অগত্যা হােটেল থেকে বেরিয়ে আসছি, হরি হঠাৎ ব্যস্তভাবে ডাকল, স্যার! শুনুন স্যার!
ঘুরে দাঁড়ালুম। সে আমাকে অবাক করে ছটা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট আমার হাতে গুঁজে দিল। বললুম,—অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট কী হবে?
হরি মুচকি হেসে বলল,—বাইরের মানুষ! হরির হােটেলে খেয়েছেন। যদি দৈবাৎ অম্বল হয়-টয়! আপনি আমার এ রাত্তিরের একমাত্র খদ্দের স্যার! আপনি আমার সার্টিফিকেটও বটে।
বলে সে হােহাটেলে ফিরে গেল। আমি এতক্ষণে একটু চিন্তায় পড়লুম। খেতে ততা সবই সুস্বাদু মনে হচ্ছিল। তাই খেয়েছিও প্রচুর। প্যান্টের বেল্ট ঢিলে করতে হয়েছে। কিন্তু অ্যান্টাসিড কেন?
দুধারে মাঠ। নির্জন পিচরাস্তায় গুনগুন করে সত্যিই মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে হাঁটছিলুম। জ্যোৎস্নায় চারদিক বেশ স্পষ্ট। কিছুদূর চলার পর মনে হল পেট বেজায় ওজনদার হয়ে উঠছে। তখন দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট মুখে পুরে চুষতে থাকলুম।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৫
আরও কিছুদূর হাঁটার পর পেটের ওজন কমেছে মনে হল। সেইসময় নেহাত খেয়ালবশে একবার পিছু ফিরে দেখি, আমার পিছনে কেউ হেঁটে আসছে। একজন সঙ্গী পাওয়া গেল ভেবে দাঁড়িয়ে গেলুম। অমনি সেই লােকটাও দাঁড়িয়ে গেল। বললুম,—কে?
কোনও সাড়া এল না। একটু ভয় পেলুম। ছিনতাইবাজ বা ডাকাত নয় তাে? চলার গতি বাড়ালুম। তারপর এক অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ করলুম। যতবার পিছনে তাকাচ্ছি, দেখছি জ্যোৎস্নায় কালাে রঙের মূর্তির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশের মাঠ থেকে একজন-দুজন করে আরও লােক এসে সেই ছায়ামিছিলকে বাড়িয়ে তুলছে।
অবশেষে ঘুরে দাড়িয়ে চঁাচামেচি করে বললুম,—তােমরা যেই হও, আমার কাছে ভাকাতি করার মতাে মালকড়ি নেই। বন্ধুর মেয়ের অন্নপ্রাশনে উপহার দিতে কিছু পুন আর আমা কিনেছি। নগদ টাকাকড়ি যা আছে, তা তােমরা কেড়ে নিয়ে ভাগাভাগি করলে প্রত্যেকে একটা আধুলির বেশি পাবে না। কাজেই তােমরা কেটে পড়ে।
আশ্চর্য ব্যাপার, কালােকালাে মানুষের দল স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আবার ফিতা হেঁটে গিয়ে ঘুরে দেখি, তারা সমান দূরত্বে আমাকে অনুসরণ করছে। এরা
কারা ? অজানা ব্রাসে শিউরে উঠলুম। সাহস দেখিয়ে খুব চেঁচিয়ে বললুম, সাবধান। আমার কাছে রিভলভার আছে। আমি কিন্তু পুলিশের লােক। গুলি করে মুন্ডু উড়িয়ে দেন।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৫
কিন্তু এই হুমকিতেও কাজ হল না। আমি যত দ্রুত হাঁটছি, তারা একই দূরত্বে নিঃশব্দে হেঁটে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালে তারাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত ছায়াকালাে মিছিল পিছনে নিয়ে হেঁটে চলা সহজ ছিল না। আমার হরির হােটেল গলা তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে।
সঙ্গে জলের বােতল নেই। এমনকী একটা টর্চও আনিনি। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আমি দৌড়তে শুরু করলুম। দৌড়তে-দৌড়তে যতবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছি, সেই বিভীষিকার আমাকে অনুসরণ করছে।
কিছুক্ষণ পরে সামনে ঘন কালাে গাছপালার ফঁাকে রাস্তার ধারে একটা মন্দির দেখতে পেলুম। মন্দিরের উঁচু খােলা চত্বরে কারা বসে কথা বলছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই লােকগুলাে হইচই করে উঠল। —কে? কে?
হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম,আমি। কেউ ধমকে বলল,“আমি কে?
—আজ্ঞে আমি কলকাতা থেকে আসছি। যাব কাঞ্চনপুর। বাস ফেল করে বড় বিপদে পড়েছি।
একজন বলল,—তাই বলুন। তা বিপদটা কী?
—একদল কালােকালােলােক আমাকে ফলাে করে আসছে।
সর্বনাশ! আপনি কি হরির হােটেলে খেয়েছেন? —খেয়েছি। বড্ড খিদে পেয়েছিল।
অমনি আবার হইচই পড়ে গেল। –ওরে! এ হরির হােটেলে খেয়েছে রে। কী সর্বনাশ! আবার একা নয়, সঙ্গে হরির হােটেলে খাওয়া পুরাে দলটাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের গাঁয়ে এসেছে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৫
এইসব বলতে-বলতে লােকগুলাে মন্দিরের পিছনে উধাও হয়ে গেল। তারপর গ্রামের কুকুরগুলাে ডাকতে লাগল। আমি এবার কী করব ভাবছি, সেইসময় দেখলুম উঁচু চত্বরের পাশে একজন লােক দাঁড়িয়ে আছে। বললুম,—দেখুন তাে মশাই, কী অদ্ভুত ব্যাপার? বিপদে পড়ে এখানে ছুটে এলুম। অথচ এঁরা অমন করে পালিয়ে গেলেন!
লােকটি খিকখিক করে হেসে বলল,পালাবারই কথা। আপনি হরির হােটেলে খেয়েছেন কিনা।
করুণ স্বরে বললুম,—কেন? হরির হােটেলে খেলে কী হয়?
—যে খায়, সে ভেদবমি করে টেসে যায়।
—আমি কিন্তু কেঁসে যাইনি। হরিবাবু আমাকে অ্যান্টাসিড দিয়েছিলেন। দুটো খেয়েছি।
–দুটোতে কাজ হয় না মশাই! এখনও আপনার পেটে হরির হােটেলের ভাত
আছে তাে। তারই গন্ধে যত গণ্ডগােল বেধেছে। কারা আপনাকে ফলাে করেছে বলছিলেন যেন।
—। একজন-দুজন করে অন্তত তিরিশ-চল্লিশ জন হবে। জ্যোৎস্নায় সব কালােকালাে মূর্তি।।
—তারা হরির হােটেলে খেয়ে টেসে গেছে। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে। হরির রান্নাটা যে সুস্বাদু! সেই লােভে পড়ে পেট পুরে খেলেই কেলেঙ্কারি। ওরা ভেদবমি করে ভেঁসে গিয়েছে বটে, কিন্তু লােভটা যায়নি। আপনার পেট থেকে হরির সুস্বাদু রান্নার গন্ধ টের পেয়েই ওরা আপনার পিছু নিয়েছে। বুঝলেন তাে?
—বুঝলুম। কিন্তু আপনি দয়া করে আমাকে কাঞ্চনপুরে পৌঁছে দিন।
Read More