পুরনো থেকে বহু পুরনো চল্লিশ পঁয়তাল্লিশটা নষ্টালজিক সব ছবির ফ্রেম। দুটো তলাতেই সামনের দিকটা টানা বারান্দা। নীচের বারান্দায় সামনে পুরোটা মোটা গ্রিল দেয়া, কৌতুহলি হাতিদের আটকানোর জন্য। আমার রুম দোতলায়। সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা ডিনার টাইম। যাইহোক্, স্নান করে ফ্রেস হতে চেয়েছিলাম। তবে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি, কারণ জলের রঙও ছিল লাল।
ঠিক সাড়ে সাতটায় ডিনারে গেলাম। বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে; শুকনো পাতার গদি আর এদিক ওদিক পার্ক করে রাখা ডাম্পার ট্রাকগুলোর ওপর জল পড়ার ভালোরকম আওয়াজ। হলে বিরাট লম্বা খান তিরিশ বত্রিশ চেয়ারঅলা ডাইনিং টেবিল। খাবার সার্ভ করা হয় পুরোপুরি সাহেবি কায়দায়, যে কায়দার সঙ্গে সেই বয়সে এবং তারপরের বহুবছর পযর্ন্ত আমি ছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত। বেয়ারা সার্ভ করে আমার বাঁ কাঁধের ঠিক একহাত পেছনে শিরদাঁড়া সোজা করে সিপাহিদের মতো ঠায় দাঁড়িয়েছিল। ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ বুঝতে পারছিলাম না, তাই স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি হচ্ছিল। ‘কিছু লাগলে ডেকে নেব’ বলে ওকে ওখান থেকে সরানোর জন্য বারদুয়েক চেষ্টা করেছিলাম, ও নড়েনি; বলেছিল ‘তোমার খাওয়ার তদারকি করা আমার ফর্জ, কর্তব্য। আসলে আমি তখন জানতাম না বেয়ারার ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্মাল ডিনার প্রোটোকলের একটা অঙ্গ।
ব্রেকফাস্ট টাইম সকালে সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে সাতটা। আটটার সময় অফিস শুরু, বারোটায় লাঞ্চ ব্রেক দুঘণ্টার, তারপর আবার দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত অফিস। কাজ শেষ করে রামার সঙ্গে গল্গগুজব করতে করতে একসঙ্গে লাঞ্চ করলাম পেঁয়াজ-করলা ভাজা, ডাল, জঙ্গলি মুরগির ঝোল আর রুটি দিয়ে। শেষপাতে, চেহারা এবং স্বাদ উভয়েই প্রাগঐতিহাসিক, দুটো করে পান্তুয়া। বেরোতে বেরোতে দুটো বেজে গিয়েছিল। ভোররাতের দিকে বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশ তখনো মেঘলা। ড্রাইভ করতে করতে ভিজে ভিজে হাওয়া ভালোই লাগছিল। আগের দিনই যেহেতু এই রাস্তা দিয়ে একবার গেছি তাই টেনশনও একটু কম। চারপাশ একইরকম শুনশান্। মাঝামাঝি পৌঁছে একটু দূর থেকে নজরে পড়ল একটা লোক অদ্ভুতভাবে হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে, কোনোরকম নড়াচড়া নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি আর আমার গাড়ি স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি।। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মনে হলো কোন লোডেড ডাম্পার ট্রাক নিশ্চয় লোকটাকে চাপা দিয়ে পালিয়েছে। একবার ভেবেছিলাম ফিরে গিয়ে রামাকে ঘটনাটা জানাই। শেষপর্যন্ত অবশ্য যাইনি। তবে আজ আমি নিশ্চিত যে সেদিন ফিরে গেলে খুব ভুল করতাম। গভীর, প্রত্যন্ত জঙ্গলে বসবাসকারি, অকল্পনীয়রকম দরিদ্র আদিবাসীদের জীবনযাত্রার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ – তাদের ‘সামাজিক স্বাধীনতা’ – চাক্ষুস দেখার সুযোগ বা অভিজ্ঞতা হয়তো কখনো পেতাম না। আর কখনো পাইওনি।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পড়ে থাকা নিশ্চল লোকটার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে দেখলাম আরও সামনে একইরকম ভাবে আরও লোক পড়ে আছে রাস্তায়। তবে এবার একজন নয়, মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে বেশ কয়েকজন এবং রাস্তার ওপর বেশ খানিকটা জুড়ে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এবার পাশ কাটিয়ে যাবার জায়গা ছিল না। আমি ভেবে নিয়েছিলাম ভয়ংকর ধরনের কোনো অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে। পরিস্থিতির কুলকিনারা না পেয়ে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে মরিয়া হয়ে গাড়ি রাস্তা থেকে শালপাতার কার্পেট বিছানো জমিতে নামিয়ে, রাস্তাটাকে পাশে রেখে এ গাছ সে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে যতটা সম্ভব গতি বাড়িয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলাম এবং সেভাবে বেরিয়ে যেতেও পেরেছিলাম। তখনই দেখেছিলাম হাঁড়িয়ায় চূড় হয়ে বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু মেয়ে, পুরুষ গাছের গুঁড়িতে এলিয়ে অথবা মাটিতে চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে, ঠিক রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোর মতন ভঙ্গিতে। তারা জীবিত, না মৃত, না ফসিল দেখে বোঝার উপায় ছিল না। আর যারা হুঁশ তখনও হারায় নি তাদের মধ্যে অনেকে ওখানেই উদ্দাম রতিক্রিয়ায় মগ্ন। বাকিরা পাশে বসে হাঁড়িয়া খেতে ব্যস্ত।
কেন জানিনা, সেই বিকেলের বড়জোর মিনিট দশেকের ঐ আচম্বিত ঘটনাপ্রবাহ মানসিক দিক দিয়ে আমাকে এতটাই পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল যে এর পরের ঘণ্টাচারেকের স্মৃতি আমার কাছে আজও খুব ঝাপসা। শুধু এটুকু মনে আছে মাঝে কোথাও গাড়ি না দাঁড় করিয়ে থেমেছিলাম একেবারে জামশেদপুরে বাড়ির দরজায় পৌঁছে।
এই অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন কাউকে বলিনি। বেশ কয়েকবছর পরে রাঁচীতে থাকাকালীন এক আদিবাসী বন্ধুকে ঘটনাটা বলেছিলাম। আমাকে একটু অবাক করে উনি পুরোটা খুব সাধারণভাবে নিয়েছিলেন এবং সেটার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। বন্ধুটি বলেছিলেন ‘আগের রাতের বৃষ্টি যেকোনো কারণেই হোক জঙ্গলবাসী ঐ লোকজনদের খুব আনন্দ দিয়েছিল। সেদিন সেই আনন্দটা ওরা সেলিব্রেট করছিল। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লোকগুলোর কেউই গাড়ির চাকায় পিষে মরেনি। ওরা সব সারাদিন ধরে আকণ্ঠ হাঁড়িয়া খেয়ে বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়েছিল। আর, প্রত্যন্ত জঙ্গলে বসবাসকারী ঐসব আদিবাসীদের যেকোন আনন্দ উৎসব উদযাপনের দুটোই বহিঃপ্রকাশ – হাঁড়িয়া আর সেক্স। ভেবে দেখুন, এই দুটো ছাড়া নিজস্ব বলতে ওদের কিন্তু আর কিছু নেই’।