সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৭

ওর কথা শুনেই আমার মাথা ভোঁ-ভো করছিল। সন্দীপ যেমন জেদি, তেমনই গোঁয়ার-গােবিন্দ। করুণমুখে বললুম, সন্দীপ। তাের পত্রিকায় লিখে কি টাকা নিতে পারি? কিন্তু কথাটা কী জানিস? ভূতের আর একটুও চাহিদা নেই। সেই মান্ধাতার আমল থেকে ভূত নিয়ে এত লেখা হয়ে গেছে যে, পাঠক ভূতকে আর একটুও ভয় পায় না। তাছাড়া স্বনামধন্য ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায় ভূতের সার কথা লিখে গেছেন। এদিকে নতুন ভূত হলেও কথা ছিল। পুরােনাে ভূতেরা বাসি হয়ে পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাজেই

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

সন্দীপ আমার কথায় বাধা দিয়ে বলল, কী যে বলিস তুই! আমার আইডিয়াটাই তাে তাই অন্যরকম। তুই নতুন ভূতের কথা বললি। সেই আনকোরা নতুন ভূত নিয়েই শারদীয়া ভূতভুতুম পত্রিকা বের করতে চাই। তুই অ্যাদ্দিন অনেকরকম ভূতের গল্প লিখেছিস। এবার নতুনরকমের ভূত নিয়ে একখানা উপন্যাস তােকে লিখতেই হবে। তুই একালের ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায় হয়ে যাবি। 

হতাশ হয়ে বললুম,ভাই সন্দীপ! তােকে খুলেই বলি। এবার মানুষ নিয়েই কোনও লেখা আসছে না, তাে ভূত। 

—আহা, নতুন ভূত।

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৭ 

কিন্তু নতুন ভূত পাচ্ছি কোথায়? আমার মগজ একেবারে খালি। কল্পনার যন্ত্রটা মগজের মধ্যে থাকে। সেটাই বিগড়ে গেছে। কল্পনা ছাড়া কি লেখা হয় ? 

সন্দীপ একটু চুপ করে থাকার পর গম্ভীর হয়ে বলল,-বুঝেছি। কলকাতায় তাের এই ঘরে বইপত্তরের আবর্জনার মধ্যে বসে কি আর লেখা আসে? তাের প্রবলেম আমি বুঝেছি। এক কাজ কর। বীরভূম জেলার ঘুমঘুমিতলায় আমার ঠাকুরদার পৈতৃক একটা বাড়ি আছে। নিরিবিলিতে দোতলা বাড়ি। পিছনে পুকুর আছে। এই বসন্তকালে প্রকৃতি-পরিবেশ—আর পাখি-টাখির ডাক—মানে, ওয়ান্ডারফুল জায়গা!

বিশেষ করে লেখকদের লেখার জন্য অত সুন্দর জায়গা আর কোথাও নেই। বাড়িটার কেয়ারটেকারের নাম কালাচঁাদ। আমরা যখন ওখানে বেড়াতে যাই, তাকে কালাচঁদখুড়াে বলে ডাকি। ডানপিটে লােক। খুড়াে বললে খুব খুশি হয়। তুই আজই ওখানে চলে যা। একমাস দেড়মাস যদ্দিন খুশি থাকবি। লিখবি। তার চেয়ে বড় কথা, নতুন ধরনের ভূত দেখতে পাওয়ার চান্স ওখানে নাইন্টি নাইন পারসেন্ট! 

 সন্দীপের কথা আমার মনে ধরল। ওর পত্রিকার জন্য ভূতের উপন্যাস না লেখা হােক, স্থানবদলের দরুণ আমার মগজে কল্পনাশক্তিটা ফিরে আসবার সম্ভাবনা প্রচুর। তাই রাজি হয়ে গেলুম। সন্দীপ এস. টি. ডি. ফোনে ঘুমঘুমিতলায় তার বাবার ভূতে-মানুষে বন্ধু এক ডাক্তারবাবুকে জানিয়ে দেবে এবং তিনি কালাচঁাদকে আমার যাওয়ার খবরটা দিয়ে রাখবেন। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৭

হাওড়া স্টেশনে বারােটা পাঁচের ট্রেনে চেপে আমাকে নামতে হবে হিংলাডিহি স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে চেপে ঘুমঘুমিতলা পোঁছুব। স্টেশন থেকে আঠারাে কিলােমিটার দূরত্ব। বাসস্টপে কালাচঁাদ থাকবে। 

সন্দীপ চলে যাওয়ার সময় আবার বলে গেল,—প্রথমে কিন্তু আমার পত্রিকার জন্য উপন্যাস লিখতে বসবি। 

পরে বুঝতে পেরেছিলুম, সন্দীপ ভূতভুতুম’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার জন্য আমার উপন্যাস সর্বাগ্রে পেতে চায়। তাই আমাকে সে তার গাড়িতে চাপিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল এবং ট্রেনেও তুলে দিয়েছিল। 

 যে ট্রেনের হিংলাডিহিতে সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছুনাের কথা, সেই ট্রেন গদাইলস্করি চালে চলতে-চলতে পৌঁছুল সওয়া চারটেতে। বেরিয়ে গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে ঘুমঘুমিতলার বাস খোঁজ করলুম। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। কয়েকটা বাস দাঁড়িয়ে আছে এবং সবগুলােই ভিড়ে ততক্ষণে ঠাসা হয়ে গেছে। আরও লােক গিয়ে বাদুড়ঝােলা হয়ে ঝুলছে। অবস্থা দেখে দমে গেলুম। ঘুমঘুমিতলার বাসের খোঁজ যার কাছে নিচ্ছি, সেই বলছে,—ওপাশে দেখুন। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৭

আমার কাধে প্রকাণ্ড ব্যাগ আর হাতে ব্রিফকে। আমার বাসটারও যদি ওইরকম অবস্থা হয়, কেমন করে আমি তাতে চাপব বুঝতে পারছিলুম না। সেইসময় বেঁটে গােলগাল চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবিপরা এক ভদ্রলােককে দেখতে পেলুম। তাঁর কাঁধে একটা কাপড়ের নকশাকাটা ব্যাগ। তিনি একপ্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মাথায় টাক। মুখে কেমন একটা হাসি। তাঁর কাছে গিয়ে খোঁজ করতেই তিনি সহাস্যে বললেন,—একটু অপেক্ষা করুন। খবর নিয়েছি। যন্তর বিগড়ে জয় মা তারা এখন মানুবাবুর গ্যারাজে আছে। মিস্তিরিরা হাত লাগিয়েছে। বুঝলেন না? একটা ট্রিপ ফেল করলে মালিকের হেভি লস! 

বুঝলুম, বাসটার নাম জয় মা তারা। ভদ্রলােকের সঙ্গে ভাব জমানাের চেষ্টা করলুম। আপনি কোথায় যাবেন? 

ভদ্রলােক মুচকি হেসে বললেন,আপনি যেখানে যাবেন। তা মশাইয়ের আসা হচ্ছে কোখেকে? 

কলকাতা থেকে। —ঘুমঘুমিতলায় কাদের বাড়ি যাওয়া হবে? 

চাটুজ্যেমশাইদের বাড়ি। বাড়িটার নাম গিরিবালা ভবন।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৮

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *