সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১০

যাই হােক, দিদিমা সেই যে শয্যাশায়িনী হলেন তাে হলেন। নাড়ডাক্তারের মােক্ষম সব ইঞ্জেকশন আর ওষুধে কাজ হল না। এরপর শহরের ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন বাবা। তিনিও দিদিমাকে বিছানা থেকে ওঠাতে পারলেন না। কোমরের যন্ত্রণাও কমল না। শেষে এলাকার নামকরা কবিরাজমশাইকে আনা হল।

লােকে তাকে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী’ বলত। কিন্তু তাঁর ওযুধেও কাজ হল না। আমার মনে পড়ে, প্রতিদিন ভােরবেলা হামানদিস্তার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। দেখতুম, মা বারান্দায় বসে ছােট্ট গােলাকার লােহার পাত্রে একটা ছােট্ট লােহার ডাণ্ডা দিয়ে কিছু পিষছেন। ছােটমামার কাছে শুনেছিলুম, ধন্বন্তরী’ কবিরাজমশাইয়ের দেওয়া ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে। সেই ওষুধ দিদিমার কোমরে প্রলেপ দেওয়া হবে।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

কিছুদিন পরে এক রবিবার সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা দিদিমাকে দেখতে এলেন। তিনিই মাকে পরামর্শ দিলেন,—সবরকম চিকিৎসা তাে করা হল। কিন্তু কাজ হল না। এবার টোটকা ওষুধ বা তুকতাক, মন্তরতন্তরে যদি বাত সারে, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী ? 

মা বললেন, আমিও তা-ই ভাবছিলুম। কিন্তু তেমন কাকেও পাচ্ছি কোথায়? সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা বললেন,—কেন? তেমন লোেক তাে হাতের কাছেই আছে। কথায় বলে, গেঁয়াে যােগী ভিক্ষে পায় না। 

—কে সে? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১০

—মােনাওঝা। আবার কে? ওই যে তােমার মা বারবার বলেন, কোমরে কে কামড়ে ধরে আছে, তাতেই তাে আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল। তােমরা কী ভাববে বলে কথাটা বলিনি। আমাদের আমবাগানে একটা গাছ আছে। সেই গাছের। তলায় বৃষ্টির সময় তােমার মা-থাকগে ওসব কথা। মােনাকেই ডাকো! 

কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলুম। আমার মনে পড়েছিল, সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে দুলেপাড়ার একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কী ভুল! কী ভুল! রথের মেলায় যাওয়ার দিন সেই কথাটা একেবারে মনে ছিল না! নির্ঘাত আমরা সেই গাছটারই তলায় বৃষ্টির সময় আশ্রয় নিয়েছিলুম। 

ছােটমামা বিকেলে মােনা-ওঝাকে ডেকে নিয়ে এলে ওর প্রমাণ মিলল। মােনা ওঝার মাথায় জটা, মুখে গোঁফদাড়ি। কপালে লাল ত্রিপুক আঁকা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কঁাধের অপ্লিমারা গেরুয়া রঙের ঝােলা থেকে সে একটা মড়ার খুলি বের করে দিদিমার ঘরে ঢুকল। তারপর মেঝেয় বসে মড়ার খুলিটা রেখে সে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ডাকল,“ওগাে মা! ও জননী! বলুন তাে আপনার কোথায় ব্যথা ? 

দিদিমা ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বললেন,—কোমরের পেছনে। 

—ব্যথাটা কীরকম বলুন তাে মা? দিদিমা একটু ককিয়ে উঠে বললেন, কে যেন কামড়ে ধরে আছে। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১০

মােনা-ওঝা হি-হি করে হেসে বলল,“বুঝেছি! বুঝেছি! এবার বলুন তাে মা। জননী, কবে কখন ব্যথাটা শুরু হয়েছিল? 

মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মােন তাঁকে চোখের ইশারায় চুপ করাল। দিদিমা অতিকষ্টে বললেন,—পুঁটুর সঙ্গে রথের মেলায় গিয়েছিলাম। হঠাৎ বিষ্টি এল। আমরা সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে এসে— 

মােনা-ওঝা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,–থাক, থাক। আর বলতে হবে না। বলে সে মড়ার খুলিটার দিকে রাঙা চোখে তাকাল। শুনলি তাে বাবা মা-জননীর কথাটা? এবার তুই আমার কানে কানে বলে দে, কী করে ওই হতচ্ছাড়ি পেতনিটাকে তাড়ানাে যায়? 

সে মড়ার খুলিটা কানের কাছে কিছুক্ষণ ধরে ফেঁস করে সশব্দে শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, “। গলায় দড়ি দিয়ে মরা আত্মা। পেতনি হয়ে গেছে। মা-জননীর কোমর কামড়ে ধরে জ্যান্ত মানুষদের ওপর রাগ দেখাচ্ছে। 

বলে মােনা-ওঝা মায়ের দিকে তাকাল,—দিদি! খুলেই বলছি। এ পেতনিকে তাড়ানাে আমার কম্ম নয়। কালিকাপুরে বাবা কন্ধকাটার থান আছে। সেই থানের খানিকটা মাটি তুলে এনে মা-জননীর কোমরে মাখিয়ে দিলেই পেতনিটা পালিয়ে যাবে।

 ছােটমামা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন,-কালিকাপুর আমি চিনি। গতবার ফুটবল খেলতে গিয়ে একটা রাজবাড়ির ধ্বংসস্তুপ দেখেছিলুম। জায়গাটা একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে। 

মােনা-ওঝা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,—বাবা কন্ধকাটার থান সেই জঙ্গলের মধ্যিখানে। একটা ভাঙা দেউড়ি এখনও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা বটগাছ। বটগাছের তলায় বাবা কন্ধকাটার থান।। 

ছােটমামা বললেন,কুছ পরােয়া নেই। এখনই বেরিয়ে পড়ছি। সওয়া চারটের ট্রেনটা পেয়ে যাব। মােটে তিনটে স্টেশন। 

মােনা জিভ কেটে বলল,—উঁ হুঁ হুঁ হুঁ! কন্ধকাটা কথাটা দাদাবাবু কি বুঝতে পেরেছেন? মুন্ডু নেই। বুকের দুপাশে দুটো চোখ।সাংঘাতিক ব্যাপার! আপনাকে থানে দেখতে পেলেই সর্বনাশ।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *