তিন মাইল মানে দেড় ক্রোশ।
মাটির রাস্তা শরৎকালে মােটামুটি শুকিয়ে খটখটে হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও একটু কাদা আছে। দুধারে আদিগন্ত ধানক্ষেত। কখনও গাছপালার জটলা বা ঝােপঝাড়। দোমােহানির হাটতলায় পৌঁছে দেখি সত্যি ম্যাজিকের তাবু বসেছে। একটু পরেই মাইকে গানবাজনা শুরু হয়ে গেল। মনটা নেচে উঠল। খয়রা মাছ কিনেই ম্যাজিকের টিকিট কাটতে বললুম ছােটমামাকে।
ছােটমামা যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছিল, সেখানে গেলেন। হাটে বড় ভিড়। ছােটমামার কোমরের কাছে শার্টটা আঁকড়ে ধরেছিলুম, পাছে হারিয়ে যাই।
একটু পরে দেখলুম, ভােলারাম মিথ্যা বলেনি। খয়রা মাছগুলাে তার হাতের মতাে বড় না হলেও আমার হাতের সাইজ। দরাদরি করে ছােটমামা সাত টাকায় এক কেজি খয়রা কিনে থলেয় ভরলেন। তারপর ভিড়ের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, বুঝলি পুঁটু, দর আরও কমবে। কিন্তু আমারও যে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখতে ইচ্ছে করছে। ওই শােন! কী বলছে ম্যাজিশিয়ান।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২
কালাে প্যান্ট-কোট, শার্ট আর মাথায় টুপিপরা একটা লােক গেটের পাশে অঙ্গভঙ্গি করে চঁাচাচ্ছিল,—আড়! আড়ম্ভ! একখুনি আড়ম্ভ হয়ে যাবে। আ—— ম-ভাে—ওওও!
আরম্ভ’-কে আড়ম্ভ বলায় খুব মজা পাচ্ছিলুম। বললুম,—চলুন ছােটমামা। এখনই টিকিট কিনে সামনের সিটে বসে পড়ি। দেরি করলে পিছনে বসতে হবে।
ঠিক বলেছিস পুঁটু! বলে ছােটমামা মাছের থলেটা সাবধানে একটু গুটিয়ে নিয়ে দুটো টিকিট কাটলেন। তারপর আমাকে এক হাতে টেনে তাঁবুতে ঢুকলেন।
ভিতরে ঢুকে নিরাশ হলুম। কোনও চেয়ার-বেঞ্চ নেই। মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা আছে, কিন্তু ততক্ষণে সামনের দিকটা লােকেরা ঠাসাঠাসি করে বসেছে। ছােটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,—কোনও মানে হয়? তাের না হয় হাফপেন্টুল। আমার যে ফুলপ্যান্ট! শােন! এই পিছনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখব।
বাইরে সেই লােকটা, যাকে ম্যাজিশিয়ান ভেবেছিলুম, সে এবার চঁাচাচ্ছে, কাটামুণ্ডু! কাটামুণ্ডু কথা বলবে,—এ-এ! আড়মভাে-ও-ও-ও!
ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ছােটমামা আর আমার পিঠ তখন তঁাবুর কাপড়ে ঠেকেছে। এতক্ষণে স্টেজের পরদা উঠল। তারপর দেখি, আমি ম্যাজিশিয়ানকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলুম। সে কোন পথে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছে ভেবে পেলুম না। সে বলল,“আমি প্রফেসর বংকারাম হাটি। আমি বাগে পেলেই লােকের মাথা কাটি।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২
সবাই হেসে উঠল। সে বেশ মিল দিয়ে কথা বলছিল। আমিও হেসে অস্থির হচ্ছিলুম; দেখলুম, ছােটমামাও খুব হাসছেন।।
প্রথমে কয়েকটা আশ্চর্য ম্যাজিক দেখানাের পর ম্যাজিশিয়ান বলল,-এবার আমি সেরা খেলাটা দেখাব। কাটামুণ্ডুর খেলা। কাটামুণ্ডুর গলায় দেখবেন চাপ-চাপ রক্ত। খােকাখুকুরা ভয় পেলে চোখ বুজে থেকো। ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করলেই খেলা পণ্ড হয়ে যাবে।
এবার দুটো লােক একটা টেবিলের মতাে জিনিস স্টেজে আনল। জিনিসটার চারদিকে কালাে কাপড়ে ঘেরা। ম্যাজিশিয়ান বলল,-তাহলে কাটামুণ্ডুর খেলা শুরু করি। ওয়ান টু থ্রি! | অমনি দেখি, ওপরের অংশে কালাে কাপড় পরদার মতাে গুটিয়ে গেল। তারপর যা দেখলুম, আঁতকে উঠে ছােটমামাকে আঁকড়ে ধরলুম।
টেবিলের ওপর একটা মানুষের মুণ্ডু। গলার কাছে চাপ-চাপ রক্ত। কিন্তু মুন্ডুটা দিব্যি হাসছে। চোখ নাচাচ্ছে। এ তাে ভারি অদ্ভুত!
ম্যাজিশিয়ান বলল,—অ্যাই কাটামুণ্ডু! তাের নাম কী? কাটামুণ্ডু বিদঘুটে গলায় বলল,—ঘংঘাড়াম।
—ভালাে করে বল! -বললুম তাে। ঘংঘাড়াম!
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২
ম্যাজিশিয়ান হাসতে-হাসতে বলল,—গলাকাটা তাে? তাই বােঝা যাচ্ছে না। ওর নাম গঙ্গারাম। আচ্ছা বাবা গঙ্গারাম! তাের বাড়ি কোথায় ?
কাটিহারের গঙ্গারাম
—কাটিহাঁড়!
ম্যাজিশিয়ান লাফ দিয়ে সরে বলল,“ওরে বাবা। এ যে বলছে কার্টি হাড়। মানে হাড় কাটবে। অ্যাই গঙ্গারাম! ঠিক করে বল।
কাটিহাড়! কাটিহাড়!
ম্যাজিশিয়ান কান পেতে শােনার ভঙ্গি করার পর হাসল, কাটিহার বলছে। বিহারে কাটিহার আছে না? সেই কাটিহার। তা বাবা কাটিহারের গঙ্গারাম, তাের মুণ্ডু কাটল কে?
কাটামুণ্ডু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,—বংকারাম!
ম্যাজিশিয়ান লাফিয়ে উঠল,“ওরে বাবা! বংকারাম বলছে যে! আমিই তাে বংকারাম! এক্ষুনি আমাকে পুলিশে ধরবে। ওরে! তােরা কাটামুণ্ডুকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখ!
আবার কালাে পরদাটা টেবিলের ওপর ঘিরে ফেলল। সেই লােকদুটো পরদা েটেবিলটা স্টেজের পিছনে নিয়ে গেল।
দর্শকরা হাততালি দিল। ম্যাজিশিয়ান হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে একটু ঝুঁকে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করল।…
ম্যাজিক শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে দেখি, হাট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মেছাে মেছুনিরা পিদিম জ্বেলে তখনও মাছ নিয়ে বসে আছে। গ্যাসবাতি জ্বেলে বসে আছে কিছু পশারি। ম্যাজিক-দেখা লােকগুলাে ছড়িয়ে পড়ল কে কোথায় কে জন। তবে মেছাে-মেছুনিদের দিকে আবার ভিড় দেখলুম। ছােটমামা বললেন,—একটু ভুল হয়ে গেছে, বুঝলি পুঁটু?
-কী ভুল ছােটমামা?
Read More