সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৯

আমার নাম তারাচরণ যশ। আপনার বন্ধু সানু আমার পদ্য শুনে বলেছিল, যদি কখনও পত্রিকা করি, আপনার পদ্য সবার আগে ছাপৰ যশকাকা!

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

দেড় কিলােমিটার পথ হাঁটতে কথা বলাই ক্লান্তি থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায়। তাই বললুম,—আমিও তাহলে আপনাকে যশকাকা বলব! 

—বলুন! ইচ্ছে যখন হয়েছে, তখন বলুন। -আচ্ছা যশকাকা, সানুদের বাড়িতে কী গণ্ডগােলের কথা বলছিলেন? —এখন এই নিরিবিলি রাস্তায় রাত্রিকালে ওকথা বলা উচিত না। 

ভূতপ্রেতের গণ্ডগোেল নয় তাে? 

তারাচরণ যশ থমকে দাঁড়ালেন। রাম! রাম! রাম! পেছনে ঝুমঝুমিতলা। একটা বটগাছ আছে ওখানে। রাতবিরেতে পেতনি ঝুমঝুম শব্দে নূপুর বাজিয়ে নাচে। কাজেই রাম রাম রাম। 

তিনি আবার পা বাড়ালেন। বললুম, ঠিক আছে। আপনার একটা পদ্য শােনান বরং। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৯

যশবাবু হাসলেন। কদিন থেকে একটা পদ্য লিখছি। তবে শেষ লাইনটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না। বড় সমস্যায় পড়েছি। আপনি তাে কলকাতায় থাকেন। শিক্ষিত মানুষ। একটু সাহায্য করতে নিশ্চয় পারবেন। 

ঝোঁকের বশে বলে ফেললুম,আমি আগে পদ্যই লিখতুম। এখন অবশ্য গদ্য লিখি। শারদীয়া সংখ্যা পত্র-পত্রিকায় লেখার জন্যই নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলুম। সন্দীপ 

ওদের গ্রামের বাড়ির কথা বলল। তাই চলে এলুম।। 

যশবাবু যেন লাফিয়ে উঠলেন। বলেন কী? মশাইয়ের নাম? নামটা বানিয়ে বলতে হল। আমার নাম কল্লোল গুপ্ত। 

বাঃ! অপূর্ব নাম! শুনেছি-শুনেছি মনে হচ্ছে। হাআপনার লেখাও পড়েছি মনে হচ্ছে। 

—আপনি না বলে তুমি বললেই খুশি হব যশকাকা। 

যশবাবু খুশি হয়ে বললেন,—তাই বলছি। তা—তুমি যখন পদ্য লিখতে একসময়, তখন তুমিই আমার অসমাপ্ত পদ্যটার একটা হিল্লে করতে পারবে। তাহলে বলি পদ্যটা? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৯

-বলুন! যশবাবু গলা ঝেড়ে চঁাদের দিকে তাকিয়ে সুর ধরে বললেন, পাতুবাবু ছাতু খান অতি আহ্বাদে জল্লাদ ধরে নিয়ে যায় প্রহ্লাদে । রামবাবু রেগে লাল সন্দেশে কেন ঝাল… 

এবার যশবাবু থেমে গেলেন। শাস ছেড়ে বললেন,—শেষ লাইনটা মেলাতে হবে প্রথম লাইনের সঙ্গে। কিন্তু আদে, প্রহ্লাদের সঙ্গে মিলবে এমন কোনও শব্দই খুঁজে পাচ্ছি না। 

একটু ভেবে নিয়ে বললুম, পাতুবাবু ছাতু খান অতি আহ্বাদে জল্লাদ ধরে নিয়ে যায় প্রহ্লাদে ভূতে-মানুষে রামবাবু রেগে লাল সন্দেশে কেন ঝাল ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে। 

যশবাবু এবার সত্যিই লাফিয়ে উঠলেন। বাঃ! ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! অপূর্ব! ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! মুখস্থ করি। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে লিখে ফেলতে হবে। নইলে ভুলে যাব। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্পা দে। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! ঝাল মেপে দেখি ওরে শর্টকাটে যাইরে! দাঁড়িপাল্লা দে।। 

সুর ধরে বলতে-বলতে তারাচরণবাবু বাঁ-দিকে ঘন কালাে রঙের মধ্যে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। একটু পরে বুঝতে পারলুম, ওটা একটা আমবাগান। শর্টকাটে আমবাগানের ভেতর দিয়ে উনি বাড়ি গিয়ে এখনই লাইনটা লিখে ফেলবেন। কিন্তু কেন যে সন্দীপের ভূতভুতুম’ পত্রিকার কথাটা বলিনি। বললে উনি আমাকে গিরিবালা ভবনে পৌঁছে দিতেন।

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-১৯

 নিজের বােকামিতে রাগ হচ্ছিল। ঘুমঘুমিতলায় কালাচঁাদখুডাের থাকার কথা। এখনও সেটা কতদূরে কে জানে! 

কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ পাশের একটা গাছের ছায়া থেকে কেউ রাস্তায় এসে করজোড়ে প্রণাম করে বলল,—মশাই কি কলকাতা থেকে আসছেন? মশাই কি সানুবাবুর বন্ধু? 

বললুম, হঁ্যা। তুমি কি কালাচঁদ-খুড়াে? 

জ্যোৎস্নায় লােকটাকে ছায়ামূর্তি বলে মনে হচ্ছিল। সে বলল,“আজ্ঞে না। আমি কালাচঁাদ না। গােরাচঁাদ। কালাচঁাদের মাসতুতাে ভাই। কই দিন আপনার মালপত্তর। আমি বয়ে নিয়ে যাই। আপনি আরামে হেঁটে আসুন। 

গােরাচঁাদকে আমার কাধের ব্যাগ দিলুম। হাতের ব্রিফকেসটা সে প্রায় ছিনিয়ে নিল। কিন্তু সে এমনভাবে হাঁটতে থাকল যে আমি তার সঙ্গ ধরতে হাঁপিয়ে উঠছিলুম। তাই বললুম,—ও গােরাচঁাদ খুড়াে! একটু আস্তে হাঁটো। এই খানাখন্দে ভরা রাস্তায় আছাড় খাব যে! 

গােরাচঁাদ গতি কমিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। জ্যোৎস্নায় মানুষের দাঁত কি অত চকচক করে? সে সহাস্যে বলল,আমাকেও খুড়াে বলছেন? বাঃ! আপনি খুব ভালাে লােক। কালাচঁাদকে গ্রামের সব্বাই খুড়াে বলে। আমাকে কেউ খুড়াে বলেনি। 

“আচ্ছা গােরাচঁাদখুড়াে, তারাচরণ যশমশাইকে তাে তুমি চেনাে। —খুব চিনি। চিনি বলেই তাে গাছপালার ছায়ার আড়ালে চুপিচুপি হাঁটছিলুম। —কেন? 

—আজ্ঞে ওঁর পদ্য শােনার ভয়ে। গত আশ্বিন মাসে এক রাত্তিরে একশাে একখানা পদ্য শুনিয়ে ছেড়েছিলেন। অগত্যা কী করব? আমিও ওঁকে বাবা! নামটি আমার গােরাচঁাদ! 

 

Read More.

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২০

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *