সে ও নর্তকী শেষ – পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

সে ও নর্তকী শেষ – পর্ব

জাহিন কিছু বলছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এখন তার একটু কান্না কান্নাও লাগছে। রুবি বলল, তুমি আমার সঙ্গে গেলে তোমার বাবার জন্যও ভালো হবে। সারাক্ষণ তোমাকে নিয়ে তার যে দুশ্চিন্তা সেটা থাকবে না। সে নিজের মনে কাজ করতে পারবে। সে হয়তো ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করে আবার সংসার শুরু করবে। কে জানে, তোমার স্বাতী আন্টি হয়তো ফিরে আসবে। অনেক সময় আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে সংসারে থাকলে মেয়েরা তাকে বিয়ে করতে চায় না।

জাহিন খুব মন দিয়ে কথা শুনছে। কথাগুলো তার কাছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। রুবি বলল, চলো এখন আমরা বেড়াতে বের হই। তোমার বাবাকে হ্যালো বলে যাই। তুমি কাপড় বদলে ভালো একটা জামা পরো।এটাই আমার সবচেয়ে ভালো জামা।এটাও অবশ্যি মন্দ না। তবে আজ আমরা অনেকগুলো ভালো জামা কিনব। তোমার চুলগুলোও সুন্দর করে কেটে দিতে হবে। অনেক কাজ। আমরা আজ প্রথম কোথায় যাব?

স্বাতী আন্টিদের বাড়িতে।

ও হ্যাঁ। তোমার বাবার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিতে হবে।

স্বাতীর সঙ্গে তাদের দেখা হলো না।

নাজমুল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, আমার মেয়েটার শরীর ভালো না। তোমরা আরেক দিন এসো। জাহিন বলল, আমি শুধু দূর থেকে উনাকে একটু দেখেই চলে যাব।নাজমুল সাহেব তারপরেও বললেন, আজ আজ না। আরেক দিন।জাহিন স্বাতীদের বাড়ি থেকে মন খারাপ করে বের হয়েছে। রুবি বলল, আমরা। আবার আসব। দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে দেখা করে যাবই, তাই না জাহিন?

হ্যাঁ।একটা কবিতা আছে না, একবার না পারিলে দেখ শতবার। আমরা শতবার দেখব। কি বলো জাহিন?

হুঁ।এখন কোথায় যাওয়া যায়। চিড়িয়াখানায়?

হুঁ।চিড়িয়াখানার কোন প্রাণীটা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?

জানি না।

জানো না কেন?

জাহিন জবাব দিল না। রুবি বলল, আমার মনে হচ্ছে তোমার চিড়িয়াখানায় যাবার তেমন ইচ্ছা নেই। এর উত্তরেও জাহিন কিছু বলল না। রুবি বলল, অন্য কোথাও যেতে চাও?

হুঁ।বলো কোথায়। তুমি যেখানে যেতে চাও, আমি নিয়ে যাব।

লিলি আন্টিদের বাড়িতে যাব।

লিলি আন্টি কে?

জাহিন উৎসাহের সঙ্গে বলল, উনি একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন খুব ঝড়-বৃষ্টি হলো। আমরা ঝড়-বৃষ্টিতে খুব হুটোপুটি করেছি। শিল কুড়িয়েছি। বাড়ির সামনে পানিভর্তি একটা গর্ত আছে না? আমরা দুজন ধপ করে গর্তে পড়ে গেলাম। আমরা দুজন খুব বন্ধু।উনি কি একদিনই এসেছিলেন?

হুঁ।একদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল? হুঁ।বন্ধুত্ব অবশ্যি হবার হলে একদিনেই হয়। হবার না হলে কখনই হয় না। তোর বাবার সঙ্গেও আমার একদিনেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। খুব মজার ঘটনা। শুনবে?

জাহিনের শুনতে ইচ্ছা করছে না। কারণ, এই মহিলা তাকে লিলি আন্টিদের বাড়িতে নিয়ে যাবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। লিলি আন্টির ঠিকানা তার কাছে আছে। তিনি কাগজে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু উনি তো ঠিকানা চাচ্ছেন না।হয়েছে কি শোনো। ছবির একটা এক্সিবিশন হচ্ছে। আমি আমার বাবার সঙ্গে এক্সিবিশন দেখতে গেলাম। একটা ছবির সামনে থমকে দাঁড়িয়েছি।

কী যে সুন্দর ছবি! টিনের ঘরের বারান্দায় একটি তরুণী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে মেয়েটি মুখ ধুচ্ছে। ছবিটবি তো আমি বুঝি না। জীবনে কোনো ছবি দেখে এত অবাক হই নি। আমি ছবির আর্টিস্টের কাছে গিয়ে বললাম, ছবিটা আমার এত ভালো লাগছে কেন বুঝিয়ে দিন।আর্টিস্ট হেসে ফেলল। তোর বাবা যে খুব সুন্দর করে হাসে সেটা নিশ্চয়ই তুই জানিস?

জানি।

সেই হাসিও দেখি ছবির মতোই সুন্দর। এই যে তোর বাবাকে ভালো লাগল, লাগলই। গল্পটা সুন্দর না জাহিন?

হু। আমরা লিলি আন্টিদের বাসায় কখন যাব?

এখনই যাওয়া যায়। কিন্তু আমার কাছে তো ঠিকানা নেই।

আমার কাছে ঠিকানা আছে।

জাহিন কাগজের টুকরাটা বের করল।

কোনো বাড়ির সদর দরজা এমন করে ভোলা থাকতে পারে তা রুবির ধারণায় ছিল না। দরজা খোলা। তারা কলিং বেল বাজাচ্ছে। কেউ আসছে না। অথচ ভেতরে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। জাহিন তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কি ভেতরে ঢুকে যাব? রুবি বলল, সেটা কি ঠিক হবে? অপরিচিত একটা বাড়ি। কেউ এলে পরিচয় দিয়ে তারপর ভেতরে যাওয়া উচিত।

কেউ তো আসছে না।

তাই তো দেখছি। চলো ঢুকে পড়ি।

তারা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রুবি অবাক হয়ে দেখল অবিকল পরীর মতো মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে তাদের দেখে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসছে। এসেই মেয়েটি জাহিনকে কোলে তুলে নিল। জাহিন মেয়েটির শাড়িতে মুখ চেপে রেখেছে। তার ছোট্ট শরীর কাঁপছে। সে কাঁদছে। রুবির বিস্ময়ের সীমা রইল না।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাবার পর লিলি লজ্জিত ভঙ্গিতে রুবির দিকে তাকাল। রুবি বলল, যে মেয়েটি আপনার কোলে বসে কাঁদছে আমি তার মা। হুট কর ঢুকে পড়েছি।খুব ভালো করেছেন।লিলি কিশোরীদের মতো গলায় পেঁচিয়ে বলল, মা দেখো! দেখো কে এসেছে। ফরিদা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন, কে এসেছে?

জাহিন এসেছে। জাহিন।

জাহিনটা কে?

লিলি জবাব দিতে পারছে না। সে লজ্জিত ও বিব্রত মুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিন মেয়েটা তাকে খুব লজ্জায়ও ফেলে দিয়েছে। কেঁদে কেঁদে তার শাড়ি প্রায় ভিজিয়ে ফেলেছে। এত কাঁদছে কেন মেয়েটা?

বাড়ির সবাই এসে ভিড় করছে। রুমু ঝুমু এসেছে, বড় চাচা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, ছোট চাচাকেও দেখা যাচ্ছে। কাজের দুই বুয়াও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। রুবি বলল, আমার মেয়েটা কিছুক্ষণ থাকুক আপনার কাছে। আমি পরে এসে নিয়ে যাব।লিলি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারল না। জাহিনের কান্নার কারণে তার নিজেরও এখন কান্না এসে গেছে।জাহিনের মা চলে যাচ্ছেন, সে তাঁকে এগিয়ে দিতে পর্যন্ত গেল না। অভদ্রের মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। ফরিদা বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি! এই মেয়ে কে?

