সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২

‘এক্সকিউজ মি।। চমকে উঠে বাঁদিকে তাকালাম। আমাদের গাড়ি থিয়েটার রােডে পৌছে একটা রাস্তার মােড়ে ঈষৎ জ্যামের দরুন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টিটা বেড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এক সিক্তবসনা যুবতী কর্নেলের কাছে ঝুঁকে কথাটি উচ্চারণ করেছিল। কর্নেল চোখ খুলে সােজা হয়ে বসে বললেন, ‘বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য।

কর্নেল সমগ্র ১ম খণ্ড 

‘একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ভিজে যাচ্ছি কিন্তু সেজন্যও না।’ যুবতীর কণ্ঠস্বরে ফটানি ছিল এবং সে বারবার ভয়-পাওয়া চোখে ফুটপাতের দিকে তাকাচ্ছিল। “প্লিজ যদি আমাকে একটু লিফট দেন। দুটো মস্তান মতাে লােক আমার পিছু নিয়েছে। 

কর্নেল ঘুরে পেছনকার দরজার লক খুলে দিলেন। যুবতীটি তক্ষুণি গাড়িতে ঢুকে পড়ল। বুঝলাম, কর্নেলের সৌম্যকান্তি এবং ঋষিসুলভ দাড়িই তাকে সাহায্যপ্রার্থিনী . করেছে। না হলে এমন অবস্থায় কোও অচেনা লােকের গাড়িতে কোনও একলা যুবতী এভাবে ঢুকে পড়ত না। 

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যেতে চান ? . : : ‘ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। 

‘অসুবিধে হবে না। আমরা এলিয়ট রােডে যাচ্ছি। জয়ন্ত, সামনের মােড়ে ঘুরে পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কী বলে? মনে মনে বিরক্ত হলেও বললাম, ঠিক আছে। 

জ্যাম ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। কর্নেল আবার অর্কিড নিয়ে পড়লেন। আমার মন শ্যাকসিটে। মেয়েটি মােটামুটি সুন্দরী বলা চলে এবং কথাবর্তাও যেটুকু শুনলাম, আর্জিত উচ্চারণ—ভদ্ৰপরিবারের বলেই মনে হচ্ছে। স্বভাবত আগ্রহ ছিল, কী তার নাম, কোথায় একা গিয়েছিল এবং কী ভাবে দুটো লােক তার পিছু নিল।

কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২

কিন্তু মার বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটি কোনও প্রশ্ন করার সুযােগই দিলেন না। পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকে বললাম, কোথায় নামবেন বলবেন। | ‘বেশি দূরে নয়।’ বলে সে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। কিন্তু ফ্রি স্কুল স্ট্রিট প্রায় কার। বড় দোকানপাট আজ রবিবারে বন্ধ। শুধু পান-সিগারেটের দোকানে মােম নহে। লােডশেডিং এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টি। 

কিছুক্ষণ পরে সে বলে উঠল, এখানে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে শুধু ‘অসংখ্য ধন্যবাদ’ বলে অন্ধকারে বাঁদিকের ফুটপাতে অদৃশ্য হলাে। 

কর্নেল বললেন, তা হলে দেখ জয়ন্ত, যা বলছিলাম— 

‘ঠিকই বলছিলেন। জীবনের সর্বত্র নাটক। রাস্তাঘাটেও নাটক। হাসতে হাসতে এলাম। জানি না এটা একই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক কিনা বলে গাড়ি ডাইনে নিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকলাম। দূরে আলােকিত বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। ‘ভার্সিং । ঝটপট বললাম, “প্লিজ কর্নেল। আর কখনও ডার্লিং বলবেন না। আপনার ডার্লিং শুনে আমাদের কাগজের জনৈক সমালােচক বেজায় খাপ্পা হয়ে গেছেন। তা ছাড়া আপনি কথায় কথায় বড্ড বেশি ইংরেজি বলেন। এও নাকি ওঁর পক্ষে বিরক্তিকর। 

কর্নেল কান করলেন না আমার কথায়। বললেন, ‘ডার্লিং! অর্কিড বা পরগাছা গাছপালার জগতে যেমন, মানুষের জীবনেও তেমনই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আসলে মানুষের সভ্যতার একটা অদ্ভুত লক্ষণও কিন্তু এই অর্কিড় জাতীয় পরজীবী সম্প্রদায়। হয়তাে বা আমরা প্রত্যেকেই কোনওনা-কোনও সময় অর্কিডের ভূমিকা নিয়ে বেঁচে থাকি।। 

কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -২

‘আহ্ কর্নেল! দার্শনিক তত্ত্ব থাক। ওই মেয়েটি সম্পর্কে কী মনে হলাে, বলুন। ‘ওকেও তুমি অর্কিড বলতে পারে। ‘কী মুশকিল! আপনার মাথায় অর্কিডের ভূত ঢুকে গেছে দেখছি। ‘জয়ন্ত! মেয়েটি পরজীবী শ্রেণীর। ‘তার মানে? ‘আমরা একজন কলগার্লকে লিফ্ট দিলাম।’ গাড়ির গতি কমিয়ে বললাম, বলেন কী! 

‘য়ে বাড়িতে ও ঢুকে গেল, সেই বাড়িতে কিছুদিন আগেই পুলিশ হানা দিয়েছিল। তুমি সাংবাদিক। তােমার মনে পড়া উচিত, এক ডজন কলগার্লকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল। ওদের কেউ কেউ নার্কোটিকসের কারবার করত। সেদিনকার খবর। 

 একটু হেসে বললাম, বাড়িটা আপনার চেনা দেখছি।’ 

কর্নেল এতক্ষণে হাসলেন। শুধু বাড়িটা নয়, মালিকও আমার চেনা। ভদ্রলােক একজন অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ান। হ্যারি ওলসন নাম। গােবেচারা নিরীহ মানুষ। বয়স প্রায় আশির ওপরে। আসলে কলগার্ল বা নার্কোটিকসের ব্যাপারটা ওঁর এক্তিয়ারের বাইরে। তাে যা বলছিলাম—সেই অর্কিড, বিষাক্ত অর্কিড শরীরে গজিয়েছে হ্যারি ওলসনেরও। ফলে তাঁর অবস্থা কল্পনা করাে। 

কল্পনা করছি এখন সবখানে সবকিছুই অর্কিডে ঢাকা। আমার ভয় হচ্ছে কর্নেল, শেষে আপনি না আপনার প্রিয় ষষ্ঠীচরণকেও অর্কিড ভেবে বসেন। তা হলে কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে কফির আশা বৃথা।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *