সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৮

—তাই বলুন! অবনী চাটুজ্যে এখন কলকাতায় চলে গেছে। অবনী স্কুলে আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। তা—মশাই কি অবনীর আত্মীয়? 

না। অবনীবাবুর ছেলে সন্দীপ আমার বন্ধু। সন্দীপ, মানে সানু আপনার সঙ্গে আসেনি? 

—সে এখন ব্যস্ত। আমি একা এসেছি।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

ভদ্রলােক কেন কে জানে মুচকি হাসলেন। তা ভালাে। কালাচঁাদ আছে। গণ্ডগােল পড়লে সে একাই একশাে। 

একটু চমকে উঠেছিলুম। গণ্ডগােল মানে? কীসের গণ্ডগোেল? 

ও কিছু না। বলে ভদ্রলােক রাস্তার দিকে তাকালেন, রেডি হােন! জয় মা তারা আসছে মনে হচ্ছে। 

প্লিজ আমাকে বাসে উঠতে আপনি যদি একটু সাহায্য করেন 

—আলবাত করব। আমার বাল্যবন্ধুর ছেলের বন্ধু আপনি। এক কাজ করবেন। আপনি আমার পেছনে আঠার মতাে সেঁটে থাকবেন। ছেড়ে গেলেই বিপদ। সেঁটে থাকলে দেখবেন, ঠিক বাসের মধ্যিখানে পৌঁছে গেছেন। আগে থেকে সাবধান করে দিলুম।.

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৮ 

একটা খালি বাস হর্ন দিতে দিতে এসে দাঁড়ানােমাত্র আমি সত্যিই খালি বাঁহাত দিয়ে ভদ্রলােকের পেটের দিকটায় জড়িয়ে ধরেছিলুম। তারপর যেন ঝড় প্লাবন মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়ে অসহায় হয়ে প্রায় ভেসেই চললুম। এরপর কী ঘটল বুঝলুম না। একসময় দেখলুম, আমি সেই ভদ্রলােকের পাশে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে আছি। 

নাঃ! কঁাধের প্রকাণ্ড ব্যাগটা ঠিকই আছে। তবে ভদ্রলােকের পেটের ওপর আছে, এই যা। হাতের ব্রিফকেস দু-পায়ের ফাঁকে কখন ঢুকে গেছে। ভদ্রলােক শাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলে উঠলেন,“জয় মা তারা! 

আমিও মনে-মনে বললুম,—জয় মা তারা! 

বাসটার মধ্যে মানুষ আর জিনিস ঠেসে প্রায় দলা পাকিয়ে আছে। পিঠে খোঁচা খেয়ে অতিকষ্টে মুখ ঘুরিয়ে দেখলুম, বাইরে বাদুড়ঝােলা হয়ে লােকেরা ঝুলছে। ভেতরের লােকেরা চাচাচ্ছে,বাস চালাও! বাস চালাও! 

বাসের ছােকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে হাঁক দিচ্ছে,—ছেড়ে গেল! ছেড়ে গেল! বেলতলা! তেলতলা! ঝুমঝুমিতলা! ঘুমঘুমিতলা! 

যাত্রীদের চঁাচামেচিতে অবশেষে বাসের চাকা গড়াল। কিন্তু এ যে দেখছি ভূমিকম্প চ্ছে যেন! প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর মাঝে-মাঝে কেমন গোঁগোঁ গরর-গরর বিদঘুটে শব্দ। জানালার বাইরে মানুষের মাথা। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে সঙ্গী ভদ্রলােককে জিগ্যেস করলুম,—পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৮ 

তিনি হাই তুলে বললেন, রাস্তার বেহাল অবস্থা। দু-ঘণ্টাও লাগতে পারে। তিন ঘন্টাও লাগতে পারে। চিন্তা করবেন না। জয় মা তারা! 

বলে তিনি চোখ বুজলেন এবং তার চিবুকটা বুকে বসে গেল। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? 

