রসিকতা করে বললুম,-পাতব শেয়াল ধরার ফঁাদ। কঁদবে শেয়াল হুক্কাহুয়া। যশমশাই ধরবে ধুয়া, ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া ?
গােরাচঁাদ থমকে দাঁড়িয়ে তেমনই চকচকে দাঁতে হাসল। ওরে বাবা। আপনি যে যশমশাইয়ের কত্তবাবা দেখছি! বাঃ। আমি এবার যশমশাইকে ছড়াটা শুনিয়ে ছাড়ব। এখনও, উনি বাড়ি পৌঁছুতে পারেননি।
বলে সে সুর ধরে আওড়াল : নামটি আমার গােরাচঁাদ পাতব শেয়াল ধরার ফাঁদ কাদবে শেয়াল হুক্কা হুয়া। যশমশাই ধরবে ধুয়া ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া৷৷
তারপর আমাকে হতবাক করে সে এই ছড়াটা সুর ধরে বলতে-বলতে রাস্তার বাঁ-দিকে গাছপালার ভেতর উধাও হয়ে গেল। সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে ডাকলুম,—গােরাচঁাদ খুড়াে! গােরাচঁাদ-খুড়ােয়
তখনও তার ছড়াটা শােনা যাচ্ছিল। কিন্তু কেমন যেন খ্যানখেনে গলার স্বর। এবার আমার মনে হল, সর্বনাশ! লােকটা ছিনতাইবাজ! চালাকি করে আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেস হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল!
সে যেদিকে গেছে, সেদিকে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলুম। একটু পরে সামনে টর্চের আলাে জ্বলে উঠল। তারপর আলােটা আমার ওপর এসে পড়ল। এবার বােধহয় ডাকাত আসছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলুম, কালাচাদ খুড়াে! কালাচঁাদ-খুড়াে!
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২০
ভারী গলায় লােকটা বলে উঠল,—মশাই কি সানুবাবুর বন্ধু? মশাই কি কলকাতা থেকে আসছেন?
এ-ও যে গােরাঠাদের ভঙ্গিতে কথা বলছে। বললুম, হ্যা। তুমি কে? | টর্চ নিভিয়ে লােকটা করজোড়ে প্রণাম করে বলল,“আজ্ঞে আমিই কালাচঁদ! বাসস্টপে আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলুম। বাস চলে গেল। আপনি নামলেন না। তারপর আমার মনে হল, বাবুমশাই তাে এ তল্লাটে নতুন আসছেন। ভূল করে ঝুমঝুমিতলায় নেমে পড়েননি তাে? তাই দেখতে আসছিলুম। হঠাৎ কানে এল কেউ গােরাচঁাদ খুড়াে বলে চঁাচাচ্ছে।
বললুম,আমিই চঁাচাচ্ছিলুম কালাচঁাদখুড়াে! গােরাচঁাদ আমাকে বলল, সে তােমার মাসতুতাে ভাই। তুমিই তাকে আমার খোঁজে পাঠিয়েছ।
কী বিপদ। তা আপনার মালপত্তর কই? —গােরাচঁাদ-খুড়াে নিয়ে পালিয়ে গেল।
কালাচঁাদ ক্রুদ্ধস্বরে বলল,“ওরে হতচ্ছাড়া! দেখাচ্ছি মজা। কথায় বলে না? স্বভাব যায় না মলে। স্বভাব বাবুমশাই!
স্বভাব যায় না মলে মানে?
—এখন ওসব কথা থাক। চলুন। সানুদের বাড়ি এখান থেকে কাছে। আমার সঙ্গে আসুন।
সে পায়ের কাছে টর্চের আলাে ফেলে হাঁটতে থাকল। বাঁ-দিকে একটা অনাবাদি মাঠের পথে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলুম। যেতে-যেতে এতক্ষণে দেখলুম, কালাচঁাদের একহাতে লাঠি আছে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২০
আবার ভয় পেলুম। লাঠির ঘায়ে আমাকে মেরে মানিব্যাগ হাতিয়ে নেবে না তাে? এ কি সত্যি সন্দীপদের বাড়ির কেয়ারটেকার কালার্টাদ? নাকি কোনও ডাকাত? নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গিয়ে লাঠি তুলবে। আমি তৈরি হয়ে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ পরে একটা পুকুরের পাড়ে উঠে সে বলল,—এই পুকুরটা সানুদের। ওই দেখুন ওদের বাড়ি।।
দোতলা বাড়িটাতে বিদ্যুতের আলাে জ্বলছে দেখে সাহস ফিরে পেলুম। বললুম,—ঘুমঘুমিতলায় ইলেকট্রিসিটি আছে দেখছি।
—আজ্ঞে হঁ্যা। বছর তিনেক হল ইলেকটিরি এসেছে।
জোরে শ্বাস ছেড়ে বললুম,—কিন্তু আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেসের কী হবে খুড়াে?
কালাচঁাদ হাসল। আজ্ঞে ও নিয়ে ভাববেন না। গােরাচঁাদ আমাকে খুব ভয় করে। বলে সে চেঁচিয়ে উঠল,—অ্যাই হতচ্ছাড়া! বাবুমশাইয়ের মালপত্তর দোতলার ঘরে রেখে তবে যে চুলােয় যাবি যা! নইলে এক্ষুনি মােনা-ওঝাকে ডেকে আনব।
সেদিনের মতাে তােকে সে তালগাছের ডগায় দাঁড়কাক করে বসিয়ে রাখবে।
গােরাচঁাদকে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না। পুকুরের পাড়ে অজস্র তালগাছ। পশ্চিমপাড় দিয়ে ঘুরে গিরিবালা ভবনের গেটে পৌঁছেছি, হঠাৎ দেখলুম একটা ছায়ামূর্তি বাড়ির পূর্বদিকে উধাও হয়ে গেল। কালাচঁাদ গেটের তালা খুলে বলল, এ গ্রামে চোর-ডাকাত নেই বাবুমশাই! গােরাঠাদেরও চুরি-ডাকাতি করা স্বভাব ছিল ।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২০
স্বভাব বলতে শুধু একটা। জোছনা-রাত্তিরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানাে। আর তালগাছের ডগায়
কথা শেষ না করে সে আমাকে দোতলায় পূর্বের একটা ঘরে নিয়ে গেল। তারপর জানালাগুলাে খুলে দিয়ে বলল,—উত্তরে পুকুর। জোছনায় পুকুরের জল’ কেমন ঝিলমিল করছে দেখুন। পুকুরে মাছ আছে। কাল জেলে ডেকে এনে মাছ ধরাব।
উঁকি মেরে দেখে ভালাে লাগল। তারপরই চোখে পড়ল আমার পাশেই টেবিলের ওপরে আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেস রাখা আছে। ঘর তাে তালাবন্ধ ছিল। ব্যাপারটা যে দেখছি একেবারে ভুতুড়ে!
|কালাচঁাদ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ফের,অ্যাই হনুমান! তালগাছের ডগায় আবার চড়েছিস?
আবার উঁকি মেরে কিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু তারপরই পুকুরের জলে ঝপাং করে কেউ ঝাপ দিল। বললুম,—কেউ যেন জলে ঝাঁপ দিল কালাচঁাদ-খুড়াে! গােরাচঁাদ নাকি?
Read More
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২১