একজন আর্টিস্টের মেয়ে মা, হাসনাত সাহেবের মেয়ে? তুই কাঁদছিস কেনরে লিলি। মেয়েটা কাঁদছে, তুইও কাঁদছিস। ব্যাপারটা কি?ফরিদার বিস্ময় কিছুতেই কমছে না।সকাল বেলাতেই নেয়ামত সাহেবের ঘরে লিলির ডাক পড়েছে। লিলি ভয়ে ভয়ে উপস্থিত হলো! নেয়ামত সাহেব অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, মা বসো।

লিলি বসল।

মা, কাছে এসে বসো।

লিলি বাবার কাছে একটু সরে এলো। খুব কাছে আসতে লজ্জা লাগছে। বাবা তুমি তুমি করে বলছেন। তাতেও লজ্জা লাগছে।তোমার বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে দেখো। হাতে নিয়ে দেখো। লজ্জার কিছু নেই। হারামজাদারা একটা বানান ভুল করেছে। শুভ লিখেছে দন্ত্যে স দিয়ে, ধরে চাবকানো দরকার। তবে ছেপেছে ভালো। কার্ড পছন্দ হয়েছে মা?”

জি বাবা।শুভ বানানটার জন্য মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়ে গেল। যাই হোক কি আর করা! তোমার কয়টা কার্ড দরকার বল তো মা।আমার কার্ড লাগবে না বাবা।কার্ড লাগবে না মানে। অবশ্যই লাগবে। বন্ধু-বান্ধবদের নিজের হাতে দাওয়াত দিয়ে আসবে। এইসব ব্যাপারে আমি খুব আধুনিক। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি সারাদিনের জন্য গাড়ি তোমার। বিশটা কার্ডে হবে মা? জি হবে।

ফ্যামিলিসুদ্ধ দাওয়াত দেবে। দাওয়াতে কার্পণ্য করবে না। নাও মা, কার্ডগুলো নাও–হারামজাদারা শুভ বানানে গণ্ডগোল করে মনটা খারাপ করে দিয়েছে। যাই হোক, কি আর করা। মা, দাওয়াত দেয়ার সময় মুখে বলবে, উপহার আনতে হবে না। দোয়াই কাম্য। কার্ডে লিখে দেয়া উচিত ছিল। অনেকেই আবার এসব লিখলে মাইন্ড করে বলে লেখা হয় নাই।বাবা, আমি যাই?

আচ্ছা মা, যাও। যেসব বাড়িতে যাবে সেখানে মুরুব্বি কেউ থাকলে পা ছুঁয়ে সালাম করবে। মুরুব্বিদের দোয়া যে কত কাজে লাগে তা তোমরা জানো না। জগৎ সংসার টিকেই থাকে মুরুব্বিদের দোয়ায়।স্বাতী গভীর আগ্রহে বিয়ের কার্ড দেখছে। লিলি তাকিয়ে আছে স্বাতীর দিকে। কী চেহারা হয়েছে স্বাতীর! যেন সে কতদিন ধরে ঘুমুচ্ছে না, খাচ্ছে না।

তুই এমন হয়ে গেছিস কেন স্বাতী?

কেমন হয়ে গেছি? পেত্নী?

প্রায় সে-রকমই।

রাতে ঘুম হয় না, বুঝলি লিলি, এক ফোঁটা ঘুম হয় না। গাদাগাদা ঘুমের ওষুধ খাই। তারপরেও ঘুম হয় না। মার ধারণা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।তোর নিজের কী ধারণা? আমারও সে রকমই ধারণা। কাল রাত তিনটার সময় হঠাৎ হো হো করে এমন হাসি শুরু করলাম–আমি হাসি মা কাঁদে। মা যত কাঁদে, আমি ততই হাসি।তোর সমস্যা কী? আমার অনেক সমস্যা। তোকে সব বলতে পারব না।আমি তোকে একটা পরামর্শ দেব? দে।

তুই হাসনাত সাহেবের কাছে ফিরে যা।স্বাতী রাগী গলায় বলল, কেন ফিরে যাব? ভালোবাসার জন্য ফিরে যাব? ওকে ভালোবাসি তোকে কে বলল? ভালোবাসা কখনও এক তরফা হয় না। ও কি। ভালোবাসে আমাকে? কখনও না। আমার একটা ছবি এঁকেছে। ছবিটা তুই ভালো করে লক্ষ করেছিস? ভালো করে দেখ। ছবির মেয়েটার চিবুকে লাল তিল আছে। আমার চিবুকে লাল তিল আছে? কোত্থেকে এই তিল এল?