খানাখন্দে পড়ে বাসের চাকা অদ্ভুত শব্দ করছে। বাসের গতি মন্থর। তারপর লক্ষ করলুম, সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট চিৎকার করে উঠছে। শুধু তলা’ শব্দটাই বুঝতে পারছি। আর বাসটা থেমে যাচ্ছে। ভাবছি, এই বুঝি বাস খালি হল। কিন্তু যতজন 

নামছে, তার বেশি উঠছেজোর ধস্তাধস্তি ধাক্কাধাক্কি ঝগড়া চলেছে দু-পক্ষের মধ্যে। অবশেষে আমার চোখ বুজে এল। কী আর করা যাবে? লেখার স্বার্থে এই কষ্টটা 

করে উপায় নেই। কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে ?.. 

একসময় সঙ্গী ভদ্রলােকের খোঁচা খেয়ে চোখ খুলতে হল। তিনি আমার ব্যাগটা আমার কোলে ঠেলে দিয়ে জয় মা তারা’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। বাসে তখনও যথেষ্ট ভিড়। আমিও ভদ্রলােকের দেখাদেখি উঠে পড়লুম এবং জনাতিনেক লােক আমাদের সিটে তখনই সশব্দে বসে পড়ল। তারপর ঠেলাঠেলি করে ভদ্রলােকের পিঠে আগের মতাে সেঁটে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেলুম।

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৮ 

এতক্ষণে দেখতে পেলুম, দরজার ধারে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টার টিকিটের পয়সা নিচ্ছে। ভদ্রলােককে তিন টাকা দিতে দেখে আমিও তা-ই দিলুম। অ্যাসিস্ট্যান্ট ‘তলা তলা’ বলে চঁাচাচ্ছিল। কোন তলা তা বােঝা যাচ্ছিল না। অবশেষে বাস থামল। ভদ্রলোেকর সঙ্গে আমিও নেমে গেলুম। কিন্তু আর কোনও যাত্রী নামল না। বাসটা চলে গেল। 

গাছের নিচে আবছা আঁধারে দাঁড়িয়ে দেখি, ভদ্রলােক এগিয়ে যাচ্ছেন।

কাছে গিয়ে বললুম,—ওঃ! একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হল বটে! তবে আপনি না থাকলে 

ভদ্রলােক আমাকে থামিয়ে খাক শব্দে হেসে বললেন,আরে কী কাণ্ড! আপনিও এই স্টপে নেমে পড়েছেন দেখছি। 

অবাক হয়ে বললুম,—কেন? আপনিও তাে ঘুমঘুমিতলায় নামবেন বলছিলেন। 

-কী বিপদ! এটা তাে ঝুমঝুমিতলা স্টপ! আপনি শােনেননি ঝুমঝুমিতলা বলে চঁাচাচ্ছিল? 

—সে কী! এটা ঝুমঝুমিতলা ? , মশাই! এই আক্রাগণ্ডার বাজারে খামােকা বাড়তি পঞ্চাশ পয়সা খরচ করতে যাব কেন? ঘুমঘুমিতলা এই স্টপ থেকে মাত্র দেড় কিলােমিটার। ওই দেখুন! চঁদমামা উঠেছে। জ্যোৎস্নায় এটুকু পথ হাঁটতে-হাঁটতে পদ্য রচনা করব। আমি একজন কবি। বুঝলেন তাে? 

এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লুম? কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। তাই বললুম,—দেড় কিলােমিটার জ্যোৎস্নায় হাঁটতে-হাঁটতে কল্পনাশক্তি জাগারই কথা। তা আপনি কবি? 

—বলতে পারেন বইকী! স্কুলের ম্যাগাজিনে পদ্য ছাপা হতাে। এখন মফস্বল শহরের পত্রিকাতেও ছাপা হয়। খানকতক পদ্য দিতেই তাে হিংলাডিহি গিয়েছিলুম। 

এবার আপনার নামটা জানতে পারি? 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৯

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *