কাঞ্চনপুর আরও প্রায় এক কিলােমিটার। সেখানে কাদের বাড়ি যাবেন? —নির্মল সিংহের বাড়ি।
—ও! সিঙ্গিমশাইদের বাড়ি? চলুন। আমার বাড়িও ওই গ্রামে। তবে সাবধান, আপনি আগে-আগে চলুন। আমি যাব পেছনে!
—কেন? আমাকে কি আপনি ভয় পাচ্ছেন?
—কিছু বলা যায় না! হরির হােটেলে এ পর্যন্ত যারা খেয়েছে তারা সবাই কেঁসে গেছে।
—আহা! বলছি তাে আমার কিছু হয়নি!
লােকটি খিকখিক করে হেসে বলল, টাটকা কেঁসে যাওয়া বডি তাে! তাই প্রথম প্রথম কিছু টের পাওয়া যায় না। মনে হয়, এই তাে দিব্য আমার বডিখানা আস্ত আছে! কিন্তু আত্মার ভ্রম। আসলে বডি কখন চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
-কী অদ্ভুত!
—মমাটেও না। এমন হতে পারে আপনার বডির স্মৃতি আপনাকে এখনও আস্ত রেখেছে। যাক গে। চলুন। পিছনে তাকাবেন না। আমিও তাকাব না।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৬
কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর বললুম,—দেখুন! আপনার যেমন আমাকে ভয় করছে, তেমনি আমারও আপনাকে ভয় করছে! কখন পিছন থেকে আপনি কী করে বসবেন!
—ঘাড় মটকে দেব বলতে চান ? —যা অবস্থা, তাতে এবার ওটুকুই যা বাকি।
বাজে কথা বলবেন না! আপনি বড় অকৃতজ্ঞ মানুষ তাে!
—আমাকে মানুষ বললেন যখন, তখন আর আমাকে ভয় কেন? বরং আপনার ভয় পাওয়া উচিত যারা আমাকে ফলাে করে আসছিল, তাদের।
লােকটি থমকে দাঁড়াল। —এই রে! একেবারে ভুলে গেছি। আমার জামার পাশপকেটে টর্চ আছে। বের করা যাক। আগে আপনাকে টর্চের আলােয় দেখে নিই। তারপর এখনও কেউ পিছনে ফলাে করছে কি না দেখা যাক।
বলে সে টর্চ জ্বেলে আমাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে চেয় আলাে ফেলল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই আলােয় দেখলুম,
এ আস্ত কাল ছিটকে দুধারে গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। | আর লােকটাও সেই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। আমার ভােগ্য, তার হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা ছিটকে পড়েছিল। সেটা আমি কুড়িয়ে নিয়ে এবার নিয়ে হেঁটে চললুম।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৬
মাঝে-মাঝে পিছু ফিরে টর্চের আলাে ফেলছিলুম। কিন্তু আর কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল না। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তার বাঁকের মুখে মােটরসাইকেলের
হরির হােটেল
উজ্জ্বল আলাে দেখা গেল। তারপর মােটর সাইকেলটা আমার কাছে এসে থেমে গেল। নির্মলের সাড়া পেলুম। যা ভেবেছিলুম! এতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, আজ তোে শনিবার। পুঁটু কি অত ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে পারবে? হা রে! হেঁটে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তাে? আয়! ব্যাকসিটে বােস! দোষটা আমারই। বুঝলি? | মােটরসাইকেলের ব্যাকসিটে চুপচাপ উঠে বসলুম। যা ধকল গেছে, এখন আর কোনও কথা নয়।
নাঃ। পরেও আর কোনও কথা নয়। এমনকী হরির হােটেলে খাওয়ার কথাও চেপে যাব। হরির দেওয়া অ্যান্টাসিডের ট্যাবলেট দেখিয়ে বলব,রাতে কিছু খাব ! পেটের অবস্থা ভালাে না।
তাছাড়া আমি হরির হােটেলে খেয়ে এসেছি শুনলে নির্মল নির্ঘাত আমাকে ফেলে পালানাের চেষ্টা করবে। তার মানে, মােটরসাইকেলের অ্যাকসিডেন্ট এবং আমি নিজেই ভূত হয়ে যাব। সর্বনাশ!
শুধু একটাই ভাবনা, হরির হােটেলের ভাত যতক্ষণ না পুরাে হজম হচ্ছে, ততক্ষণ কি নির্মলের বাড়ির আনাচে-কানাচে সেই ছায়াকালােকালাে মিছিলের মূর্তিগুলাে গন্ধ শুকতে ঘুরঘুর করে বেড়াবে? দেখা যাক।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৬
ভূতে-মানুষে কালের লেখকদের এই এক ঝামেলা। পুজোসংখ্যা পত্র-পত্রিকা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সম্পাদকমশাইদের তাগিদ শুরু হয়ে যায়, পরের বছর পুজোসংখ্যার জন্য জানুয়ারির মধ্যেই লেখা চাই। সেবার জানুয়ারি পেরিয়ে মার্চ মাস এসে গেল।
কিন্তু আমার কলম যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করে বসল। আসলে মগজ একেবারে খালি। লেখা বেরুতে চায় না। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু গােদের ওপর বিষফোড়া। মার্চের মাঝামাঝি হঠাৎ আমার এক বন্ধু সন্দীপ এসে সােল্লাসে বলল,—কেল্লা মার দিয়া!
বললম,কী ব্যাপার?
—তােকে আমি বলেছিলুম না আগামী পুজোয় একটা পত্রিকা বের করব? টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। এবার আর আমাকে রেখে কে? পত্রিকার নামও ঠিক করে ফেলেছি। বুঝলি?
সন্দীপ কবে পত্রিকা বের করবে বলেছিল মনে পড়ল না। বললুম,— ভালাে। খুব ভালাে খবর। পত্রিকার কী নাম ঠিক করলি?
সন্দীপ একগাল হেসে বলল,-“ভূতভুতুম।
অবাক হয়ে বললুম,ভূতভুতুম? তার মানে, ভূতের গল্পের পত্রিকা করবি নাকি?
—হ্যা। তবে শুধু গল্প নয়। প্রবন্ধ থাকবে। পদ্য থাকবে। উপন্যাস থাকবে। আর সেই উপন্যাস তােকেই লিখতে হবে। টাকার কথা ভাবিস না। লেখকদের আমরা উপযুক্ত দক্ষিণাই দেব।
Read More