তার স্ত্রীর চিবুকে তিল ছিল। ওর কোনো প্রেমিকা দরকার নেই। ওর দরকার জাহিনের দেখাশোনার জন্য একজন মা। ওকে বিয়ে করলে আমাকে কী করতে হবে জানিস? ওর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। আমি কোনোদিনও তা করব না।আচ্ছা ঠিক আছে। তুই শান্ত হ।স্বাতী চুপ করল। বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে লাগল। লিলি বলল, আমি এখন যাই স্বাতী? কোথায় যাবি? হাসনাতের ওখানে?

লিলি কিছু বলল না, চুপ করে রইল। স্বাতী বলল, আমি তোর চোখ দেখেই বুঝেছি তুই তার কাছে যাবি। বিয়ের দাওয়াতের অজুহাতে যাবি। তাই না? লিলি চুপ করে রইল।স্বাতী তীব্র গলায় বলল, তোর সাহসের এত অভাব কেনরে লিলি। একটু সাহসী হ। আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও তোর সাহস হলো না এটাই আশ্চর্য। আমি কী প্রচণ্ড সাহসী একটা কাজ করতে যাচ্ছি তা কি জানিস? না।

মাকে জিজ্ঞেস করিস। মা বলবে। নাও বলতে পারে। মাও তো তোর মতোই একটা মেয়ে। শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকতে ঢাকতে সবকিছু ঢাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।স্বাতী, আমি যাই।যা। ওকে জিজ্ঞেস করিস তো কোন সাহসে আমার চিবুকে সে লাল তিল আঁকল?

লিলি সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একতলায় স্বাতীর মার সঙ্গে তার দেখা হলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, মেয়েটার মাথা খারপ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। ও প্রায়ই আমাকে চিনতে পারে না।এইসব কী বলছেন খালা!সত্যি কথা বলছি মা। সত্যি কথা বলছি। ও আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজে শাস্তি পাচ্ছে।

তিনি ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।হাসনাত বাসায় ছিল। লিলিকে দেখে সে খুব অবাক হলো। লিলি বলল, জাহিন কোথায়? ও তার মার হোটেলে। ওর মা এসেছে ওকে নিয়ে যেতে।আমি জানি। জাহিন আমাকে সব বলেছে।ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে জানি না তো। জাহিন আমাকে কিছুই বলে নি। ভেতরে এসো লিলি।

আমি আপনাকে একটা কার্ড দিতে এসেছি।

বিয়ের কার্ড।

হ্যাঁ। বুঝলেন কী করে বিয়ের কার্ড?

অনুমান করেছি।

আপনি বিয়েতে এলে আমি খুব খুশি হব।

আমি যাব, আমি অবশ্যই যাব।

আরেকটা কাজ যদি করেন তাহলেও আমি খুব খুশি হব।

বলো, আমি অবশ্যই করব।

স্বাতীর সঙ্গে যদি একটু দেখা করেন। ও ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।লিলি, আমি সেটা জানি। আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে। স্বাতী আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয় নি।লিলি এসো, ভেতরে এসে বসো।জি না, আমি বসব না।হাসনাত ক্লান্ত গলায় বলল, স্বাতীর ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। রুবির ব্যাপারটাও বুঝি নি। কাউকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। এইটুকু শুধু জানি। বাস্তবে কাউকে ধরে রাখতে পারি না বলেই বোধহয় ছবিতে ধরে রাখতে পারি।লিলি বলল, আমি যাই?

হাসনাত বলল, তুমি কি ঘণ্টাখানেক বসতে পারবে? ঘণ্টাখানেক বসলে অতি দ্রুত একটা ছবি এঁকে ফেলতাম। মাঝে মাঝে আমি খুব দ্রুত কাজ করতে পারি।জি না। আমি এখন যাব।হাসনাত গেট পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল। হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে লিলি নিচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।হাসনাত বলল, আমি প্রার্থনা করছি তোমার জীবন মঙ্গলময় হবে।বিংশ শতাব্দীর সপ্তম আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটে গেছে।

জাহেদুর রহমান আমেরিকান ভিসা পেয়েছে। সে অসম্ভব অবাক হয়ে লক্ষ করল তার কোনো রকম আনন্দ হচ্ছে না। বরং হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মনে হয় আর কিছুই করার নেই। সে গুলশান থেকে বাসায় ফিরল হেঁটে হেঁটে এবং প্রথম বারের মতো এই নোংরা দেশের সবকিছুই তার অসম্ভব ভালো লাগতে লাগল।

ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে রিকশা যাচ্ছে–কী সুন্দর লাগছে দেখতে! রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটেছে—-আহা কী দৃশ্য! আকাশজোড়া ঘন কালো মেঘ। বর্ষা আসি আসি করছে। আসল কালো মেঘগুলো বের হবে বর্ষায়। দিনরাত বর্ষণ হবে। রাস্তায় পানি জমে যাবে। সেই পানি ভেঙে বাসায় ফেরা। এই আনন্দের তুলনা কোথায়?

