কিন্তু ভূত হলে কী হবে? দেহের ওপর মায়া কি সহজে যায়? কিন্তু দেহ তাে তখন কঙ্কাল! আমার মনে হচ্ছে, ওই দুই ভূতের মধ্যে খুলি বদল হয়ে গিয়ে গণ্ডগােল
বেধেছিল।
ছােটমামা বলেছিলেন, ঠিক বলেছ মােনাদা! একজন ছিলেন সাদাসিধে ভদ্রলােক। অন্যজন ছিলেন কোনও সাধুবাবা।
দিদিমা বলেছিলেন, তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু যে যার নিজের খুলি ফেরত পেয়ে মারামারি বাধাল কেন?
ছােটমামার অমনি জবাব,মনে হচ্ছে, সাধুবাবার ভূতের জন্য সেই ভূত ভদ্রলােক যে খুলিটা থানে রেখেছিলেন, সেটা সাধুবাবার খুলিই নয়। মাথায় ফিট করেনি বলেই দৌড়ে গিয়ে সাধুবাবা খটাখট ঘুষি মারছিল ভূত-ভদ্রলােককে।
মােনা-ওঝা খিকখিক করে হেসে বলেছিল,—ওসব কথা থাক। মা-জননীর কোমর থেকে পেতনিটা পালিয়ে গেছে। তবে জোরে কামড়ে ধরেছিল তাে? তাই ব্যথা পুরােপুরি সারতে আর দিনতিনেক লাগবে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৩
হা। মােনা ঠিকই বলেছিল। তিনদিন পরে দিদিমা দিব্যি হাঁটাচলা করতে পেরেছিলেন।…
হরির হােটেল।
মশনে ট্রেন থামতে না-থামতেই যাত্রীদের মধ্যে হুলস্থুল বেধে গিয়েছিল।
ভিড়ে ঠাসা কামরা। পিছন থেকে প্রচণ্ড চাপ আর গুঁতাে টের পাচ্ছিলুম। তারপর দেখলুম, কেউ-কেউ আমার কাঁধের ওপর দিয়ে কসরত দেখিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে চঁাচামেচি চলেছে। অবশেষে ঠেলা খেতে-খেতে যখন প্ল্যাটফর্মে পড়লুম, তখন আমার ওপর দিয়ে অসংখ্য জুতাে-পরা পা ছুটে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, অন্য সব কামরা থেকেও পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে স্টেশনের গেটের দিকে ছুটে চলেছে।
রাগ করে লাভ নেই। কার ওপরই বা রাগ করব! নিমেষে প্ল্যাটফর্ম নির্জন নিঝুম হয়ে গেল। কঁাধের ব্যাগ আর পােশাক ঝেড়েকুড়ে রুমালে মুখ মুছলুম। ট্রেনটা হুইসল বাজিয়ে আস্তেসুস্থে চলে গেল। সেই সময় হঠাৎ মাথায় এল, ট্রেনে ডাকাতি হচ্ছিল সম্ভবত। তাই অত সব যাত্রী প্রাণভয়ে ট্রেন থেকে ঝাপিয়ে পড়ে পালিয়ে গেল!
এতক্ষণে ভয় পেলুম। রাত আটটা বাজে। প্ল্যাটফর্মে আর স্টেশনঘরে আলাে জ্বলছে। গেটে মানুষজন নেই। সেখানে গিয়ে একটু দাঁড়ালুম। ডাকাতরা ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনঘরে ঢুকে হামলা করেছে কি না দেখবার জন্য উঁকি মারলুম।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৩
হরির হােটেল স্টেশনঘরে উর্দিপরা এক ভদ্রলোেক চেয়ারে বসে চোখ বুজে ঝিমােচ্ছন। তাকে বললুম,—একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি ?
তিনি চোখ না খুলেই বললেন,—পারেন। তবে আপনার বরাতে হরির হােটেল আছে।
অবাক হয়ে বললুম, হরির হােটেল মানে?
এ তল্লাটে নতুন এসেছেন। যাবেন কোথায় ?
কাঞ্চনপুর।
সেখানে কার বাড়ি যাবেন? একটু বিরক্ত হয়ে বললুম,—সেখানে আমার বন্ধুর বাড়ি।
রেলকোট পরা ভদ্রলােক এবার চোখ খুলে একটু হেসে বললেন, “। আপনার বন্ধু আপনাকে এখানকার হালহদিশ কিছুই জানাননি দেখছি। তা কী আর করবেন? হরির হােটেল এখন আপনার ভবিতব্য।
কথা না বাড়িয়ে বললুম,—গেটে টিকিট নেওয়ার লােক নেই। টিকিটটা নেবেন কি?
—টিকিট কেটেছেন? তা এ তল্লাটে নতুন প্যাসেঞ্জার। টিকিট কাটবেন বইকী। ইচ্ছে হলে দিন। না হলে দেবেন না।
বুঝলুম, এই ভদ্রলােকই স্টেশনমাস্টার। মাথায় হয়তাে ছিট আছে। টিকিটটা ওঁর সামনে টেবিলে রেখে বললুম,আচ্ছা, এবার বলুন তাে, অতসব যাত্রী ট্রেন থেকে ওভাবে মরিয়া হয়ে নেমে দৌড়ে পালাল কেন?
—আজ যে শনিবার। তাতে ট্রেন চার ঘন্টা লেট।
বুঝলুম না। বুঝতে পারবেন। গেট পেরিয়ে নিচের চত্বরে যান।
গেট পেরিয়ে গিয়ে দেখি, কয়েক ধাপ সিঁড়ির নিচে একটা ভােলামেলা জায়গা। একপ্রান্তে কিছু দোকানপাট। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় লক্ষ করলুম, চত্বর একেবারে জনহীন। আমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নির্মল বলেছিল, স্টেশন থেকে নামলেই বাস, সাইকেলরিকশা বা এক্কা ঘােড়ার গাড়ি একটা কিছু পেয়ে যাব। কিন্তু কোথায় তারা?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৩
একটা চায়ের দোকানে আলাে জুলছিল। সেখানে গিয়ে বেঞ্চে বসে বললুম, পরের বাস কটায় দাদা?
চা-ওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, বাবুমশাইয়ের আসা হচ্ছে কোথেকে?
কলকাতা। —ঠিক, ঠিক। তা যাওয়া হবে কোথায়?
কাঞ্চনপুর। পরের বাস কখন আসবে?
বাবুমশাই! এ রাত্তিরে আর বাস আসবে না। আসবে সেই ভােরবেলা। কেননা রাত্তিরে তে এই স্টেশনে আর কোনও ট্রেন থামে না।
Read More