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো–সমস্যার আনন্দ। চারদিকে সমস্যা কি কম? লিলির বিয়ে হচ্ছে। কত রকম ঝামেলা, রুমু ঝুমু বড় হচ্ছে, এদের বিয়ে দিতে হবে। সমস্যার কি কোনো শেষ আছে? বাড়িটা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সেই ঝামেলাও মেটাতে হবে। সব ছেড়ে বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকলে হবে? কী আছে শাদা চামড়ার দেশে? সমস্যাহীন ঐ দেশে থেকে হবেটা কী?

বাড়ি ফেরার পথে জাহেদুর রহমান বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গেল। যাকে বলে ঝুম বৃষ্টি। এত ভালো লাগছে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে। পাসপোর্টটা ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। ভিজুক। হু কেয়ারস? শালার পাসপোর্ট।কাকভেজা হয়ে জাহেদুর রহমান বাড়িতে ঢুকল। প্রথমেই দেখা হলো লিলির সঙ্গে। লিলি শঙ্কিত গলায় বলল, ভিসা এবারও হয় নি, তাই না?

জাহেদুর রহমান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, না।লিলি বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি মন খারাপ করো না ছোট চাচা। তোমার মনটা এত খারাপ দেখে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।–আহারে, মেয়েটা তো সত্যি কাঁদছে।জাহেদুর রহমানের চোখ ভিজে উঠছে–বিদেশ বিভূঁইয়ে কে তার জন্য চোখের জল ফেলবে। কেউ না।

ছোট চাচা!

কী রে!

মন খারাপ করো না ছোট চাচা, প্লিজ।

আচ্ছা যা মন খারাপ করব না।

পরের বার নিশ্চয়ই হবে।

আর এ্যাপ্লাই করব না। যথেষ্ট হয়েছে, এখন কষ্টটষ্ট করে দেশেই থাকব।জাহেদুর রহমান তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে। এত ভালো লাগছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে।বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন পর লিলিদের বাড়ি চুনকাম হচ্ছে। পুরনো বাড়ি সাজতে শুরু করেছে নতুন সাজে। বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলোও কি বদলাচ্ছে? নেয়ামত সাহেব মেয়ের সঙ্গে যে অস্বাভাবিক নরম গলায় কথা বলেন সেই কথায় লিলির চোখে প্রায়ই পানি এসে যায়। সেদিন হঠাৎ বললেন, মাগো কাছে বস তো একটু।

লিলি কাছে বসল। নেয়ামত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ পর কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, তোর ঐ বান্ধবী কি যেন নাম স্বাতী। আসে না কেন? বিয়ের সময় বন্ধুবান্ধব আশপাশে থাকলে মনটা ভালো থাকে। ওকে খবর দিয়ে নিয়ে আয়, থাকুক কয়েক দিন তোর সাথে।

লিলি বলে না যে স্বাতী অসুস্থ। স্বাতী এখন তাকে পর্যন্ত চেনে না। লিলি তাকে গত কালও দেখতে গিয়েছিল। স্বাতী তাকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলেছে, বসুন। মা উনাকে বসতে দাও। রওশন আরা লিলির দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বললেন, কেন আমার মেয়েটা এ-রকম হলো? কেন হলো? লিলি এখন নিজের মতো তার বিয়ের প্রস্তুতি দেখে। তার ভালোও লাগে না, মন্দও লাগে না।

রাতে মা তার সঙ্গে ঘুমুতে আসেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকেন। লিলির তখনই শুধু খুব একা লাগে। তখন খুব অন্যায় একটা ইচ্ছার ছায়া মনে ভাসে। মনে হয়, ইশ কেউ একজন যদি স্বাতীর মতো একটা ছবি তার এঁকে দিত। কেউ একজন যদি তাকে দেখাতো কি করে আকাশের তারা নামিয়ে আনা যায়। সে খুব সন্তর্পণে কাঁদে। এমনভাবে কাঁদে যেন তার শরীর না কাঁপে। যেন তাঁর মা কিছু বুঝতে না পারেন। কিন্তু তিনি বুঝে ফেলেন।

মেয়েকে প্রবলভাবে বুকে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন, মা রে তোর যদি সত্যি সত্যি মনের মানুষ কেউ থাকে তুই পালিয়ে চলে যা তার কাছে। কী আর হবে? তোর বাবা আমাকে ধরে মারবে। এটা তো নতুন কিছু না।লিলি অস্পষ্ট স্বরে বলে, মনের মানুষ কেউ নেই মা।লিলির মা লিলির চেয়েও নিচু গলায় বলেন, সত্যি নেই? একদিন যে কোথায় গেলি। অনেক রাত করে ফিরলি…

লিলি হাসে। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে। অনেকটা স্বাতীর মতো করেই হাসে। লিলির মা মেয়ের সেই হাসির মানে ধরতে পারেন না। তার বড় কষ্ট হয়।লিলি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি এত ভালো কেন মা? তুমি, বাবা, ছোট চাচা, বড় চাচা, রুমু ঝুমু। তোমরা যদি আরেকটু কম ভালো হতে তাহলে আমার এত কষ্ট হতো না।লিলি কাঁদে।

মা তার গায়ে-মাথায় ক্রমাগতই হাত বুলিয়ে দেন।রুবিদের ফ্লাইট রাত আটটায়। জাহিনের জিনিসপত্র গোছানো হয়েছে একদিন আগেই। যাবার দিনে তার কিছু গোছানোর নেই। সে ঠিক করে রেখেছিল যাবার দিনটা সারাক্ষণ সে বাবার সঙ্গে গল্প করবে। কিন্তু হাসনাত সকাল থেকেই স্টুডিওতে। দরজা বন্ধ করে কাজ করছে গত রাতের পুরোটাই কেটেছে স্টুডিওতে।

গভীর রাতে জাহিনের ঘুম ভেঙেছে। সে দেখে বিছানা খালি। স্টুডিওতে আলো জ্বলছে। একবার সে ভাবল বাবাকে ডাকে। শেষ পর্যন্ত ডাকল না। স্টুডিওর দরজার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার পাশে কোলবালিশ। বালিশটাকে বাবা ভেবে সে জড়িয়ে ধরে থাকল।

স্টুডিও থেকে হাসনাত বের হলো দুপুরে। সে ভেবে রেখেছিল ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে মেয়েকে নিয়ে যাবে। তার হাতে তেমন সময় নেই। তার খুব ইচ্ছা প্লেনে ওঠার সময় মেয়ের হাতে একটা ছবি তুলে দেবে। বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে নষ্ট করার সময় নেই। হাসনাত বলল, টোস্ট আর ডিমভাজা খেয়ে ফেললে কেমন হয় মা?

জাহিন বলল, খুব ভালো হয়।

হাসনাত ডিম ভাজল। রুটি টোস্ট করার সময় নেই। এমি খেয়ে নিলেই হয়।

জাহিন!

জি বাবা।

আজ একটু খারাপ খেলে কিছু হবে না। প্লেনে কত ভালো ভালো খাবার দেবে। তাই না? হুঁ।আমি ছবিটা শেষ করতে থাকি, তুই কাপড়-টাপড় পরে তৈরি হতে থাক।আচ্ছা।জাহিন একা একা একা বারান্দায় হাঁটল। বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরল। এবং মাঝে মাঝেই স্টুডিওর দরজার পাশে এসে দাঁড়াতে লাগল। একবার মনে-মনে ডাকল, বাবা। মনের ডাক কেউ শুনতে পায় না। হাসনাত শুনল না। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় ছবিতে।সন্ধ্যায় রুবি যখন গাড়ি নিয়ে এসে হর্ন বাজাচ্ছে তখন হাসনাতের ছবি শেষ হলো। সে কাগজে মুড়ে ছবিটা মেয়ের হাতে দিয়ে হাসল।

হাসি দেখেই জাহিন বুঝেছে, বাবা খুব সুন্দর ছবি এঁকেছে। তবে ছবিটা সে এখন দেখবে না। প্লেনে উঠে দেখবে।হাসনাত বলল, মা, তুমি তোমার পড়ার ঘরে ছবিটা টানিয়ে রেখো।জাহিন বলল, আচ্ছা।হাসনাত বলল, তাহলে আর খুশি করে লাভ নেই, তোমরা রওনা হয়ে যাও।রুবি বিস্মিত হয়ে বলল, রওনা হয়ে যাও মানে? তুমি সি অফ করতে যাবে না?

ইচ্ছে করছে না। খুব ক্লান্ত লাগছে।

ক্লান্ত লাগলেও চলো।

হাসনাত বিষণ্ণ গলায় বলল, বিদায়ের দৃশ্য আমার ভালো লাগে না।কারোই ভালো লাগে না। তারপরেও তো লোকজন বিদায় দিতে যায়। যায় না?এয়ারপোর্টে গাদাগাদি ভিড়। কী ভয়ানক ব্যস্ততা চারদিকে! কেউ যেন কাউকে চেনে না।জাহিনের কাঁধে একটা হ্যান্ডব্যাগ, এক হাতে সে মাকে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে কাগজে মোড়া ছবি। ছবিটা সে বুকের কাছে ব্যক্ত করে ধরে আছে।

হাসনাত এক কোনায় দাঁড়িয়ে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। জাহিন মার হাত ধরে গটগট করে এগুচ্ছে। নতুন কেনা গোলাপি ফ্রকে তাকে লাগছে পরীদের কোনো শিশুর মতো। সে একবারও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না।রুবি বলল, মা তুমি বাবার কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে এসেছ। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি, তুমি যাও বাবাকে চুমু দিয়ে আসো।জাহিন শান্ত গলায় বলল, না।না কেন মা?”

বাবাকে চুমু খেলে বাবা কাঁদতে শুরু করবে। বাবাকে কাঁদাতে ইচ্ছা করছে না।কিন্তু তোমার বাবা হয়তো তোমাকে চুমু দেয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তুমি না গেলে কষ্ট পাবেন।বাবা জানে আমি কেন যাচ্ছি না। বাবার অনেক বুদ্ধি।বেশ চলো, আমরা তাহলে যাই। বাবাকে কি একবার হাত নেড়ে বাই বাই বলবে?

না।ছবিটা তুমি আমার কাছে দাও। এত বড় একটা ছবি তোমার নিতে কষ্ট হচ্ছে।আমার কষ্ট হচ্ছে না।প্লেন আকাশে ওঠার পর জাহিন বলল, আমি ছবিটা একটু দেখব মা।রুবি মোড়ক খুলে ছবিটা মেয়ের হাতে দিলেন। জাহিন শান্ত গলায় বলল, একবার বাবা আমাকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে গিয়েছিল। বারোটার সময় ছুটি হয়েছে। বাবা আনতে গেছে তিনটার সময়। বাবাকে দেখে আমি ছুটতে ছুটতে গিয়েছিলাম। সেই ছবিটা বাবা একেঁছে। মা, দেখো।

ছবিতে ছোট্ট একটা মেয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। হাওয়ায় তার চুল উড়ছে, স্কুল ব্যাগ উড়ছে। মেয়েটার চোখভর্তি জল।রুবি অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর কাছে হঠাৎ মনে হলো অপূর্ব এই ছবিটা রঙ দিয়ে আঁকা হয় নি। আঁকা হয়েছে চোখের জলে।জাহিন চোখ মুছছে। রুবি দুহাতে মেয়েকে কাছে টানলেন। জাহিন ফিসফিস করে বলল, এয়ারপোর্টে বাবা কি রকম একা একা দাঁড়িয়ে ছিল।

রুবি বললেন, সব মানুষই একা রে মা। তারা সংসার, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে বাস করে। তার পরেও তারা একা।জাহিন প্লেনের জানালা দিয়ে তাকাল। তার খুব ইচ্ছা করছে অনেক অনেক দূর থেকে বাবাকে একটু দেখবে। কিন্তু প্লেন আকাশে উঠে গেছে। শাদা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে নিচের পৃথিবী।জাহিন কাঁদছে। কাঁদছে ফ্রেমে বন্দী স্কুলের পোশাক পরা বাচ্চা মেয়েটি।

                                      

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *